ছয় :
মালেক ওহাব খাদিজাকে ডাকছিলেন।
আহমদ খলিল দেয়ালের গা ঘেঁষে ঘুমিয়েছিল। আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে সে শুনলো, মালেক ওহাব তার মায়ের নাম ধরে ডাকছেন।
: খাদিজা ! খাদিজা! তুমি কোথায়? মালেক ওহাবের ডাক ঘরের পাথরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
মনসুর উঠে আসেন। তার বিশাল হাতটি গভীর সহানুভূতির সাথে মালেক ওহাবের কাঁধে রেখে বলেন : ভাইজান, খাদিজা আর আমাদের মধ্যে নেই। আজ থেকে দু’প্তাহ আগে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আপনি এবং আহমদ খলিল তখন এত অসুস্থ যে আপনাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। হালিমার প্রাণপণ সেবায় আপনারা এখন অনেকটা ভালো হয়ে উঠেছেন। তবে আমরা খাদিজার দাফনের ব্যাপারে কোন গাফলতি করিনি । শেষ ইচ্ছানুসারে খাদিজাকে তার আব্বা ও ভাইদের কবরের পাশেই দাফন করা হয়েছে।
মালেক ওহাব অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলেন না। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে উঠলেন : না! না! আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। এ হতে পারে না। খাদিজার বয়স মাত্র ছাব্বিশ বছর। এতো অল্প বয়সে সে মরতে পারে না। আমি চিৎকার করে ডাকলে সে নিশ্চয়ই সাড়া দেবে ।
মনসুর গভীর মমতায় মালেক ওহাবকে জড়িয়ে ধরে বলেন : ভাইজান, আপনি শত চিৎকার করলেও খাদিজা আর ফিরে আসবে না। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, আবার তাঁর কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। এটা যে আল্লাহরই নিয়ম। দুঃসহ হলেও এ সত্য আমাদের মেনে নিতেই হবে।
: না না । অদম্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মালেক ওহাব। পাথরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে তার আক্ষেপ। আহা! আমরা যদি মূর্খ না হয়ে শিক্ষিত হতাম, যদি গ্রহণ করতাম আধুনিক জীবনযাত্রা তবে কিছুতেই এ রকম ব্যাপার ঘটতে পারত না। নেগবায় ইহুদী বসতির লোকেরা কি এভাবে অসুখে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়? আমাদের মধ্যে শুধু অভাব আর অভাব। অভাব ছাড়া আমাদের আর কিছুই নেই। আমাদের কী জীবন আর তাদের কি জীবন! এক ফোঁটা পানির জন্যে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় আর তাদের খাবার, রান্নার এবং গোসলের পানির কোন অভাব নেই । এই কি আল্লাহর ইচ্ছা? আমি এ জায়গাকে ঘৃণা করি। ভীষণ ঘৃণা করি । প্রচণ্ড উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকেন তিনি। অবশেষে তার ক্লান্ত শরীর মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
: ভাইজান, নিয়তির বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করতে পারিনা। আপনি খুবই দুর্বল। একটু সবর করুন। একটু শান্ত হোন। আপনার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন।
: বিশ্রাম! কিসের বিশ্রাম। আমি এভাবে আর ফাঁদে আটকা পড়ে মরতে চাইনা । আমি এখনি আমার সন্তানদের নিয়ে এখান থেকে শহরে চলে যাচ্ছি।
আহমদ খলিল এবং খলিফাকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হন মালেক ওহাব। : ভাইজান, আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন? টাকা-পয়সা ছাড়া আপনি শহরে থাকবেন কি করে?
: আমি খুব ভালোভাবেই শহরে থাকতে পারব। মালেক ওহাবের চোখেমুখে দৃঢ়তা । আরবীর মতোই আমি ইংরেজি ও তুর্কীভাষা যথেষ্ট ভালো জানি। মাধ্যমিক এবং অনার্স পরীক্ষা পাশ করার সময় এ ভাষাগুলো আমাকে শিখতে হয়েছিল।
মালেক ওহাব ঘরের কোণায় রাখা তার ট্রাংকটার কাছে গিয়ে তালাটা খুলে ফেললেন। বিজয়ীর মতো তিনি একটি জড়ানো পার্চমেন্ট কাগজ বের করে এনে তার ভাঁজ খুলে ভাইয়ের চোখের সামনে মেলে ধরেন –
: দেখ, দেখ, এই যে আমার সার্টিফিকেট। সরকারী চাকুরী করার যোগ্যতা আমার আছে। আর তা যদি নাও হয় তবে অন্ততঃ কোন স্কুলে শিক্ষকতা তো করতে পারব? যাই হোক, আমি আর এখানে থাকছি না। আমার সন্তানদের জীবনকে এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে দেব না। মালেক ওহাবের গলার স্বর প্রতিজ্ঞায় কঠিন হয়ে ওঠে।
: ভাইজান, আজ তের বছর ধরে আপনি আমার সাথে রয়েছেন। আর আজ 1 মনসুরকে কথা শেষ করতে দিলেন না মালেক ওহাব। বললেন : হ্যাঁ ছিলাম। থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। কারণ খাদিজার আব্বা আমাকে শহরে যেতে দেননি। যদি আমি শহরে থাকতাম, তবে আমার সাতটি সন্তানই আজ সুস্থ সবলভাবে বেঁচে থাকত। কিন্তু খাদিজা তার আব্বার কথা শুনে কখনোই শহরে যেতে রাজি হয়নি। এ ব্যাপারে কিছু বললেই সে বলতো – এটা আমার জন্মভূমি। এ জায়গা ছেড়ে আমি কিছুতেই যাব না। এ ব্যাপারে তার বড় বোনের সঙ্গে খাদিজার যে কত পার্থক্য ছিল।
মালেক ওহাব মনসুরকে বলছিলেন : তোমার কি মনে নেই যে খাদিজার বোন গোপনে এক ইহুদী সৈন্যের প্রেমে পড়েছিল? ইহুদী মেয়েরা খুব জাঁহাবাজ। ওরা পুরুষদের মতো চুল কাটে, থাকি শার্ট গায়ে দেয়, খাকি প্যান্ট কিংবা শর্টস পরে। ওদের মধ্যে লালিত্য, কমনীয়তা নেই বললেই চলে। সে তুলনায় আমাদের মেয়েরা অনেক বেশি আকর্ষণীয়া। খাদিজার বোন হঠাৎ করেই সে ইহুদীটার প্রেমে পড়ে গেল ।
খাদিজার আব্বা ব্যাপারটা সম্পর্কে শুনলেও সত্য প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছিলেন না। অবশেষে সেই দিন এল। আমার চোখে এখনো স্পষ্ট হয়ে ভাসে সে দৃশ্যের কথা। খাদিজার বোন এবং তার প্রেমিক ইহুদী সৈনিকটি মাঠের মধ্যে ধরা পড়ে গিয়েছিল। এরপর ইউসুফ মালিক এবং খাদিজার আরো দু’ভাই ওদের দু’জনকে ছুরি মেরে হত্যা করে। শেখ তার বিশ্বাসঘাতিনী মেয়েকে কবর পর্যন্ত দিতে রাজি হননি। খোলা প্রান্তরে ওদের যুগল মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে লোকজন। তবে এরপর আর কোন ইহুদী কোনদিন আমাদের কোন মেয়ের দিকে নজর দেয় নি।
আহমদ খলিল অবাক হয়ে শুনছিল। তার মা তাকে কোন দিন এ ব্যাপারে কিছু বলেননি কিংবা ভুলেও কখনো তার খালার কথা উচ্চারণ করেন নি। তবে এ ঘটনা নিশ্চয়ই তার জন্মের পূর্বের বলেই আহমদ খলিলের মনে হয় ।
মালেক ওহাব মনসুরকে বলে চলেছেন খাদিজা ছিল তার বাপের ছোট মেয়ে। হয়ত ছোট বলেই সে ছিল শেখ ইবরাহিমের নয়নের মণি। বড় বোনের কেলেঙ্কারির ঘটনার ফলে কেউ খাদিজাকে হয়ত বিয়ে করতে চাইবে না— এ জন্য শেখ খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় আমি খাদিজাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলে তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন। আমার গায়ের রং কালো এবং এক সময় আমি ক্রীতদাসের জীবন যাপন করলেও তিনি কোন আপত্তি করেন নি। তবে আমার সাথে বিয়ে দেয়ার কারণে এবং বড় মেয়ের ব্যাপারে সমাজে তার যথেষ্ট সম্মানহানি ঘটেছিল। দারিদ্রের কারণে আমাদের বিয়ে হয়েছিল একেবারে সাদামাটা ভাবে। তোমার কি মনে পড়ে যে ইউসুফ মালিক এবং তুমি এ বিয়েতে সাক্ষী হিসবে উপস্থিত ছিলে? মালেক ওহাব মনসুরের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করেন । বলে চলেন তিনি : এ বিয়েতে কোন উৎসব এবং খাওয়া-দাওয়া হয়নি। তখন আমি ছিলাম ত্রিশ বছরের এক পরিণত যুবক, আর খাদিজা ছিল তের বছরের এক কিশোরী মাত্র। খাদিজার মত স্ত্রী পাওয়া যে কোন লোকের জন্যেই সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, আমি চেয়েছিলাম একজন আধুনিক, শিক্ষিত স্ত্রী। আমি কোনদিন খাদিজাকে বুঝতে পারিনি। সে জীবনধারার পরিবর্তনকে ভয় করত। আধুনিকতার ছিল প্রচণ্ড বিরোধী। সে নিজেও কোনদিন আমাকে বুঝতে পারেনি। সমুদ্রের এপার এবং ওপারের মধ্যে যেমন ব্যবধান; নতুন এবং পুরনোর মধ্যে যেমন ফারাক – তেমনি ব্যবধান ছিল আমার এবং খাদিজার মাঝে। আমি জানিনা, এ সত্ত্বেও কেন তাকে আমি এত গভীরভাবে ভালোবাসতাম । হয়তো বা সে অতুলনীয়া সুন্দরী ছিল বলেই। কিন্তু আমি তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছি, তার সাথে সংসার করেছি-আর এটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল … ।
রাত নেমে আসে। সমস্ত ঘর ঢাকা পড়ে যেতে থাকে আঁধারের কালো আবরণে। গ্রামের মসজিদ থেকে এক সময় এশার আজান শোনা যায়। কিন্তু আজ আজানের ধ্বনি আহমদ খলিলের কাছে কোন মাধুর্য বয়ে আনে না। নিজেকে তার বড় একা এবং অসহায় মনে হয় । মাকে বড় ভালোবাসত সে। প্রিয়তম নানাও আজ তার পাশে নেই। আব্বাকে কোন দিনই তার খুব একটা আপন মনে হয়নি সে তাকে কোনদিন ভালোবাসতে পারেনি। তার মা-ই ছিল তার সব কিছু, তার কাছেই সে খুঁজে পেত আশ্রয় । তার মনে হয়, তার আব্বা তাকে যেভাবে গড়ে তুলতে চান সেরকম হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় ।
আহমদ খলিলের বুক ফেটে কান্না আসে। সে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। সে কান্নার শব্দ কারো কানে পৌঁছে না। কেউ তাকে একটু সান্ত্বনা দিতেও এগিয়ে আসে না। আহমদ খলিল উপলব্ধি করে, সে যাদের গভীর ভাবে ভালোবাসত তাদের কেউই বেঁচে নেই । এমন কেউ নেই যে আজ তাকে ভালোবাসবে, আদর করে বুকে টেনে নেবে। এই বিশাল পৃথিবীতে আজ সে একা, সম্পূর্ণ একা।