কবি গোলাম মোস্তফা, Kobi Golam Mostofa, proggapath, progga, bangla literature, প্রজ্ঞাপাঠ, বাংলা সাহিত্য, প্রজ্ঞা, প্রবন্ধ, শিল্প-সাহিত্য, Articles, Prabandha

কবি গোলাম মোস্তফা

০ মন্তব্য দর্শক

বঙ্গদেশে মুসলিম রেনেসাঁর নেতা নওয়াব আবদুল লতীফ ১৮৬৩ সালে কোলকাতায় The Mohamedan Literary Society বলে যে প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলেন গোলাম মোস্তফা ছিলেন সে রেনেসাঁরই একজন কৃতিপুরুষ। ১৮৯৭ সালে তার জন্ম যশোরের শৈলকুপা থানার অন্তর্গত মনোহরপুর গ্রামে । শৈলকুপা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় ও খুলনা দণ্ডলতপুর কলেজ প্রভৃতি থেকে ডিগ্রি লাভ করে তিনি তৎকালীন বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসের নিম্ন শ্রেণীতে চাকরি গ্রহণ করেন। তখন বঙ্গদেশে তথা অবিভক্ত ভারতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের যশ ও প্রতিপত্তি অত্যন্ত প্রখর। কাব্যজীবনে প্রথম পর্যায়ে রবীন্দ্রবলয়ে অবস্থিত অপর তিনজন কবির মতো তিনিও রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল দীপ্তি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তখন এ বলয়ের মধ্যে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার অভূতপূর্ব ছন্দ আবিষ্কারের জন্য, কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক অভিনব উপমা প্রবর্তনের জন্য, কৰি কালিদাস রায় ও যতীন্দ্র মোহন বাগচী তাদের স্বকীয় ভাব, ছন্দ ও উপমা প্ৰভৃতি ব্যবহারের জন্য আমাদের সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। গোলাম মোস্তফা বয়সের দিক থেকে তাদের ছোট হলেও এ রবীন্দ্র প্রভাব তার জীবনে দেখা দিয়েছিল। তার পরিণামে রয়েছে তার রক্তরাগ প্রভৃতি রচনাতে । তবে এ প্রভাবের মধ্যেও তিনি পূর্বোক্ত রেনেসাঁর দ্বারাও বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। এ দুটো ধারার প্রভাব তার কাব্যজীবনের শুরুতে বিশেষভাবেই লক্ষণীয়। তবে বিকাশের ধারায় তিনি ক্রমশ সে রেনেসাঁর দিকেই ঝুঁকে পড়েছিলেন। সে রেনেসাঁর প্রভাব তার পূর্ববর্তীদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। মীর মোশাররফ হোসেন, কবি কায়কোবাদ, মওলানা আকরাম খাঁ, কবি সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক, ভোলার কবি মোজাম্মেল হক প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণের মধ্যে। গোলাম মোস্তফার বিশেষত্ব এই যে তাতে রাবীন্দ্রিক বলয়ের ছাপ ছিল প্রবল। আমাদের ছেলেবেলায় আমরা গোলাম মোস্তফাকেই আমাদের মুসলিম সমাজের একমাত্র জাতীয় কবি বলে শ্রদ্ধা করতাম। ইসলাম ধর্মের প্রতি প্রিয় রসূলের (স) প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা। এজন্য নজরুল ইসলামের বিশ্ববিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’র বিরুদ্ধে তিনি অপর একটি কবিতাও লিখেছিলেন। এক্ষেত্রে তার সহযোগী ছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। নজরুলের নিকট তার সে পত্রে বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কবি জীবনের সূচনা থেকেই তিনি মুসলিম সমাজের নানা দুঃখদুর্দশার চিত্র অঙ্কিত করেছেন এবং সমগ্র বিশ্বে মুসলিম জীবনে যে অধোগতি দেখা দিয়েছে তাতে তার অন্তর ব্যথিত হয়েছে। ‘ভাঙা বুক’ নামক গল্পে তার পরিচয় সুস্পষ্ট। তবে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা দেখা দিয়েছে বিশ্বনবী নামক আল্লাহর রসূলের (স) জীবনচরিত লেখায় । এতে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খান কর্তৃক মোস্তফা হযরত রসূলে আকরম (স)-এর মিরাজকে অস্বীকার করে যেসব উক্তি করা হয়েছে তার তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে। এতে তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের আশ্রয়ে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। হযরতের জীবনী সম্বন্ধে বাংলা, ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষায় যেসব গ্রন্থ এ যাবত লিখিত ও প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে এ গ্রন্থখানা শীর্ষস্থানীয় বলে গণ্য হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে তিনি ঢাকাতে গোলাম মঞ্জিল নামক একখানা আবাস তৈরি করে তাতে স্থায়ীভাবে বাস করার পরে তার সঙ্গে জগৎ, জীবন, ধর্ম, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়েছে। তাঁরই ভক্ত তালিম হোসেন প্রমুখ সাহিত্যিকগণের সঙ্গে তাঁর পূর্বোক্ত বাড়িতে যোগদানের সুযোগ হতো। এ সকল সভায় কবি সুফিয়া কামাল ও তাঁর স্বামী মরহুম কামাল উদ্দিনও যোগদান করতেন। এতে স্পষ্ট বুঝা যেতো তিনি এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কামনা করেন যাতে ইসলামের মূল্যমানগুলো রক্ষিত হয়। তবে জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে তৎকালীন আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। পরিণত বয়সে গোলাম মোস্তফাও তার এ ভুল বুঝতে পেরে ত্রুটি স্বীকার করতেন। তিনি ঢাকাতে এসে স্থায়ী নাগরিক হওয়ার পরে ‘নওবাহার’ বলে একখানা মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। তাতে উচ্চাঙ্গের প্রবন্ধ আধুনিক সমাজের রোমান্টিক গল্প প্রভৃতিও প্রকাশিত হতো। গোলাম মোস্তফা নানা ছন্দেরও প্রবর্তন করেছেন। তিনি একজন অতি উচ্চ স্তরের পিয়ানো বাদকও ছিলেন। পরিণত বয়সে তিন ইংরেজ কবি মিলটনের অনুসরণে ‘বনি আদম’ বলে একখানা মহাকাব্য প্রণয়নে রতো ছিলেন। তবে তা শেষ করে যেতে পারেননি। তিনি আমাদের সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর নানা অবদান রেখে গেছেন । তিনি পূর্বোক্ত রেনেসাঁর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের সাহিত্যে ইসলামের মানবতাবোধ সম্বন্ধে যে প্রেরণা দিয়েছিলেন তার ফলেই আমরা পেয়েছি সাত সাগরের মাঝির’ অপূর্ব স্রষ্টা কবি ফররুখ আহমদকে। ইসলাম এ দুনিয়ায় যে মানবতা প্রচার করেছে এবং তার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে সে মানবতাবোধ এ দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হলে এ দুনিয়াতে জাতিতে জাতিতে এতো মারামারি হানাহানি হতো না। গোলাম মোস্তফার জীবনে সে মানবতাবোধ ছিল অনন্ত।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

কবি গোলাম মোস্তফা

দর্শক

বঙ্গদেশে মুসলিম রেনেসাঁর নেতা নওয়াব আবদুল লতীফ ১৮৬৩ সালে কোলকাতায় The Mohamedan Literary Society বলে যে প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলেন গোলাম মোস্তফা ছিলেন সে রেনেসাঁরই একজন কৃতিপুরুষ। ১৮৯৭ সালে তার জন্ম যশোরের শৈলকুপা থানার অন্তর্গত মনোহরপুর গ্রামে । শৈলকুপা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় ও খুলনা দণ্ডলতপুর কলেজ প্রভৃতি থেকে ডিগ্রি লাভ করে তিনি তৎকালীন বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসের নিম্ন শ্রেণীতে চাকরি গ্রহণ করেন। তখন বঙ্গদেশে তথা অবিভক্ত ভারতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের যশ ও প্রতিপত্তি অত্যন্ত প্রখর। কাব্যজীবনে প্রথম পর্যায়ে রবীন্দ্রবলয়ে অবস্থিত অপর তিনজন কবির মতো তিনিও রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল দীপ্তি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তখন এ বলয়ের মধ্যে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার অভূতপূর্ব ছন্দ আবিষ্কারের জন্য, কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক অভিনব উপমা প্রবর্তনের জন্য, কৰি কালিদাস রায় ও যতীন্দ্র মোহন বাগচী তাদের স্বকীয় ভাব, ছন্দ ও উপমা প্ৰভৃতি ব্যবহারের জন্য আমাদের সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। গোলাম মোস্তফা বয়সের দিক থেকে তাদের ছোট হলেও এ রবীন্দ্র প্রভাব তার জীবনে দেখা দিয়েছিল। তার পরিণামে রয়েছে তার রক্তরাগ প্রভৃতি রচনাতে । তবে এ প্রভাবের মধ্যেও তিনি পূর্বোক্ত রেনেসাঁর দ্বারাও বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। এ দুটো ধারার প্রভাব তার কাব্যজীবনের শুরুতে বিশেষভাবেই লক্ষণীয়। তবে বিকাশের ধারায় তিনি ক্রমশ সে রেনেসাঁর দিকেই ঝুঁকে পড়েছিলেন। সে রেনেসাঁর প্রভাব তার পূর্ববর্তীদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। মীর মোশাররফ হোসেন, কবি কায়কোবাদ, মওলানা আকরাম খাঁ, কবি সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক, ভোলার কবি মোজাম্মেল হক প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণের মধ্যে। গোলাম মোস্তফার বিশেষত্ব এই যে তাতে রাবীন্দ্রিক বলয়ের ছাপ ছিল প্রবল। আমাদের ছেলেবেলায় আমরা গোলাম মোস্তফাকেই আমাদের মুসলিম সমাজের একমাত্র জাতীয় কবি বলে শ্রদ্ধা করতাম। ইসলাম ধর্মের প্রতি প্রিয় রসূলের (স) প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা। এজন্য নজরুল ইসলামের বিশ্ববিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’র বিরুদ্ধে তিনি অপর একটি কবিতাও লিখেছিলেন। এক্ষেত্রে তার সহযোগী ছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। নজরুলের নিকট তার সে পত্রে বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কবি জীবনের সূচনা থেকেই তিনি মুসলিম সমাজের নানা দুঃখদুর্দশার চিত্র অঙ্কিত করেছেন এবং সমগ্র বিশ্বে মুসলিম জীবনে যে অধোগতি দেখা দিয়েছে তাতে তার অন্তর ব্যথিত হয়েছে। ‘ভাঙা বুক’ নামক গল্পে তার পরিচয় সুস্পষ্ট। তবে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা দেখা দিয়েছে বিশ্বনবী নামক আল্লাহর রসূলের (স) জীবনচরিত লেখায় । এতে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খান কর্তৃক মোস্তফা হযরত রসূলে আকরম (স)-এর মিরাজকে অস্বীকার করে যেসব উক্তি করা হয়েছে তার তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে। এতে তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের আশ্রয়ে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। হযরতের জীবনী সম্বন্ধে বাংলা, ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষায় যেসব গ্রন্থ এ যাবত লিখিত ও প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে এ গ্রন্থখানা শীর্ষস্থানীয় বলে গণ্য হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে তিনি ঢাকাতে গোলাম মঞ্জিল নামক একখানা আবাস তৈরি করে তাতে স্থায়ীভাবে বাস করার পরে তার সঙ্গে জগৎ, জীবন, ধর্ম, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়েছে। তাঁরই ভক্ত তালিম হোসেন প্রমুখ সাহিত্যিকগণের সঙ্গে তাঁর পূর্বোক্ত বাড়িতে যোগদানের সুযোগ হতো। এ সকল সভায় কবি সুফিয়া কামাল ও তাঁর স্বামী মরহুম কামাল উদ্দিনও যোগদান করতেন। এতে স্পষ্ট বুঝা যেতো তিনি এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কামনা করেন যাতে ইসলামের মূল্যমানগুলো রক্ষিত হয়। তবে জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে তৎকালীন আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। পরিণত বয়সে গোলাম মোস্তফাও তার এ ভুল বুঝতে পেরে ত্রুটি স্বীকার করতেন। তিনি ঢাকাতে এসে স্থায়ী নাগরিক হওয়ার পরে ‘নওবাহার’ বলে একখানা মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। তাতে উচ্চাঙ্গের প্রবন্ধ আধুনিক সমাজের রোমান্টিক গল্প প্রভৃতিও প্রকাশিত হতো। গোলাম মোস্তফা নানা ছন্দেরও প্রবর্তন করেছেন। তিনি একজন অতি উচ্চ স্তরের পিয়ানো বাদকও ছিলেন। পরিণত বয়সে তিন ইংরেজ কবি মিলটনের অনুসরণে ‘বনি আদম’ বলে একখানা মহাকাব্য প্রণয়নে রতো ছিলেন। তবে তা শেষ করে যেতে পারেননি। তিনি আমাদের সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর নানা অবদান রেখে গেছেন । তিনি পূর্বোক্ত রেনেসাঁর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের সাহিত্যে ইসলামের মানবতাবোধ সম্বন্ধে যে প্রেরণা দিয়েছিলেন তার ফলেই আমরা পেয়েছি সাত সাগরের মাঝির’ অপূর্ব স্রষ্টা কবি ফররুখ আহমদকে। ইসলাম এ দুনিয়ায় যে মানবতা প্রচার করেছে এবং তার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে সে মানবতাবোধ এ দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হলে এ দুনিয়াতে জাতিতে জাতিতে এতো মারামারি হানাহানি হতো না। গোলাম মোস্তফার জীবনে সে মানবতাবোধ ছিল অনন্ত।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত