নরেশ ও পরেশ। দুইজনে সহোদর ভাই । কিন্তু এক বৃন্তে দুইটি ফুল—এ উপমা ইহাদের সম্বন্ধে খাটে না। আক্বতি ও প্রকৃতি—উভয় দিক দিয়াই ইহাদের মিলের অপেক্ষা অমিলই বেশী। নরেশের চেহারার মোটামুটি বর্ণনাটা এইরূপ—শ্যাম বর্ণ, দীর্ঘ দেহ, খোঁচা খোঁচা চিরুণী সম্পর্ক বিরহিত চুল, গোলাকার মুখ এবং সেই মুখে একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষু, একজোড়া নেউলের লেজের মত পুষ্ট গোঁফ এবং একটি স্বপ্নাগ্র শুকচঞ্চু নাসা।
পরেশ খর্ব্বাকৃতি, ফরসা, মাথার কোকড়ান কেশদাম বাবরি আকারে সুসজ্জিত। মুখটি একটু লম্বা-গোছের, নাকটি থ্যাবড়া। চক্ষু দুইটিতে কেমন যেন একটা তন্ময় ভাব। গোঁফদাড়ি কামানো। গলায় কণ্ঠী কপালে চন্দন।
মনের দিক দিয়া বিচার করিলে দেখা যায় যে, দুইজনেই গোঁড়া একজন গোঁড়া বৈজ্ঞানিক এবং আর একজন গোঁড়া বৈষ্ণব। অত্যন্ত নিষ্ঠা- সহকারে নরেশ জ্ঞানমার্গ এবং পরেশ ভক্তিমার্গ অবলম্বন করিয়াছেন ।
যখন নরেশের ‘কম্বাইন্ড হ্যাণ্ড’ চাকর নরেশের জন্য ‘ফাউল কাটুলেট’ বানাইতে ব্যস্ত এবং নরেশ ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ লইয়া উন্মত্ত তখন সেই একই বাড়ীতে পরেশ স্বপাক নিরামিষ আহার করিয়া যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণে মগ্ন । ইহা প্রায়ই দেখা যাইত।
তাই বলিয়া ভাবিবেন না যে, উভয়ে সর্ব্বদা লাঠালাঠি করিতেন, মোটেই তা নয় ৷ ইঁহাদের কলহ মোটেই নাই। তাহার সুস্পষ্ট কারণ বোধ হয় এই যে, অর্থের দিক দিয়া কেহ কাহারও মুখাপেক্ষী নন ।
উভয়েই এম-এ পাশ—নরেশ কেমিষ্টিতে এবং পরেশ সংস্কৃতে। উভয়েই কলেজের প্রফেসারি করিয়া মোটা বেতন পান । মরিবার পূর্ব্বে পিতা দুইজনকেই সমান ভাগে নগদ টাকাও কিছু দিয়া গিয়াছিলেন। যে বাড়ীতে ইহারা বাস করিতেছেন—ইহাও পৈতৃক সম্পত্তি। বাড়ীটি বেশ বড়। এত বড় যে, ইহাতে দুইতিনটি পরিবার পুত্র-পৌত্রাদি লইয়া বেশ স্বচ্ছন্দে বাস করিতে পারে। কিন্তু নরেশ এবং পরেশের মনে পৃথিবীর অনিত্যতা সম্বন্ধে এমন একটা উপলব্ধি আসিল যে, কেহই আর বিবাহ করিলেন না। পরেশ ভাবিলেন – ‘কা তব কান্তা’—ইহাই সত্য। ‘রিলেটিভিটি’র ছাত্র নরেশ ভাবিতে লাগিলেন …নিৰ্ম্মলা সত্যিই কি মরিয়াছে ? আমি দেখিতে পাইতেছি না— এই মাত্র !
সুতরাং নরেশ এবং পরেশ সহোদর হওয়া সত্ত্বেও ভিন্ন প্রকৃতির এবং ভিন্ন প্রকৃতির হওয়া সত্ত্বেও একই বাড়ীতে শান্তিতে বাস করেন।
এক বিষয়ে কিন্তু উভয়ের মিলও ছিল।
পল্টুকে উভয়ে ভালবাসিতেন। পল্টু তপেশের পুত্র নরেশ এবং পরেশের ছোট ভাই তপেশ। এলাহাবাদে চাকুরি করিত। হঠাৎ একদিন কলেরা হইয়া তপেশ এবং তপেশের পত্নী মনোরমা মারা গেল । টেলিগ্রামে আহূত নরেশ এবং পরেশ গিয়া তাহাদের শেষ কথাগুলি মাত্র শুনিবার অবসর পাইলেন। তাহার মর্ম্ম এই—“আমরা চল্লাম। পল্টুকে তোমরা দেখো ।” পল্টুকে লইয়া নরেশ এবং পরেশ কলিকাতা ফিরিয়া আসলেন। তপেশের অংশে পৈতৃক কিছু টাকা ছিল। নরেশ তাহার অর্দ্ধাংশ পরেশের সন্তোষার্থে রামকৃষ্ণ মিশনে দিবার প্রস্তাব করিবামাত্রই পরেশ এখনে— “বাকী অর্দ্ধেকটা তাহলে বিজ্ঞানের উন্নতিতে খরচ হোক্ !” তাহাই হইল । পল্টুর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাঁহারা ভাবিলেন যে, তাঁহারা নিজেরা যখন কেহই সংসারী নহেন তখন পন্টুর আর ভাবনা কি ?
পল্টু, নরেশ এবং পরেশ উভয়েরই নয়নের মণিরূপে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল । নরেশ কিম্বা পরেশ কেহই নিজের মতবাদ পল্টুর উপর ফলাতে যাইতেন না। পল্টুর যখন যাহা অভিরুচি সে তাহাই করিত। নরেশের সঙ্গে আহার করিতে করিতে যখন তাহার মুর্গী সম্বন্ধে মোহ কাটিয়া আসিত তখন সে পরেশের হবিষ্যান্নের দিকে কিছুদিন ঝুঁকিত ! কয়েকদিন হবিষ্যান্ন ভোজনের পর আবার আমিষ-লোলুপতা জাগিলে নরেশের ভোজনশালায় ফিরিয়া যাইতেও তাহার বাধিত না ।
নরেশ এবং পরেশ উভয়েই তাহাকে কোন নির্দ্দিষ্ট বাঁধনে বাঁধিতে চাহিতেন না—যদিও দুইজনেই মনে মনে আশা করিতেন যে বড় হইয়া পল্টু তাঁহার আদর্শকেই বরণ করিবে।
পল্টুর বয়স ষোল বৎসর। এইবার ম্যাট্রিক দিবে। সুন্দর স্বাস্থ্য— ধপধপে ফরসা গায়ের রঙ – আয়ত চক্ষু । নরেশ এবং পরেশ দুইজনেই সর্বান্তঃকরণে পল্টুকে ভালবাসিতেন। এ-বিষয়ে উভয়ের কিছুমাত্র অমিল ছিল না।
এই পল্টু একদিন অসুখে পড়িল ।
নরেন এবং পরেশ চিন্তিত হইলেন। নরেশ বৈজ্ঞানিক মানুষ, তিনি স্বভাবতঃই একজন এলোপ্যাথিক ডাক্তার লইয়া আসিলেন । পরেশ প্রথমটায় কিছু আপত্তি করেন নাই, কিন্তু যখন উপর্যুপরি সাত দিন কাটিয়া গেল, জ্বর ছাড়িল না তখন তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। নরেশকে বলিলেন— “আমার মনে হয় একজন ভাল কবিরাজ ডেকে দেখালে কেমন হত?”
“বেশ দেখাও—”
কবিরাজ আসিলেন – সাত দিন চিকিৎসা করিলেন জ্বর কমিল না, বরং বাড়িল। পল্টু প্রলাপ বকিতে লাগিল। অস্থির পরেশ তখন নরেশকে বলিলেন, “আচ্ছা, একজন জ্যোভিয়াকে ডেকে ওর কুষ্টিটা – দেখালে কেমন হয় ? কি বল ?”
“বেশ ত! তবে যাই কর এ জ্বর একুশ দিনের আগে কম্বে না। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন—টাইফয়েড !”
“তাই ন৷ কি ?”
পল্টুর কুষ্টি লইয়া ব্যাকুল পরেশ জ্যোতিষীর বাড়ী ছুটিলেন। জ্যোতিষী কহিলেন— “মঙ্গল মারকেশ । তিনি রুষ্ট হইয়াছেন।” কি করিলে তিনি শান্ত হইবেন, তাহার একটা ফদ দিলেন। পরেশ প্রবাল কিনিয়া পল্টুর হাতে বাঁধিয়া মঙ্গলের শান্তির জন্য শাস্ত্রীয় ব্যবস্থাদি করিতে লাগিলেন ।
অসুস্থ কিন্তু উত্তরোত্তর বাড়িয়াই চলিয়াছে । নরেশ একদিন বলিলেন—“কবিরাজি ওষুধেত বিশেষ উপকার হচ্ছে না, ডাক্তারকেই আবার ডাকব না কি ? ”
“তাই ডাক না হয়—”
নরেশ ডাক্তার ডাকিতে গেলেন । পরেশ পল্টুর মাথার শিয়রে বসিয়া মাথায় জলপটি দিতে লাগিলেন । পল্টু প্রলাপ বকিতেছে— “মা আমাকে নিয়ে যাও। বাবা কোথায় !”
আতঙ্কে পরেশের বুকটা কাঁপিয়া উঠিল। হঠাৎ মনে হইল, তারকেশ্বরে গিয়া ধর্না দিলে শুনিয়াছি দৈব ঔষধ পাওয়া যায়। ঠিক !
নরেশ ফিরিয়া আসিতেই পরেশ বলিলেন— “আমি একবার তারকেশ্বর চল্লাম, ফিরতে দু-এক দিন দেরী হবে।”
“হঠাৎ তারকেশ্বর কেন ?”
“বাবার কাছে ধর্না দেব।”
নরেশ কিছু বললেন না ! ব্যস্তসমস্ত পরেশ বাহির হইয়া গেলেন। ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন — “বড় খারাপ টার্ণ নিয়েছে।”
ডাক্তারি চিকিৎসা চলিতে লাগিল।
দিন দুই পরে পরেশ ফিরিলেন। হস্তে একটি মাটির ভাঁড়। উল্লাসিত হইয়া তিনি বলিলেন- “বাবার স্বপ্নাদেশ পেলাম। তিনি বলিলেন যে, রোগীকে যেন ইন্জেকশন দেওয়া না হয় । আর বলবেন, এই চরণামৃত রোজ একবার করে খাইয়ে দিতে, তাহলেই সেরে যাবে। ডাক্তারবাবু আপত্তি করিলেন। নরেশও আপত্তি করিলেন। টাইফয়েড রোগীকে ফুল বেলপাতা পচা জল কিছুতেই খাওয়ান চলিতে পারে না।
হতবুদ্ধি পরেশ ভাগুহস্তে চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিলেন।
আসলে কিন্তু ব্যাপার দাড়াইল অন্যরূপ। পরেশের অগোচরে পল্টুকে ডাক্তারবাবু যথাবিধি ইনজেক্সন দিতে লাগিলেন এবং ইহাদের অগোচরে পরেশ লুকাইয়া পল্টুকে প্রত্যহ একটু চরণামৃত পান করাইতে লাগিলেন ।
কয়েকদিন চলিল । রোগের কিন্তু উপশম নাই !
গভীর রাত্রি। হঠাৎ নরেশ পাশের ঘরে গিয়া পরেশকে জাগাইলেন ! “ডাক্তারবাবুকে একবার খবর দেওয়া দরকার, পল্টু কেমন যেন করছে!”
“অ্যাঁ, বল কি ?”
পল্টুর তখন শ্বাস উঠিয়াছে ।
উন্মাদের মত পরেশ ছুটিয়া নীচে নামিয়া গেলেন ডাক্তারকে ‘ফোন ‘ করিতে। তাঁহার গলার স্বর শোনা যাইতে লাগিল—
“হ্যালো—শুনছেন ডাক্তারবাবু, হ্যালো—হাঁ, হাঁ, আমার আর ইনজেক্শন দিতে আপত্তি নেই—বুঝলেন—হালো—বুঝলেন—আপত্তি নেই—আপনি ইনজেকশন নিয়ে শিগগির আসুন—আমার আপত্তি নেই, বুঝলেন—”
এদিকে নরেশ পাগলের মত চরণামৃতের ভাঁড়টা পাড়িয়াঁ, চামচে করিয়া খানিকটা চরণামৃত লইয়া পল্টুকে সাধ্যসাধনা করিতেছেন— “পল্ট খাও—খাও ত বাবা—একবার খেয়ে নাও একটু—”
তাঁহার হাত থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, চরণামৃত কস বাহিয়া পড়িয়া গেল।
০