ষষ্ঠ অঙ্কন :
বেতলা
২২-১১-৮৭
ঋতি রায়,
কলকাতা
সুজনেষু
ভারী দুঃখিত । এবারে উত্তর দিতে খুব দেরী হয়ে গেলো । উত্তরবঙ্গে গেছিলাম । সেখানে হাতির ওপর একটি সিম্পোজিয়ামে যোগ দিতে । নানা দেশ থেকে হস্তীবিশারদরা সব এসেছিলেন । আমাদের পূর্বাঞ্চলের বিখ্যাত বিশারদ গৌরীপুরের লালজী, প্রমথেশ বড়ুয়ার ছোট ভাই প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়াও এসেছিলেন । বুদ্ধদেব গুহ ওঁর কথা কিছুদিন আগে “সানন্দাতে” লিখেছিলেন। অবশ্য আপনি “মেয়েদের” কাগজ পড়েন কিনা জানি না ।
অনেক মেয়েরাই আজকাল নিজেদের “মেয়ে” বলে স্বীকার করতে নারাজ। এবং যা-কিছুই শুধুই মেয়েদের বলে চিহ্নিত বা মেয়েলি বলে পরিচিত, তা পোশাকই হোক কী মানসিকতা তার সব কিছুই সমারোহ সহকারে বর্জনীয় এমনই একটা ধারণা অনেক মেয়েরই মনে গড়ে উঠেছে দেখতে পাচ্ছি বলেই এ কথা বললাম । এই মানসিকতা ভালো কী মন্দ সে সম্বন্ধে আমার কোনো বক্তব্য নেই । হয়তো প্রয়োজনও নেই । কারণ, মানুষ জাতিরই বিশেষ বিশেষ বিভাগ নিজেদের নিয়ে কী করতে চান বা না চান সেটা সেই বিভাগীয়দেরই বিবেচ্য। এবং সেই বিবেচনার পূর্ণতম স্বাধীনতা তাঁদের থাকা উচিত এই মতেও আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি।
আপনার বাবার আর্থরাইটিস আছে এবং তা নিয়ে উনি খুব ভুগছেন শুনলাম আপনার কাকার কাছে । গত সপ্তাহে রাঁচী গিয়ে ফোনে যোগাযোগ করতেই আপনার কাকা তেজেশ নিজে এসে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেলেন ওঁর বাংলোতে । আপনি লিখেছিলেন কাকা “বড় অফিসার” । কিন্তু এত বড় যে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না । আপনার কাকীমা শ্রুতির সঙ্গেও আলাপ হলো । সত্যিই চমৎকার । বিদুষী, সরল, আন্তরিক এবং যথার্থ সুন্দরী মহিলা ।
মেয়েদের আমার ভালো লাগে । সুন্দরী হলে তো আরও ভালো লাগে । এর মধ্যে মনের সৌন্দর্যও পড়ে । সৌন্দর্যর সঙ্গে মেয়েদের কোথাও যেন এক অদৃশ্য অচ্ছেদ্য যোগাযোগ আছে । অন্তত থাকা উচিত, জন্মলগ্ন থেকেই । শুধু মেয়েরাই নন, প্রজাপতি, নদী, ফুল এই সব কিছু সুন্দর সৃষ্টির মধ্যেই আমি সৃষ্টিকর্তার এক বিশেষ সযতন সচেতন পক্ষপাতিত্ব প্রত্যক্ষ করি। পুরুষ মানুষ গড়ার সময় বিধাতা যেমন দায়সারাভাবে কাজটি সেরেছেন মেয়েদের বেলায় তা মোটেই করেননি। ‘রবীন্দ্রনাথের একটি ছোট গল্প আছে না ? যার নাম “ঘোড়া” । ব্রহ্মার সৃষ্টির কাজ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন সৃষ্টির মালমশলা রাখার কিছু পাত্রে শুধু তলানিই পড়ে ছিলো, কিছু পাত্রে উদ্বৃত্ত । কিছু পাত্র বা তখন নিঃশেষিত। ঠিক সেই সময়েই তিনি “ঘোড়া” সৃষ্টি করলেন যা ছিলো তা দিয়েই । ব্রহ্মা, মুখ্যত “মরুৎ” আর “ব্যোম্”-এর উপর নির্ভর করেই সৃষ্টি করেছিলেন ঘোড়াকে । ক্ষিতি, অপ্ ইত্যাদি উপাদানে ঘাটতি ছিলো । এবং ঘোড়া তাই বিনা কারণে মুখ ওপরে তুলে প্রচণ্ড বেগে হাওয়ার মতো নবীন সবুজ তরুণ বিশ্বময় কেশর-উড়িয়ে দাপাদাপি করে বেড়াতে লাগলো । তার দৌড়ের কোনো গন্তব্য রইলো না, দৌড়বার আনন্দের জন্যেই দৌড়তে লাগলো সে । পরে অবশ্য স্বার্থপর, ইতর-বুদ্ধি মানুষের অনুরোধে আদিম উদ্দাম ঘোড়ার উপর কিছুটা মেরামতি চালিয়ে তার সংস্কার করে ব্রহ্মা তার মৌল আকৃতি এবং স্বভাব দুই-ই বদলে দিয়েছিলেন । এই ‘ঘোড়া’ গল্প পড়েই আমার মনে হয় নারীকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে গড়ার পরই পুরুষকে গড়বার সময় বিধাতার কাঁচামালে নিশ্চয়ই কমতি পড়েছিলো ।
গল্পটি পড়া না থাকলে পড়বেন । গল্পগুচ্ছর কোন্ খণ্ডে আছে মনে পড়ছে না এক্ষুনি । এত অপ্রাসঙ্গিক কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সৃষ্টিকর্তার কথা ওঠাতেই । জানি না কেন, গভীর বনের মধ্যের ঊষাকালে বা নির্জন সন্ধ্যায় আমার কেবলই মনে হয় যে, আমি বা আপনি আমরা এই নব্য আধুনিকেরা, নানা ভাষা নানা জ্ঞানে ঋদ্ধ মানুষেরা ; বোধ হয় সব কিছু এখনও জেনে উঠতে পারিনি । এবং পারিনি বলেই, অবিশ্বাসী আমাদের দম্ভে এবং বদ্ধ-মনস্কতায় আমরা বিশ্বাসী অন্যদের প্রাকৃত ও মূঢ় বলে জেনে সহজ নিশ্চিন্তিতে গা ভাসিয়ে দিন কাটাই।
আপনাকে হয়তো ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না। কিন্তু ঊষাকালে যখন ঘুম-ভাঙা পাখির আধো-ফোটা স্বর একে একে ক্রমশ ফুটে-ওঠা ফুলকলির মতো পরিস্ফুট হয়ে উঠতে থাকে ঘাসে ঘাসে, যখন বনের পাতায় পাতায় রাতভর জমে থাকা নির্মল টলটলে শিশুর চোখের জলের মতো কোটি কোটি শিশির বিন্দুতে, প্রভাতী আলোর মসৃণ আভাস তাদের উপর হঠাৎ এসে পড়ে কোটি কোটি হীরের চমক তোলে এবং সেই চমক ভিজে প্রকৃতিতে পিছলে যায়, প্রতিসারিত হয়ে যায় বিশ্বময়, এক লহমায় ; তখন আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। যখন লক্ষ প্রজাতির পোকা-প্রজাপতি-পাখি-ফুল-ঘাস-পাতা-গাছ আমার চোখের সামনে নতুন করে তাদের নিজস্বতার ক্ষুদ্রতা বা বিরাটত্ব সমেত তাদের সার্বিক ঐকতানিক একীভূত সত্তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠে প্রতীয়মান হয় ; যা-কিছুকেই আমরা জায়মান বলে জানি—আমাদের এই চিরচেনা পৃথিবীতে তখনই মনের মধ্যে জেগে ওঠে এক অসীম ব্রহ্মাণ্ডর অস্তিত্বের অনুরণন। মনে পড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের সেই গানখানির কথা ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/আমি মানব একাকী বিস্ময়ে ভ্রমি বিশ্বনাথ, অসীম রহস্য মাঝে, নীরবে একাকী আপন মহিমানিলয়ে ।” ঠিক এমনই এক বোধ জাগে মনে, সন্ধে বেলাতেও । তখন পাতারা ফুলেরা সব চোখ বোঁজে (কিছু অবশ্য তখনই আবার চোখ খোলে), আলো নিভে আসে, সমস্ত শব্দ, সমুদ্রের বালুবেলায় আছড়ে-পড়া ঢেউ-এর ক্রমবিলীন হিজিবিজি বিড়বিড়ানিরই মতো থেমে আসে। নির্জনে চোখ-বুজে-আসা একটি দিনের নীরব মৃত্যুর মতো মহান কোনো জন্ম, উন্মেষ বা উন্মীলন আছে বলে তো আমার মনে হয় না। এমন এমন মুহূর্তে আমার দাম্ভিক বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক মনও বলে ওঠে, সেই গ্রীক দেবতাদের উদ্দেশ্যে খোদিত মন্দিরগাত্রের কথাকটিরই মতো “তুমি কে তা আমি জানি না। তবে তুমি যেই হও তোমাকে প্রণাম।”
অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে ফেললাম। বলতে চেয়েছিলাম আপনার বাবার আর্থরাইটিস-এর ওষুধের কথা। তাই বলা হলো না।
কী অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স ! আমি আপনার কাকা-কাকীমা তেজেশ এবং শ্রুতিকে বলে এসেছি যে শুকনো মহুয়া পাঠিয়ে দেবো এখান থেকে । ওঁরা আপনাকে পাঠাবেন কলকাতায় । প্রত্যেক দিন সকাল-সন্ধ্যেতে শুকনো মহুয়া শুকনো তাওয়াতে গরম করে এক টুকরো ফ্ল্যানেলে জড়িয়ে নিয়ে হাঁটুতে সেঁক দিলে সাতদিনের মধ্যেই উনি ভালো হয়ে যাবেন । এই টোটকা আমার এক জবরদস্ত হাজামৎ-এর কাছে শেখা। সে এক সময় আমাকে তেল-মালিশ করতো। তখন আমি গাড়োয়াতে ছিলাম।
মহুয়া কলকাতায় পৌঁছলে, তা দিয়ে সেঁক দেওয়ার পর বাবা কেমন থাকেন তা জানাবেন । পঞ্চান্ন বছরে মানুষের গেঁটে বাত হবে কি ? সত্তরে তো মানুষ বিয়ে করে পশ্চিমের দেশে । বাবাকে সুস্থ করে তুলুন । এবং একবার মা-বাবাকে শীত থাকতে থাকতে এখানে পাঠিয়ে দিন । দেখবেন তাঁদের শরীর শুধু সম্পূর্ণ সুস্থ করেই নয়, বয়সও পনেরো বছর কমিয়ে পাঠিয়ে দেবো। প্রকৃতি-সঙ্গর মতো এমন শারীরিক ও মানসিক “হেল্থ-ক্লিনিক” আর নেই । কথাটা যে কত বড় সত্যি তা ওঁরা এলেই বুঝতে পারবেন । আধুনিক নগরভিত্তিক মানুষের নানা রকম শারীরিক ও মানসিক কষ্টর বেশিটুকুরই কারণ প্রকৃতি-বিযুক্তি । প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেই মানুষ তার মানুষের মতো শরীরে মনে বাঁচার পথ আবারও খুঁজে পাবে। নইলে নয় । নইলে তার ভবিষ্যৎ অতীব অন্ধকার । আপনার মা-বাবাকে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ ও নিমন্ত্রণ জানাবেন । তেজেশ এবং শ্রুতিকেও বলে এসেছি আপনার মা-বাবাকে আসার অনুরোধ করতে । ওঁদেরও আসতে বলেছি ।
দীর্ঘদিন নির্জনে থাকতে থাকতে আমার বেশি মানুষজন একেবারেই ভালো লাগে না । গ্রাম বা বনভূমিতে বসবাসকারী অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষদেরই এক ধরনের আদিখ্যেতা থাকে শহরে বসবাসকারী শিক্ষিত মানুষদের বর্ণাঢ্য জীবনযাত্রার প্রতি । মনে হয়, কোনো বিশেষ হীনম্মন্যতাতেও ভোগেন প্রথমোক্তরা । আমার কিন্তু একেবারেই উল্টোটি হয়েছে।
জঙ্গলের সরল সাদা গরীব মানুষদের সঙ্গে মিশে, আদিবাসীদের সঙ্গে মিশে আমার পক্ষে শহরের “সভ্য ও শিক্ষিত” মানুষদের সহ্য করাই মুশকিল হয়ে উঠেছে ইদানীং। যেখানে তথাকথিত শিক্ষা, সেখানেই অসততা, ভণ্ডামি, খলতা, তঞ্চকতা। সাধারণভাবে শিক্ষার পরম গন্তব্য শিক্ষিতদের মধ্যে মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করেছি বলেই নিজেকে শিক্ষিত বলতে লজ্জা বোধ করি । তাই শহুরে শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে মেশামেশির ব্যাপারে আমি খুবই খুঁতখুঁতে। এই সব কারণেই সেই রাতে আমি ইচ্ছে করেই সংক্ষিপ্ত “হুঁ-হাঁ” করেই সেরেছিলাম আপনাদের সঙ্গে । আমার সম্বন্ধে কিছুই জানাইনি ইচ্ছে করেই । এই দু-দিনের জীবনে রুজি এবং জীবিকার কারণে প্রত্যেক স্ত্রী-পুরুষেরই এতো বাজে মানুষের সঙ্গে, ও এতো রকম বাজে কথাতে প্রতিটি দিন লিপ্ত হতে হয় যে যাঁদের এখও মন বা স্বকীয়তা বলে কিছুমাত্র অবশিষ্ট আছে তাঁদের উচিত উদ্বৃত্ত ও একান্ত সময় এবং অবকাশটুকু অত্যন্ত নাক-উঁচু ও বাছ-বিচারসম্পন্ন হয়েই কাটানো। যাঁদের নিজের খুউব-ই ভালো না লাগে অথবা যাদের কাছ থেকে কিছু শেখার নেই তেমন মানুষদের সঙ্গে মেশার মতো দুর্দৈব একজন আধুনিক মানুষের জীবনে না আসাই ভালো। সময় কোথায় তার হাতে ? সময় নষ্ট করবার ? চিঠিটি সত্যিই বড় হয়ে গেলো। আপনি হয়তো ভাবছেন কী বাচাল ! সকলের কাছে নই কিন্তু ।
শ্রুতির কাছে শুনলাম আপনার অনেকই গুণপনার মধ্যে একটি নাকি ভালো সোয়েটার-বোনা । এবং আপনি নাকি বাড়ির বেড়াল, পাড়ার কুকুর, পিসতুতো দিদির জ্যাঠশ্বশুরের মাসতুতো ভাই সবাইকেই অক্লেশে এবং হাসিমুখে সোয়েটার বুনে দিয়ে থাকেন প্রতি বছরই। এবং সবচেয়ে বড় কথা এই যে, সে সব বোনেন নাকি অশেষ—অবহেলায়, ইমরান খানের বোলিং, গাভাসকরের সেঞ্চুরী, বড়বাজারী ষাঁড়েদের মারামারি ইত্যাদি দেখতে দেখতে । আপনার দুটি হাতের চারটি আঙুলে ধরা সেলাইয়ের কাঁটারা অনর্গল যে কী অবহেলায় অসামান্য সব ফুল ফুটিয়ে যায় আপনার কোলের কাছে তা আপনি নজর করে দেখেনও নাকি পর্যন্ত ! আমাকে একটি সোয়েটার বুনে দেবেন ? হাতির হাত থেকে আপনার প্রাণরক্ষককে ? উলের দাম আমি দিয়ে দেব। দেব, মানে নিতেই হবে। তবে শ্রমের দাম দেবো না। সেটা হবে ‘লেবার অফ লাভ’।
ইংরেজি ভাষাটার এই একটা মস্ত গুণ! বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কর্মকাণ্ডর বার্তাবাহী কী অসাধারণ সুন্দর সব অভিব্যক্তি । বিনি পয়সায় মজুর খাটাবার নাম দিলো “লেবার অফ লাভ”। এই নইলে সারা পৃথিবীতে ও বানিয়ারা ব্যবসা ফেঁদেছিলো !
আমি নির্লজ্জর মতো এমন অশোভন অনুরোধ আদৌ করতাম না। কিন্তু আমার বড়সাহেবের স্ত্রী ভালোবেসে আমায় একটা ফুল-স্লীভস্ পুল-ওভার বুনে দিয়েছিলেন । বড়সাহেবের স্ত্রীদের ভালোবাসার বিপদ হলো এই যে তা না যায় ফেলা, না যায় গেলা । ওঁদের নানারকম খুশি পুরোতে না পারলেই বড়সাহেবের কাছে মিথ্যে করে লাগিয়ে মুশকিল বাধান ওঁরা । একাধিকবার অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেই জানি । তাই ‘না’ করতে পারিনি। তিনি আমাকে এক বিশেষ চোখে দেখতেন । তখন আমি সারাণ্ডায় পোস্টেড ছিলাম । অনেক দিনের কথা । কপাল যথেষ্ট ভালো না হলে ভালোবাসা কপাল গড়িয়ে পড়ে যায় । থাকে না । আমার পুল-ওভারের রঙটা ছিল নেভি ব্লু। গলায় সাদা কাজ করা ছিল । বুকের কাছেও ছিল মোটাদাগের সাদা ইংরিজি “ভি” অক্ষর । শীতের এক শেষরাতে কুড়ি বাংলো থেকে আসছিলাম জীপ চালিয়ে। জোড্ডার বাইফারকেশান-এর আধমাইলটাক আগে পৌঁছে এতোই শীত করতে লাগলো যে জীপ থেকে নেমে পড়ে কাঠ-কুটো দিয়ে একটু আগুন করলাম পথের পাশে হাত সেঁকবার জন্যে । থামতে এমনিতেই হতো । কারণ ঠাণ্ডা ছাড়াও কুয়াশার জন্যেও জীপ চালানো প্রায় অসম্ভবই হয়ে উঠেছিলো । কিছুক্ষণ আগুনে হাত-পা সেঁকে নেবার পর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পুরের উপত্যকার দিকে মুখ করে সাতশো পাহাড়ের দেশে সূর্যোদয় দেখছি, ঠিক এমন সময় খুবই কাছ থেকে গুড়ুম্ করে বন্দুকের শব্দ হলো । গুলিটা হলো আমার সামনে থেকে । এবং আমার বুক-ফসকে বন্দুকের গুলিটা পেছনের একটি বড় শালগাছে এসে লেগে একটি মোটা ডালে গেঁথে গেল । হতভম্ব হয়ে কী করব বুঝতে না পেরে ঐ ঠাণ্ডা পাথুরে, ভিজে পথেরই উপরে পড়লাম। পড়তেই দেখি, চিফ কনসার্ভেটরের সদ্য বিলেত-ফেরত বন্দুক হাতে এগিয়ে আসছে আমারই দিকে ।
আমি ধড়ফড় করে উঠে চেঁচিয়ে বললাম, আমি ভালুক নই, ভালুক নই! মানুষ!
তিনি একটি সংক্ষিপ্ত এবং উদ্বিগ্ন “লেহ্-হালুয়া” বলেই কুয়াশার মধ্যে হাপিস হয়ে গেলেন । বাংলোতে ফিরেই পুল-ওর্ডারটা গা থেকে আমার খিদমদগারের বৌকে দান করে দিলাম। ভাগ্যিস তাগড়া পুরুষ আর ছিপছিপে নারীর বুকের মাপ একই হয় । সেই দিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে বাকি জীবনে কোনো মহিলারই হাতে-বানানো ভালোবাসার সোয়েটার আর পরবো না। কিন্তু আপনার অসাধারণ প্রতিভার কথা শুনে, ফুল-স্লীভস্ পুলোভার একটাও নেই বলে, এবং শীতও ক্রমশ জেঁকে আসছে বলেই এই এস্ ও. এস্ পাঠালাম।
খারাপ-বেসেই বানাবেন। যে-ভালোবাসা, পুল-ওভারকে দেখতে “ম্যাটার্নিটি কোট” করে তোলে এবং একই প্রক্রিয়ায় মানুষকে অবলীলায় ভালুক বানিয়ে দেয় সেই ভালোবাসা থেকে দূরে থাকাই বোধহয় বাঞ্ছনীয়।
ভালো থাকবেন।
ইতি— রাজর্ষি
শ্রীরাজর্ষি বসু
বেতলা, পালাম্বা, বিহার,