তিন : আগুন আছে, আলো নেই
বুড্ডা মাগরিবের নামাজের আগেই নতুন গুরুর আশ্রমে গিয়ে পৌঁছাল। সেখানে তিনি একা থাকেন না। তার সাথে আরো অনেক সাধক থাকেন। অদূরে একটা লোকালয়ও আছে। সে জামায়াতে নামাজ পড়ার পর গুরুকে খুঁজতে লাগল ।
গুরুজী নামাজে ইমামতি ক’রে হঠাৎ কোথায় যে উধাও হয়ে গেলেন বুড্ডা তা দেখতে পায়নি। সে অন্যান্য সাধকদের কাছে জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু কেউই তার সাথে কথা বলল না। আবার কেউ তার সাথে দুর্ব্যবহারও করল না। সে এর রহস্যটা বুঝতে পারল না। তাই সে একাই এ-ঘর থেকে ও-ঘরে খোঁজ ক’রে দেখতে লাগল। কাউকে গুরু বলে সন্দেহ হলে সে প্রশ্ন করতে লাগল— আমি কি আপনার কাছে এসেছি? কিন্তু সবাই তার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। সে এভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক খুঁজল। অতঃপর একটা গাছের নিচে ব‘সে পড়ল বিশ্রামের জন্য। সে এখানকার অভিনব পরিবেশ এবং রীতিনীতি নিয়ে ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে তার হালকা তন্দ্রার ভাব এল। এমন সময়ে সে একটা বাণী শুনতে পেল—‘তুমি কাকে চাও?’
সে নড়েচড়ে ব‘সে চারদিকে একবার দেখে নিল। তারপর বলল—‘যাকে আমি খুঁজছি?’ ‘তোমাকে কি কেউ খুঁজছে?’
‘জ্বী । মৃত্যু। ‘
‘পাচ্ছে না?’
‘যে-কোনো মুহূর্তে পেয়ে যেতে পারে।’
‘কারণ?’
‘নিশ্চয়ই আমি এমন কিছু ধ’রে রেখেছি যা আমার নয়, তার। সে তা ফেরৎ নিতে আসছে।’
‘দিয়ে দাও।’
‘কিন্তু কী কী তার আর কী কী তার নয় তা আমি এখনও জানতে পারিনি।’
‘সে তো তোমাকে মাঝ পথে ধ’রে ফেলতে পারত।’
‘এ কারণেই মনে হয় যে কোনো পথই মাঝ-পথ নয়, পথের যে কোনো বিন্দুই তার শেষ।’
‘পাশের লোকালয়ে গিয়ে একটা মোম জ্বালিয়ে নিয়ে এস।’
সে আশে-পাশে তাকিয়ে দেখল কোনো মোম পাওয়া যায় কি না। কোথাও ভুলক্রমে একটা মোম প‘ড়ে থাকতে পারত। কিন্তু এত অন্ধকারে মোম খুঁজতে গেলেও একটা মোম দরকার। তার মনে পড়ল তার বাবার কথা। মাঝে-মাঝে তিনি তার চশমা খুঁজে না পেলে বলতেন—কেউ আমার চশমাটা দে তো, খুঁজে দেখি চশমাটা কোথায় ফেললাম। চশমাটা যখন হারায় তখন তা এমন সব ছোট- খাট জায়গায় লুকিয়ে থাকে যেখান থেকে তা বের ক‘রে আনতে গেলে চশমা লাগে। বুড্ডা অনন্যোপায় হয়ে এক দৌড়ে লোকালয়ের দিকে চ‘লে গেল। সেখানে গিয়ে সে প্রথমে যে-ঘরটা দেখতে পেল তার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সে আশ্বস্ত হলো যে ঘরের মধ্যে একটা মোমবাতি জ্বলছে এবং এক বৃদ্ধ তার আলোয় বই পড়ছেন। সে অনুমতি চাইল—‘ভেতরে আসতে পারি?’
‘আগে পারতে না, এখন পার।’
সে ঘরে ঢুকেই লোকটাকে সালাম দিল। —আমাকে একটু আলো দেবেন?
বৃদ্ধ তাকে আপাদ-মস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল – নিয়ে যাও।’
‘তাহলে একটা মোম দিন।’
বৃদ্ধ তার মুখের দিকে আবারও তাকাল। খানিক পর বলল—‘এটাই নিয়ে যাও । আলোটা রেখে মোমটা দিয়ে যেয়ো।’
বুড্ডা খানিক ভেবে বলল—‘পাকা কথা দিতে পারব না।’
সে মোম নিয়ে দৌড়াল। গাছটির নিচে এসে মোম-হাতে দাঁড়িয়ে রইল । আদেশ এল— ‘নিভিয়ে ফেল।’
সে মোমটা নিভিয়ে ফেলল ।
‘যার মোম তাকে দিয়ে এস।’
সে আবারও দিল দৌড়। সে মোমের মালিকের কাছে গিয়ে বলল— আমাকে একটু আলো দেবেন?
‘কেন?’
‘আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না । মোমটা ফেরত দিতে চাই।’
‘তাহলে যে তোমাকে কষ্ট ক’রে পাশের বাড়ি থেকে একটু আগুন আনতে হবে। আগুন ছাড়া আলো হয় না।’
‘পাশের বাড়ি কত দূরে?’
‘পাশের বাড়ি তো পাশেই থাকে।’
সে তাকিয়ে দেখল যে পাশের বাড়িটা প্রায় দুইশ হাত দূরে। সে সেখানে গিয়ে বলল—‘একটু আগুন চাই।’
জবাব এলো—‘আগুন আছে, আলো নেই। চলবে?’
সে পাল্টা প্রশ্ন করল—‘সে কেমন?’
‘তুষের আগুন। বাতের রোগীর পা গরম করার জন্য।’
সে ফিরে এল বৃদ্ধের কাছে। জিজ্ঞেস করল—‘আপনার কি বাতের রোগ আছে?’
বৃদ্ধ বলল—‘আগে ছিল, এখন নাই।’
‘কিভাবে?’
‘আগুনে যা সারেনি, তা আলোয় সেরে গেছে।’
‘সে কেমন?’
‘গুরুর দোয়ায়।’
‘মোমটা কি নেবেন ?’
‘আলোটা রেখে দিয়েছ তো?’
‘সে আলোয় আগুন ছিল।’
‘আমার আগুন দিয়ে আমার মোমটুকু জ্বালিয়ে দিতে। আলোটুকু তোমার হয়ে যেত, মোমটাও ফেরৎ দেয়া লাগত না।’
‘জানতাম না। তাছাড়া নিষেধ ছিল।’
‘ওখানে রেখে চ‘লে যাও।’
সে আবারও ফিরে এল যথাস্থানে। তাকে লক্ষ্য ক‘রে বলা হলো—মৃত্যু আসে মোম ফেরৎ নিতে। সে আলো নেয় না। আমি তো দেখতে পাচ্ছি তোমার পুরোটাই মোম। দ্রুত জ্বালিয়ে আলোটুকু নিয়ে নিতে পারলে ভালো করতে। তুমি জান না যে তুমি মোম নও। তুমিই আলো। অথচ তুমি এখনও মোমের মধ্যেই রয়ে গেছ। তোমাকে প্রচুর জ্বালানী দেয়া হয়েছিল, অথচ তুমি তা ব্যবহার করনি, শুধু অপচয় করেছ।
বুড্ডা প্রশ্ন করল—‘কিন্তু এতদিন তো জানতাম মৃত্যু এসে আলো নেয়, অর্থাৎ রূহটা নেয়।’
‘রূহের আবার মৃত্যু কী? মৃত্যু আর মৃত্যুর ফেরেস্তা এক নয়। মৃত্যুর ফেরেস্তার সান্নিধ্যে কেউ মারা পড়ে, কেউ জেগে ওঠে। তোমার অবস্থা মারা পড়ার মতো।’
একথা শুনে বুড্ডা কাঁপতে লাগল। সে অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল । আওয়াজ এল— ‘আমার কাছে এস। ’
বুড্ডা তাকিয়ে দেখল যে আশ্রমের পেছন দিয়ে এক চিলতে আলো চ‘লে গেছে বেশ দূরে ছোট একটা ঘরের দিকে। সে সেদিকে ছুটল। সেখানে গিয়ে সে দেখল যে গুরুজী বসে আছেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আট-দশজন সাধক। তারা বারবার বলছে— ‘গুরুজী, আমরা আপনার কাছে এসেছি।’
গুরুজী কিছুক্ষণ পর বললেন— ‘কিভাবে বুঝলে?’
তারা গুরুজীর কথার কোনো জবাব দিতে পারল না। সবাই পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এমন সময়ে বুড্ডা তাদের ভিড় ঠেলে গুরুজীর সামনে গিয়ে বললেন—‘গুরুজী আমি আপনার কাছে আসতে চাই।’
গুরুজী ধ্যানস্থ অবস্থায় চোখ বন্ধ রেখেই বললেন—‘পথ খোঁজো।’
‘আপনিই নিজ দয়ায় দেখিয়ে দিন।’
‘তাহলে চোখ বন্ধ কর।’
বুড্ডা চোখ বন্ধ করল ।
বুড্ডার পদ্ধতি দেখে অন্যান্য সাধকেরা বলল— ‘গুরুজী, আমরাও আপনার কাছে আসতে চাই।’
‘তাহলে বুড্ডার পিছু নাও।’
কিন্তু ততক্ষণে বুড্ডা লাপাত্তা। সে ওখানে কোথাও নেই । তারা বলল—‘গুরুজী, সে এখানে নেই।’
গুরুজী বললেন, ‘খোজ।’
‘কিভাবে গুরুজী?’ —সবাই একত্রে ব’লে উঠল
গুরুজী বললেন—‘চোখ বন্ধ কর।’
তারা চোখ বন্ধ করল। কিন্তু তারা অন্ধকার ছাড়া কেউই কিছু দেখতে পেল না। ফলে তারা কিছুক্ষণ পর চোখ খুলল। কিন্তু ততক্ষণে গুরুজীও আর সেখানে নেই। এই দৃশ্য দেখে তাদের মধ্যে একটু বয়স্ক গোছের এক সাধক বললেন—‘বারবার চেষ্টা করতে হবে। এবারও হলো না।’