দুই : মৃত্যুর প্রতিশ্রুতি
বিকেলের বাকি সময়টা বুড্ডা সবজি ক্ষেতে কাজ ক’রে কাটাল। গুরুজী রান্না করলেন। মাগরিবের নামাজের পর বুড্ডা গুরুজীর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর পাশে বসল। গুরুজীর কাছে সে জানতে চাইল —‘গুরুজী, আপনি তো এখানে একা থাকেন । তাহলে এত সবজি ফলান কেন? আপনার তো সব লাগে না।’
গুরুজী পাল্টা প্রশ্ন করলেন, – ‘মানুষের যা দরকার সে তার চেয়ে বেশি উপার্জন করে কেন?’
বুড্ডা বলল—‘কারণ, মানুষ ভীরু। মানে কাপুরুষ। সে মনে করে যে বেশি বেশি উপার্জন ক’রে কম ভোগ না করলে সে সঞ্চয় করতে পারবে না। আর সঞ্চয় না করতে পারলে ভবিষ্যতের ওপর তার কোনো আস্থা আসে না।’
‘ঠিক বলেছ। মানুষ আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে জানে না। আল্লাহ্ মানুষকে কতভাবে তাওয়াক্কুল বা আল্লাহ্-নির্ভরতা শিখিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন যে অনেক পশু আছে যারা ভবিষ্যতের খাওয়ার কথা চিন্তা করে না, সুতরাং তোমরাও আমার উপর ভরসা রাখ। অথচ মানুষ বড় অহংকারী। সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে । তাই সঞ্চয় করতে চায়। সঞ্চয়ী স্বভাব হলো নারীসুলভ আচরণ।’
‘কিন্তু আপনার কথাটা বুঝলাম না। আমি তো ভাবতাম –এবং এখনও ভাবি—যে, মানুষ সঞ্চয় করে তখন যখন সে নিজেকে ছোট মনে করে, যখন সে ভাবে যে সে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে তাকে আরো সঞ্চয় করতে হবে। অথচ আপনি বলছেন যে সঞ্চয় করে তারা যারা নিজেদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। কথাটা বুঝলাম না।’
‘কথাটা আমার নয়। স্বয়ং তোমার আমার তথা সবকিছুর স্রষ্টা আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের। তিনি বলেছেন :
যে কৃপণতা করছে ও নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করছে…..অচিরেই আমি তার জন্য কঠোর পরিণামের পথ সহজ ক’রে দেব। এবং তার সম্পদ তার কোনো কাজে আসবে না, যখন তার অধঃপতন ঘটবে। (সূরা লাইল, ৮-১১)
সচরাচর মানুষ মনে করে যে, যে-ব্যক্তি নিজেকে খুব ছোট মনে করে, নিজের সম্পদকে পর্যাপ্ত মনে করে না, সে-ই সঞ্চয় করে। কিন্তু আল্লাহ্ বলছেন যে আসল সত্যটা তা নয়। আসল সত্য হলো, সম্পদ সে-ই সঞ্চয় করে এবং কৃপণতা সে-ই করে যে অহংকারী, যে ভাবে যে সম্পদ খরচ না ক’রে তা জমা ক’রে রাখলে সেই সম্পদই তাকে বাঁচাবে এবং সুখ দেবে, যার ফলে সে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে, তাকে আর কারো ওপর নির্ভরশীল থাকা লাগবে না। কৃপণ ব্যক্তির মনের গভীর ধারণাটা সম্বন্ধে সে নিজেও সচেতন নয়, অথচ আল্লাহ্ তাকে তা জানিয়ে দিচ্ছেন । পৃথিবীর অধিকাংশ অর্থনীতিবিদও বলেন যে, কৃপণতা করলে এবং সম্পদ সঞ্চয় করলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যায়। তারা আল্লাহ্ ওপর নির্ভর করতে চান না, নির্ভর করতে চান নিজের যোগ্যতার ওপর। এই আয়াতটাই একথা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, কোরআন কোনো মানুষের রচনা নয়। এত সংক্ষেপে কৃপণ সঞ্চয়ীর মনোভাবের গোপন দিকটাকে তুলে ধরার যোগ্যতা আজও পর্যন্ত কোনো মানুষের হয়নি, অথচ পৃথিবীর আধুনিক বিপ্লবগুলো হয়েছে সঞ্চিত সম্পদের শক্তির দ্বারাই।’
‘কিন্তু গুরুজী, আপনি তো বললেন না আপনি কেন এত বেশি সবজি ফলান ।’
‘যার যা দরকার তাকে তার চেয়ে বেশি দেয়ার জন্য।’
‘কিন্তু তাহলে তো মানুষ সঞ্চয়ী হয়ে উঠবে।’
‘সুন্দর বলেছ।’
‘কিন্তু বেশি পেয়ে মুসলমানদের মধ্যে অনেকেও তো ইহুদিদের মতো আচরণ ক’রে ফেলতে পারে।’
গুরুজী না হেসে পারলেন না। বললেন, ‘মন্দ বলনি। কিন্তু বেশি দেয়াই নিয়ম । তা না হলে সঞ্চয়ের বোঝাটা আমার ঘাড়েই চাপবে।’
খানিক পর গুরুজী গণিতের অধ্যাপকের মতো ভ্রুর মধ্য দিয়ে উকি মারার মতো ভঙ্গিতে বুড্ডার দিকে তাকালেন। বুড্ডা জড়সড় হয়ে বসল। গুরুজী বললেন, ‘তুমি কী চাও?’
‘মুক্তি, ‘তাৎক্ষণাৎ জবাব দিল সে।’
‘আর তাই ঘর থেকে বের হয়ে এলে?’
‘আমার কোনো ঘরের দরকার নেই—একথা যখন জানব, তখন ঘরে ফিরে যাব, ইনশাল্লাহ।’
‘গত কতদিন যাবৎ কোনো সংসারে বাস করনি?’
‘তিন মাস আগে এক সাধক-বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। সে আমাকে ওখানেই থাকতে বলেছিল। কিন্তু তার ঘরের ভেতরটা ভালো হলেও বাইরের অবস্থাটা আমার পছন্দ হয়নি।’
‘যেমন?’
‘বাড়িটার ছাদে উঠলে চাঁদ দেখা যেত না।’
‘আর?’
‘রাতে বৃষ্টি হতো। ফলে ঘুম আসত।’
‘এখন বৃষ্টি হলে কী কর?’
‘ভিজি।’
‘নাকি ভিজতে বাধ্য হও?’
‘ভিজতে বাধ্য হলে সহজে ঘুমানো যায় না। ওটাই ভালো, ঘুমকে মৃত্যুর মতো মনে হয়।’
‘হ্যা, আল্লাহ্ কোরআনে বলেছেন যে ঘুমটা মৃত্যুরই মতো, তবুও কেউ ঘুমাতে ভয় পায় না, যদিও সবাই মরতে ভয় পায়। আর এভাবে তারা জীবনের উদ্দেশ্য এবং মৃত্যুকেও ভুলে যায়। কেবল তোমার মতো পাগলরাই ঘুমাতে ভয় পায়। আর কী সমস্যা ছিল?’
‘স্বপ্ন।’
‘স্বপ্ন?’
‘জ্বী, স্বপ্ন। ও বাড়িতে সবাই বেশি বেশি স্বপ্ন দেখে ।’’
‘তাতে তোমার কী?’
‘ও বাড়িতে একটা শিশু আছে—চার বছরের শিশু—সে প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেকে চিৎকার দিয়ে জেগে উঠত। বলত —–আমার বুড্ডা চাচাকে মের না, ছেড়ে দাও । সে প্রত্যেক দিন আমাকে স্বপ্নে দেখত। সে দেখত যে পৃথিবীর সবাই তাকে ঘৃণা করে আর শুধু আমি তাকে ভালোবাসি। এর ফলে মা-বাবার ওপর তার ভালোবাসা ক’মে যেতে লাগল। সে দেখত যে তার মা-বাবা আমাকে প্রতিদিন লাঠি দিয়ে মারছে।’
‘আমি তোমাকে যে সব-আদেশ করব তা পালনের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকবে তো?’
‘জীবনটা তো আমার না গুরুজী, ওটা তো আল্লাহর। তিনি যখন খুশী তা নিয়ে নেবেন, তাতে আর আমার বলার কী থাকতে পারে?’
‘তোমার জীবন আর বেশিদিন নেই।’
‘জ্বী। বড়জোর বিশ-ত্রিশ বছর। কিংবা এক মিনিট ।’’
‘তার আগেই মরা চাই।’
‘আপনি একজন সফল হত্যাকারী।’
‘এবং তার পর মুক্তি।’
‘আহ!’
‘যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, হতাশা, অস্থিরতা, অনাস্থার অবসান। পরম শান্তি । ‘
‘তারপর আবার নবজন্ম।’
‘তাহলে আগামীকাল সকালে উত্তর-পশ্চিম দিক বরাবর যাত্রা করবে। প্রায় দশ ঘন্টার পথ পার হয়ে দেখবে একটা পাহাড়, পাশে বড় একটা মালভূমি। ঐ পাহাড়ের ওপর আমার এক বন্ধু এবং শিষ্য থাকে। সে মরণবিদ্যায় অভিজ্ঞ। ওর কাছে গিয়ে বলবে যে মৃত্যু তোমাকে তাড়াচ্ছে।’