বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থা সম্ভবত আমাদের বুদ্ধিজীবীদের প্রকাশ্য মতামতের ভারসাম্যহীনতা। কে যে কখন কি বলবেন কখন কোন অবস্থাকে সমর্থন করে বিবৃতি ঝাড়বেন এর কোন স্থিরতা নেই। তারা প্রকাশ্যে নারী ধর্ষণ, ছিনতাই, নারী নির্যাতন ও অশ্লীলতাকে সমর্থন করেন না। এসব ঘটনার সাম্প্রতিক আধিক্যে পুলিশ প্রশাসনকে দোষারোপ করছেন। আবার এখানে সেখানে নাগরিক প্রেমকুঞ্জগুলোতে -যার গালভরা নাম হল বিনোদন কেন্দ্র-নর-নারীর অবাধ মেলামেশায় পুলিশের হস্তক্ষেপে দারুণ আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা মানতে চান না যে, সেখানে পুলিশের হস্তক্ষেপ সঠিক হয়েছে। কারণ সম্প্রতি কোনো এক লেকের পাড়ের ঘটনায় যারা ধরা পড়েছিলেন তারা ভদ্রবেশধারী। তারা পর-পুরুষের সাথে ঢলাঢলি করলেও তাদের সামাজিক সম্মানে সম্মানিত স্বামী বা অভিভাবক আছে। কেউবা অবিবাহিত তরুণী আবার কেউ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এমতাবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের ঘাবড়াবারই কথা। কারণই বিবৃতি ঝেড়ে বলা হচ্ছে যে পুলিশ ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের অবাধ মেলামেশার যে কেন্দ্রকে আমরা বিনোদন ক্ষেত্র বলি সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। পুলিশ প্রবেশ করবে শুধু দরিদ্র শ্রেণীর নর-নারীর অবৈধ দুষ্কর্মের মধ্যে। পুলিশ কেন ভদ্রলোকদের রুচিশীল নর্মলীলায় নাক গলাবে?
আমরা বুদ্ধিজীবীদের এসব মতামতের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করতে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে পুলিশ প্রশাসনকে দ্বিধাহীনচিত্তে সমর্তন জানাতে এই নিবন্ধের সূচনা করছি। আমরা লেকের পাড়ের ঘটনার মত ঘটনায় পুলিশের হস্তক্ষেপকে সমাজ-রাষ্ট্র ও ধর্মের স্বার্থে একান্ত জরুরী বলে মনে করি। সমাজে সম্প্রতিকালে অশ্লীলতার যে তরঙ্গ উঠেছে তা রোধ করতে পুলিশ প্রশাসনকে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্র সশস্ত্রভাবে পদচারণা করার সুযোগ দিতে হবে। গ্রেফতার, আটক ও প্রকাশের অধিকার দিতে হবে। একজন সমাজবিরোধী পুরুষ বা নারী যেমন অবৈধ মেলা-মেশার জন্য পুলিশ প্রশাসন- সংবাদপত্র ও সমাজের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যায়, তেমনি একজন ভদ্রঘরের বধূ যদি তার অধিকার বহির্ভূত পরপুরুষের সাথে ভদ্রলোকদের রুচিশীল বিনোদন কেন্দ্রে বা নগরের বিতানসমূহে অথবা যে কোনো লেকের পাড়ে গভীর রাতে নিভৃতচর্চা করে তবে ধর্মীয় দৃষ্টিতে তা অনধিকার চর্চার শামিল বলে গণ্য করতে হবে। এবং এ ধরনের মেলামেশার প্রতি পুলিশ চক্ষু মুদে বসে থাকতে পারে না ।
পুলিশ প্রশাসনকে সমাজে শ্রেণী বৈপরীত্যের দরুন দু’রকম আচরণ করতে যারা উৎসাহ যোগায় তারা পশ্চিমা পচা ও ঘুণেধরা সমাজ সভ্যতার দালাল। এরা নারী স্বাধীনতার কথা মুখে বললেও নারীকে ভোগ্যপণ্যের চেয়ে বেশী কিছু মনে করেন না । তারা চান নগরে কয়েকটি প্রেমকুঞ্জ থাকবে, এখানে তরুণ-তরুণীরা অবাধে মেলামেশা প্রেমালাপ ও নিভৃতচর্চা করবে। এই নিভৃতচর্চা যদি সীমা ছাড়িয়েও যায় তবুও যেহেতু ঘটনাগুলো তথাকথিত রুচিশীল কেন্দ্রে ঘটেছে তাতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই ।
আমরা এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধিতা না করে পারি না। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম মুসলিম অধ্যুসিত অঞ্চল। এখানকার শ্লীল-অশ্লীলতার সীমা সরহদ সম্পূর্ণ আলাদা। পাশ্চাত্যের নারী স্বাধীনতার দৃষ্টিভঙ্গী ও মুসলিম সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে তা অস্বীকার করে আমাদের সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে দিতে পারি না। আমাদের দেশবাসীও তা চাইবেন না। দেশের তথাকথিত কয়েকজন মুষ্টিমেয় লোক তারা যে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিকেই তাদের জীবনাদর্শনের উপজীব্য করুন না কেন, যা সামাজিক সংঘর্ষের সূচনা করে তা পরিত্যাজ ।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের নর-নারীই বসবাস করেন না, হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান সম্প্রদায়ের নাগরিকগণও বসবাস করেন। তাদের সমাজে যদি অবাধ মেলামেশার সুযোগ থাকে তবে কোন যুক্তিতে তা প্রতিহত করা হবে ?
আমরা মনে করি যুক্তি হল জনসংখ্যার গুরুত্বের এবং দেশাচারের। দেশের পনর আনা যেখানে মুসলমান সেখানে ইসলামী বিধান ও শরিয়তের বিধিনিষেধকে অবজ্ঞা করে চলা বিজ্ঞতার পরিচয় নয়। আর একান্তই যদি সংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্য নর- নারীর অবাধ মেলামেশার জন্য বিনোদন কেন্দ্রের প্রয়োজন হয় তবে সেখানে সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিতে হবে যে, এই কেন্দ্রটি কেবল অমুসলিম যুবক যুবতীদের বিনোদন ক্ষেত্র। এ ধরনের ব্যবস্থা গৃহীত হলে পুলিশও সহসা প্রবেশ করে কাউকে গ্রেফতার কিংবা কাউকে আটক করবে না।
আর তা যদি না হয় । যদি মুসলমান সম্প্রদায়ের মত দেশের সকল নাগরিকগণের সামাজিক মূল্যবোধের চেতনা একই রকম ভালো-মন্দের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে হয় তবে অবাধ প্রেমের ক্ষেত্রগুলোতে পুলিশের হস্তক্ষেপের অহরহ প্রয়োজন। কারণ দেশে যেভাবে নারীর ওপর হামলা চলছে যেভাবে সামাজিক নির্ভরতা ভেঙে যাচ্ছে তাতে সরকারী প্রশাসনকে অযথা দোষী করে লাভ নেই ।
আমরা এক দিকে প্রগতিশীলতার নামে নারীকে সম্পূর্ণ উদোম করে ফেলে বিপরীত লিঙ্গের অধিকারীকে সংযত ও সভ্য থাকার উপদেশ খয়রাত করতে পারি না । যেসব পাশ্চাত্য দেশে শতাব্দীব্যাপী নারীরা স্বাধীন সেসব দেশেও দেখা গেছে মাত্র এক ঘন্টার জন্য নৈশকালীন বৈদ্যুতিক আলো বিপর্যস্ত হলে ঐ সমস্ত মহানগরী মুহূর্তের মধ্যে মহা অরণ্যে পর্যবসিত হয়। ব্যাপকভাবে নারীরা ধর্ষিত হয়। দোকানপাট লুণ্ঠিত হয়। এবং খুন জখম মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
আল্লাহর ভয়হীন মানব সমাজ যে শেষ পর্যন্ত পশুত্বের স্তরকে অতিক্রম করতে পারে না এর বহু প্রমাণ পাশ্চাত্যের সমাজ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার ও উপলব্ধি করে আজ এক স্তম্ভিত অবস্থায় উপনীত হয়েছেন। এ ব্যাপারে নতুন কোনো পরীক্ষার জন্যে বাংলাদেশের মত পশ্চাৎপদ মুসলিম দেশকে বেছে না নিলেও চলে। অশ্লীলতার গর্ভে অশ্লীলতাই জন্মলাভ করবে।
আমরা নর-নারীর স্বাভাবিক সম্পর্ককে অস্বীকার করি না। যুবক-যুবতীরা পরস্পরকে ভালো বাসবে না। এমন কথা কোনো ধর্ম বা নীতিশাস্ত্রই বলে না। তবে প্রকৃত প্রেমের স্বার্থেই এর একটা স্বাভাবিক সীমারেখা ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কারণ প্রেমের নামে যুগ যুগ ধরে নারীকে ভ্রষ্ট চরিত্রের লোকেরা যেভাবে প্রতারণা করেছে তাতে নারীত্বের মর্যাদা ধূলায় লুণ্ঠিত হয়েছে। কত নারী হারিয়ে ফেলেছে মানসিক ভারসাম্য। কত নরীকে আশ্রয় নিতে হয়েছে মানবেতর জীবন প্রণালীতে তার হিসেব কে রাখে?
আমরা এ দেশের মুসলিম জনগণ কোনো উন্মুক্ত প্রেমকেন্দ্রে বিশ্বাসী নই । প্রেমের কোনো প্রকাশ্য প্রদর্শন ক্ষেত্র থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি না। মূলত আমরা এদেশের যুবক-যুবতীদের অবাধ মেলামেশায় আস্থাশীল নই। পৃথিবীতে বর্তমানে ইসলামী পুনর্জাগরণের একটা প্রত্যক্ষ তরঙ্গ বইছে। এ তরঙ্গের স্পর্শ আমদের দেশের আবহাওয়াতেও প্রবেশ করছে। ইসলামের শত্রুরা তা বুঝতে পেরেই যুবক যুবতীদের বিপথে চালিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। চতুর্দিকে, নাটক সিনেমায় টেলিভিশনে নর নারীর বিকৃত সম্পর্কের জয়গানকে তাই আকাশ ছাপিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। এরই পরিনামে একটি ষোল বছরের ছেলেও তাই দেখা যায় নারী ধর্ষণের মত ভয়াবহ পাপে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করে না ।
ঢাকা একটি প্রাচীন মুসলিম শহর। এর সমৃদ্ধি ও সভ্যতার একটি অতীত ইতিহাস আছে । কলকাতার মতো বৃটিশ ও বেনেদের লোভ লালসা ও শোষণের ইট দিয়ে গড়া শহর নয় ঢাকা। এখানে অসংখ্য মসজিদের আজানাধ্বনির মধ্যে মানুষের ঘুম ভাঙে। আবার বিচিত্র কণ্ঠের অসংখ্য মোয়াজ্জিমের আজানধ্বনির মধ্যে রাত্রি নেমে আসে । এই শহরে নর-নারীর অবৈধ মেলামেশার কোনো আইনানুগ সুযোগ থাকা মুসলিম জনগণের কাম্য নয়।