proggapath, progga, bangla literature, bangla kobita, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, classic novel, মরিয়ম জামিলা, Maryam Jamila, ফিলিস্তিনের আকাশ, philistiner akash

ফিলিস্তিনের আকাশ

০ মন্তব্য দর্শক

তিন :

ইহুদী দখলদারদের বিরুদ্ধে জেরুজালেমের মুফতী হাজী আমিন আল হুসাইনী যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, তখন ইরাক আল মানশিয়া গ্রামের অধিবাসীরাও তাতে সরাসরি জড়িত হয়ে পড়ে। এ সময় আহমদ খলিলের নানা শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। আহমদ খলিলের জীবনের এ সময়টুকু কেটেছিল তার নানার কাছেই ।
শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীম আদতে ছিলেন একজন গোত্রপ্রধান। প্রকৃত অর্থে তিনিই ছিলেন সমস্ত গোত্রের দন্ডমুণ্ডের মালিক। একজন পেশাদার কৃষিজীবী হিসেবে আর দশজন ফেলাহীনের সাথে তার বিশেষ পার্থক্য ছিল না। কিন্তু তার মেজাজটি ছিল একেবারে রাজকীয়। যে কেউই তাকে দেখামাত্র বুঝে ফেলত যে এ লোকটির জন্মই হয়েছে হুকুম করার জন্যে এবং অন্যদের সে হুকুম মানতেই হবে । আগের গোত্র প্রধানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার বা অন্য কোন সূত্রে নয়, শুধুমাত্র প্রবল ব্যক্তিত্বের জোরেই তিনি গোত্রের নেতা হয়ে ওঠেন।
মরুভূমির বেদুইনদের তাঁবুতেই একদিন তার সাক্ষাৎ হয় সউদী আরব থেকে আগত কয়েকজন ওহাবীর সাথে। ওহাবীরা তখন সুলতান ইবনে সউদকে রাজ্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়তা করছিল। এ সাক্ষাৎ তার জীবনে এক বড় রকমের পরিবর্তনের সূচনা করে। তিনি গতানুগতিক অভ্যাস ও প্রথার নিগড়ে বাঁধা ফেলাহীনদের জীবনধারাকে নতুন খাতে প্রবাহিত করার দুরুহ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অচেতন, উদাসীন, নিরক্ষর ফেলাহীনের দল যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পর্যন্ত শুদ্ধভাবে আদায় করতে পারতোনা- শেখের এ প্রয়াস তাদের মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার করে। তারা কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ায় তার কর্মকাণ্ডে সমর্থন যোগাতে। শিশু এবং বয়স্কদের শিক্ষাদানের জন্যে গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এজন্যে গাজা এবং অন্যান্য শহর থেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকদের নিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু এখানে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বহিরাগত ও শিক্ষিত লোকগুলি ফেলাহীনদের তাদের নিজেদের চেয়ে অনেক নীচুস্তরের মানুষ হিসেবে গণ্য করত। উপরন্তু, আধুনিক শিক্ষাদীক্ষায় চৌকস হলেও নিজ ধর্ম ও ঐতিহ্য বিষয়ে তাদের জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। ফলে শেখ এক্ষেত্রে ইন্সিত সাফল্য লাভ করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু এতে দমে না গিয়ে মসজিদগুলোতে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার কাজ চালাতে শুরু করেন। বেশ কিছুদিন একটানা প্রচার চালাবার ফলে দেখা যায় যে, গোত্রবাসীদের মধ্য থেকে অনেক কুসংস্কারসহ পীরপূজা, কবরপূজা, গান-বাজনা, নৃত্য, ধূমপান, মৃতের জন্যে উচ্চৈঃস্বরে কান্না প্রভৃতি জঞ্জালগুলো একেবারে বিদায় নিয়েছে ।
শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীমের বয়স তখন সত্তর চলছিল। তবে বয়সের ভারে তখনো নুয়ে পড়েননি তিনি। মেদহীন ঋজু দেহ। জীর্ণ গাউনের ওপর ভারী এক আঙরাখায় তার দেহ ঢাকা। সে আঙরাখার নানা জায়গায় অসংখ্য তালি লাগানো সত্ত্বেও ফুটো-ফাটার অভাব ছিল না। শুভ্র কেশভরা মাথায় জড়ানো একটি কাফিয়াহ্ । সাদা দাড়ি এবং ঈগল চঞ্চুর মতো খাড়া নাকের ওপর জ্বল জ্বল করা একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত গভীর কালো চোখ। জীর্ণ পোশাক পরিহিত, নগ্ন পা মানুষটির প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য কেউ তাকে উপেক্ষা করতে পারত না।
হালকা-পাতলা নাতিদীর্ঘ দেহের শেখ ছিলেন অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন। একটানা পরিশ্রমের ক্ষেত্রে এ বয়সেও তিনি ছিলেন একজন যুবকের মতই উৎসাহী এবং অক্লান্ত ।
মালেক ওহাবের সাথে ঝগড়ার ব্যাপারে খাদিজা তার আব্বাকে কিছুই জানাননি । আসলে স্বামীকে অপমানিত বা অপদস্থ করার কোন ইচ্ছাই তার ছিল না। কারণ সমস্ত গ্রামের মধ্যে মালেক ওহাবই ছিলেন একমাত্র শিক্ষিত লোক যিনি একাধিক ভাষা লিখতে ও পড়তে জানতেন। আর এ গুণগুলোর জন্যে তিনি কার্যতঃ হয়ে উঠেছিলেন একাধারে শেখের সেক্রেটারী এবং দোভাষী ।
আহমদ খলিল তার নানাকে লক্ষ্য করছিল। ঘরের কাঠের আলমারী থেকে তিনি একে একে বের করে আনলেন কাগজ, খাম, টিকিট, লেখার কলম এবং এক দোয়াত সুন্দর ভারতীয় কালি। উপকরণগুলো মালেক ওহাবের হাতে দিয়ে তাকে প্রস্তুত হয়ে বসতে বললেন শেখ। হাত দু’টি পিছনের দিকে বেঁধে পায়চারী করতে করতে চিঠির ভাষ্য বলতে থাকলেন তিনি। দ্রুত কলম চলতে থাকে মালেক ওহাবের। একে একে তিনটি চিঠি লেখা হল : প্রথমটি রিয়াদে সুলতান ইবনে সউদের কাছে, দ্বিতীয়টি কায়রোতে হাসান আল বান্নার কাছে এবং সর্বশেষটির প্রাপক জেরুজালেমের মুফতি হাজী আমিন আল হুসাইনী। সবগুলো চিঠিতেই মুস্তফা এফেন্দী কর্তৃক ইহুদী দখলদারদের কাছে ক্রমাগত ফিলিস্তিনী জমি বিক্রির ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করে ইরাক আল মানশিয়া গ্রামটিকে রক্ষার কাজে সাহায্য চেয়ে আবেদন জানানো হল ।
মালেক ওহাব চিঠিগুলো পোষ্ট করে আসার পর থেকেই শুরু হয় শেখের অধীর প্রতীক্ষা। কিছুদিনের ভেতরেই দু’টি চিঠির জবাব মেলে। সুলতান ইবনে সউদ কোন সাড়া না দিলেও উত্তর থেকে হাজী হুসাইনী এবং দক্ষিণ থেকে ইখওয়ান আল মুসলেমুনের স্বেচ্ছাসেবীরা জমায়েত হতে থাকে ইরাক আল মানশিয়াতে। শেখ স্বেচ্ছাসেবীদের সবার জন্যেই খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। এ স্বেচ্ছাসেবীদের আগমনে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হল তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় আশে পাশের বসতিগুলোর ফেলাহীনরাও এসে শেখের পাশে দাঁড়াল।
সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল। একদিন এক তুমুল যুদ্ধে ইহুদীদের অনিয়মিত সেনাদল ‘হোগানা’র বিশজন তরুণ যোদ্ধা গ্রামের মধ্যে ঘেরাও হয়ে পড়ে। পালানোর কোন পথ তাদের ছিলনা। বাধ্য হয়ে তারা অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। তার পুত্র ইউসুফ মালিক চাইছিলেন, এদেরকে সাথে সাথেই হত্যা করা হোক। কিন্তু তাদের এভাবে হত্যা করা ইচ্ছা শেখের ছিলনা। তাই, গ্রামের একটি বড় ঘরে তাদের বন্দী করে রাখা হলো । উত্তেজিত ফেলাহীনরা যাতে বন্দীদের হত্যা করতে না পারে সে জন্যে একদল সশস্ত্র ইখওয়ান সদস্যকে রাখা হলো কড়া পাহারায়।
আরো বেশ কয়েকটি বড় ধরণের সংঘর্ষের পর নেগবার দখলদার ইহুদীরা শান্তি প্রার্থনা করলে শেখ রাজী হলেন। উভয় পক্ষেই জীবিত বন্দী এবং মৃতদেহ বিনিময় হল ।
ইহুদীদের লাশগুলোর মধ্যে শেখ এক তরুণীর লাশ দেখতে পেলেন। তার পোশাক ছিল ছিন্নভিন্ন, চোখ দুটো উপড়ে ফেলা হয়েছিল এবং কেটে নেয়া হয়েছিল নাক ও কান। সাথে সাথে তিনি ব্যাপক অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। অবশেষে সন্ধ্যাবেলায় অপরাধীকে হাজির করা হল শেখের সামনে। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে, সমবেত জনতার মধ্যে শেখ তাকে হাঁটু গেড়ে বসার জন্যে আদেশ দিলেন। পরমুহূর্তেই তার সুতীক্ষ্ণ তলোয়ারের এক আঘাতে অপরাধীর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তধারা এবং মৃতদেহ দেখে জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ছয় বছরের বালক আহমদ খলিল চিৎকার করে উঠলো ভয় ও আতঙ্কে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে ধীর গম্ভীর গলায় শেখ বললেন-‘ভাইয়েরা, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে যারা ঘৃণ্য ও বর্বর পন্থা অবলম্বন করে আমরা তাদের দলে নই। আমরা জিহাদ করছি আল্লাহর নামে। যারা শিশু এবং নারীদের হত্যা করে আল্লাহ তাদের জন্যে জিহাদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। জিহাদের নীতিতে শত্রুর লাশের অবমাননা করা জঘন্যতমর অপরাধ। মনে রাখা দরকার, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থে যুদ্ধ করে তারা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত। শরীয়তের আইনে ন্যায়বিচার পাবার বেলায় ইহুদী, খ্রীষ্টান ও মুসলমানের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই ।
শেখ নিজেদের শক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই, পরবর্তী পর্যায়ে ইহুদীদের নিত্য নতুন দখল বিস্তারের কাজ প্রতিহত করার লক্ষ্যে তিনি আশে পাশের সমস্ত গ্রাম ও গোত্রগুলির সমন্বয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের কাজ শুরু করেন । ইহুদী বসতিগুলোতে পানি সরবরাহ বন্ধ এবং সেগুলো ঘেরাও করে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করাই ছিল শেখের পরিকল্পনা। একই সাথে আর কোন আরব ভূমি যাতে ইহুদীদের হাতে না যায়, সে ব্যাপারেও তিনি সচেষ্ট হন। তবে যে সকল এলাকায় মুসলিম আইনের প্রচলন রয়েছে সে এলাকাগুলোকে ঘেরাও পরিকল্পনার বাইরে রাখা হল । আত্মসমর্পণের পর যদি ইহুদীরা বিদ্রোহ করে তবে পুরুষদের হত্যা, মহিলাদের দাসী হিসেবে নিয়োগ এবং শিশুদের মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করে পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে শেখ জানতেন, এ ক্ষেত্রে বৃটিশরা তাকে বাধা দেয়ার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। আর এর পরিণতিও তার জানা ছিল। তাই নিজেকে ভাগ্যের হাতে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেয়াই উত্তম বলে মনে হল তার। তার বিশ্বাস ছিল, কাজ শুরু করতে পারেন তিনি, কিন্তু তার সাফল্য বা ব্যর্থতা সবই আল্লাহর হাতে । তবে, সমস্ত ফেলাহীন এবং বেদুইন গোত্রগুলোর বিশ্বাস তিনি অর্জন করেছিলেন । তারা তার নির্দেশে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়ার জন্যেও প্রস্তুত ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, হানাদারদের বিতাড়িত করার কাজে তিনি সফল হবেন এবং এটা তার মর্যাদাকে পূর্বের চেয়ে বহুশত গুণে বৃদ্ধি করবে।
সংঘাতমুখর জীবনের এ পর্যায়ে ইউসুফ মালিক এবং বালক দুই নাতি ছয় বছরের আহমদ খলিল ও আট বছরের আবদুল আজিজ ছিল শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীমের সব সময়ের সাথী । বালক দু’টি ছিল তার কাছে মূল্যবান রত্নের মত। যেখানেই তিনি যেতেন তারা দু’জনেই তাঁর সাথী হত। পথ চলতে গিয়ে ছোট আহমদ খলিল যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত তখন শেখ পরম স্নেহে তাকে নিজের কাঁধে তুলে নিতেন।
পায়ে হেঁটে শেখ কখনো যেতেন আশে পাশের গ্রামগুলোতে, কখনো যেতেন নেগেভের মরুভূমিতে কালো ছাগলের পশমে তৈরী বেদুইন তাঁবুতে কিংবা ইহুদী বসতিগুলোতে। কখনো জেলা সদরে ‘হোগানার’ সদর দফতরে, এমনকি অত্যন্ত চরমপন্থী ইহুদী ঘাতক সংগঠন ইরগুন-এর গোপন দফতরেও। বৃটিশ এবং ইহুদীদের সাথে দেন-দরবার করতে গিয়ে তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিব্রু এবং ইংরেজী বলতে শিখেছিলেন। বহু সময় তিনি বৃটিশ কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেছেন। তবে এ সব ক্ষেত্রে ভালো কোন ফল তিনি পান নি। বরং তাদের প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত শান্তি ভঙ্গের চেষ্টা করলে তাকে গ্রেফতার এবং বন্দী করে রাখার হুমকিই শুধু তাকে দেয়া হয়েছে ।
একবার গাজার বৃটিশ গভর্ণরের সাথে দেখা করা প্রয়োজন পয়ে পড়েছিল। এ উদ্দেশ্যে শেখ একদিন তার প্রাসাদোপম বাড়ীর দরজায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। বৃটিশ গভর্ণর দেখলেন নগ্নপদ একটি লোক, জীর্ণ-শীর্ণ, ধুলি ধূসরিত পোশাক তার গায়ে । সাথে উলঙ্গ প্রায় দু’টি শিশু। ক্রোধে চিৎকার করে উঠলেন তিনি –
: বের হও। ভিক্ষুকের জায়গা এটা নয় ।
প্রচণ্ড অপমানে কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো শেখের। তবু নিজেকে সংযত রেখে বললেন : আমরা ভিক্ষুক নই। আপনি আমার সাথে সাক্ষাত করতে চেয়েছিলেন এবং সে জন্যেই আমি এসেছি।
তার কথায় গভর্ণরের চোখ গিয়ে পড়ে আগন্তুকের কোমরের বেল্টে ঝোলানো মূল্যবান তলোয়ারের দিকে। তিনি দেখলেন, তার সামনে দাঁড়ানো লোকটির ঋজু ভঙ্গী, প্রদীপ্ত মুখমণ্ডল এবং রাজকীয় অভিব্যক্তি। অপশেষে তার মনে হল, লোকটি কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতেও পারে ।
: আমি ইরাক আল মানশিয়ার শেখ
চমকে উঠলেন গভর্ণর । শেখের কথা শেষ হওয়ার তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন…….. : আমি খুবই দুঃখিত। আসুন, আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
গভর্ণর সাদরে শেখকে নিয়ে তার ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। সোফা দেখিয়ে বললেন ঃ বসুন। আহমদ খলিল অবাক চোখে সব কিছু দেখছিল । এর আগে সে কোন ইউরোপীয়ের বাড়িতে আসেনি। সোফায় আবদুল আজিজের পাশে বসল সে। কিন্তু অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল তার। সে দেখল, তার নানা খুব আরামের সাথে সোফায় বসে কথা বলে চলেছেন। ওদিকে একটু দূরেই সহজ ভঙ্গিতে বসে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করছেন মালেক ওহাব।
শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীম গভর্ণরের সাথে আলোচনাকালে পূর্ণ কূটনৈতিক নিয়মনীতি পালনের দাবি জানালেন। গভর্ণর সে দাবি পূরণ করলেন। অন্যান্য বৃটিশ কর্মকর্তারা এসে পৌঁছলে শেখ তার বক্তব্য পেশ করলেন। তিনি জানালেন, ফিলিস্তিনে পুনরায় ইহুদী আগমন নিষিদ্ধ করে এবং আরবদের বিনা অনুমতিতে ইহুদীদের কাছে জমি বিক্রয় বন্ধ করার বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। সমস্ত বিকেল ধরেই আলোচনা চলল ।
কিন্তু আহমদ খলিল এ সব কথাবার্তার কিছুই শুনছিল না। সে বারবার গভর্ণরের স্ত্রীকে দেখছিল। কারণ, এর আগে এত কাছ থেকে সে কোন শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখেনি । তার দৃষ্টি ছিল গভর্ণরের স্ত্রীর মাথার বাদামী রঙের কোঁকড়ানো চুল, হাঁটু পর্যন্ত স্বচ্ছ নাইলন মোজায় আবৃত সুগঠিত দু’টি পা এবং উঁচু হিলের জুতার দিকে। ভরাট স্বাস্থ্যের প্রাচুর্যদীপ্ত রমণী মুখটির উপর বারবার ঘুরে ফিরছিল তার দৃষ্টি।
লম্বা লাল তারবুশ এবং সাদা টিউনিক পরিহিত পরিচারক মেহমানদের জন্য একটি বিশাল ট্রের ওপর খাবার নিয়ে এল । নামিয়ে রাখলো পালিশ করা মেহগণি কাঠের তৈরি টেবিলের ওপর ।
অবশেষে শ্বেতাঙ্গিনী মহিলাটির ওপর আহমদ খলিলের আগ্রহে ভাটা পড়লো। তার চোখ গিয়ে পড়ল সামনে রাখা খাবারের দিকে। অনেক কষ্টে খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ বিরত রাখল। কিন্তু কেউ তাকে খেতে বলল না। সে গভর্ণরের স্ত্রীর খাওয়া দেখছিল। তার মনে হল, নিজের খাওয়া শেষ হলে বোধহয় তিনি আহমদ খলিলকে খেতে বলবেন। তার সামনে ছিল কেক এবং পেষ্ট্রি ভর্তি প্লেট । আহমদ খলিল অবাক হয়ে দেখলো, আধাআধি পরিমাণ খেয়েই তিনি প্লেটটি পিছন দিকে সরিয়ে রাখলেন। পরিচারককে ডেকে বললেন সেগুলোকে ফেলে দিয়ে আসতে। আহমদ খলিলের পক্ষে আর আত্মসংবরণ করা সম্ভব হল না। সে ছোঁ মেরে প্লেটটি তুলে নিল এবং গোগ্রাসে খেতে শুরু করল।
ইংরেজ মহিলাটি ভীষণ অবাক হয়েছেন বোঝা গেল। তার লিপষ্টিক চৰ্চিত ঠোঁট দু’টিতে ফুটে উঠলো কাঠিন্য। শীতল দৃষ্টিতে বালকটির দিকে তাকালেন তিনি। মুখ ভর্তি কেক চিবুতে থাকা আহমদ খলিল সে দৃষ্টি দেখে কেঁদে ফেলল ।
: আমার মনে হয়, আপনার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম, বলে উঠলেন শেখ। এখন যেতে চাই আমি।
কথাগুলো বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আহমদ খলিলের হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। তার কান্না তখনো থামেনি। পথ চলতে চলতে সে শেখকে জিজ্ঞেস করলো : মহিলাটি আমার দিকে ওভাবে তাকাল কেন ?
: তোমাকে খেতে না বলা পর্যন্ত খাওয়া উচিত হয়নি। তাছাড়া ওরা তোমাদের জন্যে খাবার আনেওনি— শেখ বললেন। তবে, তুমি এখনো ভদ্রতা শেখোনি বলে ঠিক শাস্তিই পেয়েছ।
গাজা থেকে ফিরে আসার কয়েক মাস পরে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। একদিন রাতে এক তরুণ এসে হাজির হয় শেখের কাছে। উত্তরের এক গ্রামের গরীব চাষী বলে নিজের পরিচয় দেয় সে। বলে- আপনার সাহসের প্রশংসা আমি বহুজনের কাছেই শুনেছি। হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই আমি। আর সে জন্যেই আমি আপনার কাছে এসেছি। তবে, সাথে কিছু আনতে পারিনি আমি। এখন বলুন, আমি কি করবো । খুব লজ্জিতভাবেই যুবকটি শেষের কথাগুলো উচ্চারণ করে ।
: ঠিক আছে, চিন্তা করোনা। তোমাকে প্রয়োজনীয় সবকিছুই দেয়া হবে। যুবকটিকে সান্ত্বনা দিলেন শেখ ।
: কিন্তু, আমি একেবারে রিক্ত হাতে আসিনি- বলে সে সাথে আনা ময়দার ব্যাগটি দেখায় । এটা আপনার জন্যে আমার উপহার। তবে এখন আমি চলে যাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আগামীকাল সকালে এসে আপনার সাথে দেখা করব।
: না, না, তা কি করে হয় ! প্রতিবাদ করে উঠলেন শেখ। তুমি আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া সেরে রাতটা এখানেই থাক ।
শেখ খাদিজাকে ডেকে ময়দার ব্যাগটি তার হাতে তুলে দিয়ে জলদি করে রুটি তৈরি করার নির্দেশ দিলেন ।
আহমদ খলিল এবং আবদুল আজিজ মেঝেতে বসে বুলেটের শূন্য খোল নিয়ে খেলা করছিল। আগন্তুক সে দিকে এগিয়ে গেল। ওদের দেখিয়ে শেখকে জিজ্ঞেস করলো : ছেলে দু’টি কি আপনার ?
: না, ওরা আমার নাতি। উত্তর দিলেন শেখ ।
আগন্তুক আহমদ খলিলকে কোলে তুলে নিল। রুগ্ন দেহে হাত বুলোতেই চামড়া ঠেলে বের হয়ে থাকা হাড়ের অস্তিত্ব টের পেল সে। বসে যাওয়া পেট দেখে দারিদ্রের ব্যাপারটি বুঝতে দেরী হল না তার ।
ইতিমধ্যে খাবার তৈরী হয়ে এল । আগন্তুক একটা রুটি নিয়ে আহমদ খলিলের মুখে দিতে যেতেই শেখ বাধা দিলেন—
: রাখো, আগে আমি দেখে নেই খাবারটা ঠিক আছে কিনা । একটুকরো রুটি মুখে দিলেন তিনি ।
: বাজারের সব থেকে সেরা ময়দা এটা। আমি নিজে কিনেছি। আগন্তুক বলে চলেছে এবং তার কথা শেষ না হতেই হঠাৎ পেট চেপে ধরে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন শেখ ।
: এ ময়দায় বিষ মাখানো
শরীরের সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে কথাগুলো বলেই নীরব হয়ে গেলেন তিনি আহমদ খলিল ভয় পেয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না কি ঘটছে। তার মা আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন। ইউসুফ মালিক এক লাফে উঠে গিয়ে ধরে ফেললেন আততায়ীকে মালেক ওহাব একটি ছুরি নিয়ে দৌড়ে এলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাই এসে ভিড় জমাল বাড়িটিতে।
ঘাতককে হত্যা করতে চাইলেন ইউসুফ মালিক। মালেক ওহাব বাধা দিলেন তাকে । হাত বেঁধে কড়া প্রহরায় তাকে গাজা পুলিশের কাছে পাঠালেন তিনি।
ইখওয়ান স্বেচ্ছাসেবীরা শেখের দাফনের ব্যবস্থা করলো। তার ইচ্ছা অনুসারে কোন নারী উচ্চস্বরে কিংবা বুক চাপড়িয়ে কাঁদলোনা। শেখের অনুসারীদের চোখ থেকে নেতার শোকে শুধু নামতে থাকলো অনিঃশেষ অশ্রুধারা। আহমদ খলিল নীরব বিস্ময়ে তার মায়ের হাত ধরে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল তার নানার অন্তিম যাত্রা, মুর্দা বহনকারী খাটিয়ার পিছনের শত শত মানুষের শোকাত মিছিলের নিঃশব্দ অনুগমন।
পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেল, আততায়ী ইরাক আল মানশিয়া গ্রামসহ আশপাশের বিপুল ভূখণ্ডের জমিদার মুস্তফা এফেন্দীর জ্ঞাতি ভাই। মুস্তফা এফেন্দী নিজেও এ ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। আততায়ীর পকেটে তেল আবিবের ইহুদী সংগঠনের একটি টাইপ করা চিঠিও পাওয়া গেল। চিঠিতে শেখকে হত্যা করতে পারলে আততায়ীকে পাঁচ শত বৃটিশ পাউণ্ড পুরস্কার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে, এ ঘটনার মাত্র দশদিন পরই গাজার বৃটিশ গভর্ণরের নির্দেশে ছাড়া পেয়ে গেল আততায়ী । সাথে সাথে সে পালিয়ে গেল উত্তরে- হাইফাতে। ইরাক আল মানশিয়ার অধিবাসীরা আর কোন দিন তাকে দেখতে পায়নি।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

ফিলিস্তিনের আকাশ

দর্শক

তিন :

ইহুদী দখলদারদের বিরুদ্ধে জেরুজালেমের মুফতী হাজী আমিন আল হুসাইনী যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, তখন ইরাক আল মানশিয়া গ্রামের অধিবাসীরাও তাতে সরাসরি জড়িত হয়ে পড়ে। এ সময় আহমদ খলিলের নানা শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। আহমদ খলিলের জীবনের এ সময়টুকু কেটেছিল তার নানার কাছেই ।
শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীম আদতে ছিলেন একজন গোত্রপ্রধান। প্রকৃত অর্থে তিনিই ছিলেন সমস্ত গোত্রের দন্ডমুণ্ডের মালিক। একজন পেশাদার কৃষিজীবী হিসেবে আর দশজন ফেলাহীনের সাথে তার বিশেষ পার্থক্য ছিল না। কিন্তু তার মেজাজটি ছিল একেবারে রাজকীয়। যে কেউই তাকে দেখামাত্র বুঝে ফেলত যে এ লোকটির জন্মই হয়েছে হুকুম করার জন্যে এবং অন্যদের সে হুকুম মানতেই হবে । আগের গোত্র প্রধানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার বা অন্য কোন সূত্রে নয়, শুধুমাত্র প্রবল ব্যক্তিত্বের জোরেই তিনি গোত্রের নেতা হয়ে ওঠেন।
মরুভূমির বেদুইনদের তাঁবুতেই একদিন তার সাক্ষাৎ হয় সউদী আরব থেকে আগত কয়েকজন ওহাবীর সাথে। ওহাবীরা তখন সুলতান ইবনে সউদকে রাজ্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়তা করছিল। এ সাক্ষাৎ তার জীবনে এক বড় রকমের পরিবর্তনের সূচনা করে। তিনি গতানুগতিক অভ্যাস ও প্রথার নিগড়ে বাঁধা ফেলাহীনদের জীবনধারাকে নতুন খাতে প্রবাহিত করার দুরুহ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অচেতন, উদাসীন, নিরক্ষর ফেলাহীনের দল যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পর্যন্ত শুদ্ধভাবে আদায় করতে পারতোনা- শেখের এ প্রয়াস তাদের মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার করে। তারা কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ায় তার কর্মকাণ্ডে সমর্থন যোগাতে। শিশু এবং বয়স্কদের শিক্ষাদানের জন্যে গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এজন্যে গাজা এবং অন্যান্য শহর থেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকদের নিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু এখানে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বহিরাগত ও শিক্ষিত লোকগুলি ফেলাহীনদের তাদের নিজেদের চেয়ে অনেক নীচুস্তরের মানুষ হিসেবে গণ্য করত। উপরন্তু, আধুনিক শিক্ষাদীক্ষায় চৌকস হলেও নিজ ধর্ম ও ঐতিহ্য বিষয়ে তাদের জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। ফলে শেখ এক্ষেত্রে ইন্সিত সাফল্য লাভ করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু এতে দমে না গিয়ে মসজিদগুলোতে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার কাজ চালাতে শুরু করেন। বেশ কিছুদিন একটানা প্রচার চালাবার ফলে দেখা যায় যে, গোত্রবাসীদের মধ্য থেকে অনেক কুসংস্কারসহ পীরপূজা, কবরপূজা, গান-বাজনা, নৃত্য, ধূমপান, মৃতের জন্যে উচ্চৈঃস্বরে কান্না প্রভৃতি জঞ্জালগুলো একেবারে বিদায় নিয়েছে ।
শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীমের বয়স তখন সত্তর চলছিল। তবে বয়সের ভারে তখনো নুয়ে পড়েননি তিনি। মেদহীন ঋজু দেহ। জীর্ণ গাউনের ওপর ভারী এক আঙরাখায় তার দেহ ঢাকা। সে আঙরাখার নানা জায়গায় অসংখ্য তালি লাগানো সত্ত্বেও ফুটো-ফাটার অভাব ছিল না। শুভ্র কেশভরা মাথায় জড়ানো একটি কাফিয়াহ্ । সাদা দাড়ি এবং ঈগল চঞ্চুর মতো খাড়া নাকের ওপর জ্বল জ্বল করা একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত গভীর কালো চোখ। জীর্ণ পোশাক পরিহিত, নগ্ন পা মানুষটির প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য কেউ তাকে উপেক্ষা করতে পারত না।
হালকা-পাতলা নাতিদীর্ঘ দেহের শেখ ছিলেন অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন। একটানা পরিশ্রমের ক্ষেত্রে এ বয়সেও তিনি ছিলেন একজন যুবকের মতই উৎসাহী এবং অক্লান্ত ।
মালেক ওহাবের সাথে ঝগড়ার ব্যাপারে খাদিজা তার আব্বাকে কিছুই জানাননি । আসলে স্বামীকে অপমানিত বা অপদস্থ করার কোন ইচ্ছাই তার ছিল না। কারণ সমস্ত গ্রামের মধ্যে মালেক ওহাবই ছিলেন একমাত্র শিক্ষিত লোক যিনি একাধিক ভাষা লিখতে ও পড়তে জানতেন। আর এ গুণগুলোর জন্যে তিনি কার্যতঃ হয়ে উঠেছিলেন একাধারে শেখের সেক্রেটারী এবং দোভাষী ।
আহমদ খলিল তার নানাকে লক্ষ্য করছিল। ঘরের কাঠের আলমারী থেকে তিনি একে একে বের করে আনলেন কাগজ, খাম, টিকিট, লেখার কলম এবং এক দোয়াত সুন্দর ভারতীয় কালি। উপকরণগুলো মালেক ওহাবের হাতে দিয়ে তাকে প্রস্তুত হয়ে বসতে বললেন শেখ। হাত দু’টি পিছনের দিকে বেঁধে পায়চারী করতে করতে চিঠির ভাষ্য বলতে থাকলেন তিনি। দ্রুত কলম চলতে থাকে মালেক ওহাবের। একে একে তিনটি চিঠি লেখা হল : প্রথমটি রিয়াদে সুলতান ইবনে সউদের কাছে, দ্বিতীয়টি কায়রোতে হাসান আল বান্নার কাছে এবং সর্বশেষটির প্রাপক জেরুজালেমের মুফতি হাজী আমিন আল হুসাইনী। সবগুলো চিঠিতেই মুস্তফা এফেন্দী কর্তৃক ইহুদী দখলদারদের কাছে ক্রমাগত ফিলিস্তিনী জমি বিক্রির ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করে ইরাক আল মানশিয়া গ্রামটিকে রক্ষার কাজে সাহায্য চেয়ে আবেদন জানানো হল ।
মালেক ওহাব চিঠিগুলো পোষ্ট করে আসার পর থেকেই শুরু হয় শেখের অধীর প্রতীক্ষা। কিছুদিনের ভেতরেই দু’টি চিঠির জবাব মেলে। সুলতান ইবনে সউদ কোন সাড়া না দিলেও উত্তর থেকে হাজী হুসাইনী এবং দক্ষিণ থেকে ইখওয়ান আল মুসলেমুনের স্বেচ্ছাসেবীরা জমায়েত হতে থাকে ইরাক আল মানশিয়াতে। শেখ স্বেচ্ছাসেবীদের সবার জন্যেই খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। এ স্বেচ্ছাসেবীদের আগমনে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হল তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় আশে পাশের বসতিগুলোর ফেলাহীনরাও এসে শেখের পাশে দাঁড়াল।
সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল। একদিন এক তুমুল যুদ্ধে ইহুদীদের অনিয়মিত সেনাদল ‘হোগানা’র বিশজন তরুণ যোদ্ধা গ্রামের মধ্যে ঘেরাও হয়ে পড়ে। পালানোর কোন পথ তাদের ছিলনা। বাধ্য হয়ে তারা অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। তার পুত্র ইউসুফ মালিক চাইছিলেন, এদেরকে সাথে সাথেই হত্যা করা হোক। কিন্তু তাদের এভাবে হত্যা করা ইচ্ছা শেখের ছিলনা। তাই, গ্রামের একটি বড় ঘরে তাদের বন্দী করে রাখা হলো । উত্তেজিত ফেলাহীনরা যাতে বন্দীদের হত্যা করতে না পারে সে জন্যে একদল সশস্ত্র ইখওয়ান সদস্যকে রাখা হলো কড়া পাহারায়।
আরো বেশ কয়েকটি বড় ধরণের সংঘর্ষের পর নেগবার দখলদার ইহুদীরা শান্তি প্রার্থনা করলে শেখ রাজী হলেন। উভয় পক্ষেই জীবিত বন্দী এবং মৃতদেহ বিনিময় হল ।
ইহুদীদের লাশগুলোর মধ্যে শেখ এক তরুণীর লাশ দেখতে পেলেন। তার পোশাক ছিল ছিন্নভিন্ন, চোখ দুটো উপড়ে ফেলা হয়েছিল এবং কেটে নেয়া হয়েছিল নাক ও কান। সাথে সাথে তিনি ব্যাপক অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। অবশেষে সন্ধ্যাবেলায় অপরাধীকে হাজির করা হল শেখের সামনে। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে, সমবেত জনতার মধ্যে শেখ তাকে হাঁটু গেড়ে বসার জন্যে আদেশ দিলেন। পরমুহূর্তেই তার সুতীক্ষ্ণ তলোয়ারের এক আঘাতে অপরাধীর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তধারা এবং মৃতদেহ দেখে জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ছয় বছরের বালক আহমদ খলিল চিৎকার করে উঠলো ভয় ও আতঙ্কে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে ধীর গম্ভীর গলায় শেখ বললেন-‘ভাইয়েরা, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে যারা ঘৃণ্য ও বর্বর পন্থা অবলম্বন করে আমরা তাদের দলে নই। আমরা জিহাদ করছি আল্লাহর নামে। যারা শিশু এবং নারীদের হত্যা করে আল্লাহ তাদের জন্যে জিহাদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। জিহাদের নীতিতে শত্রুর লাশের অবমাননা করা জঘন্যতমর অপরাধ। মনে রাখা দরকার, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থে যুদ্ধ করে তারা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত। শরীয়তের আইনে ন্যায়বিচার পাবার বেলায় ইহুদী, খ্রীষ্টান ও মুসলমানের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই ।
শেখ নিজেদের শক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই, পরবর্তী পর্যায়ে ইহুদীদের নিত্য নতুন দখল বিস্তারের কাজ প্রতিহত করার লক্ষ্যে তিনি আশে পাশের সমস্ত গ্রাম ও গোত্রগুলির সমন্বয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের কাজ শুরু করেন । ইহুদী বসতিগুলোতে পানি সরবরাহ বন্ধ এবং সেগুলো ঘেরাও করে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করাই ছিল শেখের পরিকল্পনা। একই সাথে আর কোন আরব ভূমি যাতে ইহুদীদের হাতে না যায়, সে ব্যাপারেও তিনি সচেষ্ট হন। তবে যে সকল এলাকায় মুসলিম আইনের প্রচলন রয়েছে সে এলাকাগুলোকে ঘেরাও পরিকল্পনার বাইরে রাখা হল । আত্মসমর্পণের পর যদি ইহুদীরা বিদ্রোহ করে তবে পুরুষদের হত্যা, মহিলাদের দাসী হিসেবে নিয়োগ এবং শিশুদের মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করে পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে শেখ জানতেন, এ ক্ষেত্রে বৃটিশরা তাকে বাধা দেয়ার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। আর এর পরিণতিও তার জানা ছিল। তাই নিজেকে ভাগ্যের হাতে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেয়াই উত্তম বলে মনে হল তার। তার বিশ্বাস ছিল, কাজ শুরু করতে পারেন তিনি, কিন্তু তার সাফল্য বা ব্যর্থতা সবই আল্লাহর হাতে । তবে, সমস্ত ফেলাহীন এবং বেদুইন গোত্রগুলোর বিশ্বাস তিনি অর্জন করেছিলেন । তারা তার নির্দেশে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়ার জন্যেও প্রস্তুত ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, হানাদারদের বিতাড়িত করার কাজে তিনি সফল হবেন এবং এটা তার মর্যাদাকে পূর্বের চেয়ে বহুশত গুণে বৃদ্ধি করবে।
সংঘাতমুখর জীবনের এ পর্যায়ে ইউসুফ মালিক এবং বালক দুই নাতি ছয় বছরের আহমদ খলিল ও আট বছরের আবদুল আজিজ ছিল শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীমের সব সময়ের সাথী । বালক দু’টি ছিল তার কাছে মূল্যবান রত্নের মত। যেখানেই তিনি যেতেন তারা দু’জনেই তাঁর সাথী হত। পথ চলতে গিয়ে ছোট আহমদ খলিল যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত তখন শেখ পরম স্নেহে তাকে নিজের কাঁধে তুলে নিতেন।
পায়ে হেঁটে শেখ কখনো যেতেন আশে পাশের গ্রামগুলোতে, কখনো যেতেন নেগেভের মরুভূমিতে কালো ছাগলের পশমে তৈরী বেদুইন তাঁবুতে কিংবা ইহুদী বসতিগুলোতে। কখনো জেলা সদরে ‘হোগানার’ সদর দফতরে, এমনকি অত্যন্ত চরমপন্থী ইহুদী ঘাতক সংগঠন ইরগুন-এর গোপন দফতরেও। বৃটিশ এবং ইহুদীদের সাথে দেন-দরবার করতে গিয়ে তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিব্রু এবং ইংরেজী বলতে শিখেছিলেন। বহু সময় তিনি বৃটিশ কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেছেন। তবে এ সব ক্ষেত্রে ভালো কোন ফল তিনি পান নি। বরং তাদের প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত শান্তি ভঙ্গের চেষ্টা করলে তাকে গ্রেফতার এবং বন্দী করে রাখার হুমকিই শুধু তাকে দেয়া হয়েছে ।
একবার গাজার বৃটিশ গভর্ণরের সাথে দেখা করা প্রয়োজন পয়ে পড়েছিল। এ উদ্দেশ্যে শেখ একদিন তার প্রাসাদোপম বাড়ীর দরজায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। বৃটিশ গভর্ণর দেখলেন নগ্নপদ একটি লোক, জীর্ণ-শীর্ণ, ধুলি ধূসরিত পোশাক তার গায়ে । সাথে উলঙ্গ প্রায় দু’টি শিশু। ক্রোধে চিৎকার করে উঠলেন তিনি –
: বের হও। ভিক্ষুকের জায়গা এটা নয় ।
প্রচণ্ড অপমানে কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো শেখের। তবু নিজেকে সংযত রেখে বললেন : আমরা ভিক্ষুক নই। আপনি আমার সাথে সাক্ষাত করতে চেয়েছিলেন এবং সে জন্যেই আমি এসেছি।
তার কথায় গভর্ণরের চোখ গিয়ে পড়ে আগন্তুকের কোমরের বেল্টে ঝোলানো মূল্যবান তলোয়ারের দিকে। তিনি দেখলেন, তার সামনে দাঁড়ানো লোকটির ঋজু ভঙ্গী, প্রদীপ্ত মুখমণ্ডল এবং রাজকীয় অভিব্যক্তি। অপশেষে তার মনে হল, লোকটি কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতেও পারে ।
: আমি ইরাক আল মানশিয়ার শেখ
চমকে উঠলেন গভর্ণর । শেখের কথা শেষ হওয়ার তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন…….. : আমি খুবই দুঃখিত। আসুন, আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
গভর্ণর সাদরে শেখকে নিয়ে তার ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। সোফা দেখিয়ে বললেন ঃ বসুন। আহমদ খলিল অবাক চোখে সব কিছু দেখছিল । এর আগে সে কোন ইউরোপীয়ের বাড়িতে আসেনি। সোফায় আবদুল আজিজের পাশে বসল সে। কিন্তু অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল তার। সে দেখল, তার নানা খুব আরামের সাথে সোফায় বসে কথা বলে চলেছেন। ওদিকে একটু দূরেই সহজ ভঙ্গিতে বসে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করছেন মালেক ওহাব।
শেখ ইসহাক বিন ইবরাহীম গভর্ণরের সাথে আলোচনাকালে পূর্ণ কূটনৈতিক নিয়মনীতি পালনের দাবি জানালেন। গভর্ণর সে দাবি পূরণ করলেন। অন্যান্য বৃটিশ কর্মকর্তারা এসে পৌঁছলে শেখ তার বক্তব্য পেশ করলেন। তিনি জানালেন, ফিলিস্তিনে পুনরায় ইহুদী আগমন নিষিদ্ধ করে এবং আরবদের বিনা অনুমতিতে ইহুদীদের কাছে জমি বিক্রয় বন্ধ করার বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। সমস্ত বিকেল ধরেই আলোচনা চলল ।
কিন্তু আহমদ খলিল এ সব কথাবার্তার কিছুই শুনছিল না। সে বারবার গভর্ণরের স্ত্রীকে দেখছিল। কারণ, এর আগে এত কাছ থেকে সে কোন শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখেনি । তার দৃষ্টি ছিল গভর্ণরের স্ত্রীর মাথার বাদামী রঙের কোঁকড়ানো চুল, হাঁটু পর্যন্ত স্বচ্ছ নাইলন মোজায় আবৃত সুগঠিত দু’টি পা এবং উঁচু হিলের জুতার দিকে। ভরাট স্বাস্থ্যের প্রাচুর্যদীপ্ত রমণী মুখটির উপর বারবার ঘুরে ফিরছিল তার দৃষ্টি।
লম্বা লাল তারবুশ এবং সাদা টিউনিক পরিহিত পরিচারক মেহমানদের জন্য একটি বিশাল ট্রের ওপর খাবার নিয়ে এল । নামিয়ে রাখলো পালিশ করা মেহগণি কাঠের তৈরি টেবিলের ওপর ।
অবশেষে শ্বেতাঙ্গিনী মহিলাটির ওপর আহমদ খলিলের আগ্রহে ভাটা পড়লো। তার চোখ গিয়ে পড়ল সামনে রাখা খাবারের দিকে। অনেক কষ্টে খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ বিরত রাখল। কিন্তু কেউ তাকে খেতে বলল না। সে গভর্ণরের স্ত্রীর খাওয়া দেখছিল। তার মনে হল, নিজের খাওয়া শেষ হলে বোধহয় তিনি আহমদ খলিলকে খেতে বলবেন। তার সামনে ছিল কেক এবং পেষ্ট্রি ভর্তি প্লেট । আহমদ খলিল অবাক হয়ে দেখলো, আধাআধি পরিমাণ খেয়েই তিনি প্লেটটি পিছন দিকে সরিয়ে রাখলেন। পরিচারককে ডেকে বললেন সেগুলোকে ফেলে দিয়ে আসতে। আহমদ খলিলের পক্ষে আর আত্মসংবরণ করা সম্ভব হল না। সে ছোঁ মেরে প্লেটটি তুলে নিল এবং গোগ্রাসে খেতে শুরু করল।
ইংরেজ মহিলাটি ভীষণ অবাক হয়েছেন বোঝা গেল। তার লিপষ্টিক চৰ্চিত ঠোঁট দু’টিতে ফুটে উঠলো কাঠিন্য। শীতল দৃষ্টিতে বালকটির দিকে তাকালেন তিনি। মুখ ভর্তি কেক চিবুতে থাকা আহমদ খলিল সে দৃষ্টি দেখে কেঁদে ফেলল ।
: আমার মনে হয়, আপনার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম, বলে উঠলেন শেখ। এখন যেতে চাই আমি।
কথাগুলো বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আহমদ খলিলের হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। তার কান্না তখনো থামেনি। পথ চলতে চলতে সে শেখকে জিজ্ঞেস করলো : মহিলাটি আমার দিকে ওভাবে তাকাল কেন ?
: তোমাকে খেতে না বলা পর্যন্ত খাওয়া উচিত হয়নি। তাছাড়া ওরা তোমাদের জন্যে খাবার আনেওনি— শেখ বললেন। তবে, তুমি এখনো ভদ্রতা শেখোনি বলে ঠিক শাস্তিই পেয়েছ।
গাজা থেকে ফিরে আসার কয়েক মাস পরে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। একদিন রাতে এক তরুণ এসে হাজির হয় শেখের কাছে। উত্তরের এক গ্রামের গরীব চাষী বলে নিজের পরিচয় দেয় সে। বলে- আপনার সাহসের প্রশংসা আমি বহুজনের কাছেই শুনেছি। হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই আমি। আর সে জন্যেই আমি আপনার কাছে এসেছি। তবে, সাথে কিছু আনতে পারিনি আমি। এখন বলুন, আমি কি করবো । খুব লজ্জিতভাবেই যুবকটি শেষের কথাগুলো উচ্চারণ করে ।
: ঠিক আছে, চিন্তা করোনা। তোমাকে প্রয়োজনীয় সবকিছুই দেয়া হবে। যুবকটিকে সান্ত্বনা দিলেন শেখ ।
: কিন্তু, আমি একেবারে রিক্ত হাতে আসিনি- বলে সে সাথে আনা ময়দার ব্যাগটি দেখায় । এটা আপনার জন্যে আমার উপহার। তবে এখন আমি চলে যাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আগামীকাল সকালে এসে আপনার সাথে দেখা করব।
: না, না, তা কি করে হয় ! প্রতিবাদ করে উঠলেন শেখ। তুমি আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া সেরে রাতটা এখানেই থাক ।
শেখ খাদিজাকে ডেকে ময়দার ব্যাগটি তার হাতে তুলে দিয়ে জলদি করে রুটি তৈরি করার নির্দেশ দিলেন ।
আহমদ খলিল এবং আবদুল আজিজ মেঝেতে বসে বুলেটের শূন্য খোল নিয়ে খেলা করছিল। আগন্তুক সে দিকে এগিয়ে গেল। ওদের দেখিয়ে শেখকে জিজ্ঞেস করলো : ছেলে দু’টি কি আপনার ?
: না, ওরা আমার নাতি। উত্তর দিলেন শেখ ।
আগন্তুক আহমদ খলিলকে কোলে তুলে নিল। রুগ্ন দেহে হাত বুলোতেই চামড়া ঠেলে বের হয়ে থাকা হাড়ের অস্তিত্ব টের পেল সে। বসে যাওয়া পেট দেখে দারিদ্রের ব্যাপারটি বুঝতে দেরী হল না তার ।
ইতিমধ্যে খাবার তৈরী হয়ে এল । আগন্তুক একটা রুটি নিয়ে আহমদ খলিলের মুখে দিতে যেতেই শেখ বাধা দিলেন—
: রাখো, আগে আমি দেখে নেই খাবারটা ঠিক আছে কিনা । একটুকরো রুটি মুখে দিলেন তিনি ।
: বাজারের সব থেকে সেরা ময়দা এটা। আমি নিজে কিনেছি। আগন্তুক বলে চলেছে এবং তার কথা শেষ না হতেই হঠাৎ পেট চেপে ধরে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন শেখ ।
: এ ময়দায় বিষ মাখানো
শরীরের সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে কথাগুলো বলেই নীরব হয়ে গেলেন তিনি আহমদ খলিল ভয় পেয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না কি ঘটছে। তার মা আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন। ইউসুফ মালিক এক লাফে উঠে গিয়ে ধরে ফেললেন আততায়ীকে মালেক ওহাব একটি ছুরি নিয়ে দৌড়ে এলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাই এসে ভিড় জমাল বাড়িটিতে।
ঘাতককে হত্যা করতে চাইলেন ইউসুফ মালিক। মালেক ওহাব বাধা দিলেন তাকে । হাত বেঁধে কড়া প্রহরায় তাকে গাজা পুলিশের কাছে পাঠালেন তিনি।
ইখওয়ান স্বেচ্ছাসেবীরা শেখের দাফনের ব্যবস্থা করলো। তার ইচ্ছা অনুসারে কোন নারী উচ্চস্বরে কিংবা বুক চাপড়িয়ে কাঁদলোনা। শেখের অনুসারীদের চোখ থেকে নেতার শোকে শুধু নামতে থাকলো অনিঃশেষ অশ্রুধারা। আহমদ খলিল নীরব বিস্ময়ে তার মায়ের হাত ধরে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল তার নানার অন্তিম যাত্রা, মুর্দা বহনকারী খাটিয়ার পিছনের শত শত মানুষের শোকাত মিছিলের নিঃশব্দ অনুগমন।
পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেল, আততায়ী ইরাক আল মানশিয়া গ্রামসহ আশপাশের বিপুল ভূখণ্ডের জমিদার মুস্তফা এফেন্দীর জ্ঞাতি ভাই। মুস্তফা এফেন্দী নিজেও এ ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। আততায়ীর পকেটে তেল আবিবের ইহুদী সংগঠনের একটি টাইপ করা চিঠিও পাওয়া গেল। চিঠিতে শেখকে হত্যা করতে পারলে আততায়ীকে পাঁচ শত বৃটিশ পাউণ্ড পুরস্কার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে, এ ঘটনার মাত্র দশদিন পরই গাজার বৃটিশ গভর্ণরের নির্দেশে ছাড়া পেয়ে গেল আততায়ী । সাথে সাথে সে পালিয়ে গেল উত্তরে- হাইফাতে। ইরাক আল মানশিয়ার অধিবাসীরা আর কোন দিন তাকে দেখতে পায়নি।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত