পাঁচ : মৃত্যু এবং কোরবানি
গুরুজী বললেন—‘চোখ খোল!’
বুড্ডা চোখ খুলেই চিৎকার ক’রে উঠল—‘আহ্ মৃত্যু! মৃত্যু চাই!’
সে তাকিয়ে দেখল যে সে গুরুজীর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কখন যে সে সুড়ঙ্গের মধ্যে পড়ল, কিভাবে এখানে এল, তা তার মনে পড়ছে না, এমনকি মৃত্যুর বীভৎস চেহারার কথাও তার মনে তেমন দাগ কাটেনি—তার শুধু মনে পড়ছে এমন, একটি আলোর কথা যাতে তার সত্তা ডুবে গেছে। সে মোহাবিষ্টের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আরজ করল— ‘গুরুজী, আপনার কাছে আসতে চাই।’ গুরুজী বললেন—‘চেষ্টা কর।’
সে গুরুজীর সামনে গিয়ে বসল। গুরুজী বললেন—‘কী দেখেছিলে?’
‘আহ! গুরুজী, আমার ভাষা ব্যর্থ। কী বলতে পারি আমি। আমি যার জন্য পাঁচ টাকার নোট ভাঙিয়ে চার টাকা দান করি আর এক টাকার রুটি কিনে খাই, যার জন্য পথ চলার সময়ে হাঁটি না—দৌড়াই, যার জন্য আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া একটা পাখির পিছু নিতে গিয়ে উর্ধ্বমুখী হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ এদোডোবার মধ্যে প’ড়ে যাই এবং পরে পা না-ভাঙার কারণে আল্লাহকে ধন্যবাদ দেই, যা চাই বলে সাগরবেলায় বালির ওপরে নিজের নাম লিখে ঢেউকে তার ওপর লেলিয়ে বলি——নিশ্চিহ্ন কর এই নাম, যার সন্ধানে মত্ত হয়ে বাসন্তী বাতাস গায়ে লাগলে কাক থেকে কোকিলকে আলাদা ক’রে চিনতে পারি, যার সন্ধানে পালন করেছি কঠিন ব্রত—এক নাগাড়ে সাত দিন পর্যন্ত গাল দিয়ে নিঃশ্বাস নেইনি, যা পাবার জন্য আহার করার আগে পানি পান করাকে ফরজ হিসেবে নিয়েছি, চোখ খোলা রেখে ঘুমাই, কাজ বন্ধ ক’রে হাঁটি, নিজের ছায়া থেকে পালাবার জন্য হাঁটার বদলে দৌড়াই, নিশাচর পাখির মতো ঝোপঝাড় বিলখালের মধ্যে ঘুরঘুর করি, নিন্দুকের গালে মিষ্টি পুরে দেই এবং প্রশংসাকারীর হাতে দেই চটি, যাকে পাবার জন্য মাথার ওপরে বালিশ রেখে বসি, ইটের ওপর মাথা রেখে শুই—দেখলাম…… দেখলাম তা তো লুকিয়ে রয়েছে মৃত্যুরই মধ্যে। মুক্তি! আহ মুক্তি! সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ মুক্তি যে রয়েছে মৃত্যুরই মধ্যে!’
“দেখ বুড্ডা, তুমি যা চাচ্ছ, তা অতি মূল্যবান। সবচেয়ে মূল্যবান। আর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটাকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়? সবচেয়ে নিরাপদ এবং ভয়ংকর জায়গায়, তাই না?’
“তাহলে কি মৃত্যুর আগে মুক্তি নেই?”
“তোমার এই ভুল ধারণাটাকেই এখন ভাঙতে হবে। পৃথিবীর অধিকাংশ, অধিকাংশ এবং অধিকাংশ সাধকই ব্যর্থ হয় যে কারণে, অধিকাংশ সাধারণ মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে যে কারণে, তুমিও সেই রোগে ভুগছ, যদিও তোমার ক্ষেত্রে ব্যাধিটা আদৌ জটিল নয়। বরং তুমি মাঝে-মাঝে ঠিক জায়াগাটাতে গিয়ে হাজির হও, আবার মাঝে-মাঝে পার্থিব মায়ার জালে জড়িয়ে যাও—সে মায়া এমন সূক্ষ্ণ যে তুমি নিজেই ধরতে পার না যে তুমি মায়ার পিছনে ছুটছ।”
‘কী সেই মায়া,গুরুজী?’
‘তোমার মুক্তি কামনা।’
‘মুক্তি কামনা? মুক্তি কামনাই মায়া?’
‘হ্যা।’
‘বুঝতে পারলাম না, গুরুজী।’
‘তুমি মুক্তি চাও কেন? কারণ মানবজীবনের ওটাই একমাত্র কাম্য। কিন্তু তুমি মুক্তির জন্য এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তুমি মৃত্যুর আগেই কি মুক্তি চাও? মরতে চাও না? মৃত্যুকে এড়াতে চাও? কেন, কী দোষ করেছে মৃত্যু? সে তো তোমার আর তোমার বন্ধুর মধ্যে ঘটকালি ক’রে দেয় মাত্র। তার দোষ কী? তোমার বন্ধুই তো নিজেকে মৃত্যুর পর্দার আড়ালে লুকিয়েছেন। তুমি মৃত্যুর আগে বহুবার মুক্তি পাবে, বহু মৃত্যুকে অতিক্রম করবে, কিন্তু তোমার পূর্ণাঙ্গ মুক্তি এবং প্রভুর সাথে পূর্ণাঙ্গ মিলন ঘটবে কেবল দৈহিক মৃত্যুর সময়ে। তার আগে তুমি পূর্ণাঙ্গ মুক্তি কেন চাও? মুক্তি পাবার পরেও কিছুদিন বেঁচে থেকে জীবনটাকে ভোগ করবে ব’লে? এটা কি তাহলে নফসের কারসাজি নয়? শোন: সব কিছু মৃত্যুর আগে পাব এবং মৃত্যুকে ঘৃণা করব বা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করব, এরূপ চিন্তা করা কোনো সৎ এবং অনুগত কৃতজ্ঞ সাধকের কাজ নয়। এই চিন্তা থেকেই মানুষ অহংকারী হয়ে ওঠে। এই চিন্তা যার আছে, তার সাধনায় সফলতা যত বেশি আসে, ততই সে বিভ্রান্ত হতে থাকে। প্রকৃত আত্মসমর্পণকারীর মৃত্যুর প্রতি একটা আকর্ষণ থাকে। কারণ তিনি পূর্ণাঙ্গতা চান, অথচ পূর্ণাঙ্গতা লুকিয়ে রয়েছে মৃত্যুর মধ্যে। তোমার সাধনা ইসলাম, কিন্তু লক্ষ্য থাকবে পরকাল।
আল্লাহ্ বিভিন্নভাবে বলেছেন—আমিই জীবন দান করি, আমিই মৃত্যুদান করি; আমার কাছেই সবাইকে ফিরে আসতে হবে। তিনি জীবনদান করলে খুশি হও, তাহলে তিনি মৃত্যুদান করলে খুশি হও না কেন? তুমি তো স্বার্থপর। তিনি জীবন দান করলে তুমি খুশি হও, কারণ তখন তুমি নিজেকে পাও। অপরপক্ষে তিনি মৃত্যু দান করলে তুমি দুঃখিত হও, কারণ তখন তুমি নিজেকে হারাও । অথচ তুমি একথাটা বুঝলে না যে মৃত্যুর মাধ্যমে তুমি তাঁকেই পাও, যা তোমার জীবনের চেয়েও বড় পাওনা। কেন ভুলে যাও যে তিনিই মৃত্যু, তিনিই জীবন? সুতরাং দিন দিন ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর নেশা জাগানো চাই। এই নেশা যখন জাগবে, তখন তুমি পৃথিবীতে যাই কর না কেন, সবই হবে ইবাদত। একটা কথা মনে রেখ—এখানে পরকাল বা বেহেস্ত নেই সত্য, তবে আল্লাহ্ আছেন। তিনি তো কোনো বিশেষ সময়সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তাই তাঁকে এখানেও পাওয়া যায়। তাঁকে পেয়েও লক্ষ্য করা চাই পরকালের দিকে। তা না হলে নফস তোমাকে তোমার যোগ্যতার ফলকে পৃথিবীতে আদায় করার জন্য তাদাগা দেবে। কোনো কিছু চাওয়া মানেই নফসের কাজ। নসের এই সাধ মিটানোর উপযুক্ত জায়গা হলো পরকাল। কারণ তখন কোনো চাওয়া-পাওয়ার খেসারত হিসেবে আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। বিশুদ্ধ সাধকের কাছে আল্লাহ্ ছাড়া কিছুই চাওয়ার নেই । এবং এই চাওয়ার প্রকাশ ঘটে দেয়ার মাধ্যমে তার লক্ষ্য থাকে আল্লাহকে খুশি করার জন্য আমিত্বকে বিসর্জন দেয়ার প্রতি। এই দেয়াই হলো প্রকৃত চাওয়া। আল্লাহকে চাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য কোনো চাওয়া ব’লে কিছু নেই। অবশ্য একটা পর্যায় যারা অতিক্রম করেন তাদেরকে আল্লাহই বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করেন।
তোমাকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুবরণ করতে থাকতে হবে। নিজেকে হত্যা করতে হবে। তাহলে দেখবে যে তুমি প্রতি মুহূর্তে একটু একটু ক’রে জেগে উঠছ। একই সাথে তোমাকে কোরবানীও করতে হবে।
‘গুরুজী,খুন আর কোরবানীর মধ্যে কী পার্থক্য একটু বলবেন?’
‘ভালো খুন হলো খারাপ জিনিসকে হত্যা করা; অপরপক্ষে কোরবানী হলো ভালো জিনিসকে হত্যা করা।’
‘সে আবার কেমন?’
‘কুপ্রবৃত্তিকে দমন করাই তাকে খুন করা বা নসকে খুন করা। এর নাম হলো বেঁচে থাকা। মন্দের প্রভাব থেকে বেঁচে থাকা। যা কিছু ভালো, তারও সীমাতিরিক্ত চর্চা বা বাড়াবাড়ি মন্দের দলভুক্ত। তাকে দমন করা বা নির্মূল করা হলো নিরাপদ থাকা। এটাই কোরবানীর শুরু। আর যা কিছু বৈধ এবং শখের এবং আদরের এবং পছন্দের, তাকে আল্লাহকে খুশি করার জন্য স্বেচ্ছায় বিসর্জন দেয়া হলো কোরবানী। ইসমাইল (আঃ) ইব্রাহিম (আঃ) এর কলিজার টুকরো ছিলেন। সন্তানকে এভাবে ভালোবাসা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু আল্লাহ্ দেখতে চাইলেন ইব্রাহিম (আঃ) তাঁকে খুশি করার জন্য নিজের বৈধ আদরের বস্তুকেও বিসর্জন দিতে রাজি আছেন কি-না। একেই বলে কোরবানি। খারাপ নসকে দমন করার চেয়ে এর মূল্য আরো বেশি। কারণ এ সম্ভব পবিত্রতা অর্জনের পর, মন্দ থেকে দূরে থাকার সংকল্পে স্থির হওয়ার পর, আগে নয়। অনেকে কোরবানীকে শুধু নফস দমনের উপায় বলে মনে করে। কিন্তু আসলে সাধকের জন্য এ হলো আত্মশুদ্ধির উপায়, যা শুরু হয় নফস দমনের পরের ধাপে:
তোমরা কখনও পূণ্য অর্জন করবে না যতক্ষণ নিজেদের প্রিয়বস্তুথেকে ব্যয় না করবে। (৩:৯২)
দেখেছ আল্লাহ্ কিভাবে তোমার প্রিয়বস্তুর ওপর দাবি প্রতিষ্ঠা করেন, অথচ তার পরও তুমি তাঁকে বঞ্চিত করতে চাও? আরেকটা আয়াত বিবেচনা কর:
আর ইহুদিদের জন্য আমি বহু পবিত্র বস্তু হারাম ক’রে দিয়েছি যা তাদের জন্য হালাল ছিল, তাদের সীমালঙ্ঘনের কারণে। (৪:১৬০ )
তোমার ময়লা-ধরা, ছানি-পড়া চোখে এর রহস্য ধরা পড়বে কিভাবে? তুমি ভাবছ—এই আয়াতের সাথে আবার কোরবানীর কী সম্পর্ক? কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ যে পবিত্র কোরআনের একটা আয়াতের বিভিন্ন মাত্রার অর্থ রয়েছে। অনেকে তো অহংকারভরে একথা অস্বীকারই করে। আবার আমি যখন অর্থ ব’লে দেই, অনেকে তখন নিজেকে ছোট মনে ক’রে ভাবে, অর্থটা আমি কেন বের করতে পারলাম না? সুতরাং তারা তা পরিত্যাগ করে। অথচ তারা ভেবে দেখে না যে আল্লাহ্ তাঁর জ্ঞান যাকে ইচ্ছা দান করেন। এতে আমারও কোনো হাত বা কৃতিত্ব নেই। কাফেরদের এক অংশ বলত —–নবুয়তি কেন মুহম্মদকে দেয়া হলো? কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির ওপর কেন নাযিল হলো না? এসব হলো অহংকার। অবশ্য যারা আত্মসমর্পণকারী, তারা জ্ঞানীকে কখনও হিংসা করেন না, বরং হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন। যাহোক, এই আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন যে ইহুদিরা হালাল নিয়েই সীমালঙ্ঘন করেছিল, হারাম নিয়ে নয়, কারণ হারাম নিজেই হলো সীমালঙ্ঘন। তারা হালাল নিয়ে শুধু ভোগের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল, সংযম বা সীমার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেনি। সংযম মানেই ভোগের মধ্যে সীমা এবং শুধু ভোগ নয়, ত্যাগও। অর্থাৎ ত্যাগের বা কোরবানীর সাথে যদি হালালকে গ্রহণ না করা হয়, তাহলে তা আর হালাল থাকে না। কারণ তা হয় স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, লোভ এবং চরম অকৃতজ্ঞতার সামিল।
আয়াতটার আরো কিছু অর্থ আমার জানা আছে যা এখানে প্রাসঙ্গিক না। আরেকটা উদাহণ দেখ:
…… আমি পরীক্ষা করেছিলাম বাগানওয়ালাদেরকে, যখন তারা কসম করেছিল যে, অবশ্যই তারা ভোরবেলায় বাগানের ফল আহরণ করবে আর তারা ‘ইনশাল্লাহ’ বলেনি। অতঃপর আপনার রবের তরফ থেকে বাগানের ওপর এক বিপর্যয় আপতিত হলো, আর তারা ছিল তখন নিদ্রিত। ফলে বাগানটি শষ্য-কাটা ক্ষেতের মতো কালো রঙের হয়ে গেল, অতএব তারা সকালে একে অপরকে ডেকে বলতে লাগল——তোমরা ভোরবেলায় নিজ নিজ ক্ষেতের দিকে চল, যদি তোমরা ফল আহরণ করতে চাও।’ অতঃপর তারা বলল, চুপি চুপি কথা বলতে : আজ যেন বাগানে কোনো মিসকিন তোমাদের কাছে প্রবেশ না করতে পারে।’ আর তারা মিসকিনদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম মনে ক’রে ভোরবেলা বাগানে যাত্রা করল। তারপর যখন তারা বাগানের অবস্থা দেখল তখন তারা বলল— ‘আমরা নিশ্চয়ই পথ ভুলে গেছি। বরং আমরা তো ভাগ্যবঞ্চিত।’ তাদের ভালো লোকটি বলল– আমি কি তোমাদেরকে বলিনি? এখনও তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা – মহিমা কেন ঘোষণা করছ না? তখন তারা বলল— আমরা আমাদের রবের পবিত্রতা মহিমা ঘোষণা করছি, আমরা তো ছিলাম অত্যাচারী। অতঃপর তারা একে অপরকে সম্মোধন ক’রে পরস্পরকে দোষারোপ করতে লাগল। তারা বলতে লাগল— হায় দুর্ভোগ আমাদের! নিশ্চয় আমরা সবাই ছিলাম সীমালঙ্ঘনকারী। আশা করা যায় এর পরিবর্তে আমাদের রব আমাদেরকে দিবেন উৎকৃষ্ট বাগান; আমরা তো আমাদের রবের অভিমুখী হলাম। শাস্তি এরূপই হয়ে থাকে। আর আখেরাতের শাস্তি তো অতি গুরুতর। কি ভালো হতো যদি তারা জানত (অর্থাৎ তাদের ঘটনা থেকে তারা শিক্ষা গ্রহণ করত!)
(৬৮:১৭-৩৩)
দেখ, কি চমৎকার উদাহরণ! ত্যাগ ছাড়া হালাল ভোগও হালাল নয়। কোরবানী ছাড়া ভোগ হালাল নয়। তারা তাদের বৈধ বাগান ভোগ করতে চেয়েছিল, অবৈধ বাগান নয়। তারা শূকরের মাংশ খেতে চায়নি। তবুও তাদের ভোগকে আল্লাহ্ তাদের জন্য হালাল করেননি—তা তাদেরকে ভোগই করতে দেননি। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য কর—তারা আল্লাহর পবিত্রতা-মহিমা ঘোষণা ক’রে এবং তওবা ক’রে অর্থাৎ আল্লাহ্ ‘অভিমুখী হয়ে’ নতুন ক’রে আশা করল। যা তারা কোরবানী করেনি, অর্থাৎ মিসকিনদেরকে যার ভাগ দেয়নি, তা হারাবার পরই তাদের মনে মহিমা-ঘোষণার ইচ্ছা জাগল। এই ইচ্ছাই আন্তরিক, কারণ তারা ঠেকে শিখেছে, ভুল থেকে শিখেছে। তাদের knowledge এর development ঘটেছে এবং তা wisdom-এ পরিণত হয়েছে। জ্ঞান বা knowledge যতক্ষণ অনুভূতির স্তরে ভারসাম্য সৃষ্টি ক’রে wisdom এ রূপান্তরিত না হয়, ততক্ষণ তা জীবনের কোনো গঠনমূলক কাজে লাগে না, তা দ্বারা আচরণকে ম্যানেজ করা যায় না। একেই Daniel Goleman বলেছেন Emotional Intelligence। ভালোভাবে লক্ষ্য কর, কোরবানী এবং তওবা ছাড়া আল্লাহ্ পবিত্রতা- মহিমা ঘোষণা আন্তরিক হয় না, কবুলও হয় না। Knowledge দ্বারা emotion কে নিয়ন্ত্রণ করলে যে, Intelligence সৃষ্টি হয়, তা হলো প্রকৃত কোরবানীর ফলশ্রুতি। বর্তমান যুগে সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় latest পাঠ্যসূচিতে Emotional Intelligence সম্বন্ধে পড়ানো হয়। অথচ কেউ জানছে না যে তার আকর হলো কোরআন। যাহোক, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অমুসলিমরাই ইদানিং মুসলমানদের চেয়ে বেশি কোরবানীর দিকে ঝুঁকে পড়েছে—তারা আর কিছু না হোক অন্তত ভালোবাসার সামাজিক রূপটাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, আর মুসলমানেরা ঝুঁকে পড়েছে নফসের দিকে। অমুসলিমরা তার ফলও পাচ্ছে। সমৃদ্ধি এখন তাদেরই। আল্লাহ্ কি তাদেরকে তা না জেনেশুনে দিয়েছেন? তিনি বলেছেন:
..আল্লাহ্ নিজ দয়ায় তাদেরকে ধনী ক’রে দেবেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, পরম জ্ঞানী।
(২৪:৩২ )
এখানে তো আল্লাহ্ বলেই দিয়েছেন যে তিনি তাঁর জ্ঞান ব্যবহার ক’রেই তার দয়ার মাধ্যমে প্রাচুর্যকে বিতরণ করেন—অর্থাৎ তিনি জেনেশুনেই দিয়ে থাকেন, নয় কি? তাহলে তাদের ভালো কাজগুলোর ফল তো আল্লাহ্ দেবেনই। আরেকটা উদাহরণ দেখ:
যখন সন্ধ্যার সময়ে তার [ সুলায়মান (আঃ) ] কাছে উপস্থিত করা হলো সুন্দর ঘোড়াগুলো, তখন সে বলল, আমি তো আমার রবের স্মরণ থেকে (অর্থাৎ নামাজ থেকে) গাফেল হয়ে সুন্দর জিনিষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। এমনকি সূর্য পর্দার আড়ালে চ’লে গেছে; ওগুলোকে আমার সামনে আন। তারপর সে সেগুলোর পা ও গলা কেটে ফেলতে লাগল ।
(৩৮:৩১-৩৩)
কোরবানির এত সুন্দর উদাহরণ আর খুব বেশি নেই। সুলায়মান (আঃ) তো বলেননি যে তিনি অসুন্দর অশোভন কোনো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । তিনি তো রীতিমতো বৈধ সুন্দরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সৌন্দর্য দর্শন করার অবকাশে আসরের নামাজের সময় চ’লে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন যে যে-সুন্দর আল্লাহর স্মরণ থেকে তাঁকে দূরে রেখেছে তা কোরবানী করা আবশ্যক। ফলত তিনি নিজের আশা-আকাঙ্খাকে কোরবানী করার জন্য ঘোড়াগুলোকে টুকরো টুকরো ক’রে ফেললেন। আধুনিক যুগের পশু-অধিকার ( Animal Rights ) বিশেষজ্ঞগণ ঘটনাটায় মনঃক্ষুণ্ণ হলেও তা ছিল এক চমৎকার ত্যাগের উদাহরণ। এই ত্যাগ অসুন্দরকে ত্যাগ নয়, এ হলো সুন্দরকে ত্যাগ। অসুন্দরকে ত্যাগ করা মানে হারাম বর্জন, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী সুন্দরকে ত্যাগ করা মানে হলো কোরবানী। কেউ না জানুক, অন্তত সাধকের একথা জানতে হবে। আল্লাহ্ বলেছেন—আমার কাছে কোরবানীর মাংস পৌঁছায় না, পৌঁছায় তোমাদের খোদাভীতি বা হৃদয়। কিন্তু তোমার হৃদয় তো আটকে আছে বস্তুর মধ্যে। ফলে সেই বস্তু ত্যাগ না করা পর্যন্ত হৃদয়কে তা থেকে মুক্তও করা যাবে না এবং আল্লাহকেও তা দেয়া যাবে না। সুতরাং মনে রাখবে মন্দ কাজ থেকে নফসকে দমন করা হলো পাপ বর্জন করা, আর অর্জিত বৈধ যোগ্যতাকে ইহকালে ভোগ না ক’রে তা পরকালের জন্য সঞ্চিত রাখা হলো প্রকৃত কোরবানী এবং সঞ্চয়। তুমি যদি তোমার সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গতাকে মৃত্যুর সময়ে অর্জন করবে ব’লে নিয়ত কর এবং সেভাবে এগিয়ে যেতে থাক, তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে যে পৃথিবীর সবই মায়া এবং স্বপ্ন—এবং তখন তোমার শ্রেষ্ঠ কোরবানী প্রতিষ্ঠিত হবে।’
‘গুরুজী, আল্লাহ্ আপনার ওপর অসংখ্য রহমত বর্ষণ করুন। এই সূক্ষ ব্যাপারটা আসলে আগে জানতাম না।’
‘আল্লাহ্ তোমাকে জ্ঞান দান করুন।’
‘আল্লাহ্ আপনার দোয়া কবুল করুন।’
‘যে গুরুর আদেশে এখানে এসেছ তাঁর সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা?’
‘তাঁকে খুব বেশি কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে উনি যে-বাতিটা জ্বেলে রাতে বই পড়েন, তার গোড়ায় কোনো অন্ধকার দেখলাম না।’
‘আল্লাহ্ তোমাকে আরো সুন্দর অর্ন্তদৃষ্টি এবং ভাষা-যোগ্যতা দান করুন। আর কী দেখলে?’
‘দেখলাম উনি একা থাকেন কিন্তু নামায পড়েন জামায়াতে।’
‘আর?’
‘আর, রান্না করার কাজে অত্যন্ত অভিজ্ঞ, কিন্তু খাওয়ায় অনভিজ্ঞ।’
‘তুমি এখন যেতে পার।’
‘গুরুজী, যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন করার অনুমতি চাই।’
‘অনুমতি দেয়া হলো।’
‘মৃত্যু আমাকে গ্রহণ করেনি কেন?’
‘কারণ তুমি এখনও পূর্ণাঙ্গ মুক্তির জন্য উপযুক্ত হওনি।’
‘তাহলে কি আমার যোগ্যতা পূর্ণাঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত আমার মৃত্যু হবে না?’
“তোমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তোমার যোগ্যতা পূর্ণাঙ্গ হবে না।’