প্রথম কিস্তি :
মানুষের জীবন বড় বিচিত্র! বড় আজব!! বড় রহস্যময়!!!
একটা সময় ছিল, তখন ভাবতাম জীবনের হিসেবটা বড় সাদামাটা : ভাল পড়াশুনা, ভাল চাকরি আর তারপর সংসার— এই তো জীবন।
কিন্তু আজ যখন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব কষতে শিখলাম, প্রশ্ন করতে শিখলাম আমি আসলে কী চাই; তখন, তখন চেয়ে দেখি, জীবন মোটেই ততটাও সরল নয়; এ যেন গাণিতিক কোন জটিল সমীকরণের মতো শর্পিল ভঙ্গিতে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলা এক অন্তহীন অভিযাত্রা। এ যাত্রায় প্রতিটি বাঁকে মুখোমুখি হতে হয় অকল্পিত-অপ্রত্যাশিত সব গল্পের, যা বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার স্বাদ পাইয়ে দেয় : যে মানুষটাকে ছাড়া একসময় চলতোই না; আজ তার ফোন নম্বরটাই আর খোঁজা হয় না! যে স্বপ্নটা ছিল হৃদয়ের এক্কেবারে গভীরে; আজ সেটি চেনা মনে হয় না আর! আর সেই যে সন্ধ্যা, যেটি কেটেছিল প্রিয়তম বন্ধুর সাথে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মুহূর্তে, সেটিই আজ রয়ে গেছে সারাজীবনের সবচেয়ে ধূসর-মলিন স্মৃতি হয়ে! এই তো জীবন।
এভাবেই জীবন আমাদের শেখায়, শেখায়— সব কিছু ধরে রাখা যায় না, সব কিছু থাকে না; অনেক কিছু ফসকে যায় আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে। সব উত্তর থাকাও জরুরী নয়; কিছু অসম্পূর্ণতা নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। এই সমস্ত অমিল, অতৃপ্তি, অস্পষ্টতা মিলে-গড়েই তো জীবন। এবং হ্যাঁ, এই কারণেই জীবন বড় বিচিত্র— এতটা জীবন্ত।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়, অতীত কি সত্যিই মুছে যায় জীবন থেকে? নাকি তা রক্তের মতো শিরা-উপশিরায় আজীবন বইতে থাকে, ধরা না দিলেও কখনো ছেড়ে যায় না?
আজ এক অদ্ভূত ব্যাকুলতা আমার ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন জানালার পর্দার মতো অকারণেই হাওয়ায় দুলছে, কাঁপছে। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে এক চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস— যেন কোন হারিয়ে যাওয়া সময় নিজের ছায়া টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমার সামনে। আমি থেমে যাই। নিজের ভেতরে তাকাই। চেয়ে দেখি— কিছু মুখ, কিছু শব্দ, কিছু নিরবতা— যেগুলো হারিয়ে গেছে, অথচ কোথাও কখনো হারায় নি; আমার ভেতরে রয়ে গেছে ছায়ার মতো— কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট।
আমি আজ আপনাদের সেই গল্পটাই বলতে চাই। আমার এই গল্পের যে চরিত্রটি রয়েছে তাকে আমি লীলাবতী বলে ডাকব। সে আমার জীবনে এক ছায়াময় উপস্থিতি। সেই ছায়ার আগমন হয়েছিল এক রাতে, এক অচেনা মেসেজে— “আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছেন?” হয়তো সেটাই ছিল শুরু, অথবা দীর্ঘতর বিষাদের পূর্বাভাস। সেই রাত, সেই অনুরণন, সেই পরিচয়ের অচেনা ঝিলিক… সেখান থেকেই শুরু হলো আমার এক অন্যতর যাত্রা— লীলাবতীর যাত্রা।
(ক)
রাত তখন প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই। ঘরের বাতির আলোয় বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো যেন নিঃশব্দে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এদিকে ক্লান্তিও চুপিসারে এসে ভর করছে চোখের কোণে। হাতে বইটা ধরা থাকলেও মনটা উড়ে চলে যাচ্ছে দূরে। হঠাৎ ফোনের পর্দা আলতো কেঁপে উঠল। ঘরের নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে উঠে এলো এক ক্ষীণ কম্পন। নোটিফিকেশন বারে চেয়ে দেখলাম— “আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছেন?” অদ্ভূত অচেনা নাম। অজানা ছবি। প্রথমে মনে হলো, উত্তর না দেওয়াই ভাল। কিন্তু প্রোফাইল ঘেঁটে দেখে এক অদ্ভূত কৌতূহল আঙুলটাকে থমকে দিল মেসেজ অপশনে। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ চুপচাপ থেকে লিখলাম— “ওয়ালাইকুম আসসালাম! জ্বি, আছি ভাল। কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না তো!”
অবিলম্বে উত্তর এলো— “আমি আপনার এক ছোট ভাই।”
“ছোট ভাই! সরি, চিনতে পারছি না।”
“আমায় আপনি চিনবেন না, চেনার কথাও না। তবে আমি আপনাকে জানি। আপনার শব্দগুলো পড়ে আপনাকে বুঝবার চেষ্টা করি। আপনি আমার ভিতরে কিছু জাগিয়ে তুলেছেন, তাই কথা বলার ইচ্ছে হলো।”
আমার জীবন বরাবরই গুছানো, হিসেবি— এভাবে হঠাৎ কেউ ঢুকে পড়া আমার দৈনন্দিনের অভ্যস্ততায় একেবারেই বেমানান। তবু সেই রাতে কোথা থেকে যেন একটা শূন্যতা চুপিচুপি জেগে উঠেছিল। আমি চুপ করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর টাইপ করে পাঠালাম— “তবে বলুন, কী কথা বলতে চান?”
অপেক্ষা দীর্ঘ হলো না; সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো— “আসলে সেভাবে বলার কিছু নেই। তবে জানেন কি, মাঝে-মাঝে আমরা কেউ কেউ নিঃসঙ্গতার একদম কিনারায় এসে দাঁড়াই, আর ভাবি, এই মুহূর্তে যদি নিজের ভিতরের গল্প বলা যেত। আপনি তেমনই একজন অচেনা মানুষ, যার লেখাগুলো পড়ে মনে হয়, হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন নিঃসঙ্গতার অর্থ।”
এই কথাগুলো এক ঝটকায় আমাকেও টেনে নিল নিজের ভেতরে। আমিও তো মন খুলে বলতে চাই না বলা কথা, ভাঙা স্বপ্ন, গুমরে ওঠা দীর্ঘশ্বাস…। আমার অজান্তেই এক ধরণের অদ্ভূত মায়া খেলে গেল তার উপর। লিখলাম— “ঠিক আছে, বলুন, শুনছি।”
তারপর একের পর এক মেসেজ আদান-প্রদান হতে থাকলো। সেই ছিল শুরু। সেই এক রাত, সেই বার্তালাপ— জীবনের কত কিছুই না বদলে দিল।
সেই রাত, সেই আলাপন শেষ পর্যন্ত ঠিক কী ছিল, তা আজও আমি জানি না। বন্ধুত্ব? না নিঃসঙ্গতার আয়নায় একে অপরকে খুঁজে ফেরা? তবে এটুকু জানি, সেদিন রাতের পরে আমার জীবনের পথরেখায় আর একটি মোড় তৈরি হলো। আর সেই মোড়ে দাঁড়িয়ে আমি তাকে একটা নাম দিলাম— লীলাবতী।