তৃতীয় অঙ্কন
বালীগঞ্জ প্লেস, কলকাতা-৭০০০১৯
৮/১১/৮৭
অপরিচিতেষু,
আপনার চিঠির জন্যে অশেষ ধন্যবাদ । এতো তাড়াতাড়ি উত্তর দেওয়াতে আপনি যে অত্যন্ত ভদ্রলোক তাই প্রমাণিত হয় । বই দুটি আপনার কাছে যতদিন খুশি রাখবেন । পড়া হলেই তারপরই জানাবেন । তখনই লোক পাঠাবো । হারিয়ে যে যায়নি ওই ঢের । সৎসঙ্গে না হয় কিছুদিন থাকলোই। দিনের আলোয় দেখা হলে আমি কিন্তু আপনাকে চিনতেই পারবো না। হয়তো অন্ধকারেও নয়। আপনিও আমাকে চিনতে পারবেন না!
সত্যি কথা বলতে কী স্পটলাইটের এক ঝলক আলোয় একবার দেখা আমার মুখকে মনে করে রাখা আপনার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয় । আমার পক্ষেও আপনার মুখ মনে রাখা সম্ভব নয় । ইমরান খান বা মারাদোনার মুখ হলেও হয়তো মনে থাকতো না । তার ওপরে আপনার মাথায় আবার ছিলো লাল ধুলোয় ভরা বাঁদুরে টুপি । আমার কিন্তু ধারণা ছিল বাঁদুরে টুপি পরেন শুধুমাত্র কেদার-বদ্রী যাত্রী, হাতে লাঠি রিটায়ার্ড কুদুলে বুড়োরাই ! আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে শীতের সকালে প্রাতঃভ্রমণ করতে যাওয়া কলকাতার মাড়োয়ারীরাই। তাই খুবই অবাক হয়েছিলাম অল্পবয়সী বনপালকের মাথায় অমন টুপি দেখে ।
সেদিন আপনার জীপ যদি অকুস্থলে না পৌঁছাতো সেসময়ে তাহলে হাতিরা বোধহয় কাকার অ্যাম্বাসাডার গাড়ি নিয়ে ফুটবলই খেলতো । আমাদের যে কী হতো তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন । এখনও ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। একেই বোধহয় বলে “মিরাক্যলাস্ এসকেপ।”
ঐ হাতির দলের মধ্যে আপনি নেমে এসে গাড়ি থেকে আমাদের এক এক করে অসীম দুঃসাহসে যখন উদ্ধার করে নিজের জীপে ওঠাচ্ছিলেন, তখন কাকিমা ফিসফিস করে বলছিলো— দ্যাখ দ্যাখ্ অরণ্যদেব । সত্যি ! হাতিরা কি আপনার পোষা ? তাই অরণ্যদেবের গল্প কলকাতায় এসেও প্রত্যেককেই আমার নতুন করে দফায় দফায় বলতে হচ্ছে । কাকার অ্যাম্বাসাডার গাড়ি এবং ড্রাইভারকে পরদিন আমরা বেলাতে রেখেই স্থানীয় এক সহৃদয় ভদ্রলোক শ্রীমোহন বিশ্বাসের গাড়িতে করে হাটিয়াতে এসে পৌঁছোই। জানিনা, সেই অ্যান্টিকুয়েটেড গাড়ি ও সুপার-অ্যানুয়েটেড ড্রাইভার আজ পর্যন্ত হোটিয়াতে গিয়ে পৌঁছেছে কিনা !
হেভী এঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের গাড়ির অবস্থা দেখেই আমার পাবলিক সেকটর আন্ডারটেকিং-এর ওপর ঘেন্না ধরে গেছে, তা কাকা আমার সেখানকার যত বড় অফিসারই হোন না কেন !
আশা করি, কাকার কার্ডটি আপনি রেখে দিয়েছেন এবং রাঁচী কখনও গেলে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবেন ওঁর সঙ্গে । ওঁদের ওখানে অবশ্যই যাবেন কিন্তু । নইলে আমাদের ঋণ শোধ করা তো দূরের কথা, স্বীকার পর্যন্ত করার সুযোগ পাবো না আমরা । আর কলকাতায় এলে আমার ঠিকানাতে যোগাযোগ করলেও খুবই খুশি হবো । জানিনা আদৌ কলকাতায় আসেন কিনা !
সে রাতে আপনার নামটিই শুধু বলেছিলেন । জীপের রঙ দেখে অনেক জল্পনা-কল্পনা করে ঠিক করেছিলাম আমরা যে, আপনি বনবিভাগেরই অফিসারই হবেন নিশ্চয়ই । কিন্তু আপনার ডেসিগনেশান, ঠিকানা, কিছুই তো জানার উপায় ছিলো না ঐ স্বল্প সময়ে । আপনি যে জানাবার জন্যে ব্যগ্র ছিলেন না তাও বুঝেছিলাম। শীতের রাতে, উষ্ণ ঘরে, স্ত্রী গরম খাবার নিয়ে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছিলেন । তাড়া দেখেই বুঝেছিলাম আমরা। নেহাৎ আন্দাজেই চিঠিটি দিয়েছিলাম । পেয়েছেন জেনে সত্যিই চমৎকৃত হলাম । পুরুষরা বেশি কথা বললে খারাপ লাগে। আমার তো লাগেই। কিন্তু আপনার মতো প্রায় মৌনী পুরুষমানুষ নিয়ে বোধহয় বিপদও কম নয়। এই যেমন আপনার ঠিকানা না-জানাতে বিপদ আমাদের হয়েছিলো । চিঠি পৌঁছবে কিনা এই ভেবে টেনশন একদিন কম হয়নিও । ভালো থাকবেন । আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে ।
ঋতি রায়
ঋতি রায়
বালীগঞ্জ প্লেস, কলকাতা-৭০০০১৯