proggapath, progga, bangla literature, bangla kobita, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, classic novel, মরিয়ম জামিলা, Maryam Jamila, ফিলিস্তিনের আকাশ, philistiner akash

ফিলিস্তিনের আকাশ

০ মন্তব্য দর্শক

 দশ :

রমজান- বছরের সবচেয়ে পবিত্র মাসটি এসে গেছে। আগেকার বছরগুলোতে ইরাক আল মানশিয়ার শিশু-কিশোরদের জন্যে রমজান মাসটি ছিল বড় আনন্দের । এ সময় রাতের বেলা পুরো গাজা শহরটা হেসে উঠতো অসংখ্য লণ্ঠনের আলোয় । রাস্তায় রাস্তায় দেখা যেত মানুষের মিছিল আর মিছিল। পোষা ময়না তার ভালুক নিয়ে সবাইকে আনন্দ দিতে গ্রাম থেকে গ্রামে খেলা দেখিয়ে বেড়াত তাদের মালিকেরা। শুধু এরাই নয়- এ সময়ে আরো আসতো জাদুকর আর কথক। কথকেরা শোনাতো মহান বীর সুলতান সালাহউদ্দীন আইউবী ও সুলতান বায়বার্সের ফিলিস্তিনের মাটি থেকে খৃষ্টান ক্রুসেডারদের তাড়িয়ে দেয়ার চমকপ্রদ শৌর্য-বীর্যে ভরা কাহিনী-গাথা। আহমদ খলিলের মনে পড়ে সেই শেষ রাতগুলোর কথা। আব্বা, চাচা ও অন্যান্য পড়শীদের সাথে সে এবং আবদুল আজিজও শামিল হতো বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেহরী খাওয়ার জন্যে সকলকে জাগিয়ে তোলার আনন্দময় কাজে ।
সেই রমজান মাস আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু এবারের রমজানে আহমদ খলিলের মনে কোন আনন্দ নেই। বড় বেশি একা হয়ে পড়েছে। সে স্পষ্ট উপলব্ধি করে- এফেন্দীর বাড়ি থেকে ঘরে ফিরে আসার পর তার আব্বা, ছোট ভাইসহ পরিবারের আর সবার সাথে তার এক বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে। তাদের কাছে সে এক আগন্তুক বই নয়। অথচ কি অদ্ভুত সুন্দর মুক্তির স্বাদ এবং বুক ভরা আনন্দ নিয়েই না সে বাড়ি ফিরেছিল। আব্বার কাছে আবার ফিরতে পারছে- এ খুশিতে আর কিছুই তার নজরে আসেনি। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সব আনন্দ মিলিয়ে যায়। এখন মালেক ওহাবকে সর্বান্তকরণে এড়িয়ে চলে সে।
সত্যি কথা, তার আব্বার কোন প্রত্যাশাই আহমদ খলিল পূর্ণ করতে পারেনি। এফেন্দীর বাড়িতে কয়েক বছর কাটিয়ে সে অনেক কিছুই দেখেছে, শুনেছে ও জেনেছে বলেই মালেক ওহাবের বিশ্বাস। গাজা শহরে সে কি দেখেছে, খবরের কাগজ, বই ইত্যাদি পড়ে সে কতটুকু জানতে পেরেছে, এফেন্দীর বাড়িতে যাতায়াতকারী বৃটিশ অফিসাররা কি আলোচনা করত- এ সবই তিনি আহমদ খলিলের কাছে জানতে চান। কিন্তু আহমদ খলিল কিছুই বলতে পারে না। বেশ কয়েকদিন বহুবার জিজ্ঞেস করার পরও সে কোন কথা বলেনি বা বলতে পারেনি। দুঃখে, ক্ষোভে তাকে তিরস্কার ও গালাগালিও করেছেন মালেক ওহাব। এর ফলে আহমদ খলিলের সাথে তার আরো বেশি ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে যায়।
আহমদ খলিল যে তার আব্বার ক্ষোভের কারণ বুঝতে পারে না, তা নয়। কিন্তু সে বলতে পারে না যে খাদিজা ইন্তেকাল করার পর থেকে কি গুরুভার একাকীত্ব তাকে বছরের পর বছর ধরে কুরে কুরে খাচ্ছে।
এফেন্দীর বাড়িতে যে সময়টা সে কাটিয়েছে তার মধ্যে কোন শান্তি, স্বস্তি বা সান্ত্বনা ছিল না। একটা ক্রীতদাসের মতো সে শুধু মুখ বুজে কাজ করে গেছে, হুকুম তামিল করেছে। লেখাপড়া করার কোন রকম আগ্রহই তার মধ্যে ছিল না। তাই, মালেক ওহাবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে এখন সে শুধু ভয়ই পায়, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না ।
আহমদ খলিল আরো দেখে, খলিফার সাথেও তার বিরাট ও অনতিক্রম্য এক ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। খলিফা তার এক মাত্র ভাই এবং ছোট ভাই। তার বয়স এখন সাত। কিন্তু শারীরিক বা মানসিক ভাবে সে এখনো একটি ছোট্ট শিশুর মতই রয়ে গেছে। বড় ভাইয়ের দিকে সে তাকায় এক অপরিচিত দৃষ্টিতে। আহমদ খলিল বহু চেষ্টা করেও রুগ্ন, দুর্বল, ভাইটিকে আপন করে তুলতে পারে না। এক সময় ভাইয়ের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা উবে গিয়ে আহমদ খলিলের মনে জন্ম নিতে থাকে এক ধরনের ক্রোধ ও ঘৃণা । খলিফা ছোট হলেও বড় ভাইয়ের এ বৈরী দৃষ্টি চিনতে ভুল করেনি। ফলে উভয়ে উভয়ের কাছ থেকে অনেকখানি দূরে সরে যায়।
মালেক ওহাব নিজেও খলিফাকে নিয়ে একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছেন। খাদিজার মৃত্যুর পর শিশু সন্তানটিকে স্নেহ-মমতা উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। তবে তার চেয়েও খলিফার জন্যে বেশি করেছে খাদিজার ভাই ইউসুফ মালিক ও তার স্ত্রী নাঈমা। আসলে খলিফাকে বড় করে তুলেছে তারাই। বিশেষ করে, নিজেদের প্রথম সন্তান আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর খলিফা হয়ে উঠেছে ইউসুফ ও নাঈমার নয়নের মণি। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সাত বছরে পড়ার পরও খলিফা এখনো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি । মালেক ওহাবের একান্ত আশা ছিল খলিফাকে ডাক্তারী পড়াবেন, সে গ্রামে ফিরে এসে অশিক্ষিত ফেলাহীনদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে, সবার রোগ সারিয়ে তুলবে, খাদিজার মতো আর কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না। কিন্তু সব আশা নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখে মালেক ওহাব এখন শুধু নিজের ভাগ্যকেই অভিশাপ দেন। খলিফাকে দেখলেই এখন তার মেজাজ বিগড়ে যায়, স্নেহ-মমতার টান তিনি অনুভব করেন না।
সেদিন মালেক ওহাব ঘরে ঢুকেই দেখলেন, ইউসুফ মালিক মেঝেতে বসে আছেন । তার কোলে বসে আছে খলিফা। ইউসুফ পরম যত্নে ভালো ভালো কিছু খাবার বালকটির মুখে তুলে দিচ্ছেন। আর সেও একান্ত অভিনিবেশ সহকারে খেয়ে চলেছে। হঠাৎ করেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে মালেক ওহাবের। কণ্ঠে একরাশ ঘৃণা নিয়ে ইউসুফের উদ্দেশ্যে তিনি বলে উঠেন ঃ ওকে যে কি করে তোমরা এত ভালবাস তা আমি বুঝতে পারি না। ওতো একটা অবোধ জন্তু ছাড়া আর কিছু নয়। তোমরা জানো না, খলিফা আর কোনদিনই স্বাভাবিক হবে না। তাছাড়া ……..
মালেক ওহাবকে কথা শেষ করতে দিলেন না ইউসুফ মালিক। বেদনাহত স্বরে তিনি বললেন : এসব কি বলছেন আপনি? আপনিই যদি এরকম অবহেলা করেন তাহলে ওকে আর দেখবে কে?
আহমদ খলিল পাশেই বসেছিল। ইউসুফের কথায় চমকে ওঠে সে। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, তাইতো! এ কথাটা তো সে কোনদিন ভাবেনি। খলিফার প্রতি এতদিন সে শুধু বিরক্তি, ঘৃণা আর বিতৃষ্ণাই পোষণ করে এসেছে। কিন্তু সে তো তারই ভাই, একই মায়ের সন্তান। এখন পর্যন্ত খলিফা ভালো করে হাঁটতে পারে না। এক গভীর বিষণ্ণতা ছড়িয়ে থাকে তার সারাটা চেহারায়, সব সময়। সে কোনদিন তার মত সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম হয়ে উঠতে পারবে কি না, কে জানে! মনটা অনুশোচনায় ভরে ওঠে আহমদ খলিলের। খলিফার প্রতি এক গভীর সহানুভূতি ও মমত্ববোধে তার হৃদয় উদ্বেলিত হতে থাকে ।
সারাদিন নগ্ন, তীক্ষ্ণ উত্তাপ ঢেলে সূর্যটা সবে মাত্র মুখ লুকিয়েছে মরুভূমির দূর দিগন্তের অন্তরালে। আহমদ খলিল একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সেদিকে। আজ ক’দিন ধরে তার মনের মধ্যে গভীর বিষাদ বাসা বেঁধে আছে। চারপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশটা ভালো লাগতে থাকে তার। কখন যে নিজের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল তা সে জানে না। গ্রামের নারী ও শিশুদের আতঙ্কিত চিৎকার কানে আসতেই চমকে সে ওঠে। সামনে তাকিয়েই বরফের মতো জমে যায় সে। সৈন্যবাহী ট্রাকটাকে তাদের ঘরের সামনে এসে থেমে যেতে দেখে আহমদ খলিল। ট্রাকটা থামার সাথে সাথে দশ বারো জন ইহুদী সৈন্য লাফ দিয়ে নেমে আসে। হাল্কা মেশিনগান তাদের হাতে। পর মুহুর্তেই বিস্ময়ে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায় । সৈন্যদের অধিকাংশই সুন্দরী তরুণী। সে অবাক হয়ে দেখে শর্টস ও খাকি হাফ প্যান্ট পরা মেয়ে সৈনিকগুলোকে পুরুষের চেয়েও নির্মম, নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। বিস্ময় বিমূঢ় আহমদ খলিল সংবিত ফিরে পায়। সৈন্যরা ইতিমধ্যে বাড়ির সবাইকে আটক করে ফেলেছে। মালেক ওহাব, ইউসুফ মালিক কিংবা খলিফা কেউই বাদ যায়নি। সবাইকে তুলে নিয়ে ট্রাকটি ছুটে চলে।
কিছুক্ষণ চলার পর সৈন্যরা চিৎকার করে সবাইকে গাড়ি থেকে নেমে আসার হুকুম দেয়। জায়গাটা নেগবা। ট্রাকে করে এর আগে গ্রামের আরো প্রায় ত্রিশ জনকে ধরে আনা হয়েছিল। ইহুদী সৈন্যরা ভেড়ার পালের মতো সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে একটি লম্বা, দরজা জানালাহীন ঘরে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়। এটি ছিল নেগবার জেলখানা। ফিলিস্তিনী বন্দীদের নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবেও ইহুদীরা এটাকে ব্যবহার করত।
কিছুক্ষণ পরই বাইরে থেকে একটা কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসে গ্রাম প্রধানকে এখানে নিয়ে এসো। সৈন্যরা ইউসুফ মালিককে বন্দীদের মাঝ থেকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
বারান্দায় একটা খোলা ডেস্কের ওপাশে লোকটি বসে। ইউসুফ মালিক দেখেই বুঝলেন- লোকটা ইহুদী স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদল হোগানার একজন বড় পদের অফিসার। তার অভিব্যক্তিতে প্রচণ্ড কর্তৃত্বের ছাপ স্পষ্ট। ডেস্কের কাছে পৌঁছতেই সে হিব্রু ভাষা ছাপা একটি কাগজ তার দিকে এগিয়ে দেয়। কাগজটা যে কোন দলিল, তাতে ইউসুফ মালিকের সন্দেহ নেই। বুড়ো আঙ্গুলে কালি লাগিয়ে কাগজে একটা টিপসই দেয়ার আদেশ দেয় লোকটি। কিন্তু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন ইউসুফ।
ইউসুফের নিস্পৃহতা লক্ষ্য করে ক্ষেপে ওঠে হোগানা অফিসার : গাধা নাকি হে তুমি! শোন, যদি বাঁচতে চাও- কাগজে একটা টিপসই দাও। এতে প্রমাণ হবে যে তোমাদের জমির উপর আমাদের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছ। তাছাড়া তোমরা তো জানোই যে, এফেন্দী বহু বছর আগেই এ জমি আমাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। একটু থামে অফিসারটি। শোন, এ জমির জন্য প্রাণ দিতেও আপত্তি নেই আমাদের বুঝলে? অনেকটা রক্ত আমরা এর মধ্যেই এখানে ঢেলেছি। দরকার হলে আরো রক্ত দেব। তাছাড়া আমাদের সাথে যুদ্ধে জেতার কোন সম্ভাবনাই তোমাদের নেই। সুতরাং ইরাক আল মানশিয়ার উপর আমাদের অধিকার স্বীকার কর। ইখওয়ানদের অস্ত্র বা কোন রকম সাহায্য দেয়াও তোমাদের বন্ধ করতে হবে। আমাদের কথা মানলে তোমাদের এমন সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে যা হাজার বছরেও তোমাদের জাত ভাইদের কাছ থেকে পাওনি
ছাপানো দলিলটা থাবা দিয়ে টেবিল থেকে তুলে নেন ইউসুফ। মুহূর্তের মধ্যেই তা ছিড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলেন তিনি। চিৎকার করে বলেন-
: তোমরা কখনোই আমাদের শাসন করতে পারবে না। এখানে তোমাদের কিছুই নেই। এ জমি আমাদের। তোমরাই তা কেড়ে নিয়েছ এবং আরো নিতে চাইছ। আমাদের ঘোড়া চুরি করেছ, পানির ঝর্ণাগুলো কেড়ে নিয়েছ। আর কি চাও তোমরা? প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মাদের মতো বলতে থাকেন ইউসুফ : আমাদের জিনিস আমাদের ফিরিয়ে দাও। যদি বাঁচতে চাও সমুদ্র পারের যে দেশ থেকে এসেছ সেখানেই চলে যাও । এদেশের সবকিছু গ্রাস করার কোন অধিকার তোমাদের নেই। কথা শেষ করে উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকেন ইউসুফ।
হোগানা কমাণ্ডারের গলা শোনা গেল : আমরা জানি, আমাদের উপর হামলার জন্য ইখওয়ানদের তুমি নিজের গ্রামে ঘাঁটি তৈরি করতে দিয়েছ। তোমরা তাদের খাবার দাও, লুকিয়ে রাখ, তাদের আশ্রয় এবং উৎসাহ দাও বলেও আমরা জানতে পেরেছি। এসব তুমি বন্ধ করবে কিনা বল? নইলে তোমাকে গুলী করে মারব আমি।
ঝট করে কোমর থেকে পিস্তলটা ভুলে নিয়ে ইউসুফ মালিকের বুকের দিকে তাক করে অফিসার। মনে হলো এখনই গুলী করবে। সে ইউসুফ মালিকের চোখের দিকে তাকায়। দেখতে পায় দু’টি উজ্জ্বল কালো চোখ, ঈগলের ঠোঁটের মত বাঁকা নাক, ঘন দাড়ি ও কাফিয়াহুতে ঢাকা দীপ্ত একটি মুখ। দীর্ঘ কয়েকটি মুহূর্ত। হাত নামিয়ে নেয় অফিসার।
: নিয়ে যাও একে – সৈন্যদের প্রতি বাজখাই পলায় হুকুম দেয় সে। মরুভূমির এই ইঁদুরগুলো কিছুতেই নিজেদের ভালোটুকু বুঝবে না। ঠিক আছে, সবক’টাকে ইরগুনের হাতে তুলে দাও। এমন শিক্ষা পাবে যা সহজে ভুলতে পারবে না।
ইরগুন হলো ইহুদীদের গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। সাধারণ মানুষ এর নাম শুনলেই ভয়ে আঁতকে ওঠে। বুশেন ওয়ার্ল্ড, ডসাউ, বার্জেন বেলসন ও অসউইজ নাৎসী নির্যাতন শিবির থেকে বেঁচে যাওয়া যুবক যুবতীদের নিয়ে এ সংস্থা গঠিত। আত্মপরিচয় গোপন রাখার উদ্দেশ্যে ইরগুন সদস্যদের মুখ ঢাকা থাকে কালো মুখোশে। এর ফলে ওদের আরো বেশি ভয়ংকর দেখায় ।
ইরগুনের দু’জন সদস্য বন্দীদের দিকে এগিয়ে আসে। শুরু হয় নির্মম প্রহার ও নির্যাতন। ভাগ্যক্রমে খুব ছোট বলেই হয়ত, আহমদ খলিল, আবদুর রশিদ ও খলিফার দিকে ওরা নজর দিল না। ছোট বালক দু’টিকে যাতে ভয়ংকর কিছু স্বচক্ষে দেখতে না হয় সে জন্য কাফিয়াহ্ দিয়ে ওদের চোখ বেঁধে দিল আহমদ খলিল। কিন্তু নির্যাতনের চিৎকার আর্তনাদ ওদের কানে ঠিকই প্রবেশ করে।
সকাল বেলায় ছাড়া পায় সবাই। ঠিক সবাই নয়। নির্মম নির্যাতনে নিহত সাতজন সাথীর লাশ নিয়ে বাকি লোকেরা ইরাক আল মানশিয়ার দিকে এগিয়ে চলে । যারা আহত এবং হাঁটতে অসমর্থ, অপেক্ষাকৃত শক্তিমানেরা তাদের কাঁধে তুলে নেয় ।
গ্রামে ইখওয়ান স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সবাই এসে পৌঁছতেই আহতদের চিকিৎসার কাজ শুরু হয়। স্বেচ্ছাসেবীদের দু’জন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রী প্রাপ্ত। গুরুতর আহত ইউসুফ মালিকের জন্যে একটি স্ট্রেচার নিয়ে আসা হয়। ইরগুনের ঘাতক সদস্যরা তার পেটে গুলী করেই থামেনি, সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরের গোপন অঙ্গ পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে পশুরা। ইখওয়ান স্বেচ্ছাসেবীরা ইউসুফের তীব্র ব্যথা কমানোর জন্য আগেই মরফিয়া ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। এরপর ক্ষতস্থানে গজ ভরে বেঁধে দেওয়ার পর গাজার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই বাধা দেন তিনি। ইউসুফ মালিক তাদের বোঝান যে হাসপাতালে নিলেও তার বাঁচার কোন আশা নেই। তার চেয়ে এখানে চিকিৎসা হওয়ার দিকেই বেশী জোর দেন তিনি। ইখওয়ান সদস্যরা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যায়।
সেদিনের আতংক ভরা রাতের পর আরো পাঁচ দিন কেটে গেছে। গোত্রের আহত আট জনের অবস্থা এখন অনেকটা ভালো। কিন্তু আগের চেয়ে ইউসুফ মালিকের অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। প্রচুর রক্তপাতের ফলে তার শরীর হয়ে উঠেছে রক্তশূন্য। তাছাড়া উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে ভিতরের ক্ষতগুলোতে পচন ধরেছে। অত্যধিক পরিমাণ সালফাড্রাগস এবং পেনিসিলিন আসন্ন মৃত্যুর সামনে শুধু প্রতিরোধের সাময়িক একটি দেয়াল তৈরি করে রাখে।
ইহুদীদের নির্মম হামলার মুখে টিকতে না পেরে ফিলিস্তিনীরা প্রাণের ভয়ে দলে দলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছে। তাদের যাবার পথটা এগিয়ে গেছে ইরাক আল মানশিয়ার সামনে দিয়েই। আহমদ খলিল সারাদিন ধরে প্রাণের মায়ায় ছুটতে থাকা অসহায় বাস্তুহারা মানুষগুলোর চলে যাওয়া দেখে। তার মনে হয়, ফিলিস্তিনে হয়ত শেষ পর্যন্ত কোন আরবকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকা কাফেলার কোন দল রাত্রি নেমে এলে ইরাক আলমানশিয়ায় আসে। ছোট গ্রামটির ঘরবাড়ি ভরে ওঠে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে। পরিশ্রান্ত শরীরে তারা ঘুমিয়ে পড়ে যেখানে সেখানে। আর আহমদ খলিল দেখে, রাত একটু গভীর হতেই তার আব্বা গিয়ে বসেন অত্যাচারিত মানুষগুলোর পাশে। তার বড় বড় চোখের দৃষ্টি নিবন্ধ সামনের সড়কের দিকে। এ পথ ধরে আবারো যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে ইহুদী হায়েনারা। কোলের উপর রাখা তার প্রিয় রাইফেল। পলায়মান মানুষগুলোর নিরাপত্তার কথা ভেবে স্বেচ্ছায় রাত জেগে পাহারার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

ফিলিস্তিনের আকাশ

দর্শক

 দশ :

রমজান- বছরের সবচেয়ে পবিত্র মাসটি এসে গেছে। আগেকার বছরগুলোতে ইরাক আল মানশিয়ার শিশু-কিশোরদের জন্যে রমজান মাসটি ছিল বড় আনন্দের । এ সময় রাতের বেলা পুরো গাজা শহরটা হেসে উঠতো অসংখ্য লণ্ঠনের আলোয় । রাস্তায় রাস্তায় দেখা যেত মানুষের মিছিল আর মিছিল। পোষা ময়না তার ভালুক নিয়ে সবাইকে আনন্দ দিতে গ্রাম থেকে গ্রামে খেলা দেখিয়ে বেড়াত তাদের মালিকেরা। শুধু এরাই নয়- এ সময়ে আরো আসতো জাদুকর আর কথক। কথকেরা শোনাতো মহান বীর সুলতান সালাহউদ্দীন আইউবী ও সুলতান বায়বার্সের ফিলিস্তিনের মাটি থেকে খৃষ্টান ক্রুসেডারদের তাড়িয়ে দেয়ার চমকপ্রদ শৌর্য-বীর্যে ভরা কাহিনী-গাথা। আহমদ খলিলের মনে পড়ে সেই শেষ রাতগুলোর কথা। আব্বা, চাচা ও অন্যান্য পড়শীদের সাথে সে এবং আবদুল আজিজও শামিল হতো বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেহরী খাওয়ার জন্যে সকলকে জাগিয়ে তোলার আনন্দময় কাজে ।
সেই রমজান মাস আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু এবারের রমজানে আহমদ খলিলের মনে কোন আনন্দ নেই। বড় বেশি একা হয়ে পড়েছে। সে স্পষ্ট উপলব্ধি করে- এফেন্দীর বাড়ি থেকে ঘরে ফিরে আসার পর তার আব্বা, ছোট ভাইসহ পরিবারের আর সবার সাথে তার এক বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে। তাদের কাছে সে এক আগন্তুক বই নয়। অথচ কি অদ্ভুত সুন্দর মুক্তির স্বাদ এবং বুক ভরা আনন্দ নিয়েই না সে বাড়ি ফিরেছিল। আব্বার কাছে আবার ফিরতে পারছে- এ খুশিতে আর কিছুই তার নজরে আসেনি। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সব আনন্দ মিলিয়ে যায়। এখন মালেক ওহাবকে সর্বান্তকরণে এড়িয়ে চলে সে।
সত্যি কথা, তার আব্বার কোন প্রত্যাশাই আহমদ খলিল পূর্ণ করতে পারেনি। এফেন্দীর বাড়িতে কয়েক বছর কাটিয়ে সে অনেক কিছুই দেখেছে, শুনেছে ও জেনেছে বলেই মালেক ওহাবের বিশ্বাস। গাজা শহরে সে কি দেখেছে, খবরের কাগজ, বই ইত্যাদি পড়ে সে কতটুকু জানতে পেরেছে, এফেন্দীর বাড়িতে যাতায়াতকারী বৃটিশ অফিসাররা কি আলোচনা করত- এ সবই তিনি আহমদ খলিলের কাছে জানতে চান। কিন্তু আহমদ খলিল কিছুই বলতে পারে না। বেশ কয়েকদিন বহুবার জিজ্ঞেস করার পরও সে কোন কথা বলেনি বা বলতে পারেনি। দুঃখে, ক্ষোভে তাকে তিরস্কার ও গালাগালিও করেছেন মালেক ওহাব। এর ফলে আহমদ খলিলের সাথে তার আরো বেশি ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে যায়।
আহমদ খলিল যে তার আব্বার ক্ষোভের কারণ বুঝতে পারে না, তা নয়। কিন্তু সে বলতে পারে না যে খাদিজা ইন্তেকাল করার পর থেকে কি গুরুভার একাকীত্ব তাকে বছরের পর বছর ধরে কুরে কুরে খাচ্ছে।
এফেন্দীর বাড়িতে যে সময়টা সে কাটিয়েছে তার মধ্যে কোন শান্তি, স্বস্তি বা সান্ত্বনা ছিল না। একটা ক্রীতদাসের মতো সে শুধু মুখ বুজে কাজ করে গেছে, হুকুম তামিল করেছে। লেখাপড়া করার কোন রকম আগ্রহই তার মধ্যে ছিল না। তাই, মালেক ওহাবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে এখন সে শুধু ভয়ই পায়, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না ।
আহমদ খলিল আরো দেখে, খলিফার সাথেও তার বিরাট ও অনতিক্রম্য এক ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। খলিফা তার এক মাত্র ভাই এবং ছোট ভাই। তার বয়স এখন সাত। কিন্তু শারীরিক বা মানসিক ভাবে সে এখনো একটি ছোট্ট শিশুর মতই রয়ে গেছে। বড় ভাইয়ের দিকে সে তাকায় এক অপরিচিত দৃষ্টিতে। আহমদ খলিল বহু চেষ্টা করেও রুগ্ন, দুর্বল, ভাইটিকে আপন করে তুলতে পারে না। এক সময় ভাইয়ের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা উবে গিয়ে আহমদ খলিলের মনে জন্ম নিতে থাকে এক ধরনের ক্রোধ ও ঘৃণা । খলিফা ছোট হলেও বড় ভাইয়ের এ বৈরী দৃষ্টি চিনতে ভুল করেনি। ফলে উভয়ে উভয়ের কাছ থেকে অনেকখানি দূরে সরে যায়।
মালেক ওহাব নিজেও খলিফাকে নিয়ে একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছেন। খাদিজার মৃত্যুর পর শিশু সন্তানটিকে স্নেহ-মমতা উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। তবে তার চেয়েও খলিফার জন্যে বেশি করেছে খাদিজার ভাই ইউসুফ মালিক ও তার স্ত্রী নাঈমা। আসলে খলিফাকে বড় করে তুলেছে তারাই। বিশেষ করে, নিজেদের প্রথম সন্তান আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর খলিফা হয়ে উঠেছে ইউসুফ ও নাঈমার নয়নের মণি। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সাত বছরে পড়ার পরও খলিফা এখনো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি । মালেক ওহাবের একান্ত আশা ছিল খলিফাকে ডাক্তারী পড়াবেন, সে গ্রামে ফিরে এসে অশিক্ষিত ফেলাহীনদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে, সবার রোগ সারিয়ে তুলবে, খাদিজার মতো আর কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না। কিন্তু সব আশা নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখে মালেক ওহাব এখন শুধু নিজের ভাগ্যকেই অভিশাপ দেন। খলিফাকে দেখলেই এখন তার মেজাজ বিগড়ে যায়, স্নেহ-মমতার টান তিনি অনুভব করেন না।
সেদিন মালেক ওহাব ঘরে ঢুকেই দেখলেন, ইউসুফ মালিক মেঝেতে বসে আছেন । তার কোলে বসে আছে খলিফা। ইউসুফ পরম যত্নে ভালো ভালো কিছু খাবার বালকটির মুখে তুলে দিচ্ছেন। আর সেও একান্ত অভিনিবেশ সহকারে খেয়ে চলেছে। হঠাৎ করেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে মালেক ওহাবের। কণ্ঠে একরাশ ঘৃণা নিয়ে ইউসুফের উদ্দেশ্যে তিনি বলে উঠেন ঃ ওকে যে কি করে তোমরা এত ভালবাস তা আমি বুঝতে পারি না। ওতো একটা অবোধ জন্তু ছাড়া আর কিছু নয়। তোমরা জানো না, খলিফা আর কোনদিনই স্বাভাবিক হবে না। তাছাড়া ……..
মালেক ওহাবকে কথা শেষ করতে দিলেন না ইউসুফ মালিক। বেদনাহত স্বরে তিনি বললেন : এসব কি বলছেন আপনি? আপনিই যদি এরকম অবহেলা করেন তাহলে ওকে আর দেখবে কে?
আহমদ খলিল পাশেই বসেছিল। ইউসুফের কথায় চমকে ওঠে সে। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, তাইতো! এ কথাটা তো সে কোনদিন ভাবেনি। খলিফার প্রতি এতদিন সে শুধু বিরক্তি, ঘৃণা আর বিতৃষ্ণাই পোষণ করে এসেছে। কিন্তু সে তো তারই ভাই, একই মায়ের সন্তান। এখন পর্যন্ত খলিফা ভালো করে হাঁটতে পারে না। এক গভীর বিষণ্ণতা ছড়িয়ে থাকে তার সারাটা চেহারায়, সব সময়। সে কোনদিন তার মত সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম হয়ে উঠতে পারবে কি না, কে জানে! মনটা অনুশোচনায় ভরে ওঠে আহমদ খলিলের। খলিফার প্রতি এক গভীর সহানুভূতি ও মমত্ববোধে তার হৃদয় উদ্বেলিত হতে থাকে ।
সারাদিন নগ্ন, তীক্ষ্ণ উত্তাপ ঢেলে সূর্যটা সবে মাত্র মুখ লুকিয়েছে মরুভূমির দূর দিগন্তের অন্তরালে। আহমদ খলিল একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সেদিকে। আজ ক’দিন ধরে তার মনের মধ্যে গভীর বিষাদ বাসা বেঁধে আছে। চারপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশটা ভালো লাগতে থাকে তার। কখন যে নিজের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল তা সে জানে না। গ্রামের নারী ও শিশুদের আতঙ্কিত চিৎকার কানে আসতেই চমকে সে ওঠে। সামনে তাকিয়েই বরফের মতো জমে যায় সে। সৈন্যবাহী ট্রাকটাকে তাদের ঘরের সামনে এসে থেমে যেতে দেখে আহমদ খলিল। ট্রাকটা থামার সাথে সাথে দশ বারো জন ইহুদী সৈন্য লাফ দিয়ে নেমে আসে। হাল্কা মেশিনগান তাদের হাতে। পর মুহুর্তেই বিস্ময়ে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায় । সৈন্যদের অধিকাংশই সুন্দরী তরুণী। সে অবাক হয়ে দেখে শর্টস ও খাকি হাফ প্যান্ট পরা মেয়ে সৈনিকগুলোকে পুরুষের চেয়েও নির্মম, নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। বিস্ময় বিমূঢ় আহমদ খলিল সংবিত ফিরে পায়। সৈন্যরা ইতিমধ্যে বাড়ির সবাইকে আটক করে ফেলেছে। মালেক ওহাব, ইউসুফ মালিক কিংবা খলিফা কেউই বাদ যায়নি। সবাইকে তুলে নিয়ে ট্রাকটি ছুটে চলে।
কিছুক্ষণ চলার পর সৈন্যরা চিৎকার করে সবাইকে গাড়ি থেকে নেমে আসার হুকুম দেয়। জায়গাটা নেগবা। ট্রাকে করে এর আগে গ্রামের আরো প্রায় ত্রিশ জনকে ধরে আনা হয়েছিল। ইহুদী সৈন্যরা ভেড়ার পালের মতো সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে একটি লম্বা, দরজা জানালাহীন ঘরে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়। এটি ছিল নেগবার জেলখানা। ফিলিস্তিনী বন্দীদের নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবেও ইহুদীরা এটাকে ব্যবহার করত।
কিছুক্ষণ পরই বাইরে থেকে একটা কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসে গ্রাম প্রধানকে এখানে নিয়ে এসো। সৈন্যরা ইউসুফ মালিককে বন্দীদের মাঝ থেকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
বারান্দায় একটা খোলা ডেস্কের ওপাশে লোকটি বসে। ইউসুফ মালিক দেখেই বুঝলেন- লোকটা ইহুদী স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদল হোগানার একজন বড় পদের অফিসার। তার অভিব্যক্তিতে প্রচণ্ড কর্তৃত্বের ছাপ স্পষ্ট। ডেস্কের কাছে পৌঁছতেই সে হিব্রু ভাষা ছাপা একটি কাগজ তার দিকে এগিয়ে দেয়। কাগজটা যে কোন দলিল, তাতে ইউসুফ মালিকের সন্দেহ নেই। বুড়ো আঙ্গুলে কালি লাগিয়ে কাগজে একটা টিপসই দেয়ার আদেশ দেয় লোকটি। কিন্তু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন ইউসুফ।
ইউসুফের নিস্পৃহতা লক্ষ্য করে ক্ষেপে ওঠে হোগানা অফিসার : গাধা নাকি হে তুমি! শোন, যদি বাঁচতে চাও- কাগজে একটা টিপসই দাও। এতে প্রমাণ হবে যে তোমাদের জমির উপর আমাদের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছ। তাছাড়া তোমরা তো জানোই যে, এফেন্দী বহু বছর আগেই এ জমি আমাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। একটু থামে অফিসারটি। শোন, এ জমির জন্য প্রাণ দিতেও আপত্তি নেই আমাদের বুঝলে? অনেকটা রক্ত আমরা এর মধ্যেই এখানে ঢেলেছি। দরকার হলে আরো রক্ত দেব। তাছাড়া আমাদের সাথে যুদ্ধে জেতার কোন সম্ভাবনাই তোমাদের নেই। সুতরাং ইরাক আল মানশিয়ার উপর আমাদের অধিকার স্বীকার কর। ইখওয়ানদের অস্ত্র বা কোন রকম সাহায্য দেয়াও তোমাদের বন্ধ করতে হবে। আমাদের কথা মানলে তোমাদের এমন সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে যা হাজার বছরেও তোমাদের জাত ভাইদের কাছ থেকে পাওনি
ছাপানো দলিলটা থাবা দিয়ে টেবিল থেকে তুলে নেন ইউসুফ। মুহূর্তের মধ্যেই তা ছিড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলেন তিনি। চিৎকার করে বলেন-
: তোমরা কখনোই আমাদের শাসন করতে পারবে না। এখানে তোমাদের কিছুই নেই। এ জমি আমাদের। তোমরাই তা কেড়ে নিয়েছ এবং আরো নিতে চাইছ। আমাদের ঘোড়া চুরি করেছ, পানির ঝর্ণাগুলো কেড়ে নিয়েছ। আর কি চাও তোমরা? প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মাদের মতো বলতে থাকেন ইউসুফ : আমাদের জিনিস আমাদের ফিরিয়ে দাও। যদি বাঁচতে চাও সমুদ্র পারের যে দেশ থেকে এসেছ সেখানেই চলে যাও । এদেশের সবকিছু গ্রাস করার কোন অধিকার তোমাদের নেই। কথা শেষ করে উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকেন ইউসুফ।
হোগানা কমাণ্ডারের গলা শোনা গেল : আমরা জানি, আমাদের উপর হামলার জন্য ইখওয়ানদের তুমি নিজের গ্রামে ঘাঁটি তৈরি করতে দিয়েছ। তোমরা তাদের খাবার দাও, লুকিয়ে রাখ, তাদের আশ্রয় এবং উৎসাহ দাও বলেও আমরা জানতে পেরেছি। এসব তুমি বন্ধ করবে কিনা বল? নইলে তোমাকে গুলী করে মারব আমি।
ঝট করে কোমর থেকে পিস্তলটা ভুলে নিয়ে ইউসুফ মালিকের বুকের দিকে তাক করে অফিসার। মনে হলো এখনই গুলী করবে। সে ইউসুফ মালিকের চোখের দিকে তাকায়। দেখতে পায় দু’টি উজ্জ্বল কালো চোখ, ঈগলের ঠোঁটের মত বাঁকা নাক, ঘন দাড়ি ও কাফিয়াহুতে ঢাকা দীপ্ত একটি মুখ। দীর্ঘ কয়েকটি মুহূর্ত। হাত নামিয়ে নেয় অফিসার।
: নিয়ে যাও একে – সৈন্যদের প্রতি বাজখাই পলায় হুকুম দেয় সে। মরুভূমির এই ইঁদুরগুলো কিছুতেই নিজেদের ভালোটুকু বুঝবে না। ঠিক আছে, সবক’টাকে ইরগুনের হাতে তুলে দাও। এমন শিক্ষা পাবে যা সহজে ভুলতে পারবে না।
ইরগুন হলো ইহুদীদের গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। সাধারণ মানুষ এর নাম শুনলেই ভয়ে আঁতকে ওঠে। বুশেন ওয়ার্ল্ড, ডসাউ, বার্জেন বেলসন ও অসউইজ নাৎসী নির্যাতন শিবির থেকে বেঁচে যাওয়া যুবক যুবতীদের নিয়ে এ সংস্থা গঠিত। আত্মপরিচয় গোপন রাখার উদ্দেশ্যে ইরগুন সদস্যদের মুখ ঢাকা থাকে কালো মুখোশে। এর ফলে ওদের আরো বেশি ভয়ংকর দেখায় ।
ইরগুনের দু’জন সদস্য বন্দীদের দিকে এগিয়ে আসে। শুরু হয় নির্মম প্রহার ও নির্যাতন। ভাগ্যক্রমে খুব ছোট বলেই হয়ত, আহমদ খলিল, আবদুর রশিদ ও খলিফার দিকে ওরা নজর দিল না। ছোট বালক দু’টিকে যাতে ভয়ংকর কিছু স্বচক্ষে দেখতে না হয় সে জন্য কাফিয়াহ্ দিয়ে ওদের চোখ বেঁধে দিল আহমদ খলিল। কিন্তু নির্যাতনের চিৎকার আর্তনাদ ওদের কানে ঠিকই প্রবেশ করে।
সকাল বেলায় ছাড়া পায় সবাই। ঠিক সবাই নয়। নির্মম নির্যাতনে নিহত সাতজন সাথীর লাশ নিয়ে বাকি লোকেরা ইরাক আল মানশিয়ার দিকে এগিয়ে চলে । যারা আহত এবং হাঁটতে অসমর্থ, অপেক্ষাকৃত শক্তিমানেরা তাদের কাঁধে তুলে নেয় ।
গ্রামে ইখওয়ান স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সবাই এসে পৌঁছতেই আহতদের চিকিৎসার কাজ শুরু হয়। স্বেচ্ছাসেবীদের দু’জন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রী প্রাপ্ত। গুরুতর আহত ইউসুফ মালিকের জন্যে একটি স্ট্রেচার নিয়ে আসা হয়। ইরগুনের ঘাতক সদস্যরা তার পেটে গুলী করেই থামেনি, সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরের গোপন অঙ্গ পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে পশুরা। ইখওয়ান স্বেচ্ছাসেবীরা ইউসুফের তীব্র ব্যথা কমানোর জন্য আগেই মরফিয়া ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। এরপর ক্ষতস্থানে গজ ভরে বেঁধে দেওয়ার পর গাজার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই বাধা দেন তিনি। ইউসুফ মালিক তাদের বোঝান যে হাসপাতালে নিলেও তার বাঁচার কোন আশা নেই। তার চেয়ে এখানে চিকিৎসা হওয়ার দিকেই বেশী জোর দেন তিনি। ইখওয়ান সদস্যরা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যায়।
সেদিনের আতংক ভরা রাতের পর আরো পাঁচ দিন কেটে গেছে। গোত্রের আহত আট জনের অবস্থা এখন অনেকটা ভালো। কিন্তু আগের চেয়ে ইউসুফ মালিকের অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। প্রচুর রক্তপাতের ফলে তার শরীর হয়ে উঠেছে রক্তশূন্য। তাছাড়া উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে ভিতরের ক্ষতগুলোতে পচন ধরেছে। অত্যধিক পরিমাণ সালফাড্রাগস এবং পেনিসিলিন আসন্ন মৃত্যুর সামনে শুধু প্রতিরোধের সাময়িক একটি দেয়াল তৈরি করে রাখে।
ইহুদীদের নির্মম হামলার মুখে টিকতে না পেরে ফিলিস্তিনীরা প্রাণের ভয়ে দলে দলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছে। তাদের যাবার পথটা এগিয়ে গেছে ইরাক আল মানশিয়ার সামনে দিয়েই। আহমদ খলিল সারাদিন ধরে প্রাণের মায়ায় ছুটতে থাকা অসহায় বাস্তুহারা মানুষগুলোর চলে যাওয়া দেখে। তার মনে হয়, ফিলিস্তিনে হয়ত শেষ পর্যন্ত কোন আরবকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকা কাফেলার কোন দল রাত্রি নেমে এলে ইরাক আলমানশিয়ায় আসে। ছোট গ্রামটির ঘরবাড়ি ভরে ওঠে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে। পরিশ্রান্ত শরীরে তারা ঘুমিয়ে পড়ে যেখানে সেখানে। আর আহমদ খলিল দেখে, রাত একটু গভীর হতেই তার আব্বা গিয়ে বসেন অত্যাচারিত মানুষগুলোর পাশে। তার বড় বড় চোখের দৃষ্টি নিবন্ধ সামনের সড়কের দিকে। এ পথ ধরে আবারো যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে ইহুদী হায়েনারা। কোলের উপর রাখা তার প্রিয় রাইফেল। পলায়মান মানুষগুলোর নিরাপত্তার কথা ভেবে স্বেচ্ছায় রাত জেগে পাহারার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত