প্রথম পর্ব : গোল্ড ও ফিয়াট কারেন্সি
ভূমিকা:
আসসালামু আলাইকুম। আমি মোহাইমিন পাটোয়ারী, একজন লেখক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক। আজকে আমি এসেছি ‘The Muslim Minds’ চ্যানেলের অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানে আমরা শুধুমাত্র একটা না, একাধিক পর্ব করবো সিরিজ আকারে। আমরা বেশ কিছু টপিক আলোচনা করব এবং এই সব টপিক একটি ছাতার নিচে থাকবে। সেই ছাতাটা কি? জি, অনেকে হয়তো বুঝতে পেরেছেন, সেটা হচ্ছে আমাদের যে বর্তমান অর্থ মুদ্রা ব্যবস্থা এবং তার সাথে যে সুদের রাজত্ব, সেইটা।
টাকার ইতিহাস:
আজকে প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করবো টাকার ইতিহাস নিয়ে। টাকার ইতিহাস যখন আলোচনা করি, তখন আমি মাঝে মাঝে গাছের পাতা দিয়ে উদাহরণ দেই। হয়তো আপনারা ছোটবেলা থেকে একটা প্রবাদ শুনেছেন, “টাকা কি গাছের পাতা? টাকা কি গাছে ধরে?” তো কখনো কি ভেবেছেন এই যে এই পাতাটা, সেটা কেন টাকা হলো না? আপনি বলতে পারেন এটা একটু বড়, এই যে আরেকটু ছোট, এইটা কেন পয়সা হলো না, তাই না? দেখা যাচ্ছে? আচ্ছা, তো এইগুলা কেন টাকা হলো না এবং কি হলে আমরা সেটাকে টাকা বলি।
মুদ্রার বৈশিষ্ট্য:
তো পাতাগুলো থাক, প্রকৃতির থেকে এসেছে প্রকৃতিতে মিশে যাক। এখন আমরা আলোচনা করব যে মুদ্রা বা টাকা হওয়ার জন্য কিছু বৈশিষ্ট্য লাগে। গাছের পাতার সেই বৈশিষ্ট্যগুলো নাই দেখেই কি সেটা টাকা হতে পারে নাই। তো বৈশিষ্ট্যগুলা কি কি? মুদ্রার একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেটা সম্পদকে জমা করে রাখতে পারে। অর্থাৎ, যে জিনিসটাকে আমরা মুদ্রা বা টাকা হিসেবে ব্যবহার করি, সেটা দীর্ঘদিন আপনার সংরক্ষিত থাকে। সেটা পচে না, সেটা সহজে ক্ষয় হয় না, সেটা সহজে নষ্ট হয় না। সেটা খুব সহজে সংরক্ষণ করা যায়, খুব বেশি ভারী না, কেমন? তো এইরকম একটা বস্তুর মধ্যে, টাকা কিন্তু তার কিছু গুণ হারিয়ে ফেলেছে। কি গুণ হারিয়েছে? টাকা খুব সহজে এই গুণগুলার মধ্যে গাছের পাতা একটা গুণ হারিয়ে ফেলেছে। সেটা কি? গাছের পাতা খুব সহজে নষ্ট হয়ে যায়, ছিঁড়ে যায়, এটা আমরা সহজে ব্যবহার করতে পারি না। কিন্তু আমরা যদি আমাদের সম্পদ দীর্ঘদিন জমা করে রাখতে চাই, সেই ক্ষেত্রে আমরা যদি এটা একটা পয়সা হয়, তাহলে খুব সহজে আমরা অনেকদিন পর্যন্ত এর মধ্যে দিয়ে নিজের সম্পদটা সংরক্ষণ করে রাখতে পারি। তার কারণ, একটা পয়সা সহজে নষ্ট হয় না। আমরা যে কাগজের টাকা ব্যবহার করি, সেটাও যদি দ্রুত হাতবদল না হয়, সেই টাকাটাও কি সহজে পচে না, যদি যত্ন করে রাখতে পারি, সহজে ছিঁড়ে না এবং এটা সহজে নকলও করা যায় না। সুতরাং, এই জাতীয় বৈশিষ্ট্যগুলা যেকোনো একটা টাকাকে প্রথমত সম্পন্ন করতে হবে।
মুদ্রার বিভাজ্যতা ও বহনযোগ্যতা:
টাকার দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্যটা আছে, সেইটা হচ্ছে টাকা আপনার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা যায়। অর্থাৎ, যেমন একটা গরু, কেউ যদি বলল যে আমি ধরো যাক একটা জমি কিনতে গেলাম, তো বললো যে এই জমির দাম দেড়টা গরুর সমান, অর্থাৎ একটা গরু আরেকটা গরুর অর্ধেকের সমান। তো আমি কি এইভাবে কখনো লেনদেন করতে পারবো? যে একটা গরু দিলাম, আরেকটা গরুকে মাঝখান দিয়ে কেটে অর্ধেক দিলাম, বললাম নাও। এটা হয় না। সেইজন্য গরু কখনো টাকা হিসেবে ব্যবহার হইতে পারে নাই। কিন্তু আমরা যদি একটা জিনিসের দাম ধরি যে এটার দাম ১০০০ টাকা প্লাস ৫০ পয়সা, ঠিকই কিন্তু আপনি ভাঙতি নোট দিয়ে সেটা ম্যানেজ করে দিতে পারেন। অথবা কেউ যদি বলে যে হ্যাঁ আমি এই জমিটা বিক্রি করব, তার জন্য আমাকে ১০ ভরি ২ আনা ১ রতি সোনা দিতে হবে, আপনি কিন্তু সেটা পারবেন। অর্থাৎ কি? ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করা যায়। যে জিনিসটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করা যায় না, সেটা টাকা হতে পারে না।
টাকার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহনযোগ্যতা। একটা গরুকে আপনি পকেটে ভরে নিয়ে যাইতে পারবেন না। এখন আপনি বাজার করতে যাবেন ঢাকা শহরে, এখন আছেন গ্রামে। তো এইভাবে যদি গরু নিয়ে আনা-যাওয়া করেন তো এটা চলাফেরাই কষ্টকর। সেই তুলনায় আপনি ৫০,০০০ টাকা বা ১ লক্ষ টাকা খুব সহজে পকেটে রাখতে পারেন।
আধুনিক মুদ্রা ব্যবস্থার সূচনা:
টাকার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহনযোগ্যতা। অর্থাৎ আমরা কোনো কিছু যে বহন করে নিয়ে বাজার করবো, লেনদেন করবো, সেটা থাকতে হবে। এমন যদি হয় যে একটা গরুকে নিয়ে আমি লেনদেন করতে যাচ্ছি, তো সবাই গরু হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে বাজারে নিচ্ছে, আবার আসছে। কথার কথা আপনি থাকেন গ্রামে, আপনি যাবেন ঢাকায়। তো আপনি তো এখানে ১ লক্ষ টাকার গরু নিয়ে যাওয়া-আসা করতে আপনার খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশি হয়ে যাবে। কিন্তু সেই তুলনায় ১ লক্ষ টাকা পকেটে রাখা, কিংবা আমরা যদি সোনার মুদ্রার কথা বলি, সোনার মুদ্রা দিয়ে খুব সহজে কি আমরা লেনদেনটা করতে পারি।
আর আরেকটা বিষয় যেটা আমাদের মনে রাখা উচিত যে টাকায় যে সম্পদের যে মান, সেটাও যেন ধরে রাখতে পারে। অর্থাৎ এমন যদি হয় যে আজকে আপনি একটা টাকা রাখলেন ১ লক্ষ টাকার, আপনার দুই বছরের মধ্যে সেটা হয়ে গেল ১০,০০০ টাকার সমান, সেই জিনিসটা কিন্তু আপনি টাকা হিসেবে রাখতে চাইবেন না। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। যখন দেখা গিয়েছে যে জার্মানিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে টাকার মান খুব দ্রুত পড়া শুরু হয় কিংবা হাঙ্গেরিতে, তো তখন দেখা গেল যে মানুষ আর টাকাকে ব্যবহার করছে না। কোনো জায়গায় দেখা গেল মানুষ সিগারেটকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করছে, কোনো জায়গায় লেনদেন প্রথায় চলে গেছে যে আপনি আমাকে এটা দিবেন, আমি ওইটা দিব। তো টাকা জিনিসটা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে এমন হইতে হবে যেন সে সম্পদের মান ক্ষয় না করে ফেলে।
কাগজের টাকার প্রচলন:
এই হচ্ছে টাকার সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য। সেই জন্যই আসলে আমরা গাছের পাতাকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না। কারণ গাছের পাতা এত বেশি এভেইলেবল এবং এত সহজে নষ্ট হয় যে এটাকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করলে আমাদের সম্পদের মান রক্ষা করায় সমস্যা হয়ে যেত। এবং শেষ যে বৈশিষ্ট্যটা, সেটা হচ্ছে টাকাকে হতে হবে দুর্লভ। টাকা যদি বেশি পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়, তাহলে টাকার মান হবে খুব অল্প। আমরা জানি যে জিনিসটা বেশি পাওয়া যায়, সেই জিনিসটার কি মান হয় কম। সেই জন্যই আসলে পানি সব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও আমরা কি বলি? পানির মতন সস্তা। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটা সম্পদ হচ্ছে বাতাস এবং আলো, কিন্তু এগুলা আমরা ফ্রিতে পাচ্ছি। ঠিক একইভাবে গাছের পাতা খুব বেশি এভেইলেবল বা বালি। তো এখন আমি বললাম যে বালি হচ্ছে টাকা, যে ১ কেজি বালির বিনিময়ে আমরা সবকিছু লেনদেন করব। তাহলে আপনি একবার চিন্তা করেন, একটা গরু কিনার জন্য এক ট্রাক বালি লাগবে নিশ্চয়ই। তো এখন এত এভেইলেবল যে জিনিস, যেটা এত বেশি প্রাচুর্য, সেটা অনেক কম মূল্যে আমরা পাই এবং সেটা কি অনেক বেশি পরিমাণে নিতে হয় অল্প কিছু কিনার জন্য। সেইজন্য জগতজুড়ে যে জিনিসগুলা সবচেয়ে দুর্লভ ছিল, সেগুলোকেই কি মানুষ মুদ্রা বা টাকা হিসেবে ব্যবহার করেছে।
স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রার ব্যবহার:
এখন আমরা এই সবকিছু দ্বারা আমরা সাধারণ অর্থে দেখেছি যে টাকা জিনিসটা কেমন। প্রাচীনকাল থেকে যে জিনিসগুলো আমাদের মধ্যে টাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তার মধ্যে আছে যেমন বাংলা অঞ্চলে ছিল কড়ি, সেটা ছোটখাটো লেনদেনের জন্য ব্যবহার হয়েছে। তার পাশাপাশি ছিল রুপার মুদ্রা এবং সোনার মুদ্রা। আসলে সোনার মুদ্রা একটা বলা যায়, বিশ্বের সব জায়গাতেই কি কম-বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। তার কারণ কি? যে কয়েকটা বৈশিষ্ট্য বললাম, সেগুলো ভেবে দেখেন। সোনার মুদ্রা দীর্ঘদিন টিকে, কখনো পচে না, নষ্ট হয় না, ধ্বংস হয় না।
তারপরে সোনার মুদ্রা অত্যন্ত দুর্লভ, সোনা অত্যন্ত দুর্লভ, সেইজন্য এটার দাম অনেক বেশি। সেইজন্য অল্প পরিমাণে আমরা সহজে বহন করতে পারি এবং এটা দিয়ে অনেক বেশি মূল্যায়ন পেতে পারি এবং সোনার মূল্য সহজে কমে না, বরং দিন দিন বাড়ে। তো এই সব কারণে সোনা একটি আদর্শ মুদ্রা। সোনা ছাড়া আরেকটি আদর্শ মুদ্রা হচ্ছে রুপা।
অন্যান্য মুদ্রা ও কাগজের টাকার উদ্ভব:
এখন আপনি বলতে পারেন সোনা আর রুপা দিয়ে তো আমরা সব লেনদেন করতে পারি, তাহলে আর অন্য মুদ্রার প্রয়োজন হয় কেন? এখানে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনারা অনেকেই মিস করেন। সোনা আর রুপা দিয়ে কখনো আমরা সব লেনদেন করতে পারবো না। এবং ঐতিহাসিকভাবেই যেইসব অঞ্চলে সোনা বা রুপার মুদ্রা ছিল, সেখানে আরও অন্যান্য কারেন্সিও ছিল। কেন ছিল? এটার একটা উদাহরণ দেই। মনে করেন আমি একটা মুরগি কিনবো। তো এখন আমার প্রতিবেশীর থেকে একটা মুরগি কিনবো, তো এর দাম হচ্ছে ৭০০ টাকা। তো ৭০০ টাকা সে যদি বলে না আমি সোনার মুদ্রাতে লেনদেন করতে চাই, আপনি বলেন একটা সোনার মুদ্রার দাম কি মাত্র ৭০০ টাকা হয়? ৭০০ টাকায় তো একদম ছোট একটা গুটি সোনার দাম। তো এটা কিভাবে লেনদেন করবো? পকেটে রাখলে তো এটা পকেটেই হারায় যাবে বা দেখা গেল যে কোনো এক জায়গায় রাখলে আলমারির ড্রয়ারে চিপাতেই পড়ে থাকবে। তো আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এত ছোট জিনিস আমরা লেনদেন ঐভাবে করতে পারি না। কারণ আপনি তো করে আপনার তো একটা বস্তু হইতে হবে যেটা আমি ধরবো, লেনদেন করবো। এত ছোট জিনিস খুব সহজে হাতে থেকে পড়ে যাবে, হারায় যাবে, নষ্ট হয়ে যাবে।
এর চেয়েও যদি ছোট লেনদেন, মনে করেন যে আপনি একটা নারিকেল কিনবেন, আপনি বাজারে গিয়ে নারিকেল কিনবেন অথবা প্রতিবেশীর থেকে নারিকেল কিনবেন, তখন কি করবেন আপনি? তখন কি আপনি একটা সোনার ধূলিকণা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিবেন আর সে খপ করে ধরে ফেলবে? না, সেটা পারবেন না। আপনি বলতে পারেন যে আচ্ছা রুপা তো আরেকটু কম দামী, তাহলে এই ক্ষেত্রে রুপার মুদ্রা, হ্যাঁ, এই ক্ষেত্রে যেমন মুরগি বা আপনার দেখা গেল হাঁস বা আপনার কথার কথা একটা ছোট, এই যেমন এই মাইক্রোফোন কিনলেন, এই সব ছোটখাটো লেনদেনের ক্ষেত্রে আপনি রুপার মুদ্রা ব্যবহার করবেন। কিন্তু তার চেয়ে ছোট লেনদেন, যেমন আপনি এক কাপ চা খাবেন, একটা কলম কিনবেন, একটা ছোট কানের দুল কিনবেন, সেই ক্ষেত্রে কি আপনি আসলে রুপা দিয়ে ঐভাবে লেনদেন করতে পারবেন না।
সেটার জন্য আরও ক্ষুদ্র পর্যায়ের, আরও কম দামী বস্তু প্রয়োজন। সেই জন্যই যেইসব জায়গায় সোনা-রুপা ছিল, সেই সব জায়গাতে অন্যান্য মুদ্রাও ছিল। যেমন আরব অঞ্চলে আমরা দেখেছি হাদিস থেকে যে সেখানে খেজুর, তারপরে আপনার জব, এগুলা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাংলা অঞ্চলে কড়ি হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নটা ছিল। কোনোখানে চামড়ার টুকরা, কোনোখানে পাখির পালক, কোনোখানে বিশেষ এক ধরনের পাথর, এগুলা ব্যবহৃত ছিল। আর সোনা-রুপা বাদে তামার মুদ্রা দিয়েও চীনে প্রাচীনকালে লেনদেন হতো। এবং চীনের যে ঐতিহাসিক মুদ্রা, সেটা একটা তামার মুদ্রা, গোল তামার মুদ্রা, মাঝখানে আপনার চারকোনা ফুটা করা।
কাগুজে টাকার ইতিহাস:
এই হচ্ছে আপনার মুদ্রার জাতিতে প্রাথমিক আলোচনা। তো এখন আপনাদের কাছে প্রশ্ন হতে পারে, তো মানুষ তো মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করতো আপনার বিভিন্ন ধরনের ধাতু বা প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত বস্তু। কিভাবে সম্ভব যে আমরা একটা কাগজের টুকরাকে মুদ্রা হিসেবে কল্পনা করলাম? কাগজের টুকরা আসলো কোথা থেকে? এই ইতিহাসটা যদি জানেন, আপনারা খুবই মজা পাবেন। এখন চলুন আমরা জানি, কাগজের টুকরা কিভাবে মুদ্রা হলো।
আমরা জানি কাগজ একটা মূল্যহীন বস্তু। এতক্ষণ ধরে যত কিছুর কথা বললাম, সবকিছু কিন্তু একটা মূল্য ছিল এবং ঐ মূল্যটাই ছিল মুদ্রার মূল্যমান। কথার কথা, সোনা ছিল মূল্যবান, সেইজন্য সোনার মুদ্রা মূল্যবান। রুপা ছিল মূল্যবান, সেইজন্য রুপার মুদ্রা মূল্যবান। তামা ছিল মূল্যবান, সেইজন্য তামার মুদ্রা মূল্যবান। কড়িরও একটা মূল্য আছে, সেইজন্য কড়িও মূল্যবান। তাহলে কাগজের মতন মূল্যহীন বস্তু কিভাবে মূল্যবান হলো?
আসলে কাগজ বলতে আমরা যেইটা বুঝাচ্ছি, সেটা কিন্তু আসলে মুদ্রা না। কাগজের পিছে কিছু একটা ছিল, সেইজন্যই কাগজটা আসলে মুদ্রা হয়েছিল। তো শুনুন সেই গল্পটা। মনে করেন আপনার কাছে সোনা আছে, তো আপনি সোনা বহন করে একটা বড় লেনদেন করতে যাবেন, আপনি কিছুটা অনিরাপদ বোধ করতে পারেন অথবা আপনার একটা বড় ব্যবসা আছে, ব্যবসার অনেক লেনদেন হয়, তো সোনা এভাবে স্টোর করে রাখা বা লেনদেন করাটা আপনার কাছে অনিরাপদ লাগে। তো তখন কি করলো যে মানুষ দেখলো, যখন অনেক সোনা হয়, আমাদের যখন অনেক টাকা হলে কি করি আমরা? ব্যাংকে নিয়ে জমা করি। তো আগের দিনে যখন অনেক সোনা হতো, মানুষ কিসে দিয়ে জমা করতো? মানুষ জমা করতো একটা লকারে বা একটা আপনার, বাংলায় যদি বলি যে স্বর্ণকারের দোকানে, সেখানে সিন্দুকে একদম সুরক্ষিতভাবে জমা রাখতো সোনাটা যে না, তুমি এখানে সোনাটা রাখো, নিরাপত্তা দাও। আমার সোনা তুমি নিরাপত্তার বিনিময়ে আমি তোমাকে কিছু হয়তো সার্ভিস চার্জ দিব। আমি তোমাকে কিছু টাকা দিব কিন্তু তুমি আমার সোনাটা সংরক্ষণ করো।
ব্যাংকিং ব্যবস্থার উদ্ভব:
তো আমি যে সোনা জমা রাখলাম, এটার প্রমাণটা কি? স্বর্ণকার তো একটা রিসিট দিবে যে ওকে, আমি তোমাকে এই রিসিটটা দিলাম যে মোহাইমিন পাটোয়ারী, তুমি ৫০০ ভরি সোনা আমার এই সিন্দুকে রেখেছো, এই যে আমার সাইন। এই কাগজটা যদি আবার দেখাও, আমি তোমাকে এর বিপরীতে কি সোনাগুলা দিয়ে দিব।
তো আমি এখন খুব ভালো অনুভব করছি। আমাকে আর পকেটে করে এত কিছু নিয়ে ঘুরে বেড়াইতে হয় না। একটা ছোট কাগজ রাখি বা লোকায় রাখি কাগজটা কোনো এক জায়গায়। যখন আমার প্রয়োজন হয়, সেই কাগজটা দেখায় আমি সোনাটা তুলে আনি এবং ওইটা দিয়ে লেনদেন করি। এটা হচ্ছে কি? প্রাচীনকালের ব্যাংক ব্যবস্থা।
এখন এখানে পুরা ব্যাংক ব্যবস্থা এখনো আসে নাই, আসবে এরপরে। তো যখন আমি দেখলাম যে এই রিসিটটা আসলে আমি টাকার মতন ব্যবহার করতে পারছি, তখন আমি ভাবলাম, আসলে আমি যখন লেনদেন করবো, তখন আবার সোনা তুলে এনে ঐ সোনা দিয়ে লেনদেন না করে, আমি তো চাইলে এই কাগজটা দিয়েই লেনদেন সেরে ফেলতে পারি। কথার কথা, কাগজে লেখা ছিল আমার কাছে এই সোনার মুদ্রার মালিকানা আছে, চাইলে সিন্দুক থেকে তুলে আনতে পারি। তো আমি কি করলাম, চেকে লিখে দিলাম যে ওকে, দাখিল সাহেব, আমি তোমার কাছে পার করে দিলাম, আমি এটা দাখিলকে দিয়েছি। তো আর আমার সাইন দিলাম। তো সে আবার স্বর্ণকারের কাছে গেলে স্বর্ণকার এটার বিপরীতে তাকে সোনা দিয়ে দিতে পারে।
তো এই সিস্টেমটা যখন ডেভেলপ হলো, তখন বললো যে আচ্ছা আমরা তো ওপেন চেক আনতে পারি যে ওকে, এই চেকের নিচে সাইন করে দিলাম, এই চেক যার হাতে থাকবে, সোনাটা তার। তখন আমি যখন লেনদেন করবো বাজারে, যখন আমি লেনদেন করছি, তখন কি এই চেকটা আমি দিয়ে দিছি। তো আমি কারো থেকে জমি কিনছি, যখন আমি জমি কিনছি, তখন দেখা যাবে এই চেকটা আমি দিয়ে দিছি এবং এই চেকের বিনিময়ে আমি জমিটা পেয়ে গেছি। আবার যে কিনলো, সে দেখা গেল এই চেকটা দিয়ে ১০টা গরু কিনে ফেললো। আবার যে গরু ব্যবসায়ী, সে চাইলে আরেকটা ঘর কিনে ফেললো। তো এইভাবে কি? চেকেরই লেনদেন হওয়া শুরু হলো।
ব্রেটোন উডস চুক্তি ও ডলারের আধিপত্য:
আর কেউ যদি মনে করে না আমার চেক ভালো লাগে না, সে স্বর্ণকারের কাছে যাবে, সোনা তুলে আনবে। তো এই যে সোনার বিপরীতে একটা কাগজের রিসিট দিয়ে আমরা লেনদেন করছি, সেই কাগজের রিসিটই হচ্ছে টাকা। অর্থাৎ, কাগজ বলতে আপনি যেভাবে ভাবছেন যে শুধু একটা কাগজ, না, ব্যাপারটা ঐটা ছিল না। ব্যাপারটা ছিল, কাগজ হচ্ছে সোনার রিসিট। অর্থাৎ, সোনাই ছিল মুদ্রা আর আমরা কাগজ দিয়ে লেনদেন করতাম কারণ ঐ সোনার বিপরীতে যে দলিল, সেই দলিলটাই হচ্ছে কাগজ।
আধুনিক মুদ্রা ব্যবস্থার বাস্তবতা:
বুঝা গেল? এইভাবে আসলে কাগজের টাকার প্রচলন হয়। এবং এটা প্রথম আসে চীনে। তো এই যে কাগজের টাকাটা আসলো, এতে কি কোনো সমস্যা হলো? না, এতে কোনো সমস্যা হয় নাই, বরং সুবিধাই হয়েছে। এখানের মধ্যে কোনো জালিয়াতি বা কোনো শুভঙ্করের ফাঁকি বা সুদ কিছুই নাই। এটা একটা সত্যিকারের মুদ্রা।
সমস্যা হলো তখন, যখন দেখা গেল, নতুন করে কাগজ তৈরি হচ্ছে সোনা ছাড়া। সেটা কেমন? তো স্বর্ণকার যখন দেখলো যে আসলে অনেকে তো সোনা তুলে নিতে আসছে না, আমার কাগজ মার্কেটে ঘুরতেছে, আমার সোনা সিন্দুকে পড়ে আছে। তো আমি চাইলে তো দুই একটা কাগজ একটু বাড়তি লিখে দিতেই পারি, কেউ তো টের পাবে না। তো ওইটাই তারা করা শুরু করলো, কিন্তু ওই কাগজটা লিখে সে ঋণ দেওয়া শুরু করলো। এবং যখন ঋণ দিল, তার বিপরীতে আবার সুদও নেওয়া শুরু করলো। তো এইভাবে আর কি প্রথম, বলা যায় যে মর্ডান ব্যাংকিং সিস্টেমটা ডেভেলপ করে।
তো এইভাবে চলতে চলতে, চলতে চলতে, বহু বছর গেল এবং এটাকে পরে সেন্ট্রালাইজ করা হলো, তারপরে আবার অনেক কিছু হলো, এখন অত ইতিহাসে হয়তো এই ভিডিওতে যাব না। তো এগুলা জানার জন্য আসলে বই পড়তে হবে। তো এখন এই আমরা জানতেছি যে বর্তমান মুদ্রাটা কি। তো এইভাবে যেতে যেতে একটা পর্যায়ে আসলো যখন আসলে সম্পূর্ণ বিশ্বের মুদ্রা ব্যবস্থার বিপরীতে আসলে সোনাই হয়ে গেল রিজার্ভ। আগে যেরকম সব দেশের মুদ্রার বিপরীতে, এই সিস্টেমটা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, তখন দেখা গেল পৃথিবীর সব দেশের মুদ্রার বিপরীতে আপনার রিজার্ভ হয়ে গেল ডলার। আগে যেখানে ছিল গোল্ড রিজার্ভ, সেই গোল্ড রিজার্ভ হয়ে গেল ডলার। তো তখন দেখা গেল যে ডলার সারা বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হয়ে গেল কি? রিজার্ভ কারেন্সি। সেই জন্য বলা হয় যে ডলার রিজার্ভ কারেন্সি।
ডলারের রিজার্ভ কারেন্সি হওয়া:
তো ডলার রিজার্ভ কারেন্সি হওয়ার পিছনে আসলে এই ঘটনাটা জড়িত। তো এর মধ্যে দিয়ে কি দেখা গেল যে সবাই ডলার সংগ্রহ করছে, পৃথিবীর সব দেশ কি ডলার চায়, ডলার চায়, ডলার চায়। আর একমাত্র ডলারের বিপরীতেই সোনা।
তো এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেনের মাধ্যম থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ডলার আসলে একেবারে শীর্ষে উঠে গেল। তো এইভাবে যেতে যেতে আমেরিকা তার কথা রাখেনি একসময়। সে অতিরিক্ত ডলার ছাপানো শুরু করে। তো যখন দেখা গেল যে আমেরিকা অতিরিক্ত ডলার ছাপানো শুরু করলো, তখন সোনা আর ডলারের দামের যে ব্যালেন্স, সেটা নষ্ট হয়ে যায়। এবং একসময় দেখা যায় যে ৭০, মানে সেই ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়।
তো এই ব্যালেন্স নষ্ট হওয়ার পর অনেকে বলে আচ্ছা তুমি যেহেতু অতিরিক্ত ডলার ছাপাইছো, আমি আর এই ডলার সিস্টেমে থাকতে চাই না, আমার সোনা আমাকে ফেরত দাও। তো সর্বপ্রথম ফ্রান্স এই কথাটা বলে। সর্বপ্রথম ফ্রান্স এই কথাটা বলে যে আচ্ছা আমার সোনা আমাকে ফেরত দাও, আমি আর ডলার হাতে রাখতে চাই না। এদিকে ব্রিটেনও তখন এই ধরনের ইঙ্গিত দেয় যে সেও তার পাউন্ডের বিপরীতে সোনা চায়, সে আর আমেরিকার ডলারকে ব্যাক করে পাউন্ড হাতে রাখতে চায় না। তখন ১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট রিচার্ড নিক্সন টিভিতে স্ক্রিনে এসে সারা বিশ্বকে অবাক করে ঘোষণা দেয় যে আমেরিকার ডলারের বিপরীতে আর সোনা থাকবে না। আমাদের সোনা আমারই, তোমরা ডলার নিয়ে বসে থাকো, আমি কোনো সোনা দিব না।
ডিজিটাল কারেন্সি ও ফিয়াট মুদ্রা:
অর্থাৎ, এরপরে থেকে, ১৯৭১ সালের পর থেকে সমস্ত টাকা হয়ে গেল শুধুমাত্র কাগজ। এখন আর টাকার বিপরীতে কোনো ধরনের সোনা বা কিছুই নাই। টাকা এখন এই একেবারে কাগজই। এইটাই হচ্ছে যে ফিয়াট কারেন্সি। তো এই যে আমাদের টাকা শুধুমাত্র কাগজ এবং এর বিপরীতে কিছু নাই, এই ধরনের টাকাকে বলে ফিয়াট কারেন্সি। তো এই শব্দটা তো আপনারা অনেকদিন শুনেছেন, আজকে জানতে পারলেন যে বিষয়টা কি। এর ফলে কি হয়? এর ফলে আমরা চাইলে যত ইচ্ছা তত টাকা ছাপাইতে পারি এবং ইচ্ছা মতন ঋণ দিতে পারি এবং সুদ নিতে পারি।
তো এইটাই হচ্ছে আমাদের আধুনিক যে কাগুজে মুদ্রা ব্যবস্থা, সেইটা এবং আমরা যে ডিজিটাল কারেন্সি দেখি, সেটাও সম্পূর্ণ ফিয়াট। সেটার পিছেও কোনো ধরনের সোনা বা মূল্যবান দ্রব্য কিছুই নাই। এক কথায়, আমরা বর্তমানে পৃথিবীতে যত টাকা দেখতেছি, এই সবকিছু অনলি নাম্বার বা অনলি পেপার।
ডিজিটাল লেনদেন এবং সুদমুক্ত মুদ্রা ব্যবস্থা:
একটা মজার জিনিস কি জানেন? আমরা কাগজ ব্যবহার করি নাকি ডিজিট, সেইটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যা কিছু ব্যবহার করি, তার পিছে অন্তর্নিহিত বস্তুটা কি এবং কার হাতে এই সমস্ত মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা?
সেই প্রশ্নগুলা এখন আমরা উত্তরসহ আলোচনা করবো। প্রথমে আমরা জানি যে আমরা যে ডিজিট দেখি, আমরা যে ডিজিটাল মানি দেখি, সেই ডিজিটাল মানিটা এটা স্বর্ণভিত্তিক হতে পারে কিনা বা সোনা ছাড়াও অন্য কোনো অন্তর্নিহিত বস্তুভিত্তিক হতে পারে কিনা। আপনাদের কাছে প্রথমে শুনতে অবাক লাগতে পারে, যে ডিজিট কয়েকটা নাম্বার, চোখে দেখছি, এটা কিভাবে অন্তর্নিহিত বস্তু সম্পন্ন হয়। আমরা দেখেছি যে কাগজ, যে জিনিসটা, শুধুমাত্র এক ফালি কাগজ, সেটা কিন্তু অন্তর্নিহিত বস্তুর সমান হতে পারে। আমরা দেখেছি যে কোনো এক জায়গায় আমরা স্বর্ণ রেখেছি এবং তার বিনিময়ে আমাদেরকে একটা দলিল দিয়েছে এবং সেই কাগজের দলিলটা আসলে স্বর্ণেরই প্রতিচ্ছবি ছিল। সেখান থেকে কি কাগজের নোট আসে। এবং পরবর্তীতে সেই সোনার সাথে টাকার লিঙ্কটা নষ্ট করে দেওয়া হয় এবং তারপরেই হয়ে যায় টাকা শুধুমাত্র কাগজ এবং কোনো ধরনের অন্তর্নিহিত বস্তু ছাড়া একটি বিনিময় মাধ্যম।
এখন চিন্তা করেন, যে ব্যক্তি টাকা উৎপন্ন করছে, ১০০০ টাকার নোট তৈরি করতে তার খরচ হয় কত টাকা? ৪ থেকে ৫ টাকা। কিন্তু সে যখন মার্কেটে ছাড়ছে, তখন সে ভ্যালু পাচ্ছে কত? সে পাচ্ছে ১০০০ টাকার ভ্যালু। তাহলে এটাই তো আমার মনে হয় সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা যে আপনি টাকা ছাপাবেন এবং মার্কেটে ছাড়বেন। কিন্তু সেই অধিকারটা কার আছে? আপনার আছে? না আমার? সেই অধিকারটা আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এবং আপনারা পরবর্তীতে জানবেন, আমরা যে প্রাইভেট ব্যাংক দেখি বা কমার্শিয়াল ব্যাংক দেখি, তারাও আসলে নতুন টাকা সৃষ্টি করতে পারে।
সেটা হচ্ছে ডিজিটাল মানি আকারে। সেই আলোচনা ইনশাল্লাহ এর পরের পর্বে করবো। বর্তমান পর্বে আমরা দেখি কিভাবে আমরা ডিজিটাল গোল্ড কারেন্সি কিংবা ডিজিটাল তামা বা আপনার রুপা বা অন্য যেকোনো, এমনকি বিদ্যুৎও হতে পারে একটা কারেন্সি, সেগুলা নিয়ে এখন আলোচনা করবো। প্রথমে দেখি আমরা যে গোল্ড কিভাবে একটা ডিজিট হতে পারে।
ধরা যাক আপনার কাছে একটি বড় লকার বা সিন্দুক আছে বা ধরলাম আপনি একটা গোল্ড ব্যাংক। গোল্ড ব্যাংক কি? যেখানে মানুষ তাদের নিজ নিজ সোনা, সোনার বার বা সোনার কয়েন বা বিস্কুট জমা রাখে। আপনি যখন জমা রাখেন, তখন আপনি ওকে একটা ডিজিট দেন যে ওকে, একটা বিস্কুট কিংবা একটা কয়েন কিংবা একটা বার। তখন সেই ব্যক্তি চাইলে আরেকজনের সাথে লেনদেন করতে পারে। আমরা বর্তমানে যেভাবে মানি ট্রান্সফার করি ব্যাংকে, ঠিক সেইভাবে আপনি গোল্ড ট্রান্সফার করে দিবেন। ধরা যাক আমার কাছে এই মুহূর্তে ১০০টা সোনার ছোট কয়েন আছে, তো আমি এটা রাখলাম এক জায়গায়, সে আমাকে একটা ডিজিট দেখালো যে ১০০ গোল্ড কয়েন বা ১০০ সোনার মুদ্রা। আবার আপনি রাখলেন দুইটা, আবার আমার প্রতিবেশী সে রাখলো ১০টা। তো এইভাবে কিন্তু আমরা একটা জায়গায় সবাই রাখতে পারি। এবং কে কতটা রেখেছে, সেটা আমরা একটা অ্যাপে এবং ওয়েবসাইটে দেখতে পারি।
ভবিষ্যৎ লেনদেন ব্যবস্থা:
তারপরে, যখন আমি আমার প্রতিবেশীর থেকে একটা জমি কিনবো, ধরা যাক জমির দাম হচ্ছে ৫০ গোল্ড কয়েন, তখন আমি কি করবো? সেখানে ট্রান্সফার করে দিব। এখানে যখন আমি ক্লিক করবো, পাসওয়ার্ড দিব এবং আমার সাইন দিব বা ডিজিটাল সাইন দিব, তখন কি হবে? আমার ১০০ থেকে কমে ৫০ হয়ে যাবে, ওর কাছে ৫০ চলে যাবে এবং এর বিনিময়ে সে দলিলে আমার নাম লিখে দেবে। দেখেন, এই যে আমরা ডিজিটাল লেনদেনটা করছি, এখানে কিন্তু আমি ফিজিক্যালি মুদ্রা হাতবদল করছি না।
কিন্তু আমাদের যে লেনদেন হচ্ছে, আমাদের মাঝে যে কারেন্সি আছে, সেইটা কি কারেন্সি? সেটা ১০০% গোল্ড কারেন্সি এবং এটা কি সম্পূর্ণ সুদমুক্ত একটা মুদ্রা এবং সুদমুক্ত লেনদেন।
এবার আসা যাক যে আমরা যে ডিজিটগুলো দেখি, সেইটা কি? একটা জিনিস চিন্তা করেন, আমরা যখন ব্যাংকে টাকা জমা রাখি, তখন ব্যাংক সেই টাকাটা কি করে? ব্যাংক সেই টাকাটা ঋণ দেয়। আমরা মনে করি যে ব্যাংকে আমার টাকা জমা আছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকে আমাদের টাকা জমা নাই। ব্যাংক সেটা ঋণ দিয়ে মার্কেটে ছেড়ে দিছে। তাহলে আমরা যে ডিজিট দেখি, সেটা আসলে লকারে সঞ্চিত কোনো বস্তু না। ব্যাংকের কাছে যে টাকা আছে, ব্যাংক সেটা ছেড়ে দিছে। তার মানে ব্যাংক আমাদেরকে প্রমিজ করতেছে যে এই টাকাটা সে ফেরত দিবে। কিন্তু তার হাতে প্রকৃতপক্ষে টাকা নাই। সেই টাকাটা ঋণ আকারে মার্কেটে ছেড়ে দিছে এবং তার উপর সুদ পাচ্ছে।
সুদমুক্ত মুদ্রা ব্যবস্থার গুরুত্ব:
এবং মার্কেটে যখন এই টাকাটা ঘোরে, তখন সেখান থেকে আবার মানুষের হাতে হাতে করে ব্যাংকে পুনরায় ফেরত আসে। বলা যায় ব্যাংক সিস্টেমে কাছে আবার ফেরত আসে এবং সেখান থেকে কিছু অংশ কি আবার ঋণ আকারে যায় এবং আবার ফেরত আসে। তো এইভাবে দেখা যায় যে একটা ফিজিক্যাল কারেন্সি বা একটা কাগজের নোট অনেকবার ঋণ দেওয়া হয় এবং অনেকবার ব্যাংকে ডেপোজিট হয়।
অর্থাৎ, এক কথায় আমাদের সমাজে যেই পরিমাণ কাগজের নোট আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে কি ব্যাংকের ডিজিট বা ব্যাংকের প্রমিজ যে আমাকে পে করবে। সেই জন্যই আমরা সবাই যখন ব্যাংকে একসাথে টাকা তুলতে যাই, তখন ব্যাংক ব্যবস্থা ধসে পড়ে। এটার একটা উদাহরণ দেই আমি এইভাবে যে ধরা যাক আমাদের প্রত্যেকের পকেটে কিংবা প্রত্যেকের আলমারিতে যে পরিমাণ নোট আছে, সেগুলা আপনি একটা জায়গায় রাখলেন। ধরা যাক আমার কাছেই দিলেন, আমি এগুলা সব স্তূপ করে রাখলাম, বিশাল পাহাড়ের মতন হলো।
সুদের চক্র এবং মুক্তি:
এখন আমি বললাম যে ওকে, তোমাদের জাস্ট হাতে বা আলমারিতে যেটা আছে, সেইটাই তো আমাকে দিছো, ক্যাশগুলা। এখন তোমরা সবাই যাও, গিয়ে বিকাশকে বলো তোমার টাকাটা ক্যাশ আউট করতে অথবা ব্যাংকে বলো তোমার মানি ফিরিয়ে দিতে, তোমার টাকা হাতে তুলে দিতে। ব্যাংকের মানি থেকে বুথ থেকে এটিএম বুথ থেকে আপনি ক্যাশ তোলেন, দেখবেন ব্যাংক ব্যবস্থা সাথে সাথেই কলাপ্স। কেন? কারণ আপনার আমার হাতে যে সামান্য কিছু টাকা সঞ্চিত আছে, সেইটাই হচ্ছে কি কাগুজে মুদ্রাগুলো।
এগুলাই বারবার ঘুরছে এবং আমরা যে বিশাল নাম্বারগুলো দেখছি, প্রত্যেকে দেশে আমার বিকাশে এত টাকা, ব্যাংকে এত টাকা ইত্যাদি, এগুলো শুধুই নাম্বার। এগুলোর পিছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যাশ নাই। সামান্য কিছু ক্যাশ থাকে, সেটা হচ্ছে আমাদের ইমিডিয়েট নেসেসিটি ফিল আপ যেটা, সেটার জন্য।
তো এই যে আমাদের অল্প কিছু ক্যাশ দিয়ে এত টাকা তৈরি হলো, এই টাকাটা যে ডিজিটাল কারেন্সি তৈরি হলো, এইটা কিন্তু আসলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৈরি করে নাই। ব্যাংক ব্যবস্থা, কমার্শিয়াল ব্যাংক ব্যবস্থা তৈরি করেছে এবং এটা দিয়ে আমরা লেনদেন করতে পারি। আপনি চাইলে একজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ডিজিট ট্রান্সফার করতে পারেন, তার থেকে জমি কিনতে পারেন বা সেও এইভাবে করতে পারে। আপনি চাইলে কার্ড দিয়ে লেনদেন করতে পারেন, আপনি চাইলে মোবাইল ব্যাংকিং দিয়ে লেনদেন করতে পারেন। তার মানে এটা সম্পূর্ণ একটা কারেন্সি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও এটাকে কারেন্সি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কারণ বাস্তবে আমরা এটাকে কারেন্সি হিসেবে ব্যবহার করি।
উপসংহার:
তো এই যে আমরা এই কারেন্সিটা ব্যবহার করছি, এটা দিয়ে লেনদেনও করছি, এটা তৈরি করেছে ব্যাংক ব্যবস্থা এবং তৈরি হয়েছে কিসের বিপরীতে? ঋণের বিপরীতে। এবং এই ঋণটা তৈরি হলো এবং এর বিপরীতে যে সুদটা আসতেছে, সেই সুদের মালিক কে? সেই সুদের মালিক ব্যাংক। সেইজন্য আমরা যে মুদ্রা ব্যবস্থায় আছি, ফিয়াট কারেন্সি অত বড় সমস্যা না, যতটা বড় সমস্যা এইটা যে আমাদের টাকাগুলো তৈরি হচ্ছে ঋণের মধ্যে দিয়ে এবং সেই ঋণটা সুদযুক্ত। এবং আমরা প্রত্যেকে দিন দিন ঋণগ্রস্ত হচ্ছি এবং সুদটা পূরণ করছি। কারণ আপনি চিন্তা করে দেখেন, প্রতি ১০ টাকায় যদি ৯ টাকা ব্যাংকের তৈরি করা, ঋণের একটা ডিজিটাল কারেন্সি হয়, আপনার ১০% সুদে তো এক বছরেই সব ফিজিক্যাল ক্যাশ ব্যাংকের অধীনে চলে যাবে। কারণ আপনি দেশের যদি ১০,০০০ কোটি টাকা থাকে, আপনি বললেন ৯,০০০ কোটি টাকা ব্যাংকের ঋণ, তো ৯,০০০ কোটি টাকার ১০% সুদে আসে আপনার ৯০০ কোটি টাকা বা আসলে তো সুদের হার আরও বেশি। তার মানে জাস্ট এক বছরের মধ্যে কি সব টাকার অধিকার ব্যাংকের হাতে চলে যায়।
এবং চলে গেছেও। আমরা তো আসলে অনেক পরে এসে এসব আলাপ করছি। বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ইতিহাস তো আজকের কালকের না। অনেক দিন আগের থেকে। তো এত বছর যাওয়ার পরে আজকে আপনি আমার কথা শুনছেন আর ভাবছেন যে আসলে আমরা কি বাস্তবতার মধ্যে আছি। এবং আপনিই হয়তো ভাবছেন বা আমি হয়তো ভাবছি, আপনার আশেপাশে হিসাব নিয়ে দেখেন কয়জন ব্যক্তি বা এই জিনিসটা জানে। আমাদের মুদ্রা ব্যবস্থাটা এমন, আমরা যেন একটা কারাগারে আছি। কেন জানেন? কারণ আমরা প্রত্যেকে যে মুদ্রাগুলো ব্যবহার করছি, সেগুলো আমাদেরকে ঋণ এবং সুদের চক্রে আবদ্ধ করছে এবং আমরা এর থেকে বাঁচতে পারছি না। সেই জন্যই আসলে বলতে পারেন যে আমাদের কেউই পরিপূর্ণ সুদমুক্ত না। কোনো না কোনোভাবে সুদের লেনদেন আমাদের জীবনে হচ্ছে। আসলে যতক্ষণ টাকা ব্যবহার করছেন, পুরা সিস্টেমটাকে আপনি কোনো না কোনোভাবে শক্তিশালী করছেন। এবং এর থেকে বাঁচার সহজ কোনো উপায় নাই।
একটু আগে যে ধরনের সিস্টেম বললাম, যে আমরা একটা জায়গায় গোল্ড রাখবো এবং ডিজিটাল লেনদেন হবে, সেইটা বাদে। সুতরাং আসলে আমরা অনেক সময় যে হেইট করি, অনেক সময় হেইট করি কাগজের টাকাকে কিংবা হেইট করি ডিজিটকে, ইলেকট্রনিক মানিকে। আসলে আমাদের ঘৃণার বস্তু এটা হওয়া উচিত না যে মুদ্রাটা কি আকারে আমার সামনে আসছে। বরং আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে মুদ্রাটা তৈরি করছে কে, এটার সাথে সুদযুক্ত কিনা, এর ক্ষমতা কার হাতে এবং এই মুদ্রার বিপরীতে কি আছে।
আপনাকে যদি এই এই ধরনের শর্ত দেওয়া হয় যে বাংলাদেশে সুদ চলবে, আমাদের আজকে থেকে সব কারেন্সি কাগজের থাকবে না, হয়ে যাবে সোনার, কিন্তু বাংলাদেশে সুদ চলবে, তাতেও কিন্তু আসলে কিছুই বদলাবে না। চিন্তা করেন, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি টাকা কাদের হাতে? এবং কারা ঋণ দিচ্ছে? ব্যাংক। বর্তমানে পুঁজি সংগ্রহ করতে হলে, ব্যবসা করতে হলে কার কাছে যেতে হয়? ব্যাংক। বর্তমানে আমরা দিন দিন ঋণগ্রস্ত হচ্ছি।
যদি জাস্ট টাকা কেটে সোনা লেখি, কিছুই বদলাবে না। এখন যেমন সব টাকার মালিক ব্যাংক, তখনও সব সোনার মালিক হবে ব্যাংক ব্যবস্থা। তারাই ঋণ দিবে, তারাই সুদে-আসলে নিতে নিতে এই পুরা সবার সোনা তাদের আয়ত্তে চলে আসবে। কারণ চিন্তা করেন, তাদের হাতে যদি ১০০ টন সোনা থাকে, সেটা ঋণ দিয়ে তারা নিলো ১১০ টন সোনা, তারপর ১১০ টন দিয়ে ১২১, ১২১ দিয়ে ১৩২, ১৩২ দিয়ে ১৪৫, এইভাবে বাড়তেই থাকবে। এবং চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে সুদের যে সাইকেল, সেই সাইকেলে সমস্ত সোনা তাদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবে। তার মানে টাকা বদলায় সোনা আনলে কোনো সমাধান হবে না যদি সুদ থাকে। ফিয়াট কারেন্সি অবশ্যই সমস্যা, তার চেয়ে বড় সমস্যা কি?সুদ।
এবং এই মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ, বর্তমানে যে মুদ্রার নিয়ন্ত্রণটা, সেটা আমাদের হাতে নাই। কিন্তু যদি মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকের হাতে রেখে টাকার বদলে সোনা আনি, তাতে লাভের লাভ কিছুই হবে না। বরং আমরা যে কারাগারে আছি, সেই কারাগারেই থাকবো।