শেষ কিস্তি :
(ঙ)
এমনি করতে করতে করতে একদিন লীলাবতী হারিয়ে গেল। কোথায়, কেমন করে তা আমি জানি না। তবে তার চলে যাওয়াটা যেন কোন আগাম সংকেতহীন বিপর্যয়— একটা শব্দহীন ধ্বস!
একদিন হঠাৎ করেই লীলাবতী মেসেজ করা বন্ধ করে দিল। প্রথমে ভাবলাম— হয়তো ব্যস্ত আছে, অথবা…। এর আগেও তো এমন হয়েছিল। আমি ভাবলাম সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এবার সময় যেন থেমে গেল। আমি তখনও বুঝিনি সেদিনের মতো দীর্ঘ নীরবতা এর আগে কখনো আসেনি।
একটা দিন গেল। তারপর আর একটা। রাত আসতো, নিঃশব্দে ভোর হতো— তবু লীলাবতীর কোন শব্দ ফেরত আসতো না। এক সপ্তাহ পরেও না, এক মাস পরেও না।
আমার মন তখন একটা অসহ্য শূন্যতায় ডুবে যেতে লাগল। নিঃসঙ্গতা আর প্রশ্ন এই দুই মিলে এক অন্ধকার গলিপথ তৈরি করে আমায় যেন গিলে ফেলল।
ফেসবুক খুললেই মনে হতো তার প্রোফাইলটা যেন একটা মৃত স্ট্যাচু— যেখানে আগে শব্দ ছিল, সাড়া ছিল, এখন সেখানে কেবল স্তব্ধতা আর স্তব্ধতা।
তার প্রোফাইলটা যেন একটা শোকপতাকা— একটা ভারী ধূলিধূসর কভার, যেটা খুললেই কেবল স্মৃতির রক্তক্ষরণ। তাকে হারানো ছিল, নিজের ভিতরেই একটা আস্ত মানুষকে সমাধিস্থ করা।
তারপর বহুদিন পর, এক সন্ধ্যায় ডাকবাক্সে একটা চিঠি পেলাম। খামটা খুলতেই বুঝে ফেললাম সে শব্দহীন কণ্ঠস্বর হয়ে ফিরে এসেছে কাগজের শরীরে :
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ!
আপনি কেমন আছেন, আমি জানি না। অনেকদিন হয়ে গেল আমরা কথা বলি নি— এবং আমি তা ইচ্ছাকৃতই হতে দিয়েছি। সচেতনভাবেই দূরত্ব তৈরি করেছি। আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন, অথবা নিজেকে বোঝাতে চেয়েছেন আমি দূরে সরে গেছি।
আজ হঠাৎ করে এই চিঠি লিখছি, কারণ কিছু সম্পর্কের সব কথা কখনোই শেষ হয় না; বাকি থেকে যাওয়া কিছু কথা রয়ে যায়, সময়মতো বলা হয়ে ওঠে না— আজ আমি সেই না বলা কথাগুলোই বলবো।
আমি জানি আমার আচরণে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। এবং হ্যাঁ, আমি জানি— সে কষ্ট আমি এড়িয়ে যেতে পারি না। তবে এটুকু বুঝুন, আমি আপনার থেকে সরে এসে এক অসহ্য-অন্তহীন যন্ত্রনায় ডুবে ছিলাম। আপনার স্নেহ-ভালবাসা আমার জীবনে যে কিরকম আশ্রয়ের মতো ছিল, তা ভাষায় বলে বোঝানোর মতো নয়— আপনার কথা, আপনার উপস্থিতি, আপনার মনোযোগ এসব কিছু ছিল আমার জীবনের আলো।
তবু আমি দূরে সরে এসেছি। কেন? কারণ আমি নিজেকে অভিশপ্ত মনে করি। আমার জন্মের পর মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, বাবা চাকরি হারিয়েছেন— আমার অস্তিত্বই যেন আমাদের পরিবারের দুর্ভাগ্যের শুরু।
বুবুর স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হব। আমিও স্বপ্ন দেখতাম একদিন ডাক্তার হয়ে মাকে সুস্থ করবো, আপনাকে গর্বিত করবো, নিজেকে প্রমাণ করবো— ভেবেছিলাম, এই সাফল্যের মধ্য দিয়ে হয়তো নিজেকে মুক্ত করতে পারবো সেই অভিশপ্ত জীবন থেকে।
কিন্তু আমি পারি নি। আমি ব্যর্থ হয়েছি। মেডিকেলে পড়তে পারলাম না। আর এই ব্যর্থতার সাথে যেন সমস্ত আশ্রয়ও ঝরে গেল— পরিবারের ভেতর থেকেও একটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হলো। জীবনটা হয়ে উঠল এক নিঃসঙ্গ শূন্যতা। তখন, সত্যি বলছি, আত্মহত্যার চিন্তা বহুবার ঘিরে ধরেছিল আমায়। কিন্তু পারিনি। কেন পারিনি, জানি না। হয়তো আল্লাহর রহমত ছিল, তিনি চাননি আমি আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপে জড়িয়ে পড়ি।
আমি জানতাম, আপনি যদি আমার এই অবস্থার কথা জানতে পারেন, আপনি ব্যথা পাবেন। তাই আমি চাই নি আমার কষ্ট আপনাকে স্পর্শ করুক— আমার জীবনের অন্ধকার যেন আপনার আলোকিত পথে ছায়া না ফেলে। আমার মনে হতে লাগল, আপনার মতো এক আলোকিত মানুষকে এক অভিশপ্ত ছায়া স্পর্শ করলে সেটা অন্যায় হবে।
আপনি আমার জীবনে আশীর্বাদ ছিলেন— সেটা এখনো সত্য। আর আমি? আমি সেই মানুষ, যে জানত— এই আশীর্বাদ তার ভাগ্যে লেখা নাই।
আমি বিশ্বাস করি, আপনি যদি আমার পাশে থাকতেন, আমি হয়তো অন্য মানুষ হয়ে উঠতাম। কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে আপনার জগতের অযোগ্য ভেবেছি। তাই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি, কোন শব্দ না ফেলে নিঃশব্দে চলে গেছি— যাতে আপনি অন্তত আমাকে সেই সময়টার জন্য মনে রাখেন— যখন আমরা দুজনেই আলোয় মোড়ানো একটি মুহূর্তে বেঁধে গেছিলাম।
এখন আমি অন্য এক শহরে থাকি। রাতে একা হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে অনেকবার কবরস্থানে গিয়ে থেমে যাই— যেখানে আমার ভেতরের অশ্রু আর অভিশাপ একান্তে বিশ্রাম নেয়। আমি চাই না সেই অভিশাপের ছায়া আপনার গায়ে লাগুক। আপনি তো আগুন নন, আপনি আলো। আর আলোর উপর ছায়া পড়ে না— পড়লে তা অসুন্দর লাগে।
আপনার প্রতি এখনো শ্রদ্ধা আছে। ভালবাসি না— একথা বলবো না।
আপনার পরিবারের সবার জন্য দোয়া রইল। আপনার মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই যেন সুস্থ, শান্তিপূর্ণ জীবন পান। আর আপনি যেন এমন একটা জীবন কাটান, যেখানে আপনাকে নিয়ে গর্ব করা যায়।
আর যদি পারেন— আমায় ভুলে যাবেন। ভুলে গেলে আমার অভিশাপের ছায়া আপনার গায়ে লাগবে না। ভালো থাকবেন। আল্লাহ আপনার সহায় হোন।
— সেই মানুষ
চিঠিটা পড়ে আমি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানি সে কাঁদেনি, আমিও কাঁদিনি— তবু চারপাশে যেন এক অব্যক্ত কান্না ভেসে বেড়াচ্ছিল— নিরব, অতল।
সে ভুলে যেতে বলেছে। আমি জানি না তাকে ভুলতে পারব না কিনা। তবে আমি এটুকু বুঝি, সে নিজেকে দেখেছে একটা অভিশপ্ত ছায়া হিসেবে— যে নিজের প্রিয়জনকে ছুঁয়ে দাগ ফেলতে চায় না। এত নিঃস্ব, তবু কি মর্যাদাপূর্ণ সিদ্ধান্ত!
কতখানি নিঃস্ব হলে মানুষ এমন মর্যাদার সাথে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে? কতখানি কষ্ট পাড়ি দিলে কেউ এমনভাবে ভালোবাসতে শেখে— দূরে থেকে রক্ষা করতে চায় যাকে সে ভালোবাসে?
তার না থাকাটা এখন আমার জীবনের এক নিঃশব্দ অধ্যায়। কখনো কখনো রাতে আমি সেই চিঠিটা খুলে পড়ি। কোনো শব্দ উচ্চারণ করি না, তবু শ্বাসের ভেতর এক নাম ধরা পড়ে— লীলাবতী।
হ্যাঁ, আমি তাকে লীলাবতী নামেই ডাকলাম। এই নামটা আমি তাকে দিয়েছি— কারণ, কারণ সে আমার চোখে এক অপূর্ব লীলা’র প্রতিফলন, এক নির্মল সম্ভাবনার প্রতীক, যা ফোটার আগেই নিভে গেল!
“লীলাবতী” আমার কাছে কেবল এক নাম মাত্র নয়— সে এক প্রতীক। হারিয়ে যাওয়া সেই সকল মানুষের নাম, যাদের সমাজ প্রতিদিন নিঃশব্দে গলিয়ে দেয়; যারা সম্ভাবনার শিখরে ওঠার আগেই তলিয়ে যায় দারিদ্র্য-অবহেলা আর আত্মবিস্মৃত সমাজের কঠোর কুটিল চাহনির অগ্নিস্রোতে।
সে পারত ডাক্তার হতে, আলো ছড়াতে। কিন্তু সমাজ তাকে ভালোবাসেনি— বরং সমাজ তার জন্মের পর থেকে পরিবারের প্রতিটি দুর্ভাগ্য, প্রতিটি ব্যর্থতার দায় চাপিয়েছে তার কাঁধে। যেন সে মানুষ নয়, এক অভিশাপ। এত অবলীলায়, এত নিশ্চিন্তে তাকে দোষী করে তোলা হয়েছিল, যে একসময় সে নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করে— তার জন্মই বুঝি এক অপরাধ!
সমাজের এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে তার চলার পথ ছিল কঠিন। সুযোগের অভাব, পরিবারের চাপ, নিজস্ব মনস্তাত্ত্বিক সংকট— এসব মিলেই তার স্বপ্নগুলোকে ঘিরে এক অদ্ভুত বৃত্ত তৈরি করেছিল, যা তাকে পিছনে টেনে নিয়ে গেছে।
কিন্তু আমি বলছি, সে ব্যর্থ মানুষ ছিল না। বরং তার ভেতরে ছিল এক উজ্জ্বল আলো, যা জ্বলবার সুযোগ পায়নি। আর আমরাও কখনো সেই আলো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি!
আমি জানি না, এখন সে কোথায় আছে। হয়তো কোনো অন্য শহরের নিঃসঙ্গ গোধূলিতে নিঃশব্দে হাঁটছে, হয়তো কারো গভীর প্রার্থনার ভেতর এক অচেনা নাম হয়ে থেকে গেছে, অথবা কারো বুকের গোপন ভারে রয়ে গেছে— অদেখা হয়ে, অপচয় হয়ে।