বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবিতা যেন এক বজ্রনিনাদ—যা শুধু একটি কবিতার সীমায় আবদ্ধ নয়, হয়ে উঠেছে এক কাব্যিক আন্দোলন, এক দ্যুতিময় চেতনার উৎস, এক বিপ্লবের আহ্বান। মাত্র বাইশ বছর বয়সে কাজী নজরুল ইসলাম যে কবিতা রচনা করেছিলেন ১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে (অক্টোবর ১৯২২)—তা পরে হয়ে ওঠে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা-এর মণিমুক্তার মতো কেন্দ্রবিন্দু। সেই গ্রন্থেই বিদ্রোহীর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল : প্রলয়োল্লাস, ধূমকেতু, কামাল পাশা, আনোয়ার, রণভেরী, শাত-ইল-আরব প্রভৃতি ঝলমলে কবিতা।
‘অগ্নি-বীণা’র প্রচ্ছদচিত্র আঁকেন তরুণ চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন, পরিকল্পনায় ছিলেন শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর এই গ্রন্থটি উৎসর্গিত হয়েছিল বিপ্লবের এক জীবন্ত পুরুষ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে—যাঁকে নজরুল অভিহিত করেছিলেন “বাঙলার অগ্নিযুগের আদি পুরোহিত”। গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবির স্বাক্ষর: “তোমার অগ্নি-পূজারী -হে- মহিমাম্বিত শিষ্য – কাজী নজরুল ইসলাম”—এ এক ঐতিহাসিক অভিসন্ধি, যেখানে কবিতা শুধু শিল্প নয়, অস্ত্র; শুধু বাণী নয়, বারুদের আলো।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে এক অন্তর্জাগতিক সংলাপ—যেখানে শুরুতে ভেসে আসে একজন বক্তার কণ্ঠস্বর, আর তার বিপরীতে এক অব্যক্ত শ্রোতা। মনে হয়, কোনো পুরোহিত যেন কাউকে কিছু বলছেন, কোনো শিষ্যকে দীক্ষা দিচ্ছেন বিদ্রোহের ভাষায়। কিন্তু কবিতার প্রবাহ যত এগোয়, এই বিভাজন তত মুছে যায়। শেষ পর্যন্ত বোঝা যায়—এই কণ্ঠ, এই আহ্বান, এই দাবিদাওয়ার ভাষা কারো উদ্দেশ্যে নয়, স্বয়ং কবির আত্মঘোষণা। কবিতার ‘আমি’ আর কোনো চরিত্র নয়, তিনি নিজেই—নজরুল। এই শক্তিশালী আত্মপ্রকাশ এমন গভীর ছাপ ফেলেছে যে, একটি কবিতার শিরোনাম হয়ে উঠেছে কবিরই উপাধি। নজরুল চিরকাল হয়ে যান ‘বিদ্রোহী কবি’। বিশ্বসাহিত্যে এমন ঘটনা বিরল।
এই কবিতার গভীরে রয়েছে প্রেম এবং দ্রোহের অদ্বৈত বন্ধন। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’ – এই চরণে দ্রোহ ও প্রেম যেন পাশাপাশি বেজে ওঠে দুই সুরে।
নজরুল তাঁর বিদ্রোহের ভাষায় শুধু সামন্তবাদ, ঔপনিবেশিকতা বা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলেননি; তিনি পুরাণ ও ইতিহাসের পুরাতন ছায়াগুলোকে টেনে এনেছেন নতুন আলোয়। ভারতীয় পুরাণের নটরাজ শিব থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়ার বীরগাথা, এমনকি গ্রিক পুরাণও তাঁর কবিতায় এসেছে বিদ্রোহের রূপক হিসেবে। শিবের সৃষ্টিশীল ধ্বংস, চেঙ্গিসের নিষ্ঠুরতা, রণরসায়ন, প্রলয়—all woven into a poetic fabric of resistance.
তাঁর ঐতিহ্যভাবনা ছিল যুগোপযোগী ও জীবনঘনিষ্ঠ। নজরুল পুরাণকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি, বরং পুরাণের রূপকথা ও ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন সমকালীন সমাজের বিনির্মাণে।
সমসাময়িক গবেষক মোহিত কামাল তাঁর আলোচিত গ্রন্থ বিদ্রোহী কবিতার মনস্তত্ত্ব-এ এই কবিতার মনোজগতিক গভীরতা উন্মোচনে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছেন। তাঁর মতে, কবিতার ‘আমি’, ‘মম’, ‘আমিত্ব’ শব্দগুলোর মাধ্যমে নজরুল কেবল নিজেকে প্রকাশ করেননি, বরং নিপীড়িত মানুষের সত্তার গভীরে লুকিয়ে থাকা মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে স্পন্দন দিয়েছেন। এই কবিতা যেন আত্মবিশ্বাস, কল্পনাশক্তি ও প্রেষণার এক বিরাট ‘মোটিভেশনাল ফোর্স’—যা পাঠকের মনের গভীরে আলোড়ন তোলে।
মোহিত কামাল মনে করান, দ্রোহ এবং প্রেম উভয়ই মানুষের আবেগের অঙ্গ, আর এই আবেগই কবিতাকে করে তোলে মনস্তত্ত্বের বিস্ফোরণ। নজরুল তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা, যাপিত বাস্তবতা এবং কল্পনাশক্তিকে একত্রিত করে সৃষ্টি করেছেন এই আত্মঘোষণামূলক মহাকাব্যিক উত্থান।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল যে ত্রিমাত্রিক বিদ্রোহের কথা বলেন, তা হলো—
- অসত্য, অকল্যাণ ও অশান্তির বিরুদ্ধে আত্মবিদ্রোহ
- ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা
- আত্মসত্তার শৃঙ্খল মোচনের জন্য গভীর আত্মদৃষ্টি ও অভ্যন্তরীণ বিপ্লব
এই বিদ্রোহ ধ্বংসের জন্য নয়—বরং ধ্বংসের ভেতর দিয়ে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনাকে সন্ধান করার জন্য। এ এক সৃজনশীল বিদ্রোহ।
‘বিদ্রোহী’ কেবল একটি কবিতা নয়—এ এক কবিসত্তার অভ্যুত্থান, এক জাতিসত্তার আর্তনাদ, এক মানবিক মুক্তির মহামন্ত্র। কাজী নজরুল ইসলাম এই কবিতায় শুধু বিদ্রোহের ঝড়ই তোলেননি, তিনি আমাদের অন্তরেও জাগিয়ে দিয়েছেন আত্মমর্যাদার দাবিদার এক সাহসী ‘আমি’-কে। যে ‘আমি’ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে সমস্ত নিপীড়িত মানবজাতির একতাবদ্ধ কণ্ঠস্বর। তাই ‘বিদ্রোহী’ যুগ পেরিয়ে আজও উচ্চারিত হয় আগ্নেয় বজ্রবাণীর মতো—“আমি চির-বিদ্রোহী বীর!”
অনলাইনে বইটি কিনুন