proggapath, progga, bangla literature, bangla kobita, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, প্রজ্ঞাপাঠ, বাংলা সাহিত্য, কবিতা, বাংলা কবিতা, প্রজ্ঞা, গল্প, বাংলা গল্প, রহস্য গল্প, রম্য রচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, শিল্প-সাহিত্য, নাটক, চিঠি, patropanyas, poem, Story, golpo, bangla poem, bangla Story, Rahasya golpo, Rommo Rocona, Articles, Prabandha, Novel, Upanyas, Drama, Natok, Letter, Cithi, Art and literature, silpo-sahityo, শফীউদ্দীন সরদার, shafiuddin sardar, বিদ্রোহী জাতক, bidrohi jatok

বিদ্রোহী জাতক

০ মন্তব্য দর্শক

এক :

এইযে, শুনুন। শুনতে পাচ্ছেন ?
জি, আমাকে বলছেন?
আপনি ছাড়া আর কেউ আছে এখানে?
সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে নজর দিলো তাজউদ্দীন। দেখে নিয়ে বললো- নাতো, আর কেউ নেই।
তটিনীর হাসি পেলো। আলতোভাবে দাঁতের তলে ঠোঁট ফেলে বললো- তাহলে আপনাকেই বলছি।
সুবেহ্ সাদিকের সাথে সাথেই তাজউদ্দীন হররোজ ঘুম থেকে ওঠে। ফজরের নামাজ আদায় করে কয়েক কদম হাঁটে। আঁধারটা ফিকে হয়ে এলেই সে মজবুত হয়ে তাঁতের পাশে বসে। শুরু হয় খটাশ খটাশ্ আওয়াজ। বৈঠকখানার বারান্দায় একাই বসে কাপড় বোনে তাজউদ্দীন। নও-মুসলিম মরিয়ম ওরফে মমতা বিশ্বাসের সংসারে সে বসে বসে খেতে চায়না। খেটে খেতে চায়।
তটিনী বিশ্বাস পাশের ঘরেই শোয়। তাঁতের এই খটাশ্ খটাশ্ আওয়াজে হররোজ ঘুম ভাঙ্গে তটিনীর। পয়লা পয়লা তটিনী বিশ্বাস বিরক্তি বোধ করতো। এখন আর করে না। এখন তার সয়ে গেছে। ঘুম ভাঙ্গলে আবার সে পাশ ফিরে শোয়। আর একদফা ঘুমিয়ে নিয়ে বেলা উঠলে ওঠে। আজও তাই করলো। কিন্তু আজ আর কিছুতেই ঘুম চোখে এলো না। গতরাতের ঘটনায় কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছে সে। এপাশ ওপাশ করতে করতে অনেক সময় কেটে গেল৷ উদীয়মান সূর্যের বিচ্ছুরিত আভায় পূব আকাশ রোশনাই হয়ে উঠলো। শয্যা ছেড়ে অগত্যা উঠে এলো তটিনী। চোখে-মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। ঘটনাটা সঠিকভাবে জানার জন্যে সে তার জেঠা মশাইয়ের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
তাজউদ্দীনের সামনে দিয়ে পথ। কিছুটা কৌতূহলের বশেই সে তাজউদ্দীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। লোকটা যে একেবারেই না লায়েক, কান্ডজ্ঞানহীন নির্বোধ, সে তা জানতো। তার প্রশ্নের জবাবে সে যখন চারদিক দেখে নিয়ে বললো-না, সে ছাড়া আর কেউ নেই সেখানে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তটিনীর হাসি পেলো। সে হাসিমুখে বললো- তাহলে আপনাকেই বলছি। হাতের কাজ বন্ধ করে তাজউদ্দীন নড়ে চড়ে বসলো। বললো- আমাকে? জি, বলুন! তটিনী বললো-গতরাতে হাতেম খাঁর বাড়িতে ফৌজী হামলা হয়েছিল, জানেন ?
জি, জানি।
তারা নাকি ওপাড়ার মুসল্লীদের খতম করতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে কে একজন কোথা থেকে এসে তামাম ফৌজীলোকদের একাই লাঠিপেটা করে গ্রাম থেকে নামিয়ে দিয়েছে-কথাটা কি ঠিক?
খানিকটা ঠিক।
মানে ?
একা সে অতটা পারতো না। মুসল্লীরাও লাঠি হাতে তার পাশে দাঁড়িয়ে লড়েছিল বলেই সে
পেরেছে।
ঐ এক কথাই হলো। লোকটা আগেই এসে সেপাইদের পাল্টা হামলা না করলেতো মুসল্লীরা লাঠি ধরার সাহসই পেতোনা!
তা হয়তো পেতোনা ।
তাজ্জব! কোথা থেকে এলো লোকটা?
অন্ধকারের মধ্যে কেউ সেটা ঠাহর করতে পারেনি।
কেউ কেউ আবার বলছে-লোকটা নাকি অনেকটা আপনার মতো দেখতে!
তাই বলছে?
তাইতো কেউ কেউ বলছে!
তটিনী মুখ টিপে হাসতে লাগলো। কোন দিকে না চেয়ে তাজউদ্দীন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো ।
সে বললো-তাহলে তো আমার নসীবটা খুব শানদার, না কি বলেন ?
কেন ?
এতবড় একটা তারিফের হকদার হওয়ার মওকা
সে গুড়ে বালি!
তটিনী বিশ্বাস উপেক্ষার সাথে বললো। তাজউদ্দীন প্রশ্ন করলো কেন?
হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ইষৎ ঝাঁকুনি দিয়ে তটিনী বিশ্বাস বললো- তারিফের হকদার হতে
গেলে কিছুটা হিম্মত থাকা চাই। আপনাকে তেমন হিম্মতদার কেউ ভাবলে তো?
কেউ তা ভাবে না?
তারা কি কেউ পাগল ?
তাহলে আর বলছে কেন ?
কতকটা আপনার মতো দেখতে, সেই কথা বলছে। আপনিই সেই লোক- সেটাতো কেউ বলছে না।
তাজউদ্দীন আবার একটু নড়েচড়ে উঠলো। বললো- তাহলেও আমাকে ভাগ্যবান বলতে পারেন।
কি করে ?
কোন ঝুটঝামেলা এসে আমার ঘাড়ে চাপছে না।
ক্ষণিকের জন্যে তটিনী বিশ্বাস নীরব হয়ে গেল। এক নজরে কিছুক্ষণ লোকটার দিকে চেয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে বললো- যতটা বোকা ভাবতাম, ঠিক ততটা বোকা নন দেখছি। কিছু হুশবুদ্ধিও আছে!
তটিনীর অধরে ক্ষীণ একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে আবার মিলিয়ে গেল।
তাজউদ্দীন বললো -জি?
তটিনী এবার খানিকটা হুকুম করেই বসলো। বললো- চোখকান খোলা রাখবেন সব সময় দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে এখন।
অতঃপর সে হন হন করে তার জেঠা মশাইয়ের বাড়ির দিকে চলে গেল।
মুসলমানদের আগমনের প্রাক্কালে বাংলামূলুকে প্রধানত হিন্দুরাই বাস করতো। কারণ, বাংলামুলুকে বসবাসকারী বৌদ্ধরা শংকরাচার্যের হিন্দু ধর্ম সংস্কারের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাবে ইতিমধ্যেই পূর্বদিকে সরতে সরতে সোনারগাঁ হয়ে আরাকান এবং আরাকান হয়ে অনেকেই দূরপ্রাচ্যে চলে যায়। মুসলমানদের হুকুমাত প্রতিষ্ঠা হওয়ার ওয়াক্তে কিছু বহিরাগত মুসলমান এদেশে এলেও, তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। এদেশের মুসলমানদের বিপুলাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা মুসলমান। ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ – বিন – বখতিয়ার খলজীর অভিযানের সাথে সাথেই বাংলামুলুকে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে। বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান সুফী সাধক ইসলাম প্রচারের ইরাদায় সমুদ্র পথে বাংলামুলুকে আসেন। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে খানকাহ, মাদ্রাসা, মুসাফিরখানা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান । খুলে ইনসানের খেদমত ও ইসলামের মাহাত্ম প্রচার করতে থাকেন।
সময়টাও অত্যন্ত অনুকুল ছিল তাঁদের পক্ষে। বল্লাল সেন সৃষ্ট কৌলীন্য প্রথার বা শ্রেণীভেদের নিষ্পেষণে এই সময় মধ্যম ও নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের অত্যাচারে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছিল। ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়েরা মানুষের ন্যূনতম ইযযতও বৈশ্য আর শূদ্রদের দিতোনা। অস্পৃশ্য ও অপাংক্তেয় করে রেখে ইতর প্রাণীর কাছাকাছি একটা জীব বলে তারা এদের গণ্য করতো। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে নাজাত পাওয়ার জন্যে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা উন্মুখ ছিল এই সময়। ইসলামের সাম্যবাদের সৌন্দর্যে আর জীবন ব্যবস্থার মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে স্বাভাবিকভাবেই বৈশ্য এবং বিশেষ করে শূদ্রেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। মুসলমান শাসন এদেশে কায়েম হওয়ার পর এ প্রক্রিয়া আরো জোরদার হয়ে ওঠে। বস্তুত পরবর্তীতে শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত সাম্যবাদের হাওয়া এসে হিন্দুধর্মে না লাগলে, কুলীন হিন্দু ছাড়া নিম্ন ও মধ্যশ্রেণীর হিন্দুর কোন অস্তিত্বই এদেশে থাকতো না।
ইলিয়াসশাহী হুকুমাতের শেষের দিকে এই উপমহাদেশের বিখ্যাত দরবেশ হজরত নূর কুতুব-ই আলম সাহেবের খানকা শরীফ অত্যন্ত মশহুর হয়ে ওঠে। আর্তের আশ্রয়, অসহায়- এতিমদের আবাসস্থল এবং শিক্ষা ও নীতি আদর্শের পীঠস্থান হিসাবে তাঁর খানকাহ শরীফ শুধু মুসলমানদেরই নয় অনেক হিন্দুরও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা অর্জন করে। আশেপাশের মধ্য ও নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু পরিবার ইসলামের আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে এই সুফী সাহেবের কাছে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
বাঁশবাড়ির বিশ্বাস পরিবার, এই সময়ের এমনই একটা পরিবার যার বৃহত্তম অংশটাই ইসলাম গ্রহণ করে। বিশ্বাসেরা তিন ভাই মহেশ্বর বিশ্বাস বীরেশ্বর বিশ্বাস, সুরেশ্বর বিশ্বাস। পৃথক অন্নে বাস। একই ভিটেয় তিন ভাইয়ের লাগালাগি বাড়ি। বিশ্বাসেরা বাঁশবাড়ির বর্ধিষ্ণু পরিবার। ব্যবসায়ী ও বিত্তশালী লোক। রুচিশীল ও মার্জিত। এতদসত্ত্বেও শ্রেণীতে বৈশ্য হওয়ার কারণেই এঁদের চেয়ে বিষয়বিত্তে জ্ঞানেগুণে, রুচি-আচরণে – সর্বতোভাবে খাটো কয়েকঘর ব্রাহ্মণের মর্জির ওপর এঁদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ নির্ভরশীল ছিল। গ্রামের সামাজিক ক্রিয়া-অনুষ্ঠানে এদের কোন কতৃত্বই ছিল না। বিচারে, আচারে, পার্বণে, অনুষ্ঠানে এঁদের স্থান ছিল সব সময়ই নীচে শূদ্রদের পাশে। ব্রাক্ষ্মণদের হুকুম তামিল করা ছাড়া সামাজিক অনুশাসনে এদের কোন ভূমিকাই ছিল না।
তবু তাঁরা এই অবস্থা মেনে নিয়ে দিনগুজরান করছিলেন। বিস্ফোরণ ঘটলো এক মর্মান্তিক ঘটনায়। মেঝোভাই বীরেশ্বরের মেয়ে রুক্ষিণীকে বিয়ে করতে এসে পাওনা গন্ডার গোলমালে বিয়ের আসর থেকে বরপক্ষ উঠে যায়। আর যায় কোথায়। ব্রাহ্মণেরা সঙ্গে সঙ্গে রুক্ষিণীকে পাতকী বলে ঘোষণা দিয়ে বীরেশ্বরকে একঘরে করে এবং তাঁর নলজল বন্ধ করে দেয়। নিজের ভাইদের পরিবারের সাথেও বীরেশ্বরের পরিবারের উঠাবসা বন্ধ করে ব্রাক্ষ্মণেরা। ফলে রুক্ষিণীর পিতামাতার জীবনে এক চরম দিগ্‌দারী নেমে আসে। প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইতে গেলে ব্রাহ্মণেরা যে ফর্দ দাখিল করে, তাতে বিষয়বিত্ত-ভিটেমটি তামাম কিছু বেচলেও সে পরিমাণ অর্থ সংকুলান হয় না। অবশেষে শোকে দুঃখে বীরেশ্বর বিশ্বাস অসুস্থ হয়ে দেহত্যাগ করেন। বীরেশ্বরের স্ত্রী মমতা বিশ্বাসও শয্যা গ্রহণ করেন।
তার জন্যে পিতামাতার এই পরিণাম সহ্য করতে না পেরে রুক্ষিণী শেষ পর্যন্ত গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বীরেশ্বরের দুইটি মাত্র সন্তান ছিল। এক ছেলে আর এই মেয়ে রুক্মিণী। অল্প কিছুদিন আগে জোয়ান ছেলেটি সর্পাঘাতে মারা যায়। এবার রুক্ষিণীও আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বড়ভাই মহেশ্বরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। গাঁয়ের অধিকাংশ শূদ্রেরা এবং কয়েক ঘর বৈশ্যেরাও ইতিমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এবার তিনিও ভ্রাতৃবধু মমতাকে সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর মহেশ্বর বিশ্বাস মুহসীন বিশ্বাস, মমতা বিশ্বাস মরিয়ম বিশ্বাস এবং রুক্ষিণী রোকেয়া বিশ্বাস নামধারণ করেন। মুহসীন বিশ্বাসের পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরাও এইভাবে বিভিন্ন নামে পরিচিত হন। ইসলাম গ্রহণের পর পরই তিনি একজন মুসলমান সৎপাত্রের সাথে ধুমধাম করে রোকেয়া ওরফে রুক্ষিণীর বিয়ে দিয়ে দেন।
এ ঘটনা কয়েক বছর আগের। ছোটভাই সুরেশ্বর বিশ্বাস এ সময় রাজধানীতে ব্যস্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিও ধর্মান্তরে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বটে, কিন্তু পান্ডুয়ার হুকুমাতের এক ব্রাক্ষ্মণ সৈন্যাধ্যক্ষের অধীনে কর্মরত থাকায় চাকুরী হারানোর ভয়ে তিনি দোটানায় পড়ে যান। কয়েক বছর পর তিনি যখন শমশের বিশ্বাস নাম নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবেন বলে মনোস্থির করলেন, ঠিক তখনই পান্ডুয়ার হুকুমাতের পুরোপুরি ক্ষমতা রাজা গণেশ নিজের হাতে নিয়ে এদেশ থেকে মুসলমান উচ্ছেদের অভিযানে ব্রতী হন। রাজা গণেশ এযাবত পরোক্ষভাবে সর্বময় কর্তা হয়ে থাকলেও, পান্ডুয়ার নাম কা ওয়াস্তে সুলতান আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহকে অপসারণ করে এবার প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতাসীন হন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে তার আজন্ম আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। ফলে এই হুকুমাতের অধীনে চাকুরীরত থেকে জান এবং চাকুরী-এই দুইটিই হারানোর আশংকায় ইসলাম গ্রহণের দুঃসাহস সুরেশ্বর আর করেন না ৷
কিন্তু ইসলাম গ্রহণ না করলেও এবং একই ভিটেয় অবস্থিত তার মুসলমান জ্ঞাতিদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক না রাখলেও, আন্তরিকতার দিক দিয়ে তিনি তাঁর ভাইদের পরিবারের সাথে একান্ত ঘনিষ্ঠ এবং সহানুভূতিশীল ছিলেন। তটিনী বিশ্বাস এই সুরেশ্বরের কন্যা।
তটিনীর জেঠামশাই মুহসীন বিশ্বাস ব্যবসায়ী মানুষ। কাপড়ের ব্যবসায় তিনি অনেক টাকা খাটান। তাঁর নিজের একটা মস্তবড় কারখানা আছে তাঁতের। অনেক লোক খাটে সেখানে। এ ছাড়াও তিনি অন্যদের বুনানো কাপড় নগদ টাকায় কেনেন। তামামগুলো একত্র করে পাঠিয়ে দেন মহাজনদের কাছে। মহাজনেরা পাঠিয়ে দেন বন্দরে। কাপড় ওঠে জাহাজে। চলে যায় নানা দেশে-সুমাত্রায়, জাভায়, সিংহলে, পারস্যে, আরবে। বাংলামুলুকের সূতীবস্ত্রের বেজায় চাহিদা বাইরে। ব্যবসায়ীরা কাপড় বেচে অনেক টাকা কামায়। সে টাকার হিস্সা পায় তাঁতীরা। হিস্সা পায় তাজউদ্দীনও।
দাওয়ায় বসে মুহসীন বিশ্বাস ভাবছিলেন। মহাজনদের কাছে মাল পাঠানোর তারিখ আজ। সপ্তায় একবার করে মাল পাঠান মুহসীন সাহেব। নৌকা যোগে মাল যায় মহাজনদের ঘাটে। মুহসীন সাহেবের মতো আরো অনেক ব্যবসায়ীই মাল পাঠান সেখানে। অনেক দূরের পাল্লা। এককভাবে কারো নৌকা যায় না। জোট বেঁধে অনেক নৌকা এক সাথে ছাড়ে। লুটেরাদের হাতে কয়েকবার দাগা খাওয়ার পর এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু কাপড়ের নাওই যায় না। ধান, চাউল, তিল তিসির নৌকাও এক হাট থেকে অন্য হাটে, এক গঞ্জ থেকে অন্য গঞ্জে যায়। জাহাজভর্তি ফসল যায় বিদেশেও। অঢেল ফসল বাংলামুলুকে। তিন তিন বার ফসল ফলে বছরে। দামও খুব সস্তা। এই ফসল বাইরে পাঠালে অনেক মূল্য পাওয়া যায়৷ সেই পয়সায় বাইরে থেকে সোডা-কেরোসিন-মস্লা এনে বেনেতী দোকান খুললে পয়সা আরো বাড়ে। তাই কৃষিকাজের পাশাপাশি চুটিয়ে ব্যবসা চালায় এ মুলুকের লোকেরা।
ভোর হওয়ার সাথে সাথেই নৌকায় মাল তোলা শেষ হয়েছে। হিসেব বুঝে দেয়ার জন্যে বিশ্বাস সাহেবের কর্মচারীরা হুটপাট শুরু করেছে। দেরী হলে অন্য সব নাও ছেড়ে দেবে। কিন্তু বিশ্বাস সাহেবের কিছুতেই আজ উৎসাহ নেই। লাভ লোকসানে মন নেই। হিসাবের ফর্দটায় এক পলক চোখ বুলিয়েই কর্মচারীদের বিদায় করলেন বিশ্বাস সাহেব।
সকাল থেকেই তিনি অত্যন্ত পেরেশান আছেন। অশান্তিতে একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছেন। ধন-সম্পদ কোন কিছুরই অভাব নেই এদেশে। অভাব শুধু নিরাপত্তার। বিশেষ করে মুসলমানদের কি দিয়ে কি হয়ে গেল আচানক। এ অবস্থা এ মুলুকে কোনদিনই ছিল না। মুসলমান সুলতানদের আমলে হেফাজতির অভাবে সাধারণ মানুষ কোনদিন ভোগেনি। মুসলমানেরা তো নয়ই। হিন্দুরাও নয়। হেফাজতির প্রশ্ন নিয়ে কোন হিন্দুকে এক লহমার জন্যেও সোচ করতে হয়নি। তারা নির্ঝঞ্ছাটে ঘর সংসার করেছে। সে নিজেও তো হিন্দু ছিল কদিন আগে। সামাজিক অশান্তিটা ছাড়া এ ধরনের কোন ভাবনাই মাথায় তাদের আসেনি। এদিক দিয়ে, মায়ের কোলে থাকার মতো নিশ্চিন্তে ছিলেন। একদিনের কথা নয়। প্রায় দেড় দুইশো বছর ধরে এই অবস্থার সাথেই হিন্দু মুসলমান সকলেই পরিচিত। অখন্ড ক্ষমতা হাতে থাকা সত্ত্বেও একমাত্র প্রচার ছাড়া হাতিয়ার হাতে ইসলাম নিয়ে কোন হিন্দুর কাছে কেউ কখনও আসেনি। রাজা গণেশ তকতে বসার সাথে সাথেই একি গজব নেমে এলো দেশে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান প্রজাদের ঘরে আজ একি এক নিদারুণ আতংকের হাতছানি!
কর্মচারীরা বিদেয় হওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে মুহসীন বিশ্বাস এই ভাবনাই ভাবছিলেন। এই সময় তার সামনে এলো তটিনী। কোন ভূমিকা না করে সে সরাসরি বললো— জেঠামশাই, গত রাতের খবর কি বলুনতো! কি হয়েছিল ওপাড়ায় ?
মুহসীন বিশ্বাস নজর তুলে তটিনীর দিকে তাকালেন। নজর তাঁর নিষ্প্রভ। বললেন— বড় নাখোশ খবর মা। ওপাড়ার ঐ মসজিদের পাশে হাতেম খাঁর বাড়িতে কিছু মুসল্লী এসে আশ্রয় নিয়েছিল। বোস বাড়ির ওদিক থেকে তারা এখানে এসেছিল। খোঁজ পেয়ে রাজা গণেশের ফৌজ এসে রাতের অন্ধকারে তাদের ওপর চড়াও হয়।
কেন, কসুর কি তাদের?
রাজধানীতে হাজির হওয়ার জন্যে তাদের তলব দেয়া হয়েছিল। তারা হাজির হয়নি সেখানে।
কেন হাজির হলো না?
হলে কি আর ওয়াপস্ আসতে পারতো তারা! একটা না একটা কসুর দেখিয়ে তাদের খতম করে দেয়া হতো।
বলেন কি!
এমন ঘটনাতো হামেশাই ঘটছে এখন। কোন আলেম উলেমা আর সুফী ধরনের কোন লোক সেখানে গিয়ে আর ওয়াপস্ আসেনি। জ্ঞানী গুণী আর ধর্মভীরু মুসলমানদের আর কি কোন নিরাপত্তা আছে রাজধানীতে?
তাজ্জব!
ঘটনাটা এতদিন রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন এটা ক্রমেই গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের অনেক নীরিহ মুসলমানদেরও এখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং সূতোনাতা কারণ দেখিয়ে তাদের কোতল করা হচ্ছে।
সেকি কথা !
নানাদিক থেকে এমন পয়গাম হামেশাই আসছে এখন।
কারণটা কি জেঠা মশাই? দেশের রাজা প্রজার ওপর এমন জুলুম করবেন কেন?
কারণ ঐ একটাই। এদেশ থেকে ইসলামকে উচ্ছেদ করার এক বদখেয়াল রাজা গণেশের মগজের মধ্যে ঢুকেছে। তিনি এটা পুনরায় নির্জলা এক হিন্দুরাজ্য বানাবেন- এমনই এক খাহেশ হয়েছে এখন তাঁর। আর এই বদখেয়াল বাস্তবায়নের কারণেই তিনি এখন বেপরোয়াভাবে মুসলমানদের পেছনে লেগেছেন।
তাহলে তো বড় মুসিবতের কথা! তা ওপাড়ার ঐ মুসল্লীরা কোথায় এখন?
তারা অন্যত্র চলে গেছে।
ফৌজী হামলার হাত থেকে তারা রেহাই পেলো কিভাবে?
সবই আল্লাহর শান মা। তিনি কাউকে রক্ষে করলে, কার সাধ্যি তার গায়ে কাঁটার আঁচড় কাটে। আমরা যখন গেলাম তখন গোলমাল প্রায় থেমে গেছে। মুসল্লীরা বললেন— সেপাইরা এসে তাদের হামলা করার সাথে সাথে অন্ধকারের মধ্যে কে একজন কোথা থেকে তেড়ে এসে সেপাইদের ওপর লাঠি চালাতে শুরু করে। একজন সেপাই পড়ে যেতেই তার ঢাল তলোয়ার ছিনিয়ে নিয়ে সে লোকটা সেপাইদের সাথে তুমুল লড়াই শুরু করে। সে কি তার বিক্রম! একজনের আক্রমণেই একদল সেপাই নাজেহাল হয়ে পড়ে।
তারপর ?
তা দেখে হুঁশ হলো মুসল্লীদের। ওপাড়ার অন্যান্য মুসলমানেরাও হৈচৈ শুনে সেখানে এসে জুটেছিল। এবার সবাই লাঠি, শড়কী, বল্লম, বাঁশ-যে যা হাতের কাছে পেলো, তাই নিয়ে ঘিরে ধরলো সেপাইদের। সেপাইদের তুলনায় সংখ্যায় এরা অনেক। বেদম মার খেয়ে সেপাইরা শেষ পৰ্য্যন্ত পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো।
তটিনী বিশ্বাস তন্ময় হয়ে কাহিনী শুনলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে কি যেন চিন্তা করলো। তারপর সে উৎসুকভাবে প্রশ্ন করলো— লোকটা তাহলে কে, কেউ তা পয়চান করতে পারলো না?
মুহসীন বিশ্বাস বললেন— না। চোখ-নাক বাদে তার মাথা-মুখ সবটুকুই কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। সেপাইদের পিছে পিছে সেও নাকি অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
তাহলে কে হবে লোকটা? আপনারা কি অনুমান করেন?
হয়তো ইসলামের কোন খাদেম। অনেক মুসলমান সেপাই এখন গোপন ভাবে কাজ করছে। চাকুরীচ্যুত হাজার হাজার সেপাইদের সবাইতো আর বসে থাকবে না মুখ বুজে ?
তাহলে ঠিক তাই। তারাই কেউ হবে। কিন্তু জেঠামনি, আমি ভাবছি— সেপাইরা একবার যখন এ গাঁয়ে এসেছে, তখন আবারও তো আসতে পারে?
তা পারেইতো।
আপনার জানের ওপরও তো তাহলে হুমকি আছে এখন?
তাতো আছেই।
তাহলে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা কিছু করছেন না আপনারা ?
আমরা আর কি করতে পারি? সুফী সাহেবকে খবরটা জানিয়ে রাখা ছাড়া আপাতত আর করার কিছু দেখছিনে।
সুফী সাহেব মানে ঐ-
হ্যাঁ। হজরত নূর কুতুব-ই-আলম সাহেব।
খবর নিয়ে গেছে কেউ তাঁর কাছে?
না, এখনও কেউ যায়নি। আমার ওপরই ভার আছে লোক পাঠানোর। ভাবছি, তাজউদ্দীনকেই পাঠিয়ে দিই।
কাকে?
তটিনী বিশ্বাস বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো।
মুহসীন বিশ্বাস বললেন— তাজউদ্দীনকে।
তাজউদ্দীনকে। তার মতো একজন নালায়েক নির্বোধকে এই কাজে পাঠাবেন?
কাজটা এমন কিছু কঠিন নয়। সুফী সাহেবকে সেরেফ খবরটা জানানো। নালায়েক বা হুশবুদ্ধিহীন হলেও তাজউদ্দীন ইমানদার লোক। খুবই সৎ ছেলে। বিশ্বাসী লোক নাহলে এসব কাজে যাকে তাকে পাঠানো নিরাপদ নয়। সুফী সাহেবের সাথে এখন যোগাযোগ করাটাও মস্তবড় অপরাধ। এটা ফাঁশ হলে বিপদ হবে।
তাহলে ভাল করে বুঝিয়ে বলবেন তাকে সব। নইলে আবার গোলমাল করে ফেলবে। যে নির্বোধ লোক।
মুহসীন বিশ্বাস স্মিতহাস্যে বললেন— তা কি আর বলতে হবে মা? তাকে সব কিছু ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে তবেই পাঠাবো। তা তুমি এই সাত সকালে কি মনে করে? এই জন্যেই?
হ্যাঁ জেঠামশাই রাতে এই খবর শোনার পর আর আমার ভাল করে ঘুম হয়নি। কি জানি কোন মুসিবত কোনদিক দিয়ে আবার আপনার ঘাড়ের ওপর আসে!
মুহসীন সাহেবের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো— ছেলের চিন্তা মায়েরা তো সব সময়ই করে। কিন্তু তোমার এই বুড়ো ছেলেকে নিয়ে তোমাকে এত পেরেশান হতে হবে না মা। ঐ একজনের রহম যদি থাকে, তোমার এই ছেলের কাছে যম-আজরাইল, যা-ই বলো, কেউ ভিড়তে পারবে না।
তটিনীর মুখের দিকে চেয়ে হাসতে লাগলেন মুহসীন বিশ্বাস। তাঁর হাসির সাথে যোগ দিয়ে হেসে ফেললো তটিনীও।
তটিনী বাল্যবিধবা। গৌরী দানের সুর ধরে আট থেকে ন’বছরে পা দিতে না দিতেই তটিনীর বিয়ে দেন সুরেশ্বর বিশ্বাস। বরও কম বয়সের বালক। তার ছিল মিরূগী রোগ। বরপক্ষ চালাকী করে এ খবরটা গোপন করে রাখে। বিয়ের পর দিন তিনেক যেতে না যেতেই মিরূগী রোগে আক্রান্ত হয়ে নদীরঘাটে ডুবে মরে বর। আর বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ওয়াপস্ আসে তটিনী।
সারা রাস্তা ঘুমিয়ে তটিনী বিশ্বাস শ্বশুরবাড়িতে যায়, আর বিধবা হয়ে আসার সময়ও ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ফিরে আসে। কি দিয়ে কি হয়ে গেল সেদিনও সে কিছুই বুঝতে পারেনি। আজও তার সে সব কথা স্মরণই তেমন আসেনা। বিধবা হয়ে আসার পর অনেক দিন কেটে গেছে। কেটে গেছে এক নাগাড়ে-তের চৌদ্দ বছর। দূরন্ত যৌবনের এক দুর্বিষহ বোঝা এখন টেনে বেড়াচ্ছে তটিনী। তার ওপর ভর করেছে সৃষ্টিছাড়া রূপ। শিশুকালেই তার রূপ দেখে নাম মাত্র দেনা পাওনায় তাকে লুফে নেয় বরপক্ষ। সে রূপ এখন ষোলকলায় বিকশিত। তার মুখের দিকে তাকিয়ে অভিভাবকেরা গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। আরশীতে মুখ দেখে তটিনীও সময় সময় বিমনা হয়ে যায়। কিন্তু বড় কঠিন ধাতের মেয়ে এই তটিনী। এক অখন্ড ব্যক্তিত্বের আর প্রখর বুদ্ধি মত্তার অধিকারিনী সে। তার পরিচ্ছন্ন রুচি, দৃঢ় মনোবল আর মজবুত ব্যক্তিত্বের কারণে তাকে উত্যক্ত করার সাহস রাখেনা গোটা গাঁয়ের কেউই। সাহস রাখেনা পার্শ্ববর্তী কোন গাঁয়ের কোন লোক। তার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকাবার মতো হিম্মত চেনা জানা কোন লোকেরই ছিল না। অচেনারাও তা করতে গিয়ে চরমভাবে চুপসে গেছে। গাঁয়ের তামাম লোকই তাকে এখন আলাদা নজরে দেখে। হিন্দুরা ভাবে, ওটা তাদের মা চন্ডীর অবতার। মুসলমানেরা মনে করে-ওটা একটা নাগালের বাইরের আঙ্গুর ফল। ও আঙ্গুর টক। আইবুড়ো বিধবা মেয়ে নিয়ে এয়োতিরা বৃদ্ধারা স্বভাবতই যে কানাঘুষা করে, তটিনীর বেলায় শুরুতেই তারা খামুশ হয়ে গেছে। আর কোন উৎসাহই দিলে তাদের পয়দা হয়নি অতঃপর।
তটিনী এখন নিঃসংকোচে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। নিসঙ্গ নিশিথে তটিনীর মুখশ্রী হাতড়িয়ে বেড়ায় যারা সামনে পড়লে তারাও সসম্ভ্রমে তটিনীকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। নজর তাদের নুইয়ে পড়ে মাটির দিকে। তবুও রূপ বড় বালাই। দূর দূরান্তের লোলুপ দৃষ্টি থেকেই যায় তার দিকে। ওগুলোকে উপেক্ষা করেই চলতে হয় তটিনীকে।
তটিনীর দুই মা। সেপাই বাপ ছোট বউকে সঙ্গে নিয়ে পান্ডুয়াতে বসত করেন। তটিনী আর তটিনীর মা গাঁয়ের বাড়িতে থাকেন এবং চাকর বাকর নিয়ে ঘর সংসার সামলান। সুরেশ্বর বিশ্বাস গাঁয়ে আসেন বছরে দু’ একবার। ঘর-সংসার দেখার মতো কোন ফুরসতই তিনি পাননা। তাঁর কোন পুত্রসন্তান না থাকলেও তা নিয়ে আফসোস করতে হয়না তাঁকে। এক তটিনী এমন অনেক পুত্রের বাড়া।
মরিয়ম বিশ্বাস বাহির আঙ্গিনায় এসছিলেন। বাহির আঙ্গিনা বিশ্বাসদের একটাই। প্রশস্ত আর লম্বা। যার বাড়ির সামনে যে অংশ পড়ে সেই অংশই এক একজন ব্যবহার করেন তাঁরা। মরিয়ম বিশ্বাসের হিস্সাটা ঠিক মাঝখানে। সদ্যওঠা ফসলের তদারকির কাজে বাহির আঙ্গিনায় এসে মরিয়ম বিশ্বাস আঙ্গিনার এক প্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন। আঙ্গিনার নীচেই সরকারী ডহর। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চলাচলের রাস্তা। সেই রাস্তার দিকে নজর দিয়েই চমকে উঠলেন মরিয়ম বিশ্বাস। আঙ্গিনা থেকে বিশ-ত্রিশ গজ ফারাগে ডহরের ওপর মুহসীন বিশ্বাস কথা বলছেন যে নওজোয়ানের সাথে, সেই নওজোয়ানই মরিয়মের এই বিষয়ের কারণ। মরিয়মের বিপরীত দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল নওজোয়ানটি। মরিয়ম তার মুখ দেখতে পায়নি। কিন্তু তার পেছনটা-চুল-মাথা-ঘাড়-বিলকুল মরিয়মের মৃত পুত্র রবীন বিশ্বাসের মতো। তিল পরিমাণ ব্যতিক্রম নেই কোথাও ।
চমকে উঠেই ডহরের দিকে ছুটে এলেন মরিয়ম বিশ্বাস। স্বাভাবিক হুঁশবুদ্ধি লোপ পেয়েছে তখন তাঁর।’ মরিয়ম বিশ্বাস নিকটবর্তী হতেই মুহসীন বিশ্বাসের সাথে নওজোয়ানটিও তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকালো। ঘনকৃষ্ণ কচি দাড়ির নীবিড় একটা আবরণ নওজোয়ানটির কচি মুখে থাকলেও মরিয়ম বিশ্বাস অবাক হয়ে দেখলো তার মুখমন্ডলের রং গঠনও অনেক খানি রবীন বিশ্বাসের মতোই। দাড়িটুকু না থাকলে একে রবীন বিশ্বাস বলে যে কারুরই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। সেই রকমই দপদপে উজ্জ্বল গায়ের রং, সেই রকমই চোখ-মুখ-নাক। রবীন বিশ্বাসের একটা মস্তবড় সম্পদ ছিল, তার কার্তিক প্রতীম চেহারা। এই ছেলেটির মধ্যেও এতটুকু ঘাটতি নেই সেই সৌন্দর্যের। ফারাগ বলতে এ ছেলেটি বয়সে খানিক বড় আর তার হাত পা এবং সিনাটা আরো অধিক বলিষ্ঠ। অপর পক্ষে, তার দৃষ্টিটাও আবার রবীনের মতোই লাজুক।
মরিয়মকে ছুটে আসতে দেখেই মুহসীন বিশ্বাস বুঝতে পারলেন কারণটা। বললেন, বউমা, তোমার মতো আমারও ঐ একই ভ্রম হয়েছিল। আর তাইতো এই ছেলেটাকে ডাক দিয়ে থামালাম। আশ্চর্য! মানুষের সাথে মানুষের এতটা মিল হয়!
মরিয়মের এতক্ষণে সম্বিত ফিরে এলো। মাথার কাপড় আরো খানিকটা টেনে দিয়ে বললেন-ছেলেটা কে বড় ভাই? নাম কি?
নাম তাজউদ্দীন। এর বাড়ি নাকি ঐ কাজল দীঘির ঐদিকে। বচপনকালে বাপ-মা হারিয়ে পান্ডুয়াতে আসে। সেখানে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে মানুষ হয়। কয়দিন আগে সেই গোটা পরিবারটাই নাকি রাজা গণেশের ফৌজ খতম করে দিয়েছে। এ তখন বাড়িতে ছিলনা বলেই বেঁচে গেছে কোন মতে। এখন এ আশ্রয় আর কাজ কামের তালাশে এদিকে এসেছে। আপাতত একটা আশ্রয় এর প্রয়োজন।
মরিয়ম বিশ্বাস বললেন— আশ্ৰয় ?
এবার তাজউদ্দীন নিজেই নত মস্তকে বললো— জি, মানে কোথাও কোন কাজ কাম পেলে সেখানেই কাজ কাম করতাম আর থাকতাম ।
মুহসীন বিশ্বাস বললেন— কি কাজ জানো তুমি?
তাজউদ্দীনের নতশির আরো একটু নত হলো। সে ইতস্তত করে বললো— মানে থাকতাম তো এক বড়লোকের বাড়িতে! তাঁরা খুব যত্ন করেই আমাকে লালন পালন করেছিলেন। তাই ক্ষেত খামার বা অন্যকোন কাজ ভাল করে শেখার মওকা পাইনি। তবে আমার মনের জোর আছে, দু’একদিন কোশেশ্ করলেই কৃষিকাজ, তাঁতের কাজ বা অন্য যে কোন কাজ সব কিসিমের কাজই আমি ঠিক মতো করতে পারবো।
মরিয়ম বিশ্বাসের দিলটা আবার চঞ্চল হয়ে উঠলো। গোটা সংসারে একদম তিনি একা। দেখার মানুষ অভাবে সংসারটা তাঁর বিরান হয়ে যাচ্ছে। সবার ওপর, পুত্রশোক ভোলার মতো কোন অবলম্বনই নেই তাঁর। জামাইটা এলেও সংসার ফেলে দু’এক দিনের বেশী কোন বারেই থাকে না। আবেগের আধিক্যে তিনি ফস্ করে বলে ফেললেন— আমি যদি আমার সংসারে রাখি তোমাকে তুমি থাকবে বাবা ?
তাজউদ্দীনের মুখ মন্ডল রোশনাই হয়ে উঠলো। এতটা কল্পনাও সে করেনি। তবু নিজেকে সংযত করে সে বললো— যে কোন খানে একটু ঠাঁই পেলেই আমার জন্যে সেটা আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ রহমত। কিন্তু কাজটা কি ধরনের হবে, আমি সেটা পারবো কিনা— সে সম্বন্ধে একটু-
এর জবাবে মুহসীন বিশ্বাস বললেন— সে তোমাকে ভাবতে হবেনা। যা তুমি পারবে তাই করবে। যা পারবে না, তা করার তোমার দরকারই হবে না।
কথাটা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে না পেরে তাজউদ্দীন মুহসীন বিশ্বাসের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো— জি!
মুহসীন বিশ্বাস বললেন— তোমার আদব-আখলাকে কোন গলদ যদি না থাকে, তাহলে সুখেই থাকবে তুমি।
তাজউদ্দীন এবার চোখ নামিয়ে শরমিন্দা কন্ঠে বললো— জি না, কোন বেয়াদপী আমি কখনও করি না।
বেশ। তাহলে আর কোথাও যাওয়ার তোমার দরকার নেই। তুমি আমাদের বাড়িতেই চলো। দিলের চাঞ্চল্যে ভাশুরের মতামত না নিয়েই মরিয়ম বিশ্বাস তাজউদ্দীনকে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এবার ভাশুরকেও এ ব্যাপারে আগ্রহী দেখে তিনি খোশদিলে বললেন— আপনি ও তাহলে আমার এ প্রস্তাব সমর্থন করেন বড় ভাই ?
মুহসীন বিশ্বাস উৎসাহের সাথে বললেন— সমর্থন করি মানে! তুমি আগে এটা মুখ ফুটে না বললে, আমি নিজেই এ প্রস্তাব তোমার কাছে রাখতাম। তোমার তো একটা অবলম্বন দরকার। নিজের ছেলে নেই যখন, তখন পোষ্য নিতে দোষ কি! তাছাড়া, ছেলেটাকেও মোটামুটি নেকমান্দ বলেই মনে হচ্ছে।
তাজউদ্দীন এতক্ষণে নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারলো, কি অবস্থায় পড়েছে সে। তার এই খোশ কিসমতির জন্যে সে মনে মনে আল্লাহ পাকের শোকর গোজারী করলো।
সেইদিনই মরিয়ম বিশ্বাসের সংসারে উঠে এলো তাজউদ্দীন। মরিয়ম বিশ্বাসের বৈঠকখানার ঘরটি এযাবত ফাঁকা পড়েই ছিল। ঝেড়ে মুছে মরিয়ম বিশ্বাস সেই ঘরেই তাজউদ্দীনের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিজের সন্তানের মতো কাছে বসিয়ে খাইয়ে অনেকদিন পর অনেকখানি তৃপ্তি বোধ করলেন তিনি।
আহারের পর তাজউদ্দীন তার ঘরে এসে লম্বা একটা ঘুম দিলো এবং ঘুম থেকে সে একেবারে বিকেল বেলা উঠলো। অচেনা জায়গা। অন্য কোথাও না বেরিয়ে সে বাহির আঙ্গিনায় কিছুক্ষণ পায়চারী করলো। এরপর আঙ্গিনার এক প্রান্তে হেলে পড়া এক আমগাছের ডালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে তার অতীত আর বর্তমানের হিসাব মিলাতে লাগলো।
তটিনী বিশ্বাস সেদিন সকাল থেকেই নিজ মকানে ছিল না। ও পাড়ার এক আত্মীয়ের মকানে জরুরী কাজে আটকে ছিল। আত্মীয়ের বাড়ি থেকে সে যখন নিজ বাড়িতে ফিরলো তখন আর অল্প বেলা বাকি। ডহর বেয়ে বাড়ির নীচে এসেই সে সবিষয়ে দেখলো— এক বলিষ্ঠ নওজোয়ান আঙ্গিনার মাথায় দাঁড়িয়ে। তাজউদ্দীন তার মুখোমুখিই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন ছিল বলে তটিনীর আগমন তার দৃষ্টি গোচর হলোনা। এই ফাঁকে তটিনী তাকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলো। সে বুঝলো চেহারাখানা দেখার মতোই বটে। এ ধরনের সুপুরুষ একমাত্র তার দাদা রবীন বিশ্বাস ছাড়া, জিন্দেগীতে সে আর কোথাও তেমন একটা দেখেনি।
বাড়ির ওপর উঠতে উঠতে সে ভাবতে লাগলো— কে এই নওজোয়ান! কোথা থেকে এলো এ! সেই সাথে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো— একমুখ দাড়িতেও মানুষের সৌন্দর্য এতটা বৃদ্ধি পায়!
আঙ্গিনায় উঠে এলে তটিনীর পদশব্দে চোখ তুললো তাজউদ্দীন। চোখাচোখি হতেই তাজউদ্দীন তার নজর অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। তটিনীও চোখ নামিয়ে দ্রুত পদে গৃহের মধ্যে প্রবেশ করলো।
গৃহে ঢুকেই তটিনী খোঁজ নিয়ে জানলো— আগন্তুকটি ক্ষণিকের মেহমান নয় স্থায়ী বাসিন্দা। মেঝো জেঠীমা পোষ্য নিয়েছেন তাকে। সে এ বাড়িতেই থাকবে। এ খবরে তটিনী বিশ্বাস নাখোশও হলোনা, আবার পুরোপুরি খুশী হতেও পারলোনা। তার স্বাধীনভাবে চলাফেরার পথে এমন একটা সার্বক্ষণিক বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় সে বরং নাখোশই হলো খানিকটা। একটা অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। ভাবতে লাগলো— আগন্তুকের লোলুপ দৃষ্টি হয়তো তাকে হামেশাই বিব্রত করতে থাকবে। তার চেহারার সাথে আদব-আক্কেলের সামঞ্জস্য না থাকলে তটিনীকে হয়তো আরো অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থির মোকাবেলা করতে হবে।
কিন্তু যে ভয়ে তটিনী বিশ্বাস তটস্থ হয়ে উঠেছিল, কিছুদিন পর সে নিজেই সেই পরিস্থিতির কাঙাল হয়ে পড়লো। বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও তটিনীর অস্তিত্ব তাজউদ্দীনের গণ্যের মধ্যেই এলোনা বা তা আলাদা কোন গুরুত্বই তাজউদ্দীনের কাছে পেলোনা। লোলুপ দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করা তো দূরের কথা, তটিনী বিশ্বাস তার নাকের ডগার ওপর অহরহ বিচরণ করলেও সে চোখ তুলে সেদিকে কোন দিনই চাইলো না। কালে ভদ্রে অকস্মাত চোখে চোখ পড়লেও, তাজউদ্দীনের ফেরানো নজর দ্বিতীয় বার তটিনীর দিকে ঘুরলো না।
আরো যা বিস্ময়কর তা হলো, তাজউদ্দীনের অস্বাভাবিক বাক-সংযম। অকারণে একটা কথাও সে কারো সাথে বলে না। কোন প্রকার প্রাণ চাঞ্চল্যের অভিব্যক্তিও তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। একটা না একটা কাজের মধ্যেই সে সর্বক্ষণ মশগুল থাকতে চায়। ইদানিং তাঁতের সরঞ্জাম পেয়ে সে সাকুল্লেই গায়েব হয়ে গেছে। বাইরে তাঁত আর ভেতরে পোষ্য মাতা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝেনা। তার এই নির্লিপ্ততা নিয়ে অনেকেই টিকাটিপপনী কাটে। প্রতিবেশী ছেলেমেয়েরা তাকে ক্ষেপিয়ে তোলার ইরাদায় হরেক কিসিমের পীড়ন উৎপীড়ন করে। কিন্তু তাজউদ্দীন নির্বিকার। একটু মুছকি হেসেই সে আবার হারিয়ে যায় কাজের মধ্যে।
এসব থেকে দিনে দিনে তাজউদ্দীনের হুঁশবুদ্ধির স্বল্পতা সবার কাছে প্রতিষ্ঠিত হলো। সবাই ভাবলো-জন্মগত ভাবেই এ লোকটার হুঁশবৃদ্ধি কম। আসলেই সে একটা নালায়েক ও নির্বোধ ।
তটিনীরও ধ্যান ধারণা তার সম্বন্ধে পৃথক কিছু হওয়ার কোন অবকাশ ছিলনা। সে যে একটা সুদৃশ্য মাকাল ফল, এ সম্বন্ধে দিনে দিনে তটিনীও নিঃসন্দেহ হলো। তবে তাজউদ্দীন তার শিশুসুলভ সরলতার কারণে বিশ্বাস পরিবারের সকলের উপচে পড়া মহরত আর অফুরন্ত স্নেহ অর্জন করলো। তটিনীও তার প্রতি হৃদয়হীনা ছিলনা। তার একটাই মাত্র আফসোস্ আহা ! এই চিত্তহারী চেহারার সাথে স্বাভাবিক ইশবুদ্ধি আর খানিকটা পৌরুষ থাকতো যদি! তটিনীর মতো এমন একটা জ্বলন্ত অগ্নি শিখা পাশে থাকা সত্ত্বেও যার দিলে কিছুমাত্র তাপ পয়দা ‘হয়না, হয় সে দিল মৃত, নয় সে দিল এমন পদার্থে তৈরী যা তাপ ধারণে অক্ষম।
এই ধারণা নিয়েই তটিনী বিশ্বাস ধীরে ধীরে খামুশ হয়ে গেল। তাজউদ্দীনের অস্তিত্ব তার কাছেও দিনে দিনে নিষ্প্রভ হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও তাদের মধ্যে সামান্যতম বাক্যলাপও হলো না।
হলো একদিন অকস্মাত ।
পোষ্যমাতা মরিয়ম বিশ্বাস তাজউদ্দীনের হাতে মাছ পাঠালেন তটিনীর মায়ের কাছে। এজমালী পুকুর থেকে আজ একটা মস্তবড় মাছ ধরা হয়েছে। মেঝবউ মরিয়মকে এই মাছ কুটে তিন শরিককে বেঁটে দেয়ার ভার দিয়েছেন মুহসীন বিশ্বাস। ছোট তরফের হিস্সা নিয়ে তাজউদ্দীন এসে তটিনীদের দেউড়ির সামনে দাঁড়ালো। কাউকে কোথাও না দেখে সে কুণ্ঠাজড়িত কণ্ঠে একে ওকে ডাকতে ডাকতে দেউড়িটা পার হয়ে কিছুটা ভেতরে চলে এলো। তটিনীর মা তখন রান্না ঘরে ব্যস্ত ছিলেন। বাড়ির চাকর কালাচাঁদও বাড়ির ভেতর ছিলোনা। ডাক শুনে তটিনীই এগিয়ে এলো এবং তাজউদ্দীনকে বাড়ির মধ্যে দন্ডায়মান দেখে অবাক হয়ে বললো-কি ব্যাপার! আপনি!
হাতে ধরা কুটা মাছের পোটলাটা তুলে ধরে তাজউদ্দীন বললো— মাছ। কে পাঠিয়েছে?
আম্মা ।
মেঝো জেঠীমা?
হ্যাঁ। আপনাদের পুকুরের মাছ।
ও, আচ্ছা- আচ্ছা। একটু দাঁড়ান-
তটিনী ছুটে গিয়ে একটা ডালা নিয়ে এলো। ডালা পেতে বললো— দিন, এখানে দিন।
তাজউদ্দীন তার দুই হাতে ধরা কলার পাতার পোঁটলাটা ডালার মধ্যে রাখলো। তটিনী লক্ষ্য করে দেখলো-তাজউদ্দীনের দুই হাতে বেশ খানিকটা ময়লা লেগেছে পোঁটলা থেকে। তাজউদ্দীন ফিরে যাবার উদ্যোগ করতেই তটিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো- উহুঁ, যাবেন না । আর একটু দাঁড়ান।
বলেই তটিনী গিয়ে মাছের ডালাটা বারান্দার ওপর রেখে এক ঘটি পানি নিয়ে দ্রুতপদে ফিরে এলো। এসেই সে বললো— হাত পাতুন।
তাজউদ্দীন ইতস্তত করে বললো— মানে!
তটিনী শক্ত কন্ঠে বললো— হাতে ময়লা। ধুতে হবেনা হাত ?
জি হবে।
তাহলে হাত পাতুন।
অগত্যা হাত পাতলো তাজউদ্দীন। তটিনীর ঢেলে দেয়া পানিতে ঝুঁকে পড়ে দুই হাত ধুয়ে নিলো। পরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দুটি ঝাড়তে লাগলো।
তা দেখে তটিনী বিশ্বাস বললো— গামছা দেবো ?
জবাবে তাজউদ্দীন বললো— জি না, আমার গামছা আছে।
কৈ গামছা ?
আমার ঘরে।
তটিনীর রাগ হলো। বললো— আপনার যে গামছা আছে, সেতো আমি জানিই। আমি আপনাকে কোন গামছা দান করতে চাচ্ছিনে। হাত মুছার জন্য—
তাজউদ্দীন সঙ্গে সঙ্গে বললো— জি-না। আমি যেয়েই মুছে নেবো।
তো যান, তাই নিনগে—
কিছুটা বিরক্ত হয়েই সরে গেল তটিনী।
বিকেল বেলা মরিয়মকে সামনে পেয়ে তটিনী বিশ্বাস বললো, মেঝো জেঠীমা, জেঠা মশাই বুড়ো মানুষ। আজ বাদে কাল তাঁর খাওয়ার কিমত নাও হতে পারে। মাছের ঐ অতবড় মুড়োটা তাঁকে না পাঠিয়ে আমাদের দিয়েছেন কেন? একটা মাত্র মাথা। তিনি থাকতে আমরা খাবো সেটা, এটা কেমন বেয়াদপী আর বেইনসাফীর ব্যাপার!
মরিয়ম বিশ্বাস বললেন— তিনি যে নিতে চাননি কিছুতেই। বললেন, “বড় তকলিফ করে তাজউদ্দীন মাছটা ধরেছে। কাপড় জামা ভিজিয়ে ও ঝাঁপ দিয়ে না পড়লে ছুটেই যেতো মাছটা। এ মুড়োটা তারই হক। তারই জন্যে মুড়োটা রেখে দেবে কিন্তু। তাকে না দিয়ে আমার জন্যে পাঠালে আমি ভয়ানক রাগ করবো।”
তটিনী অবাক হয়ে বললো— তাহলে আমাদের দিলেন যে!
আমি তো দেইনি, তাজউদ্দীন জিদ ধরে দিয়েছে।
মানে!
কবে নাকি তোমাদের কালাচাঁদকে তুমি হাট থেকে মাছের মুড়ো আনতে বলেছিলে? কালাচাঁদ তা ভুল করে আসায় তুমি নাকি তাকে বকাবকি করে বলেছিলে— মুড়িঘন্ট খাওয়ার নাকি তোমার সখ হয়েছে খুব? তাই তাজউদ্দীন, কিছুতেই মুড়োটা তার জন্যে রাখলে না।
একটা রীতিমতো ধাক্কা খেলো তটিনী। তার স্মরণ হলো— পাঁচ ছয়দিন আগে বাহির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে সে কালু ওরফে কালাদাঁদকে এই কথাটা একটু গরম কণ্ঠেই বলেছিল; তাজউদ্দীন বারান্দায় তার তাঁতের কাজে এ সময় মশগুল ছিল। এ কথা তার কানে গেছে তটিনী তা মনেই করেনি তখন। এমন একটা ছোট্ট ঘটনা তার মতো আদ্‌না আদমী মনে রেখেছে এতদিন! আর সেই কারণেই সে নিজের হিস্সাটাই জিদ ধরে অকাতরে দিয়ে দিলো! তাজ্জব!
অভিযোগ উবে গেল তটিনীর। কোনমতে আর দু’একটি কথা বলেই সে তাড়াতাড়ি সরে গেল অন্যদিকে।
এ ঘটনার দিন তিনেক পরের কথা। আসর নামাজ আদায় করার ইরাদায় অজু করে তাজউদ্দীন বাহির আঙ্গিনার পাশে এক সরু গলিতে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছিলো। এমন সময় তাড়া খেয়ে একটা নেড়ী কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ঐ পথেই তার দিকে আসতে দেখে তাজউদ্দীন ছিটকে এলো ওখান থেকে এবং লাফ দিয়ে তার বারান্দার ওপর উঠলো। এমন ভাবে এ কাজটা সে করলো— যেন কুকুর দেখে যারপরনাই ভয় পেয়েছে সে।
তটিনী বিশ্বাস নিকটেই ছিল। তাজউদ্দীনের কান্ড দেখে সে হাসির বেগ চেপে রাখতে পারলোনা। সে সশব্দে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে তাজউদ্দীন চোখ তুলতেই তটিনী বিশ্বাস আর একটু কাছে এসে ব্যঙ্গ করে বললো— আহারে! অল্পের জন্যে বেঁচে গেল জানটা আপনার!
প্রত্যুত্তরে তাজউদ্দীন বললো— জি ?
ভয় পেয়েছেন খুব ?
ভয়? কৈ, নাতো!
কিন্তু আমি যে নিজের চোখেই দেখলাম, আপনি আঁতকে উঠে লাফ দিলেন ?
ও, তা হবে হয়তো। যেভাবে কুকুরটা আসছিলো, তাতে ওটা আমার গায়ের ওপরই পড়তো।
আর সঙ্গে সঙ্গে গিলে ফেলতো আপনাকে !
তটিনীর ঠোঁটে হাসি। তা দেখে তাজউদ্দীন শরমিন্দা কণ্ঠে বললো— না মানে, জানোয়ারটাতো আসলে—
বাঘ ভাল্লুকের চেয়েও ভয়ংকর একটা কিছু!
তাজউদ্দীন বলতে চাইলো জানোয়ারটাতো আসলে না-পাক জানোয়ার। কিন্তু তটিনী তার মুখের কথা শেষ করতে না দিয়ে এই মন্তব্য করলো। সেই সাথে সে আরো বললো— বাইরে বাইরে না ঘুরে আপনার জেনানার মতো শাড়ি পরে অন্দর মহলে থাকা উচিত।
তাজউদ্দীনও হেসে ফেললো। বললো— কি বললেন ? শাড়ি?
শাড়ি নয়,
বোরকা- বোরকা
হো হো করে হেসে উঠলো তাজউদ্দীন। তটিনীর সামনে এইভাবে হাসা এই তার প্রথম। এই নির্মল হাসির মধ্যে একটা নিষ্পাপ অন্তর তটিনীর নজরে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়লো। হাসতে হাসতে তাজউদ্দীন বললো— কি যে বলেন! আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই ভয় পাইনি!
তটিনীও হাসতে হাসতে বললো— না-না, আপনি পাবেন ভয়? আপনার বুকে কত হিম্মত !
জি?
ওটুকুতে হবে না। হিম্মত আরো বাড়াতে হবে। হর কদম আতংকে লাফিয়ে উঠলে অপঘাতে মারা পড়বেন।
না, মানে-
তটিনীর ঠোঁট থেকে হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। তাজউদ্দীনের কথায় কোন কর্ণপাত না করে সে অপেক্ষাকৃত গম্ভীর কন্ঠে পুনরায় বললো— শিশু হলে আমিই না হয় সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভয়টা আপনার ভাঙ্গাতাম। কিন্তু আপনি তো আর শিশু নন। এখন নিজের সাহস বাড়াতে হবে নিজেকেই। এত অবলা আর ভীতু হয়ে চললে এ দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারবেন না, বুঝেছেন ? একটা করুণ দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে তটিনী বিশ্বাস আস্তে আস্তে গৃহের মধ্যে প্রবেশ করলো। তাজউদ্দীনও আর কৈফিয়ত দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলোনা।
এর কয়দিন পরেই তাদের মধ্যে তৃতীয়বার কথা হলো— ঐ মুসল্লীদের ওপর রাত্রিকালে ফৌজী হামলার ঘটনা নিয়ে। যে লোকটা মুসল্লীদের বাঁচালো সে লোকটা নাকি তাজউদ্দিনের মতোই দেখতে— এই আলাপটা নিয়ে।
ঘটনার পরের দিন মুহসীন সাহেবের নির্দেশে এই ফৌজী হামলার খবর নিয়ে তাজউদ্দীন যখন সত্যি সত্যিই সুফী সাহেবের উদ্দেশ্যে রওনা হলো তখন আর একবার এলো তটিনী। এসেই সে তাজউদ্দীনকে তার কর্তব্য ও নিরাপত্তা সম্বন্ধে বার বার হুশিয়ার করে দিতে লাগলো। বললো— আপনি ছাড়া এ কাজের আর যোগ্য লোক আপাতত কাউকে দেখছিনে। আর তাই জেঠা মশাই এর মুখে একথা শুনেও আমি চুপ করে আছি। আমার ধারণা ছিল উনি হয়তো শেষ পর্যন্ত অন্য কাউকে পাঠাবেন। তবু আপনাকেই যখন পাঠাচ্ছেন আর আপনিও যাচ্ছেন, তখন যান। কিন্তু একাজে পদে পদে মুসিবত! যে রকম শিশুর মতো অসহায় আর আলা-ভোলা লোক আপনি! কি ঘটিয়ে বসেন কে জানে! খুব হুশিয়ার থাকবেন সব সময়। ফ্যাসাদ কিছু হলে তো আর গাঁয়ের আর কারো কিছু হবেনা। সবটুকুই যাবে আমাদের ওপর দিয়ে। মানে মারা পড়বেন আপনি আর জেঠামশাই।
কন্ঠে তার উৎকণ্ঠার অভিব্যক্তি ধ্বনিত হয়ে উঠলো। তা লক্ষ্য করে তটিনীর মুখের দিকে এক নজরে চেয়ে রইলো তাজউদ্দীন। একেবারে চোখের ওপর চোখ রেখে। এমন নিবিড়ভাবে তটিনীর । মুখের দিকে তাজউদ্দীন আর কোনদিন তাকায়নি। স্থির নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর তাজউদ্দিন হাসি মুখে বললো— সত্যি, আপনার খাপসুরতের মতোই আপনার দিলটাও বড় পবিত্র!
রওনা হলো তাজউদ্দীন। অসাড় হয়ে অনেকক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো তটিনী।

বিদ্রোহী জাতক

দর্শক

এক :

এইযে, শুনুন। শুনতে পাচ্ছেন ?
জি, আমাকে বলছেন?
আপনি ছাড়া আর কেউ আছে এখানে?
সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে নজর দিলো তাজউদ্দীন। দেখে নিয়ে বললো- নাতো, আর কেউ নেই।
তটিনীর হাসি পেলো। আলতোভাবে দাঁতের তলে ঠোঁট ফেলে বললো- তাহলে আপনাকেই বলছি।
সুবেহ্ সাদিকের সাথে সাথেই তাজউদ্দীন হররোজ ঘুম থেকে ওঠে। ফজরের নামাজ আদায় করে কয়েক কদম হাঁটে। আঁধারটা ফিকে হয়ে এলেই সে মজবুত হয়ে তাঁতের পাশে বসে। শুরু হয় খটাশ খটাশ্ আওয়াজ। বৈঠকখানার বারান্দায় একাই বসে কাপড় বোনে তাজউদ্দীন। নও-মুসলিম মরিয়ম ওরফে মমতা বিশ্বাসের সংসারে সে বসে বসে খেতে চায়না। খেটে খেতে চায়।
তটিনী বিশ্বাস পাশের ঘরেই শোয়। তাঁতের এই খটাশ্ খটাশ্ আওয়াজে হররোজ ঘুম ভাঙ্গে তটিনীর। পয়লা পয়লা তটিনী বিশ্বাস বিরক্তি বোধ করতো। এখন আর করে না। এখন তার সয়ে গেছে। ঘুম ভাঙ্গলে আবার সে পাশ ফিরে শোয়। আর একদফা ঘুমিয়ে নিয়ে বেলা উঠলে ওঠে। আজও তাই করলো। কিন্তু আজ আর কিছুতেই ঘুম চোখে এলো না। গতরাতের ঘটনায় কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছে সে। এপাশ ওপাশ করতে করতে অনেক সময় কেটে গেল৷ উদীয়মান সূর্যের বিচ্ছুরিত আভায় পূব আকাশ রোশনাই হয়ে উঠলো। শয্যা ছেড়ে অগত্যা উঠে এলো তটিনী। চোখে-মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। ঘটনাটা সঠিকভাবে জানার জন্যে সে তার জেঠা মশাইয়ের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
তাজউদ্দীনের সামনে দিয়ে পথ। কিছুটা কৌতূহলের বশেই সে তাজউদ্দীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। লোকটা যে একেবারেই না লায়েক, কান্ডজ্ঞানহীন নির্বোধ, সে তা জানতো। তার প্রশ্নের জবাবে সে যখন চারদিক দেখে নিয়ে বললো-না, সে ছাড়া আর কেউ নেই সেখানে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তটিনীর হাসি পেলো। সে হাসিমুখে বললো- তাহলে আপনাকেই বলছি। হাতের কাজ বন্ধ করে তাজউদ্দীন নড়ে চড়ে বসলো। বললো- আমাকে? জি, বলুন! তটিনী বললো-গতরাতে হাতেম খাঁর বাড়িতে ফৌজী হামলা হয়েছিল, জানেন ?
জি, জানি।
তারা নাকি ওপাড়ার মুসল্লীদের খতম করতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে কে একজন কোথা থেকে এসে তামাম ফৌজীলোকদের একাই লাঠিপেটা করে গ্রাম থেকে নামিয়ে দিয়েছে-কথাটা কি ঠিক?
খানিকটা ঠিক।
মানে ?
একা সে অতটা পারতো না। মুসল্লীরাও লাঠি হাতে তার পাশে দাঁড়িয়ে লড়েছিল বলেই সে
পেরেছে।
ঐ এক কথাই হলো। লোকটা আগেই এসে সেপাইদের পাল্টা হামলা না করলেতো মুসল্লীরা লাঠি ধরার সাহসই পেতোনা!
তা হয়তো পেতোনা ।
তাজ্জব! কোথা থেকে এলো লোকটা?
অন্ধকারের মধ্যে কেউ সেটা ঠাহর করতে পারেনি।
কেউ কেউ আবার বলছে-লোকটা নাকি অনেকটা আপনার মতো দেখতে!
তাই বলছে?
তাইতো কেউ কেউ বলছে!
তটিনী মুখ টিপে হাসতে লাগলো। কোন দিকে না চেয়ে তাজউদ্দীন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো ।
সে বললো-তাহলে তো আমার নসীবটা খুব শানদার, না কি বলেন ?
কেন ?
এতবড় একটা তারিফের হকদার হওয়ার মওকা
সে গুড়ে বালি!
তটিনী বিশ্বাস উপেক্ষার সাথে বললো। তাজউদ্দীন প্রশ্ন করলো কেন?
হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ইষৎ ঝাঁকুনি দিয়ে তটিনী বিশ্বাস বললো- তারিফের হকদার হতে
গেলে কিছুটা হিম্মত থাকা চাই। আপনাকে তেমন হিম্মতদার কেউ ভাবলে তো?
কেউ তা ভাবে না?
তারা কি কেউ পাগল ?
তাহলে আর বলছে কেন ?
কতকটা আপনার মতো দেখতে, সেই কথা বলছে। আপনিই সেই লোক- সেটাতো কেউ বলছে না।
তাজউদ্দীন আবার একটু নড়েচড়ে উঠলো। বললো- তাহলেও আমাকে ভাগ্যবান বলতে পারেন।
কি করে ?
কোন ঝুটঝামেলা এসে আমার ঘাড়ে চাপছে না।
ক্ষণিকের জন্যে তটিনী বিশ্বাস নীরব হয়ে গেল। এক নজরে কিছুক্ষণ লোকটার দিকে চেয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে বললো- যতটা বোকা ভাবতাম, ঠিক ততটা বোকা নন দেখছি। কিছু হুশবুদ্ধিও আছে!
তটিনীর অধরে ক্ষীণ একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে আবার মিলিয়ে গেল।
তাজউদ্দীন বললো -জি?
তটিনী এবার খানিকটা হুকুম করেই বসলো। বললো- চোখকান খোলা রাখবেন সব সময় দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে এখন।
অতঃপর সে হন হন করে তার জেঠা মশাইয়ের বাড়ির দিকে চলে গেল।
মুসলমানদের আগমনের প্রাক্কালে বাংলামূলুকে প্রধানত হিন্দুরাই বাস করতো। কারণ, বাংলামুলুকে বসবাসকারী বৌদ্ধরা শংকরাচার্যের হিন্দু ধর্ম সংস্কারের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাবে ইতিমধ্যেই পূর্বদিকে সরতে সরতে সোনারগাঁ হয়ে আরাকান এবং আরাকান হয়ে অনেকেই দূরপ্রাচ্যে চলে যায়। মুসলমানদের হুকুমাত প্রতিষ্ঠা হওয়ার ওয়াক্তে কিছু বহিরাগত মুসলমান এদেশে এলেও, তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। এদেশের মুসলমানদের বিপুলাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা মুসলমান। ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ – বিন – বখতিয়ার খলজীর অভিযানের সাথে সাথেই বাংলামুলুকে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে। বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান সুফী সাধক ইসলাম প্রচারের ইরাদায় সমুদ্র পথে বাংলামুলুকে আসেন। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে খানকাহ, মাদ্রাসা, মুসাফিরখানা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান । খুলে ইনসানের খেদমত ও ইসলামের মাহাত্ম প্রচার করতে থাকেন।
সময়টাও অত্যন্ত অনুকুল ছিল তাঁদের পক্ষে। বল্লাল সেন সৃষ্ট কৌলীন্য প্রথার বা শ্রেণীভেদের নিষ্পেষণে এই সময় মধ্যম ও নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের অত্যাচারে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছিল। ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়েরা মানুষের ন্যূনতম ইযযতও বৈশ্য আর শূদ্রদের দিতোনা। অস্পৃশ্য ও অপাংক্তেয় করে রেখে ইতর প্রাণীর কাছাকাছি একটা জীব বলে তারা এদের গণ্য করতো। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে নাজাত পাওয়ার জন্যে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা উন্মুখ ছিল এই সময়। ইসলামের সাম্যবাদের সৌন্দর্যে আর জীবন ব্যবস্থার মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে স্বাভাবিকভাবেই বৈশ্য এবং বিশেষ করে শূদ্রেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। মুসলমান শাসন এদেশে কায়েম হওয়ার পর এ প্রক্রিয়া আরো জোরদার হয়ে ওঠে। বস্তুত পরবর্তীতে শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত সাম্যবাদের হাওয়া এসে হিন্দুধর্মে না লাগলে, কুলীন হিন্দু ছাড়া নিম্ন ও মধ্যশ্রেণীর হিন্দুর কোন অস্তিত্বই এদেশে থাকতো না।
ইলিয়াসশাহী হুকুমাতের শেষের দিকে এই উপমহাদেশের বিখ্যাত দরবেশ হজরত নূর কুতুব-ই আলম সাহেবের খানকা শরীফ অত্যন্ত মশহুর হয়ে ওঠে। আর্তের আশ্রয়, অসহায়- এতিমদের আবাসস্থল এবং শিক্ষা ও নীতি আদর্শের পীঠস্থান হিসাবে তাঁর খানকাহ শরীফ শুধু মুসলমানদেরই নয় অনেক হিন্দুরও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা অর্জন করে। আশেপাশের মধ্য ও নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু পরিবার ইসলামের আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে এই সুফী সাহেবের কাছে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
বাঁশবাড়ির বিশ্বাস পরিবার, এই সময়ের এমনই একটা পরিবার যার বৃহত্তম অংশটাই ইসলাম গ্রহণ করে। বিশ্বাসেরা তিন ভাই মহেশ্বর বিশ্বাস বীরেশ্বর বিশ্বাস, সুরেশ্বর বিশ্বাস। পৃথক অন্নে বাস। একই ভিটেয় তিন ভাইয়ের লাগালাগি বাড়ি। বিশ্বাসেরা বাঁশবাড়ির বর্ধিষ্ণু পরিবার। ব্যবসায়ী ও বিত্তশালী লোক। রুচিশীল ও মার্জিত। এতদসত্ত্বেও শ্রেণীতে বৈশ্য হওয়ার কারণেই এঁদের চেয়ে বিষয়বিত্তে জ্ঞানেগুণে, রুচি-আচরণে – সর্বতোভাবে খাটো কয়েকঘর ব্রাহ্মণের মর্জির ওপর এঁদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ নির্ভরশীল ছিল। গ্রামের সামাজিক ক্রিয়া-অনুষ্ঠানে এদের কোন কতৃত্বই ছিল না। বিচারে, আচারে, পার্বণে, অনুষ্ঠানে এঁদের স্থান ছিল সব সময়ই নীচে শূদ্রদের পাশে। ব্রাক্ষ্মণদের হুকুম তামিল করা ছাড়া সামাজিক অনুশাসনে এদের কোন ভূমিকাই ছিল না।
তবু তাঁরা এই অবস্থা মেনে নিয়ে দিনগুজরান করছিলেন। বিস্ফোরণ ঘটলো এক মর্মান্তিক ঘটনায়। মেঝোভাই বীরেশ্বরের মেয়ে রুক্ষিণীকে বিয়ে করতে এসে পাওনা গন্ডার গোলমালে বিয়ের আসর থেকে বরপক্ষ উঠে যায়। আর যায় কোথায়। ব্রাহ্মণেরা সঙ্গে সঙ্গে রুক্ষিণীকে পাতকী বলে ঘোষণা দিয়ে বীরেশ্বরকে একঘরে করে এবং তাঁর নলজল বন্ধ করে দেয়। নিজের ভাইদের পরিবারের সাথেও বীরেশ্বরের পরিবারের উঠাবসা বন্ধ করে ব্রাক্ষ্মণেরা। ফলে রুক্ষিণীর পিতামাতার জীবনে এক চরম দিগ্‌দারী নেমে আসে। প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইতে গেলে ব্রাহ্মণেরা যে ফর্দ দাখিল করে, তাতে বিষয়বিত্ত-ভিটেমটি তামাম কিছু বেচলেও সে পরিমাণ অর্থ সংকুলান হয় না। অবশেষে শোকে দুঃখে বীরেশ্বর বিশ্বাস অসুস্থ হয়ে দেহত্যাগ করেন। বীরেশ্বরের স্ত্রী মমতা বিশ্বাসও শয্যা গ্রহণ করেন।
তার জন্যে পিতামাতার এই পরিণাম সহ্য করতে না পেরে রুক্ষিণী শেষ পর্যন্ত গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বীরেশ্বরের দুইটি মাত্র সন্তান ছিল। এক ছেলে আর এই মেয়ে রুক্মিণী। অল্প কিছুদিন আগে জোয়ান ছেলেটি সর্পাঘাতে মারা যায়। এবার রুক্ষিণীও আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বড়ভাই মহেশ্বরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। গাঁয়ের অধিকাংশ শূদ্রেরা এবং কয়েক ঘর বৈশ্যেরাও ইতিমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এবার তিনিও ভ্রাতৃবধু মমতাকে সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর মহেশ্বর বিশ্বাস মুহসীন বিশ্বাস, মমতা বিশ্বাস মরিয়ম বিশ্বাস এবং রুক্ষিণী রোকেয়া বিশ্বাস নামধারণ করেন। মুহসীন বিশ্বাসের পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরাও এইভাবে বিভিন্ন নামে পরিচিত হন। ইসলাম গ্রহণের পর পরই তিনি একজন মুসলমান সৎপাত্রের সাথে ধুমধাম করে রোকেয়া ওরফে রুক্ষিণীর বিয়ে দিয়ে দেন।
এ ঘটনা কয়েক বছর আগের। ছোটভাই সুরেশ্বর বিশ্বাস এ সময় রাজধানীতে ব্যস্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিও ধর্মান্তরে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বটে, কিন্তু পান্ডুয়ার হুকুমাতের এক ব্রাক্ষ্মণ সৈন্যাধ্যক্ষের অধীনে কর্মরত থাকায় চাকুরী হারানোর ভয়ে তিনি দোটানায় পড়ে যান। কয়েক বছর পর তিনি যখন শমশের বিশ্বাস নাম নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবেন বলে মনোস্থির করলেন, ঠিক তখনই পান্ডুয়ার হুকুমাতের পুরোপুরি ক্ষমতা রাজা গণেশ নিজের হাতে নিয়ে এদেশ থেকে মুসলমান উচ্ছেদের অভিযানে ব্রতী হন। রাজা গণেশ এযাবত পরোক্ষভাবে সর্বময় কর্তা হয়ে থাকলেও, পান্ডুয়ার নাম কা ওয়াস্তে সুলতান আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহকে অপসারণ করে এবার প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতাসীন হন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে তার আজন্ম আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। ফলে এই হুকুমাতের অধীনে চাকুরীরত থেকে জান এবং চাকুরী-এই দুইটিই হারানোর আশংকায় ইসলাম গ্রহণের দুঃসাহস সুরেশ্বর আর করেন না ৷
কিন্তু ইসলাম গ্রহণ না করলেও এবং একই ভিটেয় অবস্থিত তার মুসলমান জ্ঞাতিদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক না রাখলেও, আন্তরিকতার দিক দিয়ে তিনি তাঁর ভাইদের পরিবারের সাথে একান্ত ঘনিষ্ঠ এবং সহানুভূতিশীল ছিলেন। তটিনী বিশ্বাস এই সুরেশ্বরের কন্যা।
তটিনীর জেঠামশাই মুহসীন বিশ্বাস ব্যবসায়ী মানুষ। কাপড়ের ব্যবসায় তিনি অনেক টাকা খাটান। তাঁর নিজের একটা মস্তবড় কারখানা আছে তাঁতের। অনেক লোক খাটে সেখানে। এ ছাড়াও তিনি অন্যদের বুনানো কাপড় নগদ টাকায় কেনেন। তামামগুলো একত্র করে পাঠিয়ে দেন মহাজনদের কাছে। মহাজনেরা পাঠিয়ে দেন বন্দরে। কাপড় ওঠে জাহাজে। চলে যায় নানা দেশে-সুমাত্রায়, জাভায়, সিংহলে, পারস্যে, আরবে। বাংলামুলুকের সূতীবস্ত্রের বেজায় চাহিদা বাইরে। ব্যবসায়ীরা কাপড় বেচে অনেক টাকা কামায়। সে টাকার হিস্সা পায় তাঁতীরা। হিস্সা পায় তাজউদ্দীনও।
দাওয়ায় বসে মুহসীন বিশ্বাস ভাবছিলেন। মহাজনদের কাছে মাল পাঠানোর তারিখ আজ। সপ্তায় একবার করে মাল পাঠান মুহসীন সাহেব। নৌকা যোগে মাল যায় মহাজনদের ঘাটে। মুহসীন সাহেবের মতো আরো অনেক ব্যবসায়ীই মাল পাঠান সেখানে। অনেক দূরের পাল্লা। এককভাবে কারো নৌকা যায় না। জোট বেঁধে অনেক নৌকা এক সাথে ছাড়ে। লুটেরাদের হাতে কয়েকবার দাগা খাওয়ার পর এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু কাপড়ের নাওই যায় না। ধান, চাউল, তিল তিসির নৌকাও এক হাট থেকে অন্য হাটে, এক গঞ্জ থেকে অন্য গঞ্জে যায়। জাহাজভর্তি ফসল যায় বিদেশেও। অঢেল ফসল বাংলামুলুকে। তিন তিন বার ফসল ফলে বছরে। দামও খুব সস্তা। এই ফসল বাইরে পাঠালে অনেক মূল্য পাওয়া যায়৷ সেই পয়সায় বাইরে থেকে সোডা-কেরোসিন-মস্লা এনে বেনেতী দোকান খুললে পয়সা আরো বাড়ে। তাই কৃষিকাজের পাশাপাশি চুটিয়ে ব্যবসা চালায় এ মুলুকের লোকেরা।
ভোর হওয়ার সাথে সাথেই নৌকায় মাল তোলা শেষ হয়েছে। হিসেব বুঝে দেয়ার জন্যে বিশ্বাস সাহেবের কর্মচারীরা হুটপাট শুরু করেছে। দেরী হলে অন্য সব নাও ছেড়ে দেবে। কিন্তু বিশ্বাস সাহেবের কিছুতেই আজ উৎসাহ নেই। লাভ লোকসানে মন নেই। হিসাবের ফর্দটায় এক পলক চোখ বুলিয়েই কর্মচারীদের বিদায় করলেন বিশ্বাস সাহেব।
সকাল থেকেই তিনি অত্যন্ত পেরেশান আছেন। অশান্তিতে একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছেন। ধন-সম্পদ কোন কিছুরই অভাব নেই এদেশে। অভাব শুধু নিরাপত্তার। বিশেষ করে মুসলমানদের কি দিয়ে কি হয়ে গেল আচানক। এ অবস্থা এ মুলুকে কোনদিনই ছিল না। মুসলমান সুলতানদের আমলে হেফাজতির অভাবে সাধারণ মানুষ কোনদিন ভোগেনি। মুসলমানেরা তো নয়ই। হিন্দুরাও নয়। হেফাজতির প্রশ্ন নিয়ে কোন হিন্দুকে এক লহমার জন্যেও সোচ করতে হয়নি। তারা নির্ঝঞ্ছাটে ঘর সংসার করেছে। সে নিজেও তো হিন্দু ছিল কদিন আগে। সামাজিক অশান্তিটা ছাড়া এ ধরনের কোন ভাবনাই মাথায় তাদের আসেনি। এদিক দিয়ে, মায়ের কোলে থাকার মতো নিশ্চিন্তে ছিলেন। একদিনের কথা নয়। প্রায় দেড় দুইশো বছর ধরে এই অবস্থার সাথেই হিন্দু মুসলমান সকলেই পরিচিত। অখন্ড ক্ষমতা হাতে থাকা সত্ত্বেও একমাত্র প্রচার ছাড়া হাতিয়ার হাতে ইসলাম নিয়ে কোন হিন্দুর কাছে কেউ কখনও আসেনি। রাজা গণেশ তকতে বসার সাথে সাথেই একি গজব নেমে এলো দেশে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান প্রজাদের ঘরে আজ একি এক নিদারুণ আতংকের হাতছানি!
কর্মচারীরা বিদেয় হওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে মুহসীন বিশ্বাস এই ভাবনাই ভাবছিলেন। এই সময় তার সামনে এলো তটিনী। কোন ভূমিকা না করে সে সরাসরি বললো— জেঠামশাই, গত রাতের খবর কি বলুনতো! কি হয়েছিল ওপাড়ায় ?
মুহসীন বিশ্বাস নজর তুলে তটিনীর দিকে তাকালেন। নজর তাঁর নিষ্প্রভ। বললেন— বড় নাখোশ খবর মা। ওপাড়ার ঐ মসজিদের পাশে হাতেম খাঁর বাড়িতে কিছু মুসল্লী এসে আশ্রয় নিয়েছিল। বোস বাড়ির ওদিক থেকে তারা এখানে এসেছিল। খোঁজ পেয়ে রাজা গণেশের ফৌজ এসে রাতের অন্ধকারে তাদের ওপর চড়াও হয়।
কেন, কসুর কি তাদের?
রাজধানীতে হাজির হওয়ার জন্যে তাদের তলব দেয়া হয়েছিল। তারা হাজির হয়নি সেখানে।
কেন হাজির হলো না?
হলে কি আর ওয়াপস্ আসতে পারতো তারা! একটা না একটা কসুর দেখিয়ে তাদের খতম করে দেয়া হতো।
বলেন কি!
এমন ঘটনাতো হামেশাই ঘটছে এখন। কোন আলেম উলেমা আর সুফী ধরনের কোন লোক সেখানে গিয়ে আর ওয়াপস্ আসেনি। জ্ঞানী গুণী আর ধর্মভীরু মুসলমানদের আর কি কোন নিরাপত্তা আছে রাজধানীতে?
তাজ্জব!
ঘটনাটা এতদিন রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন এটা ক্রমেই গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের অনেক নীরিহ মুসলমানদেরও এখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং সূতোনাতা কারণ দেখিয়ে তাদের কোতল করা হচ্ছে।
সেকি কথা !
নানাদিক থেকে এমন পয়গাম হামেশাই আসছে এখন।
কারণটা কি জেঠা মশাই? দেশের রাজা প্রজার ওপর এমন জুলুম করবেন কেন?
কারণ ঐ একটাই। এদেশ থেকে ইসলামকে উচ্ছেদ করার এক বদখেয়াল রাজা গণেশের মগজের মধ্যে ঢুকেছে। তিনি এটা পুনরায় নির্জলা এক হিন্দুরাজ্য বানাবেন- এমনই এক খাহেশ হয়েছে এখন তাঁর। আর এই বদখেয়াল বাস্তবায়নের কারণেই তিনি এখন বেপরোয়াভাবে মুসলমানদের পেছনে লেগেছেন।
তাহলে তো বড় মুসিবতের কথা! তা ওপাড়ার ঐ মুসল্লীরা কোথায় এখন?
তারা অন্যত্র চলে গেছে।
ফৌজী হামলার হাত থেকে তারা রেহাই পেলো কিভাবে?
সবই আল্লাহর শান মা। তিনি কাউকে রক্ষে করলে, কার সাধ্যি তার গায়ে কাঁটার আঁচড় কাটে। আমরা যখন গেলাম তখন গোলমাল প্রায় থেমে গেছে। মুসল্লীরা বললেন— সেপাইরা এসে তাদের হামলা করার সাথে সাথে অন্ধকারের মধ্যে কে একজন কোথা থেকে তেড়ে এসে সেপাইদের ওপর লাঠি চালাতে শুরু করে। একজন সেপাই পড়ে যেতেই তার ঢাল তলোয়ার ছিনিয়ে নিয়ে সে লোকটা সেপাইদের সাথে তুমুল লড়াই শুরু করে। সে কি তার বিক্রম! একজনের আক্রমণেই একদল সেপাই নাজেহাল হয়ে পড়ে।
তারপর ?
তা দেখে হুঁশ হলো মুসল্লীদের। ওপাড়ার অন্যান্য মুসলমানেরাও হৈচৈ শুনে সেখানে এসে জুটেছিল। এবার সবাই লাঠি, শড়কী, বল্লম, বাঁশ-যে যা হাতের কাছে পেলো, তাই নিয়ে ঘিরে ধরলো সেপাইদের। সেপাইদের তুলনায় সংখ্যায় এরা অনেক। বেদম মার খেয়ে সেপাইরা শেষ পৰ্য্যন্ত পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো।
তটিনী বিশ্বাস তন্ময় হয়ে কাহিনী শুনলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে কি যেন চিন্তা করলো। তারপর সে উৎসুকভাবে প্রশ্ন করলো— লোকটা তাহলে কে, কেউ তা পয়চান করতে পারলো না?
মুহসীন বিশ্বাস বললেন— না। চোখ-নাক বাদে তার মাথা-মুখ সবটুকুই কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। সেপাইদের পিছে পিছে সেও নাকি অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
তাহলে কে হবে লোকটা? আপনারা কি অনুমান করেন?
হয়তো ইসলামের কোন খাদেম। অনেক মুসলমান সেপাই এখন গোপন ভাবে কাজ করছে। চাকুরীচ্যুত হাজার হাজার সেপাইদের সবাইতো আর বসে থাকবে না মুখ বুজে ?
তাহলে ঠিক তাই। তারাই কেউ হবে। কিন্তু জেঠামনি, আমি ভাবছি— সেপাইরা একবার যখন এ গাঁয়ে এসেছে, তখন আবারও তো আসতে পারে?
তা পারেইতো।
আপনার জানের ওপরও তো তাহলে হুমকি আছে এখন?
তাতো আছেই।
তাহলে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা কিছু করছেন না আপনারা ?
আমরা আর কি করতে পারি? সুফী সাহেবকে খবরটা জানিয়ে রাখা ছাড়া আপাতত আর করার কিছু দেখছিনে।
সুফী সাহেব মানে ঐ-
হ্যাঁ। হজরত নূর কুতুব-ই-আলম সাহেব।
খবর নিয়ে গেছে কেউ তাঁর কাছে?
না, এখনও কেউ যায়নি। আমার ওপরই ভার আছে লোক পাঠানোর। ভাবছি, তাজউদ্দীনকেই পাঠিয়ে দিই।
কাকে?
তটিনী বিশ্বাস বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো।
মুহসীন বিশ্বাস বললেন— তাজউদ্দীনকে।
তাজউদ্দীনকে। তার মতো একজন নালায়েক নির্বোধকে এই কাজে পাঠাবেন?
কাজটা এমন কিছু কঠিন নয়। সুফী সাহেবকে সেরেফ খবরটা জানানো। নালায়েক বা হুশবুদ্ধিহীন হলেও তাজউদ্দীন ইমানদার লোক। খুবই সৎ ছেলে। বিশ্বাসী লোক নাহলে এসব কাজে যাকে তাকে পাঠানো নিরাপদ নয়। সুফী সাহেবের সাথে এখন যোগাযোগ করাটাও মস্তবড় অপরাধ। এটা ফাঁশ হলে বিপদ হবে।
তাহলে ভাল করে বুঝিয়ে বলবেন তাকে সব। নইলে আবার গোলমাল করে ফেলবে। যে নির্বোধ লোক।
মুহসীন বিশ্বাস স্মিতহাস্যে বললেন— তা কি আর বলতে হবে মা? তাকে সব কিছু ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে তবেই পাঠাবো। তা তুমি এই সাত সকালে কি মনে করে? এই জন্যেই?
হ্যাঁ জেঠামশাই রাতে এই খবর শোনার পর আর আমার ভাল করে ঘুম হয়নি। কি জানি কোন মুসিবত কোনদিক দিয়ে আবার আপনার ঘাড়ের ওপর আসে!
মুহসীন সাহেবের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো— ছেলের চিন্তা মায়েরা তো সব সময়ই করে। কিন্তু তোমার এই বুড়ো ছেলেকে নিয়ে তোমাকে এত পেরেশান হতে হবে না মা। ঐ একজনের রহম যদি থাকে, তোমার এই ছেলের কাছে যম-আজরাইল, যা-ই বলো, কেউ ভিড়তে পারবে না।
তটিনীর মুখের দিকে চেয়ে হাসতে লাগলেন মুহসীন বিশ্বাস। তাঁর হাসির সাথে যোগ দিয়ে হেসে ফেললো তটিনীও।
তটিনী বাল্যবিধবা। গৌরী দানের সুর ধরে আট থেকে ন’বছরে পা দিতে না দিতেই তটিনীর বিয়ে দেন সুরেশ্বর বিশ্বাস। বরও কম বয়সের বালক। তার ছিল মিরূগী রোগ। বরপক্ষ চালাকী করে এ খবরটা গোপন করে রাখে। বিয়ের পর দিন তিনেক যেতে না যেতেই মিরূগী রোগে আক্রান্ত হয়ে নদীরঘাটে ডুবে মরে বর। আর বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ওয়াপস্ আসে তটিনী।
সারা রাস্তা ঘুমিয়ে তটিনী বিশ্বাস শ্বশুরবাড়িতে যায়, আর বিধবা হয়ে আসার সময়ও ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ফিরে আসে। কি দিয়ে কি হয়ে গেল সেদিনও সে কিছুই বুঝতে পারেনি। আজও তার সে সব কথা স্মরণই তেমন আসেনা। বিধবা হয়ে আসার পর অনেক দিন কেটে গেছে। কেটে গেছে এক নাগাড়ে-তের চৌদ্দ বছর। দূরন্ত যৌবনের এক দুর্বিষহ বোঝা এখন টেনে বেড়াচ্ছে তটিনী। তার ওপর ভর করেছে সৃষ্টিছাড়া রূপ। শিশুকালেই তার রূপ দেখে নাম মাত্র দেনা পাওনায় তাকে লুফে নেয় বরপক্ষ। সে রূপ এখন ষোলকলায় বিকশিত। তার মুখের দিকে তাকিয়ে অভিভাবকেরা গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। আরশীতে মুখ দেখে তটিনীও সময় সময় বিমনা হয়ে যায়। কিন্তু বড় কঠিন ধাতের মেয়ে এই তটিনী। এক অখন্ড ব্যক্তিত্বের আর প্রখর বুদ্ধি মত্তার অধিকারিনী সে। তার পরিচ্ছন্ন রুচি, দৃঢ় মনোবল আর মজবুত ব্যক্তিত্বের কারণে তাকে উত্যক্ত করার সাহস রাখেনা গোটা গাঁয়ের কেউই। সাহস রাখেনা পার্শ্ববর্তী কোন গাঁয়ের কোন লোক। তার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকাবার মতো হিম্মত চেনা জানা কোন লোকেরই ছিল না। অচেনারাও তা করতে গিয়ে চরমভাবে চুপসে গেছে। গাঁয়ের তামাম লোকই তাকে এখন আলাদা নজরে দেখে। হিন্দুরা ভাবে, ওটা তাদের মা চন্ডীর অবতার। মুসলমানেরা মনে করে-ওটা একটা নাগালের বাইরের আঙ্গুর ফল। ও আঙ্গুর টক। আইবুড়ো বিধবা মেয়ে নিয়ে এয়োতিরা বৃদ্ধারা স্বভাবতই যে কানাঘুষা করে, তটিনীর বেলায় শুরুতেই তারা খামুশ হয়ে গেছে। আর কোন উৎসাহই দিলে তাদের পয়দা হয়নি অতঃপর।
তটিনী এখন নিঃসংকোচে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। নিসঙ্গ নিশিথে তটিনীর মুখশ্রী হাতড়িয়ে বেড়ায় যারা সামনে পড়লে তারাও সসম্ভ্রমে তটিনীকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। নজর তাদের নুইয়ে পড়ে মাটির দিকে। তবুও রূপ বড় বালাই। দূর দূরান্তের লোলুপ দৃষ্টি থেকেই যায় তার দিকে। ওগুলোকে উপেক্ষা করেই চলতে হয় তটিনীকে।
তটিনীর দুই মা। সেপাই বাপ ছোট বউকে সঙ্গে নিয়ে পান্ডুয়াতে বসত করেন। তটিনী আর তটিনীর মা গাঁয়ের বাড়িতে থাকেন এবং চাকর বাকর নিয়ে ঘর সংসার সামলান। সুরেশ্বর বিশ্বাস গাঁয়ে আসেন বছরে দু’ একবার। ঘর-সংসার দেখার মতো কোন ফুরসতই তিনি পাননা। তাঁর কোন পুত্রসন্তান না থাকলেও তা নিয়ে আফসোস করতে হয়না তাঁকে। এক তটিনী এমন অনেক পুত্রের বাড়া।
মরিয়ম বিশ্বাস বাহির আঙ্গিনায় এসছিলেন। বাহির আঙ্গিনা বিশ্বাসদের একটাই। প্রশস্ত আর লম্বা। যার বাড়ির সামনে যে অংশ পড়ে সেই অংশই এক একজন ব্যবহার করেন তাঁরা। মরিয়ম বিশ্বাসের হিস্সাটা ঠিক মাঝখানে। সদ্যওঠা ফসলের তদারকির কাজে বাহির আঙ্গিনায় এসে মরিয়ম বিশ্বাস আঙ্গিনার এক প্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন। আঙ্গিনার নীচেই সরকারী ডহর। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চলাচলের রাস্তা। সেই রাস্তার দিকে নজর দিয়েই চমকে উঠলেন মরিয়ম বিশ্বাস। আঙ্গিনা থেকে বিশ-ত্রিশ গজ ফারাগে ডহরের ওপর মুহসীন বিশ্বাস কথা বলছেন যে নওজোয়ানের সাথে, সেই নওজোয়ানই মরিয়মের এই বিষয়ের কারণ। মরিয়মের বিপরীত দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল নওজোয়ানটি। মরিয়ম তার মুখ দেখতে পায়নি। কিন্তু তার পেছনটা-চুল-মাথা-ঘাড়-বিলকুল মরিয়মের মৃত পুত্র রবীন বিশ্বাসের মতো। তিল পরিমাণ ব্যতিক্রম নেই কোথাও ।
চমকে উঠেই ডহরের দিকে ছুটে এলেন মরিয়ম বিশ্বাস। স্বাভাবিক হুঁশবুদ্ধি লোপ পেয়েছে তখন তাঁর।’ মরিয়ম বিশ্বাস নিকটবর্তী হতেই মুহসীন বিশ্বাসের সাথে নওজোয়ানটিও তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকালো। ঘনকৃষ্ণ কচি দাড়ির নীবিড় একটা আবরণ নওজোয়ানটির কচি মুখে থাকলেও মরিয়ম বিশ্বাস অবাক হয়ে দেখলো তার মুখমন্ডলের রং গঠনও অনেক খানি রবীন বিশ্বাসের মতোই। দাড়িটুকু না থাকলে একে রবীন বিশ্বাস বলে যে কারুরই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। সেই রকমই দপদপে উজ্জ্বল গায়ের রং, সেই রকমই চোখ-মুখ-নাক। রবীন বিশ্বাসের একটা মস্তবড় সম্পদ ছিল, তার কার্তিক প্রতীম চেহারা। এই ছেলেটির মধ্যেও এতটুকু ঘাটতি নেই সেই সৌন্দর্যের। ফারাগ বলতে এ ছেলেটি বয়সে খানিক বড় আর তার হাত পা এবং সিনাটা আরো অধিক বলিষ্ঠ। অপর পক্ষে, তার দৃষ্টিটাও আবার রবীনের মতোই লাজুক।
মরিয়মকে ছুটে আসতে দেখেই মুহসীন বিশ্বাস বুঝতে পারলেন কারণটা। বললেন, বউমা, তোমার মতো আমারও ঐ একই ভ্রম হয়েছিল। আর তাইতো এই ছেলেটাকে ডাক দিয়ে থামালাম। আশ্চর্য! মানুষের সাথে মানুষের এতটা মিল হয়!
মরিয়মের এতক্ষণে সম্বিত ফিরে এলো। মাথার কাপড় আরো খানিকটা টেনে দিয়ে বললেন-ছেলেটা কে বড় ভাই? নাম কি?
নাম তাজউদ্দীন। এর বাড়ি নাকি ঐ কাজল দীঘির ঐদিকে। বচপনকালে বাপ-মা হারিয়ে পান্ডুয়াতে আসে। সেখানে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে মানুষ হয়। কয়দিন আগে সেই গোটা পরিবারটাই নাকি রাজা গণেশের ফৌজ খতম করে দিয়েছে। এ তখন বাড়িতে ছিলনা বলেই বেঁচে গেছে কোন মতে। এখন এ আশ্রয় আর কাজ কামের তালাশে এদিকে এসেছে। আপাতত একটা আশ্রয় এর প্রয়োজন।
মরিয়ম বিশ্বাস বললেন— আশ্ৰয় ?
এবার তাজউদ্দীন নিজেই নত মস্তকে বললো— জি, মানে কোথাও কোন কাজ কাম পেলে সেখানেই কাজ কাম করতাম আর থাকতাম ।
মুহসীন বিশ্বাস বললেন— কি কাজ জানো তুমি?
তাজউদ্দীনের নতশির আরো একটু নত হলো। সে ইতস্তত করে বললো— মানে থাকতাম তো এক বড়লোকের বাড়িতে! তাঁরা খুব যত্ন করেই আমাকে লালন পালন করেছিলেন। তাই ক্ষেত খামার বা অন্যকোন কাজ ভাল করে শেখার মওকা পাইনি। তবে আমার মনের জোর আছে, দু’একদিন কোশেশ্ করলেই কৃষিকাজ, তাঁতের কাজ বা অন্য যে কোন কাজ সব কিসিমের কাজই আমি ঠিক মতো করতে পারবো।
মরিয়ম বিশ্বাসের দিলটা আবার চঞ্চল হয়ে উঠলো। গোটা সংসারে একদম তিনি একা। দেখার মানুষ অভাবে সংসারটা তাঁর বিরান হয়ে যাচ্ছে। সবার ওপর, পুত্রশোক ভোলার মতো কোন অবলম্বনই নেই তাঁর। জামাইটা এলেও সংসার ফেলে দু’এক দিনের বেশী কোন বারেই থাকে না। আবেগের আধিক্যে তিনি ফস্ করে বলে ফেললেন— আমি যদি আমার সংসারে রাখি তোমাকে তুমি থাকবে বাবা ?
তাজউদ্দীনের মুখ মন্ডল রোশনাই হয়ে উঠলো। এতটা কল্পনাও সে করেনি। তবু নিজেকে সংযত করে সে বললো— যে কোন খানে একটু ঠাঁই পেলেই আমার জন্যে সেটা আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ রহমত। কিন্তু কাজটা কি ধরনের হবে, আমি সেটা পারবো কিনা— সে সম্বন্ধে একটু-
এর জবাবে মুহসীন বিশ্বাস বললেন— সে তোমাকে ভাবতে হবেনা। যা তুমি পারবে তাই করবে। যা পারবে না, তা করার তোমার দরকারই হবে না।
কথাটা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে না পেরে তাজউদ্দীন মুহসীন বিশ্বাসের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো— জি!
মুহসীন বিশ্বাস বললেন— তোমার আদব-আখলাকে কোন গলদ যদি না থাকে, তাহলে সুখেই থাকবে তুমি।
তাজউদ্দীন এবার চোখ নামিয়ে শরমিন্দা কন্ঠে বললো— জি না, কোন বেয়াদপী আমি কখনও করি না।
বেশ। তাহলে আর কোথাও যাওয়ার তোমার দরকার নেই। তুমি আমাদের বাড়িতেই চলো। দিলের চাঞ্চল্যে ভাশুরের মতামত না নিয়েই মরিয়ম বিশ্বাস তাজউদ্দীনকে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এবার ভাশুরকেও এ ব্যাপারে আগ্রহী দেখে তিনি খোশদিলে বললেন— আপনি ও তাহলে আমার এ প্রস্তাব সমর্থন করেন বড় ভাই ?
মুহসীন বিশ্বাস উৎসাহের সাথে বললেন— সমর্থন করি মানে! তুমি আগে এটা মুখ ফুটে না বললে, আমি নিজেই এ প্রস্তাব তোমার কাছে রাখতাম। তোমার তো একটা অবলম্বন দরকার। নিজের ছেলে নেই যখন, তখন পোষ্য নিতে দোষ কি! তাছাড়া, ছেলেটাকেও মোটামুটি নেকমান্দ বলেই মনে হচ্ছে।
তাজউদ্দীন এতক্ষণে নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারলো, কি অবস্থায় পড়েছে সে। তার এই খোশ কিসমতির জন্যে সে মনে মনে আল্লাহ পাকের শোকর গোজারী করলো।
সেইদিনই মরিয়ম বিশ্বাসের সংসারে উঠে এলো তাজউদ্দীন। মরিয়ম বিশ্বাসের বৈঠকখানার ঘরটি এযাবত ফাঁকা পড়েই ছিল। ঝেড়ে মুছে মরিয়ম বিশ্বাস সেই ঘরেই তাজউদ্দীনের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিজের সন্তানের মতো কাছে বসিয়ে খাইয়ে অনেকদিন পর অনেকখানি তৃপ্তি বোধ করলেন তিনি।
আহারের পর তাজউদ্দীন তার ঘরে এসে লম্বা একটা ঘুম দিলো এবং ঘুম থেকে সে একেবারে বিকেল বেলা উঠলো। অচেনা জায়গা। অন্য কোথাও না বেরিয়ে সে বাহির আঙ্গিনায় কিছুক্ষণ পায়চারী করলো। এরপর আঙ্গিনার এক প্রান্তে হেলে পড়া এক আমগাছের ডালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে তার অতীত আর বর্তমানের হিসাব মিলাতে লাগলো।
তটিনী বিশ্বাস সেদিন সকাল থেকেই নিজ মকানে ছিল না। ও পাড়ার এক আত্মীয়ের মকানে জরুরী কাজে আটকে ছিল। আত্মীয়ের বাড়ি থেকে সে যখন নিজ বাড়িতে ফিরলো তখন আর অল্প বেলা বাকি। ডহর বেয়ে বাড়ির নীচে এসেই সে সবিষয়ে দেখলো— এক বলিষ্ঠ নওজোয়ান আঙ্গিনার মাথায় দাঁড়িয়ে। তাজউদ্দীন তার মুখোমুখিই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন ছিল বলে তটিনীর আগমন তার দৃষ্টি গোচর হলোনা। এই ফাঁকে তটিনী তাকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলো। সে বুঝলো চেহারাখানা দেখার মতোই বটে। এ ধরনের সুপুরুষ একমাত্র তার দাদা রবীন বিশ্বাস ছাড়া, জিন্দেগীতে সে আর কোথাও তেমন একটা দেখেনি।
বাড়ির ওপর উঠতে উঠতে সে ভাবতে লাগলো— কে এই নওজোয়ান! কোথা থেকে এলো এ! সেই সাথে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো— একমুখ দাড়িতেও মানুষের সৌন্দর্য এতটা বৃদ্ধি পায়!
আঙ্গিনায় উঠে এলে তটিনীর পদশব্দে চোখ তুললো তাজউদ্দীন। চোখাচোখি হতেই তাজউদ্দীন তার নজর অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। তটিনীও চোখ নামিয়ে দ্রুত পদে গৃহের মধ্যে প্রবেশ করলো।
গৃহে ঢুকেই তটিনী খোঁজ নিয়ে জানলো— আগন্তুকটি ক্ষণিকের মেহমান নয় স্থায়ী বাসিন্দা। মেঝো জেঠীমা পোষ্য নিয়েছেন তাকে। সে এ বাড়িতেই থাকবে। এ খবরে তটিনী বিশ্বাস নাখোশও হলোনা, আবার পুরোপুরি খুশী হতেও পারলোনা। তার স্বাধীনভাবে চলাফেরার পথে এমন একটা সার্বক্ষণিক বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় সে বরং নাখোশই হলো খানিকটা। একটা অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। ভাবতে লাগলো— আগন্তুকের লোলুপ দৃষ্টি হয়তো তাকে হামেশাই বিব্রত করতে থাকবে। তার চেহারার সাথে আদব-আক্কেলের সামঞ্জস্য না থাকলে তটিনীকে হয়তো আরো অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থির মোকাবেলা করতে হবে।
কিন্তু যে ভয়ে তটিনী বিশ্বাস তটস্থ হয়ে উঠেছিল, কিছুদিন পর সে নিজেই সেই পরিস্থিতির কাঙাল হয়ে পড়লো। বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও তটিনীর অস্তিত্ব তাজউদ্দীনের গণ্যের মধ্যেই এলোনা বা তা আলাদা কোন গুরুত্বই তাজউদ্দীনের কাছে পেলোনা। লোলুপ দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করা তো দূরের কথা, তটিনী বিশ্বাস তার নাকের ডগার ওপর অহরহ বিচরণ করলেও সে চোখ তুলে সেদিকে কোন দিনই চাইলো না। কালে ভদ্রে অকস্মাত চোখে চোখ পড়লেও, তাজউদ্দীনের ফেরানো নজর দ্বিতীয় বার তটিনীর দিকে ঘুরলো না।
আরো যা বিস্ময়কর তা হলো, তাজউদ্দীনের অস্বাভাবিক বাক-সংযম। অকারণে একটা কথাও সে কারো সাথে বলে না। কোন প্রকার প্রাণ চাঞ্চল্যের অভিব্যক্তিও তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। একটা না একটা কাজের মধ্যেই সে সর্বক্ষণ মশগুল থাকতে চায়। ইদানিং তাঁতের সরঞ্জাম পেয়ে সে সাকুল্লেই গায়েব হয়ে গেছে। বাইরে তাঁত আর ভেতরে পোষ্য মাতা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝেনা। তার এই নির্লিপ্ততা নিয়ে অনেকেই টিকাটিপপনী কাটে। প্রতিবেশী ছেলেমেয়েরা তাকে ক্ষেপিয়ে তোলার ইরাদায় হরেক কিসিমের পীড়ন উৎপীড়ন করে। কিন্তু তাজউদ্দীন নির্বিকার। একটু মুছকি হেসেই সে আবার হারিয়ে যায় কাজের মধ্যে।
এসব থেকে দিনে দিনে তাজউদ্দীনের হুঁশবুদ্ধির স্বল্পতা সবার কাছে প্রতিষ্ঠিত হলো। সবাই ভাবলো-জন্মগত ভাবেই এ লোকটার হুঁশবৃদ্ধি কম। আসলেই সে একটা নালায়েক ও নির্বোধ ।
তটিনীরও ধ্যান ধারণা তার সম্বন্ধে পৃথক কিছু হওয়ার কোন অবকাশ ছিলনা। সে যে একটা সুদৃশ্য মাকাল ফল, এ সম্বন্ধে দিনে দিনে তটিনীও নিঃসন্দেহ হলো। তবে তাজউদ্দীন তার শিশুসুলভ সরলতার কারণে বিশ্বাস পরিবারের সকলের উপচে পড়া মহরত আর অফুরন্ত স্নেহ অর্জন করলো। তটিনীও তার প্রতি হৃদয়হীনা ছিলনা। তার একটাই মাত্র আফসোস্ আহা ! এই চিত্তহারী চেহারার সাথে স্বাভাবিক ইশবুদ্ধি আর খানিকটা পৌরুষ থাকতো যদি! তটিনীর মতো এমন একটা জ্বলন্ত অগ্নি শিখা পাশে থাকা সত্ত্বেও যার দিলে কিছুমাত্র তাপ পয়দা ‘হয়না, হয় সে দিল মৃত, নয় সে দিল এমন পদার্থে তৈরী যা তাপ ধারণে অক্ষম।
এই ধারণা নিয়েই তটিনী বিশ্বাস ধীরে ধীরে খামুশ হয়ে গেল। তাজউদ্দীনের অস্তিত্ব তার কাছেও দিনে দিনে নিষ্প্রভ হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও তাদের মধ্যে সামান্যতম বাক্যলাপও হলো না।
হলো একদিন অকস্মাত ।
পোষ্যমাতা মরিয়ম বিশ্বাস তাজউদ্দীনের হাতে মাছ পাঠালেন তটিনীর মায়ের কাছে। এজমালী পুকুর থেকে আজ একটা মস্তবড় মাছ ধরা হয়েছে। মেঝবউ মরিয়মকে এই মাছ কুটে তিন শরিককে বেঁটে দেয়ার ভার দিয়েছেন মুহসীন বিশ্বাস। ছোট তরফের হিস্সা নিয়ে তাজউদ্দীন এসে তটিনীদের দেউড়ির সামনে দাঁড়ালো। কাউকে কোথাও না দেখে সে কুণ্ঠাজড়িত কণ্ঠে একে ওকে ডাকতে ডাকতে দেউড়িটা পার হয়ে কিছুটা ভেতরে চলে এলো। তটিনীর মা তখন রান্না ঘরে ব্যস্ত ছিলেন। বাড়ির চাকর কালাচাঁদও বাড়ির ভেতর ছিলোনা। ডাক শুনে তটিনীই এগিয়ে এলো এবং তাজউদ্দীনকে বাড়ির মধ্যে দন্ডায়মান দেখে অবাক হয়ে বললো-কি ব্যাপার! আপনি!
হাতে ধরা কুটা মাছের পোটলাটা তুলে ধরে তাজউদ্দীন বললো— মাছ। কে পাঠিয়েছে?
আম্মা ।
মেঝো জেঠীমা?
হ্যাঁ। আপনাদের পুকুরের মাছ।
ও, আচ্ছা- আচ্ছা। একটু দাঁড়ান-
তটিনী ছুটে গিয়ে একটা ডালা নিয়ে এলো। ডালা পেতে বললো— দিন, এখানে দিন।
তাজউদ্দীন তার দুই হাতে ধরা কলার পাতার পোঁটলাটা ডালার মধ্যে রাখলো। তটিনী লক্ষ্য করে দেখলো-তাজউদ্দীনের দুই হাতে বেশ খানিকটা ময়লা লেগেছে পোঁটলা থেকে। তাজউদ্দীন ফিরে যাবার উদ্যোগ করতেই তটিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো- উহুঁ, যাবেন না । আর একটু দাঁড়ান।
বলেই তটিনী গিয়ে মাছের ডালাটা বারান্দার ওপর রেখে এক ঘটি পানি নিয়ে দ্রুতপদে ফিরে এলো। এসেই সে বললো— হাত পাতুন।
তাজউদ্দীন ইতস্তত করে বললো— মানে!
তটিনী শক্ত কন্ঠে বললো— হাতে ময়লা। ধুতে হবেনা হাত ?
জি হবে।
তাহলে হাত পাতুন।
অগত্যা হাত পাতলো তাজউদ্দীন। তটিনীর ঢেলে দেয়া পানিতে ঝুঁকে পড়ে দুই হাত ধুয়ে নিলো। পরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দুটি ঝাড়তে লাগলো।
তা দেখে তটিনী বিশ্বাস বললো— গামছা দেবো ?
জবাবে তাজউদ্দীন বললো— জি না, আমার গামছা আছে।
কৈ গামছা ?
আমার ঘরে।
তটিনীর রাগ হলো। বললো— আপনার যে গামছা আছে, সেতো আমি জানিই। আমি আপনাকে কোন গামছা দান করতে চাচ্ছিনে। হাত মুছার জন্য—
তাজউদ্দীন সঙ্গে সঙ্গে বললো— জি-না। আমি যেয়েই মুছে নেবো।
তো যান, তাই নিনগে—
কিছুটা বিরক্ত হয়েই সরে গেল তটিনী।
বিকেল বেলা মরিয়মকে সামনে পেয়ে তটিনী বিশ্বাস বললো, মেঝো জেঠীমা, জেঠা মশাই বুড়ো মানুষ। আজ বাদে কাল তাঁর খাওয়ার কিমত নাও হতে পারে। মাছের ঐ অতবড় মুড়োটা তাঁকে না পাঠিয়ে আমাদের দিয়েছেন কেন? একটা মাত্র মাথা। তিনি থাকতে আমরা খাবো সেটা, এটা কেমন বেয়াদপী আর বেইনসাফীর ব্যাপার!
মরিয়ম বিশ্বাস বললেন— তিনি যে নিতে চাননি কিছুতেই। বললেন, “বড় তকলিফ করে তাজউদ্দীন মাছটা ধরেছে। কাপড় জামা ভিজিয়ে ও ঝাঁপ দিয়ে না পড়লে ছুটেই যেতো মাছটা। এ মুড়োটা তারই হক। তারই জন্যে মুড়োটা রেখে দেবে কিন্তু। তাকে না দিয়ে আমার জন্যে পাঠালে আমি ভয়ানক রাগ করবো।”
তটিনী অবাক হয়ে বললো— তাহলে আমাদের দিলেন যে!
আমি তো দেইনি, তাজউদ্দীন জিদ ধরে দিয়েছে।
মানে!
কবে নাকি তোমাদের কালাচাঁদকে তুমি হাট থেকে মাছের মুড়ো আনতে বলেছিলে? কালাচাঁদ তা ভুল করে আসায় তুমি নাকি তাকে বকাবকি করে বলেছিলে— মুড়িঘন্ট খাওয়ার নাকি তোমার সখ হয়েছে খুব? তাই তাজউদ্দীন, কিছুতেই মুড়োটা তার জন্যে রাখলে না।
একটা রীতিমতো ধাক্কা খেলো তটিনী। তার স্মরণ হলো— পাঁচ ছয়দিন আগে বাহির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে সে কালু ওরফে কালাদাঁদকে এই কথাটা একটু গরম কণ্ঠেই বলেছিল; তাজউদ্দীন বারান্দায় তার তাঁতের কাজে এ সময় মশগুল ছিল। এ কথা তার কানে গেছে তটিনী তা মনেই করেনি তখন। এমন একটা ছোট্ট ঘটনা তার মতো আদ্‌না আদমী মনে রেখেছে এতদিন! আর সেই কারণেই সে নিজের হিস্সাটাই জিদ ধরে অকাতরে দিয়ে দিলো! তাজ্জব!
অভিযোগ উবে গেল তটিনীর। কোনমতে আর দু’একটি কথা বলেই সে তাড়াতাড়ি সরে গেল অন্যদিকে।
এ ঘটনার দিন তিনেক পরের কথা। আসর নামাজ আদায় করার ইরাদায় অজু করে তাজউদ্দীন বাহির আঙ্গিনার পাশে এক সরু গলিতে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছিলো। এমন সময় তাড়া খেয়ে একটা নেড়ী কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ঐ পথেই তার দিকে আসতে দেখে তাজউদ্দীন ছিটকে এলো ওখান থেকে এবং লাফ দিয়ে তার বারান্দার ওপর উঠলো। এমন ভাবে এ কাজটা সে করলো— যেন কুকুর দেখে যারপরনাই ভয় পেয়েছে সে।
তটিনী বিশ্বাস নিকটেই ছিল। তাজউদ্দীনের কান্ড দেখে সে হাসির বেগ চেপে রাখতে পারলোনা। সে সশব্দে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে তাজউদ্দীন চোখ তুলতেই তটিনী বিশ্বাস আর একটু কাছে এসে ব্যঙ্গ করে বললো— আহারে! অল্পের জন্যে বেঁচে গেল জানটা আপনার!
প্রত্যুত্তরে তাজউদ্দীন বললো— জি ?
ভয় পেয়েছেন খুব ?
ভয়? কৈ, নাতো!
কিন্তু আমি যে নিজের চোখেই দেখলাম, আপনি আঁতকে উঠে লাফ দিলেন ?
ও, তা হবে হয়তো। যেভাবে কুকুরটা আসছিলো, তাতে ওটা আমার গায়ের ওপরই পড়তো।
আর সঙ্গে সঙ্গে গিলে ফেলতো আপনাকে !
তটিনীর ঠোঁটে হাসি। তা দেখে তাজউদ্দীন শরমিন্দা কণ্ঠে বললো— না মানে, জানোয়ারটাতো আসলে—
বাঘ ভাল্লুকের চেয়েও ভয়ংকর একটা কিছু!
তাজউদ্দীন বলতে চাইলো জানোয়ারটাতো আসলে না-পাক জানোয়ার। কিন্তু তটিনী তার মুখের কথা শেষ করতে না দিয়ে এই মন্তব্য করলো। সেই সাথে সে আরো বললো— বাইরে বাইরে না ঘুরে আপনার জেনানার মতো শাড়ি পরে অন্দর মহলে থাকা উচিত।
তাজউদ্দীনও হেসে ফেললো। বললো— কি বললেন ? শাড়ি?
শাড়ি নয়,
বোরকা- বোরকা
হো হো করে হেসে উঠলো তাজউদ্দীন। তটিনীর সামনে এইভাবে হাসা এই তার প্রথম। এই নির্মল হাসির মধ্যে একটা নিষ্পাপ অন্তর তটিনীর নজরে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়লো। হাসতে হাসতে তাজউদ্দীন বললো— কি যে বলেন! আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই ভয় পাইনি!
তটিনীও হাসতে হাসতে বললো— না-না, আপনি পাবেন ভয়? আপনার বুকে কত হিম্মত !
জি?
ওটুকুতে হবে না। হিম্মত আরো বাড়াতে হবে। হর কদম আতংকে লাফিয়ে উঠলে অপঘাতে মারা পড়বেন।
না, মানে-
তটিনীর ঠোঁট থেকে হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। তাজউদ্দীনের কথায় কোন কর্ণপাত না করে সে অপেক্ষাকৃত গম্ভীর কন্ঠে পুনরায় বললো— শিশু হলে আমিই না হয় সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভয়টা আপনার ভাঙ্গাতাম। কিন্তু আপনি তো আর শিশু নন। এখন নিজের সাহস বাড়াতে হবে নিজেকেই। এত অবলা আর ভীতু হয়ে চললে এ দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারবেন না, বুঝেছেন ? একটা করুণ দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে তটিনী বিশ্বাস আস্তে আস্তে গৃহের মধ্যে প্রবেশ করলো। তাজউদ্দীনও আর কৈফিয়ত দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলোনা।
এর কয়দিন পরেই তাদের মধ্যে তৃতীয়বার কথা হলো— ঐ মুসল্লীদের ওপর রাত্রিকালে ফৌজী হামলার ঘটনা নিয়ে। যে লোকটা মুসল্লীদের বাঁচালো সে লোকটা নাকি তাজউদ্দিনের মতোই দেখতে— এই আলাপটা নিয়ে।
ঘটনার পরের দিন মুহসীন সাহেবের নির্দেশে এই ফৌজী হামলার খবর নিয়ে তাজউদ্দীন যখন সত্যি সত্যিই সুফী সাহেবের উদ্দেশ্যে রওনা হলো তখন আর একবার এলো তটিনী। এসেই সে তাজউদ্দীনকে তার কর্তব্য ও নিরাপত্তা সম্বন্ধে বার বার হুশিয়ার করে দিতে লাগলো। বললো— আপনি ছাড়া এ কাজের আর যোগ্য লোক আপাতত কাউকে দেখছিনে। আর তাই জেঠা মশাই এর মুখে একথা শুনেও আমি চুপ করে আছি। আমার ধারণা ছিল উনি হয়তো শেষ পর্যন্ত অন্য কাউকে পাঠাবেন। তবু আপনাকেই যখন পাঠাচ্ছেন আর আপনিও যাচ্ছেন, তখন যান। কিন্তু একাজে পদে পদে মুসিবত! যে রকম শিশুর মতো অসহায় আর আলা-ভোলা লোক আপনি! কি ঘটিয়ে বসেন কে জানে! খুব হুশিয়ার থাকবেন সব সময়। ফ্যাসাদ কিছু হলে তো আর গাঁয়ের আর কারো কিছু হবেনা। সবটুকুই যাবে আমাদের ওপর দিয়ে। মানে মারা পড়বেন আপনি আর জেঠামশাই।
কন্ঠে তার উৎকণ্ঠার অভিব্যক্তি ধ্বনিত হয়ে উঠলো। তা লক্ষ্য করে তটিনীর মুখের দিকে এক নজরে চেয়ে রইলো তাজউদ্দীন। একেবারে চোখের ওপর চোখ রেখে। এমন নিবিড়ভাবে তটিনীর । মুখের দিকে তাজউদ্দীন আর কোনদিন তাকায়নি। স্থির নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর তাজউদ্দিন হাসি মুখে বললো— সত্যি, আপনার খাপসুরতের মতোই আপনার দিলটাও বড় পবিত্র!
রওনা হলো তাজউদ্দীন। অসাড় হয়ে অনেকক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো তটিনী।