দুই :
আহমদ খলিল যে বেঁচে থাকবে-তার পরিবারের কেউই এ কথা ভাবতে পারেনি । তার জন্মের আগে তিন ভাই ও এক বোন এবং জন্মের পরে আরো দু’টি ভাই ও বোন তার মায়ের বুক শূন্য করে ঢলে পড়েছে হিমশীতল মৃত্যুর কোলে। জন্মের পর থেকেই শরীরে বাসা বাঁধা অসুস্থতা ও দুর্বলতার জন্যে তারা কেউই শৈশবের সীমা পেরোতে পারে নি। শারীরিক দিক দিয়ে শিশু আহমদ খলিলের অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল না। হাঁটতে না শেখা পর্যন্ত সে শুধু ঘরের মধ্যে হামাগুড়ি দেয়াটাই রপ্ত করেছিল। দু’চারটে করে কথাও বলতে শিখেছিল সে। এই কথা বলায় তার উৎসাহ ছিল অপরিসীম। যে ঘরে তারা থাকত সে ঘরটা শুধু তাদের একার ছিল না। তার দাদা, চাচা এবং সন্তান সম্ভবা চাচীও ওদের সাথে একই ঘরে থাকতেন। এর ফলে, আহমদ খলিলের চারপাশে লোক জুটেছিল প্রচুর এবং তার নতুন কথা ফোটা মুখে মওকা পেয়ে অবিশ্রান্তভাবে কথার ফুলঝুরি ছুটতে লাগল । অবাক ব্যাপার যে এ সময়েই দাদা ও মায়ের মুখ থেকে শোনা কবিতার লাইনগুলো পুনরাবৃত্তির চেষ্টা করত সে। আরবী ভাষার অতুলনীয় ধ্বনি গাম্ভীর্য এবং অপরূপ ছন্দের দোলা এক অপূর্ব আবেশে তাকে মুগ্ধ করে দিত ।
মাঠে কাজের চাপ বেড়ে উঠেছিল ভীষণভাবে। আহমদ খলিলের মা খাদিজা আর আগের মতো শিশু পুত্রটির কাছে আসতে বা থাকতে পারতেন না। এত অল্প বয়সের জন্যে বাইরে যাওয়াও সম্ভব হতো না আহমদ খলিলের। ফলে, তার সারাটি দিন কাটতো ওই পাথুরে দেয়াল ঘেরা বদ্ধ ঘরের আবেষ্টনীতে। সে এক মর্মান্তিক সময় । ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় অস্থির একটি অসহায় শিশুর চিৎকার এবং আর্ত কান্নায় ভারী হয়ে উঠতো সে বদ্ধ ঘরের আবহাওয়া। তার কান্না ও চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে কেউ এগিয়ে এসে খাবার কোন ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত কিছুই করার থাকতো না তার ।
নিজেদের ঘরটি প্রথম দৃষ্টিতে শূন্য এবং অনাকর্ষণীয় মনে হলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ঘরটিই আহমদ খলিলের কাছে হয়ে উঠেছিল এক বিরাট আনন্দের উৎস। ঘরের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত বিছানো বিরাট মাদুরের ওপর হাত এবং পায়ের সাহায্যে সে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াত। এটাই ছিল তার প্রধান খেলা। এ খেলায় ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে আরেকটি নতুন খেলা শুরু করত। ঘরে দেয়ালের গায়ে সারি দিয়ে রাখা ছিল বিরাট বিরাট মাটির পাত্র। পানি এবং শস্য রাখার কাজে ব্যবহার করা হত এগুলো। আহমদ খলিল লুকোচুরি খেলতো এগুলোর আড়ালে একা একাই । এ খেলাতেও ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে এগিয়ে যেতো ঘরের কোণে। সেখানে বসানো তাঁতে মায়ের বোনা সুন্দর কারু-কাজ করা কাপড়গুলোর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে কেটে যেত তার অনেকটা সময়। কখনো বা সে এগিয়ে যেত ঘরের মাঝখানে চুল্লির দিকে । এর উপরে রাখা থাকত বিশাল এক তামার ডেকচি। পুরুষানুক্রমিক ভাবে এ পাত্রটি তার মায়ের হাতে এসেছিল। এর পাশেই একটি চ্যাপ্টা লোহার থালায় রুটি তৈরীর জন্যে মাখানো ময়দা রাখা হত। এগুলোতে ময়দা মাখা দেখতে খুব ভালো লাগত তার। সে বয়সেই খাবারের একটি কণাও নষ্ট করা বা বাইরে ছুঁড়ে না ফেলার শিক্ষা পেয়েছিল সে মায়ের কাছে। খাদিজা বলতেন : ‘নষ্ট করা বা ফেলে দেয়া খাবার কণাগুলি শয়তান কুড়িয়ে খায়। তাই এটা যারা করে, আল্লাহ তাদের শাস্তি দেন।’ ছোট ছেলে-মেয়েদের কেউ খেতে বসে অসাবধানে রুটির কোন টুকরো মাটিতে ফেলে দিলে খাদিজা তাকে তিরস্কার করতেন । সেটাকে পরম যত্নে তুলে নিতেন তিনি, রেখে আসতেন বাইরের দেয়ালের খাঁজে যাতে বিড়াল, কুকুর বা কোন পাখি ওগুলো খেয়ে যেতে পারে।
আহমদ খলিল জানত না, তার জন্মের মাত্র কয়েকমাস আগে তার গোত্রের ওপর অত্যাচারের কি ভয়ঙ্কর গজব নেমে এসেছিল। এর ফলে পুরো গোত্রটিই শিকার হয় এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের। একদিন গোত্রের কিছু ক্ষুধার্ত লোক পার্শ্ববর্তী দখলদার ইহুদী বসতি থেকে কিছু ভেড়া এবং মুরগী ধরে নিয়ে আসে। জোর করেই অবশ্য এগুলো আনা হয়েছিল। তারই প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ইসরাইলী সৈন্যরা সারাটি গ্রাম ঘেরাও করে বাসিন্দাদের সমস্ত গৃহপালিত পশু ধরে নিয়ে যায়। এসবের মধ্যে উটগুলো ছিল তাদের জন্যে অপ্রয়োজনীয় । কারণ, ইহুদীরা জমি চাষের কাজে ট্রাক্টর ব্যবহার করত, তাছাড়া উটের দুধ বা গোশ্ত তারা খেত না। তাই, গ্রামবাসীদের সমস্ত উট তারা গুলী করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় খোলা আকাশের নীচে । কয়েকটি মাত্র পশু তাদের নারকীয় আক্রোশ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। গোত্রের অসহায় মানুষদের পক্ষে এ ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারটি নীরবে এবং বিনাপ্রতিবাদে মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না । জমি চাষের জরুরী প্রয়োজনে এক বস্তা শস্যের বিনিময়েও আহমদ খলিলের আব্বা মালেক ওহাব ধার হিসেবে কোন উট যোগাড় করতে ব্যর্থ হন। বাধ্য হয়ে স্বয়ং খাদিজাকেই তখন ঘাড়ে জোয়াল রেখে লাঙ্গল টানতে হয়েছে জমিতে। যাদের লাঙ্গল টানার মত কোনই লোক ছিল না, জমি চাষে ব্যর্থ হয়ে জায়গায় জায়গায় গর্ত করে তার মধ্যে শস্যের বীজ পুঁতে দেয়া ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না । আর এটাও তারা পেরেছিল শুধুমাত্র এ কারণে যে তাদের জমির পরিমাণ ছিল নেহায়েতই কম ।
ঘরের একদিকের কোণায় ছিল পরিবারের অস্ত্রাগার। দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা তেল চকচকে রাইফেলগুলো দেখে আহমদ খলিল নিজেকে খুব নিরাপদ মনে করত। তার নানা, আব্বা এবং চাচারা তাকে যে কোন বিপদ থেকে রক্ষা করবেন-এ ব্যাপারে সে ছিল নিশ্চিত ।
আহমদ খলিলদের ঘরটি তৈরি হয়েছিল শক্ত পাথরের দেয়াল গেঁথে। এ সব ঘর ছিল অত্যন্ত মজবুত, টেকসই। দেয়ালগুলো ছিল অত্যন্ত পুরু যা ভেদ করে সূর্যের প্রখর তাপ ঘরের মধ্যে পৌঁছতে পারত না। কোন জানালা না থাকায় ভিতরটা ছিল আলো আঁধারিতে ভরা। তবে গরমের দিনে এ ঘর অত্যন্ত আরামদায়ক হলেও শীতকালের বৃষ্টির সময়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভূত হত।
এক বছর খুব ভালো ফসল হয়েছিল। খাবার জন্যে দুধ এবং কোন কোন সময় গোশ্ত পাওয়া যাচ্ছিল। মালেক ওহাব খাবার সময় তার থালায় খাদিজার তুলে দেয়া গোশতের টুকরোগুলো থেকে কয়েকটি টুকরো লুকিয়ে ফেলতেন। খাদিজা একটু অন্যদিকে তাকালেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেগুলো পুরে দিতেন আহমদ খলিলের মুখে। আবার রাতে বিছানায় শুয়েও অন্ধকারের সুযোগে অতিরিক্ত একটু দুধ কিংবা কমলা তাকে খাইয়ে দিতেন ।
আহমদ খলিল এ ব্যাপারে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। রাতে মালেক ওহাব ঘরে ফিরতেই সে হামাগুড়ি দিয়ে যতদ্রুত সম্ভব তার দিকে এগিয়ে যেত। তার ক্ষুদে হাত দু’টি কোন কিছু পাওয়ার আশায় তার আব্বার এ পকেট-সে পকেট ঘুরে ফিরত। আর কোনদিনই সে আশাহত হত না। মালেক ওহাব তার একমাত্র সন্তানটির জন্য রোজই দু’- তিনটে সিদ্ধ আলু কিংবা নিদেন পক্ষে একটি কমলা অবশ্যই নিয়ে আসতেন।
একদিনের ঘটনা। সকালে কাজে বের হবার আগে মালেক ওহাব তার গোপনে সঞ্চিত খাবারটুকু সযত্নে ছেলের মুখে তুলে দিচ্ছেন। খাওয়া শেষ হতেই আহমদ খলিল তার আব্বাকে অবাক করে দিয়ে বসে থাকা অবস্থা থেকে পায়ের ওপর ভর করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। বিরাট কোন কাজ সমাধা করার মতো এক আনন্দোজ্জ্বল অনুভূতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার চোখ-মুখ। বিস্ময় ও আনন্দে চিৎকার করে খাদিজাকে ডাকলেন মালেক ওহাব। খাদিজা দৌড়ে এসে তার সন্তানকে জীবনে এই প্রথমবারের মতো কোন অবলম্বন ছাড়া নিজের পায়ে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন। মালেক ওহাব একটু দূর থেকে হাত দু’টি প্রসারিত করে আরো এগিয়ে আসার জন্যে তাকে উৎসাহ দিতে শুরু করলেন। আহমদ খলিল তার দিকে কয়েক পা এগিয়েই তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। কিন্তু পর মুহূর্তেই সে আবার উঠে দাঁড়ায় এবং ঘরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে যায় গুটি গুটি পায়ে।
নিজের চোখে দেখেও খাদিজা ব্যাপারটি যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার ধারণা ছিল, আহমদ খলিল কোনদিন হাঁটতে পারবে না, বড়জোর বসে থাকার মত শক্তিটুকু সে অর্জন করতে পারবে। কারণ এই চার বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও এতদিন একটি অপরিণত শিশুর মতোই তাকে কোলে রাখতে হত। আহমদ খলিলের এই হাঁটতে পারার সাফল্য খাদিজার অন্তরকে ভরে তোলে এক অবর্ণনীয় আনন্দে ।
উজ্জ্বল সূর্যতাপের মাঝ থেকে সঞ্জীবনী শক্তি আহরণ করে যেমন বেড়ে ওঠে মাঠে ফসলগুলো এবং পায় পূর্ণতা, আহমদ খলিলের শরীর এবং স্বাস্থ্যের বেলাতেও ঠিক সে রকমই ঘটেছিল। সন্ধ্যায় মাঠের কাজ শেষে ঘরে ফিরতে শুরু করত লোকজন, ফিরে আসতেন খাদিজাও। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় তিনি ডাকতেন আহমদ খলিলকে। কিন্তু সে তখন ব্যস্ত থাকতো গ্রামের রাস্তায় অবিরাম ছুটোছুটিতে। অবশেষে মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে এলে খাদিজা তাকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরতেন বুকে। এক অদ্ভুত অনিবচনীয় আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠতো তার সারা শরীর। পরপর ছয়টি সন্তানের মৃত্যুর পর সেই খাদিজার একমাত্র সন্তান যে এখন পর্যন্ত জীবিত। এ জন্যে আল্লার দরবারে তিনি সারা দিনে অসংখ্যবার শোকর আদায় করতেন।
আহমদ খলিল ধীরে ধীরে বেশ শক্ত সমর্থ হয়ে উঠছিল। তার প্রধান খেলার সাথী ছিল দু’জন, চাচাতো ভাই আবদুল আজিজ ও চাচাতো বোন আসমা। খুব ভোর বেলায় ইরাক আল মানশিয়া গ্রামের কেউ জেগে ওঠার আগেই ওরা তিনজনে উঠে পড়ত বিছানা ছেড়ে। এরপর শুরু হতো ঘরের ছাদে উঠে হুটোপুটি, এক ছাদ থেকে লাফিয়ে যাওয়া আরেকটায় । যতক্ষণ না সব ঘরের লোকজন জেগে উঠত ততক্ষণ পর্যন্ত অবিশ্রান্তভাবে চলত তাদের এ লাফালাফি। তবে, গোত্রের অন্য ছেলে-মেয়েদের মতো প্রবীণ এবং মুরব্বীদের উপযুক্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর ব্যাপারটি কখনো বিস্মৃত হত না তারা ।
রাতে শোবার সময় মালেক ওহাব ছেলেকে পাশে রাখতেন। আহমদ খলিলের চোখে ঘুম নেমে না আসা পর্যন্ত তিনি মধুর স্বরে পবিত্র কুরআন পাঠ করে শোনাতেন ৷ আহমদ খলিল অত্যন্ত মনোযোগ ও আগ্রহ নিয়ে তা শুনত। খুবই ভাল লাগত তার। এর অন্যতম কারণ ছিল, এ পবিত্র গ্রন্থের বাণী সমুহের অর্থ বোঝায় তার কোন অসুবিধা হত না। কারণ, কুরআনের ভাষা-রীতির সঙ্গে শহর বা নগরে চর্চিত ও বিকশিত আরবীর মধ্যে অনেকখানি পার্থক্য সৃষ্টি হলেও আরবের বেদুইন গোত্রগুলির মধ্যে প্রচলিত আরবীর সঙ্গে কুরআনের ভাষার পার্থক্য ছিল সামান্যই
মালেক ওহাব ছেলেকে প্রায়ই নানা ধরনের গল্প শোনাতেন। এ প্রসঙ্গে নিজের প্রথম জীবনের কষ্টকর অধ্যায়ের কথাও কখনো কখনো গল্প করতেন। তার জীবনের একটি বিরাট অংশ কেটেছে তুর্কী সুলতানের এক ফিলিস্তিনী সেবাদাস মুস্তফা এফেন্দীর প্রাসাদোপম বাড়িতে একজন দাস হিসেবে। তবে প্রায় সময়ই নিজের কথা বাদ দিয়ে শহরগুলোর কথাই তিনি বেশি করে বলতেন। তার মনে এগুলোর স্মৃতি ছিল উজ্জ্বল। গাজা শহরটি ছিল একেবারে ক্ষুদ্র এবং গুরুত্বহীন-শহর না বলে এটিকে বরং বেদুইনদের কোন ব্যবসা কেন্দ্র বলতেই তিনি পছন্দ করতেন। এ তুলনায় কায়রো ছিল তার কাছে অনেকটা স্বপ্নপুরীর মতো। গভীরতম বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে আহমদ খলিল তার আব্বার কাছে শুনতো কায়রোর বিশাল বহুতল বিশিষ্ট বাড়িগুলোর কথা। সে আরো শুনতো দিনের আলোকে প্রায় হার মানানো বৈদ্যুতিক বাতি, বাস, ট্রাক, কার প্রভৃতি যন্ত্রযানের দ্রুত ধাবমানতার ক্ষেত্র সুবিশাল রাজপথ; নুতন পোস্ট অফিস, শিল্প কারখানা এবং সর্বাধুনিক উপকরণে সুসজ্জিত হাসপাতালের কথা। তবে তার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা গেল উড়োজাহাজের বেলায়। আহমদ খলিল উড়োজাহাজে চড়ে পাখির চেয়েও দ্রুত গতিতে আকাশে উড়ে বেড়াতে চায় কিনা– একথা জিজ্ঞেস করতেই সে প্রচণ্ড খুশিতে লাফিয়ে ওঠে বলে, হ্যাঁ, আব্বা, অবশ্যই। আমি আপনার সাথে ওই রকম একটি উড়ন্ত মেশিনে চড়তে চাই । পরক্ষণেই তার গলায় আকুল আগ্রহ ফুটে ওঠে : আপনি আমাকে কখন নিয়ে যাবেন আব্বা? আমরা কি এখনি রওনা হতে পারি না?
মৃদু হাসিতে ভরে ওঠে মালেক ওহাবের মুখ । বলেন : বাবা, সবুর কর। ইনশাল্লাহ খুব শীঘ্রই তুমি উড়োজাহাজে চড়তে পারবে। কারণ, তোমার সারাটি জীবনই এখানে এভাবে কাটুক তা আমি চাই না।
এরপর অনেকটা স্বগতোক্তির মতো তিনি পুত্রকে লক্ষ্য করে বলতে থাকেন ঃ সমগ্র ফিলিস্তিনের মধ্যে আমরা সবচেয়ে নিঃস্ব, অনগ্রসর এবং উপেক্ষিত। আমি প্রতি ওয়াক্ত নামাজের সময় আল্লাহর কাছে মোনাজাত করি যাতে একটি আধুনিক স্কুলে তোমাকে লেখাপড়া করাতে পারি। আমার ইচ্ছা, স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে তুমি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করবে এবং একজন সামান্য ফেলাহীন হওয়ার বদলে হবে একজন শিক্ষক, সমাজকর্মী; আইনজীবী অথবা একজন ডাক্তার ।
পাঁচ বছরের আহমদ খলিল এসব কথাবার্তা খুব কমই বুঝতো। কিন্তু তার পিতার ধীর, গম্ভীর কন্ঠস্বর এবং স্বপ্নময় অথচ সংহত আবেগ তাকে অভিভূত করত। মন্ত্রমুগ্ধের মত সে শুনে যেত এসব কথা। একসময় গাঢ় ঘুমে ছেয়ে যেতো তার চোখ। নিজের অজান্তেই সে হারিয়ে যেত আরেকটি অস্পষ্ট অচেনা জগতের গভীরে ।
একমাত্র পুত্রকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার আগ্রহের পিছনে মালেক ওহাবের একটি কারণ ছিল। একবার হজ্ব পালন উপলক্ষ্যে মক্কা যাওয়ার পথে কায়রো গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে সাইয়িদ রাশিদ রিজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইসলামী চিন্তানায়ক শাইখ মুহাম্মদ আবদুহু সহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গেও তিনি দেখা করেন। এ সাক্ষাতের ঘটনা তার চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তার দৃঢ় বিশ্বাস জাগে, কুরআন এবং হাদীসের আলোকে জীবন গঠন এবং তার সাথে পাশ্চাত্যের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জন করা জরুরী। নইলে ফিলিস্তিনের মত সারা দুনিয়ার মুসলমানরা শুধু ধ্বংস এবং নিগ্রহের অসহায় শিকারে পরিণত হবে।
এক রাতে আব্বার কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল আহমদ খলিল। এক সময় মালেক ওহাবের উঁচু গলার আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে দেখে, ঘরের কোণার দিকে রাখা ট্রাংকগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তালা খুলে তিনি এক প্ৰস্থ পোশাক বের করলেন। নিজের কাফিয়া এবং অন্যান্য কাপড় খুলে একে একে পরলেন শার্ট, জ্যাকেট, টাই, প্যান্ট, এবং জুতা। এরপর হ্যাট বের করে মাথায় দিতে যেতেই পাশে দাঁড়ানো খাদিজা ছোঁ মেরে কেড়ে নিলেন সেটা। পর মুহূর্তেই পায়ের তলায় ফেলে সেটাকে দলা-মোচড়া করে ফেললেন। রাগে কাঁপছিলো তার সারা শরীর। আহমদ খলিল আর কোনদিন তার মাকে এভাবে রাগতে দেখেনি ।
মালেক ওহাব ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেও কিছু না বলে এগিয়ে গিয়ে হ্যাটটি হাতে তুলে নিলেন। আহমদ খলিলের দিকে ফিরে বললেন – আজকের দিনের সভ্য মানুষ কোন পোশাক পরে, আমি সেটাই তোমাকে দেখাতে চাচ্ছি। এখানে আসার আগে আমি সব সময় এ পোশাকই পরতাম । অগ্রগতির স্পর্শ যখন এখানে এসেও লাগবে-দেখবে, তখন সবাই এ পোশাকই পরিধান করেছে। তা এ পোশাক তোমার কেমন মনে হয় বলতো?
-ঃ একেবারে বিশ্রী, আপনাকে খুব কুৎসিত দেখাচ্ছে। কাঁচা ঘুম ভাঙ্গা চোখে কেঁদে ফেলে আহমদ খলিল। পরমুহূর্তেই বিছানা থেকে উঠে দৌঁড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সে, যেন বাঁচতে চায় এ পোশাকধারীর কাছ থেকে।
: খুলে ফেল ওগুলো। শান্ত কিন্তু কঠিন স্বরে বললেন খাদিজা ।
: না, খুলবো না।
: আমি বলছি – তুমি খুলে ফেল ওগুলো। আর কোনদিন তুমি আমার সামনে এই
পোশাক পরবে না ।
খাদিজার কালো চোখ দু’টি থেকে যেন আগুন ঝরছিল। তার তীক্ষ্ণ নাক এবং শক্ত চিবুকে ফুটে উঠেছিল কর্তৃত্বের ছাপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তখনো ধীর, স্থির, শান্ত ছিলেন
তিনি।
মালেক ওহাবের মধ্যে পোশাক খোলার কোন আগ্রহ দেখা গেলনা। অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।
আরো কয়েকটি মুহূর্ত । হঠাৎ দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা গুলী ভরা রাইফেল হাতে তুলে নিলেন খাদিজা। চোখের পলকে চেম্বারে গুলী তুলে মালেক ওহাবের বুক বরাবর নিশানা করতেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি-
: না, না, গুলী করো না। তুমি পাগল হয়ে গেলে নাকি?
: আমি জানতে চাই, তুমি আমাদের না ওদের? খাদিজার গলায় ইস্পাতের কাঠিন্য — তুমি এগুলো এখনো খোল। নইলে সবাইকে আমি জানিয়ে দেব যে তুমি গোত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী একজন ব্রিটিশ স্পাই। আমার আব্বাকেও আমি কথাটা জানাব। আমার বিশ্বাস, গোত্রের প্রধান হিসেবে তোমার অপরাধের উপযুক্ত বিচার করবেন তিনি।
আহমদ খলিল দেখলো, তার শক্তিশালী পিতার মাথা অবনত হয়ে এসেছে। খাদিজা পাথরের মতো নীরবে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করছেন। রাইফেলটি তখনো হাতে ধরা রয়েছে তার। মালেক ওহাব ধীরে ধীরে ইউরোপীয় পোশাকগুলো খুলে ফেললেন। আগের পোশাকগুলো পরার পর ওগুলো পুনরায় তুলে রাখলেন ট্রাংকটিতে। বন্ধ ট্রাংকটির গায়ে তালাটা পূর্বের মতই ঝুলতে থাকলো ।