বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের যে পথচলা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হয়েছিল, সেখানে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ এক অনন্য ও বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। সময়ের হিসাব কষে দেখলে বলা যায়, প্রায় একশ ত্রিশ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই উপন্যাসের আবেদন ফুরোয়নি। বরং সময়ের প্রবাহে এটি একদিকে যেমন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি অন্যদিকে ধর্মীয় আবেগ, সাহিত্যিক নান্দনিকতা ও লোকজ সংস্কৃতির আঙ্গিকে নিজেকে বহুস্তরীয় রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
‘বিষাদ সিন্ধু’র কাহিনির মূলে রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মন্তুদ ঘটনা—কারবালার ট্র্যাজেডি। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হাসান ও হোসেনের শাহাদতের পেছনের ঘটনাপ্রবাহ, তাঁদের সঙ্গে ইয়াজিদের দ্বন্দ্ব, এবং কারবালার রক্তক্ষয়ী অধ্যায় এই উপন্যাসের কাহিনির কাঠামো গড়ে তোলে। তবে এটিকে নিছক ঐতিহাসিক বিবরণ বলা চলে না—এর গদ্য শৈলী, আবেগঘন ভাষা এবং করুণ রসের প্রয়োগ একে রূপান্তরিত করেছে এক ধরনের গদ্য মহাকাব্যে।
এই উপন্যাসটি মোট তিনটি খণ্ডে বিভক্ত—মহররম পর্ব (১৮৮৫), এজিদবধ পর্ব (১৮৮৭), ও উদ্ধার পর্ব (১৮৯১)। তৎকালীন সাধুভাষায় রচিত এই গ্রন্থে কাব্যিকতা ও গদ্যের এক অভিনব মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ ও বর্ণনায় এমন একটি আবেগপ্রবণতা রয়েছে, যা পাঠকের মনে এক গভীর বিষাদের আবেশ ছড়িয়ে দেয়।
উল্লেখযোগ্য যে, ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচনাশৈলীতে মধ্যযুগীয় পুঁথি সাহিত্যের প্রভাব স্পষ্ট। অলৌকিকতা, দৈবশক্তি ও ভাবাবেগের প্রবল উপস্থিতি একে কিছুটা পৌরাণিক রূপও দিয়েছে। কিন্তু মীর মশাররফ হোসেন সেই অলৌকিক উপাদানকেও এতো নান্দনিকভাবে ব্যবহার করেছেন যে তা কাহিনির ভারসাম্য নষ্ট করেনি।
‘বিষাদ সিন্ধু’র অন্যতম হৃদয়স্পর্শী দিক হলো জয়নাব চরিত্রের উপস্থিতি। ইসলামের ইতিহাসে নায়িকা হিসেবে তাঁর গুরুত্ব যেভাবে রচিত হয়নি, মশাররফ হোসেনের কল্পনায় তিনি হয়ে উঠেছেন এক ট্র্যাজিক নায়িকা। প্রথম স্বামীর পরিত্যক্তা হয়ে পরিণীত হন ইমাম হাসানের সাথে; তারপরে ভাগ্য তাকে টেনে নেয় এজিদের বন্দীশালায়। এই নারী চরিত্রকে ঘিরেই যেন উপন্যাসের কেন্দ্রে এক মানবিক ও আবেগময় প্রশ্ন জেগে থাকে—ভাগ্য, ধর্ম, এবং প্রেমের সংঘাতে কোনটা মানুষের নিয়তি গড়ে দেয়?
জয়নাবকে কেন্দ্র করে সংঘটিত পুরুষদের দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ এবং আত্মত্যাগ এই উপন্যাসে নারীর এক অনুল্লেখিত অথচ প্রভাবশালী ভূমিকার দ্যোতক। অনেক পাঠকের কাছে জয়নাব চরিত্র ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র সীতার মতো করুণ ও মহিমান্বিত মনে হয়।
‘বিষাদ সিন্ধু’র জনপ্রিয়তা শুধু পাঠ্যবই বা প্রাতিষ্ঠানিক পাঠেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাংলার জারিগান, বয়াতি-সংস্কৃতি, এবং গ্রামীণ লোকনাট্যের ধারায় এই উপন্যাসটি আত্মীকৃত হয়েছে অসাধারণভাবে। গবেষণা বলছে, নেত্রকোণা অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন গ্রামে বয়াতিরা এই কাহিনি নিজেদের ভাষা, ছন্দ ও গীতিতে রূপান্তর করে পরিবেশন করেছেন।
জারিগানের আসরে প্রথমে প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক উপাদান হিসেবে, পরে ধাপে ধাপে গীতিনাট্যে রূপান্তরিত হয়ে বিষাদ-সিন্ধু হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের রক্তে-মিশে-থাকা এক কাহিনিকথা। গ্রন্থের লেখা চরিত্র ও ঘটনা যখন গ্রামীণ আসরে ছন্দে, সুরে ও নৃত্যে ধ্বনিত হয়, তখনই বোঝা যায় সাহিত্য কিভাবে লোকজ ঐতিহ্যে নিজেকে বিস্তার করে।
‘বিষাদ সিন্ধু’কে একদিকে যেমন প্রশংসা করা হয় এর আবেগঘন উপস্থাপনা ও করুণ রসের জন্য, তেমনি সমালোচনার দিকও অবান্তর নয়। ইতিহাসবিদদের মতে, উপন্যাসে কিছু চরিত্র ও ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য নয়। অলৌকিকতা ও কল্পনার মিশ্রণ ঐতিহাসিক সত্যকে আচ্ছন্ন করেছে অনেক ক্ষেত্রে। তবুও সাহিত্যের নিরিখে এই গদ্য মহাকাব্য তার অবস্থান বজায় রেখেছে, কারণ পাঠকের মনে এটি সৃষ্টি করে গভীর সহানুভূতি, কষ্ট এবং অনুশোচনার রস।
‘বিষাদ সিন্ধু’ শুধু একটি উপন্যাস নয়—এটি একটি সামাজিক দলিল, একটি ধর্মীয় স্মৃতির ক্যানভাস, এবং এক মানবিক ট্র্যাজেডির মহাকাব্যিক রূপায়ণ। সময়ের বহু পরিবর্তনের মধ্যেও যে সাহিত্য তার আবেদন অক্ষুণ্ণ রাখে, তাকে নির্দ্বিধায় ‘কালজয়ী’ বলা চলে। মীর মশাররফ হোসেন তাঁর সময়, সমাজ ও সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে এমন এক রচনা আমাদের উপহার দিয়েছেন, যা পড়লে শুধু ইতিহাস নয়, এক চিরন্তন বিষাদের ভিতর দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠার বোধ জাগে।
পরিশিষ্টে প্রস্তাবনা*
এই রচনার পাঠ যারা করতে চান, তারা ‘বিষাদ সিন্ধু’কে ইতিহাস জানার মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং সাহিত্যের সৌন্দর্য, আবেগ ও মানবিক সত্তার অভিজ্ঞান হিসেবে পাঠ করুন। তাহলেই বোঝা যাবে, কেন আজও এই উপন্যাস পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিতে সক্ষম।