১
নিমকের সের ষোল টাকা। ষোল পয়সার জিনিস ষোল টাকা। নুনের অভাবে দেশময় হাহাকার! রাজধানীতে হৈ-হল্লা। অগত্যা এম. এল. এরা এবং পি. এস. ( পুনশ্চ নয়, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিরা ) মন্ত্রীদেরে ধরিলেন । দেশ যে আর রক্ষা করা যায় না । তার মানে, জনগণকে আর পক্ষে রাখা গেল না। ফলে মন্ত্রীদের গদিও টলমল। একটা কিছু না করিলে নয়।
মন্ত্রিসভার বৈঠক বসিল ক্যাবিনেট রুমে। সবারই মুখ মলিন ও লম্বা । প্রধানমন্ত্রী সরবরাহমন্ত্রীকে ধমক দিলেন : কি করতেছেন আপনে ? লবণের সের বড় জোর ৮/১০ টাকা হৈবার পারে, এক্কেবারে ষোল টাকায় তুললেন কি কৌশলে ?
সরবরাহমন্ত্রী আমতা-আমতা করিয়া বলিলেন : সব চেষ্টাই ত আমি করছি, স্যার। কিন্তু কিছুই ত কৈরা উঠবার পারলাম না । করাচী থাইকা লবণও কম আনলাম না। কিন্তু জাহাজ আইসা নামতেই লবণ নাই ।
প্রধানমন্ত্রী : কনট্রোল করেন না কেন ?
সরবরাহ মন্ত্রী : কনট্রোল ত খুব করতেছি, স্যার। কিন্তু কনট্রোল দামে চাইলেই লবণ একরত্তি নাই; আর ষোল টাকা দিলে কয় সের চান ?
প্রধানমন্ত্রী : তবে দেখা যাইতেছে লবণগুলি হাওয়া হৈয়া গেছে না । আছে ব্যাপারীদের গুদামেই, তবে ধরবার পারেন না কেন ?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : লবণের ব্যাপারীরা ম্যাজিক জানে, স্যার ।
প্রধানমন্ত্রী : কিন্তু তাতে আমরার মন্ত্রীত্বের অবস্থা যে ট্র্যাজিক হৈয়া উঠছে। একটা কিছু না করলে যে মন্ত্রীত্ব রাখা দায় হৈবে ।
চীফ সেক্রেটারি : স্যার, আগামীকাল ইউনিভারসিটির ছাত্ররা ভূখা মিছিল বাইর করবে। গাঁও থাইকা লাখে লাখে লোক রওনা হৈয়া গেছে। কাল তারা আপনার প্রাসাদের সামনে বিক্ষোভ দেখাবে ঠিক করছে। শুধু বিক্ষোভই হয়, না আরও বেশি অনর্থ কিছু ঘটে, সে চিন্তায় আমার আর ঘুম নাই ।
প্রধানমন্ত্রী: তোমরা আছ খালি ঘুমের তালে। আমি তোমরার গদি ঠিক রাখি, আর তোমরা কর ঘুমের চিন্তা। বাহ্, ! বাহ্! কিন্তু এখন করি কি ? দিমু নাকি ১৪৪ ধারা জারি কৈরা ?
শিক্ষামন্ত্রী মুখ বাঁকাইয়া বলিলেন : আজকাল ছেলেরা যেমন কমিউনিস্ট হৈয়া উঠছে, তাতে ১৪৪ ধারা তারা মানবে কি না সন্দেহ ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : তবে দিয়া দেই গুলি চালাবার হুকুম ? স্যার কি বলেন ?
প্রধানমন্ত্রী : না, না, আগেই গুলি না। হাতের পাঁচ ত ওটা থাকলই ৷ আগে অন্য ফন্দি ঠাহর করেন। আপনেরা যেমন কৈরা পারেন, আজকার দিনের মধ্যেই একটা উপায় বার করেন। আমার বাতের টাটানি বড় বাইড়া গেছে। নইলে আমি একটা না-একটা ফন্দি বার করবার পারতাম। বাতের বেদনা যে কি ভয়ানক, তা ত আপনেরা জানেন না। এখন আপনেরা বিদায় হন। সন্ধ্যার আগে সকলেই আমার বাসায় জমায়েত হৈবেন একটা ফন্দি বার কৈরা। বুঝলেন ত ?
২
সন্ধ্যা ৷ প্রধান মন্ত্রীর প্রাসাদে সভা। মন্ত্রীরা এবং বিভিন্ন দফতরের হেডেরা ছাড়াও বিভিন্ন দলের নেতা-উপনেতারাও আসিয়াছেন। সকলের মুখেই কাল ছায়া ।
প্রধানমন্ত্রী বলিলেন : আমার বাতের জোরটা ক্রমেই বাইড়া চলছে। আমি সারাদিন ছটফট কৈরা কাটাইছি। কোন কিছু ভাববার পারলাম না। আমি আশা করি, আপনেরা একটা না একটা ফন্দি ঠাহর করছেন। কারণ আপনেরার বাতের বেদনা নাই ।
সরবরাহ মন্ত্রী : স্যার, বাতের বেদনা না থাকলেও মাথার বেদনায় আর ঘাড় সিধা করবার পারতাছি না।
প্রধানমন্ত্রী : আরে রাইখা দেন মাথার বেদনা। বাতের বেদনার কাছে একসাথে দশটা মাথার বেদনাও কিছু না। ভুগেন নাই ত কোনদিন বাতের বেদনায় । মাথা বেদনা, সে ত ছেলে-পিলের অসুখ । এখন বলেন কে কি ফন্দি ঠাহর করছেন ।
কেউ কিছু বলিলেন না। শুধু এ-ওর মুখের দিকে চাহিতে লাগিলেন । প্রধানমন্ত্রী ক্রুদ্ধ স্বরে বলিলেন: বুঝলাম আপনেরা কেউ কিছু করছেন না। কোনো যোগ্যতাই আপনেরার নাই । এমন সব অপদার্থ লোক লৈয়া আমি মন্ত্রিত্ব করবার চাই না। আমি রিজাইন দিমু ঠিক করছি ৷
এক কোণ হইতে সুফী চেহারার একজন লোক দাঁড়াইয়া বলিলেন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার চাক্ষুষ পরিচয় নাই। আমার নাম খাকসার কেরামত উল্লাহ ৷ লোকে আমাকে মুফতি বৈলাই ডাকে। আমি একটা আরজ করবার চাই ।
প্রধানমন্ত্রী বিরক্তি মাখা সুরে বলিলেন : হাঁ, আপনের তারিফ আমি বহুত শুনছি। কিন্তু এখন আমি বড় ব্যস্ত, আপনের কোনো কাজ এখন আমারে দিয়া হৈবে না। আপনে পরে আসবেন।
মুফতি হাসিলেন। বলিলেন: হুজুর, আমি নিজের কোনো মতলবে আসছি না। আগামী কালের বিক্ষোভ ঠেকাবার ফন্দি বাৎলাবার লাগিই আপনের সেক্রেটারী আত্মীয় ফিরোজ সা’ব আমাকে ডাইকা আনছেন ।
প্রধানমন্ত্রী অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া বলিলেন : বে-আদবি মাফ কর — বেন । আপনে মোল্লা মানুষ, এ সব রাজনীতির কি জানেন ?
মুফতি সাহেব মুখে প্রচুর আত্ম-বিশ্বাসের ভাব আনিয়া বলিলেন : হুজুর, আগে জানতাম না, একথা ঠিক। কিন্তু লীগে ঢুইকা কিছুকাল মন্ত্রী-মেম্বরগ সহবতে থাইকা বেলেকে ভৰ্তি হৈয়া গেছি। এখন রাজনীতি কিছু-কিছু বুঝি।
প্রধানমন্ত্রী : বেশ, বেশ। তা হৈলে কন, আপনের ফন্দিটা কি ?
মুফতি : আগামীকালের মিছিলের উপর কোনো ৪৪ ধারা করবেন না । বরঞ্চ ঘোষণা কৈরা দিবেন, প্রধানমন্ত্রী লবণ সম্বন্ধে জরুরী ঘোষণা করবেন। আপনের বাসায় মাইক বসাইয়া সারা শহরে, দোকানে-দোকানে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাউড স্পীকার বসাবেন ।
প্রধানমন্ত্রী : তা যেন করলাম । তারপর আমি কি কি ঘোষণা করমু ? ঘোষণার ত কিছুই নাই ৷
মুফতি : আপনের বেশি কিছু কওয়া লাগবে না । শুধু এইটুকু বলবেন যে, আপনের তরফ থাইকা মুফতি মওলানা অমুক লবণ-সমস্যা সম্বন্ধে বক্তৃতা করবেন ।
প্রধানমন্ত্রী : আর, আপনে কি কইবেন ? আমার তা আগে জানা দরকার ।
মুফতি : আমি যুক্তি-তর্কের দ্বারা, হাদিস-কোরানের সনদ দিয়া পরমাণ কৈরা দিমু যে, লবণ খাওয়া ভাল মানুষের, বিশেষতঃ মুসলমানদের উচিত নয় বৈলাই আমরার জনপ্রিয় মন্ত্রিসভা ইচ্ছা কৈরা লবণের দাম বাড়াইয়া দিছেন।
প্রধানমন্ত্রী উচ্চস্বরে কৌতুকের হাসি হাসিয়া বলিলেন : এ সব বাজে কথা লোকে বিশ্বাস করবে কেন?
মুফতি : সে ভার ছাইড়া দেন, হুজুর, আমার উপরে। আপনেরা ত কাছে বইসা সবই দেখবেন শুনবেন। দেইখা ও যাচাই কৈরা নিবেন আপ- নেরা। আমার বক্তৃতা শুইনা যদি জনতা খুশী না হয়, যদি তারা মন্ত্রি-সভা জিন্দাবাদ দিয়া না যায়, তবে আমার নাম ফিরাইয়া রাখবেন। আর যদি জিন্দাবাদ দেয়, তবে আমারে আপনে কি দেবেন ?
প্রধানমন্ত্রী : যদি সত্যই বিক্ষোভ সামলাইতে পারেন মুফতি সাব, তবে আপনে যা কইবেন, তাই দিয়া দিমু! আসলে অর্ধেক রাজ্য ও রাজকন্যাই আপনের প্রাপ্য । তবে আমার মেয়ে না থাকায় রাজকন্যা দেওয়া সম্ভব নয় । প্রধান মন্ত্রিত্বের গদিও আধা-আধি ভাগ করা যায় না । এরপর আপনি যা চান, তাই দিমু দরকার হৈলে কাজীগিরি পর্যন্ত।
মুফতি : হুজুর, কাজীগিরির এলাকা আজকাল যা ছোট করা হৈছে, তাতে কাজীগিরি নিয়া লাভ নাই। তার চেয়ে বরঞ্চ আমারে একটা কেরা- সিনের পারমিট দিবেন ।
প্রধানমন্ত্রী কেন, একটা লবণের পারমিটই নেন না কেন ?
মুফতি : না, হুজুর আগামীকাল আমি যে বক্তৃতা করুম, তারপরে লোকে আর লবণই খাবে না। কাজেই লবণের পারমিট নিয়া আমি ঠকতে রাজি না।
৩
প্রধানমন্ত্রীর বালাখানার সামনে বিশাল আংগিনা । আংগিনার পর প্রশস্ত পিচ-দেওয়া রাস্তা ; তার বাদে বিস্তৃত ময়দান। যেদিকে যতদূর নজর যায়, কেবল লোকে লোকারণ্য; চারদিককার কুশাদা রাস্তাগুলির যে দিকেই চাই, পিপড়ার লাছির মত জনতার ‘লবণ চাই’ ‘নইলে মন্ত্রীদের মাথা চাই,’ ‘লবণ দাও, নয়ত গদি ছাড়’ ‘লবণ-চোরের গর্দান চাই’ ইত্যাদি ইত্যাদি শ্লোগানে আসমান-জমিন মুখরিত ।
প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির গাড়ী-বারান্দার ছাদে মাইক বসান হইয়াছে। প্রধান মন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রীরা ও নেতারা গোলবন্দী হইয়া মাইকের চারিদিকে বসিয়া আছেন। তাঁদের মধ্যে সাদা বড় পাগড়ি-বাঁধা মুফতি সাহেবকেও দেখা যাইতেছে ৷
প্রধানমন্ত্রী মাইকের সামনে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বিপুল জনতা ‘শেম’ ‘শেম’ ‘রিজাইন’ ‘রিজাইন’ বলিতে লাগিল। প্রধানমন্ত্রী কি বলিলেন কিছুই শোনা গেল না। চার দিকে ঘন ঘন আওয়াজ হইতে লাগিল । “আমরা লবণ চাই, বক্তৃতা চাই না ”
প্রধানমন্ত্রী জনতার দিকে হাত জোড় করিলেন। জনতা একটু শান্ত হইল ৷ দুইবার কাশিয়া প্রধান মন্ত্রী এই সুযোগে বলিলেন : আপনেরার কথা আমি শুনলাম, আপনেরাও আমার কথাটা শুনেন। লবণ-সমস্যা নিয়া আমরা খুবই চিন্তা করছি। বিশ্ব-বিখ্যাত আলেম মুফতি কেরামতুল্লা সাহেবের কেরামতির দওলতে আমরা একটা সমাধানও করছি। আমি নিজ মুখে সেটা কইবার চাই না, মুফতি সাহেবের মুখেই সেটা আপনেরা শুনবার পাবেন। তাঁর কথা শুনবার পরেও যদি আপনেরা সন্তুষ্ট না হন, তবে আপ- নেরা যা খুশী করবার পারেন ৷
জনতা এবার সত্যই শান্ত হইল । মুফতি সাহেব কাল বিলম্ব না করিয়া একলাফে মাইকের সামনে আসিলেন এবং বাম হাতে মাইকের খুটি চাপিয়া ধরিয়া মাইকের সামনে মুখ নিয়া ষাড়ের আওয়াজে বলিলেন : বেরাদরানে মিল্লাত, আসসালামু আলায়কুম ।
জনতা আর কি করে ? ‘ওয়া আলায়কুম’ বলা ফরয, তাই যেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলিল : ওয়া আলায়কুম সালাম ।
মুফতি সাহেব সময় নষ্ট না করিয়া বলিতে লাগিলেন : আপনেরা এই মাত্র আল্লার নামে হলফ কৈরা কইছেন আপনেরা সালাম অর্থাৎ শান্তি চান । কাজেই শান্তির সংগে আমার আরজটা আপনেরা শুনবেন! এটা আমি নিশ্চয়ই দাবি করবার পারি ।
জনতা বিরক্ত হইয়া বলিল : কি কইবার চান, জলদি কইয়া ফেলেন।
মুফতি : নিমক নিয়া আপনেরা হৈ চৈ করতে আছেন দেইখা আমি তাজ্জব হৈলাম । আপনেরা কি হাদিস মানেন না ? আপনেরা কি মুসল- মান না ?
জনতা : কথা ক্যান ? আমরা মুসলমানও, হাদিসও মানি আমরা। কিন্তু এখানে সে কথা ক্যান?
মুফতি এবার নড়িয়া চড়িয়া সোজা হইয়া বলিলেন : হাদিস শরীফে আছে নিমক হারাম। কথাটা কি আপনেরা কোন দিন শুনছেন না ? হাদিস শরীফে মুসলমানেরা লাগি নিমক কেন হারাম করা হৈল, সেটা কি কোনো দিন আপনারা চিন্তা কৈরা দেখছেন ?
জনতা হঠাৎ নিস্তব্ধ হইল । ক্ৰমে এখান ওখান হইতে গুনগুন শব্দ শোনা গেল : নিমক হারাম ? মওলানা সাহেব এটা কি কইতে আছেন ? ও-কথার অর্থ কি এই ?
মুফতি সাহেব তাঁর গলা আরও মোটা, আরও গম্ভীর করিয়া বলিলেন : হাদিস শরীফ কি তবে ভুল ? নাউযুবিল্লাহে মিন জালেক। আসতাগফেরুল্লাহ বলুল। হাদিস কখনো ভুল হবার পারে না। আপনেরা গওর কৈরা দেখেন, কেন মমিন-মুসলমানের লাগি, ইনসানের লাগি, নিমকহারাম করা হৈল ।
প্রধানমন্ত্রী সহ সমস্ত মন্ত্রী নেতাদের চোখ কপালে উঠিল। কিন্তু তাঁরা -খুশী হইলেন ।
জনতা প্রশ্ন করিল : কিসের লাগি হারাম করা হৈল আপনেই কন ?
মুফতি আবার নড়িয়া-চড়িয়া বুক উঁচা করিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন : হাদিস শরীফে আছে : নিমক না খাওয়ার ফযিলত তিনটি। পয়লা ফযিলত -এই যে, যে লবণ না খাবে তার বাড়িতে কোন দিন চুরি হৈবে না।
মন্ত্রীরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলেন ।
জনতা বিস্ময়ে বলিল : চুরি হৈবে না। ইটা সত্য নাকি ?
মুফতি : নিশ্চয় সত্য। তারপর দুসরা ফযিলত এই যে, যে লবণ খাবে না, তারে কোনো দিন কুত্তায় কামড়াবে না ।
মন্ত্রীদের একজন আরেকজনের পেটে আংগুল দিয়া গুতা মারিতে লাগিলেন ।
জনতার মধ্যে বিস্ময় ও উত্তেজনা দেখা দিল । তারা এ ওর কাঁধে ধাক্কা মারিয়া বলিতে লাগিল : মওলানা ইসব কি কইতে আছেন ? এসব কথা সত্য হবার পারে ?
মুফতি : আমার কথা সত্য না হৈলে আপনেরার হাতে আমি যে-কোনো সাজা গ্রহণ করবার লাগি তৈয়ার আছি। তারপর তেসরা ফযিলতের কথা শুনেন।
এত বড় জনতা পলকে শান্ত হইয়া গেল ।
মুফতি গলা আরো উচা করিয়া মাথা তুলিয়া বলিলেন : লবণ না খাবার তেসরা ফজিলত এই যে, যে লবণ না খাবে, তার চুল-দাঁড়ি সাদা হৈবে না, তার দাঁত পড়বে না ।
বিস্ময় ও আনন্দের গুঞ্জনে জনতা মুখর হইয়া উঠিল। জনতার বিষণ্ণ মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তারা বলিল : কিন্তু এসব কথা যে ঠিক তার পরমাণ কি ? আমরা পরমাণ চাই ।
মুফতি : যে কোন প্রমাণ দিতে আমি প্রস্তুত। যা-তা প্রমাণ না, একেবারে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। দাঁত ও চুলদাড়ির কথা ডাক্তারি ব্যাপার, চুরি-ডাকাতির কথা পুলিশের ব্যাপার, আর কুত্তার কথা ভেটারিনারি সার্জনের ব্যাপার। তাঁরা যদি আমার কথার সত্যতা স্বীকার করেন, তবে আপনেরা বিশ্বাস করবেন ?
জনতা : হাঁ করমু। কিন্তু বিশ্বাসী লোক হওয়া চাই। ঘুষখোর লোকে চলবে না।
প্রধানমন্ত্রী মাইকের সামনে আসিলেন। মুফতি সাহেব সরিয়া জায়গা করিয়া দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলিলেন: ভাই সাহেবান, লবণের অভাবে আপাততঃ দু’চারদিন আমরা কষ্ট পাইলেও কেন আমার গবর্ণমেন্ট লবণের সের ষোল পয়সার জায়গায় ষোল টাকা করছেন, তার কারণ এতক্ষণে আপনেরা নিশ্চয়ই বুঝবার পারছেন । আমাদের রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র। এখানে আমরা আলেমরার উপদেশে নিজামে ইসলাম কায়েম করছি। এখানকার ‘লোক যাতে আস্তে-আস্তে নিমক খাওয়া ছাইড়া দেয়, সেই মতলবেই আমরা লবণ এমন চাংগা কৈরা দিছি। মুফতি সাহেব বিশ্ব-বিখ্যাত আলেম। তাঁর মুখে আপনেরা হাদিসের হুকুম এবং সে হুকুম মানবতার ফযিলতের বয়ান শুনলেন । তিনি আমরার কাছেও এই কথাই কইছেন। আমরা তাঁর কথার বিশ্বাস কইরা লবণের দাম বাড়াইয়া দিছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর সমস্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব লৈয়া আজ এই বিপুল জনতার সামনে ঘোষণা করতে আছি যে, আমার দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ডাক্তার মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেবকে চেয়ারম্যান এবং গোয়েন্দা পুলিশের কর্তা ডি. আই. জি. সি. আই. ডি. কে ও ভেটারিনারি হাসপাতালের সুপারি-ন্টেণ্ডেন্টকে মেম্বর কৈরা একটি কমিশন নিয়োগ করলাম। মুফতি সাহেবের কথা ঠিক কি না, এই কমিশন বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে তা তযদিক করবেন। আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আরো ঘোষণা করতে আছি যে, যদি এই কমিশনের কাছে মুফতি সাহেব তাঁর কথার সত্যতা প্রমাণ করবার না পারেন, তবে মুফতি সাহেবকে চরম দণ্ড দান করা হৈবে। আজকার জনতার মতো বিরাট জনতা ডাইকা তাদের সামনে মুফতি সাহেবের ফাঁসি দিমু। কি মুফতি সাহেব এতে আপনি রাজি ?
মুফতি সাহেব সহজ পদে মাইকের সামনে আসিয়া বলিলেন : জি হ্যাঁ, আমার কথা মিথ্যা হৈলে ঐ শাস্তি আমি মাথা পাইতা নিমু।
জনতা উল্লাস প্রকাশ করিল। কিন্তু বলল : আমরা জানবার চাই, কমিশনের রায় কবে বাইর হৈবে ?
প্রধানমন্ত্রী মুফতির দিকে চাইয়া মাইকের সামনে মুখ নিয়া বলিলেন : মুফতি সাহেব, কয়দিনে আপনে ইটা প্রমাণ করবার পারবেন ?
মুফতি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সংগে বললেন : আমি সব সময়ই প্রস্তুত আছি। কালই আপনেরা প্রমাণ নিবার পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী জনতাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন : শুনলেন ভাই সাহেবান, মুফতি সাহেব কালই প্রমাণ করবার পারবেন। তা-হৈলে পরশুদিন সকালে খবরের কাগজে সরকারী প্রেসনোটে কমিশনের রিপোর্ট দেখবার পারবেন । যদি মুফতি সাহেব কমিশনকে সন্তুষ্ট করবার না পারেন, তবে ঐ প্রেসনোটে মুফতির ফাসির দিন ঘোষণা করা হৈবে। আপনেরা নির্ধারিত সময়ে এই-খানে জমায়েত হৈবেন মুফতিকে প্রকাশ্যে আপনেরার চোখের সামনে ফাঁসি দেওয়া হৈবে । কেমন এতে আপনেরা খুশী হৈলেন ত ?
বিপুল জনতা উল্লাস ও উত্তেজনায় জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। প্রধানমন্ত্রী ‘জিন্দাবাদ। মন্ত্রিসভা জিন্দাবাদ। আমরা লবণ চাই না। লবণ আর খামু না। আল্লাহু আকবর।
জনতা বাঁধভাংগা নদীর স্রোতের মতো চলিয়া যাইতে লাগিল। মন্ত্রীরা ‘খুশীতে গলে প্রসারিত’ ও দাঁত বিকশিত করিলেন। নেতারা মুফতিকে বুকে জড়াইয়া টানা-হেচড়া করিতে লাগিলেন ৷ লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়িয়া প্রধানমন্ত্রী শিরওয়ানীর বোতাম খুলিয়া বুকে ফু দিতে লাগিলেন : আপাততঃ বাঁচা ত গেল। কিন্তু এর শেষ কোনখানে ? ‘মুফতিকে শেষ লাগাৎ ফাঁসিই দেওন লাগব। কিন্তু তাতেও আমরার রক্ষা নাই । কি হৈবে মুফতি সাব ?
মুফতি হাসিয়া বলিলেন : কোন চিন্তা করবেন না হুজুর! কিন্তু আমার কেরাসিনের লাইসেনসের কথাটাও যেন ভুইলা যাইবেন না ।
৪
কমিশনের বৈঠক। মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল চেয়ারম্যান হিসাবে মধ্যস্থলে বসা। তাঁর ডানদিকে ডি. আই. জি. সি. আই. ডি. বামদিকে ভেটারিনারি সুপার। কমিশন সিগারেট পুড়িয়া সময় কাটাইতেছেন ; কারণ মুফতি সাহেবের দেখা নাই । তারা হাসাহাসি করিতেছেন।
প্রিন্সিপাল সাহেব বলিলেন : আমি ত আগেই বলছিলাম, মুফতি আসবেনা। আসবে কোন সাহসে ? আমরারে সে কি পাগল পাইছে নাকি ? আমি বুঝি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই পাগলটাকে দিয়া যা-তা বলাইয়া এই ঝক্কিটা নিলেন কেন ?
ডি. আই. জি : আমি মাননীয় প্রধান মন্ত্রীকে বলছিলাম, ব্যাটাকে পুলিশ-গার্ডে রাখা হউক। ফাঁসি যার ধরা-বান্ধা, সে পলাবে না কেন ?
ভেটারি সুপার : কিন্তু মোল্লাটাকে ফাঁসি দিয়াই কি মন্ত্রীরা রক্ষা পাইবেন ? বড় জটিল অবস্থা সৃষ্টি হৈছে কিন্তু । আমি কোনো উপায় দেখতেছি না।
মেডিক্যাল : উপায় ওদিকেই আছিল নাকি ? যা জনতা জমা হৈছিল, আর তারা ক্ষেপছিলও এমন সাংঘাতিক যে ঐ রকম একটা কিছু না কৈরা উপায়ই বা কি আছিল ?
ডি. আই. জি : হাঁ, উপায় আবার আছিল না; একটু হুকুম পাইলে সব ব্যাটাকে তোপের মুখে উড়াইয়া দিতাম। প্রধানমন্ত্রী খামোখা গেলেন এক বান্দর নাচাবার । এখন সে ব্যাটাকে পাই কোনখানে ?
‘এই যে, বান্দরটা হাজির’ বলিতে বলিতে মুফতি সাহেব কামরায় প্রবেশ -করিলেন এবং হি হি করিয়া হাসিতে থাকিলেন। অবশেষে হাসি থামাইয়া বলিলেন । মোল্লা মানুষ ঘড়ির ধার ধারি না। দু’চার মিনিট দেরি হৈয়া গেছে; কিছু মনে করবেন না। মাফ করবেন।
মেডিক্যাল : আচ্ছা আচ্ছা, যা হবার হৈয়া গেছে। এখন কাজ শুরু করা যাক। মেম্বর সাহেবান, প্রশ্ন করুন।
ডি. আই. জি : বলেন মুফতি সাব, নিমক না খাইলে চুরি হৈবে না কেন ?
মুফতি : লবণ না খাইলে যক্ষা-কাশি অবধারিত, এ কথা ঠিক কিনা, ডাক্তার সাহেবই কন ৷
ডাক্তার সাহেব অর্থাৎ মেডিক্যাল প্রিন্সিপাল সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িলেন ।
মুফতি : যক্ষ্মা-কাশি হৈলে সারা রাত কাশতে হৈবে ? সেই কাশির শব্দে ঘরে চোর ঢুকবার পারবে না। ঠিক কি না ?
ডি. আই. জি : ( বিস্ময়ে গাল প্রশস্ত করিয়া) ঠিক ত। এতক্ষণে আপনের কথার ভেদ বুঝবার পারলাম ।
ভেটারিনারি : কিন্তু লবণ না খাইলে কুত্তায় কামড়াবে না কেন ?
মুফতি : যক্ষ্মা-কাশিতে লোক দুর্বল ও গুজা হৈয়া পড়বে। লাঠি ভর না দিয়া তারা চলবার পারবে না। লাঠি হাতে থাকলে কুত্তায় কামড়াবার পারব না, এটা বুঝবার পারলেন না ?
কমিশনের মেম্বরদের মুখ বিস্ময়-আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল । সকলে বলিলেন : কথাগুলা ত সত্য বৈলাই বোধ হৈতেছে ।
মেডিক্যাল : কিন্তু চুলদাঁড়ি সাদা হৈব না, দাঁত পড়ব না, এটা কিছুতেই ঠিক হৈবার পারে না ।
মুফতি : এটাও হবার পারে। যক্ষ্মা-কাশিতে লোকেরা অল্প বয়সেই মারা যায়, ত্রিশ পয়ত্রিশের বেশি কেউ বাঁচবে না । ঐ বয়সে চুল-দাঁড়ি পাক-বার আর দাঁত পড়বার সময় কই?
প্রচণ্ড বিস্ময়ে কমিশনের মেম্বরগণ স্তম্ভিত হইলেন। তাঁদের বিস্ময় কাটিলে মুফতি সাহেবকে ধন্যবাদ দিলেন। প্রবল উৎসাহে তাঁর করমর্দন করিলেন ।
পরদিন সরকারী প্রেসনোটে বলা হইল : কমিশন সর্বসম্মত রিপোর্ট দিয়াছেন যে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হইয়াছে, যে লবণ না খাইবে
১. তার বাড়িতে চুরি হইবে না ।
২. তারে কুত্তায় কামড়াইবে না ।
৩. তার চুল-দাঁড়ি সাদা হইবে না ও দাঁত পড়িবে না ।
অতএব মওলানা মুফতি কেরামতুল্লা সাহেবের মতই ঠিক। কাজে- কাজেই হারাম নিমকের দাম প্রতিসের ষোল টাকা করিয়া মন্ত্রিসভা ঠিক কাজই করিয়াছেন।