বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে মাইকেল মধুসূদন দত্তের এক বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে । তিনি মহাকবি। তাঁর ‘মেঘনাদবধ’ই বাংলা সাহিত্যে একমাত্র সার্থক মহাকাব্য । এর উপর আবার তিনিই বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম প্রবর্তক; সনেট, নাটক ও প্রহসনেরও তিনি প্রথম রচয়িতা। এতগুলি প্রাথমিকতা বা বৈশিষ্ট্যের যে কোনো একটি থাকলেই তো সাহিত্য-ক্ষেত্রে তিনি একটা স্থায়ী আসন দাবী করতে পারতেন। মাইকেলের সবগুলিই আছে। মাইকেলের স্থান তাই বাংলা-সাহিত্যে একক ও অনন্য। কিন্তু আজ আমি সে সব কথা কিছুই বলবো না। অন্য দু-একটা কথা বলবো ।
মাইকেল ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দুঘরের ছেলে। অথচ কোন্ অজানার ডাক শুনে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই এই তরুণ যুবক স্বধর্ম, স্বজাতি ও স্বদেশ ত্যাগ করে চলে গেলেন বিদেশে। প্রথমে মাদ্রাজে, তারপর বিলেতে। একি শুধু যুগের আবেগ? অথবা অন্য কোনো বিলাস? না। কঠোর সাধনায় তাঁর এই প্রবাস-জীবন কেটেছে। ১০/১২টি ভাষা তিনি শিখেছেন। ফার্সী, বাংলা, সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, ইংরাজী, ল্যাটিন, গ্রীক— ইত্যাদি ভাষায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। নানা শাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়ে তিনি যখন দেশে ফিরলেন, তখনই তিনি বাংলা ভাষার সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। মাত্র ৩-৪ বছরের সাধনাতেই তিনি নব নব অবদানে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তুললেন। কাজেই মাইকেল যে একজন ক্ষণজন্মা প্রতিভা ছিলেন, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই ।
তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দিকপাল। যুগে যুগে এমন পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। ধর্মজগতে নবীদের যে কাজ, সাহিত্য-জগতে কবিদেরও সেই কাজ। মনে হয় তাঁরা আসেন না- প্রেরিত হন। মাইকেলকে আমার সেইরূপ একজন সংস্কারধর্মী কবি বলে মনে হয়। আপনারা জানেন বাংলা সাহিত্যে তখন বিদ্যাসাগরের যুগ। উইলিয়াম কেরী প্রমুখ খৃষ্টান পাদ্রীগণ ও কলিকাতার রামনাথ বিদ্যাবাচষ্পতি প্রমুখ পণ্ডিতগণ এক সাথে মিলে বাংলা ভাষার খাত পরিবর্তন করে ফেলেছেন। তখনই সর্বপ্রথম পণ্ডিতদের হাতে পড়ে সংস্কৃতের তুহিনস্পর্শে বাংলা ভাষা তার স্বাভাবিক প্রাণশক্তি ও সচ্ছন্দ গতি হারিয়েছে। আরবী-ফার্সী সমস্ত শব্দ বাংলা ভাষা থেকে বর্জিত হলো আর তাদের জায়গায় আমদানি করা হলো কঠিন কঠিন সংস্কৃত শব্দ । প্রকাশভঙ্গীও হলো আড়ষ্ট। পয়ারের একঘেয়ে ছন্দ (jingling monotony) প্রগতিশীল ভাবধারার অভাব এবং অন্ধ সংস্কার-প্রীতি বাংলা ভাষার প্রগতির পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ালো । বাংলা ভাষার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে পণ্ডিতেরা তাকে আবার সেই পৌরাণিক যুগে নিয়ে গেলেন। সীতার বনবাস, শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা, কাদম্বরী ইত্যাদি পৌরাণিক ধ্যান-ধারণা বাংলা ভাষাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললো। আগের সেই দেবমাহাত্ম ও অলৌকিকতার দিন যেন ফিরে এলো। মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের হাতে এসে বাংলা সাহিত্যে যে উদার মানবিকতার সুর ধ্বনিত হয়েছিল, তা যেন আবার মিলিয়ে যেতে চাইলো । বন্দিনী সীতার মতোই অবরুদ্ধ বাংলা ভাষা মুক্তির জন্য তার দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানালো ।
কেউ কোনো সাড়া দিল না। অবশেষে যশোরের এক তরুণ যুবক এগিয়ে এলেন ভাষা-জননীর এই আহ্বানে। স্বদেশ ছাড়লেন, স্বজাতি ছাড়লেন, স্বধর্ম ছাড়লেন। তিনি গেলেন ইউরোপে— সেখানে বসে দীর্ঘ সাধনার পর নানা উপাদান নিয়ে ফিরে এলেন বাংলা দেশে। তারপর এক এক করে কেটে দিলেন ভাষা-জননীর পায়ের যতো শৃঙ্খল । বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে করে দিলেন তার সংযোগ। এমনি করে আনলেন তিনি বাংলা ভাষার মুক্তি । মাইকেল তাই সর্বপ্রথম সার্থক বিপ্লবী কবি। তিনি না এলে বাংলা ভাষা কোন্ পথে কোনখাতে প্রবাহিত হতো বলা কঠিন। আমার মতে মাইকেলের সবচেয়ে বড় দান বা বড় কৃতিত্ব এইখানে। মাইকেলের পথ ধরেই তো বাংলা ভাষা আজ এতদূর অগ্রসর হতে পেরেছে। হিন্দী, মারাঠি বা অপর কোনো আঞ্চলিক ভাষা এই গৌরব লাভ করতে পারেনি।
এর একমাত্র কারণঃ মাইকেলের সংস্কারমুক্ত প্রচারধর্মী মন ও উদার মানবতাবোধ । আর্য-আবেষ্টনে শৃঙ্খলিত হতে না হতেই বাংলা ভাষা মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল এবং সে সংগ্রামের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মাইকেল
মেঘনাদবধ কাব্যের আগাগোড়া রয়েছে এই বন্ধন-মুক্তির সুর, শাশ্বত মানবতার সুর । অযোধ্যার রাম, লক্ষণ, সীতা প্রমুখ আর্য, আর লঙ্কার রাবণ, মেঘনাদ, প্রমুখ অনার্য । কিন্তু উৎকট জাতিবিদ্বেষের ফলে অনার্যেরা আর্যদের চোখে অসভ্য, রাক্ষস, বর্বর, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি ছাড়া অন্য কিছু নয়। মানবতার প্রতি এই অবমাননা মাইকেল বরদাস্ত করতে পারেন নি। তিনি তাঁর কাব্যে রাম-লক্ষণকে বরং খাটো করে রাবণ ও মেঘনাদকে বড় করে দেখিয়েছেন। এই নূতন দৃষ্টিভঙ্গি ও সৎসাহসের জন্য মাইকেল যথার্থই ধন্যবাদের পাত্র । এই দৃষ্টি, এই মূল্যবোধ সে যুগে খুবই বিরল ছিল না কি? এই গণজাগরণের দিনে মেঘনাবধ কাব্যের আবেদন তাই এখনও অব্যাহত আছে। আর্ত-নিপীড়িত মানুষ মেঘনাদবধ কাব্য থেকে যথেষ্ট প্রেরণা পাবে ।
মেঘনাদবধের আর একটা বৈশিষ্ট্য—জীবনের সংগ্রামশীল চেতনা। সমগ্র কাব্য জুড়ে এই কথাই যেন ঘোষণা করা হচ্ছে- এ জীবন সংগ্রামশীল। জীবনের অর্থই তো সংগ্রাম । ইকবাল একেই বলেছেন tension মানুষের জীবন হচ্ছে তরঙ্গের মতো; চললে আছে, না চললে নেই । এই গতির সুর মেঘনাদবধ কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ।
মাইকেলকে আমি আর এক দিক দিয়ে মূল্য দিই। বিশেষ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে : বাংলা ভাষা বিকাশের একটা বিশেষ ধারা বা পথ আছে। আর্যস্পর্শ ও পরিবেশ সে সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলে। প্রাচীন বাংলার দ্রাবিড়দের হাতে তার জন্ম, তারপর সে লালিত হয় বৌদ্ধদেব হাতে সেখান থেকে সে আশ্রয় নেয় বাংলার সুলতানদের শাহী দরবারে। ৪-৫ শ’ বছর পর বৃটিশ আমলে এলে ষড়যন্ত্রের ফলে সে সংস্কৃতের কবলে পতিত হয়, কিন্তু খৃষ্টধর্মী মাইকেল এসে তার উদ্ধার সাধন করেন। তারপর ব্রাহ্মধর্মী রবীন্দ্রনাথ তাকে অপরূপ শ্রী দান করেন। ইসলামধর্মী নজরুল তাকে নূতন মহিমা দান করেন। সর্বশেষে দেশ-বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে যেই সে পাকিস্তানে এসেছে, অমনি সে লাভ করেছে অন্যতর রাষ্ট্রভাষার পদগৌরব। আশ্চর্য লাগে, অন্যত্র তার এ সম্মানলাভ আজ পর্যন্ত ঘটেনি। এ কথার দ্বারা আমি বলতে চাই, পাকিস্তানে বাংলা ভাষার নূতন সম্ভাবনা আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মাইকেলকে যখন দেখি, তখন তাঁকে দেখি আর এক বিশিষ্ট মূর্তিতে। কবিদের জাত-বিচার নেই; গণ্ডী-সংকীর্ণতার তাঁরা ঊর্ধ্বে। তবু মাইকেল যে পাকিস্তানের মহাকবি—-এ গৌরব প্রকাশে আনন্দ পাই-ভরসা পাই-প্রেরণা পাই।
মহাকাব্যের বিচারে মেঘনাদবধ কাব্যের দোষগুণ বিচার সমালোচকেরা করবেন। মানুষের কোনো সৃষ্টিই ত্রুটিমুক্ত, নয়। মেঘনাদবধ কাব্যেরও তাই ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে । Milton-এর Paradise Lost-এরও ত্রুটি আছে। কেউ কেউ বলেন : Milton is more criticized than read”. এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও কাব্য সমালোচক T. S. Eliot বলেছেন : Miltion writes English like a dead language” তাই তিনি একটু ব্যঙ্গচ্ছলে বলেছেন : ‘কেউ যদি মিলটনের প্যারাডাইজ লষ্ট পড়তে চায় তা যেন দু’বার করে পড়ে; প্রথমবার শুধু শব্দাড়ম্বর উপভোগ করবার জন্যে, দ্বিতীয়বার তার অন্তর্নিহিত ভাববস্তুর উপলব্ধির জন্যে।’ এ ধরনের উক্তি অবশ্য বিতর্কমূলক । মাইকেল সম্বন্ধেও হয়তো অনেকে এই ধরনের কথা বলবেন। আমি সে বিতর্কের মধ্যে যাবো না। আমি তাঁর শুধু গুণই গ্রহণ করবো, কারণ, “a critic must always be on the poets side”.
আজ আমার তরুণ ভাইদেরকে ডাক দিই মাইকেলের দিকে দৃষ্টি ফিরাতে। মাইকেলের আদর্শকে যথাসম্ভব আমাদের গ্রহণ করতে হবে। তাঁর মতো সবাইকে ধর্মান্তর গ্রহণ করতে হবে- সে কথা বলছি না। তাঁর মধ্যে অন্যান্য যে সব মহৎ গুণ ছিল, তার থেকে নিশ্চয়ই আমরা আলো নিতে পারি। তাঁর মতো ছাত্র কই? তার মতো মুক্তমনা তরুণ কই? সেই অটল দৃঢ় বিশ্বাস, সেই নির্ভীক মনোবল, সেই সত্যানুসন্ধিৎসা, সেই সাধনা কই? কোথায় আমাদের মধ্যে সেই নবসৃষ্টির কৌতুহল সেই উদ্যম? সেই দুঃসাহস? শুধু নয়, আমাদের জীবন-ধারা আজ পয়ারের শ্লথ গতিতে একটানা ভাবে ভাষা বয়ে চলেছে। কোন্ তরুণ আজ এই একঘেয়েমি ভেঙে দিয়ে আনবে আমাদের জীবনে মুক্তচ্ছন্দের উচ্ছল গতিবেগ? সেই তরুণ এসো, মাইকেলকে আজ শ্রদ্ধা জানাও।
পরিশেষে আমি দুটো প্রস্তাব করতে চাই। প্রথমটা হচ্ছে যে, “মাইকেল পুরস্কার” নাম দিয়ে বাংলা একাডেমী থেকে একটা বাৎসরিক সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা করা হোক। দ্বিতীয়টা হচ্ছে : মাইকেলের সমস্ত গ্রন্থাবলী বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশ করা হোক ৷