মানুষ শুধু মাত্র জৈবিক নয়। যুগপৎ আত্মারও অধিকারী। দেহের মতো আত্মারও ক্ষুধা আছে। অধিকন্তু আছে আশা-আকাঙ্ক্ষা, এষণা আর অভীপ্সা। তাই মানুষমাত্রেই অল্পবিস্তর আত্মজিজ্ঞাসু । সে চায় নিজের মধ্যে নিজে ডুব দিতে অল্পক্ষণের জন্য হলেও। এখানে সে স্বাধীন, অন্য-নিরপেক্ষ, সম্পূর্ণ মুক্ত । এখানে বিরোধের অনুপ্রবেশ ঘটলে আত্মা ভারসাম্য হারায়, মনের শান্তি আর সমাহিতচিত্ততা হয় বিপর্যস্ত ।
ব্যক্তিগতভাবে যেমন তেমনি সামাজিকভাবেও মানুষের এমন একটি এলাকা রয়েছে ( এবং থাকা উচিত ), যা সব তর্ক, বিরোধ আর বাদামুবাদের ঊর্ধ্বে । অদৃশ্য আর ব্যবহারিক অর্থে অপ্রামাণ্য এমন এক সার্বিক আর অসীম শক্তির সঙ্গে মানুষের আত্মগত যোগাযোগ আর অভীপ্সা, শুধু যে চিরন্তন তা নয়, ব্যক্তিবিশেষে তা দুর্বারও। এর ফলেই ধর্মীয় বিদ্যা ও আনুষঙ্গিক শাস্ত্র আর ওলী-দরবেশ ও মুনি-ঋষিদের আবির্ভাব । মানব-মনের স্বাভাবিক প্রবণতার সঙ্গে এ সবের সম্পর্ক না থাকলে তা কখনো এতখানি কালজয়ী আর এমন বিচিত্র হতে পারতো না । মনের যে-গভীর উপলব্ধি থেকে ধর্মের উৎপত্তি, সে মনের চেয়ে বিচিত্র-স্বভাব আর কিছু নেই। এ কারণেই ধর্মের এত বিভিন্ন অভিব্যক্তি ও এত বৈপরীত্য আর এতখানি রকমফের। এমন কি একই ধর্মের মধ্যেও বৈচিত্র্য আর বৈপরীত্যের অন্ত নেই ।
আমার বিশ্বাস, অনুষ্ঠান আর আচার বিচারের দিক দিয়ে ধর্ম বিচিত্র হলেও, মানুষের জীবনে ধর্মের ভূমিকা এক ও অভিন্ন। সে ভূমিকা একদিকে মানব মনের গভীরতর উপলব্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসার পরিতৃপ্তি যেমন তেমনি অন্যদিকে মানুষের নিত্যদিনের হাজারো ব্যাকুলতা আর যন্ত্রণায় সান্ত্বনাও । তাই শোকে দুঃখে, বিপদে-আপদে, বিরহ-বিচ্ছেদে মানুষ ধর্ম আর ধার্মিকদের আশ্রয় খোজে। এখানে সব মানুষ তথা সব বিশ্বাসী এক, শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ এখানে রহিত। এখানে ঠাঁই দিতে গেলেই ধর্মের ভূমিকা হয় বিপর্যস্ত। সত্যিকার ধর্ম ও ধর্ম-জীবন এক অখণ্ড শান্তির প্রতীক। তাই ধর্ম আর ধর্ম-জীবনের সাধকদের সব সময় তর্ক আর বিরোধের বাইরে থাকতে হয়। তা না হলে তাঁদের সাধনা যেমন বিঘ্নিত হয় তেমনি সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে । এ কারণে অতীতে মুসলিম ধর্ম-সাধকদের অনেকে বড় বড় লোভনীয় প্রশাসনিক দায়িত্বও-যে প্রত্যাখ্যান করেছেন তার নজির ইসলামের ইতিহাসে বিরল নয়।
ধর্মীয় অনুষ্ঠান সকলের জন্য, সমাজের অর্থাৎ বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের সব মানুষের জন্যই। কিন্তু ধর্ম আর ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়া কিংবা গভীর আর ব্যাপকভাবে শাস্ত্র অধ্যয়ন সকলের পক্ষে সম্ভব নয় । ইসলাম পৌরোহিত্য স্বীকার না করলেও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব ইসলামের সূচনা থেকেই গড়ে উঠেছে। এবং এ সম্পর্কে শাস্ত্রীয় বিধান আর নির্দেশও অসন্দিগ্ধ। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে আলেম সমাজেরই অগ্রাধিকার ।
সব সমাজেই দেখা যায়, একটা বিশেষ শ্রেণী শাস্ত্রকে গভীর ভাবে অধ্যয়ন করে তার চর্চায় আত্মনিবিষ্ট থাকে সারাটা জীবন। বিশেষজ্ঞের জ্ঞান নিয়ে এঁরাই সমাজের সামনে শাস্ত্রের ভাষ্য আর ব্যাখ্যা তুলে ধরেন আর নিজেদের জীবনকেও গড়ে তোলেন সে ভাবে। ধারা নিজের আর সমাজের কল্যাণার্থে এ গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁদের চরিত্র আর আচরণ হওয়া চাই সব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে, হওয়া চাই সর্বজনমান্য ও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ আর ঐহিক ব্যাপারে নিঃস্বার্থ । তাঁদের প্রতিও থাকা চাই সমাজের সার্বিক শ্রদ্ধা আর আনুগত্য। মানুষের ধর্ম- জীবন এমন এক পবিত্র এলাকা যে, সেখানে’ তর্ক, বিরোধ আর সংঘর্ষের অনু- প্রবেশ ঘটলে তার পবিত্রতা আর শাস্তিময় পরিবেশ কিছুতেই বজায় রাখা যায় না ।
রাখা না গেলেও সমাজের ধর্ম-জীবনও রাজনৈতিক আখড়ায় তথা দলাদলি আর বিরোধের ক্ষেত্রে পরিণত হবে। লক্ষণ দেখে মনে হয় অচিরে আমাদের মসজিদ আর ঈদগাগুলিও পরস্পর-বিরোধী শ্লোগানে হয়ে উঠবে মুখরিত । এমন কি ইদানীং দেখা যাচ্ছে কোন কোন মসজিদের ইমামও রাজনৈতিক বিতর্কে অংশ নিয়ে থাকেন। সমাজের পক্ষে এর চেয়ে অশুভ লক্ষণ আর ভাবা যায় না । ধর্মীয় এলাকায় বিরোধধর্মী কোন কিছুর আমদানি যেমন অবাঞ্ছিত তেমনি যারা সমাজের ধর্ম-জীবনের দিশারী আর ধর্মীয় ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ তাঁদের পক্ষেও উচিত নয় বিরোধমূলক কোন কিছুতে লিপ্ত হওয়া । ক্ষতি হবে তা নয় তাঁদের নিজেদের ক্ষতিও কম হবে না। প্রথমত সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা তাঁরা হারাবেনই, সে সঙ্গে যে-ধর্ম-জীবনের ব্রতে তাঁরা ব্রতী তাঁদের সে জীবনও হবে পদে পদে বিঘ্নিত। সমাজের ধর্ম-জীবনের দিশারী হওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার তখন তাঁদের আর থাকবে না! তাই দেখা যায় কোন দেশেই শাস্ত্রবিদ আর ধর্ম-জীবনে আত্মনিবেদিত ব্যক্তিরা বিরোধমূলক বিষয়ে অংশ গ্রহণ করেন না- ঐসব ব্যাপার থেকে সব সময় তাঁরা নিজেদের রাখেন নিরাপদ দূরত্বে। জাগতিক ব্যাপারে এঁদের নির্লিপ্তি ধর্মক্ষেত্রে কম ফলপ্রসূ হয় নি। প্রত্যেক ধর্মকে কেন্দ্র করে যে বিরাট শাস্ত্র আর ধর্মীয় সাহিত্য গড়ে উঠেছে, আমার বিশ্বাস এর ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের ধর্ম-জীবনের দিশারী আমাদের আলেম সমাজ, এ সম্বন্ধে তাঁদের যোগ্যতা ও অধিকার নিঃসন্দেহ। তাঁদের শিক্ষা-দীক্ষা আর প্রস্তুতিও এ জীবনেরই উপযোগী। তাঁদের অভিজ্ঞতাও এ ক্ষেত্রেই সীমিত। এখানে তাঁরা সমাজের প্রভূত খেদমৎ অতীতে যেমন করেছেন এখনো-যে না করছেন তা নয়। রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করলে তা সম্ভব হবে না বলেই আমার আশঙ্কা । বর্তমানে এক শ্রেণীর আলেম সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছেন বলেই এ প্রসঙ্গের অবতারণা । আমার বিশ্বাস এর পরিণাম সমাজের পক্ষে মোটেও শুভ হতে পারে না। বরং অচিরে এ সমূহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সমাজের যে- এলাকাকে আমরা সব রকম বিরোধ বিতর্কের বাইরে রাখতে চাই, রাখা প্রয়োজন মনে করি, আলেম সমাজ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করলে তা রাখার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ তিরোহিত হবে। তখন সে পবিত্র এলাকায়ও দেখা দেবে বিরোধ, বিতর্ক, সংঘাত ও সংঘর্ষ। সর্বস্তরের মুসলমানের সেই শান্তির এলাকাটিও তখন আর থাকবে না শান্তির এলাকা। সমাজের ধর্ম-শিক্ষা আর ধর্ম-জীবনের দিক থেকে এ হবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি। রাজনৈতিক ক্ষমতা এ ক্ষতি কখনো পূরণ করতে পারবে না। তখন মসজিদেও দেখা দেবে দল, মক্তব মাদ্রাসায়ও রাজনৈতিক বিশ্বাস আর মতাদর্শ অনুসারে গড়ে উঠবে পরস্পর- বিরোধী ফেরকা বা উপদল। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম বিরোধ আর সংঘর্ষ ।
আমি অন্য এক প্রবন্ধে বলেছি ধর্ম স্বভাবে মিলনধর্মী; ধর্ম মানুষকে সংঘবন্ধ করে সম-বিশ্বাসীদের একই ক্ষেত্রে, একই মঞ্চে মিলায়, মিলনে সহায়তা করে। রাজনীতি কিন্তু স্বভাবে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজনীতির চরিত্র বিরোধধর্মী বিশেষত গণতান্ত্রিক, রাজনীতি দলভিত্তিক বলে তাতে দলে দলে বিরোধ আর বিভেদ অনিবার্য। এ কারণে পাকিস্তান মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র হলেও আর পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল মুসলমানদের দ্বারা গঠিত আর পরিচালিত হলেও এক দলের সঙ্গে অন্য দলের মিল নেই, মিল হচ্ছে না। এমন কি ইসলামের নামে যে-সব রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে সে সব দলের মধ্যেও পারস্পরিক মিল- মহবৎ ও ঐক্য-বোধ অনুপস্থিত। এবং এদেরও এক দল অন্য দলকে মনে করে শত্রু। এমন কি পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘কাফেরী’ ফতোয়াও বিরল নয়। দেখে অবাক হতে হয় এ ফতোয়া দিচ্ছে মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে, এক আলেম অন্য আলেমের বিরুদ্ধে! ধর্ম নিয়ে এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কি হতে পারে ? রাজনীতি স্বভাব-চরিত্রে বিরোধ-ধর্মী বলে এ না ঘটে পারে না । ‘ইসলামী ভ্রাতৃত্বে’র শ্লোগান কিংবা ‘কোরান-সূন্না’র দোহাই এ বিরোধ কিছুতেই ঠেকাতে পারবে না। ইসলামের জন্মভূমি খাস আরব দেশে তা ঠেকানো যায় নি। সেখানে এক ধর্মাবলম্বী এক ভাষাভাষী এক জাতি ভেঙে আজ বারো জাতিতে পরিণত । এর মূলে রাজনীতি আর রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছাড়া দ্বিতীয় কোন কারণ নেই। আমাদের দেশেও আলেম সমাজ যে আজ বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তারও কারণ রাজনীতি। রাজনীতিতে তাঁদের একটা অংশ দল বা পক্ষ নেওয়ার পর থেকেই এ বিভেদ আর বিরোধের সূচনা। এর আগে আলেমদের মধ্যে এমন দল-ভিত্তিক বিরোধ আমরা কখনো দেখি নি। তখন শাস্ত্রীয় মসলা-মসায়েল নিয়ে যে-বিরোধ ঘটতো তা ছিল অনেকখানি কেতাবী আর অতি স্বল্প সংখ্যকের মধ্যে সীমিত। তার সঙ্গে বৃহত্তর জনতার কোন সম্বন্ধ ছিল না। কিন্তু রাজনীতি তো তা নয়। রাজনীতি আজ সর্বতোভাবে জন-জীবনের এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। সার্বজনীন ভোটাধিকার যেখানে স্বীকৃত সেখানে রাজনীতি কিছুতেই ঘরোয়া কিংবা স্রেফ কেতাবী হয়ে থাকতে পারে না। সমাজের সর্বস্তরে এ রাজনীতির প্রতিক্রিয়া এক ভাবে না এক ভাবে হবেই— ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য নেই কারো । আলেমেরা যদি এমন রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন তাহলে তাঁরাও ‘দলীয়’ না হয়ে পারবেন না। তখন সমাজও তাঁদের গ্রহণ করবেন ‘দলীয় মানুষ’ হিসেবেই— ধর্ম-জীবনের দিশারী কিংবা প্রতিভূ হিসেবে নয়। যে-সমাজে নানা দল রয়েছে, রয়েছে নানা দলের অনুসারী মানুষ সে সমাজে রাজনৈতিক আলেমরা কখনো সমাজের সার্বিক শ্রদ্ধা আর আনুগত্য আশা করতে পারেন না। আমার বিশ্বাস ধর্মীয় নেতৃত্বের জন্য এ শ্রদ্ধা আর আনুগত্যটুকু অপরিহার্য। অতীতে আলেম সমাজ যখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকতেন তখন তাঁদের প্রতি জনগণের যে-শ্রদ্ধা আর আনুগত্য ছিল তা ছিল সর্বতোভাবে আন্তরিক নির্ভেজাল ও সার্বজনীন। সেদিন সত্যিকার অর্থে তাঁরা সমাজের সামনে শুধু যে ধর্ম-জীবনের আদর্শ ছিলেন তা নয়, দলমত- নির্বিশেষে সকলের ভক্তির পাত্রও ছিলেন। আমি জোর করে বলতে পারি কোন রকম রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করলে, এমন সম্মানের পাত্র তাঁরা কখনো হতে পারতেন না।
ধর্মীয় রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ নাকি হযরত রসুলে করিমের দোহাই দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান যে, রসুলে করিমের যমানার রাজনীতি আর এখনকার রাজনীতি এক নয়। তখন দলীয় রাজনীতির অস্তিত্বই ছিল না। ইসলামে দলীর রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে ‘খোরেজিদে’র আবির্ভাবের পর থেকে আর তা ঘটে রসুলে করিমের ইন্তেকালের বহু বছর পরে চতুর্থ খলিফা হযরত আলীর সময় আর তার মর্মন্তুদ পরিণাম ইসলামের ইতিহাস-পাঠকদের অজানা নয়। অধিকন্তু তখনকার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন ‘আমিরুল মোমেনীন’- এখন রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা তাঁর উজির সভার কেউ-ই ‘আমিরুল মোমেনীন’ নন্। কাজেই তখনকার রাজনীতির সঙ্গে এখনকার রাজনীতির কোন তুলনাই চলে না। এখন রাজনীতি এক জটিল ব্যাপার আর তা মোটেও সীমিত নয় কোন ভৌগোলিক সীমায়, সারা বিশ্বের সঙ্গে এ রাজনীতির এখন গাঁটছড়া বাধা ।
এ কারণে আমাদের কোন কোন ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমাজতন্ত্রকে ‘কুফরীর সমতুল্য’ ঘোষণা করলেও তার প্রতি কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান আর সৈন্যাধ্যক্ষরা সমাজতান্ত্রিক দেশে শুধু-যে সফর করছেন তা নয়, নিচ্ছেন সে সব দেশ থেকে নানা রকম সাহায্য, আবদ্ধ হচ্ছেন নানা চুক্তিতে সে সব দেশের সঙ্গে। কই এ সবের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ তো সোচ্চার হতে শোনা যায় না। ‘শক্তের ভক্ত আর নরমের যম’ নীতি কোন সৎ-ধার্মিকের লক্ষণ নয়। ‘সমাজবাদ’, ‘পুঁজিবাদ’, ‘মাওবাদ’ চলবে না এমন স্নোগান আউড়ানো অতি সহজ কিন্তু যে-সব দেশে ঐ সব ‘বাদ’ চলছে তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ভিন্ন কথা। আধুনিক রাষ্ট্র আর নীতির পক্ষে তা করা সম্ভব নয় । এ সত্য সমাজতন্ত্র-বিরোধীদেরও যে জানা নেই তা নয়, জানা আছে বলেই তাঁরা আজো সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে ‘আদর্শভিত্তিক’ রাষ্ট্র পাকিস্তানের সম্পর্ক-চ্ছেদের ধুয়া তোলেন নি । তাঁরা এও ভালো করেই জানেন, তুললেও কেউ তার প্রতি কর্ণপাত করার প্রয়োজন বোধ করবে না। আলেম সমাজ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করলে এ রকম স্ব-বিরোধিতার শিকার তাঁরা না হয়ে পারবেন না । বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম তথা শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধের বিরোধ এত বেশী যে, এ দু’য়ের মিলন কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই আলেম সমাজের রাজনীতিতে অংশ-গ্রহণের আমি বিরোধী। অংশ গ্রহণ করলে রাজনীতির কোন ফায়দা তো হবেই না অধিকন্তু ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদিতেও অনিবার্য ভাবেই দেখা দেবে বিরোধ, বাদানুবাদ ও সংঘর্ষ। দলীয় রাজনীতি তাঁদেরও দলীয় আলেম বানিয়েই ছাড়বে। দল হলে বা থাকলে দলাদলিও-যে হবে এ প্রায় স্বতঃসিদ্ধ । তখন মসজিদে, জুমার নামাজে, মিলাদ শরিফে এবং ঈদগায়ও দেখা দেবে বিরোধ আর সংঘর্ষ। যার সূচনা ইতিমধ্যেই লক্ষগোচর। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এখন দেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আলেমদের ব্যবহার করছে নিজেদের দলীয় স্বার্থে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমার বিশ্বাস অগৌণে এক দলের আলেমের পেছনে, তিনি যতই যোগ্য হোন না কেন, অন্য দলের সমর্থক মুসল্লীরা, নামাজ পড়তে আপত্তি করে বসবে। প্রত্যেক দলের আলেম আর মুসল্লী সম্বন্ধেই একথা বলা যায়। ধর্মীয় দলগুলি তো আরো জঙ্গী। তাঁদের বেলায় বিরোধটা হবে অধিকতর তীব্র ও মারাত্মক । এভাবে দলাদলির সম্প্রসারণ ঘটবে ধর্মীয় এলাকায়ও ।
আগেই বলেছি ধর্মীয় এলাকাটা সব সমাজের সব জাতির এমন একটা মুক্ত ও পবিত্র এলাকা যে, সেখানে রাজনৈতিক মতামত-নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষের নির্ভয়ে সরল মনে আর বিনা দ্বিধায় প্রবেশ আর অংশ গ্রহণ করতে পারা চাই । পারা চাই সহজ ও নিষ্কলুষ মনে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করে পরস্পরের সঙ্গে দিল খুলে মেলামেশা করতে। রাজনীতি সেখানেও মাথা গলালে এ সম্ভব হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। অন্তত এ একটা ক্ষেত্রে কোন রকম বিতর্ক-মূলক বিষয়ের অনুপ্রবেশ না ঘটুক এ আমি চাই।
শিক্ষার ক্ষেত্রে রাজনীতিকে প্রবেশ করতে দিয়ে আমরা নিজের হাতে আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শান্তি নষ্ট করেছি। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও যদি রাজনীতিকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় এখানেও সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কেউ-ই রুখতে পারবে না।