ধরা যাক, আমরা শিকার করতে বেরিয়েছি। ধরা যাক, আমরা একটি সিংহ শিকার করব। কিন্তু যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সিংহ সেখানে সত্যি-সত্যি আছে তো? কীভাবে বুঝব যে, সে আছে? ধরা যাক, একটু আগেই আমরা তার গর্জন শুনেছি। কিংবা নরম মাটিতে দেখেছি তার পায়ের ছাপ। সেই শোনা কিংবা সেই দেখার উপরে নির্ভর করে আমরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। দূরের একটা ঝোপ যেন একটু নড়ে উঠল। সিংহ? চকিতে একটা ছায়া যেন আমাদের চোখের সামনে থেকে সরে গেল। সিংহ ? আমাদের প্রত্যেকেরই স্নায়ু একেবারে টান- টান হয়ে আছে। হৃৎপিণ্ড উঠে এসেছে মুখের মধ্যে। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের বুকের ধক্ধক্ খুব স্পষ্ট করে শুনতে পাচ্ছি। আমরা প্রত্যেকেই ভাবছি যে, আর দেরি নেই, এইবারে হয়তো যে-কোনও মুহূর্তে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।
ধরা যাক, ঠিক এইভাবেই একটি কবিতার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। আমরা শুনেছি যে, কবিতা কিছু অসম্ভব শশবিষাণের ব্যাপার নয়, কবিতা বলে সত্যিই কিছু আছে, এবং আমাদের ধারেকাছেই আছে। তাই আমরা আশা করছি যে, আমাদের অন্বেষণ বিফলে যাবে না, যে-কোনও মুহূর্তে আমরা তার দেখা পাব ।
কিন্তু দেখা পাওয়াই যথেষ্ট নয়, দেখা যখন হবে, তখন তাকে চিনে নিতে পারব তো? প্রশ্নটা আমাদের নয়, বিদেশি এক কবি-সমালোচকের। কিন্তু আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ যখন এই প্রশ্ন তোলেন, তখন তাঁর সমস্যাটা যে কী, তা খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি। আসলে, সিংহ কিংবা বাঘ কিংবা টেবিল কিংবা চেয়ার কিংবা কলম কিংবা বই কিংবা এই রকমের আরও অজস্র প্রাণী অথবা বস্তুকে যত সহজে চিনে নেওয়া যায়, কবিতাকে চিনে নেওয়া তত সহজ ব্যাপার নয়।
কেন নয়? ম্যাকলিশ এই প্রশ্নের একটা উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। প্রসঙ্গত তিনি যা বলেছেন, তার মোদ্দা কথাটা এই যে, ইতিপূর্বে আমরা যদি সিংহ না-ও দেখে থাকি, তবু যে তাকে দেখবামাত্র আমরা চিনে নিতে পারি, তার কারণ আর কিছু নয়, নানাজনের কাছে এই প্রাণীটির যে বর্ণনা আমরা শুনেছি, তার মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল না। গল্পের অন্ধেরা যখন হাতির বর্ণনা দিয়েছিল, তখন তাদের একজন বলেছিল, হাতি হচ্ছে সাপের মতো; একজন বলেছিল, হাতি হচ্ছে কুলোর মতো; একজন বলেছিল, হাতি হচ্ছে থামের মতো; আর যে-অন্ধটি হাতির শুঁড়, কান বা পা ছোঁয়নি, শুধু—হাতি যখন তার পাশ দিয়ে চলে যায়, তখন—আন্দোলিত বাতাসের একটা ঝাপ্টা খেয়েছিল মাত্র, সে বলেছিল যে, হাতি হচ্ছে একটা ঝড়ের মতো ব্যাপার। কিন্তু তেমন কোনও বিভ্ৰাট এক্ষেত্রে ঘটছে না। সিংহের বর্ণনা যাঁরা দিয়েছেন, প্রত্যেকেই তাঁরা চক্ষুষ্মান ব্যক্তি। সুতরাং তাঁদের দেওয়া সেই বর্ণনার উপরে নির্ভর করেই সিংহকে শনাক্ত করা যায়। পক্ষান্তরে, কবিতা নামক ব্যাপারটাকে যে তেমন করে আমরা শনাক্ত করতে পারি না, তার কারণ, তার বিষয়ে যে-সব বর্ণনা আমরা পেয়েছি, অনেক ক্ষেত্রেই সেইসব বর্ণনার মধ্যে কোনও মিল নেই। এমনকী, প্রায়শ তারা পরস্পরের বিরোধী। রামের দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে শ্যামের বর্ণনা মেলে না। যদুর বর্ণনা ও মধুর বর্ণনার মধ্যে বিস্তর ফারাক থেকে যায়। নবীনের দেওয়া বৰ্ণনায় আবার রাম শ্যাম যদু ও মধু, প্রত্যেকেরই আপত্তি ঘটে। ফলে, তাকে শনাক্ত করা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দুই মহাজন যার বর্ণনায় একমত হতে পারেন না, কীভাবে তাকে আমরা খুঁজে ফিরব? এবং দেখা হয়ে গেলেই বা কীভাবে, কোন্ কোন্ লক্ষণ মিলিয়ে চিনে নেব তাকে ?
সর্বসম্মত কোনও বর্ণনা কিংবা সংজ্ঞা না-পাবার যে অসুবিধা, কবিতার আলোচক মাত্রেই কখনও না কখনও তার সম্মুখীন হন। তখন কীভাবে তাকে কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা করেন তাঁরা? তাঁদের কেউ-বা কোনও পূর্বাচার্যের দেওয়া সংজ্ঞাকে পুরোপুরি মেনে নিয়ে অতঃপর তারই আলোয় চিনবার চেষ্টা করেন যে, কোটা কবিতা আর কোন্টা নয়। কেউ-বা সেক্ষেত্রে, কোনও পূর্বাচার্যের সংজ্ঞাকে একেবারে পুরোপুরি হয়তো মেনে নেন না, কিন্তু তারই সূত্র ধরে চেষ্টা করেন অন্য-কোনও সংজ্ঞা নির্ধারণের। আবার কেউ-বা অন্য কারও সংজ্ঞার মুখাপেক্ষী না-হয়ে, একান্তভাবে অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে, অন্য পথে এগিয়ে যেতে চান। চেষ্টা করেন, পূর্বলব্ধ যাবতীয় সংজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্কহীন, কোনও নূতন সংজ্ঞা খুঁজে নিতে। কিন্তু সেই নূতন সংজ্ঞা যখন খুঁজে পাওয়া যায়, তখন তা নিয়েও আবার নূতন করে বিরোধ ঘনিয়ে ওঠে। কাকে কবিতা বলে, এই প্রারম্ভিক প্রশ্নেরই কোনও সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসা আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
বলা বাহুল্য, কবিতার সংজ্ঞা নির্ধারণ ও লক্ষণ নির্ণয়ের এই যে নব-নব প্রয়াস, এবং তার থেকে সঞ্জাত এই যে বিরোধ, এই নিয়েই আমরা এখানে প্রশ্ন তুলতে পারি। বলতে পারি যে, নূতন করে আবার এতসব বাদ-বিসংবাদের মধ্যে জড়িয়ে যাবার দরকার নেই, তার চেয়ে বরং প্রাচীন মতামতগুলির দিকেই আর- একবার চোখ ফেরানো যাক। দেখা যাক, তা-ই দিয়েই আমাদের প্রয়োজন মেটে কি না। অর্থাৎ তারই উপরে নির্ভর করে আমরা বুঝে নিতে পারি কি না যে, কবিতা নামক ব্যাপারটা আসলে কী।
মুশকিল এই যে, কবিতা-সংক্রান্ত আমাদের এই জিজ্ঞাসা সেখানেও কোনও চূড়ান্ত উত্তর খুঁজে পায় না। বিসংবাদের ক্ষেত্রটি বস্তুত সেখানেও বেশ বড় মাপের। বামনাচার্য যখন বলেন, কাব্যং গ্রাহ্যমলংকারাৎ, তখন প্রতিবাদীরা বলেন, তা কেন হবে, অলংকৃত বাক্যমাত্রেই কিছু কাব্যের মর্যাদা পেতে পারে না; উপরন্তু, বাক্যবন্ধ নিরলংকার হলেই যে তা কাব্য বলে গ্রাহ্য হবে না, এমনও নয়। বস্তুত, কাকে আমরা অলংকার বলব, এবং কাকে নয়, বিরোধ ঘটে তা নিয়েও। বিশ্বনাথ অবশ্য অলংকৃত বাক্যবন্ধের উপরে জোর দেন না, গুরুত্ব আরোপ করেন রসের উপরে। কিন্তু, বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্, এই সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞাটিও যে আমাদের চূড়ান্ত সন্তোষ উৎপাদন করে না, তার কারণ, সেক্ষেত্রে আমরা আবার নূতন জিজ্ঞাসার জালে জড়িয়ে যাই। কাব্যজিজ্ঞাসাকে মুলতুবি রেখে তখন আবার সন্ধান করতে হয় যে, রস কাকে বলে।
আনন্দবর্ধন সম্পর্কে, আরও অনেক কথার মতো, এই কথাটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, কাব্যের ব্যাপারটাকে বোঝাতে গিয়ে তিনি একেবারেই। বিপরীত বিন্দু থেকে অগ্রসর হয়েছেন। কাব্য কী, তা জানাবার জন্যই তিনি আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, কাকে আমরা কাব্য বলতে পারি না। আমরা যাকে ‘এলিমিনেশন পদ্ধতি’ বলি, বস্তুত তারই আশ্রয় নিয়েছেন তিনি; এবং বলছেন যে, যে-বাক্যবন্ধ থেকে নিতান্ত আক্ষরিক অর্থ ছাড়া আর কিছুই আমাদের লভ্য নয়, কাব্য বলে গণ্য হবার কোনও যোগ্যতাই তার নেই।
ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াল? মোটামুটি এই দাঁড়াল যে, বাক্য যখন কাব্য বলে গণ্য হতে চায়, তখন তার মধ্যে নিতান্ত শব্দার্থের অতিরিক্ত কোনও অর্থের কিংবা তাৎপর্যের আভাস থাকা চাই। এই যে তাৎক্ষণিক অর্থের অতিরিক্ত অর্থ, এরই প্রসঙ্গে আসবে ব্যঞ্জনার কথা। কিন্তু তার আগে একবার পাশ্চাত্ত্যের কাব্যতত্ত্বের সন্ধান নেওয়া যাক, এবং দেখা যাক যে, কাব্যবিচারের কোনও সহজ সূত্র সেখানে মেলে কি না।
আরিস্টটলের কথাই ধরা যাক। কাব্য বিষয়ে তাঁর অতিবিখ্যাত যে প্রস্তাবের কথা সবাই জানেন, এবং গিলবার্ট মারের সিদ্ধান্ত মেনে নিলে যে-প্রস্তাবকে আমরা কবিতা নামক ব্যাপারটার প্রতি প্লেটোর উগ্র উষ্মার উত্তর বলে গণ্য করতে পারি, সেখানে কিন্তু আমাদের প্রারম্ভিক জিজ্ঞাসার কোনও জবাব মেলে না। কবিতাকে সেখানে হরেক শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছেন আরিস্টটল, এবং বর্ণনা করেছেন তাদের ইতিহাস ও লক্ষণাবলী, কিন্তু কবিতা বলতে যে ঠিক কী বোঝায়, কোনও স্পষ্ট সংজ্ঞার মাধ্যমে তা তিনি নির্দেশ করেননি।
কবিতার জন্মরহস্য সম্পর্কে অবশ্য তিনি নীরব নন। রাজশেখরের ‘কাব্যমীমাংসা’য় আছে, “পুরাকালে সরস্বতী পুত্র কামনা করিয়া হিমালয় পর্বতে তপস্যা করিয়াছিলেন। সন্তুষ্ট মনে ব্রহ্মা তাঁহাকে বলিলেন— ‘আমি তোমার পুত্র সৃষ্টি করিতেছি।’ তাহার পর সরস্বতী কাব্যপুরুষকে প্রসব করিলেন।”২ আরিস্টটল কিন্তু তেমন কোনও দৈব উৎসের উল্লেখ করেন না। বরং বেশ স্পষ্ট করেই তিনি আমাদের জানিয়ে দেন যে, কবিতা আসলে বাস্তব জীবন কিংবা ঘটনারই এক ধরনের অনুকৃতি মাত্র। তাঁর বক্তব্য, “মানুষ হচ্ছে অনুকরণপ্রিয় প্রাণী, সে সবকিছুকে অনুকরণ করে দেখাতে পারে, যা কিনা অন্যান্য প্রাণী পারে না,” এবং তার এই অনুকরণস্পৃহা থেকেই জন্ম নিয়েছে কবিতা।
বলা বাহুল্য, আরিস্টটলের এই উক্তি আমাদের ভাবায়, কিন্তু আমাদের কৌতূহল শুধু এইটুকু জেনে তৃপ্ত হয় না। তার কারণ, গ্রিক দার্শনিকের ভাবনার সঙ্গে পরিচয় ঘটবার দরুন ইতিমধ্যে আমরা এও জেনেছি যে, শুধু কবিতা নয়, সর্বরকমের সুকুমার শিল্পই হচ্ছে বাস্তবের অনুকরণ। অর্থাৎ কোনও শিল্পকেই মৌল কোনও রচনা বলে গণ্য করা চলে না, সবই আসলে মূলের প্রতিবিম্ব বা প্রতিচ্ছবি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে যে, চিত্রকলার সঙ্গে কবিতার তবে আর পার্থক্য কোথায়, কিংবা কিসের উপরে ভিত্তি করে তা হলে ভাস্কর্য কিংবা সংগীত থেকে কবিতাকে আমরা আলাদা করে চিনে নেব?
আরিস্টটল যে এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দেননি, তা অবশ্য নয় ; তিনি আমাদের বলেই দিচ্ছেন যে, সব শিল্পই যদিও বাস্তব অথবা সত্যের অনুকৃতি মাত্র, তবু বিভিন্ন শিল্পের মাধ্যম, বিষয় ও রীতি বা পদ্ধতি তো এক নয়, সেক্ষেত্রে তারা পরস্পর থেকে পৃথক। বস্তুত, মাধ্যম, বিষয় ও রীতির বিশিষ্টতা থেকেই বিভিন্ন শিল্পকে আমরা আলাদা করে চিনতে পারি।
কোনও শিল্পকে পৃথকভাবে শনাক্ত করবার এই যে উপায়, এরই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে চিত্র ভাস্কর্য কিংবা সংগীতকলা থেকে কবিতাকে একেবারে আলাদা করে চিনে নেবার একটি সহজ সূত্র। চিত্রের মাধ্যম যদি রং ও রেখা, ভাস্কর্যের মাধ্যম যদি ত্রিমাত্রিক শিলাখণ্ড এবং সংগীতের মাধ্যম যদি ধ্বনি, কবিতার মাধ্যম তা হলে শব্দ। কবিতা কী, এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তবে আর চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলবার দরকার কী? খুব সহজেই তো এখন তা হলে আমরা বলতে পারি যে, কবিতা হচ্ছে শব্দ। মুশকিল এই যে, কেউ-কেউ শুধু এইটুকু বলেই ক্ষান্ত হন না, আরও খানিকটা এগিয়ে যান। তাঁদের বক্তব্য, শব্দকে এক্ষেত্রে শুধু ‘মাধ্যম’ বলাটাই যথেষ্ট নয়, শব্দের ভূমিকা এক্ষেত্রে আরও বড়। যার ভিতর দিয়ে একটি কবিতা প্রকাশ পাচ্ছে, সেই শব্দগুলিকে যদি আমরা সরিয়ে নিই, কবিতাটিরও কোনও অস্তিত্ব তা হলে থাকে না। সেই বিচারে আমাদের বলতে হয় যে, কবিতা হচ্ছে শব্দ, এবং শব্দই হচ্ছে কবিতা।
তা কি আমরা বলতে পারি ? না, পারি না। কেন পারি না, একটু বাদেই সে- কথায় আবার আসা যাবে। তার আগে বলা দরকার যে, কাব্যজিজ্ঞাসার এই সহজ সমাধানকেও অনেকে একেবারে অগ্রাহ্য করছেন না। এবং তাঁদেরই মধ্যে একজন, চার্লস হুইলার, আমাদের জানাচ্ছেন যে, যে-সমাধান সবচেয়ে সরল, স্রেফ ওই সারল্যের জন্যেই অনেক ক্ষেত্রে সেটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। ৩ প্রসঙ্গত তিনি এডগার অ্যালান পো’র সেই গল্পের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, পুলিশকে ধোঁকা দেবার জন্যে একখানা চোরাই চিঠিকে আসামি যেখানে পুলিশের একেবারে চোখের সামনেই ফেলে রেখেছিল। বলা বাহুল্য, চোখের সামনে ছিল বলেই পুলিশ সেটা দেখতে পায়নি, কিংবা দেখতে পেলেও গুরুত্ব দেয়নি, হরেক গোপন জায়গায় তারা সেই চিঠির জন্য গলদঘর্ম তল্লাশ চালিয়েছে। শুধু পো’র ওই একটি গল্প কেন, এমন আরও অনেক রহস্যকাহিনী আমরা পড়েছি, লেখক যেখানে পাঠকের সামনে একটি সহজ সমাধান ঝুলিয়ে রেখে দেন, অথচ সহজ বলেই পাঠক সেটাকে গুরুত্ব দিতে চায় না, তার নজর স্বতই চলে যায় সম্ভাব্য আরও হরেক সমাধানের দিকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বোকা বনতে হয়, কেননা শেষ পরিচ্ছেদে লেখক জানিয়ে দেন যে, ওই সহজ সমাধানটিই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। কিন্তু সে-কথা থাক। দরকারি কথাটা হচ্ছে এই যে, কবিতা-বিষয়ক এই সহজ সমাধানটিকে হুইলারও আসলে তাঁর আলোচনাকে এগিয়ে নেবার সুবিধার জন্য গ্রাহ্য করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কিন্তু তিনিও একে চূড়ান্ত সমাধান বলে মানেননি।
মানছি না, বলা বাহুল্য, আমরাও। কেননা, আমাদের চিত্তে ইতিমধ্যে অন্য- একটি জিজ্ঞাসার উদ্ভব হয়েছে। কবিতা অবশ্যই শব্দ। কিন্তু নিতান্ত সেই কারণেই কি শব্দকে আমরা কবিতা বলে গ্রাহ্য করব? যে-কোনওভাবে ব্যবহৃত শব্দকে? তা হলে তো যে-কোনওভাবে ব্যবহৃত রঙ ও রেখাকে চিত্র বলে, যে- কোনওভাবে ব্যবহৃত ত্রিমাত্রিক শিলাখণ্ডকে ভাস্কর্য বলে এবং যে-কোনওভাবে ব্যবহৃত ধ্বনিকে সংগীত বলে আমাদের গ্রাহ্য করতে হয়। কিন্তু তা তো আমরা করি না। শুধু তা-ই নয়, ইতিমধ্যে আবার আর-এক দিক থেকেও এই সমস্যাটিকে আমরা দেখতে শুরু করেছি। আমরা ভাবছি যে, শুধু কবিতা কেন, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার—উপন্যাসের, গল্পের কি নাটকের মাধ্যমও তো শব্দই। শুধু মাধ্যম নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। কেননা, সেক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যার মাধ্যমে সেগুলি রচিত হচ্ছে, সেই শব্দগুলিকে যদি সরিয়ে নেওয়া যায়, উপন্যাস, গল্প কি নাটকেরও কোনও পৃথক অস্তিত্ব তা হলে থাকে না। সুতরাং শব্দ আর কবিতাকে যদি আমরা তুল্যমূল্য বলে মনে করি, তবে শব্দ আর উপন্যাস, শব্দ আর গল্প, কিংবা শব্দ আর নাটককেও তুল্যমূল্য জ্ঞান করতে হয়। এবং তা যদি আমরা করি, অবস্থাটা তা হলে এই রকম দাঁড়ায় :
কবিতা হয় শব্দ
শব্দ হয় উপন্যাস,
(সুতরাং) কবিতা হয় উপন্যাস ।
অর্থাৎ, ব্যাপারটা একেবারে যৎপরোনাস্তি হাস্যকর হয়ে ওঠে।
তা হলে আমরা কী বুঝব? আমরা কি এটাই বুঝব যে, এক্ষেত্রে যে প্রেমিস অর্থাৎ আশ্রয়বাক্য বা হেতুবাক্যের সোপান বেয়ে আমরা সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছিলুম, তারই মধ্যে একটা ভ্রান্তি থেকে গিয়েছিল, এবং সেই ভ্রান্ত আশ্রয়বাক্যই একটা ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের দিকে আমাদের ঠেলে দিয়েছে? বলা বাহুল্য, তা-ই আমাদের বুঝতে হবে! আমাদের ধরেই নিতে হবে যে, শব্দ যদিও কবিতার মাধ্যম, এমন কী কবিতার অস্তিত্ব যদিও শব্দের অস্তিত্বের উপরে একান্তভাবে নির্ভরশীল, তবু কবিতা ও শব্দকে তুল্যমূল্য কিংবা সমার্থক বলে গণ্য করা চলে না!
কোনও কালেরই কোনও কবি কিংবা সমালোচক যে তা করেছেন, তাও নয়। কবিতার আলোচনায় এই অভিমত তবে প্রাধান্য পেয়েছিল কেন যে, পোয়ট্রি ইজ ওয়র্ডস? প্রাধান্য যাঁরা দিয়েছিলেন, কবিতাকে যে তাঁরা মুখ্যত একটি ভাষা- শিল্প বলে গণ্য করতেন, তাতে সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, নিতান্ত ভাষা-শিল্প না-ভেবে, কবিতাকে যাঁরা বিশেষ এক ধরনের ভাষার শিল্প বলে মনে করতেন, প্রতিপত্তি তাদেরও কিছু কম ছিল না। তাঁরা এমনও ভাবতেন যে, কবিতা হচ্ছে এমনই সুকুমার একটি শিল্প, যা তার উপাদান হিসেবে শুধু সুকুমার শব্দই দাবি করে। সমস্ত শব্দই যে কবিতায় ব্যবহৃত হবার যোগ্য, এবং, যোগ্যজনের হাতে পড়লে, কোনও শব্দকেই যে কবিতার মধ্যে অনধিকার- প্রবেশকারীর মতো অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, এই উদার ধারণা তাঁদের কাছে প্রশ্রয় পায়নি। ‘পোয়েটিক ডিকশন’ বলে যে ব্যাপারটার সঙ্গে আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিত, তার প্রতি অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের অত্যধিক আসক্তির কথা আমরা শুনেছি। সেইসঙ্গে জেনেছি যে, শেক্সপিয়রের রচিত একটি সংলাপ কেন পরবর্তী কালের একজন বিখ্যাত সমালোচকের অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হয়েছিল। ম্যাকবেথের উক্তির মধ্যে ‘নাইফ’ শব্দটা ডঃ স্যামুয়েল জনসনের পছন্দ হয়নি; বস্তুত তাঁর এমনও মনে হয়েছিল যে, ওই শব্দটা থাকার ফলে গোটা সংলাপটাই একেবারে ঝুলে গেছে। মনে হবার কারণ আর কিছুই নয়, ‘নাইফ’ নামক অস্ত্রটি কসাই ও পাচকেরা ব্যবহার করে থাকে, এবং—ডঃ জনসনের বিবেচনায় — এই ‘ইতরজনসংসর্গের ফলে তার শুচিতা নষ্ট হয়েছে, সুতরাং কবিতায় তার উল্লেখ নিষেধ। শেক্সপিয়ারের কপাল ভাল, ডঃ জনসনের পাল্লায় তাঁকে পড়তে হয়নি, স্বদেশীয় সাহিত্যের শব্দরুচি অত্যধিক সভ্যভব্য হয়ে উঠবার অনেক আগেই তিনি ধরাধাম পরিত্যাগ করতে পেরেছিলেন।
কাব্যিক শব্দের প্রতি এই যে পক্ষপাত, এটা কিন্তু একান্তভাবেই অষ্টাদশ শতকের ব্যাপার নয়, কিংবা বিশেষভাবে ইংরেজি সাহিত্যেরও ব্যাপার নয় । এই সেদিনও বাংলা কাব্যসাহিত্যের যা ছিল প্রধান স্রোতোধারা, এবং মুখ্যত যা ছিল রবীন্দ্রপ্রতিভা ও রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে উৎসারিত, গত শতাব্দীর অন্ত্য অধ্যায় ও এই শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশকে তার মধ্যেও এই একই পক্ষপাত আমরা দেখতে পাই। আমরা লক্ষ করি যে, সাধারণ মানুষরা তাদের কথাবার্তায় যে-সব শব্দ প্রায়শ ব্যবহার করে থাকে, সেই আটপৌরে শব্দগুলি সেখানে বিশেষ প্রশ্রয় পায় না, এবং সাধারণ মানুষদের নিত্যব্যবহার্য নানা সাংসারিক জিনিসপত্র সম্পর্কেও সেই কবিতা বড় বিস্ময়করভাবে নীরব থাকে।
অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ কবি টমাস গ্রে বলেছিলেন, কবিতা কখনও তার সমকালীন ভাষায় রচিত হয় না। গ্রের এই উক্তিকেই বাংলা কবিতা পরবর্তী শতকে তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিল কি না, তা আমাদের জানা নেই। তবে, উনিশ শতকের অন্ত্য অধ্যায় থেকে তাঁর মৃত্যুকাল অবধি যিনি ছিলেন বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ, সেই রবীন্দ্রনাথের, অন্যবিধ সাহিত্যকর্মে না হোক, কবিতায়—এমনকী, এই শতাব্দীর প্রথম তিন দশকের মধ্যে রচিত কবিতায়—যে-শব্দরুচির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, তাতে আমরা বুঝতে পারি যে, কবি হিসেবে তিনিও ছিলেন ‘কাব্যিক’ শব্দের পক্ষপাতী। তাঁর সাহিত্য- বিষয়ক নিবন্ধাবলিতেও এই সত্যটা গোপন থাকেনি। সেখানে তিনি দাবি করছেন বটে, “আমি নিজে জাত-মানা কবির দলে নই,” কিন্তু পরক্ষণেই বলছেন, “বাঁশবনের কথা পাড়তে গেলে অনেক সময় বেণুবন বলে সামলে নিতে হয়।” শুনে কি গ্রের কথাটাই মনে পড়ে না ? আবার যখন শুনি, “বকফুল, বেগুনের ফুল, কুমড়োফুল, এই-সব রইল কাব্যের বাহির দরজায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে ; রান্নাঘর ওদের জাত মেরেছে,”৬ তখন সেই জনসনের কথাই আমাদের মনে পড়ে যায়, যিনি বিশ্বাস করতেন যে, কসাই ও পাচকের ‘সংসর্গদোষ নাইফ শব্দটার জাত মেরে দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ যে সেই পর্যায়ে রচিত তাঁর কবিতায় কোথাও আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করেননি, কিংবা নামোল্লেখ করেননি আমাদের নিত্যব্যবহার্য বস্তুসামগ্রীর, তা অবশ্য নয়। এক্ষুনি আমার মনে পড়ছে গত শতকের অন্ত্য দশকে রচিত তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতার কথা, যেখানে ‘হাঁড়ি’ ‘সরা’ থেকে শুরু করে ‘গুড়ের পাটালি’ আর ‘ঝুনা নারিকেল’ পর্যন্ত এমন সমস্ত শব্দের উল্লেখ ঘটেছে, হেঁশেল আর উদরের সঙ্গে যাদের ‘সংসর্গদোষের’ কথা আমরা সবাই জানি। উপরন্তু সেখানে ব্যবহৃত হচ্ছে আটপৌরে বাগভঙ্গিমাও। কিন্তু একইসঙ্গে আমরা লক্ষ না-করে পারি না যে, এই জাত-যাওয়া বস্তুসামগ্রীর নাম আর আটপৌরে বাগ্ভঙ্গিমা আসছে কবিতাটির শুধু সেই অংশেই, যেখানে তিনি একটু রঙ্গরসের লঘু আবহ গড়ে তুলতে চান। আমরা বুঝতে পারি, আটপৌরে শব্দ আর আটপৌরে বাগভঙ্গিমা সেখানে তাঁর কৌতুকের উপকরণ মাত্র। তার বেশি মর্যাদা তিনি তখনও তাদের দিচ্ছেন না। এমনকী, তার অনেক বছর পরে লেখা, এবং প্রায় একই রকমের বিখ্যাত, আর-একটি কবিতাতেও না। সেখানে রুগ্ণা নারীটি যখন বলে, “রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধা/বাইশ বছর এক চাকাতে বাঁধা”, তখন সেই বক্তব্যের সূত্র ধরে কত অনায়াসেই তো নিত্যব্যবহার্য নানা তৈজসপত্রের উল্লেখ ঘটতে পারত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তা ঘটতে দেন না, হেঁশেলের আভাসমাত্র দিয়েই তাঁকে—তাঁরই ভাষায় বলি— “সামলে নিতে হয়।” অথচ ও-সব জিনিসের উল্লেখ ঘটলে কবিতাটির বেদনার দিকটা যে কিছুমাত্র চাপা পড়ত, এমন কথা বিশ্বাস করবার কোনও যুক্তি নেই ।
লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, ইংরেজি সাহিত্যের হঠাৎ-ভব্য হয়ে ওঠা পরিবেশের মধ্যে স্যামুয়েল জনসন যখন ‘অকাব্যিক’ শব্দের দিকে তাঁর নিষেধের তর্জনী তুলে ধরছিলেন, টমাস গ্রে যখন সমকালীন ভাষা থেকে কবিতার ভাষাকে একেবারে আলাদা করে চিহ্নিত করে দিচ্ছিলেন, এবং অলিভার গোল্ডস্মিথ যখন তাঁর এই প্রত্যয়কে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টায় ছিলেন যে, সব শব্দ নয়, প্রতিটি ভাষাতেই আসলে কবিতায় ব্যবহৃত হবার যোগ্য আলাদা এমন-কিছু শব্দ রয়েছে, যা আমাদের কল্পনাকে দীপিত করে ও কর্ণকে আরাম দেয়,১০ তখন অন্যদিকে ধীরে-ধীরে তৈরি হয়ে উঠছিল বিদ্রোহের পটভূমি। আমরা জানি যে, এর কিছুদিন বাদেই আবির্ভাব ঘটবে ওয়র্ডসওয়র্থের। জানি যে, পোশাকি শব্দকে নির্বাসনে পাঠাবার আহ্বান জানাবেন তিনি। বলবেন যে, শুধু সেই ভাষাতেই কবিতা লেখা উচিত, যা কিনা মানুষের নিত্যব্যবহার্য মুখের ভাষা। ১১
১. …it looks as if his (Aristotle’s ] treatise on poetry was an answer to Plato’s challenge.” (আরিস্টটলের কাব্যতত্ত্বের ইনগ্রাম বাইওয়াটারকৃত অনুবাদের ভূমিকা।)
২. ‘রাজশেখর ও কাব্যমীমাংসা’। শ্রীনগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
৩. The Design of Poetry. Charles B. Wheeler.
৪. ৫. ৬. সাহিত্যধর্ম। ‘সাহিত্যের পথে’।
৭. যেতে নাহি দিব (১২৯৯ বঙ্গাব্দ)। ‘সোনার তরী।’
৮. মুক্তি (১৩২৫ বঙ্গাব্দ)। ‘পলাতকা।’
৯. “The language of the age is never the language of poetry.” Thomas Gray.
১০. “There are certain words in every language particularly adapted to the poetical expression; some from the image or idea they convey to the imagination; and some from the effect they have upon the ear.” Oliver Goldsmith.
১১. “…the real language of men.” W. Wordsworth