১.
সূর্য ডুবে যাচ্ছে। বিদায়ের আগে সারা আকাশ রাঙিয়ে তুলেছে রঙের গাঢ় আলপনায় । নীরবে বসে প্রকৃতির এই বিচিত্র রূপ চেয়ে চেয়ে দেখছিল আহমদ খলিল । তার দৃষ্টি নেমে আসে নিচে। সামনে যতদূর চোখ যায় – ছড়িয়ে আছে ফসল ভরা মাঠ। দু’এক দিনের মধ্যেই ফসল তোলার কাজ শুরু হয়ে যাবে। প্রতিদিন এ সময়টায় এসে এখানে বসে থাকে আহমদ খলিল। তার মনে হয় – এই ফসল ভরা বিশাল প্রান্তরটি যেন এখনো তাদেরই আছে। তার মনে পড়ে পবিত্র কুরআনের বাণী—
“এবং (হে মুহাম্মদ!) তুমি ভূমিকে দেখ শুষ্ক ও প্রাণহীন, অতঃপর তাতে আমি বারি বর্ষণ করলে তা শস্য-শ্যামল হয়ে আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদ্গত করে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ।”
প্রত্যেক বছরই আল্লাহর তরফ থেকে অলৌকিক রহমত হিসেবে এ বৃষ্টিপাত হতে দেখে আহমদ খলিল। শীতের শেষে বিরান মাঠ বিকশিত হয়ে ওঠে অফুরান সবুজের সমারোহে । সেই দ্রুত বেড়ে ওঠা সবুজের রংয়ে খুব তাড়াতাড়িই আবার পরিবর্তন ঘটে । চারদিকে তখন সোনারং আভার ঝলমলানি। মাঠের পর মাঠভরা পাকা ফসলের সোনালি রঙের কাছে আসল সোনাও যেন একান্ত তুচ্ছ মনে হয় আহমদ খলিলের। এ সোনার আরেক অর্থ জীবন। বিগত বছরগুলোর কথা মনে পড়ে তার। নিজে, এক চাচার ছেলে এবং আরো কয়েকজন ফেলাহীন (কৃষক) কে সঙ্গে নিয়ে খাবার সংগ্রহের জন্যে কি দুঃসাহসিক কাজই না করত তারা। প্রায়ই, রাতের আঁধারে ইহুদীদের দেয়া কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে তারা প্রবেশ করত দখলীকৃত এলাকায়। একবার ইহুদী সৈন্যরা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। সাথে সাথে চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। মেশিন গানের অবিশ্রান্ত গুলী বর্ষণ এবং গ্রেনেড বিস্ফোরণের মাঝে সেদিন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসাই কঠিন হয়ে উঠেছিল। আহমদ খলিল ভেবে পায়নি, পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত তাদের এ ক্ষুদ্র ভূখন্ড, যা তাদের (জীবিকা) পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, ইহুদীরা তা কি করে নিজেদের বলে দাবি করতে পারে ?
অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে, আহমদ খলিল বসে থাকে নীরবে। সে ক্রমশঃ-ডুবে যেতে থাকে অতীত দিনের গভীরে। সব ঘটনাই তার মনে স্মৃতি হয়ে জমে আছে। তার এই সতেরো বছরের জীবনে ঘটনাতো কম ঘটেনি। এ বছরগুলোতে গোত্রের তিনশোরও বেশি মানুষকে তারা হারিয়েছে। সে নিজে, তার ভাই, চাচা-চাচী ও তাদের ছেলে রশিদ এবং মামাতো বোন আসমা ছাড়া তার গোত্রের আর কেউ বেঁচে নেই। একদিকে অনেকটা দূরে, মরুভূমির মধ্যে আবছাভাবে তার নজরে পড়ছিল চ্যাপ্টা ছাদের ঘরগুলো। দেখতে অনেকটা তার নিজেরই গ্রামের মতো যা গুঁড়িয়ে দিয়েছে হানাদার ইহুদীরা। আহমদ খলিলের মনে হয় যদিও এখান থেকে অনেক দূরে, তবুও ফেলে আসা ফিলিস্তিনের আকাশ নিজের গ্রামের ছবিটা সে স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে। তার সামনে প্রসারিত দিগন্তের শেষে নেগেভের মরুভূমি। পাথর আর মোটা বালিতে ভরা সে মরু প্রান্তরে গ্রীষ্মের জ্বলন্ত সূর্য সারাদিন আগুন ঢেলে যায় অবিশ্রান্ত ধারায় । কোথাও একটি গাছ কিংবা এক গোছা ঘাসেরও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। নেগেভ ছাড়িয়ে আরো দক্ষিণে নেফুদ অঞ্চল। আহমদ খলিলদের বাস্তুভিটা ছিল সেখানেই। তেরশ বছর আগে আজকের সউদী আরব থেকে মুসলিম বিজয়াভিযানে অংশ নিয়ে ফিলিস্তিনে এসেছিলেন তার পূর্বপুরুষেরা । পরে এখানেই তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ সময় স্থানীয় বহু খৃষ্টান তাদের কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। আরো পরে, ক্রুসেডে পরাজিত, এদেশে বসবাসে আগ্রহী বহু ক্রুসেডারও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং আত্মীয়তার বন্ধনে মিশে একীভূত হয়ে যায় তাদের গোত্রের সাথে।
নেফুদ অঞ্চলে বসতি স্থাপনের পর আহমদ খলিলের পূর্ব-পুরুষরা জীবিকার পেশা হিসেবে কৃষিকাজকেই বেছে নিয়েছিলেন। বহু শতাব্দী ধরে তারা ফেলাহীন (কৃষক), কৃষিকাজ তাদের পেশা। আর এ পেশা অবলম্বনের জন্যে অপরাপর মরুবাসী গোত্র ও শহরবাসীদের কাছে তারা ছিল উপেক্ষিত ও ঘৃণিত। কিন্তু কৃষিকাজের সুকঠিন পরিশ্রমে কড়া পড়ে যাওয়া হাত, পোশাক, ব্যক্তিত্ব, কষ্ট সহিষ্ণুতা ও মুক্ত স্বাধীন প্রকৃতির জন্যে মরুচারী বেদুইনদের থেকে তাদের আলাদা মনে হত না। অন্যান্যদের উপেক্ষা ও ঘৃণা সত্ত্বেও তাদের গোত্রের একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা ছিল। আর এ জন্যই, আগের তুর্কী শাসনকালে কিংবা কিছুকাল পূর্বের বৃটিশ ম্যান্ডেটরি শাসনব্যবস্থায়ও তাদের ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করতে সাহসী হয়নি। তাদের শাসক ছিল তারা নিজেরাই এবং যে কোন শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের ক্ষেতের ফসল, ভেড়ার পাল, ছাগল এবং উটগুলোকে রক্ষা করতে তারা নিজেরাই ছিল যথেষ্ট।
আহমদ খলিলের চোখের সামনে এ মুহূর্তে ভেসে ওঠে তার ফেলে আসা গ্রাম ইরাক আল-মানশিয়ার সবুজ গম এবং যবের চারা, মসুর, পিয়াজ ও শস্য ক্ষেতের ছবি । মায়ের কথা মনে পড়ে তার। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও মায়ের মুখটি মনে আনতে পারে না সে। এমন কি তার কণ্ঠস্বরও স্মরণ করতে পারে না। তার শুধু মনে পড়ে, সংসারের অজস্র, আয়াসসাধ্য কাজ সম্পাদনের জন্যে তার মায়ের কঠোর পরিশ্রমের কথা। সংসারের কঠিন ভার বহন করতে মায়ের মুখে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার যে ছাপটি সে আঁকা দেখতে পেত-তা আহমদ খলিলকে মনে করিয়ে দিত হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রিয়তমা সহধর্মিনী হযরত খাদিজার (রা) কথা। তার মায়ের নামও ছিল খাদিজা। এ জন্যে সে খুবই গর্ববোধ করত।
আহমদ খলিলের শৈশবের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। সে দিনগুলোতে কখনোই সে তার মায়ের কাছ ছাড়া হয়নি। তার মা শিশুকাল থেকেই, যেখানেই হোক না কেন, যাবার বেলায় শিশু আহমদ খলিলকে সাথে নিয়ে যেতেন। একেবারে ছোট্ট অবস্থায় কাপড়ের দোলনায় এবং পরে তাকে কাঁধে করে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতেন তিনি। এমনকি, গাজা শহর থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন- লবণ, ম্যাচ, কাঁচা তুলা, সেলাইয়ের সূঁচ এবং স্বামীর রাইফেলের বুলেট সংগ্রহের জন্যে যখন তিনি জরুরী ভিত্তিতে নিজের তাঁতে কাপড় বুনতেন, তখনো আহমদ খলিলকে চোখের আড়াল করতেন না তিনি। শিশুটি কোন কারণে হঠাৎ কেঁদে উঠলে সাথে সাথে হাতের সব কাজ ফেলে তাকে কোলে তুলে নিতেন খাদিজা। স্তন মুখে দিয়ে থামিয়ে দিতেন তার সকল কান্না। এরপর মৃদু দুলুনিতে আহমদ খলিলকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে কালেমা পড়তে থাকতেন তিনি । আর কখনো খাদিজা একান্তই ছেলেকে কোলে নিতে না পারলে আব্বা, চাচা অথবা চাচীদের কারো না কারো কোলে সে আশ্রয় পেত ।
কিন্তু দু’বছর বয়স থেকে আহমদ খলিল আর মায়ের বুকের দুধ খুব একটা পায়নি । খাদিজাকে এ সময়ই সারাদিনই কাজ করতে হত মাঠে গিয়ে। কখনো ক্ষুধায় আহমদ খলিল তীব্র চীৎকার শুরু করলে আশ-পাশের কোন মহিলা এসে তাকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে যেত। কিন্তু এ অবস্থাও বেশিদিন চলেনি। প্রায়ই সে দুধ খেতে পেতনা, খাদিজাও শিশু বড় হয়ে ওঠার জন্যে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন। এ সময় আহমদ খলিলকে ধীরে ধীরে তেলে ভেজানো রুটি, সিদ্ধ পিঁয়াজ অথবা কাঁচা শসা খাওয়া শিখতে হয় ।
মাঠের কাজের অবসরে খাদিজা আহমদ খলিলকে জোর করে হাঁটতে শেখানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু এক পা, দু’পা এগিয়েই সে হুমড়ি খেয়ে পড়তো মাটির ওপর। অন্য ছেলে-মেয়েরা এ সময় তাকে উৎসাহ দিত। ফেরার সময় বড় এক ঝুড়ির মধ্যে তাকে বসিয়ে মাথায় তুলে নিয়ে নীরবে ঘরে ফিরতেন খাদিজা।
মালেক ওহাব, আহমদ খলিলের আব্বা- ঘরে ফেরা মাত্রই দরজায় তাকে দেখে সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করত। মাসুম শিশুটির দু’টি চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো গভীর আনন্দে। আব্বা! আব্বা! বলে কচি গলায় সে শোরগোল শুরু করে দিত। সে উচ্ছল ডাকের ‘আওয়াজে’ সারা ঘরের জমাট নীরবতা দেয়ালের ফাঁক-ফোঁকর গলে বেরিয়ে যেত বাইরে। মালেক ওহাব ছেলের ডাকে সাড়া দিয়ে তাড়াতাড়ি হাতের জিনিসপত্র নামিয়ে তাকে কোলে তুলে নিতেন। তার বিশাল বুকের উষ্ণ উত্তাপে ও গভীর আদরে তিনি ভরিয়ে দিতেন, শিশুটিকে। সে মুহূর্তে তার প্রতিটি আচরণেই সন্তানের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের পরিচয় ফুটে উঠত ।