পাঠকের মৃত্যু, Pathoker Mrittu, বনফুল, bonoful, proggapath, progga, bangla literature, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, প্রজ্ঞাপাঠ, বাংলা সাহিত্য, প্রজ্ঞা, গল্প, বাংলা গল্প, রহস্য গল্প, রম্য রচনা, উপন্যাস, শিল্প-সাহিত্য, Story, golpo, bangla Story, Rahasya golpo, Rommo Rocona, art and literature, silpo-sahityo

পাঠকের মৃত্যু

০ মন্তব্য দর্শক

এক

প্রায় দশ বৎসর আগেকার কথা। আসানসোল ষ্টেশনে ট্রেণের অপেক্ষায় বসিয়াছিলাম। ঠিক আমার পাশেই আর একজন বসিয়াছিলেন। তাঁহার হাতে একখানি বই ছিল। বেশ মোটা একখানি উপন্যাস।
আলাপ-পরিচয় হইলে জানিতে পারিলাম যে ভদ্রলোককে ট্রেণের জন্য সমস্ত দিন অপেক্ষা করিতে হইবে।
আমার ট্রেণেরও ঘণ্টা তিনেক দেরী ছিল।
আমরা উভয়েই বাঙালী ।
সুতরাং পাচ মিনিট পরেই তাঁহাকে যে প্রশ্নটি আমি করিলাম তাহা এই—“আপনার বইখানা একবার দেখতে পারি কি ?”
“হুঁ। হুঁ। দেখুন না—”
এই উত্তরই স্বাভাবিক এবং আশাও করিয়াছিলাম ।
অবিলম্বে বইখানা দখল করিয়া বসিলাম
দুঃসহ গ্রীষ্মের দারুণ দ্বিপ্রহর।
আসানসোল ষ্টেশনের টিনের ছাদ ।
সমস্ত কিন্তু তলাইয়া গেল ।
উপন্যাস অদ্ভুত।
বহির মালিক ভদ্রলোক আড়-নয়নে একবার আমার পানে চাহিয়া একটু ভ্রূ কুঞ্চিত করিলেন এবং একটি টাইম্ টেবল্ বাহির করিয়া তাহাতেই মনোনিবেশ করিলেন ।
আমি রুদ্ধশ্বাসে পড়িয়া চলিলাম।

চমৎকার বই।
বস্তুতঃ এমন ভালো উপন্যাস আমি ইতিপূর্বে পড়ি নাই।
একেবারে যেন জুতাইয়া দিতেছে।

দুই ঘণ্টা কাটিল ।
বহির মালিক ভদ্রলোক টাইম টেবলটি বারংবার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া অবশেষে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন— “আপনার ট্রেণের ত আর বেশী দেরী নেই । এইবার—”
বলিয়া একটু গলা খাঁকারি দিলেন।
আমি তখন তন্ময়।
চকিতে একবার হাত ঘড়িটার পানে চাহিয়া দেখিলাম । এখনও ঘণ্টাখানেক সময় আছে । বই কিন্তু অর্দ্ধেকের উপর বাকী। বাক্যব্যয় করিয়া সময় নষ্ট করিলাম না। গোগ্রাসে গিলিতে লাগিলাম।
অদ্ভুত বই।
বাকী ঘণ্টাটা যেন উড়িয়া চলিয়া গেল ।
আমার ট্রেণের ঘণ্টা পড়িল ।
বইএর তখনও অনেক বাকী ।
রোখ চড়িয়া গিয়াছিল ।
বলিলাম—“নেক্সট ট্রেণে যাব—এ বই শেষ না করে উঠছি না !”
বহির মালিক ভদ্রলোক একটু কাসিয়া নির্বাক হইয়া রহিলেন।
ট্রেণ চলিয়া গেল—বই পড়িতে লাগিলাম।
শেষ কিন্তু করিতে পারি নাই ।
শেষের দিকে অনেকগুলি পাতা ছিল না।
বহির মালিককে বলিলাম – “এঃ, শেষের দিকে এতগুলো পাতা নেই ! আগে বলেন নি কেন ? ছি ছি—”
এতদুত্তরে ভদ্রলোক কেবল নিষ্পলকনেত্রে আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন। দেখিলাম তাঁহার রগের শিরাগুলি স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে ।

দুই

দশ বৎসর পরে উক্ত পুস্তকথানি আর একবার আমার হস্তগত হইয়াছিল।
আমার ভাগিনেয়ীর শ্বশুরালয়ে।
তাহাকে পৌঁছাইতে গিয়াছিলাম। সেই দিনই ফিরিয়া আসার কথা। কিন্তু বইখানির লোভে থাকিয়া গেলাম ।
সুযোগমত বইখানি সংগ্রহ করিয়া আবার সাগ্রহে সুরু করা গেল । খাপছাড়াভাবে শেষটুকু না পড়িয়৷ গোড়া হইতেই আবার জমাইয়া পড়িব ঠিক করিলাম।
কয়েক পাতা পড়িয়াই কেমন যেন খট্‌কা লাগিল ।
উল্টাইয়া দেখিলাম—হ্যা সেই বইই ত !
আবার কয়েক পাতা অগ্রসর হইলাম—নাঃ কেমন যেন গোলমাল ঠেকিতেছে।
তবু পড়িতে লাগিলাম ।
কিছুক্ষণ পরে মনে হইল—না: —আর ত চলে না ।
এ কি সেই বই যাহা আমি আসানসোল ষ্টেশনে দারুণ গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে উর্দ্ধশ্বাসে তন্ময় হইয়া পড়িয়াছিলাম ?
এমন রাবিশ, মানুষে লেখে !
এ শেষ করা ত অসম্ভব !
দশ বৎসর আগেকার সেই উৎসুক পাঠক কবে মারা গিয়াছিল টেরও পাই নাই ।
এবারও বই শেষ হইল না ।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

পাঠকের মৃত্যু

দর্শক

এক

প্রায় দশ বৎসর আগেকার কথা। আসানসোল ষ্টেশনে ট্রেণের অপেক্ষায় বসিয়াছিলাম। ঠিক আমার পাশেই আর একজন বসিয়াছিলেন। তাঁহার হাতে একখানি বই ছিল। বেশ মোটা একখানি উপন্যাস।
আলাপ-পরিচয় হইলে জানিতে পারিলাম যে ভদ্রলোককে ট্রেণের জন্য সমস্ত দিন অপেক্ষা করিতে হইবে।
আমার ট্রেণেরও ঘণ্টা তিনেক দেরী ছিল।
আমরা উভয়েই বাঙালী ।
সুতরাং পাচ মিনিট পরেই তাঁহাকে যে প্রশ্নটি আমি করিলাম তাহা এই—“আপনার বইখানা একবার দেখতে পারি কি ?”
“হুঁ। হুঁ। দেখুন না—”
এই উত্তরই স্বাভাবিক এবং আশাও করিয়াছিলাম ।
অবিলম্বে বইখানা দখল করিয়া বসিলাম
দুঃসহ গ্রীষ্মের দারুণ দ্বিপ্রহর।
আসানসোল ষ্টেশনের টিনের ছাদ ।
সমস্ত কিন্তু তলাইয়া গেল ।
উপন্যাস অদ্ভুত।
বহির মালিক ভদ্রলোক আড়-নয়নে একবার আমার পানে চাহিয়া একটু ভ্রূ কুঞ্চিত করিলেন এবং একটি টাইম্ টেবল্ বাহির করিয়া তাহাতেই মনোনিবেশ করিলেন ।
আমি রুদ্ধশ্বাসে পড়িয়া চলিলাম।

চমৎকার বই।
বস্তুতঃ এমন ভালো উপন্যাস আমি ইতিপূর্বে পড়ি নাই।
একেবারে যেন জুতাইয়া দিতেছে।

দুই ঘণ্টা কাটিল ।
বহির মালিক ভদ্রলোক টাইম টেবলটি বারংবার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া অবশেষে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন— “আপনার ট্রেণের ত আর বেশী দেরী নেই । এইবার—”
বলিয়া একটু গলা খাঁকারি দিলেন।
আমি তখন তন্ময়।
চকিতে একবার হাত ঘড়িটার পানে চাহিয়া দেখিলাম । এখনও ঘণ্টাখানেক সময় আছে । বই কিন্তু অর্দ্ধেকের উপর বাকী। বাক্যব্যয় করিয়া সময় নষ্ট করিলাম না। গোগ্রাসে গিলিতে লাগিলাম।
অদ্ভুত বই।
বাকী ঘণ্টাটা যেন উড়িয়া চলিয়া গেল ।
আমার ট্রেণের ঘণ্টা পড়িল ।
বইএর তখনও অনেক বাকী ।
রোখ চড়িয়া গিয়াছিল ।
বলিলাম—“নেক্সট ট্রেণে যাব—এ বই শেষ না করে উঠছি না !”
বহির মালিক ভদ্রলোক একটু কাসিয়া নির্বাক হইয়া রহিলেন।
ট্রেণ চলিয়া গেল—বই পড়িতে লাগিলাম।
শেষ কিন্তু করিতে পারি নাই ।
শেষের দিকে অনেকগুলি পাতা ছিল না।
বহির মালিককে বলিলাম – “এঃ, শেষের দিকে এতগুলো পাতা নেই ! আগে বলেন নি কেন ? ছি ছি—”
এতদুত্তরে ভদ্রলোক কেবল নিষ্পলকনেত্রে আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন। দেখিলাম তাঁহার রগের শিরাগুলি স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে ।

দুই

দশ বৎসর পরে উক্ত পুস্তকথানি আর একবার আমার হস্তগত হইয়াছিল।
আমার ভাগিনেয়ীর শ্বশুরালয়ে।
তাহাকে পৌঁছাইতে গিয়াছিলাম। সেই দিনই ফিরিয়া আসার কথা। কিন্তু বইখানির লোভে থাকিয়া গেলাম ।
সুযোগমত বইখানি সংগ্রহ করিয়া আবার সাগ্রহে সুরু করা গেল । খাপছাড়াভাবে শেষটুকু না পড়িয়৷ গোড়া হইতেই আবার জমাইয়া পড়িব ঠিক করিলাম।
কয়েক পাতা পড়িয়াই কেমন যেন খট্‌কা লাগিল ।
উল্টাইয়া দেখিলাম—হ্যা সেই বইই ত !
আবার কয়েক পাতা অগ্রসর হইলাম—নাঃ কেমন যেন গোলমাল ঠেকিতেছে।
তবু পড়িতে লাগিলাম ।
কিছুক্ষণ পরে মনে হইল—না: —আর ত চলে না ।
এ কি সেই বই যাহা আমি আসানসোল ষ্টেশনে দারুণ গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে উর্দ্ধশ্বাসে তন্ময় হইয়া পড়িয়াছিলাম ?
এমন রাবিশ, মানুষে লেখে !
এ শেষ করা ত অসম্ভব !
দশ বৎসর আগেকার সেই উৎসুক পাঠক কবে মারা গিয়াছিল টেরও পাই নাই ।
এবারও বই শেষ হইল না ।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত