এগারো :
রমজান শেষ হয়ে আসে। তারাবীর শেষ দিনে ইউসুফ মালিক এসে হাজির হন মসজিদে। অর্ধেক তারাবী হওয়ার পর যার দু’জন ইখওয়ান কর্মীর কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি । যন্ত্রণাকাতর শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে মিম্বরে ওঠেন। বোঝা যাচ্ছিল, তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন। সবাইকে অপেক্ষা করতে বলে নীরবে নিজের সাথে যুদ্ধ করে যেন কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিলেন তিনি। উপস্থিত গোত্রবাসীরা দেখছিল তার দুর্বল শরীর, পাণ্ডুর হয়ে আসা মুখ। মনে হচ্ছিল, তার শুকনো শরীরে চামড়া ছাড়া আর কিছু নেই। অবশেষে কথা শুরু করেন ইউসুফ গম্ভীর ও বলিষ্ঠ গলায়-
‘আমরা অন্য ফিলিস্তিনীদের মত নই। আমরা তাদের মত নই যারা আমাদের শত্রুদের ন্যায় আল্লাহকে অবিশ্বাস করে এবং বিবেকহীন, যারা শুধুমাত্র এক টুকরো জমির জন্য হয়ে উঠতে পারে নির্মম ও বেপরোয়া। আমরা যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি তা জেহাদ ……
ইউসুফের কথায় বাধা পড়ে। আহমদ খলিলের সামনে বসে থাকা একটি কিশোর ভয়ানক ভাবে কাশতে শুরু করেছিল। কাশির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার শরীর। কাশি থামতেই নোংরা কম্বলের একটা অংশ দিয়ে সে তার মুখ মোছে। দেখা গেল, কাশির সাথে উঠে আসা রক্তে তা ভরে গেছে।
সে দিকে একনজর তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করেন ইউসুফ মালিক—
‘আমরা শুধু ইহুদীদের নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করছি না। আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে অশুভ চক্রান্ত শুরু হয়েছে তার মোকাবেলার জন্য এবং চিরন্তন ও শাশ্বত সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই আমরা যুদ্ধ করছি। অন্যান্য গ্রাম, শহর, নগরের অধিবাসীরা দুশমনদের মোকাবেলা না করে পালিয়েছে। কিন্তু যাই ঘটুক না কেন বা দুশমনরা যাই করুক না কেন আমরা পালিয়ে যাব না। এমনকি ইরগুন যদি দাইর ইয়াসিনের মতে এখানেও গণহত্যা চালায় তবুও আমরা ভেড়া বা দুম্বার মত প্রাণভয়ে উর্ধ্বশ্বাসে পালাব না । এটা আমাদেরই জন্মভূমি এবং আমরা শত্রুর মোকাবেলা করে যাব।
ইউসুফের বক্তৃতা শেষ হতে খলিফা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। ইউসুফের দুর্বল শরীরে দাঁড়ানোর শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় মিম্বরের উপরের ধাপটিতে বসে পড়েন। ছোট্ট বালকটিকে দু’হাতের মধ্যে জড়িয়ে নেন তিনি। এসময় খলিফাকে দেখে মনে হচ্ছিল, কি এক গভীর চিন্তায় যেন সে নিমগ্ন। আরো মনে হচ্ছিল, ইউসুফ মালিকের সব কথাই সে বুঝতে পেরেছে।
রমজান মাস শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ হয় নি প্রচণ্ড খরার নির্মম দহন । মাঠগুলোকে এখন মরুভূমি থেকে আলাদা করে চেনাই শক্ত। এবারও শীতকালে বৃষ্টি হয় নি। সারা প্রান্তরে কোথাও সবুজের কোন চিহ্ন দেখা যায় না। এমন কি গিরগিটিগুলোও আর এখন মাটির উপর বেরিয়ে আসে না। শুকনো মাটির তীব্র উত্তাপ থেকে রেহাই পেতে একটু আর্দ্রতার সন্ধানে তারা ঢুকে গেছে মাটির আরো গভীরে।
আকাশের নীচে পাখিদের ওড়াউড়িও বন্ধ। আছে একমাত্র শকুনগুলো। সারাদিন তারা কুৎসিত দেহছায়া নিয়ে উড়ে বেড়ায় বাধাহীন উক্ত আকাশের বুকে। বিরল শিংওয়ালা হরিণের পাল অধিকতর উর্বর ভূমির সন্ধানে চলে গেছে উত্তর দিকে।
খলিফা এবং রশিদের পাশে নীরবে বসেছিল আহমদ খলিল। তীব্র আগুনে ঝাঁজ এবং উড়ন্ত বালি থেকে রেহাই পাবার জন্য ওদের সারা মুখ কাফিয়াতে ঢাকা। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় । তিনজোড়া চোখ আকুল তৃষ্ণায় চেয়ে থাকে দূর দিগন্তে। তাদের ব্যাকুল দৃষ্টি আকাশের কোণে এক টুকরো মেঘ খুঁজে ফেরে। কিন্তু হতাশায় ভরে ওঠে তাদের মন। মেঘের কোন চিহ্নই আকাশে খুঁজে পায় না তারা।
প্রচণ্ড খরার এই দিনগুলোতেও মালেক ওহাব এবং তার ভাই মনসুর ইহুদী হামলার হাত থেকে গ্রামকে রক্ষার কাজে অমানুষিক পরিশ্রমে ব্যস্ত। ইহুদীরা যে কোন সময় ইরাক-আল-মানশিয়াতে হামলা চালাতে পারে। গ্রামের চারপাশে পরিখা খুঁড়ে ইহুদীদের হামলা ঠেকানোর পরিকল্পনা করেছিলেন মালেক ওহাব। বেঁচে থাকা গ্রামবাসী এবং ইখওয়ান স্বেচ্ছাসেবীরা তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। অনাহারক্লিষ্ট দুর্বল আহমদ খলিল দাঁড়িয়ে বিষন্ন চোখে তাকিয়ে দেখছিল গ্রামবাসীদের এই প্রতিরোধ প্রচেষ্টা। দুর্ধর্ষ বেদুইন যোদ্ধারা উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যাওয়া আসা করছে গ্রামের সংকীর্ণ পথে। মাঝে মাঝেই শূন্যে রাইফেল ঘুরিয়ে রণহুংকার দিয়ে উঠছে তারা। সিরীয় সৈন্যেরা নেগবা অবরোধ করে রেখেছে। ইহুদীদের পতনের আর বেশী দেরি নেই । এই আসন্ন বিজয় সম্ভাবনায় বেদুইনরা উল্লাসে ফেটে পড়ছে। তবে নেগবার ইহুদীদের অবস্থা ইরাক আল মানশিয়ার মত নয়। বরোধ শুরু হতেই ধূর্ত ইহুদীগুলো ভূ-গর্ভস্থ আশ্রয়ে ঢুকে পড়েছে। খাদ্য বা অস্ত্রের তেমন অভাব এখনও তাদের ঘটেনি। তাই, বেশ জোরালোভাবেই প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
এর মধ্যেই নেগবার ইহুদীদের জন্যে সাহায্য এসে যায়। খুব তাড়াতাড়িই অবরোধ ভেঙ্গে পড়ে এবং যুদ্ধের গতি যায় আমূল পাল্টে। ইরাক-আল মানশিয়ার অধিবাসীরা যারা এখনো বেঁচে আছে বুঝতে পারে, এবার চূড়ান্ত হামলা আসছে। তারই প্রতীক্ষায় আছে তারা। কে জানে, কত মানুষের রক্ত এবার মরুভূমির রুক্ষ বুকে ঝরবে!
আহমদ খলিলের চোখে তন্দ্রা নেমে এসেছিল। হঠাৎ যেন তার কানে আসে পবিত্র কুরআনের বাণী :
আল্লাহর পথে যারা নিহত হয়, তাদের তোমরা মৃত বল না। তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না ।
তার মনে হল, রাস্তার হৈ-হট্টগোল এখন অনেক দূরে সরে গেছে। কানে এখনো বেজে চলেছে সেই অপার্থিব ধ্বনি। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে তার। পায়ের নীচে মাটি দুলতে থাকে। বসে থাকার মত শক্তি সে শরীরে পায় না। প্রাণপণ চেষ্টায় সে এগিয়ে যায় ঘরের দিকে। অবশেষে ঘরে পৌঁছে সে। তারপর পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভে যায় তার চোখ থেকে ।
জ্ঞান ফিরে পাবার পর চোখ খুলে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না আহমদ খলিল। ধীরে ধীরে উঠে বসে সে। দৃষ্টি স্পষ্ট হতে থাকে। অবশেষে ঘরের মধ্যে জ্বলতে থাকা আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে থাকা মালেক ওহাব, মনসুর, খলিফা এবং রশিদকে দেখতে পায়। আগুনের শিখায় ঘরের দেয়ালে বড় বড় কলস, তার মায়ের তাঁত, আব্বার বিশাল ট্রাংকের ততোধিক বিশাল ছায়ার সমাবেশ চোখে পড়ে তার। রান্নার হাঁড়ি, বসার চেয়ার এবং অস্ত্র-শস্ত্রগুলো কাছেই রয়েছে। এই অতি পরিচিত এবং প্রিয় দৃশ্যগুলো তার মনকে আশ্বস্ত করে তোলে। সে ধীরে ধীরে ঘরের চারদিকে নজর বুলিয়ে যেতে থাকে- তার মনে হয়, এটিই পৃথিবীতে তার সবচাইতে আপন স্থান । কারণ— এখানেই তার জন্ম, এখানেই সে বেড়ে উঠেছে। তীক্ষ্ণ চোখে ঘরের সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে থাকে সে।
স্তিমিতপ্রায় আগুনের পাশে সবাই বসে। মালেক ওহাব এবং মনসুর রাইফেল সাফ করার কাজে ব্যস্ত। পাশে বসে একদৃষ্টে তা দেখছে রশিদ। ঘরের মধ্যে বিরাজ করছে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। হঠাৎ খলিফার প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করে আহমদ খলিল। ছোট ভাইটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার আন্তরিক ইচ্ছায় নিজের হাত দু’টি বাড়িয়ে দেয়। ঠিক সে মুহূর্তেই, আহমদ খলিলের হাত প্রসারিত হতে দেখে এক লাফে কিছুটা সরে যায় খলিফা। মনে হল, আহমদ খলিলের প্রচণ্ড এক ঘুষির হাত থেকে যেন সে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল। ব্যাপারটি লক্ষ্য করে ব্যথায় ভরে ওঠে আহমদ খলিলের অন্তর। সে বলে-
: খলিফা ভয় নেই । আমার কাছে আয়। আমি তোকে মারব না রে ….. । : না, খলিফা চিৎকার করে ওঠে- আমি তোমার কাছে যাব না। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। তুমি শত্রুর গুপ্তচর।
ছোট ভাইয়ের কথা শুনে যেন আর্তনাদ করে ওঠে আহমদ খলিল।
: না, খলিফা ! আমি তোরই ভাই। আমি নামাযের সময় আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করেছি- তোর সাথে আর খারাপ ব্যবহার করব না। আমি তোর সাথে ঝগড়াও করবনা । যখন যা পাই দু’জনেই তা ভাগ করে খাব। আমি তোকে আর মারবনা কখনোই না।
আহমদ খলিল আবেগে ভাইয়ের দিকে আবার তারা বাহু দু’টি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু খলিফা তার প্রসারিত বাহুর মধ্যে ধরা দেয় না। বরং ভয়চকিত দৃষ্টিতে সে ক্রমশঃই দেয়ালের দিকে পিছিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে পিছানোর পথ বন্ধ হয়ে যেতেই চিৎকার করে ওঠে সে সরে যাও, আমার কাছ থেকে সরে যাও। তুমি আমার কাছে এসোনা ।
আহমদ খলিল থেমে যায়। এত চেষ্টা করেও ছোট ভাইটিকে আপন করতে না পারার ব্যর্থতায় চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে তার।
বহু রাত পযন্ত তার ঘুম আসে না। অন্ধকারে চোখ মেলে সে চেয়ে থাকে। একাকী শুয়ে থাকায় ঠাণ্ডার নির্মম আক্রোশ যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে তাকে। আধো জাগরণ, আধো তন্দ্রার মধ্যে এক সময় সে শরীরের পাশে একটু উষ্ণতার স্পর্শ অনুভব করে। সে আর কেউ নয়। খলিফা এক সময় সরতে সরতে এসে কখন তার পাশ ঘেঁষে শুয়েছে। আহমদ খলিল হাত বাড়িয়ে ভাইয়ের ক্ষুদ্র দেহটাকে নিজের কাছে টেনে নেয় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থেকে বাঁচবার জন্যে। খলিফার হৃৎস্পন্দনের শব্দ ঘরের গভীর নির্জনতার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে কানে বাজে তার। নিজের শরীরের সাথে ভাইয়ের শরীরের স্পর্শে মনে এক প্রশান্তির পরশ অনুভব করে সে। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে যায়।