proggapath, progga, bangla literature, bangla kobita, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, classic novel, মরিয়ম জামিলা, Maryam Jamila, ফিলিস্তিনের আকাশ, philistiner akash

ফিলিস্তিনের আকাশ

০ মন্তব্য দর্শক

পাঁচ :

আহমদ খলিলের বয়স সাত বছর চলছে। তার আর কোন ভাইবোন নেই । ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় সে। তার মনে হয়- ইস্! আল্লাহ যদি তার একটা ভাই কিংবা বোন দিতেন, তাহলে কি মজাই না হত।
নামাজ কায়েম করার বয়স হয়েছে আহমদ খলিলের। আব্বা এবং মাকে দিনে পাঁচবার নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করতে দেখে সে। নামাজের সমস্ত নিয়ম-কানুন এখনো শেখা হয়ে ওঠেনি তার। তবে তাদের নামাজ পড়তে দেখে তার নিজের মধ্যেও একটা ব্যাকুলতা দেখা দিয়েছিল। এ সময় একদিন মালেক ওহাব তাকে মসজিদে নিয়ে গেলেন। শ’খানেক লোকের বিরাট জামাতে নামাজ আদায় করে আনন্দ ও গর্বে বুকটা যেন ভরে ওঠে তার।
মিনার ছাড়া মসজিদটি ছিল দেখতে গ্রামের আর দশটা বাড়ির মতোই । ইট বিছানো মেঝেয় পেতে দেয়া মাদুর এবং দেয়ালে পবিত্র কুরআনের আয়াত লেখা মসজিদটি ছিল খুবই ছিমছাম এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। গ্রামের কল-কোলাহল এবং একঘেয়ে ক্লান্তিকর পরিবেশের মধ্যে এটি ছিল যেন প্রশান্ত বেহেশত। প্রথম দিনেই আল্লাহর ঘরটিকে গভীর ভালবেসে ফেলে আহমদ খলিল ।
একদিন এশার নামাজ আদায় করে ঘুমানোর আগে আব্বা-আম্মার মধ্যকার টুকরো টুকরো কয়েকটি কথা কানে আসে তার। আনন্দে লাফিয়ে ওঠে সে। তার একটি ভাই কিংবা বোন আসছে শিগগিরই। এতদিন সে একা ছিল, এবারে একজন সাথী পাবে-এ আনন্দে মন ভরে ওঠে তার। তার মনে হয়- অবশেষে আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেছেন। খুশিতে সারারাত ভালো করে ঘুমাতে পারে না সে ।
খাদিজার সন্তান জন্মদানের সময় ক্রমশই এগিয়ে আসতে থাকে। যে কোন নারীর জন্যেই সন্তান জন্মদানের সময় একটি নিরিবিলি ঘর প্রয়োজন। কিন্তু মালেক ওহাবই শুধু নয়, ইরাক আল মানশিয়া গ্রামে কারোরই একটির বেশি দু’টি ঘর ছিল না। এর ফল হয়েছিল এই যে, গ্রামের একেবারে ছোট্ট ছেলেটিও যাবতীয় কিছু জেনে ফেলত। এমন কোন ব্যাপারই ছিল না যা তাদের কাছে গোপন রাখা যেত। তবে দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত লাভ করা এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে একে অন্যের সাথে আলোচনার কোন সুযোগ তারা পেত না । অথবা বলা যায়, বড়রা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিল বলেই অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এগুলোর চর্চা বা রসালো আলাপ সম্ভব হত না ।
আসন্ন সন্তান সম্ভবা খাদিজা একদিন রাতে একটি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন : চারদিক ঘন অন্ধকার। এমন সময় কে যেন তার নাম ধরে ডেকে উঠল। কণ্ঠস্বরটি কোন পুরুষের, শান্ত এবং ভরাট। এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি।
: আপনি কে? কেন আমাকে ডাকছেন? অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন খাদিজা।
: আল্লাহর ইচ্ছায় খুব শিগগিরই তোমার কোলে এক পুত্র সন্তান আসবে। অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বলে চললেন- এই ছেলেটি হবে আর সবার চাইতে আলাদা, অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
: আপনি কে? খাদিজা আবারো জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কোন উত্তর এলোনা।
অবশেষে তাকে দেখতে পেলেন খাদিজা। তিনি দেখলেন- দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী একটি মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছেন। উজ্জ্বল জ্যোতি। তাঁর মাথায় বাঁধা কাফিয়াটি দিয়ে মুখটার প্রায় সবটুকু ঢাকা। সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষের দু’হাতে একটি শিশু। নিজের অজান্তেই খাদিজা হাত বাড়িয়ে দিলেন শিশুটিকে নিজের কোলে নেয়ার জন্যে। মহাপুরুষ পরম যত্নে খাদিজার হাতে তুলে দিলেন শিশুটিকে। বলেন- খাদিজা, আল্লাহ এ শিশুটিকে তোমায় দিয়েছেন। তুমি সব সময় এর প্রতি খেয়াল রেখ। মহাপুরুষের ভরাট কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে গেল চারদিকে। কিন্তু খাদিজা আর তাঁকে দেখতে পেলেন না । তখনি ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। কানে এল গ্রামের মসজিদ থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের গলায় ভোরের সুমধুর আজানের ধ্বনি ।
সকাল বেলায় মালেক ওহাব, ইউসুফ মালিক এবং আহমদ খলিলকে নাস্তা দিতে গিয়ে স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল খাদিজার। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বলে গেলেন তিনি । তারপর স্বামীকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়লেন মালেক ওহাব
: আমি কি করে জানব এ স্বপ্নের অর্থ। তবে স্বপ্ন স্বপ্নই। তা কখনো সত্য হয় না। মালেক ওহাবের কথা শেষ হতেই কথা বলে উঠলেন ইউসুফ মালিক-
: স্বপ্নে আপনি নবী করিম (স) কে দেখেছেন। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই । তিনি যখন কাউকে স্বপ্নের মধ্যে দেখা দেন তখন তার মুখ একটা আবরণে ঢাকা থাকে।
মালেক ওহাবের নিষেধে খাদিজা এ দিন আর কাজের জন্যে মাঠে পেলেন না । মালেক ওহাব নিজেও ঘরেই থাকলেন। দুপুরের দিকে খাদিজা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। রাস্তায় খেলা করছিল আহমদ খলিল। বেশ কিছুক্ষণ পর ভাইয়ের জন্ম সংবাদ কানে যেতেই এক দৌড়ে ঘরে চলে আসে সে।
: আমার ভাই কোথায়? আমার ভাইকে দেখতে দাও। সে চিৎকার শুরু করল। আহমদ খলিলের চাচী হালিমা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। ধমকে উঠলেন তিনি- ঃ এভাবে চিৎকার কর না। এখন যাও, পরে দেখতে এসো ভাইকে।
ঘরের ভিতর থেকে খাদিজার ক্লান্ত গলা ভেসে এল। ছেলেকে ভিতরে যেতে দিতে বলছেন তিনি।
আহমদ খলিল ঘরের মধ্যে ঢুকতেই দেখতে পেল তার ছোট্ট ভাইটিকে। তার আম্মা দু’হাতে তুলে ধরেছেন পুতুলের মতো শিশুটিকে যাতে আহমদ খলিল ভালো করে দেখতে পায়। আহমদ খলিল ভাইকে দেখছিল। ছোট্ট অথচ স্বাস্থ্যবান, উজ্জ্বল তামাটে রং, মাথা ভরা কালো চুল। হঠাৎ করেই এ সময় তার মনে পড়ে যায় আম্মার দেখা স্বপ্নের কথা। আরো ভালো করে সে ভাইকে লক্ষ্য করতে শুরু করে। হঠাৎ তার মনে হয়, আর দশটি নবজাত শিশুর মত নয় তার ভাই। শিশুটি এখনই অদ্ভুত রকমের শান্ত এবং স্থির তার চোখ দু’টি অসাধারণ উজ্জ্বল, আর তাতে জড়িয়ে আছে যেন একরাশ মমত্ব ও সারল্য। আহমদ খলিল খুব আশ্চর্য হয়ে যায়।
ভাইয়ের আগমনে আহমদ খলিলের ছোট্ট জীবনের সবকিছুতেই পরিবর্তন ঘটে যায়। নবজাতকের নামা রাখা হয়েছে খলিফা- অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিনিধি। কিছুদিন পর খলিফাকে দেখা শোনার দায়িত্ব তার উপরেই পড়লো। মাঠের কাজে না গিয়ে উপায় ছিল না খাদিজার। ইরাক আল মানশিয়ার অধিবাসীদের জীবন ধারণের কঠোর কঠিন সংগ্রামে অংশগ্রহণ থেকে সরে থাকার কোন পথ খাদিজার ছিল না। এরপর আরো মুশকিল হল যখন শীতকালে একটু বৃষ্টিও হল না। জমিগুলো ফসলশূন্য হয়ে দীর্ঘশ্বাস এবং হাহাকার তোলে সবার মাঝে। মালেক ওহাবকে খাদ্য সংগ্রহের জন্যে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হত।
অবস্থা শেষপর্যন্ত খুবই সংকটজনক হয়ে দাঁড়াল। গ্রামের অন্য পরিবারগুলোর মতো মালেক ওহাবের সংসারটিও প্রায় অচল হয়ে পড়ল। বৃষ্টি ছাড়া মাঠ থেকে ফসল পাবার কোন উপায় ছিল না। তাই মালেক ওহাব সম্পূর্ণরূপে ঘরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। খাদিজা ঘরের তাঁতে যে কাপড় বুনতেন সেগুলো গাজাতে নিয়ে বিক্রি করে পাওয়া অর্থই ছিল সংসার চলার একমাত্র উপায়। ফলে দুর্বল শরীরের আহমদ খলিল নিয়মিত পুষ্টিকর খাবারের অভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত এমন হল যে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে যাওয়া কিংবা সঙ্গীদের সাথে খেলতে যাবার শক্তিটুকুও তার রইল না ।
আবার শীত এসে গেছে। প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে এবার। চারদিকের ধূসর প্রান্তর ইতিমধ্যেই সবুজের চাদর গায়ে হেসে উঠেছে। মরুভূমির ঝাঁঝালো গরম হাওয়ায় ঠাণ্ডার আমেজ। সূর্যের আলো সারা গায়ে ছড়িয়ে দেয় আরামের মধুর পরশ। মাঠে ফসলের অবস্থা খুবই ভালো। ইরাক আল মানশিয়ার মানুষগুলোর জীবনে আবার স্বস্তি ও আনন্দের ছোঁয়া লেগেছে।
ঘরের বাইরে দেয়ালে হেলান দিয়ে জোরে জোরে খবরের কাগজ পড়ছিলেন মালেক ওহাব। তাকে ঘিরে আছে কয়েকজন শ্রোতা। ইউসুফ মালিক এবং মনসুরও ছিলেন তাদের মধ্যে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিল আসরে। মালেক ওহাবের হাতের কাগজটি ছিল প্রায় এক মাসের পুরনো। ইরাক আল মানশিয়ার মতো গ্রামে খবরের কাগজ পাওয়ার ব্যাপারটি ছিল এক আশ্চর্যপ্রায় ঘটনা। মালেক ওহাব কিভাবে খবরের কাগজ পেতেন এটি ছিল সবার কাছেই এক রহস্যের ব্যাপার।
আহমদ খলিল তার আব্বার খবরের কাগজ পাঠ এবং লোকদের আলাপ-আলোচনা থেকে বুঝল- এখান থেকে বহুদূরে শীতপ্রধান দেশগুলোতে যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধের কারণ তার জানা ছিল না। সে উঠে গিয়ে মালেক ওহাবের পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁধের উপর দিয়ে উকি মেরে খবরের কাগজটি দেখতে থাকল। একটি ছবির উপর চোখ আটকে যায় তার। এ লোকটির ছবি আগেও দেখেছিল সে। লোকটি হলেন উইনস্টন চার্চিল, ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী। লন্ডনে জার্মানরা বোমা ফেলেছে। এ প্রেক্ষিতে ইংরেজদের উদ্দেশ্যে চার্চিলের দেয়া ভাষণের আরবী অনুবাদ পড়ছিলেন মালেক ওহাব। এরপর আরেকটি ফটো এবং তাঁর বিবরণ পড়ে শোনালেন তিনি। এ ফটোটি ছিল হাজী আমিন আল হুসাইনী এবং এডলফ হিটলারের মধ্যকার বৈঠকের একটি দৃশ্য। তারা দু’জনে একটি সোফায় পাশাপাশি উপবিষ্ট অবস্থায়ই ফটোটি তোলা হয়েছে।
কাগজ পড়া বন্ধ করে কথা বলে উঠলেন মালেক ওহাব :
: হিটলার আমাদের বন্ধু। জার্মানরা যদি যুদ্ধে জিতে যায় তবে ইহুদীরা ধ্বংস হয়ে যাবে। ইংরেজদের ম্যাণ্ডেটের কোন দাম তখন থাকবে না। এর ফলে ফিলিস্তিন একটি আরব রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করবে।
: না, এতে কোন লাভই হবে না। প্রতিবাদ করলেন ইউসুফ মালিক। তিনি বললেনঃ এতে শুধু শাসকের বদল হবে মাত্র। মালেক ওহাবের দিকে তাকালেন তিনি- কেন, আপনি কি জার্মানদের অত্যাচারের কথা ভুলে গেলেন ! হিটলার লোকটি ভয়ানক নিষ্ঠুর। ওরা যেস্থানই দখল করছে সেখানেই চলছে, হত্যা, নির্যাতন এবং সন্ত্রাস। নারী এবং মাসুম বাচ্চাদের হত্যা করতেও ওদের হাত কাঁপেনা। তাছাড়া ওরা যে শুধু ইহুদীদেরই হত্যা করেছে তা তো নয়। ওদের অত্যাচার থেকে কেউই আসলে রেহাই পাচ্ছে না। কুখ্যাত বন্দীশিবিরগুলোর কথা তো আপনি শুনেছেন। তাই, আমার মনে হয়, আপনার ধারণা ভুল। হিটলার আমাদের শত্রু। আর তা এ কারণে যে আজ বন্যাস্রোতের মতো ফিলিস্তিনে ইহুদী আগমনের জন্যে মূলতঃ সেই দায়ী। সে যদি ইহুদীদের অপরাধের জন্যে উপযুক্ত ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা নিত তবে এভাবে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ
করে আমাদের জায়গায় এসে চেপে বসার প্রয়োজন হত না ।
: আচ্ছা ফিলিস্তিনেও কি যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে? তোমার কি মনে হয়! মনসুর প্রশ্ন করেন। অনাগত বিপদের আশংকায় তার মুখটি কালো হয়ে উঠেছে। আমি শুনেছি, মিসরে ইতিমধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তাছাড়া ইদানিং জার্মানদের স্বস্তিকাচিহ্ন অংকিত যুদ্ধ বিমানগুলো আমাদের এলাকার উপর দিয়েই উড়ে যাচ্ছে। তোমাদের কি মনে হয়, জার্মানরা শীঘ্রই এদিকে আসবে? মনসুরের গলায় জিজ্ঞাসা।
: একমাত্র আল্লাহই জানেন কি হবে। হতাশ গলায় বললেন ইউসুফ মালিক।
এর পরপরই আসর ভেঙ্গে গেল। সবাই চলে গেল যে যার ঘরে।
দুপুর বেলায় আহমদ খলিলকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন খাদিজা। খুবই ক্লান্ত মনে হল তাকে। খাদিজা তাকে জাগানোর জন্যে কয়েক বার ঝাঁকুনি দিলেও ঘুম ভাঙল না তার। বিরক্ত হয়ে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করলেন খাদিজা। মালেক ওহাব মাঠে গিয়েছিলেন একা। আহমদ খলিল তাকে সাহায্য করতে না গেলে খুবই অসুবিধায় পড়বেন তিনি। এ সময় জোর ধাক্কায় জেগে ওঠে আহমদ খলিল। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে যন্ত্রণায় কাত্রাতে থাকে সে।
খাদিজা অবাক হয়ে তার মাথায় হাত রেখেই চমকে উঠলেন। একি! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে আহমদ খলিলের। বুকটা কেঁপে ওঠে তার। ঘরের এক কোণ থেকে কয়েকটি ময়দার বস্তা এনে সুন্দর করে বিছিয়ে মোটামুটি নরম একটি শয্যা তৈরি করে ছেলেকে তার উপর সযত্নে শুইয়ে দেন তিনি। এরপর কাপড় ভিজিয়ে কপালে পানি-পট্টি দিতে শুরু করেন।
মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল আহমদ খলিলের। তার মনে হচ্ছিল যে মাথাটা যে কোন মুহূর্তে বোধ হয় ছিঁড়ে অথবা ফেটে যাবে। যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল তার । কিন্তু, মা রেগে যাবেন মনে করে মুখ বুজে সহ্য করতে থাকল সে। এ সময় জোহরের নামাজের আযান কানে ভেসে আসে। হঠাৎ করেই তার মনে হয়- মাথার অসহ্য যন্ত্রণাটি অনেকখানি যেন কমে গেছে ।
আযানের আওয়াজে উঠে গিয়েছিলেন খাদিজা। অযু সেরে এসে নামাযে দাঁড়ান তিনি। এক অদ্ভুত আত্মমগ্নতা লক্ষ্য করে আহমদ খলিল তার মায়ের মধ্যে। নিবিষ্ট মনে মায়ের রুকুতে যাওয়া, সিজদায় নত হওয়া, আবার উঠে দাঁড়ানো- সবকিছুই লক্ষ্য করছিল সে। অন্যান্য দিনগুলোর চেয়ে আজকে অনেক সময় ধরে মাকে মোনাজাত করতে দেখে একটু অবাকই হয় সে।
রাত অনেক হয়ে গেছে। আহমদ খলিলের জ্বর ক্রমশই বেড়ে চলেছে। দেয়ালের একটি খাজের মধ্যে রাখা বাতি থেকে ঘরখানায় হলুদাভ আলো ছড়িয়ে পড়ছে। পাংশু মুখে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন মালেক ওহাব। অনেক চেষ্টা করেও ঘুম আসছিল না আহমদ খলিলের। হঠাৎ তার মনে হলো, ঘরের মধ্যে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। সে আগুনের প্রচণ্ড উত্তাপে গলা শুকিয়ে আসে তার। তার মনে হলো, পানির অভাবে বুকটা ফেটে যাবে। পানি পানি- বলে চিৎকার করে ওঠে সে।
প্রায় সাথে সাথেই একটি কোমল হাতের মমতা মাখানো ছোঁয়া পায় আহমদ খলিল। হাতটি ছিল তার মায়ের। ছেলের পানির পিপাসা লেগেছে বুঝতে পেরে তাকে পানি খাইয়ে দেন খাদিজা।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

ফিলিস্তিনের আকাশ

দর্শক

পাঁচ :

আহমদ খলিলের বয়স সাত বছর চলছে। তার আর কোন ভাইবোন নেই । ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় সে। তার মনে হয়- ইস্! আল্লাহ যদি তার একটা ভাই কিংবা বোন দিতেন, তাহলে কি মজাই না হত।
নামাজ কায়েম করার বয়স হয়েছে আহমদ খলিলের। আব্বা এবং মাকে দিনে পাঁচবার নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করতে দেখে সে। নামাজের সমস্ত নিয়ম-কানুন এখনো শেখা হয়ে ওঠেনি তার। তবে তাদের নামাজ পড়তে দেখে তার নিজের মধ্যেও একটা ব্যাকুলতা দেখা দিয়েছিল। এ সময় একদিন মালেক ওহাব তাকে মসজিদে নিয়ে গেলেন। শ’খানেক লোকের বিরাট জামাতে নামাজ আদায় করে আনন্দ ও গর্বে বুকটা যেন ভরে ওঠে তার।
মিনার ছাড়া মসজিদটি ছিল দেখতে গ্রামের আর দশটা বাড়ির মতোই । ইট বিছানো মেঝেয় পেতে দেয়া মাদুর এবং দেয়ালে পবিত্র কুরআনের আয়াত লেখা মসজিদটি ছিল খুবই ছিমছাম এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। গ্রামের কল-কোলাহল এবং একঘেয়ে ক্লান্তিকর পরিবেশের মধ্যে এটি ছিল যেন প্রশান্ত বেহেশত। প্রথম দিনেই আল্লাহর ঘরটিকে গভীর ভালবেসে ফেলে আহমদ খলিল ।
একদিন এশার নামাজ আদায় করে ঘুমানোর আগে আব্বা-আম্মার মধ্যকার টুকরো টুকরো কয়েকটি কথা কানে আসে তার। আনন্দে লাফিয়ে ওঠে সে। তার একটি ভাই কিংবা বোন আসছে শিগগিরই। এতদিন সে একা ছিল, এবারে একজন সাথী পাবে-এ আনন্দে মন ভরে ওঠে তার। তার মনে হয়- অবশেষে আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেছেন। খুশিতে সারারাত ভালো করে ঘুমাতে পারে না সে ।
খাদিজার সন্তান জন্মদানের সময় ক্রমশই এগিয়ে আসতে থাকে। যে কোন নারীর জন্যেই সন্তান জন্মদানের সময় একটি নিরিবিলি ঘর প্রয়োজন। কিন্তু মালেক ওহাবই শুধু নয়, ইরাক আল মানশিয়া গ্রামে কারোরই একটির বেশি দু’টি ঘর ছিল না। এর ফল হয়েছিল এই যে, গ্রামের একেবারে ছোট্ট ছেলেটিও যাবতীয় কিছু জেনে ফেলত। এমন কোন ব্যাপারই ছিল না যা তাদের কাছে গোপন রাখা যেত। তবে দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত লাভ করা এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে একে অন্যের সাথে আলোচনার কোন সুযোগ তারা পেত না । অথবা বলা যায়, বড়রা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিল বলেই অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এগুলোর চর্চা বা রসালো আলাপ সম্ভব হত না ।
আসন্ন সন্তান সম্ভবা খাদিজা একদিন রাতে একটি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন : চারদিক ঘন অন্ধকার। এমন সময় কে যেন তার নাম ধরে ডেকে উঠল। কণ্ঠস্বরটি কোন পুরুষের, শান্ত এবং ভরাট। এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি।
: আপনি কে? কেন আমাকে ডাকছেন? অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন খাদিজা।
: আল্লাহর ইচ্ছায় খুব শিগগিরই তোমার কোলে এক পুত্র সন্তান আসবে। অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বলে চললেন- এই ছেলেটি হবে আর সবার চাইতে আলাদা, অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
: আপনি কে? খাদিজা আবারো জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কোন উত্তর এলোনা।
অবশেষে তাকে দেখতে পেলেন খাদিজা। তিনি দেখলেন- দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী একটি মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছেন। উজ্জ্বল জ্যোতি। তাঁর মাথায় বাঁধা কাফিয়াটি দিয়ে মুখটার প্রায় সবটুকু ঢাকা। সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষের দু’হাতে একটি শিশু। নিজের অজান্তেই খাদিজা হাত বাড়িয়ে দিলেন শিশুটিকে নিজের কোলে নেয়ার জন্যে। মহাপুরুষ পরম যত্নে খাদিজার হাতে তুলে দিলেন শিশুটিকে। বলেন- খাদিজা, আল্লাহ এ শিশুটিকে তোমায় দিয়েছেন। তুমি সব সময় এর প্রতি খেয়াল রেখ। মহাপুরুষের ভরাট কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে গেল চারদিকে। কিন্তু খাদিজা আর তাঁকে দেখতে পেলেন না । তখনি ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। কানে এল গ্রামের মসজিদ থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের গলায় ভোরের সুমধুর আজানের ধ্বনি ।
সকাল বেলায় মালেক ওহাব, ইউসুফ মালিক এবং আহমদ খলিলকে নাস্তা দিতে গিয়ে স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল খাদিজার। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বলে গেলেন তিনি । তারপর স্বামীকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়লেন মালেক ওহাব
: আমি কি করে জানব এ স্বপ্নের অর্থ। তবে স্বপ্ন স্বপ্নই। তা কখনো সত্য হয় না। মালেক ওহাবের কথা শেষ হতেই কথা বলে উঠলেন ইউসুফ মালিক-
: স্বপ্নে আপনি নবী করিম (স) কে দেখেছেন। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই । তিনি যখন কাউকে স্বপ্নের মধ্যে দেখা দেন তখন তার মুখ একটা আবরণে ঢাকা থাকে।
মালেক ওহাবের নিষেধে খাদিজা এ দিন আর কাজের জন্যে মাঠে পেলেন না । মালেক ওহাব নিজেও ঘরেই থাকলেন। দুপুরের দিকে খাদিজা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। রাস্তায় খেলা করছিল আহমদ খলিল। বেশ কিছুক্ষণ পর ভাইয়ের জন্ম সংবাদ কানে যেতেই এক দৌড়ে ঘরে চলে আসে সে।
: আমার ভাই কোথায়? আমার ভাইকে দেখতে দাও। সে চিৎকার শুরু করল। আহমদ খলিলের চাচী হালিমা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। ধমকে উঠলেন তিনি- ঃ এভাবে চিৎকার কর না। এখন যাও, পরে দেখতে এসো ভাইকে।
ঘরের ভিতর থেকে খাদিজার ক্লান্ত গলা ভেসে এল। ছেলেকে ভিতরে যেতে দিতে বলছেন তিনি।
আহমদ খলিল ঘরের মধ্যে ঢুকতেই দেখতে পেল তার ছোট্ট ভাইটিকে। তার আম্মা দু’হাতে তুলে ধরেছেন পুতুলের মতো শিশুটিকে যাতে আহমদ খলিল ভালো করে দেখতে পায়। আহমদ খলিল ভাইকে দেখছিল। ছোট্ট অথচ স্বাস্থ্যবান, উজ্জ্বল তামাটে রং, মাথা ভরা কালো চুল। হঠাৎ করেই এ সময় তার মনে পড়ে যায় আম্মার দেখা স্বপ্নের কথা। আরো ভালো করে সে ভাইকে লক্ষ্য করতে শুরু করে। হঠাৎ তার মনে হয়, আর দশটি নবজাত শিশুর মত নয় তার ভাই। শিশুটি এখনই অদ্ভুত রকমের শান্ত এবং স্থির তার চোখ দু’টি অসাধারণ উজ্জ্বল, আর তাতে জড়িয়ে আছে যেন একরাশ মমত্ব ও সারল্য। আহমদ খলিল খুব আশ্চর্য হয়ে যায়।
ভাইয়ের আগমনে আহমদ খলিলের ছোট্ট জীবনের সবকিছুতেই পরিবর্তন ঘটে যায়। নবজাতকের নামা রাখা হয়েছে খলিফা- অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিনিধি। কিছুদিন পর খলিফাকে দেখা শোনার দায়িত্ব তার উপরেই পড়লো। মাঠের কাজে না গিয়ে উপায় ছিল না খাদিজার। ইরাক আল মানশিয়ার অধিবাসীদের জীবন ধারণের কঠোর কঠিন সংগ্রামে অংশগ্রহণ থেকে সরে থাকার কোন পথ খাদিজার ছিল না। এরপর আরো মুশকিল হল যখন শীতকালে একটু বৃষ্টিও হল না। জমিগুলো ফসলশূন্য হয়ে দীর্ঘশ্বাস এবং হাহাকার তোলে সবার মাঝে। মালেক ওহাবকে খাদ্য সংগ্রহের জন্যে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হত।
অবস্থা শেষপর্যন্ত খুবই সংকটজনক হয়ে দাঁড়াল। গ্রামের অন্য পরিবারগুলোর মতো মালেক ওহাবের সংসারটিও প্রায় অচল হয়ে পড়ল। বৃষ্টি ছাড়া মাঠ থেকে ফসল পাবার কোন উপায় ছিল না। তাই মালেক ওহাব সম্পূর্ণরূপে ঘরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। খাদিজা ঘরের তাঁতে যে কাপড় বুনতেন সেগুলো গাজাতে নিয়ে বিক্রি করে পাওয়া অর্থই ছিল সংসার চলার একমাত্র উপায়। ফলে দুর্বল শরীরের আহমদ খলিল নিয়মিত পুষ্টিকর খাবারের অভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত এমন হল যে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে যাওয়া কিংবা সঙ্গীদের সাথে খেলতে যাবার শক্তিটুকুও তার রইল না ।
আবার শীত এসে গেছে। প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে এবার। চারদিকের ধূসর প্রান্তর ইতিমধ্যেই সবুজের চাদর গায়ে হেসে উঠেছে। মরুভূমির ঝাঁঝালো গরম হাওয়ায় ঠাণ্ডার আমেজ। সূর্যের আলো সারা গায়ে ছড়িয়ে দেয় আরামের মধুর পরশ। মাঠে ফসলের অবস্থা খুবই ভালো। ইরাক আল মানশিয়ার মানুষগুলোর জীবনে আবার স্বস্তি ও আনন্দের ছোঁয়া লেগেছে।
ঘরের বাইরে দেয়ালে হেলান দিয়ে জোরে জোরে খবরের কাগজ পড়ছিলেন মালেক ওহাব। তাকে ঘিরে আছে কয়েকজন শ্রোতা। ইউসুফ মালিক এবং মনসুরও ছিলেন তাদের মধ্যে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিল আসরে। মালেক ওহাবের হাতের কাগজটি ছিল প্রায় এক মাসের পুরনো। ইরাক আল মানশিয়ার মতো গ্রামে খবরের কাগজ পাওয়ার ব্যাপারটি ছিল এক আশ্চর্যপ্রায় ঘটনা। মালেক ওহাব কিভাবে খবরের কাগজ পেতেন এটি ছিল সবার কাছেই এক রহস্যের ব্যাপার।
আহমদ খলিল তার আব্বার খবরের কাগজ পাঠ এবং লোকদের আলাপ-আলোচনা থেকে বুঝল- এখান থেকে বহুদূরে শীতপ্রধান দেশগুলোতে যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধের কারণ তার জানা ছিল না। সে উঠে গিয়ে মালেক ওহাবের পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁধের উপর দিয়ে উকি মেরে খবরের কাগজটি দেখতে থাকল। একটি ছবির উপর চোখ আটকে যায় তার। এ লোকটির ছবি আগেও দেখেছিল সে। লোকটি হলেন উইনস্টন চার্চিল, ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী। লন্ডনে জার্মানরা বোমা ফেলেছে। এ প্রেক্ষিতে ইংরেজদের উদ্দেশ্যে চার্চিলের দেয়া ভাষণের আরবী অনুবাদ পড়ছিলেন মালেক ওহাব। এরপর আরেকটি ফটো এবং তাঁর বিবরণ পড়ে শোনালেন তিনি। এ ফটোটি ছিল হাজী আমিন আল হুসাইনী এবং এডলফ হিটলারের মধ্যকার বৈঠকের একটি দৃশ্য। তারা দু’জনে একটি সোফায় পাশাপাশি উপবিষ্ট অবস্থায়ই ফটোটি তোলা হয়েছে।
কাগজ পড়া বন্ধ করে কথা বলে উঠলেন মালেক ওহাব :
: হিটলার আমাদের বন্ধু। জার্মানরা যদি যুদ্ধে জিতে যায় তবে ইহুদীরা ধ্বংস হয়ে যাবে। ইংরেজদের ম্যাণ্ডেটের কোন দাম তখন থাকবে না। এর ফলে ফিলিস্তিন একটি আরব রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করবে।
: না, এতে কোন লাভই হবে না। প্রতিবাদ করলেন ইউসুফ মালিক। তিনি বললেনঃ এতে শুধু শাসকের বদল হবে মাত্র। মালেক ওহাবের দিকে তাকালেন তিনি- কেন, আপনি কি জার্মানদের অত্যাচারের কথা ভুলে গেলেন ! হিটলার লোকটি ভয়ানক নিষ্ঠুর। ওরা যেস্থানই দখল করছে সেখানেই চলছে, হত্যা, নির্যাতন এবং সন্ত্রাস। নারী এবং মাসুম বাচ্চাদের হত্যা করতেও ওদের হাত কাঁপেনা। তাছাড়া ওরা যে শুধু ইহুদীদেরই হত্যা করেছে তা তো নয়। ওদের অত্যাচার থেকে কেউই আসলে রেহাই পাচ্ছে না। কুখ্যাত বন্দীশিবিরগুলোর কথা তো আপনি শুনেছেন। তাই, আমার মনে হয়, আপনার ধারণা ভুল। হিটলার আমাদের শত্রু। আর তা এ কারণে যে আজ বন্যাস্রোতের মতো ফিলিস্তিনে ইহুদী আগমনের জন্যে মূলতঃ সেই দায়ী। সে যদি ইহুদীদের অপরাধের জন্যে উপযুক্ত ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা নিত তবে এভাবে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ
করে আমাদের জায়গায় এসে চেপে বসার প্রয়োজন হত না ।
: আচ্ছা ফিলিস্তিনেও কি যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে? তোমার কি মনে হয়! মনসুর প্রশ্ন করেন। অনাগত বিপদের আশংকায় তার মুখটি কালো হয়ে উঠেছে। আমি শুনেছি, মিসরে ইতিমধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তাছাড়া ইদানিং জার্মানদের স্বস্তিকাচিহ্ন অংকিত যুদ্ধ বিমানগুলো আমাদের এলাকার উপর দিয়েই উড়ে যাচ্ছে। তোমাদের কি মনে হয়, জার্মানরা শীঘ্রই এদিকে আসবে? মনসুরের গলায় জিজ্ঞাসা।
: একমাত্র আল্লাহই জানেন কি হবে। হতাশ গলায় বললেন ইউসুফ মালিক।
এর পরপরই আসর ভেঙ্গে গেল। সবাই চলে গেল যে যার ঘরে।
দুপুর বেলায় আহমদ খলিলকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন খাদিজা। খুবই ক্লান্ত মনে হল তাকে। খাদিজা তাকে জাগানোর জন্যে কয়েক বার ঝাঁকুনি দিলেও ঘুম ভাঙল না তার। বিরক্ত হয়ে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করলেন খাদিজা। মালেক ওহাব মাঠে গিয়েছিলেন একা। আহমদ খলিল তাকে সাহায্য করতে না গেলে খুবই অসুবিধায় পড়বেন তিনি। এ সময় জোর ধাক্কায় জেগে ওঠে আহমদ খলিল। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে যন্ত্রণায় কাত্রাতে থাকে সে।
খাদিজা অবাক হয়ে তার মাথায় হাত রেখেই চমকে উঠলেন। একি! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে আহমদ খলিলের। বুকটা কেঁপে ওঠে তার। ঘরের এক কোণ থেকে কয়েকটি ময়দার বস্তা এনে সুন্দর করে বিছিয়ে মোটামুটি নরম একটি শয্যা তৈরি করে ছেলেকে তার উপর সযত্নে শুইয়ে দেন তিনি। এরপর কাপড় ভিজিয়ে কপালে পানি-পট্টি দিতে শুরু করেন।
মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল আহমদ খলিলের। তার মনে হচ্ছিল যে মাথাটা যে কোন মুহূর্তে বোধ হয় ছিঁড়ে অথবা ফেটে যাবে। যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল তার । কিন্তু, মা রেগে যাবেন মনে করে মুখ বুজে সহ্য করতে থাকল সে। এ সময় জোহরের নামাজের আযান কানে ভেসে আসে। হঠাৎ করেই তার মনে হয়- মাথার অসহ্য যন্ত্রণাটি অনেকখানি যেন কমে গেছে ।
আযানের আওয়াজে উঠে গিয়েছিলেন খাদিজা। অযু সেরে এসে নামাযে দাঁড়ান তিনি। এক অদ্ভুত আত্মমগ্নতা লক্ষ্য করে আহমদ খলিল তার মায়ের মধ্যে। নিবিষ্ট মনে মায়ের রুকুতে যাওয়া, সিজদায় নত হওয়া, আবার উঠে দাঁড়ানো- সবকিছুই লক্ষ্য করছিল সে। অন্যান্য দিনগুলোর চেয়ে আজকে অনেক সময় ধরে মাকে মোনাজাত করতে দেখে একটু অবাকই হয় সে।
রাত অনেক হয়ে গেছে। আহমদ খলিলের জ্বর ক্রমশই বেড়ে চলেছে। দেয়ালের একটি খাজের মধ্যে রাখা বাতি থেকে ঘরখানায় হলুদাভ আলো ছড়িয়ে পড়ছে। পাংশু মুখে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন মালেক ওহাব। অনেক চেষ্টা করেও ঘুম আসছিল না আহমদ খলিলের। হঠাৎ তার মনে হলো, ঘরের মধ্যে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। সে আগুনের প্রচণ্ড উত্তাপে গলা শুকিয়ে আসে তার। তার মনে হলো, পানির অভাবে বুকটা ফেটে যাবে। পানি পানি- বলে চিৎকার করে ওঠে সে।
প্রায় সাথে সাথেই একটি কোমল হাতের মমতা মাখানো ছোঁয়া পায় আহমদ খলিল। হাতটি ছিল তার মায়ের। ছেলের পানির পিপাসা লেগেছে বুঝতে পেরে তাকে পানি খাইয়ে দেন খাদিজা।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত