proggapath, progga, bangla literature, প্রজ্ঞাপাঠ, বাংলা সাহিত্য, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, প্রজ্ঞা, গল্প, বাংলা গল্প, রহস্য গল্প, রম্য রচনা, শিল্প-সাহিত্য, Story, golpo, Art and literature, মুহাম্মদ আশিক, Muhammad Ashik, লীলাবতী, lilaboti

লীলাবতী

০ মন্তব্য দর্শক

দ্বিতীয় কিস্তি :

(খ)

সন্ধ্যা তখনও পুরোপুরি নামে নাই; দিনের আলো একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছে। সূর্য্যটা ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে— আলো আর অন্ধকারের মধ্যেকার খেলায় একটা ক্লান্ত কোমল দন্ধ মিশে আছে। আমি দুধকুমার নদীর তীরে চুপচাপ বসে আছি। এই জায়গাটা আমার একান্ত আপন। এখানে এলেই মনটা হাল্কা লাগে, ভেতরে জ্বমে থাকা ব্যথাগুলো যেন নীরবে নদীর স্রোতে মিশে যায়। তাই তো মাঝে মাঝে এখানে এসে নিজের ভেতরের ধুলো-ময়লা ঝেড়ে ফেলি; একটু একটু নতুন হয়ে উঠি।
নদীর ওপারে কাশবন দুলছে হাল্কা বাতাসে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। কোথাও একটা বাঁশির মতো পাখির ডাক ভেসে আসে, আবার মিলিয়ে যায় অচেনা অন্ধকারে। আমি তন্ময় অথচ উৎসুখ হয়ে সমস্তটা দেখছি। হঠাৎ মোবাইলটা কেঁপে উঠলো। চোখ নামিয়ে চেয়ে দেখি পরিচিত নাম্বার, কিন্তু রোজকার নয়। রিসিভ করলাম— “হ্যালো।”
ওপাশ থেকে খুব নরম গলায় উত্তর এলো— “আসসালামু আলাইকুম, গুরুজী! আপনি কথা বলার মতো সময় পাবেন?”
“তুমি তো— হ্যাঁ, নিশ্চিন্তে বলো না। কিন্তু তোমার কণ্ঠটা বিষণ্ন লাগছে কেন?”
একটা দীর্ঘশ্বাসের ভেতর হাল্কা হাসি মিশিয়ে বললো— “বলতে গেলে কণ্ঠটা বিষণ্নতা নিয়েই জন্মেছি। যাকগে আপনি ভাল আছেন?”
“হুম, আছি ভাল। তুমি ভাল?”
“একদম ভাল নেই। আসলে অনেকদিন ধরে ভেতরে অনেক কথা জ্বমে আছে, বলার মতো কাউকে পাই নি; আপনাকে বলার ভরসা হচ্ছে।”
“আমি শুনবো।” — এই বলে আমি নদীর দিকে চেয়ে থাকি। ওপার থেকে লীলাবতী ধীরে ধীরে খুলতে থাকে তার জীবনের অজানা অধ্যায়।
“জানেন গুরুজী, আপনার লেখা আমি প্রথম যেদিন পড়ি, মনে হয়েছিল, কেউ যেন চুপিচুপি আমার ভিতরের শব্দহীন কণ্ঠটা শুনে ফেলছে। আপনি কীভাবে বোঝেন? এমনসব কথা, যা আমি কাউকে কোনদিন বলি নি, যা শুধু রাতের নীরবতায় নিজেকে বলেছি বারবার— সেই কথাগুলোই আপনার বাক্যে খুঁজে পাই।
সেদিন থেকেই মনে হচ্ছিল আপনার সামনেই বলা যায়। আপনাকে বলা মানে আত্মমুক্তি। আমি বলতে পারি?”
“পারো।”
“জানেন গুরুজী, আমার জন্মদিনের তারিখটা আমার মা প্রায় ভুলে যান। তবে আমার জন্মদিনটা কখনো ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়; কারণ ঐ দিনটিই তো আমাদের পরিবারকে দীর্ঘকালীন ঘন-কালো অন্ধকারে ঢেকে রেখেছে। যেন আমি জন্মাইনি; রাহুর মতো অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছি— পরিবারের উপর, মায়ের উপর।
আমার জন্মের পর পরেই মায়ের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। শুরুটা ছিল সূক্ষ্ম— একটা শূন্য দৃষ্টি, মাঝেমধ্যে ফাঁকা হাসি, অথবা কোন পূর্বাভাস ছাড়াই চমকে ওঠা। ডাক্তার বলেছিলেন, মানসিক ভারসাম্যের কিছু সমস্যা। কিন্তু সেই সমস্যাটা যেন আমাদের ঘরের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ল। একটা অদৃশ্য অন্ধকার নেমে এলো আমাদের চারপাশে, যার উৎস আমি— আমার জন্ম।
বাবা তখন চাকরিতে। খবর পেয়ে ছুটে এলেন। দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে যখন ফিরে গিয়েছিলেন কর্মস্থলে, চাকরিটা আর পাননি। তারপর থেকে আমার দিকে তাকালে তাঁর চোখে একটা কথাই ফুটে উঠত— ‘আমি অলক্ষ্মী।’ আমি বুঝি— বাবার প্রতিবারের চাহনিতে, নিরবতা ভরা মুখে আমি টের পাই— আমি অপ্রিয়। আমার অস্তিত্বটা তাঁর কাছে অনাকাঙ্খিত, একরকমের অভিশাপ।
তবে একটা মানুষ ছিলেন, যে আমাকে আগলে রাখত— আমার বুবু। ঐ ছিল আমার আশ্রয়স্থল। ওর বুকের কাছে মুখ লুকিয়ে আমি কান্না চেপে রাখতাম।
মা আছেন, তবে সেই থাকাটা শুধুই শরীরী উপস্থিতি। তাঁর চোখে এক অদ্ভূত ঘোর। নিজের ভিতর ডুবে আছেন চুপচাপ।
আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি— হাত ধরেছি, কাঁদতে কাঁদতে জেগে থাকা রাতগুলো পাশে গিয়ে বসেছি, কিন্তু কোনদিন সেই চোখে আমার প্রতি এতটুকু সহানুভূতি পাইনি। তিনি যেন একা হেঁটে চলেছেন এক অজানা স্বর্গের পথ ধরে। আর আমি, আমি শুধু অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থেকেছি।
আমি অনেক সময় ভাবি, মা কি জানেন আমি কতবার তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে থেমে গেছি? তিনি কি টের পান, একটা ছোট্ট ছেলে কী গভীর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে থাকে?
আমি এসব দেখেই আপন মনে সিদ্ধান্ত গেঁথে নিয়েছি, আমি একদিন ডাক্তার হব। আমি মাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাব। আমি প্রমাণ করব, আমার জন্ম অনন্ত অভিশাপ নয়।
তবু গভীর রাত হলে, যখন আমি নিঃশব্দে নিজের সাথে কথা বলি, তখন নিজের বুকের ভেতর একটা প্রশ্ন শুনি— ‘আমি কি তবে দায়ী?’ মায়ের সেই নির্লিপ্ত চোখ, বাবার নীরব ক্ষোভ, সংসারের অস্বচ্ছলতা— এই সব কিছুর শিকড় কি আমার জন্মেই?
জানেন গুরুজী, আপনার একটা লেখার ছোট্ট একটা বাক্য আমায় একদিন থমকে দিয়েছিল— ‘কিছু কিছু মানুষ আসে এক অপ্রস্তুত সময়ের ভিতর, তাই তারা হয়ে ওঠে সময়ের ভার।’ জানিনা আপনি কার কথা ভেবে লিখেছেন এটি, তবে আমি এই বাক্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।
জানেন গুরুজী, আজ আপনাকে এইসব বলার পর অনেকটা হাল্কা অনুভব করছি।”
লীলাবতীর কথা থামার পর আমি একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাই। দুধকুমার নদীর স্রোত বয়ে চলেছে একই ছন্দে, কিন্তু আমার ভেতরে যেন এক তীব্র ঢেউ খেলে গেল। কী বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, শুধু বললাম— “তোমার ভিতরে এক সমুদ্র আছে, আমি শুধু তীরে দাঁড়িয়ে আছি সে সমুদ্রের ঢেউ ছুঁয়ে দেখার সাহস নিয়ে।”
ফোনের ওপারে নীরব কান্না। নদীর জলে সন্ধ্যার শেষ আলো ডুবে যায়। রাত নামে ধীরে ধীরে…

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

লীলাবতী

দর্শক

দ্বিতীয় কিস্তি :

(খ)

সন্ধ্যা তখনও পুরোপুরি নামে নাই; দিনের আলো একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছে। সূর্য্যটা ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে— আলো আর অন্ধকারের মধ্যেকার খেলায় একটা ক্লান্ত কোমল দন্ধ মিশে আছে। আমি দুধকুমার নদীর তীরে চুপচাপ বসে আছি। এই জায়গাটা আমার একান্ত আপন। এখানে এলেই মনটা হাল্কা লাগে, ভেতরে জ্বমে থাকা ব্যথাগুলো যেন নীরবে নদীর স্রোতে মিশে যায়। তাই তো মাঝে মাঝে এখানে এসে নিজের ভেতরের ধুলো-ময়লা ঝেড়ে ফেলি; একটু একটু নতুন হয়ে উঠি।
নদীর ওপারে কাশবন দুলছে হাল্কা বাতাসে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। কোথাও একটা বাঁশির মতো পাখির ডাক ভেসে আসে, আবার মিলিয়ে যায় অচেনা অন্ধকারে। আমি তন্ময় অথচ উৎসুখ হয়ে সমস্তটা দেখছি। হঠাৎ মোবাইলটা কেঁপে উঠলো। চোখ নামিয়ে চেয়ে দেখি পরিচিত নাম্বার, কিন্তু রোজকার নয়। রিসিভ করলাম— “হ্যালো।”
ওপাশ থেকে খুব নরম গলায় উত্তর এলো— “আসসালামু আলাইকুম, গুরুজী! আপনি কথা বলার মতো সময় পাবেন?”
“তুমি তো— হ্যাঁ, নিশ্চিন্তে বলো না। কিন্তু তোমার কণ্ঠটা বিষণ্ন লাগছে কেন?”
একটা দীর্ঘশ্বাসের ভেতর হাল্কা হাসি মিশিয়ে বললো— “বলতে গেলে কণ্ঠটা বিষণ্নতা নিয়েই জন্মেছি। যাকগে আপনি ভাল আছেন?”
“হুম, আছি ভাল। তুমি ভাল?”
“একদম ভাল নেই। আসলে অনেকদিন ধরে ভেতরে অনেক কথা জ্বমে আছে, বলার মতো কাউকে পাই নি; আপনাকে বলার ভরসা হচ্ছে।”
“আমি শুনবো।” — এই বলে আমি নদীর দিকে চেয়ে থাকি। ওপার থেকে লীলাবতী ধীরে ধীরে খুলতে থাকে তার জীবনের অজানা অধ্যায়।
“জানেন গুরুজী, আপনার লেখা আমি প্রথম যেদিন পড়ি, মনে হয়েছিল, কেউ যেন চুপিচুপি আমার ভিতরের শব্দহীন কণ্ঠটা শুনে ফেলছে। আপনি কীভাবে বোঝেন? এমনসব কথা, যা আমি কাউকে কোনদিন বলি নি, যা শুধু রাতের নীরবতায় নিজেকে বলেছি বারবার— সেই কথাগুলোই আপনার বাক্যে খুঁজে পাই।
সেদিন থেকেই মনে হচ্ছিল আপনার সামনেই বলা যায়। আপনাকে বলা মানে আত্মমুক্তি। আমি বলতে পারি?”
“পারো।”
“জানেন গুরুজী, আমার জন্মদিনের তারিখটা আমার মা প্রায় ভুলে যান। তবে আমার জন্মদিনটা কখনো ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়; কারণ ঐ দিনটিই তো আমাদের পরিবারকে দীর্ঘকালীন ঘন-কালো অন্ধকারে ঢেকে রেখেছে। যেন আমি জন্মাইনি; রাহুর মতো অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছি— পরিবারের উপর, মায়ের উপর।
আমার জন্মের পর পরেই মায়ের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। শুরুটা ছিল সূক্ষ্ম— একটা শূন্য দৃষ্টি, মাঝেমধ্যে ফাঁকা হাসি, অথবা কোন পূর্বাভাস ছাড়াই চমকে ওঠা। ডাক্তার বলেছিলেন, মানসিক ভারসাম্যের কিছু সমস্যা। কিন্তু সেই সমস্যাটা যেন আমাদের ঘরের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ল। একটা অদৃশ্য অন্ধকার নেমে এলো আমাদের চারপাশে, যার উৎস আমি— আমার জন্ম।
বাবা তখন চাকরিতে। খবর পেয়ে ছুটে এলেন। দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে যখন ফিরে গিয়েছিলেন কর্মস্থলে, চাকরিটা আর পাননি। তারপর থেকে আমার দিকে তাকালে তাঁর চোখে একটা কথাই ফুটে উঠত— ‘আমি অলক্ষ্মী।’ আমি বুঝি— বাবার প্রতিবারের চাহনিতে, নিরবতা ভরা মুখে আমি টের পাই— আমি অপ্রিয়। আমার অস্তিত্বটা তাঁর কাছে অনাকাঙ্খিত, একরকমের অভিশাপ।
তবে একটা মানুষ ছিলেন, যে আমাকে আগলে রাখত— আমার বুবু। ঐ ছিল আমার আশ্রয়স্থল। ওর বুকের কাছে মুখ লুকিয়ে আমি কান্না চেপে রাখতাম।
মা আছেন, তবে সেই থাকাটা শুধুই শরীরী উপস্থিতি। তাঁর চোখে এক অদ্ভূত ঘোর। নিজের ভিতর ডুবে আছেন চুপচাপ।
আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি— হাত ধরেছি, কাঁদতে কাঁদতে জেগে থাকা রাতগুলো পাশে গিয়ে বসেছি, কিন্তু কোনদিন সেই চোখে আমার প্রতি এতটুকু সহানুভূতি পাইনি। তিনি যেন একা হেঁটে চলেছেন এক অজানা স্বর্গের পথ ধরে। আর আমি, আমি শুধু অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থেকেছি।
আমি অনেক সময় ভাবি, মা কি জানেন আমি কতবার তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে থেমে গেছি? তিনি কি টের পান, একটা ছোট্ট ছেলে কী গভীর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে থাকে?
আমি এসব দেখেই আপন মনে সিদ্ধান্ত গেঁথে নিয়েছি, আমি একদিন ডাক্তার হব। আমি মাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাব। আমি প্রমাণ করব, আমার জন্ম অনন্ত অভিশাপ নয়।
তবু গভীর রাত হলে, যখন আমি নিঃশব্দে নিজের সাথে কথা বলি, তখন নিজের বুকের ভেতর একটা প্রশ্ন শুনি— ‘আমি কি তবে দায়ী?’ মায়ের সেই নির্লিপ্ত চোখ, বাবার নীরব ক্ষোভ, সংসারের অস্বচ্ছলতা— এই সব কিছুর শিকড় কি আমার জন্মেই?
জানেন গুরুজী, আপনার একটা লেখার ছোট্ট একটা বাক্য আমায় একদিন থমকে দিয়েছিল— ‘কিছু কিছু মানুষ আসে এক অপ্রস্তুত সময়ের ভিতর, তাই তারা হয়ে ওঠে সময়ের ভার।’ জানিনা আপনি কার কথা ভেবে লিখেছেন এটি, তবে আমি এই বাক্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।
জানেন গুরুজী, আজ আপনাকে এইসব বলার পর অনেকটা হাল্কা অনুভব করছি।”
লীলাবতীর কথা থামার পর আমি একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাই। দুধকুমার নদীর স্রোত বয়ে চলেছে একই ছন্দে, কিন্তু আমার ভেতরে যেন এক তীব্র ঢেউ খেলে গেল। কী বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, শুধু বললাম— “তোমার ভিতরে এক সমুদ্র আছে, আমি শুধু তীরে দাঁড়িয়ে আছি সে সমুদ্রের ঢেউ ছুঁয়ে দেখার সাহস নিয়ে।”
ফোনের ওপারে নীরব কান্না। নদীর জলে সন্ধ্যার শেষ আলো ডুবে যায়। রাত নামে ধীরে ধীরে…

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত