সুদূর অতীতে মানব যেদিন বিচিত্র-সুন্দর এই বিরাট বিশ্বের বুকে দাঁড়াইয়া অসীম রহস্যভরা প্রকৃতির পানে বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে প্রথম দৃষ্টিপাত করিয়াছিল, সেই দিনই কবিতার জন্ম।
প্রকৃতিই কবিত্বের উৎস। সে-ই মানুষকে কবি করিয়া তুলিয়াছে । যখন ভাষার সৃষ্টি হয় নাই, মানুষ যখন সবেমাত্র এই অদৃষ্টপূর্ব নবীন বিশ্বের নবীন অধিবাসী, তখনই প্রকৃতি- সুন্দরী আপনার সৌন্দর্য-লীলা তাহার নয়ন-সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়া তাহাকে পাগল করিয়া তুলিয়াছে। প্রভাতের অরুণ-কিরণ, বিচিত্র বিহংগরাজির বিচিত্র কূজন, সদ্যপ্রস্ফুটিত্য কুসুম-বালিকার সুরভিমাখা হাসির বিচ্ছুরণ, শ্যামসুন্দর তরুলতিকার মন্দমন্দ অংগ-শিহরণ, ঘোর ঘনঘটাচ্ছন্ন গগন মণ্ডলে বিদ্যুৎ-স্ফূরণ ও বজ্র-আস্ফালন, সন্ধ্যাকাশে রক্ত- নদীর পরপারে অস্তোন্মুখ সূর্যের বিদায়-জ্ঞাপন-ইত্যাদি যাহা কিছু সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক, সকলই তাহার হৃদয়ক্ষেত্রে শত-প্রকারের অনুভূতি ও ভাবের প্রবাহ ছুটাইয়া দিয়াছে । বিস্ময়-বিহ্বল মানুষ সেই ভাবগুচ্ছকে হৃদয়ের মাঝে রুদ্ধ করিয়া রাখিতে পারে নাই; তাই সে ভাষা দিয়া তার অন্তরের অনুভূতিকে প্রকাশ করিয়া দিয়াছে। ভাষার সেই সৌন্দর্যমণ্ডিত ভাবের অবিভ্যক্তিই কবিতা ।
সুতরাং দেখা যাইতেছে, প্রকৃতির সহিত কবিতার তথা কবিরও অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ । প্রকৃতি যদি সৌন্দর্য দিয়া মানব-মনকে পাগল করিয়া না তুলিত, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী (Phenomena of Nature) যদি মানব-প্রাণে বিস্ময় ও আনন্দের উদ্রেক না করিত, তবে মানুষের ভিতর কবিত্বের বিকাশ হইত কি না, সন্দেহ। সৌন্দর্য-বোধই কবিতার জননী ।
এই সৌন্দর্য-চেতনা কাহার না আছে? অল্প-বিস্তর সকলেরই আছে। সুতরাং বলা যায় মানব-মাত্রই কবি, কেহ বা নীরব, কেহ বা সরব। প্রাচীন ভারতের সাহিত্যে অথবা হেলেনিক (Helelnic) সাহিত্যে দেখিতে পাই : চন্দ্র-সূর্য ঝটিকা-বিদ্যুৎ ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দৃশ্যসমূহের ব্যাখ্যা করিতে যাইয়া তৎকালীন কবি-দার্শনিকেরা অনেক রূপ-কাহিনী (Mythology) সৃষ্টি করিয়াছেন। প্রকৃতিকে অতি-প্রাকৃতিক (supernatural) দ্বারা ব্যাখ্যা করিয়াছেন। দেবতাজ্ঞানে চন্দ্র-সূর্য আলো-বাতাসকে উদ্দেশ করিয়া বহু স্তোত্র (hymns) রচনা করিয়াছেন, ইন্দ্র-বরুণ, প্লুটো নেপচুন, লক্ষ্মী- সরস্বতী, প্যাণ্ডোরা ভেনাস্-ইত্যাদি ধরনের বহু দেবদেবীর কল্পনা করিয়াছেন। এই রূপেই মূর্তিপূজা প্রচলিত হইয়াছে। এ ছিল প্যাগান যুগের কথা। প্রাকৃতিক দৃশ্যে দেবত্ব আরোপই ছিল এ যুগের বৈশিষ্ট্য। এই সব কল্পকাহিনী ও অন্ধবিশ্বাস জ্ঞানের দিক দিয়া মানব-জাতিকে প্রগতির পথে চালনা করে নাই সত্য, কিন্তু কল্পনা-বিলাসে ও কাব্য- সৃষ্টিতে যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছে। বহু রোমন্টিক কাব্য ও কাহিনী এই যুগেই রচিত হইয়াছে ।
কবিতার উপর প্রকৃতির প্রভাব তাই স্মরণাতীত কাল হইতেই চলিয়া আসিতেছে। তাদের অমল-ধবল দীপ্তির মধ্যে কবি রূপসী নারীর মুখচ্ছবি দেখিতে পাইয়াছেন, মনহরিণীর চঞ্চল আঁখিকোণে তিনি তাহার নয়ন-ভংগিমা লক্ষ্য করিয়াছেন; ফণিনীর অংগ-সৌষ্ঠবে তিনি তাহার কুঞ্চিত বেণীর শোভা দেখিয়াছেন; চাঁদে-চকোরে বৃক্ষলতিকায়, সাগর-তটিনীতে তিনি প্রেম ও মিলনের মহিমা লক্ষ্য করিয়াছেন। বস্তুতঃ প্রকৃতির ক্ষুদ্র-বৃহৎ কোন বস্তুই কবির চোখ এড়াইয়া যাইতে পারে নাই। আকাশে-ভুবনে আলোকে-আঁধারে সর্বত্র সে সৌন্দর্য খুঁজিয়া ফিরিতেছে।
কবির সঙ্গে প্রকৃতির যেন তাই আছে এক নিগূঢ় মিতালি । প্রকৃতি যখন প্রফুল্ল কবিও তখন উৎফুল্ল; প্রকৃতি যখন বিষাদে মলিন, কবিও তখন আনন্দহীন । প্রকৃতির সঙ্গে কবির হৃদয়বীণা যেন একতারে এক সুরে বাঁধা। কবির চোখে প্রকৃতি তাই জড়মূর্তি নহে—জীবন্ত, মানুষের মতই তার সুখদুঃখ হাসিকান্না-সব কিছুই আছে । কালিদাস, ওয়ার্ডস-ওয়ার্থ, শেলী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম প্রত্যেকেই তাই প্রকৃতির পটভূমিতে দাঁড়াইয়া কাব্য-রচনা করিয়াছেন ।
কিন্তু কবিও প্রকৃতির এই চিরন্তন সম্বন্ধ পূর্বাপেক্ষা অনেক পরিমাণে শিথিল হইয়া পড়িয়াছে। তাহার কারণ বৈজ্ঞানিকের আবির্ভাবও নানাবিধ বৈজ্ঞানিক সত্যের আবিষ্কার। বৈজ্ঞানিক আসিয়া কবির কল্পনা-পথ রুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে; তার সমস্ত স্বপ্নসৌধ সে ভাঙিয়া দিতেছে । কবি এতদিন অবাধে আকাশ-ভুবনের সর্বত্র বিহার করিয়া ফিরিত, কিন্তু বৈজ্ঞানিক আসিয়া তাহার যে সাধে বাদ সাধিয়াছে। প্রেয়সীর নয়ন-কৌণে বিরহের অশ্রুবিন্দু দেখিয়া কবি মুক্তাবিন্দু জ্ঞানে যে গুলিকে প্রেম-সূত্রে গ্রথিত করিয়া প্রিয়ার কন্ঠে পরাইয়া দিতে যাইতেছিল, অমনি বৈজ্ঞানিক আসিয়া সেই অশ্রুমালাকে বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইয়া দিল, উহা মুক্তা নহে-উহা দুইভাগ হাইড্রোজেন ও একভাগ অক্সিজেন মাত্র । কবি পূর্বে বাগানে ফুলের মধ্যে ফুলরাণীকে খুঁজিয়া ফিরিতেছিল, অমনি বৈজ্ঞানিক আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইল এবং শানিত অস্ত্র দ্বারা ফুলের পাপড়িগুলিকে কাটিয়া উদ্ভিদতত্ত্বের গবেষণা শুরু করিল। নিশীথের অন্ধকারে পূর্ণচাঁদ ও তারকা মণ্ডলীকে দেখিয়া কবি নন্দন-কাননের শোভা দেখিতেছিল, বৈজ্ঞানিক আসিয়া অমনি সেই চাঁদে গভীর খাত ও কঠিন পাহাড় আবিষ্কার করিল আর তারাগুলোকে এক একটা গ্রহ-উপগ্রহ বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়া কবিকে একদম বেকুফ বানাইয়া ছাড়িল । এই রূপে যেদিকেই দৃষ্টিপাত করি না কেন, বৈজ্ঞানিকের ভয়ে কবি সর্বত্র আড়ষ্ট, শিহরিত ও সংকুচিত। বস্তুতঃ কোন স্থানেই বৈজ্ঞানিকের যাইতে বাকী নাই; সবখান হইতে সে কবি ও কল্পনাকে গলাধাক্কা দিয়া বাহির করিয়া দিতেছে। নিদাঘ-দিবসে ( Mid Summer Day) কুঞ্জবাটিকায় এখন আর পরীর মেলা বসে না; আকাশ-বীণার তারে তারে এখন আর সংগীত-ধ্বনি শোনা যায় না । বৈজ্ঞানিক কলকারখানার বিকট গর্জনে আজ কোকিল-পাপিয়া দেশ ছাড়িয়াছে, আলোর নাচন স্তব্ধ হইয়াছে, সব সুর, সব ইংগিত থামিয়া গিয়াছে। বস্তুতঃ প্রকৃতির বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিকেরা দস্তুরমত অভিযান চালাইয়াছে । প্রকৃতি তাই তার গোপন সম্পদ লইয়া যেন আরও দূরে সরিয়া যাইতেছে। রহস্যের দুয়ার সে যেন এখন বন্ধ করিয়া দিতেছে ।
কিন্তু প্রকৃতিও সহজ পাত্রী নহে। বৈজ্ঞানিকের উপর সেও হাড়ে হাড়ে চটিয়া গিয়াছে । সময়ে সময়ে সেও প্লাবন ভূমিকম্প ঝটিকা ঘূর্ণিবাৰ্তা ইত্যাদি মারণযন্ত্র দ্বারা বৈজ্ঞানিকের সকল প্রয়াসকে ব্যর্থ করিয়া দিতেছে। কোন কঠিন ধাতব অস্ত্র বা বিস্ফোরক পদার্থ দ্বারা নয়-বরফস্তূপ দ্বারা সে সমুদ্র-জয়ী ‘টাইটানিক; জাহাজকেও ধ্বংস করিয়া দিয়াছে কবিদের প্রতি সে এখনও সদয় আছে। তাই আমরা দেখিতে পাই—যুগে যুগে এক একজন খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিকের আবির্ভাব হইবার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও এক একজন খ্যাতনামা কবিকে পাঠাইয়া দিয়াছে। টমসনের পাশে পোপ, নিউটনের পাশে মিলটন, জগদীশচন্দ্রের পাশে রবীন্দ্রনাথ এ-কথার সাক্ষ্য দিবে। এমনও ঘটিতেছে যে, কোন কোন বৈজ্ঞানিকের মধ্যেই কবির জন্ম হইতেছে। ওমর খৈয়াম তাহার সুন্দর দৃষ্টান্ত । প্রকৃতির কী অপরূপ প্রতিশোধ ।
অধুনা বিজ্ঞানের যুগ আসিয়াছে। কাব্যের তাই আর তত আদর নাই । কবির কল্পনা এখন বিদ্রূপে পরিণত হইয়াছে। কিন্তু তবুও হতাশ হইবার কিছু নাই। বিজ্ঞানের প্রতিপত্তি যতই বৃদ্ধি পাউক না কেন, জড়শক্তি যতই প্রবল হউক না কেন, কবিকে একেবারে নির্বাসিত করা কিছুতেই সম্ভব হইবে না। মানুষ শুধু কর্ম লইয়া বাঁচিতে পারে না। কর্ম ও চাই, কল্পনাও চাই, কাজও চাই, কথাও চাই। শুধু কথা দ্বারা কাজ হয় না বটে, কিন্তু কথা ছাড়াও ত কাজ হয় না। এ সম্বন্ধে জনৈক কবি বলিতেছেন :
“Words are deeds, the words we hear
May revolutionise or rear
A mighty State. The words we read
May be a spiritual deed
Excelling any fleshly one
As much as the celestial sun\
Transcends a bonfire, made to throw
A light upon some rare show;
A simple proverb tagged with rhyme
May colour half the course of time.
The pregnant saying of a sage
May influence every coming age.
A song in its effect may be
More glorious than Thermopylae.
: কথাই কার্য। কথার দ্বারাই জগতে বড় বড় কার্য সাধিত হইতেছে। কথার দ্বারা এক একটা যুগের স্রোত ফিরিয়া যাইতেছে। একটা গান থার্মোপালির যুদ্ধজয়ের চেয়েও মূল্যবান । বাস্তবিকই কথার মূল্য আছে। কথার দ্বারাই কত ঘুমন্ত জাতি জাগিয়া উঠিতেছে, আবার কথার অভাবে কত জাগ্রত জাতি ঘুমাইয়া পড়িতেছে। দ্বিতীয় মেসেনিয়ার যুদ্ধে (Second Messenian War in Greece) স্পার্টাবাসীরা দৈববাণী ( oracle ) অনুসারে এথেন্সের নিকট একজন নেতার জন্য আবেদন করে। কিন্তু এথেন্সবাসীরা স্পার্টানদিগকে সাহায্য করিতে আন্তরিকভাবে ইচ্ছুক ছিল না; অথচ দৈববাণীর অসম্মান ও করা যায় না। তাই উভয় কূল বজায় রাখিতে গিয়া তাহারা টার্টিয়াস (Tyrtaeus) নামক একজন খোঁড়া লোককে স্পার্টান সৈন্যের অধিনায়করূপে প্রেরণ করে। টার্টিয়াস ছিলেন একজন কবি। স্পার্টাবাসীরা তাঁহাকেই নেতারূপে বরণ করিয়া লইয়া মেসেনিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করে । প্রথমতঃ মেসেনিয়ানরা জয়লাভ করিল। তদ্দৃষ্টে স্পার্টান সৈন্য ভীত ও হতাশ হইয়া পড়িল। কিন্তু এই সময়ে টার্টিয়াসের অনলবর্ষী সমর-সংগীতে স্পার্টানদের প্রাণে নববলের সঞ্চার হইল । নূতন উদ্যমে তাহারা আবার যুদ্ধদান করিল এইবার মেসেনিয়ান সৈন্য সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইল ।
আরব ইতিহাসেও এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই ।
বস্তুতঃ কবি না থাকিলে এই পৃথিবী কঠিন বাস্তবে পরিণত হইত। মাটির পৃথিবীকে অতিক্রম করিয়া আমাদের চিন্তা আর অনন্তের পথে উধাও হইতে পারিত না। নিরাকার আল্লার ধ্যান করাও তখন আর সম্ভব হইত না। সৃষ্টির অন্তরে কী গোপন রহস্য আছে, কোথাও কী ইংগিত আছে, কিছুই আমরা জানিতে পারিতাম না ।
কবি কল্পনা লইয়া থাকে, ইহাই তাহার অপরাধ । কিন্তু একটু ধীরভাবে চিন্তা করিলে দেখিতে পাওয়া যাইবে, কল্পনা না হইলে বৈজ্ঞানিকের বিজ্ঞান-সাধনাও অচল হইয়া যায় । বৈজ্ঞানিক প্রথমতঃ কল্পনা বলে একটা থিওরী খাড়া করেন, পরে তাহাকে অবলম্বন করিয়া গবেষণা করিতে থাকেন। গবেষণা দ্বারা কল্পিত থিওরীটি সত্য প্রমাণিত হইলে তখনই তাহা বৈজ্ঞানিক তথ্যে পরিণত হয়। বস্তুতঃ বৈজ্ঞানিকের জন্যও কল্পনার প্রয়োজন আছে ।
অতএব দেখা যাইতেছে কবি সহজ পাত্র নন। কবির আদর চিরকাল ছিল, আছে এবং থাকিবে। সেই কবির মহিমা গাহিয়া এই প্রবন্ধের পরিসমাপ্তি করিলাম।