proggapath, progga, bangla literature, প্রজ্ঞাপাঠ, বাংলা সাহিত্য, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, প্রজ্ঞা, গল্প, বাংলা গল্প, রহস্য গল্প, রম্য রচনা, শিল্প-সাহিত্য, Story, golpo, Art and literature, মুহাম্মদ আশিক, Muhammad Ashik, লীলাবতী, lilaboti

লীলাবতী

০ মন্তব্য দর্শক

চতুর্থ কিস্তি :

(ঘ)

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে হেলে পড়ছে সূর্য্যরে আলো। গোসল সেরে, খেয়ে উঠে বিছানায় শরীরটা একটু এলিয়ে দিই। জানালার পর্দা হালকা বাতাসে ধীরে ধীরে দুলছে— এক অজানা নিসঙ্গতা ঘিরে ধরেছে আমাকে। মননটা উদাস। চোখ বন্ধ করে, কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছি—

যে তৃষা জাগিলে তোমারে হারাবো
সে তৃষা আমার জাগায়ো না।
যে ভালোবাসায় তোমারে ভুলিব
সে ভালোবাসায় ভুলায়ো না।
যে জ্ঞানের দ্বীপ তোমারে লুকায়
সে জ্ঞানের দ্বীপ জ্বালায়ো না।
যে যাতনা পেলে তোমারে লভিব
সে যাতনা মোর হরিও না।
যে নেশা আমার তোমা ছাড়া করে
সে নেশা আমার জাগায়ো না।
যে সুখ লভিলে তোমারে ভুলিব
সে সুখ সাগরে ভাসায়ো না।
যে কথার মাঝে তব কথা নাই
সে কথা আমায় শুনায়ো না।
যে আঁখি ঝরিলে তোমারে লভিব
সে আঁখির ধারা মুছায়ো না।

প্রথমবার শুনছি এমটা নয়, কিন্তু আজ যেন গানের এই কথাগুলো হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ছে। কী গভীর আকুতি! কী নির্মম-সত্য সতর্কবাণী!
আমি আনমনে শুনতে থাকি। মনে হয়, এ যেন কেবল গানের কথা নয়; এ আমার নিজের মনের কথা, যেটা আমি নিজেই কখনো শুনিনি। আমি নিজেকে বলি— ‘হে আমার আত্মা, এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? এত আলো, এত জ্ঞান, এত প্রেম— সব পেয়েও কি সেই এক শূন্যতা পূরণ হয় নি? তুমি তো জান, ঠিক কোন তৃষ্ণা তোমায় তৃষিত করে, কোন ভালোবাসা তোমার আর সব ভালবাসাকে তুচ্ছ করে ফেলে। তবু তুমি চেয়েছ, চেয়েছ এমন সবকিছু— যা পার্থিব, ক্ষণস্থায়ী, বিভ্রান্তিকর। তুমি কেন সেই বিভ্রমে এখনো পড়ে আছ?’
আমি অনুভব করি, এ গান যেন মনে করিয়ে দেয়, আমি আসলে এক বেখায়াল আত্মা— যে রবকে ভুলে গিয়ে নিজেই নিজের চোরাগলিতে হারিয়ে গেছে। গানটা আমার ভেতরে মায়ার পর্দাগুলো একে একে সরিয়ে দেয়।
বলতে ইচ্ছে হয়— ‘হে পরম! তুমি এমন কিছু দিও না, যা আমায় তোমার থেকে সরিয়ে দেয়। আমায় সেই যন্ত্রণা দাও, যা তোমার নিকটে টানে। সেই অভাব দাও, যা তোমার প্রার্থনায় পৌঁছে দেয়। সেই অশ্রু দাও, যা ঝরলে তোমার পায়ের কাছে পৌঁছে যাই।
পৃথিবীতে মানুষের কত চাওয়া, কত আকাঙ্খা! কিন্তু দিনশেষে যদি তাতে রবের প্রেম ও স্মরণ না থাকে, তবে সে কিসের চাওয়া? তবে সেই তো জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়।
এইসব ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ফোনে নরম কাঁপুনি। স্ক্রিনে চেয়ে দেখি লীলাবতীর মেসেজ— “গুরুজী, আছেন?”
হালকা একটা হাসি এসে পড়ে ঠোঁটের কোণে। বললাম— “হুম আছি, গান শুনছি।”
“গান! কী গান শুনছেন?”
“যে তৃষা জাগিলে তোমারে হারাবো
সে তৃষা আমার জাগায়ো না।…”
আমি গানের লিঙ্ক পাঠিয়ে দেই সঙ্গে সঙ্গে।
“ভয়ানক গভীর কথা। আমি মাঝে মাঝে শুনি। শুনলেই বুকের ভেতর কিছু একটা নড়ে ওঠে। মনশুদ্ধ হয়। অন্তত আমার তো তাই লাগে। আপনার মনে পড়বে হয়তো, আমি একদিন আপনাকে বলছিলাম, ‘কবরস্থানে দাঁড়িয়ে আছি, আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিব।…’ এই গানটা সেদিন প্রথম শুনে ব্যাকুল হয়েছিলাম। গানটার প্রতিটা শব্দে তখন মনে হচ্ছিল, যেন আমার নিজের মনের কথা। আমি বুঝতে পারছিলাম, জীবনের এত দুঃখ, এত ব্যর্থতা, এত টানাপোড়েন— এই সব কিছুর উর্ধ্বে আমি যেন কাউকে খুঁজে ফিরছি। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না!
এই গানটা সেই অপূর্ণতা এত নিখুঁতভাবে বলে দেয় যে, তখন মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীর কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে— একদম নিঃশব্দ কোন জায়গায়।
আর নিঃশব্দ জায়গা মানেই তো কবরস্থান। সেই রাতে আমি চেয়েছিলাম, একবার অন্তত আমার ভেতরের আর্তিটা একা শুনি— কোন শব্দ, কোন আলো বা মানুষের চোখ ছাড়াই।
গানটা যেন আমাকে বলেছিল— ‘তুমি নিজের ভেতরের সেই শূন্যতায় গিয়ে দাঁড়াও, দেখো, তুমি যাকে খুঁজছো হয়তো সে সেখানেই আছে।’
আমি চুপ করে থাকি। জানি, লীলাবতীর এই অদ্ভূত কথাগুলোই তাকে আলাদা করে রেখেছে। লিখি— “তোমার সেই একাকীত্বের সাথে এই গানটার মিল ছিল হয়তো। এই গান তো এক প্রার্থনাই।”
সে টাইপ করে— “আপনি যে কীভাবে আমার মনের ভিতরে ঢুকে পড়েন! হয়তো এই কারণেই আপনি আমার গুরু।”
আমি আর কিছু লিখি না। মাথার উপর ফ্যানের ঘূর্ণনের শব্দে মিশে যায় কথার মানে।
লীলাবতী আবার জিজ্ঞেস করে— “আপনার পড়াশুনার কী খবর, গুরুজী? আপনার দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা তো সামনে, তাই না?”
“হুম, পরীক্ষা তো সামনেই। কিন্তু পড়াশুনার অবস্থা ভাল না, পড়ায় মন বসে না। আল্লাহ মাবুদ জানেন রেজাল্টের পর এবার বাড়ি থেকে বের দেয় কিনা! তখন হয়তো রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে বসে সাহিত্য চর্চা করতে হবে। হা-হা-হা!
যাকগে তোমার খবর বলো, তোমার মেডিকেল পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?”
“চেষ্টার ত্রুটি করছি না এতটুকু। তবে জানেন গুরুজী, মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়, আমি পারবো তো।”
“পারবে পারবে, তোমার উপর আমার খুব বিশ্বাস আছে।”
“আপনার কথা শুনলে বুকে ভরসা পাই। আসলে আপনি না থাকলে আমার সবকিছু হয়তো আরও বেশী অন্ধকার হয়ে যেত।”
আমি নিঃশ্বাস ফেলি। মনে মনে ভাবি— ‘এই ছেলেটা কি আমায় আচার্য দ্রোণের আসনে বসিয়ে নিজেকে একলব্য ভাবতে শুরু করেছে?’

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

লীলাবতী

দর্শক

চতুর্থ কিস্তি :

(ঘ)

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে হেলে পড়ছে সূর্য্যরে আলো। গোসল সেরে, খেয়ে উঠে বিছানায় শরীরটা একটু এলিয়ে দিই। জানালার পর্দা হালকা বাতাসে ধীরে ধীরে দুলছে— এক অজানা নিসঙ্গতা ঘিরে ধরেছে আমাকে। মননটা উদাস। চোখ বন্ধ করে, কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছি—

যে তৃষা জাগিলে তোমারে হারাবো
সে তৃষা আমার জাগায়ো না।
যে ভালোবাসায় তোমারে ভুলিব
সে ভালোবাসায় ভুলায়ো না।
যে জ্ঞানের দ্বীপ তোমারে লুকায়
সে জ্ঞানের দ্বীপ জ্বালায়ো না।
যে যাতনা পেলে তোমারে লভিব
সে যাতনা মোর হরিও না।
যে নেশা আমার তোমা ছাড়া করে
সে নেশা আমার জাগায়ো না।
যে সুখ লভিলে তোমারে ভুলিব
সে সুখ সাগরে ভাসায়ো না।
যে কথার মাঝে তব কথা নাই
সে কথা আমায় শুনায়ো না।
যে আঁখি ঝরিলে তোমারে লভিব
সে আঁখির ধারা মুছায়ো না।

প্রথমবার শুনছি এমটা নয়, কিন্তু আজ যেন গানের এই কথাগুলো হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ছে। কী গভীর আকুতি! কী নির্মম-সত্য সতর্কবাণী!
আমি আনমনে শুনতে থাকি। মনে হয়, এ যেন কেবল গানের কথা নয়; এ আমার নিজের মনের কথা, যেটা আমি নিজেই কখনো শুনিনি। আমি নিজেকে বলি— ‘হে আমার আত্মা, এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? এত আলো, এত জ্ঞান, এত প্রেম— সব পেয়েও কি সেই এক শূন্যতা পূরণ হয় নি? তুমি তো জান, ঠিক কোন তৃষ্ণা তোমায় তৃষিত করে, কোন ভালোবাসা তোমার আর সব ভালবাসাকে তুচ্ছ করে ফেলে। তবু তুমি চেয়েছ, চেয়েছ এমন সবকিছু— যা পার্থিব, ক্ষণস্থায়ী, বিভ্রান্তিকর। তুমি কেন সেই বিভ্রমে এখনো পড়ে আছ?’
আমি অনুভব করি, এ গান যেন মনে করিয়ে দেয়, আমি আসলে এক বেখায়াল আত্মা— যে রবকে ভুলে গিয়ে নিজেই নিজের চোরাগলিতে হারিয়ে গেছে। গানটা আমার ভেতরে মায়ার পর্দাগুলো একে একে সরিয়ে দেয়।
বলতে ইচ্ছে হয়— ‘হে পরম! তুমি এমন কিছু দিও না, যা আমায় তোমার থেকে সরিয়ে দেয়। আমায় সেই যন্ত্রণা দাও, যা তোমার নিকটে টানে। সেই অভাব দাও, যা তোমার প্রার্থনায় পৌঁছে দেয়। সেই অশ্রু দাও, যা ঝরলে তোমার পায়ের কাছে পৌঁছে যাই।
পৃথিবীতে মানুষের কত চাওয়া, কত আকাঙ্খা! কিন্তু দিনশেষে যদি তাতে রবের প্রেম ও স্মরণ না থাকে, তবে সে কিসের চাওয়া? তবে সেই তো জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়।
এইসব ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ফোনে নরম কাঁপুনি। স্ক্রিনে চেয়ে দেখি লীলাবতীর মেসেজ— “গুরুজী, আছেন?”
হালকা একটা হাসি এসে পড়ে ঠোঁটের কোণে। বললাম— “হুম আছি, গান শুনছি।”
“গান! কী গান শুনছেন?”
“যে তৃষা জাগিলে তোমারে হারাবো
সে তৃষা আমার জাগায়ো না।…”
আমি গানের লিঙ্ক পাঠিয়ে দেই সঙ্গে সঙ্গে।
“ভয়ানক গভীর কথা। আমি মাঝে মাঝে শুনি। শুনলেই বুকের ভেতর কিছু একটা নড়ে ওঠে। মনশুদ্ধ হয়। অন্তত আমার তো তাই লাগে। আপনার মনে পড়বে হয়তো, আমি একদিন আপনাকে বলছিলাম, ‘কবরস্থানে দাঁড়িয়ে আছি, আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিব।…’ এই গানটা সেদিন প্রথম শুনে ব্যাকুল হয়েছিলাম। গানটার প্রতিটা শব্দে তখন মনে হচ্ছিল, যেন আমার নিজের মনের কথা। আমি বুঝতে পারছিলাম, জীবনের এত দুঃখ, এত ব্যর্থতা, এত টানাপোড়েন— এই সব কিছুর উর্ধ্বে আমি যেন কাউকে খুঁজে ফিরছি। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না!
এই গানটা সেই অপূর্ণতা এত নিখুঁতভাবে বলে দেয় যে, তখন মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীর কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে— একদম নিঃশব্দ কোন জায়গায়।
আর নিঃশব্দ জায়গা মানেই তো কবরস্থান। সেই রাতে আমি চেয়েছিলাম, একবার অন্তত আমার ভেতরের আর্তিটা একা শুনি— কোন শব্দ, কোন আলো বা মানুষের চোখ ছাড়াই।
গানটা যেন আমাকে বলেছিল— ‘তুমি নিজের ভেতরের সেই শূন্যতায় গিয়ে দাঁড়াও, দেখো, তুমি যাকে খুঁজছো হয়তো সে সেখানেই আছে।’
আমি চুপ করে থাকি। জানি, লীলাবতীর এই অদ্ভূত কথাগুলোই তাকে আলাদা করে রেখেছে। লিখি— “তোমার সেই একাকীত্বের সাথে এই গানটার মিল ছিল হয়তো। এই গান তো এক প্রার্থনাই।”
সে টাইপ করে— “আপনি যে কীভাবে আমার মনের ভিতরে ঢুকে পড়েন! হয়তো এই কারণেই আপনি আমার গুরু।”
আমি আর কিছু লিখি না। মাথার উপর ফ্যানের ঘূর্ণনের শব্দে মিশে যায় কথার মানে।
লীলাবতী আবার জিজ্ঞেস করে— “আপনার পড়াশুনার কী খবর, গুরুজী? আপনার দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা তো সামনে, তাই না?”
“হুম, পরীক্ষা তো সামনেই। কিন্তু পড়াশুনার অবস্থা ভাল না, পড়ায় মন বসে না। আল্লাহ মাবুদ জানেন রেজাল্টের পর এবার বাড়ি থেকে বের দেয় কিনা! তখন হয়তো রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে বসে সাহিত্য চর্চা করতে হবে। হা-হা-হা!
যাকগে তোমার খবর বলো, তোমার মেডিকেল পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?”
“চেষ্টার ত্রুটি করছি না এতটুকু। তবে জানেন গুরুজী, মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়, আমি পারবো তো।”
“পারবে পারবে, তোমার উপর আমার খুব বিশ্বাস আছে।”
“আপনার কথা শুনলে বুকে ভরসা পাই। আসলে আপনি না থাকলে আমার সবকিছু হয়তো আরও বেশী অন্ধকার হয়ে যেত।”
আমি নিঃশ্বাস ফেলি। মনে মনে ভাবি— ‘এই ছেলেটা কি আমায় আচার্য দ্রোণের আসনে বসিয়ে নিজেকে একলব্য ভাবতে শুরু করেছে?’

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত