চার
: তোমরা কি ইহুদীদের তাড়িয়ে দিতে পেরেছিলে? – মায়ের কাহিনী শুনতে শুনতে প্রশ্ন করে আহমদ খলিল। কাহিনী শোনার আগ্রহ ও উত্তেজনায় চোখ দুটি বড় বড় হয়ে উঠেছে তার। হ্যাঁ বাবা খাদিজা উত্তর দেন। আমরা ওদেরকে বারবার তাড়িয়ে দিয়েছি। বহুবারই অনেক সাথীর মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে তারা। এমন কি নিহতদের অস্ত্রগুলো নিয়ে যাওয়ার অবকাশ পর্যন্ত তারা পায়নি। বিগত পনের বছর ধরে ইহুদীরা এখানে বসতি স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে, আমাদের জমি কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দিতে শক্তি প্রয়োগ করেছে। গবাদিপশুগুলোসহ পানি ও ঘাস থেকে আমাদের বঞ্চিত করারও চেষ্টা করেছে তারা। কিন্তু সফল হতে পারেনি।
একটু বিরতি নেন খাদিজা। তারপর আবার বলে চলেনঃ সে সময় আমার আব্বা এবং আমার সাতটি ভাই মরুভূমির দুর্ধর্ষ গোত্রগুলোকে এই আগ্রাসনের মুখে ঐক্যবদ্ধ করে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ইহুদীদের প্রত্যেকটি আক্রমণের মোকাবেলা করে তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন তারা।
কথা বলতে বলতে মরহুম পিতার কথা মনে করে অবর্ণনীয় দুঃখ ও ব্যথায় ভরে ওঠে খাদিজার হৃদয় । তিনি ছিলেন মরুভূমির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান। উট এবং খাঁটি আরবী ঘোড়াগুলো ছিল আব্বার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এগুলোর প্রতি তার ভালবাসা ছিল অপরিসীম। খাদিজার চোখে ভেসে ওঠে সেই দিনগুলোর ছবি। বাড়ির আঙিনায় ঘোড়া এবং উটগুলোকে সাজানো হয়েছে কোন অভিযানের যাওয়ার জন্যে । একে একে উঠে বসেছে তাদের সওয়াররা। কদমে কদমে ছুটতে শুরু করেছে প্রাণীগুলো। মরুভূমির দুরন্ত হওয়ায় পত্ পত্ করে উড়ছে সওয়ারদের দীর্ঘ আলখাল্লা, মাঝে মাঝেই তার প্রান্তভাগ তীক্ষুচাবুকের মত এসে আঘাত করেছে প্রাণীগুলোর পশ্চাৎ দেশে। সওয়ারদের গতি হচ্ছে দ্রুত থেকে দ্রুততর। উজ্জ্বল রোদের আলোয় ঝকমক করছে তাদের অস্ত্র, দৃষ্টি নিবদ্ধ মরুভুমির দূর দিগন্তরেখায়। খাদিজার মনে হয়, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য তিনি কোনদিন দেখেননি, দেখবেনও না। আব্বার জন্য অত্যন্ত গর্ববোধ হয় তার। অন্য যে কোন বেদুইনের মত তিনিও ঘোড়ায় চড়তে, দ্রুত হাতে গুলি ছুঁড়তে এবং যুদ্ধকৌশলে ছিলেন সুদক্ষ। এ দক্ষতা তাকে করে তুলেছিল দুর্ধর্ষ এবং অপরাজেয় । তার নামে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল বৃটিশ ও ইহুদীরা। এর ফলে তার আসল নামটি ঢাকা পড়ে গিয়ে তিনি শুধু ‘মরুভূমির সন্ত্রাস’ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
আব্বার মৃত্যুর বহু দিন পরও স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খাদিজার গলার স্বর ভারি হয়ে আসে। তার সেই গভীর ব্যথাভরা অনুভূতির প্রকাশ ঘটত তারই গর্ভজাত সন্তানের কাছে- যে কিনা একটি অবুঝ শিশু ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
শুধু তার আব্বার কথাই নয়, কাজকর্মের ফাঁকে কিংবা সন্ধ্যাবেলায় কখনো একটু অবসর পেলে শিশু আহমদ খলিলকে নিজের শৈশবের কথা শোনাতেন খাদিজা। সে শৈশব ছিল সুখস্মৃতি ভরা অনন্ত সুমধুর।
খাদিজার জীবনে তার শৈশব কালটি ছিল সবচেয়ে আনন্দময়। তাদের বাড়িতে সব সময় মেহমানের ভিড় লেগেই থাকত। মেহমানদারীতে তার আব্বার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদূর পর্যন্ত। শেখ নিজেও তা জানতেন। আর এ জন্যেই তার বাড়িতে সব সময় মজুদ থাকত যথেষ্ট পরিমাণ গোত, চাল, মাখন, খেজুর এবং দুধ। অতিথিদের জন্যে ঘরের এক কোণায় প্রস্তুত রাখা হতো স্তূপীকৃত কম্বল যা ছিল খাদিজার আম্মার নিজের হাতে সযত্নে বোনা। আরামে বসার জন্যে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হতো তাকিয়া, ঘুমানোর জন্যে মেঝে ঢাকা ছিল সুদৃশ্য গালিচায় এবং প্রচন্ড ঠাণ্ডার সময় শরীরকে উষ্ণ রাখার জন্যে ছিল তুলার পুরু লেপ। বাড়িটাকে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হত। খাদিজার আম্মা ছেলে মেয়েদের পোষাকগুলোতে নানারকম সূচিকাজ করে ভারি চমৎকার করে তুলতেন। খাদিজা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অবাক হন। তখনকার দিনগুলোতে রোগ ভোগ ছিল বিরল। সারা গোত্র খুঁজেও একজন অসুস্থ লোককে খুঁজে পাওয়া যেতোনা । ফলে গোত্রের লোকবল এবং শক্তি ও ক্ষমতা বেড়ে চলেছিল দিনকে দিন। আর এখন? এখন প্রতি বছরেই গোত্রের লোকসংখ্যা শুধুই কমছে আর কমছে … ।
খাদিজা যখন তার শৈশবের কথা শোনাতেন, শিশু আহমদ খলিলের চোখের সামনে যেন তার মায়ের সেই দিনগুলোর ছবি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠত। খাদিজার পুরো শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে যুদ্ধের ডামাডোলে। আহমদ খলিল যেন দেখতে পায় ঘরের মেঝেতে স্তূপ করে রাখা হয়েছে ইহুদীদের কাছ থেকে দখল করা রাইফেল, রিভলবার এবং পিস্তল। মেঝেতে বসে খাদিজা দ্রুত হাতে সেগুলো সাফ করে তেল মাখিয়ে চলেছেন যাতে ব্যবহারের সময় কোন অসুবিধার সৃষ্টি না হয়। খাদিজা বলে চলেন ভাইদের সতর্ক তত্ত্বাবধানে তলোয়ার এবং ছোরাগুলো তীক্ষ্ণধার করার জন্যে তার কাজের কথা। বলেন : যুদ্ধ ক্ষেত্রে যখন বুলেটগুলো ফুরিয়ে যেত তখন শেখ ইব্রাহিম শত্রু খতমের জন্য ব্যবহার করতেন বিষ মাখানো প্রাণঘাতী তীর। তাছাড়া আমার ভাইয়েরা যখন ঘরে বসে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র-শস্ত্র তৈরি করত, আমি তাদেরকে সাহায্য করতাম। কিন্তু এক এক করে তারা প্রত্যেকেই শহীদ হয়ে গেল ।
খাদিজা বলতে থাকেন মুস্তফা এফেন্দীর কথা। এ সময় ভীষণ ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়ে ওঠে তার মুখমণ্ডল। কারণ, এই লোকটি যেমন অর্থপিশাচ তেমনি নীতিবোধ বিবর্জিত এক ঘৃণ্য শয়তান। নগদ অর্থ হাতে পাওয়ার লোভে ইহুদীদের সাথে কোন দরদাম না করেই একের পর এক আরবভূমি সে তুলে দিয়েছে তাদের হাতে। খাদিজাদের গ্রামটিও এ থেকে রেহাই পায়নি। ইতিমধ্যেই গ্রামের প্রায় অর্ধেকটা জমি সে বিক্রি করে দিয়েছে। আর ইহুদীরাও আছে সুযোগের অপেক্ষায়। ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনিদের বহু জমি তারা দখল করে নিচ্ছে এ বেঈমানের অর্থলিপ্সার সুযোগে ।
আহমদ খলিলকে খাদিজা বলেন : কিন্তু বাবা, দেখ, এখানেই এর শেষ নয়। আমাদের সব কিছু গ্রাস না করা পর্যন্ত লোভী ইহুদীরা সন্তুষ্ট হবে না।
: কিন্তু ওরা আর কোথাও না গিয়ে শুধু এখানে আসছে কেন? আহমদ খলিল প্রশ্ন করে।
: ওরা বলে- ওদের কোন দেশ নেই। এ দেশটা নাকি ওদেরই ছিল। বহুকাল আগে জোর করে ওদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এ দেশ থেকে— পুত্রের কথার জবাব দেন খাদিজা। ওরা আরো বলে, যে করেই হোক এদেশ তারা অধিকার করবেই- কারণ এটাই নাকি ছিল তাদের পূর্ব পুরুষের বাসভূমি।
: ওরা কি অন্য কোথাও যেতে পারে না?
: অন্য দেশগুলো ওদের চায়না। তাই পৃথিবীর আর কোথাও ইহুদীদের যাবার জায়গা নেই। খাদিজা ছেলেকে ব্যাপারটি যতটুকু সম্ভব বোঝাবার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন ঃ পবিত্র কোরআনে বনি ইসরাইলীদের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। কুকর্ম ও পাপের জন্যে আল্লাহ তাদের যে শাস্তি নির্ধারণ করেন তারই ফলে তারা হয় গৃহহীন এবং স্বদেশভূমি থেকে নির্বাসিত।
: আজকের ইহুদীরাই কি সেই বনি ইসরাইলীদের বংশধর? প্রশ্ন করে আহমদ খলিল। তার আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে ওঠে।
: কেন, তোমার আব্বার কোরআন তেলাওয়াত কি তুমি শোন নি? আল্লাহ বলেছেন, হযরত মুহাম্মদ (স) এর পূর্বে আগত নবীদের অধিকাংশই ছিলেন বনি ইসরাইল জাতির। তাদের সবার উপরেই আল্লাহ কিতাব নাযিল করেছিলেন বলে তারা আহলুল কিতাব। বনি ইসরাইলের এ নবীদের প্রতি আমরা অর্থাৎ মুসলমানরাও যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
বল (হে মুহাম্মদ), আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি এবং তাতে যা তিনি নাযিল করেছেন আমাদের উপর এবং যা নাযিল হয়েছিল ইবরাহীম এবং ইসমাঈল এবং ইসহাক এবং ইয়াকুব এবং তাদের জাতির উপর এবং যা নাযিল হয়েছিল মুসা এবং ঈসার উপর- তাদের প্রভুর তরফ থেকে। বল, আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং তাঁর প্রতি যার কাছে আমরা আত্মসমর্পিত… ।”
কিন্তু কালক্রমে ইহুদীরা ক্রমশই আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরে যায়। আকণ্ঠ ডুবে যায় পাপ ও অনাচারে। অবশেষে তারা পরিণত হয় এক অভিশপ্ত জাতিতে। আল্লাহ ভয়ানক রুষ্ট হয়ে তাদের উপর গযব নাযিল করলে তারা স্বদেশভূমি ত্যাগ করে দূর- দূরান্তের দেশগুলোতে গমন করে। তাদের আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ এককালে হুবহু আমাদের মতো থাকলেও পরে তা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এখন তাদের এবং খৃষ্টানদের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই বললেই চলে। তারা এখন অত্যাচারী, নিষ্ঠুর এবং আল্লাহতে অবিশ্বাসী। অন্য ধর্মের প্রতি তো নয়ই, নিজেদের ধর্মেই ওরা এখন কতটা বিশ্বাস রাখে তা বলা মুশকিল।
: কেন? কেন এমন হল? আহমদ খলিলের গলায় ধ্বনিত হয় অন্তহীন প্রশ্ন।
: একমাত্র আল্লাহই তা জানেন- উত্তর দেন খাদিজা। আমার আব্বা এবং ভাইদের কাছে এ বিষয়ে অনেক কথা শুনেছি। ইহুদীদের সাথে শান্তি আলোচনার জন্যে তারা বহুবার নেগবায় গিয়েছেন। নামাজের সময় হতেই তারা জামাতে দাঁড়িয়ে যেতেন। তখন ইহুদী ছেলেমেয়েরা তাদের ঘিরে দাঁড়াত, ধুলা ছুঁড়ে দিত তাদের গায়ে এবং নানা প্রকার অপমানজনক মন্তব্য করত। শুধু তাই নয়- ‘আল্লাহ বলে কিছু নেই, আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি না’ প্রভৃতি কথা বলেও তারা চিৎকার করত ।
এসব কথা শুনে আহমদ খলিল অবাক হয়ে যায়। সে ভেবে পায় না- এসব কথা ওরা কি করে বলতে পারে। এরপরে যখনি সে ঘরের মধ্যে একা থেকেছে তখনি সে ভেবেছে- আল্লাহ কেন এই বেঈমান ছেলে-মেয়েগুলোকে শাস্তি দেন না। একটা গভীর বেদনাবোধ তার ক্ষুদ্র বুকে চেপে বসে থাকে। কিন্তু সেই সকালে তার এই বেদনাবোধ সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেল যখন সে শুনল তার আব্বা পবিত্র কুরআন থেকে তিলাওয়াত
করছেন :
“হে মুহাম্মদ! জেনে রাখ, প্রত্যেক জাতিকেই তাদের কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে- সেই নির্দিষ্ট দিনটিতে।”