proggapath, progga, bangla literature, bangla kobita, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, classic novel, মরিয়ম জামিলা, Maryam Jamila, ফিলিস্তিনের আকাশ, philistiner akash

ফিলিস্তিনের আকাশ

০ মন্তব্য দর্শক

সাত

ইরাক আল মানশিয়ার মানুষেরা আগে কোনদিন এরকম অবস্থায় পড়েনি। হঠাৎ করে সংক্রামক জ্বর মহামারী আকারে গ্রামের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। অবাক ব্যাপার যে, আশে-পাশে আর কোথাও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি। ইরাক আল মানশিয়ার এ এ মহামারী যাতে অন্যত্র ছড়িয়ে না পড়তে পারে সেজন্য গাজার বৃটিশ গভর্ণরের গৃহীত ব্যবস্থা গ্রামবাসীদের দুর্দশা আরো বেশি বাড়িয়ে তোলে। বাইরের সাথে যোগাযোগের সমস্ত পথই বন্ধ করে দেয়া হল। এমন কি সামান্যতম করুণা দেখাতেও ঔষধপত্র কিংবা কোন ডাক্তারকে তারা ইরাক আল মানশিয়ায় পাঠাল না। গ্রামবাসীরা নিজেদের চেষ্টায় বাইরে থেকে যে কাউকে আনাবে তারও কোন উপায় রইল না।
ইহুদীরা এমনিতেই ফিলিস্তিনীদের দু’চোখে দেখতে পারত না। বহু সংঘর্ষে তারা হার মেনেছে। তাদের বহু লোকও নিহত হয়েছে গ্রামের লোকদের সাথে লড়তে এসে ইহুদীরা তা ভোলেনি। এক সময় তারা পুরো গ্রামটিকেই সমূলে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু বৃটিশরা অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারী করায় ইহুদীরা তাদের একান্ত ইচ্ছেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারছিল না। এ সময়েই এল মহামারী খবরটা কানে পৌঁছতেই উল্লসিত হয়ে উঠল তারা। মূল্যবান গোলাগুলী খরচ এবং তারও চেয়ে বেশি মূল্যবান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামবাসীদের উৎখাত করার চেয়ে ভয়ঙ্কর রোগেই যদি সব কিছু শেষ হয়ে যায় তা হলে আর চাই কি! ইহুদীরা গভীর আগ্রহ নিয়ে ইরাক আল মানশিয়ার অসহায় মানুষগুলোর করুণ মৃত্যু দেখতে লাগলো। এক সময় মহামারীর তাণ্ডবলীলা আপনা আপনিই থেমে গেল বটে- তবে গ্রামের এক তৃতীয়াংশেরও বেশী মানুষের মুল্যবান জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে গেল।
দিনের পর দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বন্যাস্রোতের মতো ইহুদীরা আসছে তো আসছেই। ইরাক আল মানশিয়ার প্রায় চারদিক ঘিরেই তারা বসতি বানানোর কাজ শুরু করেছে। গ্রামবাসীরা স্পষ্ট অনুভব করে, লোভী ইহুদীদের ক্ষুধা নিবৃত্ত হওয়ার নয়। ওদের জমি চাই, আরো জায়গা চাই। তাদের ক্ষুধার শেষ নেই। কিন্তু এটা বুঝেও ইরাক আল মানশিয়ার লোকদের কিছু করার ছিল না। মহামারী তাদের মেরুদণ্ডটা একেবারে শুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ইহুদী দখলদারদের সাথে লড়ার মতো মনোবল বা শক্তি আর তাদের ছিল না।
আহমদ খলিলের ছোট ভাই খলিফার বয়স এখন দু’বছর। কিন্তু আহমদ খলিল অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, তার শিশু ভাইটি একটু যেন অন্যরকম। খলিফা কোন সময় হাসে না। সারাদিন দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে। নিশ্চুপ, নির্বিকার। আশে পাশে যা কিছুই হোক, সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। মালেক ওহাবের মনে খলিফার বেঁচে থাকার ব্যাপারে কোন আশা ছিল না। তার করুণ আর্তিভরা চোখের দিকে তাকালেই তার বুকের মধ্যে একটা ব্যথা জেগে ওঠে। তার বুক ভেঙ্গে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে-আহা! আজ যদি খাদিজা বেঁচে থাকতো!
আহমদ খলিল তার চাচাতো-মামাতো ভাই-বোনদের সাথে মাঠে এসেছিল। তাদের সাথে ভেড়া আর ছাগলের পাল। অবোধ পশুর পাল নিয়ে খোলা প্রান্তরে চরাতে এসে আহমদ খলিলের খুশি উপচে পড়ছিল। কাজটা তার ভারি পছন্দের। এর তুলনায় ঘরে বসে লেখা-পড়া করাটা নিতান্তই বিরক্তিকর বলে মনে হয়। পশুর পাল নিয়ে মাঠে আসা মানেই যেন স্বাধীন জীবনের স্বাদ পাওয়া। মাথার ওপরে খোলা আকাশ । যতদুর দু’চোখ যায় উধাও প্রান্তর আর মুক্ত হাওয়া তাকে পাগল করে তোলে। এখানে মালেক ওহাবের শাসন নেই, গলা খুলে চেঁচামেচিতে কেউ বাধা দেবার নেই-এর চেয়ে ভাল কিছু আহমদ খলিল আর কল্পনা করতে পারে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনাবিল আনন্দময় একটা দিনের সন্ধান পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে সে।
প্রান্তরে ছুটোছুটি করতে করতে আহমদ খলিলের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি আসে । প্রান্তরের শেষ সীমার দিকে তাকায় সে। এ মালভূমির যেখানে শেষ সেখান থেকে নেগবার সীমানা শুরু। অর্থাৎ, এ মালভূমিটাই ইরাক আল মানাশিয়াকে নেগবা থেকে আলাদা করে রেখেছে। নেগবা হলো ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদীদের বড় ঘাঁটির একটি। কথাটা মনে হতেই ঘৃণা এবং প্রতিশোধের ইচ্ছার এক শিহরণ বয়ে যায় তার সারা শরীরে। কিন্তু কিশোর আহমদ খলিল খুব ভাল ভাবেই জানে, তার করার কিছুই নেই । আর তখনি বুদ্ধিটা মাথায় আসে তার। আর কিছু না হোক, একটা নতুন খেলার আয়োজন তো করা যেতে পারে।
আহমদ খলিল তার সাথীদের ডাকে, মাথায় গজিয়ে ওঠা নতুন খেলাটার কথা সে জানায় তাদের। এখান থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে নেগবার সীমানার মধ্যে একটা উঁচু মতো টিলা। তার ওপাশে যেন লুকিয়ে আছে ইহুদী হানাদাররা। আমরা ওদের সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি-পরিকল্পনাটা বেশ ব্যাখ্যা করে সবাইকে বুঝিয়ে দেয় সে। তারপরই কচি কণ্ঠের রণহুঙ্কারে প্রান্তর কাঁপিয়ে ছুটে চলে চার শিশু সৈনিক টিলার দিকে ইহুদী শত্রুর সন্ধানে।
হাঁপাতে হাঁপাতে টিলার ওপরে উঠতেই চিৎকার করে উঠে রশিদ-দেখ দেখ, ইহুদীরা সত্যিই রয়েছে এখানে। রশিদের কথায় ঘাড় ফেরাতেই আহমদ খলিল নিজেও একটু চমকে ওঠে । আরে তাই তো! তাদের বয়সী একদল ইহুদী ছেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে। তাদের পরনে শর্টস, গায়ে নীল শার্ট আর পিঠে ঝোলানো ন্যাপস্যাক। আহমদ খলিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে-তাদের কাছে কোন অস্ত্র আছে কিনা। সে শুনেছে, দখলদার ইহুদীরা শিশু-কিশোরদের নিয়ে একটা প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেছে। তার নাম ‘পাদনা’। এরা ‘গাদনার’ সদস্য কিনা তা বোঝার জন্যে তাদের গায়ের শার্টগুলোতে পরিচয় চিহ্ন খুঁজতে থাকে সে। অবশেষে নিশ্চিন্ত হয়। না, এরা স্কুলগামী শিশুর দল। টিলার নীচের রাস্তা দিয়ে ওরা একের পর এক লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। সবারই হাতে চকলেট বার কিংবা ফল দেখতে পায় আহমদ খলিল । নিশ্চিন্ত মনে খেতে খেতে, হাসতে হাসতে সুখী সুন্দর শিশুগুলো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। দলের মধ্যে কেউ কেউ এতো ছোট যে, তার গায়ের উজ্জ্বল গোলাপী আভাটি পর্যন্ত এখনো মিলায়নি। আহমদ খলিলের মনটা হঠাৎ করে গভীর বিষাদে ছেয়ে যায়। ওই শিশুগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেদের দুর্দশাভরা জীবনের ছবিটি মূহূর্তে তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।
ইহুদী শিশুগুলো টিলার ওপর দাঁড়ানো আরব শিশুদের দেখতে পেয়েছিল। আহমদ খলিলদের দিকে তাকিয়ে বন্ধু সুলভভাবে হাত নাড়াতে শুরু করে তারা । কেউ কেউ চলা থামিয়ে ওদের হাসিমুখে ডাকতে থাকে নেমে আসার জন্যে। কিন্তু ওরা কোন উত্তর দেয় না। এ সময় ইহুদী শিশুদের দু’একজন হঠাৎ করেই বিদ্রূপ করতে শুরু করে। ক্ষেপে ওঠে আহমদ খলিল। চটপট কয়েকটা ছোট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ইহুদী শিশুগুলোর দিকে ছুঁড়তে শুরু করে সে। সাথে সাথেই আবদুল আজিজ, আসমা এবং রশিদও যোগ দেয় তার সাথে। ভীত-চকিত ইহুদী ছেলে-মেয়েগুলো পড়িমরি করে দৌড়ে পালিয়ে যায় চোখের আড়ালে।
নেগবার এ অঞ্চলটার সাথে পরিচিত হয়ে আহমদ খলিল ভীষণ খুশী। সেই ঘটনার পর থেকে সুযোগ পেলে সে একাই এখানে চলে আসে। বলা যায়, এলাকাটার প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ জন্ম নিয়েছে তার মধ্যে। জায়গাটাও খুবই ভালো। অন্ততঃ আহমদ খলিলের তাই মনে হয়। তবে, এখানকার ইহুদীগুলো আরবদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করে না এটা স্পষ্ট বুঝেছে সে। তারা তার দিকে যখন তাকায় তখনি আহমদ খলিলের মনে পড়ে গাজার গভর্ণরের স্ত্রীর সেই ঘৃণাভরা দৃষ্টির কথা। গাজার গভর্ণরের স্ত্রী আর ইহুদীদের মধ্যে যে কোনোই পার্থক্য নেই একথাটাও বোঝা হয়ে গেছে তার।
নেগবাতে আহমদ খলিলের সবচেয়ে প্রিয় স্থান হলো ফলের বাগানগুলো। সকাল বেলায় গ্রাম ছেড়ে আসার পর সারদিন তার কাটে শহরের পথে পথে। ক্ষুধা পেলেই কোন বাগানের দিকে এগিয়ে যায় সে। কারণ বাগানগুলোর বাইরে পড়ে থাকে ফেলে দেয়া পচা এবং বেশি পাকা কমলাগুলো। সেগুলো কুড়িয়ে খেয়ে পেট ভরে যায় তার। এর মধ্যে বার কয়েক সে একটি ছোট্ট মুরগীর খামার থেকে গোটা ছয়েক করে ডিমও চুরি করে খেয়েছে কাঁচা অবস্থাতেই। মাঝে মধ্যে রাস্তায় হাঁটতে থাকলে তাকে দেখে চলন্ত কোনো ট্রাকের ড্রাইভার কি মনে করে ছুঁড়ে দেয় কখনো এক টুকরো, কখনো আস্ত একটা রুটি। বেকারীতে তৈরি এ রুটির স্বাদ বড় মজাদার। এভাবে কোন একটা রুটি পেলেই আহমদ খলিল দৌড়াতে শুরু করে গ্রামের দিকে। চাচাতো-মামাতো ভাই- বোনদের সাথে এ সুস্বাদু রুটি ভাগ করে খাওয়ার সম্ভাব্য আনন্দে নিমেষেই যেন ফুরিয়ে যায় পথের দূরত্বটুকু। তারপর সবাই মিলে মহা আনন্দে সে রুটির প্রতিটি কণার সদ্ব্যবহার করে ।
একদিন আবদুল আজিজ আহমদ খলিলকে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা, নেগবা জায়গাটা কেমন? আমাদের গ্রামের চেয়ে কি খুব বেশি ভাল?
আহমদ খলিল জানে, আব্বার কড়া নিষেধের ফলে আবদুল আজিজ কোনদিন নেগবা শহরে যায়নি। তাকে সব কথা বলে বোঝানো মুশকিল। তাই সে সংক্ষেপে উত্তর দিল ঃ খুবই ভালো, যদি তার ভিতরের জঘন্য নোংরামি তোমার চোখে না পড়ে।
বারো বছরের আবদুল আজিজের কাছে এ কথার অর্থ অবশ্য পরিষ্কার হয় না । কয়েকটি মাস পার হয়ে যায়। আহমদ খলিলের স্বাধীন মুক্ত জীবন এখন ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে এবং অবিরাম কাজের ভিড়ে বন্দী। সে তার চাচীর কাছে নিজের কাপড়- চোপড় ধোয়া এবং রান্নার কাজ শিখে নিয়েছে। তাছাড়া বসে না থেকে সারাদিনই কিভাবে কোন না কোন কাজ খুঁজে নিয়ে শেষ করতে হয়, সে শিক্ষাও চাচীর কাছ থেকে পেয়েছে। তাই দশ বছর বয়সেই কিভাবে কাজ করে দিন কাটাতে হয়-আহমদ খলিল তা শিখে ফেলেছে।
একদিন মাগরেবের নামাজ পড়া শেষ করেই আহমদ খলিল এক দৌড়ে চলে আসে মামার বাড়িতে। আবদুল আজিজ রাতের জমে ওঠা আঁধারে চুপ করে শুয়েছিল ঘরের এক কোণে। ক’দিন থেকেই সে অসুস্থ। থেকে থেকে কাশির দমকে কেঁপে উঠছিল সে। এ সময় আহমদ খলিলকে দেখে খুব খুশি হয় আবদুল আজিজ ।
: চল, ছাদে যাই আমরা। আবদুল আজিজ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। কিন্তু ছাদে উঠতে পারে না সে। শরীরে শক্তি নেই। ভাঙ্গা কাঠের সিঁড়ি বয়ে তাকে ছাদে নিয়ে যায় আহমদ খলিল।
ইরাক আল মানশিয়ায় রাত নেমেছে। বহুদূরে আঁধারে ঢাকা নেগবার প্রান্তর । আকাশে তারার মেলা। নিঃস্তব্ধ চারদিক। দূরের মরুভূমি থেকে বইতে শুরু করেছে ঝিরঝির বাতাস। সে বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায় তাদের। পাশাপাশি চুপচাপ শুয়ে থাকে দু’জনে ।
এক সময় কথা বলে আহমদ খলিল : আচ্ছা, আমরা সেদিন যে ইহুদী ছেলে- মেয়েদের দলটার ওপর পাথর ছুঁড়লাম, ওরা যদি আসলেই ‘গাদনা’র সদস্য হতো তা হলে? : তুমি তো এখন শুধু পাথর ছুঁড়ছ- আবদুল আজিজের গলায় প্রাপ্তবয়স্কদের গভীরতা, তুমি যখন বড় হবে তখন আর পাথর নয়, তখন তোমাকে ছুঁড়তে হবে রাইফেলের বুলেট।
একটু থামে আবদুল আজিজ। বলে- খুব শিগগিরই যুদ্ধ শুরু হবে। আমি জানি – যুদ্ধ একটা হবেই। তখন যে কি হবে।
এর কদিন পরই জ্বরে ইন্তেকাল করে আবদুল আজিজ।
দীর্ঘ শীতের দিনগুলো শুরু হয়েছে। ইরাক আল মানশিয়ার লোকদের ঘরে বন্দী হয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। প্রবল বৃষ্টির ফলে গ্রামের রাস্তাগুলো এক হাঁটু কাদার নীচে ডুবে আছে । মাঠেও তেমন কোন কাজ নেই। মালেক ওহাবের মনে হয়, এখনই উপযুক্ত সময়। আহমদ খলিলকে লেখা পড়া শেখানোর কাজটা শুরু করতে হয় এবার। তিনি গাজা থেকে সুন্দর এবং স্পষ্ট ছাপার একখানা কুরআন শরীফ এবং বার বার লেখা ও মোছায় রং চটে যায় না- এরকম একটা যুৎসই ব্ল্যাকবোর্ডও নিয়ে এলেন।
বারবার ডেকেও আহমদ খলিলের কোন সাড়া পাচ্ছিলেন না মালেক ওহাব। অবশেষে আহমদ খলিল ভীতসন্ত্রস্ত ভাবে এসে হাজির হয় তার আব্বার সামনে। সে বুঝে উঠতে পারছিল না, তার আব্বা তার কাছে কি চান।
: শোন- মালেক ওহাবের গম্ভীর গলা শোনা যায় এখন তো করার মতো কোন কাজ নেই। এ ফাঁকে তোমার লেখাপড়ার কাজটা শুরু করে দাও। আমি তোমাকে সব কিছু শিখিয়ে দেব।
আহমদ খলিল অবিশ্বাস ও সন্দেহের চোখে তার আব্বার দিকে তাকায়। সে জানে, তার মাঠে কাজ করার ব্যাপারটি তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। তিনি চান, আহমদ খলিল লেখা-পড়া শিখে বড় হোক এবং শহরে গিয়ে জীবন যাপন করুক। এজন্য তিনি ছেলেকে আধুনিক স্কুলে ভর্তি করতে আগ্রহী। কিন্তু আহমদ খলিলের এ ব্যাপারে কোন আগ্রহই নেই। ইরাক আল মানশিয়া এবং নেগবার মালভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই। তবে সে বোঝে, আব্বার তুলনায় সে একেবারেই অজ্ঞ এবং মূর্খ । আর সে সময় হঠাৎ করেই তার মনে হয়; পৃথিবীতে বহু কিছু জানার আছে আর তা জানতে পারলে তারই জ্ঞানের ভান্ডার বৃদ্ধি পাবে। কুরআন পাঠ করতে শেখা এবং এর অর্থ জানার জন্যে তার মনে তখনই এক অদম্য আগ্রহ জেগে ওঠে। তার মনে হয়, তাকে হাদীস পড়তে হবে, আদর্শ সৃষ্টিকারী সাহাবাদের জীবন কাহিনী জানতে হবে, জানতে হবে অন্যান্য নবীদের কথা, এমনকি ইহুদী ও বৃটিশদের ইতিহাসও। আর এগুলো জানার জন্যেই সে আজ থেকেই লেখা পড়া শিখবে। আর এতে কোন ফাঁকি দেবেনা বলে মনে মনে শপথ নেয়।
মালেক ওহাব ছেলের ওপর অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে বিসমিল্লাহ্ বলে পড়াতে শুরু করেন। প্রতিটি শব্দ তার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন এবং উচ্চারণ করেন। আহমদ খলিল তাকে অনুসরণ করে। বার বার ভুল হয়। কিন্তু অসীম ধৈর্য নিয়ে মালেক ওহাব তাকে শেখাতে থাকেন ।
ছোট্ট খলিফা প্রথম থেকেই আহমদ খলিলের পড়া লেখার বিষয়টি লক্ষ্য করছিল। তার গভীর দু’টি কালো চোখে প্রখর বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক। আহমদ খলিলের পড়াশুনা শেষ হতেই ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা আরবী অক্ষরগুলো এক এক করে উচ্চারণ করতে শুরু করে সে এবং কোন বাধা ছাড়াই নির্ভুলভাবে শেষ করে। মালেক ওহাব স্তম্ভিত বিস্ময়ে তার এই চার বছর বয়সের অসাধারণ বুদ্ধিমান সন্তানের প্রতি একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন ।
প্রথমে একটি অক্ষর। এরপর একটি অক্ষরের সাথে আরেকটি অক্ষরের সংযোগ । কয়েকটি অক্ষরে একটি শব্দ এবং কয়েকটি শব্দে একটি আয়াত। এভাবেই এক সময় হঠাৎ করেই আহমদ খলিলের সামনে পবিত্র কুরআনের কালো অক্ষরে ছাপা এতদিনের বন্ধ বাতায়নটি উন্মুক্ত হয়ে যায়। কি অদ্ভুত শিহরণ! আহমদ খলিল নির্ভুলভাবে তরতর করে পড়ে যেতে থাকে –

“সূর্য যখন নিষ্প্রভ হবে,
যখন নক্ষত্র খসে পড়বে,
পর্বতসমূহ যখন অপসারিত হবে
যখন জীবন্ত কবরস্থ করা কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল
যখন আমলনামা উন্মোচিত হবে
যখন আকাশের আবরণ অপসারিত হবে
জাহান্নামে যখন অগ্নি উদ্দীপিত হবে
এবং জান্নাত যখন নিকটবর্তী হবে
তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে সে কি নিয়ে এসেছে।”

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

ফিলিস্তিনের আকাশ

দর্শক

সাত

ইরাক আল মানশিয়ার মানুষেরা আগে কোনদিন এরকম অবস্থায় পড়েনি। হঠাৎ করে সংক্রামক জ্বর মহামারী আকারে গ্রামের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। অবাক ব্যাপার যে, আশে-পাশে আর কোথাও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি। ইরাক আল মানশিয়ার এ এ মহামারী যাতে অন্যত্র ছড়িয়ে না পড়তে পারে সেজন্য গাজার বৃটিশ গভর্ণরের গৃহীত ব্যবস্থা গ্রামবাসীদের দুর্দশা আরো বেশি বাড়িয়ে তোলে। বাইরের সাথে যোগাযোগের সমস্ত পথই বন্ধ করে দেয়া হল। এমন কি সামান্যতম করুণা দেখাতেও ঔষধপত্র কিংবা কোন ডাক্তারকে তারা ইরাক আল মানশিয়ায় পাঠাল না। গ্রামবাসীরা নিজেদের চেষ্টায় বাইরে থেকে যে কাউকে আনাবে তারও কোন উপায় রইল না।
ইহুদীরা এমনিতেই ফিলিস্তিনীদের দু’চোখে দেখতে পারত না। বহু সংঘর্ষে তারা হার মেনেছে। তাদের বহু লোকও নিহত হয়েছে গ্রামের লোকদের সাথে লড়তে এসে ইহুদীরা তা ভোলেনি। এক সময় তারা পুরো গ্রামটিকেই সমূলে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু বৃটিশরা অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারী করায় ইহুদীরা তাদের একান্ত ইচ্ছেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারছিল না। এ সময়েই এল মহামারী খবরটা কানে পৌঁছতেই উল্লসিত হয়ে উঠল তারা। মূল্যবান গোলাগুলী খরচ এবং তারও চেয়ে বেশি মূল্যবান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামবাসীদের উৎখাত করার চেয়ে ভয়ঙ্কর রোগেই যদি সব কিছু শেষ হয়ে যায় তা হলে আর চাই কি! ইহুদীরা গভীর আগ্রহ নিয়ে ইরাক আল মানশিয়ার অসহায় মানুষগুলোর করুণ মৃত্যু দেখতে লাগলো। এক সময় মহামারীর তাণ্ডবলীলা আপনা আপনিই থেমে গেল বটে- তবে গ্রামের এক তৃতীয়াংশেরও বেশী মানুষের মুল্যবান জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে গেল।
দিনের পর দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বন্যাস্রোতের মতো ইহুদীরা আসছে তো আসছেই। ইরাক আল মানশিয়ার প্রায় চারদিক ঘিরেই তারা বসতি বানানোর কাজ শুরু করেছে। গ্রামবাসীরা স্পষ্ট অনুভব করে, লোভী ইহুদীদের ক্ষুধা নিবৃত্ত হওয়ার নয়। ওদের জমি চাই, আরো জায়গা চাই। তাদের ক্ষুধার শেষ নেই। কিন্তু এটা বুঝেও ইরাক আল মানশিয়ার লোকদের কিছু করার ছিল না। মহামারী তাদের মেরুদণ্ডটা একেবারে শুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ইহুদী দখলদারদের সাথে লড়ার মতো মনোবল বা শক্তি আর তাদের ছিল না।
আহমদ খলিলের ছোট ভাই খলিফার বয়স এখন দু’বছর। কিন্তু আহমদ খলিল অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, তার শিশু ভাইটি একটু যেন অন্যরকম। খলিফা কোন সময় হাসে না। সারাদিন দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে। নিশ্চুপ, নির্বিকার। আশে পাশে যা কিছুই হোক, সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। মালেক ওহাবের মনে খলিফার বেঁচে থাকার ব্যাপারে কোন আশা ছিল না। তার করুণ আর্তিভরা চোখের দিকে তাকালেই তার বুকের মধ্যে একটা ব্যথা জেগে ওঠে। তার বুক ভেঙ্গে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে-আহা! আজ যদি খাদিজা বেঁচে থাকতো!
আহমদ খলিল তার চাচাতো-মামাতো ভাই-বোনদের সাথে মাঠে এসেছিল। তাদের সাথে ভেড়া আর ছাগলের পাল। অবোধ পশুর পাল নিয়ে খোলা প্রান্তরে চরাতে এসে আহমদ খলিলের খুশি উপচে পড়ছিল। কাজটা তার ভারি পছন্দের। এর তুলনায় ঘরে বসে লেখা-পড়া করাটা নিতান্তই বিরক্তিকর বলে মনে হয়। পশুর পাল নিয়ে মাঠে আসা মানেই যেন স্বাধীন জীবনের স্বাদ পাওয়া। মাথার ওপরে খোলা আকাশ । যতদুর দু’চোখ যায় উধাও প্রান্তর আর মুক্ত হাওয়া তাকে পাগল করে তোলে। এখানে মালেক ওহাবের শাসন নেই, গলা খুলে চেঁচামেচিতে কেউ বাধা দেবার নেই-এর চেয়ে ভাল কিছু আহমদ খলিল আর কল্পনা করতে পারে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনাবিল আনন্দময় একটা দিনের সন্ধান পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে সে।
প্রান্তরে ছুটোছুটি করতে করতে আহমদ খলিলের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি আসে । প্রান্তরের শেষ সীমার দিকে তাকায় সে। এ মালভূমির যেখানে শেষ সেখান থেকে নেগবার সীমানা শুরু। অর্থাৎ, এ মালভূমিটাই ইরাক আল মানাশিয়াকে নেগবা থেকে আলাদা করে রেখেছে। নেগবা হলো ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদীদের বড় ঘাঁটির একটি। কথাটা মনে হতেই ঘৃণা এবং প্রতিশোধের ইচ্ছার এক শিহরণ বয়ে যায় তার সারা শরীরে। কিন্তু কিশোর আহমদ খলিল খুব ভাল ভাবেই জানে, তার করার কিছুই নেই । আর তখনি বুদ্ধিটা মাথায় আসে তার। আর কিছু না হোক, একটা নতুন খেলার আয়োজন তো করা যেতে পারে।
আহমদ খলিল তার সাথীদের ডাকে, মাথায় গজিয়ে ওঠা নতুন খেলাটার কথা সে জানায় তাদের। এখান থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে নেগবার সীমানার মধ্যে একটা উঁচু মতো টিলা। তার ওপাশে যেন লুকিয়ে আছে ইহুদী হানাদাররা। আমরা ওদের সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি-পরিকল্পনাটা বেশ ব্যাখ্যা করে সবাইকে বুঝিয়ে দেয় সে। তারপরই কচি কণ্ঠের রণহুঙ্কারে প্রান্তর কাঁপিয়ে ছুটে চলে চার শিশু সৈনিক টিলার দিকে ইহুদী শত্রুর সন্ধানে।
হাঁপাতে হাঁপাতে টিলার ওপরে উঠতেই চিৎকার করে উঠে রশিদ-দেখ দেখ, ইহুদীরা সত্যিই রয়েছে এখানে। রশিদের কথায় ঘাড় ফেরাতেই আহমদ খলিল নিজেও একটু চমকে ওঠে । আরে তাই তো! তাদের বয়সী একদল ইহুদী ছেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে। তাদের পরনে শর্টস, গায়ে নীল শার্ট আর পিঠে ঝোলানো ন্যাপস্যাক। আহমদ খলিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে-তাদের কাছে কোন অস্ত্র আছে কিনা। সে শুনেছে, দখলদার ইহুদীরা শিশু-কিশোরদের নিয়ে একটা প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেছে। তার নাম ‘পাদনা’। এরা ‘গাদনার’ সদস্য কিনা তা বোঝার জন্যে তাদের গায়ের শার্টগুলোতে পরিচয় চিহ্ন খুঁজতে থাকে সে। অবশেষে নিশ্চিন্ত হয়। না, এরা স্কুলগামী শিশুর দল। টিলার নীচের রাস্তা দিয়ে ওরা একের পর এক লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। সবারই হাতে চকলেট বার কিংবা ফল দেখতে পায় আহমদ খলিল । নিশ্চিন্ত মনে খেতে খেতে, হাসতে হাসতে সুখী সুন্দর শিশুগুলো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। দলের মধ্যে কেউ কেউ এতো ছোট যে, তার গায়ের উজ্জ্বল গোলাপী আভাটি পর্যন্ত এখনো মিলায়নি। আহমদ খলিলের মনটা হঠাৎ করে গভীর বিষাদে ছেয়ে যায়। ওই শিশুগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেদের দুর্দশাভরা জীবনের ছবিটি মূহূর্তে তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।
ইহুদী শিশুগুলো টিলার ওপর দাঁড়ানো আরব শিশুদের দেখতে পেয়েছিল। আহমদ খলিলদের দিকে তাকিয়ে বন্ধু সুলভভাবে হাত নাড়াতে শুরু করে তারা । কেউ কেউ চলা থামিয়ে ওদের হাসিমুখে ডাকতে থাকে নেমে আসার জন্যে। কিন্তু ওরা কোন উত্তর দেয় না। এ সময় ইহুদী শিশুদের দু’একজন হঠাৎ করেই বিদ্রূপ করতে শুরু করে। ক্ষেপে ওঠে আহমদ খলিল। চটপট কয়েকটা ছোট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ইহুদী শিশুগুলোর দিকে ছুঁড়তে শুরু করে সে। সাথে সাথেই আবদুল আজিজ, আসমা এবং রশিদও যোগ দেয় তার সাথে। ভীত-চকিত ইহুদী ছেলে-মেয়েগুলো পড়িমরি করে দৌড়ে পালিয়ে যায় চোখের আড়ালে।
নেগবার এ অঞ্চলটার সাথে পরিচিত হয়ে আহমদ খলিল ভীষণ খুশী। সেই ঘটনার পর থেকে সুযোগ পেলে সে একাই এখানে চলে আসে। বলা যায়, এলাকাটার প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ জন্ম নিয়েছে তার মধ্যে। জায়গাটাও খুবই ভালো। অন্ততঃ আহমদ খলিলের তাই মনে হয়। তবে, এখানকার ইহুদীগুলো আরবদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করে না এটা স্পষ্ট বুঝেছে সে। তারা তার দিকে যখন তাকায় তখনি আহমদ খলিলের মনে পড়ে গাজার গভর্ণরের স্ত্রীর সেই ঘৃণাভরা দৃষ্টির কথা। গাজার গভর্ণরের স্ত্রী আর ইহুদীদের মধ্যে যে কোনোই পার্থক্য নেই একথাটাও বোঝা হয়ে গেছে তার।
নেগবাতে আহমদ খলিলের সবচেয়ে প্রিয় স্থান হলো ফলের বাগানগুলো। সকাল বেলায় গ্রাম ছেড়ে আসার পর সারদিন তার কাটে শহরের পথে পথে। ক্ষুধা পেলেই কোন বাগানের দিকে এগিয়ে যায় সে। কারণ বাগানগুলোর বাইরে পড়ে থাকে ফেলে দেয়া পচা এবং বেশি পাকা কমলাগুলো। সেগুলো কুড়িয়ে খেয়ে পেট ভরে যায় তার। এর মধ্যে বার কয়েক সে একটি ছোট্ট মুরগীর খামার থেকে গোটা ছয়েক করে ডিমও চুরি করে খেয়েছে কাঁচা অবস্থাতেই। মাঝে মধ্যে রাস্তায় হাঁটতে থাকলে তাকে দেখে চলন্ত কোনো ট্রাকের ড্রাইভার কি মনে করে ছুঁড়ে দেয় কখনো এক টুকরো, কখনো আস্ত একটা রুটি। বেকারীতে তৈরি এ রুটির স্বাদ বড় মজাদার। এভাবে কোন একটা রুটি পেলেই আহমদ খলিল দৌড়াতে শুরু করে গ্রামের দিকে। চাচাতো-মামাতো ভাই- বোনদের সাথে এ সুস্বাদু রুটি ভাগ করে খাওয়ার সম্ভাব্য আনন্দে নিমেষেই যেন ফুরিয়ে যায় পথের দূরত্বটুকু। তারপর সবাই মিলে মহা আনন্দে সে রুটির প্রতিটি কণার সদ্ব্যবহার করে ।
একদিন আবদুল আজিজ আহমদ খলিলকে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা, নেগবা জায়গাটা কেমন? আমাদের গ্রামের চেয়ে কি খুব বেশি ভাল?
আহমদ খলিল জানে, আব্বার কড়া নিষেধের ফলে আবদুল আজিজ কোনদিন নেগবা শহরে যায়নি। তাকে সব কথা বলে বোঝানো মুশকিল। তাই সে সংক্ষেপে উত্তর দিল ঃ খুবই ভালো, যদি তার ভিতরের জঘন্য নোংরামি তোমার চোখে না পড়ে।
বারো বছরের আবদুল আজিজের কাছে এ কথার অর্থ অবশ্য পরিষ্কার হয় না । কয়েকটি মাস পার হয়ে যায়। আহমদ খলিলের স্বাধীন মুক্ত জীবন এখন ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে এবং অবিরাম কাজের ভিড়ে বন্দী। সে তার চাচীর কাছে নিজের কাপড়- চোপড় ধোয়া এবং রান্নার কাজ শিখে নিয়েছে। তাছাড়া বসে না থেকে সারাদিনই কিভাবে কোন না কোন কাজ খুঁজে নিয়ে শেষ করতে হয়, সে শিক্ষাও চাচীর কাছ থেকে পেয়েছে। তাই দশ বছর বয়সেই কিভাবে কাজ করে দিন কাটাতে হয়-আহমদ খলিল তা শিখে ফেলেছে।
একদিন মাগরেবের নামাজ পড়া শেষ করেই আহমদ খলিল এক দৌড়ে চলে আসে মামার বাড়িতে। আবদুল আজিজ রাতের জমে ওঠা আঁধারে চুপ করে শুয়েছিল ঘরের এক কোণে। ক’দিন থেকেই সে অসুস্থ। থেকে থেকে কাশির দমকে কেঁপে উঠছিল সে। এ সময় আহমদ খলিলকে দেখে খুব খুশি হয় আবদুল আজিজ ।
: চল, ছাদে যাই আমরা। আবদুল আজিজ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। কিন্তু ছাদে উঠতে পারে না সে। শরীরে শক্তি নেই। ভাঙ্গা কাঠের সিঁড়ি বয়ে তাকে ছাদে নিয়ে যায় আহমদ খলিল।
ইরাক আল মানশিয়ায় রাত নেমেছে। বহুদূরে আঁধারে ঢাকা নেগবার প্রান্তর । আকাশে তারার মেলা। নিঃস্তব্ধ চারদিক। দূরের মরুভূমি থেকে বইতে শুরু করেছে ঝিরঝির বাতাস। সে বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায় তাদের। পাশাপাশি চুপচাপ শুয়ে থাকে দু’জনে ।
এক সময় কথা বলে আহমদ খলিল : আচ্ছা, আমরা সেদিন যে ইহুদী ছেলে- মেয়েদের দলটার ওপর পাথর ছুঁড়লাম, ওরা যদি আসলেই ‘গাদনা’র সদস্য হতো তা হলে? : তুমি তো এখন শুধু পাথর ছুঁড়ছ- আবদুল আজিজের গলায় প্রাপ্তবয়স্কদের গভীরতা, তুমি যখন বড় হবে তখন আর পাথর নয়, তখন তোমাকে ছুঁড়তে হবে রাইফেলের বুলেট।
একটু থামে আবদুল আজিজ। বলে- খুব শিগগিরই যুদ্ধ শুরু হবে। আমি জানি – যুদ্ধ একটা হবেই। তখন যে কি হবে।
এর কদিন পরই জ্বরে ইন্তেকাল করে আবদুল আজিজ।
দীর্ঘ শীতের দিনগুলো শুরু হয়েছে। ইরাক আল মানশিয়ার লোকদের ঘরে বন্দী হয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। প্রবল বৃষ্টির ফলে গ্রামের রাস্তাগুলো এক হাঁটু কাদার নীচে ডুবে আছে । মাঠেও তেমন কোন কাজ নেই। মালেক ওহাবের মনে হয়, এখনই উপযুক্ত সময়। আহমদ খলিলকে লেখা পড়া শেখানোর কাজটা শুরু করতে হয় এবার। তিনি গাজা থেকে সুন্দর এবং স্পষ্ট ছাপার একখানা কুরআন শরীফ এবং বার বার লেখা ও মোছায় রং চটে যায় না- এরকম একটা যুৎসই ব্ল্যাকবোর্ডও নিয়ে এলেন।
বারবার ডেকেও আহমদ খলিলের কোন সাড়া পাচ্ছিলেন না মালেক ওহাব। অবশেষে আহমদ খলিল ভীতসন্ত্রস্ত ভাবে এসে হাজির হয় তার আব্বার সামনে। সে বুঝে উঠতে পারছিল না, তার আব্বা তার কাছে কি চান।
: শোন- মালেক ওহাবের গম্ভীর গলা শোনা যায় এখন তো করার মতো কোন কাজ নেই। এ ফাঁকে তোমার লেখাপড়ার কাজটা শুরু করে দাও। আমি তোমাকে সব কিছু শিখিয়ে দেব।
আহমদ খলিল অবিশ্বাস ও সন্দেহের চোখে তার আব্বার দিকে তাকায়। সে জানে, তার মাঠে কাজ করার ব্যাপারটি তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। তিনি চান, আহমদ খলিল লেখা-পড়া শিখে বড় হোক এবং শহরে গিয়ে জীবন যাপন করুক। এজন্য তিনি ছেলেকে আধুনিক স্কুলে ভর্তি করতে আগ্রহী। কিন্তু আহমদ খলিলের এ ব্যাপারে কোন আগ্রহই নেই। ইরাক আল মানশিয়া এবং নেগবার মালভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই। তবে সে বোঝে, আব্বার তুলনায় সে একেবারেই অজ্ঞ এবং মূর্খ । আর সে সময় হঠাৎ করেই তার মনে হয়; পৃথিবীতে বহু কিছু জানার আছে আর তা জানতে পারলে তারই জ্ঞানের ভান্ডার বৃদ্ধি পাবে। কুরআন পাঠ করতে শেখা এবং এর অর্থ জানার জন্যে তার মনে তখনই এক অদম্য আগ্রহ জেগে ওঠে। তার মনে হয়, তাকে হাদীস পড়তে হবে, আদর্শ সৃষ্টিকারী সাহাবাদের জীবন কাহিনী জানতে হবে, জানতে হবে অন্যান্য নবীদের কথা, এমনকি ইহুদী ও বৃটিশদের ইতিহাসও। আর এগুলো জানার জন্যেই সে আজ থেকেই লেখা পড়া শিখবে। আর এতে কোন ফাঁকি দেবেনা বলে মনে মনে শপথ নেয়।
মালেক ওহাব ছেলের ওপর অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে বিসমিল্লাহ্ বলে পড়াতে শুরু করেন। প্রতিটি শব্দ তার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন এবং উচ্চারণ করেন। আহমদ খলিল তাকে অনুসরণ করে। বার বার ভুল হয়। কিন্তু অসীম ধৈর্য নিয়ে মালেক ওহাব তাকে শেখাতে থাকেন ।
ছোট্ট খলিফা প্রথম থেকেই আহমদ খলিলের পড়া লেখার বিষয়টি লক্ষ্য করছিল। তার গভীর দু’টি কালো চোখে প্রখর বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক। আহমদ খলিলের পড়াশুনা শেষ হতেই ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা আরবী অক্ষরগুলো এক এক করে উচ্চারণ করতে শুরু করে সে এবং কোন বাধা ছাড়াই নির্ভুলভাবে শেষ করে। মালেক ওহাব স্তম্ভিত বিস্ময়ে তার এই চার বছর বয়সের অসাধারণ বুদ্ধিমান সন্তানের প্রতি একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন ।
প্রথমে একটি অক্ষর। এরপর একটি অক্ষরের সাথে আরেকটি অক্ষরের সংযোগ । কয়েকটি অক্ষরে একটি শব্দ এবং কয়েকটি শব্দে একটি আয়াত। এভাবেই এক সময় হঠাৎ করেই আহমদ খলিলের সামনে পবিত্র কুরআনের কালো অক্ষরে ছাপা এতদিনের বন্ধ বাতায়নটি উন্মুক্ত হয়ে যায়। কি অদ্ভুত শিহরণ! আহমদ খলিল নির্ভুলভাবে তরতর করে পড়ে যেতে থাকে –

“সূর্য যখন নিষ্প্রভ হবে,
যখন নক্ষত্র খসে পড়বে,
পর্বতসমূহ যখন অপসারিত হবে
যখন জীবন্ত কবরস্থ করা কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল
যখন আমলনামা উন্মোচিত হবে
যখন আকাশের আবরণ অপসারিত হবে
জাহান্নামে যখন অগ্নি উদ্দীপিত হবে
এবং জান্নাত যখন নিকটবর্তী হবে
তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে সে কি নিয়ে এসেছে।”

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত