আট :
আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর…
গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসা সুমধুর আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আহমদ খলিলের। উঠে বসে। খলিফা ও রশিদ কম্বলের নীচে গভীর ঘুমে মগ্ন। তাদের গায়ের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দেয় সে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সাথে সাথেই জেগে ওঠে তারা। ফজরের নামাজ পড়ে। তারপর দেয়ালের গায়ে বসে পড়ে হেলান দিয়ে। এখন তিনজোড়া চোখই একাগ্রভাবে নিবন্ধ হালিমার দিকে। চুলোর ওপরে সকালের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হালিমা। আরো কিছুক্ষণ পরে শুকনো সীম ও যবের রুটির মিশেলে তৈরী খাবার তাদের সামনে এস যায়। ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সে খাবারের ওপর। কয়েকমুহূর্ত পর তাদের আঙ্গুলের ডগাগুলো খাবারের আর একটি দানাও খুঁজে পায় না। ‘আলহামদুলিল্লাহ্’! মনসুর শোকরগুযারী করলেন আল্লাহর কাছে। ছেলেদের দিকে ফিরে তিনি বললেন : সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদের খাবার এবং পানি দিয়েছেন এবং আমাদের সৃষ্টি করেছেন মুসলিম হিসেবে। ছেলেদের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয় সে প্রশংসাবাণী।
এর পর মালেক ওহাব আহমদ খলিলের দিকে তাকিয়ে বললেন- মাঠে যাবার আগে কুয়া থেকে আজ পানি আনার দায়িত্ব তোমার। হালিমা আজ খুবই ব্যস্ত। পানি আনার পাত্র দেখিয়ে তিনি বললেন – এটা নিয়ে যাবার সময় খলিফাকেও সাথে নিয়ে যেও। সে এখনো খুব ছোট, তাই সব সময় ওর দিকে খেয়াল রেখ।
আহমদ খলিল ক্রুদ্ধ চোখে তাকায় তার ছোট ভাইয়ের দিকে। তার দৃষ্টি দেখে মনে হল, খলিফা জন্মগ্রহণ না করলেই যেন ভালো ছিল। আহমদ খলিল ভাবে, সে তো আল্লাহর কাছে একটি ভাই কিংবা বোন চেয়েছিল যাতে একজন সঙ্গী বা খেলার সাথী পাওয়া যায়। তা না হয়ে একটা উটকো ঝামেলা কোত্থেকে এসে তার ঘাড়ে চাপল ? তার বয়স এখন এগারো। খলিফা তার চেয়ে সাত বছরের ছোট। এই ছোট বালকটির দেখাশোনা তাকে করতে হবে ভেবে আহমদ খলিলের মন বিষিয়ে ওঠে।
তবে খলিফা আহমদ খলিলের সাথে গেল না। ছোট্ট শিশুটি তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কি বুঝলো কে জানে, বার বার ডাকা সত্ত্বেও ঘরেই রয়ে গেল। ফলে মালেক ওহাবও বাধ্য হয়ে ঘরেই থেকে গেলেন।
কুয়ার ধারে পানি নেয়ার জন্যে গ্রামের বহু মহিলা ভিড় জমিয়েছিল। দূর থেকে বিরাট কলসি ঘাড়ে আহমদ খলিলকে আসতে দেখেই হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে তারা। কেউ কেউ আবার ঠাট্টা-বিদ্রূপ শুরু করে দেয়। পানি নেয়ার কাজটা একান্তভাবেই মেয়েদের। একে তো মেয়েদের কাজটি পুরুষ হয়েও তাকে করতে হচ্ছে, তারপর এই ঠাট্টা বিদ্রূপে ভীষণ অপমানিত বোধ করে সে। দুঃখে, লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে তার মুখ। মেয়েদের ভিড় ঠেলে কোন রকমে পানি ভরে বাড়ি ফিরে আসে আহমদ খলিল ।
আহমদ খলিল এবং রশিদ দু’জনে মিলে মাটি খুঁড়ছিল। বেশ কিছুটা গর্ত হওয়ার পর অনেকগুলো বীজ তারা পুঁতে দেয় সেই গর্তে। আকাশের দিকে তাকায় আহমদ খলিল। ঝকঝকে নীল আকাশ। কোথাও মেঘের ছিটে ফোঁটাও নেই। নগ্ন সূর্য-তাপে কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। পানি এনে গর্তে ঢেলে দেওয়ার পর সন্তুষ্ট হয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। বীজ থেকে চারা গজাবে, চারাগুলোর পাতা দোল খাবে মরুর বাতাসে, আকণ্ঠ তৃষ্ণায় শুষে নেবে প্রখর সূর্যালোক, বেড়ে উঠে এক সময় পরিণত হবে বিশাল মহীরুহ আহমদ খলিল যেন স্পষ্ট ছবিটা দেখতে পেল। এ বছর ভাল ফসল হবে ইনশাল্লাহ। অন্তর থেকে কথাটার সমর্থন পেল সে। পানি ভেজা কিছু মাটি সে তুলে নেয় হাতে। দু’হাতের আঙ্গুলের চাপে দলা বানিয়ে ফেলে। মরুভূমিতে এ মাটির যে কি মূল্য তা একমাত্র ফেলাহীনরাই জানে। ইরাক আল মানশিয়ার অবস্থান মরুভূমির একেবারেই কিনারে। যতদূর চোখ যায়- রুক্ষ, ঊষর, মরুময় প্রান্তর। বাইরের কোন লোকের পক্ষে কিছুতেই বিশ্বাস করা সম্ভব নয় যে এখানে কোন শস্য ফলতে পারে। কিন্তু ফেলাহীনরা ঠিকই জানে যে কোথায় মাটি আছে, কোথায় শস্য ফলানো যায়। যেখানে মাটি আছে, নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি যত্ন নেয় তারা সে মাটিটুকুর। জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দই তারা খুঁজে পায় এর মাঝে। তবে মালেক ওহাব এ সবের মধ্যে কোন আকর্ষণ খুঁজে পান না। তিনি এটাও বুঝতে পারেন না যে আহমদ খলিল আর সব কিছুর চেয়ে মাঠে কাজ করতেই কেন বেশি ভালবাসে ।
হঠাৎ করে একটা মটর গাড়ির শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে সবাই। গাড়িটি নজরে আসা মাত্র ভীত সন্ত্রস্ত খলিফা এক দৌড়ে গিয়ে হালিমার পিছনে লুকিয়ে পড়ে। বাড়ির সীমানায় গাড়িটা এসে থামতেই আহমদ খলিল উঠে দাঁড়ায়। ইংলিশ স্যুট এবং লালটুপি পরা মোটা একটি লোক নেমে আসে। মালেক ওহাবের দিকে এগিয়ে যায় সে।
মালেক ওহাব মোটর গাড়ির শব্দ কিংবা তার দিকে লোকটির এগিয়ে আসা কিছুই বুঝতে পারেন নি। এক মনে একটি গর্ত খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। অবশেষে মোটা লোকটি মুস্তফা এফেন্দী, জোরে তার নাম ধরে ডাকতেই সচকিত হয়ে মুখ তোলেন তিনি। মুস্তফা এফেন্দীকে দেখেই বোঝা যায়- এ লোক শুধু হুকুম করতে চায় এবং চায় লোকেরা তাকে মেনে চলুক। কিন্তু মালেক ওহাব তার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকালেন তাতে শুধু এফেন্দীর প্রতি তার ঘৃণা, ক্রোধ এবং ক্ষোভই ফুটে উঠলো ।
কাজ ছেড়ে উঠে আসেন ওহাব। তার হাত-পা মাটিতে ভরে আছে। কোন ভণিতা না করে সোজাসুজি কাজের কথায় এলেন তিনি – কি ব্যাপার এফেন্দী। আপনার সাথে তো আমার আর কোনদিন দেখা হওয়ার কথা নয়। কি চান আপনি?
: আমি তোমার ছেলে দুটোর কথা শুনেছি। আহমদ খলিলের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায় এফেন্দী- সম্ভবত এটিই তোমার বড় ছেলে। দেখতে তেমন সুবিধের না, তবে স্বাস্থ্যটা ভালোই মনে হচ্ছে ………….. ।
অনেকগুলো মুহূর্ত নিঃশব্দে পার হয়ে যায়। আহমদ খলিল এফেন্দীর দিকে তাকায় এবং প্রথম দৃষ্টিতেই লোকটির প্রতি অপরিসীম ঘৃণায় তার মন বিষিয়ে ওঠে। সে দেখে, হলদেটে চামড়ায় ঢাকা লোকটির বলি রেখাঙ্কিত মুখ, লালাভ চোখ। সে চোখে শুধু ঈর্ষা, স্বার্থপরতা আর ধূর্ততার ছায়া। বাঁকানো নাক, মাংসের ভারে ঝুলে পড়া চিবুক। এর আগে এ রকম কুৎসিত ও কদাকার মানুষ আহমদ খলিল আর দেখেনি। সে অনেকটা সম্মোহিতের মতো অবাক বিস্ময়ে, অন্তর্জাত ঘৃণায় লোকটির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে ।
মুস্তফা এফেন্সী ঘুরে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় আহমদ খলিলের দিকে। এমনভাবে তার দিকে তাকায় যেমনভাবে মানুষ তাকায় কোন ঘৃণ্য জীবের দিকে।
আহমদ খলিলের দিকে এফেন্দৌর তাকানো দেখেই মালেক ওহাবের মনে শংকা জেগে ওঠে। তিনি বললেন : কি ব্যাপার? আমার ছেলেকে নিয়ে কি করতে চান আপনি?
: আমার একটা চাকরের দরকার। ঘর পরিষ্কার করবে, মেঝে ঘষে সাফ করবে। এ কাজের জন্যে তোমার ছেলেটাকে খুব উপযুক্ত মনে হচ্ছে। নির্মম নিস্পৃহ কণ্ঠে কথাগুলো বলে এফেন্দী।
: সে ক্ষেত্রে অন্য কোথাও দেখতে হবে আপনাকে। আমার ছেলেকে দাস বানাবার জন্যে দিতে পারিনা আমি। তাছাড়া আপনি ভুলে যাবেন না যে তুর্কীরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ম্যাণ্ডেটে দাস প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপরও যদি আপনি ছেলেকে নিতে চান তবে আমি গাজার পুলিশের কাছে যাবো যাতে ওরা আপনাকে জেলে ভরার ব্যবস্থা করে।
আত্মপ্রসাদের হাসিতে ভরে ওঠে মুস্তফা এফেন্দীর মুখ। বলে : গাজার ইংরেজ অফিসাররা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর পুলিশ! ওদেরকে ঘুষ দিয়ে ঠাণ্ডা করার কায়দা আমার জানা আছে। এই গ্রাম, জমি এবং এখানে বসবাসকারী সব ফেলাহীনই আমার নিজস্ব সম্পত্তি। আমি এদের নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারি।
মালেক ওহাবের দিকে বাঁকা চোখে তাকায় এফেন্দী : তুমি ভুলে যেও না যে তোমার মা ছিল আমার বাপের এক রক্ষিতা দাসী। তুমি হয় আমার কথা মতো কাজ করবে আর নইলে আমি শস্যের খাজনা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেব এবং তা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। আর পরিশোধ যদি না হয় তবে আর কেউ নয়, শুধু তুমিই এজন্যে দায়ী হবে।
: না! চিৎকার করে উঠলেন মালেক ওহাব। এটা আমি হতে দেবনা। তার আগে আমি তোমাকে খুন করবো।
আহমদ খলিল ভয়ে দৌড়ে পালাতে চাইল। কিন্তু সে নড়ে ওঠার আগেই একজোড়া কঠিন হাত তার কাঁধ চেপে ধরলো। সে হাতে প্রচণ্ড শক্তি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে।
এ সময় গাড়ি থেকে আরো দু’জন লোক নেমে আছে। লম্বা চওড়া শক্তিশালী পেশী বহুল শরীর। এফেন্দীর পোষা গুপ্তা। এফেন্দী ওদের দেখেই চেঁচিয়ে উঠে ঃ আরিফ! এখনি একে গাড়িতে তোল ।
আহমদ খলিল আবার প্রাণপণ শক্তিতে চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে, কিন্তু পারে না। লোক দু’টি দু’দিক থেকে তাকে ধরে ফেলে ।
: আব্বা! আব্বা! আহমদ খলিল চিৎকার করে।
একটি লোমশ হাত মুখ চেপে ধরে তার। তারপর শূন্যে তুলে নিয়ে যায় গাড়ির কাছে। আরেকজন দরজা খুলে ধরতেই নির্মম ভাবে আহমদ খলিলকে সে ছুঁড়ে ফেলে গাড়ির মধ্যে। তারপর ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় সিটের তলায়।
গাড়ি ছুটে চলে।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আহমদ খলিল ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছিল। এখানে আসার দিনটি থেকেই সে পালাবার সুযোগ খুঁজিল। কিন্তু কোন সুযোগই সে পায়নি। মুস্তফা এফেন্দী তার ওপর কড়া নজর রেখেছিল। বাড়ির কারো সাথে দেখা করার অনুমতি তাকে দেয়া হয় নি। মালেক ওহাব বহু কাকুতি মিনতি করেছিলেন ছেলেকে একনজর দেখার জন্য। সেটাও প্রত্যাখ্যান করেছে এফেন্দী। এমন কি ছেলের জন্যে কাপড় ও খাবার পর্যন্ত দিতে দেয়া হয়নি তাকে
আহমদ খলিল বড় অসহায় বোধ করে। গ্রামের বা বাড়ির কারো কোন খবরই সে পায়না। তার দিন কাটে শত্রুভাবাপন্ন কিছু মানুষের সাথে। সারাদিন সে বাড়ির মধ্যে বন্দী থাকে। কখনো মেঝে মুছে দেয়ালের ঝুলকালি সাফ করে, আসবাপত্র পরিষ্কার কিংবা বাগানে মালির কাজ করে তার দিন কাটে। এসব কাজে তাকে সাহায্য করার কেউ ছিল না। কাজে কখনো গাফিলতি হলেই তার ভাগ্যে জোটে নির্মম প্রহার ।
এর মাঝেই একদিন পালাতে গেল আহমদ খলিল। দুর্ভাগ্য, এফেন্দীর কুকুরটা টের পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর। শুধু যে ভাল মত কিছু, কামড় খেল সে তাই-ই নয়, এফেন্দী এসে কুকুরটাকে সরিয়ে না নিলে শরীরটা তখনই টুকরো টুকরো হয়ে যেত তার। এফেন্দী জানিয়ে দিল, সে যদি আবার পালাবার চেষ্টা করে তবে রাতে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হবে। নিজের দুর্ভাগ্য এবং অসহায়ত্বের কথা ভেবে আহমদ খলিলের বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে।
কুকুরের খাবার তৈরি এবং খাওয়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আহমদ খলিলকে । এফেন্দীর কুকুরের জন্যে মাংস, ডিম এবং দুধের বরাদ্দ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় সে । এত বিপুল পরিমাণ খাবার একটা কুকুরের জন্যে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তার। এক সঙ্গে এতটা খাবার এবং এত রকমের, সে জীবনেও দেখেনি। অল্প দিনের মধ্যেই একটা বুদ্ধি খেলে যায় তার মাথায়। প্রত্যেকবার খাবারের সময় যাতে সন্দেহের সৃষ্টি না হয় এমন ভাবে বেশ ভালো মত একটা অংশ নিজের পেটে দিতে শুরু করে সে।
আহমদ খলিল দেখে, গাজা থেকে প্রায়ই এফেন্দীর ইংরেজ বন্ধুরা আসে। আর তারা এলেই বিপুল খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুত করা হয়। ফল, মাখন, জলপাই, সেদ্ধ ডিম, রোস্ট করা মুরগী, ভেড়ার গোত ট্রের ওপর সাজিয়ে ওদের সামনে রাখে সে। পরে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ঈর্ষাতুর চোখে ওদের খাওয়া-দাওয়া দেখে। খাবার শেষে কারো উচ্ছিষ্ট গোশত কিংবা অন্য যাই পড়ে থাক, আগ্রাসী ক্ষুধায় পরম পরিতৃপ্তির সাথে খেয়ে নিঃশেষ করে সে।
কখনো কখনো আহমদ খলিল স্পষ্ট বুঝতে পারে এফেন্দীর পরিবারের লোকেরা এবং ইংরেজ লোকগুলো তার সম্পর্কে আলোচনা করছে। কিন্তু এ বিষয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না সে। তার একমাত্র লক্ষ্য, সুযোগ মতো কিছু খাবার হাতিয়ে নেয়া। এর বাইরে আর কোন ব্যাপারে কোন আগ্রহ তার আছে বলে মনে হয় না। তবে কখনো যদি পেটটা ভরে ওঠে অর্থাৎ ক্ষুধার জ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পায় তখন সে ড্রয়িং রুমে ইংরেজ অফিসার আর এফেন্দীর মধ্যকার কথাবার্তাগুলো কান পেতে শোনে।
একদিন এরকম খাওয়া-দাওয়ার পর মুস্তফা এফেন্দী তার ইংরেজ বন্ধুদের সাথে ড্রইংরুমে বসে গল্প-গুজব করছে। এগিয়ে যায় আহমদ খলিল। দেখে, এফেন্দীর হাতে ধরা রয়েছে বড় বড় অক্ষরে ছাপা এক আরবী খবরের কাগজ। পিছন থেকে উঁকি দিয়ে খবরগুলো পড়ার চেষ্টা করে সে। জার্মানদের আত্ম-সমর্পণ এবং হিটলারের আত্মহত্যার কথা কাগজে লেখা হয়েছে। এর অর্থ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ। এতবড় খবরেও আহমদ খলিলের কোন ভাবান্তর হয় না। সে স্পষ্টই উপলব্ধি করে, এতে তার কোন আনন্দ বা দুঃখ কিছুই নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান তার দাসত্বের নিগড়ে বাঁধা জীবনে কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না তা সে ভালো করেই জানে।
ম্যান্ডেট সম্পর্কে অনেক কথা তার কানে আসে। ইহুদী সন্ত্রাসবাদীরা দিন দিন তাদের তৎপরতা জোরদার করছে। ইংরেজ সরকারের সাধ্য নেই তাদের দমন করা। সরকারের কাছে এমন কোন সমাধানও নেই যাতে আরব ও ইহুদীদের সমানভাবে সন্তুষ্ট করা যায়। এমন সময় ঘরের মধ্যে কানাকানি শুরু হয়। আহমদ খলিল সচকিত হয়ে ওঠে কথাগুলো বোঝার জন্যে। সে একজন ইংরেজকে বলতে শোনে- পরিস্থিতি যদি আরো বেশী খারাপ হয়ে পড়ে তবে ইংল্যাণ্ড তার ম্যান্ডেট প্রথার অবসান ঘটিয়ে সৈন্য তুলে নেবে। ইহুদী এবং আরবরা তখন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে ফয়সালা করে নেবে ফিলিস্তিন কাদের হবে। আহমদ খলিল কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে যায়। এটাও কি সম্ভব?
রাত গভীর হয়। সেদিনের মত কাজ শেষ হয় আহমদ খলিলের। এফেন্দী, তার স্ত্রীরা ও ছেলে-মেয়ে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় নিজেদের শোবার ঘরের দিকে চলে যায়। এখন তার ওপর নজর রাখার আর কেউ নেই। এ সময়টা ভীষণ ভালো লাগে তার। পালানোর চিন্তাটা আবার তার মাথায় ঢোকে। কিন্তু সে যাবে কোথায় ? আহমদ খলিল ভাবে । যদি কোন রকমে পালিয়ে সে তার গ্রামে পৌঁছে যায়ও, এফেন্দী সাথে সাথেই তা জানতে পারবে। কোন সন্দেহ নেই, তাকে আবার ধরে আনা হবে এবং তখন তার ভাগ্যে যে কি নির্মম শাস্তি লেখা আছে সেটা তার অজানা নয় । তাই পালানোর চিন্তাটা বাতিল করে দেয় সে।
রাতের গভীর অন্ধকারে আহমদ খলিল একমাত্র তখনই নিরাপদ বোধ করে যখন ছুরিটা সে হাতে নেয়। পরণের কাপড়ের ভাঁজে সারাদিন এটাকে লুকিয়ে রাখে সে। রাতে শোবার সময় বের করে হাতে নেয়। এফেন্দী যদি আবারো তার ওপর নির্যাতন চালায় তবে উপযুক্ত জবাব এবার সে দেবে।
হঠাৎ করে গায়ের কাপড়ে তার হাতের স্পর্শ লাগে। তার মনে পড়ে, আবদুল আজিজ মারা যাওয়ার ফলেই এগুলো পেয়েছে সে। তার গায়ে আরো যে তিনটি কাপড় আছে তাও আবদুল আজিজেরই। হঠাৎ তার মনে হয়- আবদুল আজিজ তার আশে পাশেই আছে, নিঃশব্দে ।
রশিদ এবং খলিফার কথা মনে আসে তার। সে আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করে-যদি সে এখান থেকে মুক্তি পেয়ে ঘরে ফিরে যেতে পারে তবে খলিফাকে আর কখনো উত্ত্যক্ত করবে না কিংবা তার অমঙ্গল সূচক কোন কথা বলবে না। মানস চক্ষে সে দেখতে পায় তার গ্রামের প্রসারিত মাঠ। এখন জমি চাষের সময়। খুব শিগগিরই মাটির নীচ থেকে চারাগুলো বেরিয়ে আসবে আলো হাওয়ার স্পর্শ নিতে। যখন সে খুবই ছোট ছিল তখন তার মা মাঠে গিয়ে তাকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন সব রকমের গাছ-পালা। তাদের নামগুলোও তিনি বলে দিতেন তাকে। একবার নয়, বারবার যাতে সে কোনদিন ভুলে না যায়।
চোখ ভাসিয়ে নেমে আসা অশ্রুর বন্যা ঠেকাতে সন্তর্পণে উঠে দাঁড়ায় আহমদ খলিল। পা টিপে টিপে রান্না ঘরে গিয়ে কলের ট্যাপ খুলে চুপচাপ অজু করে নেয়। তারপর দাঁড়িয়ে যায় নামাযে ।
একসময় নামায শেষ হয়- মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে আসে তার। আহমদ খলিলের মনে হয় সে আর এখন একা নয়। সে আল্লাহকে ভুলে যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহ তাকে ভোলেন নি। চোখে ঘুম নেমে আসে। কম্বলটা খুঁজে নিয়ে অন্ধকারে ঢাকা বারান্দায় বেরিয়ে আসে সে, দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে শুয়ে পড়ে। সাথে সাথেই তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে ।