proggapath, progga, bangla literature, bangla kobita, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, গোপন মৃত্যু ও নবজীবন, এস. এম. জাকির হুসাইন, gopon mirttu o nabojibon

গোপন মৃত্যু ও নবজীবন

০ মন্তব্য দর্শক

 এক : মৃত্যুর সাথে চুক্তি

গুরুজী মোরাকাবায় (ধ্যানে) ব’সে আছেন। তাই বুড্ডা অদূরে দাঁড়িয়ে রইল । অনেক্ষণ ধ’রে দাঁড়িয়ে আছে সে। পা দুটো লেগে গেছে। তাই সে কিছুক্ষণ পর ব’সে পড়ল । খানিক পর গুরুজী চোখ না খুলেই বললেন-‘ব’সে পড়।’
বুড্ডা চমকে উঠল। সে তো গুরুজীর অনুমতি না নিয়েই ব’সে পড়েছে। সুতরাং সে উঠে দাঁড়াল।
গুরুজী চোখ খুললেন ।
বুড্ডা ব’সে পড়ল ।
গুরুজী বললেন-‘আস সালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। গুরুজী আমি নতুন এসেছি। আপনার কাছে দীক্ষা নিতে চাই।’
‘আমি কি বলেছি যে তোমাকে আমি আগে দেখেছি?’
‘কিন্তু আমি আপনাকে আগে দেখেছি।’
‘কোথায়?’
‘স্বপ্নে।’
‘তুমি আবার স্বপ্নও দেখ নাকি?’
‘জ্বী, মাঝে মাঝে। কিংবা হয়তো সব সময়ে। তবে সব স্বপ্নের কথা মনে থাকে না।’
‘তার মানে তুমি সারা রাত খালি ঘুমাও? আমার কাছে তোমার দীক্ষা জুটবে না।’
একথা ব’লে গুরুজী উঠে ওপাশে সবজি-বাগানের মধ্যে ঢুকলেন গাছে পানি দেবার জন্য । বুড্ডা লজ্জায় ঠায় ব’সে রইল। সে ভাবল, এমন গুরুর কাছে ধরা দিতেই হবে। কিন্তু কিভাবে?
সে কিছুক্ষণ ব’সে থেকে উঠে এলো সবজি বাগানের কাছে। বেড়া ধ’রে দাড়িয়ে রইল। গুরুজী নিজ হাতে গাছে পানি দিচ্ছেন। সে ভাবল—গুরুজীর কাছ থেকে কাজটার দায়িত্ব তারই নেয়া উচিৎ। কিন্তু তার কাছ থেকে কি পাত্রটা কেড়ে নিতে হবে? কিভাবে আচরণ করলে তা ভদ্রতাপূর্ণ হবে? সে জ্ঞানের তৃষ্ণায় এতই বিভোর থাকে যে কিভাবে সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করতে হয় তা সে প্রায়ই ভুলে যায় । সে চিন্তা ক’রে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। খানিক ভেবে অবশেষে দৌড়ে গেল গুরুজীর কাছে—‘গুরুজী, কাজটা আমি করতে পারলে ধন্য হতাম।’
গুরুজী তার দিকে বাঁকা চোখে তাঁকিয়ে বললেন – ‘আমি না তোমাকে বসতে বলেছিলাম?’
বুড্ডা দিকজ্ঞানহীন হয়ে সেখানেই ব’সে পড়ল। গুরুজী গাছে পানি দিয়ে তার ছোট ঘরটাতে চ’লে গেলেন।
বুড্ডা বাগানে ব’সে রইল। খানিক পর সে দেখতে পেল এক অদ্ভুত ঘটনা। গুরুজীর পানি পেয়ে সবজি গাছের সাথে লাগানো কিছু ফুলগাছে তরতর ক’রে ফুল ফুটতে শুরু করল। সে অবাক হয়ে দেখতে লাগল এই অলৌকিক ঘটনা। দেখতে দেখতে গোটা বাগান ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল। সে প্লুতনেত্রে এই দৃশ্য দেখতে লাগল। এমন দৃশ্য সে এর আগে কখনও দেখেনি। তবে সে বিভিন্ন শুরুর কাছে কিছু কিছু অলৌকিক কাজও দেখেছে। কিন্তু কোনো অলৌকিক কাজ দেখে সে এত তৃপ্তি পায়নি। আজ সে এমন একটা অলৌকিক কাজ দেখল যার সাথে স্বয়ং আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের প্রেমের এবং কুদরতের ছোঁয়া জড়িত। সে নিজের অজান্তেই দাঁত খুলে হেসে ফেলল। কিন্তু তার জন্য আরো সুখের সংবাদ এল—‘বুড্ডা এদিকে এস।’
সে এক দৌড়ে গুরুজীর কাছে গিয়ে তার সামনে বসে পড়ল । ’
‘উঠে দাঁড়াও।’
সে উঠে দাঁড়াল ।
‘তুমি না গাছে পানি দিতে চেয়েছিলে?’
‘জ্বী, গুরুজী।’ সে অত্যন্ত আহলাদের সাথে দ্রুত জবাব দিল ।
‘যাও।’
সে এক দৌড়ে পাত্রটা নিয়ে বাগানে গেল। তার এত খুশি হওয়ার কারণ দুটো—এক : গুরুজী তাকে আদেশ করেছেন এবং দুই : তারও গুরুজীর মতো ফুল ফুটাতে ইচ্ছে করছিল।
সে প্রত্যেকটা গাছে বেশি বেশি ক’রে পানি দিতে লাগল আর গুন গুন ক’রে বলতে লাগল—‘হে আল্লাহ্! তুমি কত মহান! তোমাকে ধন্যবাদ। গুরুজী আমাকে গ্রহণ করেছেন । তুমি চাইলে আমি তোমার আরো নিকটবর্তী হব।’
সে বাগানে পানি দেয়া শেষ ক’রে সন্দেহপূর্ণ আগ্রহ নিয়ে একবার তাকাল গাছগুলির দিকে। কিন্তু না, একটি ফুলও বেশি ফুটল না বা উজ্জ্বলতর হলো না। সে আরো আগ্রহ নিয়ে তাকাল—যদি একটি ফুলও ফোটে। হঠাৎ ক’রে তার চোখের সামনেই সবগুলি ফুল দল ধ’রে ঝ’রে পড়ে গেল।
এই দৃশ্য দেখে সে নির্বাক, নিথর হয়ে গেল। তার হাত থেকে পানির পাত্রটি প’ড়ে গেল। তার বুক ভ’রে কান্না চ’লে এল। এখন সে গুরুজীকে গিয়ে কী বলবে? এসব জেনেশুনে কি গুরুজী তাকে আর দীক্ষা দেবেন?
এমন সময়ে গুরুজী আজান দিলেন। বুড্ডা এক দৌড়ে চ’লে গেল নামাজ পড়তে । নামাজ পড়তে গিয়েই সে নিশ্চিতভাবে জানতে পারল যে সেখানে গুরুজী একা থাকেন ।
নামাজ শেষে গুরুজী বুড্ডাকে বললেন, ‘এমনভাবে হাসা উচিৎ নয় যাতে অন্য কেউ তোমার দাঁত গুনতে পারে।’
বুড্ডার মনে পড়ল বাগানে ব’সে তার সেই হাসির কথা। সে লজ্জিত হলো।
গুরুজী প্রশ্ন করলেন—‘ফুল ফোটা দেখেছ কখনও?’
বুড্ডা চমকে উঠল। —‘জ্বী, গুরুজী। তখন হেসে উঠেছিলাম।’
‘ফুল ঝরে যাওয়া দেখনি?’
বুড্ডার মুখখানা অন্ধকার হয়ে গেল। সে মুখ নিচু ক’রে বলল— ‘জ্বী, তাও দেখেছি। কিন্তু ঘটনাটা ভুলে যেতে পারলে ভালো হতো।’
‘তাহলে তুমি ফুলের ফোটার ঘটনাটাও ভুলে যেতে। ঝ’রে যাওয়ার ভয়াবহতা না দেখলে ফুটে ওঠার গুরুত্বকে অনুধাবন করা যায় না। যাহোক, আগ্রহ থাকা ভালো, কিন্তু সন্দেহপূর্ণ আগ্রহ ভালো নয়। বরং তার চেয়ে আগ্রহপূর্ণ সন্দেহই ভালো। তাতে মনটা মুক্ত থাকে, জ্ঞানী হবার সম্ভাবনা থাকে।’
বুড্ডা কৃতজ্ঞতার সাথে আশা নিয়ে গুরুজীর দিকে তাকাল। গুরুজী বললেন—‘নিজেকে লজ্জা পাও?’
‘জ্বী, পাই।
‘কারণ তুমি পাপী।’
‘জ্বী। নিজের পাপের জন্য লজ্জা হয়।’
‘তোমার পাপের সাক্ষী কে?’
‘কমপক্ষে আমি নিজে।’
‘তোমার সব পাপের স্মৃতি ফুলগুলোর মতো ঝ’রে যাক। কেবল ফুটে উঠলেই কোনোকিছু ফুল হয়ে যায় না। পাপের দিনগুলোর দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে শেখ।’
‘আমীন।’
‘বেশি বেশি “ইয়া সাত্তারু” (হে দোষ-ত্রুটি গোপনকারী) আল্লাহর এই পবিত্র নামটা জপ করবে। আল্লাহ্ করুণা হলে তুমি সব ভুলে যাবে।’
‘গুরুজী, স্মৃতিতে একবার কোনো কিছু লেখা হয়ে গেলে তা কি মোছা যায়?’
‘কম্পিউটারে কোনো কিছু টাইপ ক’রে তা আবার মোছা যায় কিভাবে? কমান্ড দিয়ে । ঠিক তেমনি আল্লাহ্র আস-সাত্তারু নামটা এমন একটা শক্তিশালী কমান্ড যা তোমার ব্যক্তিগত স্মৃতিকে মুছে দেবে। স্মৃতি-বিস্মৃতি সব স্তরে আল্লাহর আদেশই কাজ করে।’

আল্লাহ্ মিথ্যাকে মুছে দেন এবং নিজ বাণী দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। (সূরা শূরা, ২৪ – ২9 )

 

অপরাধীরা (যেমন কাফেররা, মোনাফেকরা, এবং নফসের কুপ্রবৃত্তিরা) অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ্ তাঁর বাণী অনুযায়ী সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেন ।
(সূরা ইউনুস, ৮২)

তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার আগে মিথ্যাকে জাগিয়ে তোলেন এবং পরে মুছে দেন। নবুয়তির ঘটনাগুলো এভাবে ঘটে। আল্লাহ বলেছেন যে তিনি যখন যে জনগোষ্ঠীর কাছে নবী পাঠান তখন তাদের মধ্যস্থ ‘বিখ্যাত’ লোকদের কাছ থেকে বিরোধিতা উত্থিত করেন। সাধকের মনের মধ্যেও এরূপ ঘটনা ঘটে। তুমি সত্যের পূজারী। তোমার মধ্যে তিনি সত্যকে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন, আগে মিথ্যাকে না মুছে? প্রচুর তওবা পড়বে। যদিও তুমি তওবার আদব এবং শক্তি সম্বন্ধে কিছুই জান না। তওবা মানুষের মন, অর্থনৈতিক অবস্থা, শারিরীক অবস্থা, সমাজব্যবস্থা, এমনকি গোটা মহাবিশ্বকে বদলে দিতে পারে। তওবার মাধ্যমে মনটাকে প্রচন্ড পরিমাণে শক্তিশালী করা যায়, মহাবিপদ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ধ্যানের শক্তি এবং নবজীবন বইটা প’ড়ে নিয়ো। যাহোক, তোমার কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং মূল্যবান জিনিস কোনটা ?
‘বিশ্বাস। অর্থাৎ ইমান।’
‘অলৌকিকের চেয়েও?’
‘জ্বী। অনেক অলৌকিক কাজ দেখেছি। কিন্তু তার পরও বিশ্বাস ওঠা-নামা করেছে। আমি আল্লাহ্র কাছে কিছুই চাই না, কেবল বিশ্বাস চাই।’
‘তুমি আসল জায়গাটাকে চিহ্নিত ক’রে ফেলেছ। আল্লাহ্ তোমার আত্মার ব্যাধি সারিয়ে দিন।’
‘আমীন।’
‘তুমি এখানে কেন এসেছ?’
‘জ্ঞানের জন্য।’
‘কোত্থেকে এসেছ?’
‘অজ্ঞানপুর থেকে।’
‘আরেকটু দূর থেকে আসলে ভালো হতো। জ্ঞানার্জনের জন্য খুব বেশি দূরে যাওয়া দরকার। চট পরেছ কেন?’
‘গুরুজী, আমি গরীব নই, দাতা।’
‘আল্লাহ্ তোমার ওপর রহমত বর্ষণ করুন।’
‘আমাকে কবে স্বপ্নে দেখেছিলে?’
‘গতদিন দুপূরে।’
‘দিবাস্বপ্ন? তুমি দিনে ঘুমাও?’
‘গুরুজী, দুপুর বেলাটায় একটু ঘুমাই। রাতে ঘুমাই না। রসূলুল্লাহ (সঃ) দুপুরে বিশ্রাম করতেন। তিনি আমাদেরকেও তা করতে বলেছেন।’
‘হুঁম্ । তুমি যখন আমাকে স্বপ্নে দেখেছিলে তখন তুমি কোথায় ছিলে?’
‘অজ্ঞানপুরে।’
‘এত অল্প সময়ের মধ্যে সেখান থেকে এতদূর এলে কিভাবে?’
‘দৌড়ে।’
‘কারণ?’
‘জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনদেশে যাওয়ার নিয়ম। তাই ভাবলাম, পথ যখন অল্প, তখন দৌড়ে পরিশ্রম বেশি ক’রে গেলে নবীজী (সঃ) এর কথার মর্যাদা রক্ষা হবে।’
‘আল্লাহ্ তোমাকে জ্ঞান দান করুন।’
‘জ্ঞানের পথ কখনও ছোট হয় না। ফলে দৌড়াতে হলেও সেখানে ম্যারাথন দৌড় দরকার। আমীন।’
‘স্বপ্নে কী দেখেছিলে?’
‘দেখেছিলাম যে আপনি দুপূরে শুয়ে আমাকে স্বপ্নে দেখছেন।’
‘তার মানে তুমি আমার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলে?’
‘আমি স্বেচ্ছায় তা করিনি।’
‘আমি যে দুপুরে ঘুমাই তাও জেনে ফেলেছ?’
‘অনিচ্ছায়।’
‘তোমাকে আমার আসলেই দরকার।’
‘কেন গুরুজী? যে কারণে আমার আপনাকে দরকার সেই কারণে কি?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘আমি তোমাকে খুন করতে চাই।’
‘আমি জানতাম আপনি তা পারবেন।’

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

গোপন মৃত্যু ও নবজীবন

দর্শক

 এক : মৃত্যুর সাথে চুক্তি

গুরুজী মোরাকাবায় (ধ্যানে) ব’সে আছেন। তাই বুড্ডা অদূরে দাঁড়িয়ে রইল । অনেক্ষণ ধ’রে দাঁড়িয়ে আছে সে। পা দুটো লেগে গেছে। তাই সে কিছুক্ষণ পর ব’সে পড়ল । খানিক পর গুরুজী চোখ না খুলেই বললেন-‘ব’সে পড়।’
বুড্ডা চমকে উঠল। সে তো গুরুজীর অনুমতি না নিয়েই ব’সে পড়েছে। সুতরাং সে উঠে দাঁড়াল।
গুরুজী চোখ খুললেন ।
বুড্ডা ব’সে পড়ল ।
গুরুজী বললেন-‘আস সালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। গুরুজী আমি নতুন এসেছি। আপনার কাছে দীক্ষা নিতে চাই।’
‘আমি কি বলেছি যে তোমাকে আমি আগে দেখেছি?’
‘কিন্তু আমি আপনাকে আগে দেখেছি।’
‘কোথায়?’
‘স্বপ্নে।’
‘তুমি আবার স্বপ্নও দেখ নাকি?’
‘জ্বী, মাঝে মাঝে। কিংবা হয়তো সব সময়ে। তবে সব স্বপ্নের কথা মনে থাকে না।’
‘তার মানে তুমি সারা রাত খালি ঘুমাও? আমার কাছে তোমার দীক্ষা জুটবে না।’
একথা ব’লে গুরুজী উঠে ওপাশে সবজি-বাগানের মধ্যে ঢুকলেন গাছে পানি দেবার জন্য । বুড্ডা লজ্জায় ঠায় ব’সে রইল। সে ভাবল, এমন গুরুর কাছে ধরা দিতেই হবে। কিন্তু কিভাবে?
সে কিছুক্ষণ ব’সে থেকে উঠে এলো সবজি বাগানের কাছে। বেড়া ধ’রে দাড়িয়ে রইল। গুরুজী নিজ হাতে গাছে পানি দিচ্ছেন। সে ভাবল—গুরুজীর কাছ থেকে কাজটার দায়িত্ব তারই নেয়া উচিৎ। কিন্তু তার কাছ থেকে কি পাত্রটা কেড়ে নিতে হবে? কিভাবে আচরণ করলে তা ভদ্রতাপূর্ণ হবে? সে জ্ঞানের তৃষ্ণায় এতই বিভোর থাকে যে কিভাবে সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করতে হয় তা সে প্রায়ই ভুলে যায় । সে চিন্তা ক’রে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। খানিক ভেবে অবশেষে দৌড়ে গেল গুরুজীর কাছে—‘গুরুজী, কাজটা আমি করতে পারলে ধন্য হতাম।’
গুরুজী তার দিকে বাঁকা চোখে তাঁকিয়ে বললেন – ‘আমি না তোমাকে বসতে বলেছিলাম?’
বুড্ডা দিকজ্ঞানহীন হয়ে সেখানেই ব’সে পড়ল। গুরুজী গাছে পানি দিয়ে তার ছোট ঘরটাতে চ’লে গেলেন।
বুড্ডা বাগানে ব’সে রইল। খানিক পর সে দেখতে পেল এক অদ্ভুত ঘটনা। গুরুজীর পানি পেয়ে সবজি গাছের সাথে লাগানো কিছু ফুলগাছে তরতর ক’রে ফুল ফুটতে শুরু করল। সে অবাক হয়ে দেখতে লাগল এই অলৌকিক ঘটনা। দেখতে দেখতে গোটা বাগান ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল। সে প্লুতনেত্রে এই দৃশ্য দেখতে লাগল। এমন দৃশ্য সে এর আগে কখনও দেখেনি। তবে সে বিভিন্ন শুরুর কাছে কিছু কিছু অলৌকিক কাজও দেখেছে। কিন্তু কোনো অলৌকিক কাজ দেখে সে এত তৃপ্তি পায়নি। আজ সে এমন একটা অলৌকিক কাজ দেখল যার সাথে স্বয়ং আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের প্রেমের এবং কুদরতের ছোঁয়া জড়িত। সে নিজের অজান্তেই দাঁত খুলে হেসে ফেলল। কিন্তু তার জন্য আরো সুখের সংবাদ এল—‘বুড্ডা এদিকে এস।’
সে এক দৌড়ে গুরুজীর কাছে গিয়ে তার সামনে বসে পড়ল । ’
‘উঠে দাঁড়াও।’
সে উঠে দাঁড়াল ।
‘তুমি না গাছে পানি দিতে চেয়েছিলে?’
‘জ্বী, গুরুজী।’ সে অত্যন্ত আহলাদের সাথে দ্রুত জবাব দিল ।
‘যাও।’
সে এক দৌড়ে পাত্রটা নিয়ে বাগানে গেল। তার এত খুশি হওয়ার কারণ দুটো—এক : গুরুজী তাকে আদেশ করেছেন এবং দুই : তারও গুরুজীর মতো ফুল ফুটাতে ইচ্ছে করছিল।
সে প্রত্যেকটা গাছে বেশি বেশি ক’রে পানি দিতে লাগল আর গুন গুন ক’রে বলতে লাগল—‘হে আল্লাহ্! তুমি কত মহান! তোমাকে ধন্যবাদ। গুরুজী আমাকে গ্রহণ করেছেন । তুমি চাইলে আমি তোমার আরো নিকটবর্তী হব।’
সে বাগানে পানি দেয়া শেষ ক’রে সন্দেহপূর্ণ আগ্রহ নিয়ে একবার তাকাল গাছগুলির দিকে। কিন্তু না, একটি ফুলও বেশি ফুটল না বা উজ্জ্বলতর হলো না। সে আরো আগ্রহ নিয়ে তাকাল—যদি একটি ফুলও ফোটে। হঠাৎ ক’রে তার চোখের সামনেই সবগুলি ফুল দল ধ’রে ঝ’রে পড়ে গেল।
এই দৃশ্য দেখে সে নির্বাক, নিথর হয়ে গেল। তার হাত থেকে পানির পাত্রটি প’ড়ে গেল। তার বুক ভ’রে কান্না চ’লে এল। এখন সে গুরুজীকে গিয়ে কী বলবে? এসব জেনেশুনে কি গুরুজী তাকে আর দীক্ষা দেবেন?
এমন সময়ে গুরুজী আজান দিলেন। বুড্ডা এক দৌড়ে চ’লে গেল নামাজ পড়তে । নামাজ পড়তে গিয়েই সে নিশ্চিতভাবে জানতে পারল যে সেখানে গুরুজী একা থাকেন ।
নামাজ শেষে গুরুজী বুড্ডাকে বললেন, ‘এমনভাবে হাসা উচিৎ নয় যাতে অন্য কেউ তোমার দাঁত গুনতে পারে।’
বুড্ডার মনে পড়ল বাগানে ব’সে তার সেই হাসির কথা। সে লজ্জিত হলো।
গুরুজী প্রশ্ন করলেন—‘ফুল ফোটা দেখেছ কখনও?’
বুড্ডা চমকে উঠল। —‘জ্বী, গুরুজী। তখন হেসে উঠেছিলাম।’
‘ফুল ঝরে যাওয়া দেখনি?’
বুড্ডার মুখখানা অন্ধকার হয়ে গেল। সে মুখ নিচু ক’রে বলল— ‘জ্বী, তাও দেখেছি। কিন্তু ঘটনাটা ভুলে যেতে পারলে ভালো হতো।’
‘তাহলে তুমি ফুলের ফোটার ঘটনাটাও ভুলে যেতে। ঝ’রে যাওয়ার ভয়াবহতা না দেখলে ফুটে ওঠার গুরুত্বকে অনুধাবন করা যায় না। যাহোক, আগ্রহ থাকা ভালো, কিন্তু সন্দেহপূর্ণ আগ্রহ ভালো নয়। বরং তার চেয়ে আগ্রহপূর্ণ সন্দেহই ভালো। তাতে মনটা মুক্ত থাকে, জ্ঞানী হবার সম্ভাবনা থাকে।’
বুড্ডা কৃতজ্ঞতার সাথে আশা নিয়ে গুরুজীর দিকে তাকাল। গুরুজী বললেন—‘নিজেকে লজ্জা পাও?’
‘জ্বী, পাই।
‘কারণ তুমি পাপী।’
‘জ্বী। নিজের পাপের জন্য লজ্জা হয়।’
‘তোমার পাপের সাক্ষী কে?’
‘কমপক্ষে আমি নিজে।’
‘তোমার সব পাপের স্মৃতি ফুলগুলোর মতো ঝ’রে যাক। কেবল ফুটে উঠলেই কোনোকিছু ফুল হয়ে যায় না। পাপের দিনগুলোর দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে শেখ।’
‘আমীন।’
‘বেশি বেশি “ইয়া সাত্তারু” (হে দোষ-ত্রুটি গোপনকারী) আল্লাহর এই পবিত্র নামটা জপ করবে। আল্লাহ্ করুণা হলে তুমি সব ভুলে যাবে।’
‘গুরুজী, স্মৃতিতে একবার কোনো কিছু লেখা হয়ে গেলে তা কি মোছা যায়?’
‘কম্পিউটারে কোনো কিছু টাইপ ক’রে তা আবার মোছা যায় কিভাবে? কমান্ড দিয়ে । ঠিক তেমনি আল্লাহ্র আস-সাত্তারু নামটা এমন একটা শক্তিশালী কমান্ড যা তোমার ব্যক্তিগত স্মৃতিকে মুছে দেবে। স্মৃতি-বিস্মৃতি সব স্তরে আল্লাহর আদেশই কাজ করে।’

আল্লাহ্ মিথ্যাকে মুছে দেন এবং নিজ বাণী দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। (সূরা শূরা, ২৪ – ২9 )

 

অপরাধীরা (যেমন কাফেররা, মোনাফেকরা, এবং নফসের কুপ্রবৃত্তিরা) অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ্ তাঁর বাণী অনুযায়ী সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেন ।
(সূরা ইউনুস, ৮২)

তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার আগে মিথ্যাকে জাগিয়ে তোলেন এবং পরে মুছে দেন। নবুয়তির ঘটনাগুলো এভাবে ঘটে। আল্লাহ বলেছেন যে তিনি যখন যে জনগোষ্ঠীর কাছে নবী পাঠান তখন তাদের মধ্যস্থ ‘বিখ্যাত’ লোকদের কাছ থেকে বিরোধিতা উত্থিত করেন। সাধকের মনের মধ্যেও এরূপ ঘটনা ঘটে। তুমি সত্যের পূজারী। তোমার মধ্যে তিনি সত্যকে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন, আগে মিথ্যাকে না মুছে? প্রচুর তওবা পড়বে। যদিও তুমি তওবার আদব এবং শক্তি সম্বন্ধে কিছুই জান না। তওবা মানুষের মন, অর্থনৈতিক অবস্থা, শারিরীক অবস্থা, সমাজব্যবস্থা, এমনকি গোটা মহাবিশ্বকে বদলে দিতে পারে। তওবার মাধ্যমে মনটাকে প্রচন্ড পরিমাণে শক্তিশালী করা যায়, মহাবিপদ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ধ্যানের শক্তি এবং নবজীবন বইটা প’ড়ে নিয়ো। যাহোক, তোমার কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং মূল্যবান জিনিস কোনটা ?
‘বিশ্বাস। অর্থাৎ ইমান।’
‘অলৌকিকের চেয়েও?’
‘জ্বী। অনেক অলৌকিক কাজ দেখেছি। কিন্তু তার পরও বিশ্বাস ওঠা-নামা করেছে। আমি আল্লাহ্র কাছে কিছুই চাই না, কেবল বিশ্বাস চাই।’
‘তুমি আসল জায়গাটাকে চিহ্নিত ক’রে ফেলেছ। আল্লাহ্ তোমার আত্মার ব্যাধি সারিয়ে দিন।’
‘আমীন।’
‘তুমি এখানে কেন এসেছ?’
‘জ্ঞানের জন্য।’
‘কোত্থেকে এসেছ?’
‘অজ্ঞানপুর থেকে।’
‘আরেকটু দূর থেকে আসলে ভালো হতো। জ্ঞানার্জনের জন্য খুব বেশি দূরে যাওয়া দরকার। চট পরেছ কেন?’
‘গুরুজী, আমি গরীব নই, দাতা।’
‘আল্লাহ্ তোমার ওপর রহমত বর্ষণ করুন।’
‘আমাকে কবে স্বপ্নে দেখেছিলে?’
‘গতদিন দুপূরে।’
‘দিবাস্বপ্ন? তুমি দিনে ঘুমাও?’
‘গুরুজী, দুপুর বেলাটায় একটু ঘুমাই। রাতে ঘুমাই না। রসূলুল্লাহ (সঃ) দুপুরে বিশ্রাম করতেন। তিনি আমাদেরকেও তা করতে বলেছেন।’
‘হুঁম্ । তুমি যখন আমাকে স্বপ্নে দেখেছিলে তখন তুমি কোথায় ছিলে?’
‘অজ্ঞানপুরে।’
‘এত অল্প সময়ের মধ্যে সেখান থেকে এতদূর এলে কিভাবে?’
‘দৌড়ে।’
‘কারণ?’
‘জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনদেশে যাওয়ার নিয়ম। তাই ভাবলাম, পথ যখন অল্প, তখন দৌড়ে পরিশ্রম বেশি ক’রে গেলে নবীজী (সঃ) এর কথার মর্যাদা রক্ষা হবে।’
‘আল্লাহ্ তোমাকে জ্ঞান দান করুন।’
‘জ্ঞানের পথ কখনও ছোট হয় না। ফলে দৌড়াতে হলেও সেখানে ম্যারাথন দৌড় দরকার। আমীন।’
‘স্বপ্নে কী দেখেছিলে?’
‘দেখেছিলাম যে আপনি দুপূরে শুয়ে আমাকে স্বপ্নে দেখছেন।’
‘তার মানে তুমি আমার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলে?’
‘আমি স্বেচ্ছায় তা করিনি।’
‘আমি যে দুপুরে ঘুমাই তাও জেনে ফেলেছ?’
‘অনিচ্ছায়।’
‘তোমাকে আমার আসলেই দরকার।’
‘কেন গুরুজী? যে কারণে আমার আপনাকে দরকার সেই কারণে কি?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘আমি তোমাকে খুন করতে চাই।’
‘আমি জানতাম আপনি তা পারবেন।’

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত