proggapath, progga, bangla literature, bangla kobita, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, প্রজ্ঞাপাঠ, বাংলা সাহিত্য, কবিতা, বাংলা কবিতা, প্রজ্ঞা, গল্প, বাংলা গল্প, রহস্য গল্প, রম্য রচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, শিল্প-সাহিত্য, নাটক, চিঠি, patropanyas, poem, Story, golpo, bangla poem, bangla Story, Rahasya golpo, Rommo Rocona, Articles, Prabandha, Novel, Upanyas, Drama, Natok, Letter, Cithi, Art and literature, silpo-sahityo, শফীউদ্দীন সরদার, shafiuddin sardar, বিদ্রোহী জাতক, bidrohi jatok

বিদ্রোহী জাতক

০ মন্তব্য দর্শক

দুই :

মযলুমের ভিড়ে হযরত নূর কুতুব-ই-আলমের খানকা শরীফে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। খানকা শরীফের ভেতর বাহির সর্বত্রই মযলুমের আহাজারী। তফাৎ-নযদীক, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর-তামাম অঞ্চল থেকেই নিত্য নয়া পয়গাম আসছে জুলুমের। সুফী হযরত নূর কুতুব-ই-আলম সাহেব একজন যইফ আদমী। অনেক তাঁর বয়স। তুলার মতো সফেদ তাঁর চুলদাড়ি ও চোখের ভ্রু। খানকা শরীফের বারান্দায় আসনের ওপর স্থির হয়ে বসে আছেন সুফী সাহেব। তসবিহ তেলাওয়াত করছেন আর একিন দিলে স্মরণ করছেন আল্লাহ পাককে মযলুমদের আহাজারীতে মাঝে মাঝে চোখ মেলে চাইছেন এবং অশান্ত মযলুমদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন-ইন্নাল্লাহা মায়াস্ সোয়াবেরীন। সবুর করো। আল্লাহ পাকের ওপর আস্থা রেখে ধৈর্য্য ধরো। মুসিবত চিরকাল থাকে না। মুসিবতে ধৈর্য হারানো ইমানদারীর বরখেলাপ। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক ধৈর্য শীলদের পক্ষে থাকেন।
অনেকের ভিড় ঠেলে সুফী সাহেবের আওলাদ শায়খ আনোয়ার সাহেব ওয়ালিদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে ফরিয়াদির আর্তি। সূফী সাহেব কিছুক্ষণ পর চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকালেন। তাঁর মুখাকৃতি অবলোকনেই তিনি অনুমান করতে পারলেন- আর এক নাখোশ পয়গাম তাঁর সামনে হাজির। নিজেকে সংযত করে তিনি ধীর কন্ঠে বললেন-বলো কি বলতে এসেছো?
শায়খ আনোয়ার সাহেবের নজর জমিনের ওপর নিবদ্ধ হলো। তিনি কম্পিত কণ্ঠে বললেন, শায়খ মুইনদ্দীন আব্বাস সাহেবের আওলাদদের রাজা গণেশের ফৌজ কয়েদ করে নিয়ে গেছে। সুফী সাহেব কিয়ৎকাল নীরব হয়ে রইলেন। পরে আবার চোখ তুলে প্রশ্ন করলেন-
আওলাদদের মানে ?
মানে, শায়খ বদরুল ইসলাম বাদে সবাইকে।
সুফী সাহেব পুনরায় নীরব হলেন। শায়খ আনোয়ার সাহেব বললেন-বরদাস্ত করার ওয়াক্ত বোধ হয় পার হয়ে গেছে। এখন আব্বা হুজুরের নির্দেশ কি?
জিজ্ঞাসু নেত্রে শায়খ আনোয়ার সাহেব পিতার দিকে চেয়ে রইলেন। জওয়াবে অনেকক্ষণ পর সুফী সাহেব ফের বললেন-ইন্নাল্লাহা মায়াস্ সোয়াবেরীন।
শায়খ আনোয়ার এরপরও বললেন- শায়খ বদরুল ইসলাম সাহেব ভাইদের জন্যে রাজা গণেশের কাছে দরবার করতে গেছেন। তাঁরও হয়তো বিপদ ঘটতে পারে।
সুফী সাহেব ভারী গলায় বললেন- তুফানের সময় কোন আদমীরই নিরাপত্তা থাকে না। আল্লাহ পাক যার নসীবে যতখানি দুর্ভোগ লিখে রেখেছেন, তা ঘটবেই।
সুফী সাহেবকে পুনরায় নীরব হতে দেখে আনোয়ার সাহেব খানিকটা জিদ ধরে বললেন- আমরা এর প্রতিকার করতে চাই।
না।
সুফী সাহেব আবার চোখ তুলে বললেন- কি প্রতিকার করবে?
যে শক্তি হাতে আছে আমাদের, তাই নিয়ে আমরা রাজা গণেশের ওপর হামলা চালাতে চাই।
সামনা সামনি?
হ্যাঁ, সামনা সামনি। প্রকাশ্যে তার ওপর আমরা হামলা চালাতে চাই। আর চুপ থাকা যায় না
তাতে আরো প্রাণহানিই ঘটবে শুধু৷ সীমিত শক্তি নিয়ে একটা প্রতিষ্ঠিত হুকুমাতের বিরুদ্ধে বেশী সুবিধে করতে পারবেনা।
কিন্তু
তৌহিদ বেগ চৌকশ রণবিদ। তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখো, এই প্রকাশ্য লড়াইয়ে নামতে সেও রাজী হবে না কিছুতেই।
আব্বা হুজুর!
সে জন্যে ঢের বেশী সামর্থের প্রয়োজন।
তাহলে কি আমাদের কিছুই করার নেই?
আছে। যে সব জায়গায় নিরীহ লোকদের ওপর অতর্কিতে হামলা হচ্ছে, সংবাদ যোগাড় করে নিয়ে সেসব জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলো এবং যথা সম্ভব তাদের হেফাজত করো।
সুফী সাহেব চোখ বুজে তসবিহ তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করলেন। শায়খ আনোয়ার সাহেব বুঝলেন তাঁর বুজুর্গান ওয়ালেদ আর বাক্যালাপে আগ্রহী নন। তাঁর যা বলার তা শেষ করেছেন তিনি। অগত্যা আনোয়ার সাহেব আস্তে আস্তে সরে এলেন।
খানিক পরেই তাজউদ্দীন সামনে এসে দাঁড়ালো। সুফী সাহেবকে জেরেত দেখে সে বারান্দার নীচে একটু দূরে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। কতজন কত কথা বলতে এসে সুফী সাহেবকে ধ্যান মগ্ন দেখে সবাই আবার ফিরে গেলো একে একে। কিন্তু তাজউদ্দীন ঐ একইভাবে দাঁড়িয়েই রইলো ওখানে। তা দেখে কেউ কেউ তাকে নিরুৎসাহ করলো। কেউ কেউ আবার ঠাট্টা করে টিকা টিপপনী কাটলো। দরবেশের এক অনুচর এসে তাজউদ্দীনকে কিছুটা ঠেলতে ঠেলতেই বললো হুজুরের ইবাদতে আপনারা এভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন কেন? সকাল থেকে উনি একটানা কথা বলতেই আছেন। এখন যান, উনাকে একটু নিরিবিলিতে থাকতে দিন। আবার যখন চোখ খুলবেন, তখন এসে কথা বলবেন। এখানে উনাকে ডাকাডাকি করবেন না।
তাজউদ্দীন মৃদু কণ্ঠে বললো- না- না। তা আমি করবোনা। অনেক দূর থেকে এসেছি। অন্যত্র যাবো আর কোথায়, এখানেই থাকি। উনি নিজে যখন কথা বলার মওকা দেবেন তখন কথা বলবো।
অনুচরটি বললো-নাছোড় বান্দারে বাবা! তো থাকেন। দ্যাখেন, কখন মওকা পান।

খানিকটা নাখোশদিলেই অনুচরটি চলে গেল। কিন্তু সুফী সাহেব তাকে মওকা দিলেন তখনই। ইবাদতের ফাঁকে তিনি চোখ মেলতেই তাঁর চোখ পড়লো তাজউদ্দীনের ওপর। তিনি তসবিহ রেখে তৎক্ষণাৎ হাত নেড়ে তাজউদ্দীনকে আরো খানিক কাছে ডেকে বললেন- তোমার নাম তো হলো-
তাজিমের সাথে সুফী সাহেবকে সালাম করে তাজউদ্দীন তাঁর কথার খেই ধরে বললেন- তাজউদ্দীন।
সুফী সাহেব খেই পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বললেন- হ্যাঁ-হ্যাঁ, তাজউদ্দীন-তাজউদ্দীন! তা হামলা হোয়েছে তোমার ওখানে?
জবাবে তাজউদ্দীন বললো–জি হাঁ। কিন্তু আপনি-
আমি অনুমান করতে পারছি। কিন্তু তুমি সেজন্যে-
জি না। আমি শুধু পয়গামটা পৌঁছে দিতে এসেছি। গ্রামবাসীরা সবাই চায়,
পাকের নজরে থাক ।
ভাল ওদের হটিয়ে দিতে খুবই কি বেগ পেতে হয়েছে?
জি না। মুসল্লীরা সংখ্যায় অনেক ছিলেন।
বহুত খুব। সবাইকে সজাগ থেকে চলা-ফেরা করতে বলবে।
জি আচ্ছা।
এটা হজুর
সবাইকে বলবে-মুসিবতের সময় অসহায় ইনসানের পাশে দাঁড়ানো সওয়াবের কাজ। হুজুর !
ইত্তেফাকের কুণ্ডত ছাড়া তুফানের সময় জুদা হয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়-এ জ্ঞানটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দাও।
তাতো হলো হুজুর, কিন্তু
বলো-
বুজুগান ব্যক্তিদের ওপরই যে এখন হুমকির আলামত বেশী দেখতে পাচ্ছি।
শায়খ মুইনুদ্দীন আব্বাস সাহেবের আওলাদদের কথা বলছো ?
জি। শায়খ বদরুল ইসলাম সাহেবও শুনছি ভাইদের তালাশে গেছেন।
হু!
এ ছাড়া আরো অনেক ওলামায়ে কেরামের ওপরও হামেশাই হামলা হচ্ছে। হুজুর কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা এই খানকা শরীফে রাখেননি। ভাবছি কখন যে এসব হামলার জের এই খানকা শরীফ পৌঁছে-
হাত তুলে সুফী সাহেব তাজউদ্দীনকে থামিয়ে দিলেন। বললেন- আমাদের কথা ছেড়ে দাও। আমাদের নিয়ে যা খুশী ঐ আলেমুল গায়েব করবেন। ও নিয়ে তোমরা কোন সোচ্ করতে যাবেনা। এখন তোমাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হলো গ্রামগঞ্জের অসহায় মমদের হেফাজত করা।
হুজুর!
রাজার ফৌজের গতিবিধির খবর সংগ্রহ করার কাজও এখন জোরদার করা দরকার। কখন কোন অঞ্চলে যায়! অবশ্য তোমাকে এসব বলা-
হুজুর যা বিবেচনা করেন!
আর কিছু বলবে তুমি?
জি না। আমার আশ্রয়দাতা মুহসিন বিশ্বাস সাহেবের নির্দেশ তো আর ফেলতে পারিনে আমি। তাই ঐ পয়গামটা পেশ করতেই এসেছিলাম।
ভাল-কোন তকলীফই তকলীফ নয় তোমার কাছে। এই তো চাই।
স্মিতহাসি হেসে আবার চোখ বুজলেন সুফী সাহেব। তসবিহ তেলাওয়াতের মধ্যে আস্তে আস্তে আবার তিনি তলিয়ে গেলেন। বেলার দিকে তাকিয়ে তাজউদ্দীন ত্রস্তপদে পথে নেমে এলো।
সুফী সাহেবের খানকা থেকে বাঁশবাড়ির পথ খানিকটা আঁকা-বাঁকা। খানকা থেকে বেরিয়ে নানা ডালে বাগ হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে এপথটা বাঁশবাড়িতে এসেছে। সুলতান দীঘির পাশ দিয়ে যে বড় রাস্তা বরাবর রাজধানীতে চলে গেছে, সেই রাস্তার পেট কেটে চলে এসেছে পথটা। বড় রাস্তা পেরিয়ে খানিক পথ এগুলেই এক নদী। নদী থেকে বাঁশবাড়ি আধাক্রোশের অল্প একটু বেশী পথ। পারাপারের খেয়াঘাটটা এপার-ওপার যোগ করেছে এই পথকে। ঘাটের ওপরই বন্দর মাফিক ছোট্ট একটা জায়গা। জায়গাটার নাম পাকুড়তলা। কোন বটপাকুড়ের গাছ এখানে নেই। কোন এক সুদূর অতীতে তা হয়তো ছিল। আর হয় তো সেই সুবাদেই নাম হয়েছে পাকুড়তলা। দু’চার জন ব্যবসায়ী, দু’পাঁচজন দোকানদার, কয়েকজন খদ্দের, কিছু পথচারী আর আশপড়শী ছাড়া, হররোজ খুব বেশী জন মানবের পদচিহ্ন পাকুড়তলায় পড়েনা। মাঝে মধ্যে ব্যবসায়ীদের নাও ভিড়ে এই ঘাটে। বছরে বার কয়েক বেদের বহর নোঙ্গর ফেলে এখানে। কোন কোনদিন হালদারদের মাছ ধরার তৎপরতা বৃদ্ধি পায় ঘাটের পাশে৷ তখন পাকুড়তলা অনেক খানি চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
ঘাটের ওপরই মুখোমুখী দুইজনের দুই দোকান। একটা দোকান বিষ্ণুপালের, অপরটা রজব আলীর। পাতিল গড়ানো ত্যাগ করে দোকান খুলেছে বিষ্ণুপাল। বেণেতি দোকান বিষ্ণুপালের হরেক কিসিমের বেণেতি মাল পালের দোকানে পাওয়া যায়। রজব আলী কাপড় বিক্রি করে। লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি, চাদর ইত্যাদি।
ছোট ছোট চালার নীচেও দোকান বসে কয়েকটা। খন্ড কালীন দোকান। পান, তামাক, সুপারী আর আলাপাতা এসব দোকানে পাওয়া যায়। তরিতরকারি নিয়েও হেথা হোথা দু’ একজন বসে। শাঁখা-চুড়ি- আলতা-সিঁদুর নিয়ে অনেক সময় ফেরিওয়ালারাও এসে ঘাটের ওপর দোকান খোলে।
রজব আলীর ঘরের পাশেই মহাজনদের এক আড়তঘর। ঘাট দিয়ে মালচলাচল কালে এই আড়তঘরে কয়েকদিন অপেক্ষা করে মালগুলো। এঘরেও কয়েকজন লোক বসবাস করে। বিষ্ণুপালের দোকানের পাশেই কয়েক ঘর কলুর বাস। ক্যাঁকড় ক্যাঁকড় ঘানি ঘোরে সারারাত।
সেদিন শেষ প্রহরে ভিড় ছিলনা ক্রেতাদের। ভিড় ছিলনা অন্য কোন লোকেরও। বসে বসে হাই তুলে গান ধরলো বিষ্ণুপাল। বিষ্ণুপাল রসিক মানুষ। কণ্ঠও বেশ সুরেলা। পূজা-পাৰ্বন বারোয়ারীতে একাই সে মাতিয়ে রাখে আসর। গুণ গুণ করে গাইতে গাইতে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো বিষ্ণুপাল-এত খবর করি হরি, তবু খবর মেলেনা। ও ডোলা মনরে-
তা শুনে রজব আলী হাসতে হাসতে বললো-কি হলো দাদা? কিসের খবর করছো এত? গান থামিয়ে বিষ্ণুপাল বললো- এ্যাঁ! আমায় কিছু বললে?
বৌদি কি বাপের বাড়ি থেকে আসেনি?
বাপের বাড়ি! বাপের বাড়ি গেলই বা কখন, আর আসবেই বা কেন?
তাহলে এতো খবর করছো কার ? অন্য কাউকে মনে ধরেছে বুঝি?
হো হো করে হেসে উঠলো বিষ্ণুপাল। বললো- আরে মিয়াভাই, তা ধরলেই কি আর উপায় আছে? দরোয়াজা বন্ধ !
মানে?
মানে বিশমুণে পাথরের মতো ঘাড়ে যেটা চেপে আছে সেকি আর অন্য কাউকে ঢুকতে দেবে ঘরে?
দেবেনা ?
না ।
বিলকুল না?
জান গেলেও না। আর শুধু ঢুকতে দেয়া? এমন খোশ পয়গাম তার কানে গেলেও গর্দান থাকবে আমার? মটকে দেবেনা মট্ মট্ করে?
বলো কি দাদা। এয়সা মাফিক বৌদি আমাদের?
তো আর বলছি কি? পেনি পেনি। একদম শ্যাওড়া গাছের পেতনি। তার ইয়াৰ্ব্বড়ো ভাঁটার মতো চোখ দুটো হরদম আমার পেছনে বন বন করে ঘুরছে। পান থেকে চূন খসতে দেখলেই ব্যস। জিন্দেগী খতম!
বলো কি!
উঃ! কি কুলক্ষণেই যে ঘরে তুলেছি তাকে!
রজব আলী কৌতুক করে বললো-কি দাদা, কথাটাকি দেবো একবার বৌদির কানে? কপট ভয়ের ভাব করে বিষ্ণুপাল জোড় হাতে বললো- দোহাই ভাই সাহেব, মাথায় দু’ঘা লাঠি মারো, ওভি আচ্ছা। কিন্তু দয়া করে এ দুশমনিটা করোনা।
এবার রজব আলীও আওয়াজ দিয়ে হেসে উঠলো। বললো- তা যা-ই বলো দাদা, আমাদের সত্যি কিন্তু বড় ভাগ্যবতী। খোদ ভগবান তার ভাগ্যটা নিজ হাতে গড়েছেন।
কেন কেন ?
বৌদি
এমন বউ ভীতু বর কয়টা মেয়ের নসীবে জোটে?
বউ ভীতু!
একদম ভেড়া মার্কা। বউ এর ভয়ে এমন ভ্যা-ভ্যা করা বর, সাত জনম তপস্যা করেও কোন মেয়ে পায়না।
বটে! ঠাট্টা হচ্ছে?
না দাদা, ঠাট্টা করবো কেন? যা সত্যি, তাই বলছি। আমি আবার বরাবরই সত্য বলতে খুব ভালবাসি কিনা?
বিষ্ণুপাল তেতে উঠলো। বললো-ওরে আমার সত্যপীরের পোলারে! নিজে যে কেমন বীর বাহাদুর, তা বুঝি আর জানিনে?
কি রকম ?
কাপুরুষ-কাপুরুষ। একদম প্রথম শ্রেণীর কাপুরুষ।
কে.
আমি?
জি, হাঁ। সমীর খাঁর ঐ বিধবা মেয়েটাকে নিকাহ করার জাররা পরিমান খাহেশ প্ৰকাশ করায় ঠ্যালাটা কি খেয়েছো। তা ভুলে গেছো এত শিগগির? ঘরে ঢুকতে না পেরে একখান নয়, দুইখান নয়, সাত সাত খান রাত যে বৈঠকখানায় ল্যাজ গুটিয়ে কাটালে, সে খবর কি জানেনা কেউ?
রজব আলী কাবু হয়ে বললো-তা-মানে-
কি, মানেটা কি?
মানে আমি কাপুরুষ নই যে, সত্যিটাকে সত্যি বলতে ভয় পাবো।
তার মানে, ঘরে ঢুকতে পারোনি।
হাঁ, তা পারিনি।
কেন ঢুকতে পারোনি?
দুয়ার খুলে দেয়নি যে।
দরজা ভেংগে ঢুকবে !
ওরে বাপরে! তাহলে আর রক্ষে ছিল দাদা? যে দজ্জালের দজ্জাল! বাড়িটাই ছাড়তে হতো তাহলে।
কেন, খুব নাকি বীর বাহাদুর? বউকে মোটেই ডরাওনা?
ডরাই না আমি ঠিকই দাদা। তবে ঐ দ্বিতীয় পক্ষের খাহেশটা দিলের ভেতর উকি দিলেই দিলটা কেমন একটু
কমজোর হয়ে যায়।
ঠিক তাই।
বুকের মধ্যে ধড়াশ ধড়াশ আওয়াজ হয়?
তাই হয়৷
বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গেলেই ঠ্যাংটা একটু কাঁপে ?
হো হো করে হেসে উঠলো রজব আলী। বললো-তুমি শালা একদম সবজান্তা দাদা! বিলকুল ধরে ফেলেছো।
বাঁশের তৈরী মাচার ওপর বসে ছিল বিষ্ণুপাল। সেই মাচাতে সজোরে এক চাঁটি মেরে বিষ্ণুপাল বললো-সাৰ্ব্বাস্! তাহলে আর খামোকা ফোড়ন কাটছো কেন বাপধন ?
রজব আলী হাসি মুখে আমতা আমতা করে বললো-না, মানে ঐ একটা কথার কথা
দাদা।
বিষ্ণুপাল বললো- আরে ভাইসাব! সব বানরের মুখ ঐ একই রকম পোড়া। একমাত্র পাষন্ডরা ছাড়া, বিশ্বের তামাম বীর পুরুষেরাই বাইরে বীর, ঘরে ভেড়া।
দাদা!
অতএব খিস্তিপনা ছাড়ো, আখেরাতে মন দাও-
বলেই বিষ্ণুপাল ফের সশব্দে গেয়ে উঠলো ও ভোলা মনরে-
গান ধরেই অকস্মাত থেমে গেল বিষ্ণুপাল। তা লক্ষ্য করে রজব আলী বললো-কি হলো দাদা! থামলে যে?
বিষ্ণুপাল ইশারা করে নীচু গলায় বললো- ঐ দেখো –
রজব আলী গলা বাড়িয়ে দিয়ে দেখলো, এক হাতে একটা বাটি আর অন্য হাতে আধময়লা একটা গামছা নিয়ে ভোলা ভট্টচার্জ বিষ্ণুপালের দোকানের দিকেই আসছে। দেখামাত্র বিষ্ণুপালের মতো রজব আলীও গম্ভীর হয়ে গেল।
ভোলা ভট্‌চাজ সরাসরি বিষ্ণুপালের দোকানে এসে ঢুকলেন। হাতে ধরা গামছা খানা মাচার ওপর বিছিয়ে দিয়ে বললেন- শ্ৰীমান বিষ্ণুপাদ, এই বস্ত্রখন্ডে আধা পয়সার লবশ, আধা পয়সার ডাউল আর এই কাংসপাত্রে দুই পয়সার ঘৃত প্রদান কর দেখি। লবলটা কদলী পত্রে উৎকৃষ্ট করে বেঁধে দাও। লবনের সাথে ডাউলের মিশ্রণ যাতে না ঘটে, সে দিকে সবিশেষ দৃষ্টি রাখবে
বত্স।
বিষ্ণুপাল নির্জীবের মতো যেমন চুপ করে বসে ছিল, তেমনি চুপচাপ বসে রইলো। তা দেখে ভট্‌চাজ মশাই বিস্মিত হয়ে বললেন-কি বৎস, আমার বাক্যগুলি শুনতে পেয়েছো কি? বিষ্ণুপাল জড়িত জন্ঠে বললো- তাতো পেয়েছি ঠাকুর, কিন্তু
কিন্তু কি?
আর তো বাকি দিতে পারবোনা!
ভট্‌চাজ্‌ মশাই চোখজোড়া কপালে তুলে বললেন-মানে!
মানে, অনেক পয়সা বাকি পড়েছে। হররোজ শুধু নিয়েই যাচ্ছেন। একদিনও একটা পয়সা দেননি। বাকি বকেয়া শোধ না করলে, এমন করে বাকি খাওয়ানোর তাকদ আমার নেই। ভট্‌চাজ্‌ মশাই দুইকানে আঙ্গুল দিয়ে বললেন রাম-রাম। হররোজ, বাকি বকেয়া, তাকদ- এসব কিহে? এক প্রকার স্লেচ্ছ শব্দ আমার সামনে উচ্চারণ করে আমাকে পাতকী করতে চাও ?
তা যা-ই বলেন ঠাকুর। পয়সা দেবেন, সওদা নেবেন। বিনি পয়সায় আর কিছুই দেয়া
সম্ভব নয়!
ভট্‌ট্চাজ্ মশায়ের দুইচোখে অগ্নুৎপাত শুরু হলো। তিনি সগর্জনে বললেন-তবেরে দুর্জন! নরক, নরক! রৌরব নরকে পচে মরতে হবে তোকে। আমরা হলেম নমস্য ব্যক্তি। নমস্যদের মনোতুষ্টির জন্যে অর্ঘ প্রদান অনন্ত পূণ্যের কাজ। আর তুই পাপাত্মা তা না করে নমস্যদের কাছেই পাওনা দাবী করিস্ ? নমস্যদেরই ঋণী করতে চাস্? নরকের ভয় কি অন্তরে তোর কিছুমাত্র নেই?
এর জবাবে বিষ্ণুপাল বুকে সাহস বেঁধে বললো- আমি তো দোকান খুলেছি ঠাকুর! অর্থ দিতেও বসিনি, দানপত্রও খুলিনি। মাল বেচে পয়সা না পেলে আমার দোকান চলবে কি করে?
ভট্চাজ মশাই রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন- বটে। এত সাহস বৃদ্ধি পেয়েছে তোদের? দেবতুল্য মনুষ্যের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধাকে তোরা এইভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছিস্ ? তিষ্ঠ! এই অনন্ত পাপের প্রতিফল অচিরেই ভোগ করতে হবে।
অতঃপর একটা তামার পয়সা ঝণাৎ করে বিষ্ণুপালের বাটখারার ওপর ফেলে দিয়ে বললেন—এই নে তোর মূল্য। অবশিষ্ট যা পাবি, অচিরেই পরিশোধ করে দেবো। এবার দ্রব্যগুলো প্রদান কর।
বিষ্ণুপাল আর করে কি! বামুন- পুরুতের অভিশাপের ভয়ে এ যাবত যা চেয়েছে, মুখ মুজে দিয়ে গেছে। একটা কথাও বলেনি। আজ একদিনে আর কত কথা বলবে? অগত্যা সে নতশিরে মাল মাপতে লাগলো।
বুধু হালদার নদী থেকে একঝুড়ি মাছ এনে এই অবেলায় ঘাটের ওপর বসলো। বসেই সে হাঁকতে লাগলো-মাছ-মাছ, টাটকা মাছ!
সবেমাত্র মাছ এনেছে বুধু হালদার। এক পয়সাও বিক্রি হয়নি। এমন সময় ভোলা ভট্‌চাজ্‌ সামনে এসে বললেন–এই বুধে ঐ বড় বড় পাদাগুলো দাও দিকি এই বস্ত্ৰখন্ডে ?
বুধু হালদার ইতস্তত করে বললো- পয়সা দিবেন তো গো ঠাকুর? এখনও আমার বউনি- বাটা হয়নি। বিনি পয়সায় দিতে পারবোনা কিন্তু !
জ্বলে উঠলেন ভট্‌চাজ মশাই। গোস্বাভরে বললেন-বাকি! আমাদের কাছে মাছ দিয়ে অদ্যাবধি পয়সা চায় কোন জেলে, যে পয়সার কথা বলিস্ ? আমাদের মনোতুষ্টির মূল্যই তো অমন শ’ টাকার সমান !
তা -মানে-
অনন্ত নরক থেকে মুক্তি পাওয়ার মানসে কত জেলে বাড়িতে আমার মাছ এনে সাধাসাধি করে, আর তুই নরাধম, নরকের কীট পয়সার কথা বলিস্ ? এখনও বাড় তোদের কমেনি ? বাড় দেখছেন ক্যানেগো ঠাকুর? বাড়ের কথা হলোডা কি? মাছ লেবেন পয়সা দেবেন। এখানে বাড়ের কথা কি হলো?
চোখ দুটো চড়কগাছ করে ঠাকুর মশাই বললেন-কিমাশ্চর্য্যম্! ওরে ব্যাটা অকাল কুষাণ্ড, অস্পৃশ্য, ছোটজাত, যার পায়ের ধুলোর আশায় তোর চৌদ্দ পুরুষ মাথা কুটেছে অহর্নিশ, তাঁর মুখের ওপর এমন ঠাশ ঠাশ্ করে কথা বলিস্ এত সাহস তোর। ভেবেছিস্ এখনও সেদিন তোদের আছে?
বুধু হালদার ক্ষোভের সাথে বললো- আমাদের আবার দিন অদিন কি গো? কামাই হলে খাই, না হলে না খেয়ে থাকি। আমাদের আবার দিন অদিন কি?
গোস্বার আধিক্যে ভোলা ভট্‌চাজ ধূতির কোঁচা ঝাড়তে লাগলেন। বললেন-এখন এদেশের রাজা কে জানিস্ ব্যাটা গোমূর্খ? ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণ, নৈকষ্য কুলীন ব্রাহ্মণ! ইচ্ছে হলেই যে হুটুশ করে জাত খোয়ায়ে মুসলমান হবি, ওটি আর হচ্ছেনা!
মানে?
সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়ে গিয়ে শূলে দেবে। এমনিইতেই যেগুলো যবন এদেশে আছে ওগুলো সাফ করতেই রাজা আমাদের পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ছেন, তার ওপর তোরা আবার নূতন করে যবন হবি? হ! হয়ে দেখনা একবার ঠ্যালাটা!
বুধু হালদার বিরক্ত হয়ে বললো-দাম দেবেন, মাছ লেবেন। এই বেচাকেনার মধ্যে এত কথা শুনাচ্ছেন ক্যানে গো ঠাকুর ?
শুনাচ্ছি এইজন্যে যে, পায়ের তলার জীব তোরা, আমাদের পায়ের তলাতেই থাকবি তো প্রাণে বেঁচে থাকবি। আমাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এখন মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করলে ঐ প্রাণটাও আর থাকবে না।
না থাকে, না থাকবে। বেঁচে থেকে আপনাদের এই জুলুম সহ্য করার চেয়ে মরে যাওয়াও আমাদের জন্যে মঙ্গল। আপনি এখন যান। ঘরে আমার চা’ল নেই। আপনার ঐ বকবকানী শুনলে পেট ভরবে না আমার
মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে বুধু হালদার পুনরায় হাঁকতে লাগলো-মাছ-মাছ, এই যে টাকা মাছ—
দেখে নেবো। ব্যাটাদের কত বাড় বেড়েছে তা একবার দেখে নেবো
গোস্বায় ফুলতে ফুলতে ভোলা ভট্‌চাজ ট্যাং ট্যাং করে চলে গেলেন।
ভোলা ভট্‌চাজ্‌ বিদেয় হওয়ার পর বিষ্ণুপাল রজব আলীকে লক্ষ্য করে বললো-দেখলে ভাই সাহেব, দেখলে ব্যাটা বিকেলে বামুনটার তেজ? এর পর আর কার মেজাজ ঠিক থাকে বলো ?
রজব আলী ভারি গলায় জবাব দিলো, কি আর দেখবো দাদা! যে মুসিবতের মধ্যে এখন আমরা পড়ে আছি, তাতে আর আমাদের বলার কিছু আছে?
মুসিবত!
মুসিবত নয়? ঐ ভট্টচার্জ মশাই কি বললে, শুনলেনা ?
বিষ্ণুপাল নীরব হলো। নিমেষ কয়েক নীরব থেকে সেও অপেক্ষাকৃত গম্ভীর কন্ঠে বললো- সে কথা যদি বলো মিয়াভাই, তাহলে মুসিবত আমাদেরই কি কম? যে দুর্দিনে পড়লাম আমরা আবার ?
রজব আলী তাজ্জব হলো। সেকি দাদা? তোমাদের আবার দুর্দিন কি? দেশের রাজা এখন হিন্দু, এখন তো তোমাদের সুদিন দাদা!
বিষ্ণুপাল আক্ষেপ করে বললো- আরে মিয়াভাই, ঐ যে কথায় বলে, বেল পাকলে কাকের কি? ব্যাপারটা হলো ঐ রকম। সুদিন হলে, সুদিন হলো ঐ ভোলা ভট্চাজের মতো মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চজাতের হিন্দুদের। শুধু হিন্দুটাই তুমি শুনলে? শুনলেনা দেশের রাজা এখন একজন বামুন? আমরাতো জাতে খাটো। আমরা যারা অসংখ্য নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু এদেশে আছি, দুঃখ বাড়লো বইতো কমলো না!
তার অর্থ?
তাদের
অর্থ, মুসলমান সুলতানদের আমলে যেটুকু আরাম আমরা পেয়েছিলাম, সে আরামটাতো হারাম হয়ে গেল আবার।
বলো কি দাদা?
বিষ্ণুপাল ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বললো- এইবুঝে না বোঝার ভাণ করলেই মেজাজটা বড্ড খারাপ হয় রজব ভাই। আরে, মুসলমান সুলতানেরা তো কেউ জোর করে মুসলমান করতে আসেনি আমাদের। কিংবা হিন্দুদের হত্যা করে দেশটাকে নির্জলা মুসলমান দেশ বানানোর জন্যেও উঠে পড়ে লাগেনি তারা। আমাদের অসুবিধাটা ছিল কোথায়? বরং আমরা ইসলাম গ্রহণ করতে পারি ভয়ে উঁচুজাতের হিন্দুরাও খামুশ হয়ে ছিল। আগের মতো অতটা জুলুম করার সাহস পায়নি তারা। আর এখন? এখন অবস্থাটা কি দাঁড়াচ্ছে? ভোলা ভট্‌চা যা বললে তার একদিকটাই দেখলে, আর এক দিকটা দেখলেনা?
রজব আলী থতমত খেয়ে বললে- তা মানে-
এখন তো ওরা ওদের পুরানো ঝাল সমানে ওসুল করতে থাকবে। ঐ আগের মতোই আবার ওদের পায়ের তলে পিষে মরতে হবে আমাদের। ভোলা ভট্টচাজের আচরণ থেকেও কি আঁচ করতে পারোনা কিছু?
রজব আলীর কাছে ব্যাপারটা এতক্ষণে পরিষ্কার হলো। বললো- হ্যাঁ দাদা, কথাটা তোমার অবশ্যি ভেবে দেখার মতো।
বিষ্ণুপাল বললো-আমাদের সুখ শান্তি বলে কি আর থাকতে পারবে কিছু? ওদের সুখ শান্তির যোগান দিতেই তো জান আমাদের ফানা হয়ে যাবে।
ওদের কথপোকথনের মাঝখানে পায়রা হাতে এক বাজীকর এসে হাজির হলো সেখানে। এসেই সে আওয়াজ দিয়ে বোল্ ধরলো এই যে,
খেলার খেলা পায়রা খেলা,
দ্যানেওয়ালা দ্যাখ্ এবেলা,
খেলছে খেলা ভুলুর চেলা।
(আর) ঢংএর বাজী রং এর মেলা
দেখলে খেলা যায় না ফেলা
চোখের পাতা, রয়না বেলা
করলে হেলা পস্তায়,
দেখাই খেলা সস্তায় –
মুখের কথা শেষ করে সে সজোরে ডুগডুগিতে আওয়াজ দিলো। ডুগডুগির বাজনা শোনার সংগে সংগে ছেলে ছোকরাদের সাথে কিছু আগন্তুক ও ইতস্তত বিচরণকারী লোকজন সবাই এসে ঘিরে ধরলো বাজীকরকে। শুরু হলো খেলা। বাজীকর তার পায়রাটাকে ছেড়ে দিয়ে বোল তুললো ডুগডুগিতে। পায়রাটি উড়ে উঠে সেই ঢোলের তালে তালে উলটে উলটে বাজী করতে লাগলো। উপস্থিত জনতা তন্ময় হয়ে খেলা দেখতে লাগলো।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর শেষ হলো খেলা। বাজীকরের পায়রা আবার বাজীকরের হাতে এসে বসলো। জনতার ভিড়টাও সেই সাথে ফিকে হয়ে গেল।
খেলাটা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সুফী সাহেবের খানকা থেকে তাজউদ্দীন এখানে এসে পৌঁছেছিল। জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে সেও আগ্রহভরে এই খেলা দেখছিলো। ভিড়টা ফিকে হয়ে যেতেই আগন্তুকদের একজন এসে তাজউদ্দীনের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। সে তার কামিযের জেব থেকে একটা পত্রবের করে তাজউদ্দীনের হাতে দিয়ে বললো, এই খতখানা মুহসীন বিশ্বাসকে দেবেন। ঘাট থেকে তাঁর কর্মচারী তাঁকে দিয়েছেন।
তাজউদ্দীন আগ্রহভরে বললো- জরুরী পয়গাম কিছু?
মোটেই না, মোটেই না। সেরেফ ঠাঁই ঠিকানা আর হাল হকিকত।
আর আছে?
আপাতত নেই।
যে যা দিলো তাই নিয়ে বাজীকর প্রস্থানোদ্যোগ করতেই তাজউদ্দীন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তা দেখে বাজীকরটি হাসি মুখে বললো-কিছু বলবেন?

তাজউদ্দীন বললো- আপনার বোটা বড় সুন্দর। যা বলেছেন ঐ টুকই কি সব?
হাসতে হাসতে বাজীকরটি বললো তা মানে-
আরো কিছু থাকলে সেটাও শুনতে ইচ্ছে করছে। কতদিন এসব কিছুই শুনিনা ।
আমি যেটুকু শিখেছি তা বলেছি। আরো বেশী শিখবো যখন, আপনি পয়সা জোগাড় রাখবেন, আমি নিজ গরজে আপনার বাড়িতে গিয়ে শুনিয়ে দিয়ে আসবো-
হাসতে হাসতে কটাক্ষ করে আপন পথে পা বাড়ালো বাজীকর। তাজউদ্দীনের মতো একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের এই শিশু সুলভ কান্ড দেখে আশে পাশের অনেকেই হো হো করে হেসে উঠলো।
বিষ্ণুপাল আর রজব আলী দুই জনেই তা লক্ষ্য করলো। রজব আলী বিষ্ণুপালকে বললো- ওকে চেনো দাদা?
বিষ্ণুপাল বললো-নাতো! তবে এইপথে হামেশাই যাতায়াত করতে দেখি।
বাঁশবাড়ির বিশ্বাস বাড়িতে থাকে। একেবারেই নালায়েক লোকটা।
তাতো দেখতেই পাচ্ছি। এ বয়সেও যে বাজীকরের বোল শুনার বায়না ধরে, তার হুঁশবুদ্ধি বলে থাকতে পারে কিছু?
তবে শুনি, লোকটা নাকি খুবই সাদাসিধে।
হবেই তো। বোকারা খানিকটা সাদাসিধেই হয়।
মোজাক করার ইরাদায় রজব আলী তাজউদ্দীনকে লক্ষ্য করে বললো- আরে এই মিয়া, বাড়ি কৈ?
জবাবে তাজউদ্দীন বললো- বাঁশবাড়ি।
আরে ওটাতো হালের বাড়ি। এর আগে কোথায় ছিল?
আগে ছিল পান্ডুয়ায়। তার আগে কাজল দিঘির ঐদিকে। বাপরে এত বাড়ি তোমার ?
জি।
বাপ-মা, ভাই-বেরাদার-এ দুনিয়ায় আছে কেউ ? জি না। বিশ্বাস বাড়িতে এখন আম্মা আছেন একজন!
হো হো করে হেসে উঠলো রজব আলী। বললো- ভাল ভাল।
বিষ্ণুপালও হাসতে হাসতে বললো- তা দুনিয়ায় এত বাড়ি থাকতে ঐ নওমুসলিমের বাড়িতে গিয়ে মা পাতালেন কেন বাপু? যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে জানের ভয়ে ওরা আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে এলে এ মা’টাও তো হারাবে।
তাজউদ্দীন অবাক হয়ে বিষ্ণুপালের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর সে বললো-তা ফিরে আসা যায়?
বিষ্ণুপাল বললো- সমাজপতিরা পাঁতি দিলেই যায়। আর মোটা দক্ষিণা পেলে বামুন- পুরুতেরা পাঁতি দিতে পারেনা- এমন কোন সমস্যা এ দুনিয়ায় আছে?
তা পারে পারুক। পাঁতি দিলেই সব মানুষ ইসলাম ত্যাগ করেনা।
মানে ?
আল্লাহ্ রসুলের প্রতি মহরত যার দিলে একবার পয়দা হয়, কোন কিছুর ভয়ে বা বিনিময়ে সে ইসলাম ত্যাগ করেনা।
কোন ভয়েই না?
জান গেলেও না।
বেলা তখন শেষ। তাজউদ্দীন দ্রুত পদে ঘাটের দিকে রওনা হলো। বিষ্ণুপাল অবাক হয়ে রজব আলীর মুখের দিকে তাকালো। রজব আলী বিস্মিত কন্ঠে বললো-তাজ্জব! পাগল হলেও তো এ জ্ঞান দেখি তার টনটনে !

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

বিদ্রোহী জাতক

দর্শক

দুই :

মযলুমের ভিড়ে হযরত নূর কুতুব-ই-আলমের খানকা শরীফে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। খানকা শরীফের ভেতর বাহির সর্বত্রই মযলুমের আহাজারী। তফাৎ-নযদীক, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর-তামাম অঞ্চল থেকেই নিত্য নয়া পয়গাম আসছে জুলুমের। সুফী হযরত নূর কুতুব-ই-আলম সাহেব একজন যইফ আদমী। অনেক তাঁর বয়স। তুলার মতো সফেদ তাঁর চুলদাড়ি ও চোখের ভ্রু। খানকা শরীফের বারান্দায় আসনের ওপর স্থির হয়ে বসে আছেন সুফী সাহেব। তসবিহ তেলাওয়াত করছেন আর একিন দিলে স্মরণ করছেন আল্লাহ পাককে মযলুমদের আহাজারীতে মাঝে মাঝে চোখ মেলে চাইছেন এবং অশান্ত মযলুমদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন-ইন্নাল্লাহা মায়াস্ সোয়াবেরীন। সবুর করো। আল্লাহ পাকের ওপর আস্থা রেখে ধৈর্য্য ধরো। মুসিবত চিরকাল থাকে না। মুসিবতে ধৈর্য হারানো ইমানদারীর বরখেলাপ। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক ধৈর্য শীলদের পক্ষে থাকেন।
অনেকের ভিড় ঠেলে সুফী সাহেবের আওলাদ শায়খ আনোয়ার সাহেব ওয়ালিদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে ফরিয়াদির আর্তি। সূফী সাহেব কিছুক্ষণ পর চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকালেন। তাঁর মুখাকৃতি অবলোকনেই তিনি অনুমান করতে পারলেন- আর এক নাখোশ পয়গাম তাঁর সামনে হাজির। নিজেকে সংযত করে তিনি ধীর কন্ঠে বললেন-বলো কি বলতে এসেছো?
শায়খ আনোয়ার সাহেবের নজর জমিনের ওপর নিবদ্ধ হলো। তিনি কম্পিত কণ্ঠে বললেন, শায়খ মুইনদ্দীন আব্বাস সাহেবের আওলাদদের রাজা গণেশের ফৌজ কয়েদ করে নিয়ে গেছে। সুফী সাহেব কিয়ৎকাল নীরব হয়ে রইলেন। পরে আবার চোখ তুলে প্রশ্ন করলেন-
আওলাদদের মানে ?
মানে, শায়খ বদরুল ইসলাম বাদে সবাইকে।
সুফী সাহেব পুনরায় নীরব হলেন। শায়খ আনোয়ার সাহেব বললেন-বরদাস্ত করার ওয়াক্ত বোধ হয় পার হয়ে গেছে। এখন আব্বা হুজুরের নির্দেশ কি?
জিজ্ঞাসু নেত্রে শায়খ আনোয়ার সাহেব পিতার দিকে চেয়ে রইলেন। জওয়াবে অনেকক্ষণ পর সুফী সাহেব ফের বললেন-ইন্নাল্লাহা মায়াস্ সোয়াবেরীন।
শায়খ আনোয়ার এরপরও বললেন- শায়খ বদরুল ইসলাম সাহেব ভাইদের জন্যে রাজা গণেশের কাছে দরবার করতে গেছেন। তাঁরও হয়তো বিপদ ঘটতে পারে।
সুফী সাহেব ভারী গলায় বললেন- তুফানের সময় কোন আদমীরই নিরাপত্তা থাকে না। আল্লাহ পাক যার নসীবে যতখানি দুর্ভোগ লিখে রেখেছেন, তা ঘটবেই।
সুফী সাহেবকে পুনরায় নীরব হতে দেখে আনোয়ার সাহেব খানিকটা জিদ ধরে বললেন- আমরা এর প্রতিকার করতে চাই।
না।
সুফী সাহেব আবার চোখ তুলে বললেন- কি প্রতিকার করবে?
যে শক্তি হাতে আছে আমাদের, তাই নিয়ে আমরা রাজা গণেশের ওপর হামলা চালাতে চাই।
সামনা সামনি?
হ্যাঁ, সামনা সামনি। প্রকাশ্যে তার ওপর আমরা হামলা চালাতে চাই। আর চুপ থাকা যায় না
তাতে আরো প্রাণহানিই ঘটবে শুধু৷ সীমিত শক্তি নিয়ে একটা প্রতিষ্ঠিত হুকুমাতের বিরুদ্ধে বেশী সুবিধে করতে পারবেনা।
কিন্তু
তৌহিদ বেগ চৌকশ রণবিদ। তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখো, এই প্রকাশ্য লড়াইয়ে নামতে সেও রাজী হবে না কিছুতেই।
আব্বা হুজুর!
সে জন্যে ঢের বেশী সামর্থের প্রয়োজন।
তাহলে কি আমাদের কিছুই করার নেই?
আছে। যে সব জায়গায় নিরীহ লোকদের ওপর অতর্কিতে হামলা হচ্ছে, সংবাদ যোগাড় করে নিয়ে সেসব জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলো এবং যথা সম্ভব তাদের হেফাজত করো।
সুফী সাহেব চোখ বুজে তসবিহ তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করলেন। শায়খ আনোয়ার সাহেব বুঝলেন তাঁর বুজুর্গান ওয়ালেদ আর বাক্যালাপে আগ্রহী নন। তাঁর যা বলার তা শেষ করেছেন তিনি। অগত্যা আনোয়ার সাহেব আস্তে আস্তে সরে এলেন।
খানিক পরেই তাজউদ্দীন সামনে এসে দাঁড়ালো। সুফী সাহেবকে জেরেত দেখে সে বারান্দার নীচে একটু দূরে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। কতজন কত কথা বলতে এসে সুফী সাহেবকে ধ্যান মগ্ন দেখে সবাই আবার ফিরে গেলো একে একে। কিন্তু তাজউদ্দীন ঐ একইভাবে দাঁড়িয়েই রইলো ওখানে। তা দেখে কেউ কেউ তাকে নিরুৎসাহ করলো। কেউ কেউ আবার ঠাট্টা করে টিকা টিপপনী কাটলো। দরবেশের এক অনুচর এসে তাজউদ্দীনকে কিছুটা ঠেলতে ঠেলতেই বললো হুজুরের ইবাদতে আপনারা এভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন কেন? সকাল থেকে উনি একটানা কথা বলতেই আছেন। এখন যান, উনাকে একটু নিরিবিলিতে থাকতে দিন। আবার যখন চোখ খুলবেন, তখন এসে কথা বলবেন। এখানে উনাকে ডাকাডাকি করবেন না।
তাজউদ্দীন মৃদু কণ্ঠে বললো- না- না। তা আমি করবোনা। অনেক দূর থেকে এসেছি। অন্যত্র যাবো আর কোথায়, এখানেই থাকি। উনি নিজে যখন কথা বলার মওকা দেবেন তখন কথা বলবো।
অনুচরটি বললো-নাছোড় বান্দারে বাবা! তো থাকেন। দ্যাখেন, কখন মওকা পান।

খানিকটা নাখোশদিলেই অনুচরটি চলে গেল। কিন্তু সুফী সাহেব তাকে মওকা দিলেন তখনই। ইবাদতের ফাঁকে তিনি চোখ মেলতেই তাঁর চোখ পড়লো তাজউদ্দীনের ওপর। তিনি তসবিহ রেখে তৎক্ষণাৎ হাত নেড়ে তাজউদ্দীনকে আরো খানিক কাছে ডেকে বললেন- তোমার নাম তো হলো-
তাজিমের সাথে সুফী সাহেবকে সালাম করে তাজউদ্দীন তাঁর কথার খেই ধরে বললেন- তাজউদ্দীন।
সুফী সাহেব খেই পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বললেন- হ্যাঁ-হ্যাঁ, তাজউদ্দীন-তাজউদ্দীন! তা হামলা হোয়েছে তোমার ওখানে?
জবাবে তাজউদ্দীন বললো–জি হাঁ। কিন্তু আপনি-
আমি অনুমান করতে পারছি। কিন্তু তুমি সেজন্যে-
জি না। আমি শুধু পয়গামটা পৌঁছে দিতে এসেছি। গ্রামবাসীরা সবাই চায়,
পাকের নজরে থাক ।
ভাল ওদের হটিয়ে দিতে খুবই কি বেগ পেতে হয়েছে?
জি না। মুসল্লীরা সংখ্যায় অনেক ছিলেন।
বহুত খুব। সবাইকে সজাগ থেকে চলা-ফেরা করতে বলবে।
জি আচ্ছা।
এটা হজুর
সবাইকে বলবে-মুসিবতের সময় অসহায় ইনসানের পাশে দাঁড়ানো সওয়াবের কাজ। হুজুর !
ইত্তেফাকের কুণ্ডত ছাড়া তুফানের সময় জুদা হয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়-এ জ্ঞানটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দাও।
তাতো হলো হুজুর, কিন্তু
বলো-
বুজুগান ব্যক্তিদের ওপরই যে এখন হুমকির আলামত বেশী দেখতে পাচ্ছি।
শায়খ মুইনুদ্দীন আব্বাস সাহেবের আওলাদদের কথা বলছো ?
জি। শায়খ বদরুল ইসলাম সাহেবও শুনছি ভাইদের তালাশে গেছেন।
হু!
এ ছাড়া আরো অনেক ওলামায়ে কেরামের ওপরও হামেশাই হামলা হচ্ছে। হুজুর কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা এই খানকা শরীফে রাখেননি। ভাবছি কখন যে এসব হামলার জের এই খানকা শরীফ পৌঁছে-
হাত তুলে সুফী সাহেব তাজউদ্দীনকে থামিয়ে দিলেন। বললেন- আমাদের কথা ছেড়ে দাও। আমাদের নিয়ে যা খুশী ঐ আলেমুল গায়েব করবেন। ও নিয়ে তোমরা কোন সোচ্ করতে যাবেনা। এখন তোমাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হলো গ্রামগঞ্জের অসহায় মমদের হেফাজত করা।
হুজুর!
রাজার ফৌজের গতিবিধির খবর সংগ্রহ করার কাজও এখন জোরদার করা দরকার। কখন কোন অঞ্চলে যায়! অবশ্য তোমাকে এসব বলা-
হুজুর যা বিবেচনা করেন!
আর কিছু বলবে তুমি?
জি না। আমার আশ্রয়দাতা মুহসিন বিশ্বাস সাহেবের নির্দেশ তো আর ফেলতে পারিনে আমি। তাই ঐ পয়গামটা পেশ করতেই এসেছিলাম।
ভাল-কোন তকলীফই তকলীফ নয় তোমার কাছে। এই তো চাই।
স্মিতহাসি হেসে আবার চোখ বুজলেন সুফী সাহেব। তসবিহ তেলাওয়াতের মধ্যে আস্তে আস্তে আবার তিনি তলিয়ে গেলেন। বেলার দিকে তাকিয়ে তাজউদ্দীন ত্রস্তপদে পথে নেমে এলো।
সুফী সাহেবের খানকা থেকে বাঁশবাড়ির পথ খানিকটা আঁকা-বাঁকা। খানকা থেকে বেরিয়ে নানা ডালে বাগ হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে এপথটা বাঁশবাড়িতে এসেছে। সুলতান দীঘির পাশ দিয়ে যে বড় রাস্তা বরাবর রাজধানীতে চলে গেছে, সেই রাস্তার পেট কেটে চলে এসেছে পথটা। বড় রাস্তা পেরিয়ে খানিক পথ এগুলেই এক নদী। নদী থেকে বাঁশবাড়ি আধাক্রোশের অল্প একটু বেশী পথ। পারাপারের খেয়াঘাটটা এপার-ওপার যোগ করেছে এই পথকে। ঘাটের ওপরই বন্দর মাফিক ছোট্ট একটা জায়গা। জায়গাটার নাম পাকুড়তলা। কোন বটপাকুড়ের গাছ এখানে নেই। কোন এক সুদূর অতীতে তা হয়তো ছিল। আর হয় তো সেই সুবাদেই নাম হয়েছে পাকুড়তলা। দু’চার জন ব্যবসায়ী, দু’পাঁচজন দোকানদার, কয়েকজন খদ্দের, কিছু পথচারী আর আশপড়শী ছাড়া, হররোজ খুব বেশী জন মানবের পদচিহ্ন পাকুড়তলায় পড়েনা। মাঝে মধ্যে ব্যবসায়ীদের নাও ভিড়ে এই ঘাটে। বছরে বার কয়েক বেদের বহর নোঙ্গর ফেলে এখানে। কোন কোনদিন হালদারদের মাছ ধরার তৎপরতা বৃদ্ধি পায় ঘাটের পাশে৷ তখন পাকুড়তলা অনেক খানি চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
ঘাটের ওপরই মুখোমুখী দুইজনের দুই দোকান। একটা দোকান বিষ্ণুপালের, অপরটা রজব আলীর। পাতিল গড়ানো ত্যাগ করে দোকান খুলেছে বিষ্ণুপাল। বেণেতি দোকান বিষ্ণুপালের হরেক কিসিমের বেণেতি মাল পালের দোকানে পাওয়া যায়। রজব আলী কাপড় বিক্রি করে। লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি, চাদর ইত্যাদি।
ছোট ছোট চালার নীচেও দোকান বসে কয়েকটা। খন্ড কালীন দোকান। পান, তামাক, সুপারী আর আলাপাতা এসব দোকানে পাওয়া যায়। তরিতরকারি নিয়েও হেথা হোথা দু’ একজন বসে। শাঁখা-চুড়ি- আলতা-সিঁদুর নিয়ে অনেক সময় ফেরিওয়ালারাও এসে ঘাটের ওপর দোকান খোলে।
রজব আলীর ঘরের পাশেই মহাজনদের এক আড়তঘর। ঘাট দিয়ে মালচলাচল কালে এই আড়তঘরে কয়েকদিন অপেক্ষা করে মালগুলো। এঘরেও কয়েকজন লোক বসবাস করে। বিষ্ণুপালের দোকানের পাশেই কয়েক ঘর কলুর বাস। ক্যাঁকড় ক্যাঁকড় ঘানি ঘোরে সারারাত।
সেদিন শেষ প্রহরে ভিড় ছিলনা ক্রেতাদের। ভিড় ছিলনা অন্য কোন লোকেরও। বসে বসে হাই তুলে গান ধরলো বিষ্ণুপাল। বিষ্ণুপাল রসিক মানুষ। কণ্ঠও বেশ সুরেলা। পূজা-পাৰ্বন বারোয়ারীতে একাই সে মাতিয়ে রাখে আসর। গুণ গুণ করে গাইতে গাইতে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো বিষ্ণুপাল-এত খবর করি হরি, তবু খবর মেলেনা। ও ডোলা মনরে-
তা শুনে রজব আলী হাসতে হাসতে বললো-কি হলো দাদা? কিসের খবর করছো এত? গান থামিয়ে বিষ্ণুপাল বললো- এ্যাঁ! আমায় কিছু বললে?
বৌদি কি বাপের বাড়ি থেকে আসেনি?
বাপের বাড়ি! বাপের বাড়ি গেলই বা কখন, আর আসবেই বা কেন?
তাহলে এতো খবর করছো কার ? অন্য কাউকে মনে ধরেছে বুঝি?
হো হো করে হেসে উঠলো বিষ্ণুপাল। বললো- আরে মিয়াভাই, তা ধরলেই কি আর উপায় আছে? দরোয়াজা বন্ধ !
মানে?
মানে বিশমুণে পাথরের মতো ঘাড়ে যেটা চেপে আছে সেকি আর অন্য কাউকে ঢুকতে দেবে ঘরে?
দেবেনা ?
না ।
বিলকুল না?
জান গেলেও না। আর শুধু ঢুকতে দেয়া? এমন খোশ পয়গাম তার কানে গেলেও গর্দান থাকবে আমার? মটকে দেবেনা মট্ মট্ করে?
বলো কি দাদা। এয়সা মাফিক বৌদি আমাদের?
তো আর বলছি কি? পেনি পেনি। একদম শ্যাওড়া গাছের পেতনি। তার ইয়াৰ্ব্বড়ো ভাঁটার মতো চোখ দুটো হরদম আমার পেছনে বন বন করে ঘুরছে। পান থেকে চূন খসতে দেখলেই ব্যস। জিন্দেগী খতম!
বলো কি!
উঃ! কি কুলক্ষণেই যে ঘরে তুলেছি তাকে!
রজব আলী কৌতুক করে বললো-কি দাদা, কথাটাকি দেবো একবার বৌদির কানে? কপট ভয়ের ভাব করে বিষ্ণুপাল জোড় হাতে বললো- দোহাই ভাই সাহেব, মাথায় দু’ঘা লাঠি মারো, ওভি আচ্ছা। কিন্তু দয়া করে এ দুশমনিটা করোনা।
এবার রজব আলীও আওয়াজ দিয়ে হেসে উঠলো। বললো- তা যা-ই বলো দাদা, আমাদের সত্যি কিন্তু বড় ভাগ্যবতী। খোদ ভগবান তার ভাগ্যটা নিজ হাতে গড়েছেন।
কেন কেন ?
বৌদি
এমন বউ ভীতু বর কয়টা মেয়ের নসীবে জোটে?
বউ ভীতু!
একদম ভেড়া মার্কা। বউ এর ভয়ে এমন ভ্যা-ভ্যা করা বর, সাত জনম তপস্যা করেও কোন মেয়ে পায়না।
বটে! ঠাট্টা হচ্ছে?
না দাদা, ঠাট্টা করবো কেন? যা সত্যি, তাই বলছি। আমি আবার বরাবরই সত্য বলতে খুব ভালবাসি কিনা?
বিষ্ণুপাল তেতে উঠলো। বললো-ওরে আমার সত্যপীরের পোলারে! নিজে যে কেমন বীর বাহাদুর, তা বুঝি আর জানিনে?
কি রকম ?
কাপুরুষ-কাপুরুষ। একদম প্রথম শ্রেণীর কাপুরুষ।
কে.
আমি?
জি, হাঁ। সমীর খাঁর ঐ বিধবা মেয়েটাকে নিকাহ করার জাররা পরিমান খাহেশ প্ৰকাশ করায় ঠ্যালাটা কি খেয়েছো। তা ভুলে গেছো এত শিগগির? ঘরে ঢুকতে না পেরে একখান নয়, দুইখান নয়, সাত সাত খান রাত যে বৈঠকখানায় ল্যাজ গুটিয়ে কাটালে, সে খবর কি জানেনা কেউ?
রজব আলী কাবু হয়ে বললো-তা-মানে-
কি, মানেটা কি?
মানে আমি কাপুরুষ নই যে, সত্যিটাকে সত্যি বলতে ভয় পাবো।
তার মানে, ঘরে ঢুকতে পারোনি।
হাঁ, তা পারিনি।
কেন ঢুকতে পারোনি?
দুয়ার খুলে দেয়নি যে।
দরজা ভেংগে ঢুকবে !
ওরে বাপরে! তাহলে আর রক্ষে ছিল দাদা? যে দজ্জালের দজ্জাল! বাড়িটাই ছাড়তে হতো তাহলে।
কেন, খুব নাকি বীর বাহাদুর? বউকে মোটেই ডরাওনা?
ডরাই না আমি ঠিকই দাদা। তবে ঐ দ্বিতীয় পক্ষের খাহেশটা দিলের ভেতর উকি দিলেই দিলটা কেমন একটু
কমজোর হয়ে যায়।
ঠিক তাই।
বুকের মধ্যে ধড়াশ ধড়াশ আওয়াজ হয়?
তাই হয়৷
বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গেলেই ঠ্যাংটা একটু কাঁপে ?
হো হো করে হেসে উঠলো রজব আলী। বললো-তুমি শালা একদম সবজান্তা দাদা! বিলকুল ধরে ফেলেছো।
বাঁশের তৈরী মাচার ওপর বসে ছিল বিষ্ণুপাল। সেই মাচাতে সজোরে এক চাঁটি মেরে বিষ্ণুপাল বললো-সাৰ্ব্বাস্! তাহলে আর খামোকা ফোড়ন কাটছো কেন বাপধন ?
রজব আলী হাসি মুখে আমতা আমতা করে বললো-না, মানে ঐ একটা কথার কথা
দাদা।
বিষ্ণুপাল বললো- আরে ভাইসাব! সব বানরের মুখ ঐ একই রকম পোড়া। একমাত্র পাষন্ডরা ছাড়া, বিশ্বের তামাম বীর পুরুষেরাই বাইরে বীর, ঘরে ভেড়া।
দাদা!
অতএব খিস্তিপনা ছাড়ো, আখেরাতে মন দাও-
বলেই বিষ্ণুপাল ফের সশব্দে গেয়ে উঠলো ও ভোলা মনরে-
গান ধরেই অকস্মাত থেমে গেল বিষ্ণুপাল। তা লক্ষ্য করে রজব আলী বললো-কি হলো দাদা! থামলে যে?
বিষ্ণুপাল ইশারা করে নীচু গলায় বললো- ঐ দেখো –
রজব আলী গলা বাড়িয়ে দিয়ে দেখলো, এক হাতে একটা বাটি আর অন্য হাতে আধময়লা একটা গামছা নিয়ে ভোলা ভট্টচার্জ বিষ্ণুপালের দোকানের দিকেই আসছে। দেখামাত্র বিষ্ণুপালের মতো রজব আলীও গম্ভীর হয়ে গেল।
ভোলা ভট্‌চাজ সরাসরি বিষ্ণুপালের দোকানে এসে ঢুকলেন। হাতে ধরা গামছা খানা মাচার ওপর বিছিয়ে দিয়ে বললেন- শ্ৰীমান বিষ্ণুপাদ, এই বস্ত্রখন্ডে আধা পয়সার লবশ, আধা পয়সার ডাউল আর এই কাংসপাত্রে দুই পয়সার ঘৃত প্রদান কর দেখি। লবলটা কদলী পত্রে উৎকৃষ্ট করে বেঁধে দাও। লবনের সাথে ডাউলের মিশ্রণ যাতে না ঘটে, সে দিকে সবিশেষ দৃষ্টি রাখবে
বত্স।
বিষ্ণুপাল নির্জীবের মতো যেমন চুপ করে বসে ছিল, তেমনি চুপচাপ বসে রইলো। তা দেখে ভট্‌চাজ মশাই বিস্মিত হয়ে বললেন-কি বৎস, আমার বাক্যগুলি শুনতে পেয়েছো কি? বিষ্ণুপাল জড়িত জন্ঠে বললো- তাতো পেয়েছি ঠাকুর, কিন্তু
কিন্তু কি?
আর তো বাকি দিতে পারবোনা!
ভট্‌চাজ্‌ মশাই চোখজোড়া কপালে তুলে বললেন-মানে!
মানে, অনেক পয়সা বাকি পড়েছে। হররোজ শুধু নিয়েই যাচ্ছেন। একদিনও একটা পয়সা দেননি। বাকি বকেয়া শোধ না করলে, এমন করে বাকি খাওয়ানোর তাকদ আমার নেই। ভট্‌চাজ্‌ মশাই দুইকানে আঙ্গুল দিয়ে বললেন রাম-রাম। হররোজ, বাকি বকেয়া, তাকদ- এসব কিহে? এক প্রকার স্লেচ্ছ শব্দ আমার সামনে উচ্চারণ করে আমাকে পাতকী করতে চাও ?
তা যা-ই বলেন ঠাকুর। পয়সা দেবেন, সওদা নেবেন। বিনি পয়সায় আর কিছুই দেয়া
সম্ভব নয়!
ভট্‌ট্চাজ্ মশায়ের দুইচোখে অগ্নুৎপাত শুরু হলো। তিনি সগর্জনে বললেন-তবেরে দুর্জন! নরক, নরক! রৌরব নরকে পচে মরতে হবে তোকে। আমরা হলেম নমস্য ব্যক্তি। নমস্যদের মনোতুষ্টির জন্যে অর্ঘ প্রদান অনন্ত পূণ্যের কাজ। আর তুই পাপাত্মা তা না করে নমস্যদের কাছেই পাওনা দাবী করিস্ ? নমস্যদেরই ঋণী করতে চাস্? নরকের ভয় কি অন্তরে তোর কিছুমাত্র নেই?
এর জবাবে বিষ্ণুপাল বুকে সাহস বেঁধে বললো- আমি তো দোকান খুলেছি ঠাকুর! অর্থ দিতেও বসিনি, দানপত্রও খুলিনি। মাল বেচে পয়সা না পেলে আমার দোকান চলবে কি করে?
ভট্চাজ মশাই রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন- বটে। এত সাহস বৃদ্ধি পেয়েছে তোদের? দেবতুল্য মনুষ্যের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধাকে তোরা এইভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছিস্ ? তিষ্ঠ! এই অনন্ত পাপের প্রতিফল অচিরেই ভোগ করতে হবে।
অতঃপর একটা তামার পয়সা ঝণাৎ করে বিষ্ণুপালের বাটখারার ওপর ফেলে দিয়ে বললেন—এই নে তোর মূল্য। অবশিষ্ট যা পাবি, অচিরেই পরিশোধ করে দেবো। এবার দ্রব্যগুলো প্রদান কর।
বিষ্ণুপাল আর করে কি! বামুন- পুরুতের অভিশাপের ভয়ে এ যাবত যা চেয়েছে, মুখ মুজে দিয়ে গেছে। একটা কথাও বলেনি। আজ একদিনে আর কত কথা বলবে? অগত্যা সে নতশিরে মাল মাপতে লাগলো।
বুধু হালদার নদী থেকে একঝুড়ি মাছ এনে এই অবেলায় ঘাটের ওপর বসলো। বসেই সে হাঁকতে লাগলো-মাছ-মাছ, টাটকা মাছ!
সবেমাত্র মাছ এনেছে বুধু হালদার। এক পয়সাও বিক্রি হয়নি। এমন সময় ভোলা ভট্‌চাজ্‌ সামনে এসে বললেন–এই বুধে ঐ বড় বড় পাদাগুলো দাও দিকি এই বস্ত্ৰখন্ডে ?
বুধু হালদার ইতস্তত করে বললো- পয়সা দিবেন তো গো ঠাকুর? এখনও আমার বউনি- বাটা হয়নি। বিনি পয়সায় দিতে পারবোনা কিন্তু !
জ্বলে উঠলেন ভট্‌চাজ মশাই। গোস্বাভরে বললেন-বাকি! আমাদের কাছে মাছ দিয়ে অদ্যাবধি পয়সা চায় কোন জেলে, যে পয়সার কথা বলিস্ ? আমাদের মনোতুষ্টির মূল্যই তো অমন শ’ টাকার সমান !
তা -মানে-
অনন্ত নরক থেকে মুক্তি পাওয়ার মানসে কত জেলে বাড়িতে আমার মাছ এনে সাধাসাধি করে, আর তুই নরাধম, নরকের কীট পয়সার কথা বলিস্ ? এখনও বাড় তোদের কমেনি ? বাড় দেখছেন ক্যানেগো ঠাকুর? বাড়ের কথা হলোডা কি? মাছ লেবেন পয়সা দেবেন। এখানে বাড়ের কথা কি হলো?
চোখ দুটো চড়কগাছ করে ঠাকুর মশাই বললেন-কিমাশ্চর্য্যম্! ওরে ব্যাটা অকাল কুষাণ্ড, অস্পৃশ্য, ছোটজাত, যার পায়ের ধুলোর আশায় তোর চৌদ্দ পুরুষ মাথা কুটেছে অহর্নিশ, তাঁর মুখের ওপর এমন ঠাশ ঠাশ্ করে কথা বলিস্ এত সাহস তোর। ভেবেছিস্ এখনও সেদিন তোদের আছে?
বুধু হালদার ক্ষোভের সাথে বললো- আমাদের আবার দিন অদিন কি গো? কামাই হলে খাই, না হলে না খেয়ে থাকি। আমাদের আবার দিন অদিন কি?
গোস্বার আধিক্যে ভোলা ভট্‌চাজ ধূতির কোঁচা ঝাড়তে লাগলেন। বললেন-এখন এদেশের রাজা কে জানিস্ ব্যাটা গোমূর্খ? ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণ, নৈকষ্য কুলীন ব্রাহ্মণ! ইচ্ছে হলেই যে হুটুশ করে জাত খোয়ায়ে মুসলমান হবি, ওটি আর হচ্ছেনা!
মানে?
সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়ে গিয়ে শূলে দেবে। এমনিইতেই যেগুলো যবন এদেশে আছে ওগুলো সাফ করতেই রাজা আমাদের পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ছেন, তার ওপর তোরা আবার নূতন করে যবন হবি? হ! হয়ে দেখনা একবার ঠ্যালাটা!
বুধু হালদার বিরক্ত হয়ে বললো-দাম দেবেন, মাছ লেবেন। এই বেচাকেনার মধ্যে এত কথা শুনাচ্ছেন ক্যানে গো ঠাকুর ?
শুনাচ্ছি এইজন্যে যে, পায়ের তলার জীব তোরা, আমাদের পায়ের তলাতেই থাকবি তো প্রাণে বেঁচে থাকবি। আমাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এখন মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করলে ঐ প্রাণটাও আর থাকবে না।
না থাকে, না থাকবে। বেঁচে থেকে আপনাদের এই জুলুম সহ্য করার চেয়ে মরে যাওয়াও আমাদের জন্যে মঙ্গল। আপনি এখন যান। ঘরে আমার চা’ল নেই। আপনার ঐ বকবকানী শুনলে পেট ভরবে না আমার
মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে বুধু হালদার পুনরায় হাঁকতে লাগলো-মাছ-মাছ, এই যে টাকা মাছ—
দেখে নেবো। ব্যাটাদের কত বাড় বেড়েছে তা একবার দেখে নেবো
গোস্বায় ফুলতে ফুলতে ভোলা ভট্‌চাজ ট্যাং ট্যাং করে চলে গেলেন।
ভোলা ভট্‌চাজ্‌ বিদেয় হওয়ার পর বিষ্ণুপাল রজব আলীকে লক্ষ্য করে বললো-দেখলে ভাই সাহেব, দেখলে ব্যাটা বিকেলে বামুনটার তেজ? এর পর আর কার মেজাজ ঠিক থাকে বলো ?
রজব আলী ভারি গলায় জবাব দিলো, কি আর দেখবো দাদা! যে মুসিবতের মধ্যে এখন আমরা পড়ে আছি, তাতে আর আমাদের বলার কিছু আছে?
মুসিবত!
মুসিবত নয়? ঐ ভট্টচার্জ মশাই কি বললে, শুনলেনা ?
বিষ্ণুপাল নীরব হলো। নিমেষ কয়েক নীরব থেকে সেও অপেক্ষাকৃত গম্ভীর কন্ঠে বললো- সে কথা যদি বলো মিয়াভাই, তাহলে মুসিবত আমাদেরই কি কম? যে দুর্দিনে পড়লাম আমরা আবার ?
রজব আলী তাজ্জব হলো। সেকি দাদা? তোমাদের আবার দুর্দিন কি? দেশের রাজা এখন হিন্দু, এখন তো তোমাদের সুদিন দাদা!
বিষ্ণুপাল আক্ষেপ করে বললো- আরে মিয়াভাই, ঐ যে কথায় বলে, বেল পাকলে কাকের কি? ব্যাপারটা হলো ঐ রকম। সুদিন হলে, সুদিন হলো ঐ ভোলা ভট্চাজের মতো মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চজাতের হিন্দুদের। শুধু হিন্দুটাই তুমি শুনলে? শুনলেনা দেশের রাজা এখন একজন বামুন? আমরাতো জাতে খাটো। আমরা যারা অসংখ্য নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু এদেশে আছি, দুঃখ বাড়লো বইতো কমলো না!
তার অর্থ?
তাদের
অর্থ, মুসলমান সুলতানদের আমলে যেটুকু আরাম আমরা পেয়েছিলাম, সে আরামটাতো হারাম হয়ে গেল আবার।
বলো কি দাদা?
বিষ্ণুপাল ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বললো- এইবুঝে না বোঝার ভাণ করলেই মেজাজটা বড্ড খারাপ হয় রজব ভাই। আরে, মুসলমান সুলতানেরা তো কেউ জোর করে মুসলমান করতে আসেনি আমাদের। কিংবা হিন্দুদের হত্যা করে দেশটাকে নির্জলা মুসলমান দেশ বানানোর জন্যেও উঠে পড়ে লাগেনি তারা। আমাদের অসুবিধাটা ছিল কোথায়? বরং আমরা ইসলাম গ্রহণ করতে পারি ভয়ে উঁচুজাতের হিন্দুরাও খামুশ হয়ে ছিল। আগের মতো অতটা জুলুম করার সাহস পায়নি তারা। আর এখন? এখন অবস্থাটা কি দাঁড়াচ্ছে? ভোলা ভট্‌চা যা বললে তার একদিকটাই দেখলে, আর এক দিকটা দেখলেনা?
রজব আলী থতমত খেয়ে বললে- তা মানে-
এখন তো ওরা ওদের পুরানো ঝাল সমানে ওসুল করতে থাকবে। ঐ আগের মতোই আবার ওদের পায়ের তলে পিষে মরতে হবে আমাদের। ভোলা ভট্টচাজের আচরণ থেকেও কি আঁচ করতে পারোনা কিছু?
রজব আলীর কাছে ব্যাপারটা এতক্ষণে পরিষ্কার হলো। বললো- হ্যাঁ দাদা, কথাটা তোমার অবশ্যি ভেবে দেখার মতো।
বিষ্ণুপাল বললো-আমাদের সুখ শান্তি বলে কি আর থাকতে পারবে কিছু? ওদের সুখ শান্তির যোগান দিতেই তো জান আমাদের ফানা হয়ে যাবে।
ওদের কথপোকথনের মাঝখানে পায়রা হাতে এক বাজীকর এসে হাজির হলো সেখানে। এসেই সে আওয়াজ দিয়ে বোল্ ধরলো এই যে,
খেলার খেলা পায়রা খেলা,
দ্যানেওয়ালা দ্যাখ্ এবেলা,
খেলছে খেলা ভুলুর চেলা।
(আর) ঢংএর বাজী রং এর মেলা
দেখলে খেলা যায় না ফেলা
চোখের পাতা, রয়না বেলা
করলে হেলা পস্তায়,
দেখাই খেলা সস্তায় –
মুখের কথা শেষ করে সে সজোরে ডুগডুগিতে আওয়াজ দিলো। ডুগডুগির বাজনা শোনার সংগে সংগে ছেলে ছোকরাদের সাথে কিছু আগন্তুক ও ইতস্তত বিচরণকারী লোকজন সবাই এসে ঘিরে ধরলো বাজীকরকে। শুরু হলো খেলা। বাজীকর তার পায়রাটাকে ছেড়ে দিয়ে বোল তুললো ডুগডুগিতে। পায়রাটি উড়ে উঠে সেই ঢোলের তালে তালে উলটে উলটে বাজী করতে লাগলো। উপস্থিত জনতা তন্ময় হয়ে খেলা দেখতে লাগলো।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর শেষ হলো খেলা। বাজীকরের পায়রা আবার বাজীকরের হাতে এসে বসলো। জনতার ভিড়টাও সেই সাথে ফিকে হয়ে গেল।
খেলাটা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সুফী সাহেবের খানকা থেকে তাজউদ্দীন এখানে এসে পৌঁছেছিল। জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে সেও আগ্রহভরে এই খেলা দেখছিলো। ভিড়টা ফিকে হয়ে যেতেই আগন্তুকদের একজন এসে তাজউদ্দীনের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। সে তার কামিযের জেব থেকে একটা পত্রবের করে তাজউদ্দীনের হাতে দিয়ে বললো, এই খতখানা মুহসীন বিশ্বাসকে দেবেন। ঘাট থেকে তাঁর কর্মচারী তাঁকে দিয়েছেন।
তাজউদ্দীন আগ্রহভরে বললো- জরুরী পয়গাম কিছু?
মোটেই না, মোটেই না। সেরেফ ঠাঁই ঠিকানা আর হাল হকিকত।
আর আছে?
আপাতত নেই।
যে যা দিলো তাই নিয়ে বাজীকর প্রস্থানোদ্যোগ করতেই তাজউদ্দীন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তা দেখে বাজীকরটি হাসি মুখে বললো-কিছু বলবেন?

তাজউদ্দীন বললো- আপনার বোটা বড় সুন্দর। যা বলেছেন ঐ টুকই কি সব?
হাসতে হাসতে বাজীকরটি বললো তা মানে-
আরো কিছু থাকলে সেটাও শুনতে ইচ্ছে করছে। কতদিন এসব কিছুই শুনিনা ।
আমি যেটুকু শিখেছি তা বলেছি। আরো বেশী শিখবো যখন, আপনি পয়সা জোগাড় রাখবেন, আমি নিজ গরজে আপনার বাড়িতে গিয়ে শুনিয়ে দিয়ে আসবো-
হাসতে হাসতে কটাক্ষ করে আপন পথে পা বাড়ালো বাজীকর। তাজউদ্দীনের মতো একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের এই শিশু সুলভ কান্ড দেখে আশে পাশের অনেকেই হো হো করে হেসে উঠলো।
বিষ্ণুপাল আর রজব আলী দুই জনেই তা লক্ষ্য করলো। রজব আলী বিষ্ণুপালকে বললো- ওকে চেনো দাদা?
বিষ্ণুপাল বললো-নাতো! তবে এইপথে হামেশাই যাতায়াত করতে দেখি।
বাঁশবাড়ির বিশ্বাস বাড়িতে থাকে। একেবারেই নালায়েক লোকটা।
তাতো দেখতেই পাচ্ছি। এ বয়সেও যে বাজীকরের বোল শুনার বায়না ধরে, তার হুঁশবুদ্ধি বলে থাকতে পারে কিছু?
তবে শুনি, লোকটা নাকি খুবই সাদাসিধে।
হবেই তো। বোকারা খানিকটা সাদাসিধেই হয়।
মোজাক করার ইরাদায় রজব আলী তাজউদ্দীনকে লক্ষ্য করে বললো- আরে এই মিয়া, বাড়ি কৈ?
জবাবে তাজউদ্দীন বললো- বাঁশবাড়ি।
আরে ওটাতো হালের বাড়ি। এর আগে কোথায় ছিল?
আগে ছিল পান্ডুয়ায়। তার আগে কাজল দিঘির ঐদিকে। বাপরে এত বাড়ি তোমার ?
জি।
বাপ-মা, ভাই-বেরাদার-এ দুনিয়ায় আছে কেউ ? জি না। বিশ্বাস বাড়িতে এখন আম্মা আছেন একজন!
হো হো করে হেসে উঠলো রজব আলী। বললো- ভাল ভাল।
বিষ্ণুপালও হাসতে হাসতে বললো- তা দুনিয়ায় এত বাড়ি থাকতে ঐ নওমুসলিমের বাড়িতে গিয়ে মা পাতালেন কেন বাপু? যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে জানের ভয়ে ওরা আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে এলে এ মা’টাও তো হারাবে।
তাজউদ্দীন অবাক হয়ে বিষ্ণুপালের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর সে বললো-তা ফিরে আসা যায়?
বিষ্ণুপাল বললো- সমাজপতিরা পাঁতি দিলেই যায়। আর মোটা দক্ষিণা পেলে বামুন- পুরুতেরা পাঁতি দিতে পারেনা- এমন কোন সমস্যা এ দুনিয়ায় আছে?
তা পারে পারুক। পাঁতি দিলেই সব মানুষ ইসলাম ত্যাগ করেনা।
মানে ?
আল্লাহ্ রসুলের প্রতি মহরত যার দিলে একবার পয়দা হয়, কোন কিছুর ভয়ে বা বিনিময়ে সে ইসলাম ত্যাগ করেনা।
কোন ভয়েই না?
জান গেলেও না।
বেলা তখন শেষ। তাজউদ্দীন দ্রুত পদে ঘাটের দিকে রওনা হলো। বিষ্ণুপাল অবাক হয়ে রজব আলীর মুখের দিকে তাকালো। রজব আলী বিস্মিত কন্ঠে বললো-তাজ্জব! পাগল হলেও তো এ জ্ঞান দেখি তার টনটনে !

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত