বিস্কুট ফ্যাক্টারি
কাজলা,
রাজশাহী।
প্রিয় তামারা,
তোমার নামে চিঠি লিখতে গিয়ে প্রতিবারই মনে হয়, শব্দেরা যেন নিজ থেকেই প্রাণ ফিরে পায়, এক একটি কথা যেন আত্মা হয়ে ওঠে। অনেকদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি, কথা হয়নি, অথচ প্রতিদিনই মনে হয়, তুমি আমার চারপাশে রয়েছো—অদৃশ্য অথচ অপরিহার্য। তোমার স্মৃতির মাধুর্য, কথার সুরের নেশা, চিন্তার গভীরতার প্রতিফলন আমাকে এমন এক কল্পনার জগতে টেনে নিয়ে যায়, যেখানে আমরা একসঙ্গে রাতভর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতাম। আজ সেই মুহূর্তগুলো স্মৃতির সোনালি পাতায় আঁকা এক ধ্রুপদী চিত্রকর্ম।
জানো, কেমন আছি আমি? চারপাশের জীবন দেখে দেখে মনে হয়, হৃদয় যেন ক্রমাগত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। আমরা এক বিস্ময়কর অথচ বেদনাদায়ক সময়ে বাস করছি। একসময় সাহিত্য ছিল জীবনের কেন্দ্রস্থল—মানুষের আত্মাকে নির্মাণের, তাকে গভীরতর অর্থে পরিপূর্ণ করার এক অনন্য মাধ্যম। আজ সেই সাহিত্য যেন আধুনিকতার নির্লজ্জ প্রবাহে পরিত্যক্ত, বিস্মৃত। এখন মানুষ বইয়ের পাতার রূপালি জগতের বদলে চোখ রাখে ইলেকট্রনিক স্ক্রিনে। তারা সাহিত্যপাঠের স্থিরতা ও গভীরতার বদলে মেতে থাকে সামাজিক মাধ্যমের ক্ষণস্থায়ী মোহে। জীবনের গভীর অনুভূতির জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ত্বরিত, অথচ শূন্যতায় পূর্ণ একরকমের “বিনোদন।“ এই প্রেক্ষাপট আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।
মনে পড়ে, আমাদের দিনগুলো? আমাদের জীবনের একসময়ের অনন্য বিন্দু ছিল বই। মনে আছে, কত সন্ধ্যায় আমরা পাঠাগারের কোণে বসে নবীন বইয়ের মলাট খুলে তার গন্ধে মুগ্ধ হতাম? সেই দিনগুলো যেন স্বপ্নের মতো। আর এখন? পাঠাগারগুলো মৃতপ্রায়, বইয়ের পাতাগুলো যেন ধূলোমলিন স্মৃতি। মানুষ সাহিত্যকে প্রয়োজন বলে মনে করে না। অথচ তারা বুঝতে পারে না যে সাহিত্যই জীবনকে গভীরতম উপলব্ধিতে পৌঁছে দেয়।আমাদের এই সময়ে প্রযুক্তি যেন জীবনের সর্বগ্রাসী শক্তি হয়ে উঠেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমরা স্ক্রিনে বন্দি, সামাজিক মাধ্যমের অন্তহীন প্রবাহে ডুবে আছি। এই দ্রুতগতির বিনোদন মানুষের মন থেকে গভীর চিন্তা, গভীর অনুভূতির স্থানটুকু হরণ করেছে। সাহিত্যের যে অন্তর্দৃষ্টি, যা আত্মাকে জাগিয়ে তোলে, তা যেন হারিয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে, জানো, এর পরিণতি কী হতে পারে? মানুষের মন ক্রমেই এক অনন্ত শূন্যতায় ভরে উঠবে। প্রযুক্তি জীবনের বহিরঙ্গে সহজতা আনলেও হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। মানুষ একাকিত্বে নিমজ্জিত হচ্ছে, অথচ তারা তা বুঝতেও পারছে না। সাহিত্য সেই একাকিত্বের ওষুধ ছিল, যা মানুষের হৃদয়ে শান্তি এনে দিত। আজ সেই সাহিত্য থেকে দূরে সরে গিয়ে আমরা নিজেদের আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি।
তুমি কি জানো, এককালে সাহিত্যের হাত ধরেই সমাজ নির্মিত হয়েছিল? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, ছফা, শেলি, বায়রনের মতো স্রষ্টারা শুধু লেখক ছিলেন না; তারা ছিলেন দার্শনিক, দিশারি। তারা মানুষের হৃদয় আলোকিত করতেন, তাদের পথ দেখাতেন। আজ এই ভূমিকা পালন করবে কে? আমরা যারা কলম হাতে নিই, আমাদের কি দায়িত্ব নয় সাহিত্যের সেই হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে আনার? আমি প্রায়ই ভাবি, আমাদের লেখা কি মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে? যদি আমরা মানুষের জীবনের প্রতিটি বাস্তবতা, তাদের আনন্দ, দুঃখ, প্রেম, হতাশা—এই সবকিছুকে সাহিত্যে রূপ দিতে পারি, তবে হয়তো একদিন মানুষ আবার বইয়ের পাতায় ডুবে যাবে। সাহিত্যের কাছে ফিরে আসবে তাদের শূন্যতা পূরণ করতে।
তুমি কি এখনও গভীর রাতের তারাদের সঙ্গে কথা বলো? তোমার কলমের কালিতে কি এখনও মানুষের হৃদয় স্পর্শ করার ক্ষমতা আছে? আমি জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, তোমার চিন্তা, অনুভূতি, সৃষ্টিশীলতার শক্তি আমাদের সাহিত্য জগৎকে আলোকিত করে চলেছে। এই পথচলা সহজ নয়, জানি। কিন্তু আমরা জানি, আমাদের সৃষ্ট শব্দ চিরকাল বেঁচে থাকবে। হয়তো আমাদের নাম মানুষ ভুলে যাবে, কিন্তু আমাদের সৃষ্টি তাদের জীবনে গভীর ছাপ রেখে যাবে। সাহিত্যের এই চিরন্তন শক্তিই তো আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা।তুমি জানো, আমি প্রায়ই রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে তোমার কথা ভাবি। তোমার হাসি, তোমার চোখের গভীরতা, তোমার স্নিগ্ধ উপস্থিতি সবকিছুই যেন আমাকে নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে নিতে সাহায্য করে। জানি না, তুমি এই চিঠি পড়ে কী অনুভব করবে। তবু লিখলাম। কারণ আমি জানি, আমাদের হৃদয়ের সেই সংযোগ আজও অক্ষুণ্ণ, চিরন্তন।
তোমার একান্ত বন্ধু
তীব্র