নয় :
একদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আহমদ খলিল শুনল, মুস্তফা এফেন্দী তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। তাছাড়া, আজ তাকে কোন কাজ করতে হবে না।
অবাক হয় আহমদ খলিল। ব্যাপারটা কি? তবে কি এতদিন ধরে ঘরে ফিরে যাবার যে স্বপ্ন সে দেখে আসছিল তা আজ সফল হতে যাচ্ছে! কিংবা তার আব্বা কোন সহৃদয় বৃটিশ অফিসারকে ধরে তার মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন? মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা চিন্তাগুলো নিয়ে এফেন্দীর সামনে গিয়ে হাজির হয় সে।
: শোন- মুস্তফা এফেন্দী বলতে শুরু করলো, টুকিটাকি কিছু জিনিস কেনার জন্যে আজ তোমাকে গাজায় যেতে হবে। বাড়িতে বহু মেহমান আসার কথা। তাদের জন্যে মিষ্টি আর তামাক নিয়ে আসবে তুমি।
কোথায় ভালো জিনিস পাওয়া যাবে এফেন্দী তা জানিয়ে দিল। তবে সাবধান করে দেয় সে পালানোর কোন চেষ্টা করো না। লাভ হবে না। তুমি যেখানেই যাওনা কেন আমি তোমাকে ঠিকই খুঁজে বের করব।
অতএব গাজার প্রধান সড়কে এসে পৌঁছে আহমদ খলিল। পথ চিনতে তেমন অসুবিধে হয়নি তার। কারণ ছোটবেলায় তার চাচার সাথে বহুবারই সে এখানে এসেছে। আহামরি কোন শহর নয় গাজা, বরং একটা উন্নত ধরনের গ্রামই বলা চলে একে। বাজারে বেশ কিছু দোকানপাট। জায়গাটা ছোট, নোংরা এবং দুর্গন্ধময়। কিছু ট্রাক এবং স্কুটার দেখা যায় রাস্তাগুলোতে। সে রাস্তায়ও আবার কংক্রিটের কোন আস্তরণ নেই। গাধার চলাচলই বেশি। গাধাগুলোর পিঠে নিজেদের ওজনের চাইতেও বেশি যাত্রীর বোঝা কিংবা গ্যাসোলিনের টিন চাপানো। তবে দীর্ঘদিন ধরে এফেন্দীর বাড়িতে বন্দী আহমদ খলিল খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে অনুভব করল, এ ছোট্ট শহরটি তার ভালো লাগছে। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে সে মুক্তির স্বাদ অনুভব করে ।
এফেন্দীর বলে দেয়া দোকানে পৌঁছে যায় আহমদ খলিল। ঘরের মধ্যে বেশ অন্ধকার। টাকমাথা দোকানী এক কোণায় টুলের ওপর বসে অনবরত হুঁকো টেনে চলেছে। তার পাশেই রাখা একটা ছোট্ট রেডিও। তাতে ভেসে আসছে আরবী গানের সুর। কায়রো স্টেশন ধরা আছে বোধহয় ভাবে আহমদ খলিল ।
সামনে লোক দেখে মুখ তুলে তাকায় দোকানী ।
: আমার কিছু তামাক এবং মধু, শুকনো আঙ্গুর দেয়া পঞ্চাশটি কেক দরকার। জানায় আহমদ খলিল। তারপর থলে খুলে রুপো ও তামার মুদ্রাগুলো বের করে দোকানীর বাদামী হাতের তালুর ওপর রাখে।
: মোটে! টাকার পরিমাণ দেখে তাচ্ছিল্য ফোটে দোকানীর গলায়। তা কতখানি তামাক দরকার তোমার? জানতে চাইল সে।
: ছয়জন লোকের সারা দুপুর ও বিকেল ধরে হুঁকো টানার মত।
জিনিসগুলোর ব্যাপারে দর কষাকষির চেষ্টা করে আহমদ খলিল। কিন্তু এজন্যে যতটা চালাক-চতুর হওয়া দরকার, সে তা ছিল না। দোকানী টাকাগুলো আগে হাতে পাবার পুরো সুযোগটাই নিয়েছে। শেষে প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হয় তার।
অবশেষে, দোকানী মিষ্টি কেক ও তামাক তার হাতে দিয়ে রেডিওটা বন্ধ করে দেয়। আহমদ খলিলকে চলে যেতে দেখে ডাক দেয় সে-
: শোন, জিনিসগুলো তো পেয়ে গেছ। এখন একটু বসে আরাম করে যাও। বেশ দূর থেকেই তো তুমি এসেছ, তাই না ।
একটা টুল এগিয়ে দেয় সে তার দিকে। পাশে রাখা কফিপটটা নিয়ে এক কাপ কফি ঢেলে কাপটা বাড়িয়ে দেয় আহমদ খলিলের দিকে, এবার বলো, কে তুমি?
: আমি মালেক ওহাবের ছেলে।
কথা শেষ করতে পারল না আহমদ খলিল।
: মালেক ওহাবের ছেলে তুমি? বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে ওঠে দোকানী ।
এরপর একনাগাড়ে অনেক কথা বলে যায় সে। তার নাম ইসা বরকত। মালেক ওহাব এবং সে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বহুদিন এবং রাত তারা কাটিয়েছে এক সঙ্গে। মালেক ওহাব এ দোকানে বসে বহুদিন তার সাথে জিনিসপত্র বিক্রি করেছে, খদ্দেরদের সাথে মূল্য নিয়ে দর কষাকষি করেছে। প্রায়ই সে উদাত্ত গলায় কবিতা আবৃত্তি করে শোনাত । ইসা আবার জাত গায়ক। মালেক ওহাবের আবৃত্তি করা কবিতাগুলোতে সে সুর দিত, গেয়ে শোনাত তাকে। বড়দিনের সময় সবার জন্য কেনাকাটা করতে গেলে মালেক ওহাবও তার সঙ্গে যেত। তাকে বেথলেহেম নিয়ে যেতে পারলে খুব খুশি হতো ইসা। প্রতি বছরই তার সাথে সে যেত পবিত্র স্থানগুলোতে।
কথার মাঝে হঠাৎ বাধা হয়ে ওঠে আহমদ খলিল-
: আপনি কি হজ্জ করেছেন? মক্কা-মদীনায় কতদিন ছিলেন?
: না- বাবা, মক্কা-মদীনায় কখনো যাইনি আমি। সেখানে তো শুধু মুসলমানরাই যায়। ভরি হয়ে ওঠে ইসার গলা। আমি একজন খৃষ্টান। তোমার আব্বা প্রায়ই কুরআন পড়ে শোনাত আমাকে । যীশু এবং তার মায়ের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। ফিলিস্তিনের সব জায়গায় আমি ঘুরেছি। জেরুজালেম ও নাবলুসের পবিত্র স্থানগুলোতে আমি বহুবার গিয়েছি। ফলবান আঙ্গুরলতা, জলপাই বাগানে ঘেরা সূর্যতপ্ত ফিলিস্তিন তখন ছিল শান্ত ও সুন্দর। যীশুখৃষ্ট, বহু নবী এবং দরবেশের স্মৃতি এ দেশকে পবিত্রভূমিতে পরিণত করেছে। এ কারণেই এ দেশ ছেড়ে আর কোথাও যেতে চাইনি আমি ।
আহমদ খলিল জিজ্ঞেস করে : আচ্ছা, আপনি কি কখনো আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন? এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় কিন্তু ।
: হ্যাঁ, তোমার আব্বার খোঁজে একবার গিয়েছিলাম। কিন্তু সেবার তাকে পাইনি । ইসা বরকত জানালেন।
: কেন, এমন তো হওয়ার কথা নয়। আমি জানি, আব্বা সব সময় গ্রামেই থাকতেন।
: হয়তো তোমার কথা সত্য, আবার সত্য নাও হতে পারে। ইসা বরকত বললেন। তবে তোমার আব্বার কিছু ব্যাপার হয়তো তোমার জানা নেই। বলতে শুরু করলেন তিনি-
: মুস্তফা এফেন্দী ও তোমার আব্বাকে ছোটবেলায় একজন দক্ষ গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ভালো করে লেখাপড়া শেখানো হয়। পরে মুস্তফার আব্বা ফুয়াদ এফেন্দী দুজনকেই উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্যে ইংল্যান্ড পাঠান। তবে এ সময় প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তাদের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মালেক ওহাবকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেয়া হলেও মুস্তফার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয় । ইতিমধ্যে ফুয়াদ মারা গিয়েছিলেন। মুস্তফা নিজে অক্সফোর্ডে ভর্তি না হতে পারার ব্যর্থতায় এবং মালেক ওহাবের সাফল্যে ক্ষেপে ওঠে। সে তোমার আব্বাকে বিয়ে দিতে এবং তোমার চাচাসহ তাকে ফেলাহীনদের সাথে কাজ করার জন্য ইরাক আল মানশিয়াতে পাঠায়। আমি অবশ্য সব সময় মনে করতাম- তোমার আব্বা বড়জোর ওদের বাড়ির ভৃত্য হবে। কিন্তু সে যে একজন দাস- এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এ ঘটনায় খুবই আঘাত পেয়েছিলাম আমি, কিন্তু আমার করার কিছুই ছিলনা। একমাত্র যা করতে পারতাম তা হল তার জায়গায় নিজে গিয়ে তাকে মুক্তি দেয়া ।
গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ইসা বরকতের বুক চিরে। স্নেহমাখা দৃষ্টি নিয়ে তাকান তিনি আহমদ খলিলের দিকে-
: তুমি আর এক কাপ চা কিংবা কফি খাও বাবা। শরীরটা ভাল লাগবে।
: না, না। প্রতিবাদ করে আহমদ খলিল। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি এবার চলি। উঠে পড়ে সে।
: ঠিক আছে। ঈশ্বর তোমার ভালো করুন। আর হ্যাঁ, তোমার আব্বার সাথে দেখা হলে তাকে আমার কথা বলতে ভুলো না, কেমন?
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় আহমদ খলিল ।
জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে খুব দ্রুত চলতে থাকে আহমদ খলিল। সে জানে, এত দেরি হওয়ায় মুস্তফা ঠিকই তার ওপর ক্ষেপে গেছে। কপালে মারধরও যে আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। চলার গতি আরো দ্রুত করে সে। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে তার শরীরটা যেন ভেঙ্গে পড়তে চাইল। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত আহমদ খলিল রাস্তার ধারের একটি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।
দীর্ঘ বলিষ্ঠ গড়নের এক রমণী আহমদ খলিলের সামনে দিয়ে চলে যায়। তার মাথায় ঝুড়ি ভর্তি শসা। ঝুড়িটি নিঃসন্দেহে যথেষ্ট ভারি। কিন্তু সে হেঁটে গেল অনায়াসে, দৃঢ় পায়ে। এ রমণীটির হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গি অবিকল খাদিজার মতো। হঠাৎ করেই আহমদ খলিলের মনে হয়- তার আম্মাই যেন ফিরে এসেছে। মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে তার।
নতুন করে কারো পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে আহমদ খলিল। একজন বৃদ্ধাকে দেখতে পায় এবার। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে পড়েছে। গায়ের কাপড় শরীরটা ঢাকতে পারিনি ভালোমতো। পেঁয়াজ ভরা মোটা একটা কাপড়ের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল- ব্যাগটি বইতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। আহমদ খলিলকে ছাড়িয়ে একটু সামনে গিয়েই পথের ওপর ধপ করে বসে পড়ে বৃদ্ধা। পরক্ষণে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। বোঝা যায়, ব্যাগটি বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি আর তার শরীরে অবশিষ্ট নেই। পথিকেরা তার দিকে তাকিয়ে দেখে- কিন্তু সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে না কেউই।
ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায় আহমদ খলিল। বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে সযত্নে দাঁড় করিয়ে বোঝাটি কাঁধে তুলে দেয়। কাছেই একটা মসজিদ। তার মনে হয়, বৃদ্ধাকে ওখানে পৌঁছে দেয়াই ভাল হবে। তাহলে একটু বিশ্রাম নিয়ে সুস্থ হয়ে বাজারে যেতে পারবে সে।
বৃদ্ধাকে রেখে ফিরে আসার সময় আহমদ খলিল স্পষ্ট অনুভব করল, তার নিজের অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়। পকেট হাতড়ে শেষ সম্বল কয়েকটি পয়সা বের করে সে। শরবতের দোকান থেকে এক গ্লাস শরবত খেয়ে অনেকটা ভালো বোধ করে। এবার জিনিসপত্র নিয়ে এফেন্দীর বাড়ির দিকে রওনা হয় সে।
মুস্তফা এফেন্দীর বাড়িতে আসার পর দু’বছর কেটে গেছে। আহমদ খলিল এখন বহাল তবিয়তেই আছে। বেশ কিছু দিন থেকে কেউ তার ওপর আর নজর রাখে না। কোন ভুল ত্রুটি হলেও মুস্তফা এফেন্দী গায়ে হাত তোলে না আর। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। মাস তিনেক আগে ছোট একটি ত্রুটির জন্যে এফেন্দী তার গায়ে হাত তুলতেই কোমরে কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ছুরিটা বের করে এনেছিল আহমদ খলিল। মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল তার। শেষ পর্যন্ত কি ঘটতো তা বলা যায় না। কিন্তু আহমদ খলিলের হাতে ছুরি দেখেই ঘরের মধ্যে পিছু হটতে শুরু করেছিল এফেন্দী। অবশেষে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে যায় তার। পালাবার পথ নেই। উদ্যত ছুরি হাতে আহমদ খলিল দাঁড়িয়ে আছে সামনে। চিৎকার করে কারো সাহায্য চাইবে কিংবা কিশোরটির কাছ থেকে ছুরি কেড়ে নেবে- এ শক্তিও তখন এফেন্দীর নেই। আর মাথায় খুন চড়ে যাওয়া আহমদ খলিল একটু অবাক হয়েই দেখে, নিশ্চিত মৃত্যুর আতঙ্কে এফেন্দী থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ করে কেমন যেন হয়ে যায় সে। বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। মৃত্যুর ভয়ে কাঁপতে থাকা শত্রুকে আঘাত করতে পারে না সে।
এ ঘটনার পর পুরো পরিবেশটাই একবারে বদলে গেছে। এফেন্দী তাকে আর বেশি কাজের জন্য বলে না। তাছাড়া যেখানে খুশি যে কোন সময় যেতে পারে সে। আর সবার মতো তাকেও ভাল খাবারই দেয়া হয় এখন। সবচেয়ে বড় কথা, এফেন্দী এখন আহমদ খলিলকে যথেষ্ট সমীহ করে চলে।
বাড়ির ঘর-দোরগুলো নিজের ইচ্ছাতেই পরিষ্কার করে আহমদ খলিল। নানা ধরনের বই ও পত্র-পত্রিকা এফেন্দীর বাড়িতে আছে। রোজই সেগুলো নাড়া-চাড়া করে সে। তবে খুব একটা সুবিধে হয় না। একেতো বিষয়গুলো তার মনের মত নয়, তারপর আবার তার পড়াও এগোয় খুব ধীর গতিতে। মূলতঃ ঘরের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাবার মত কিছু সে পায় না।
ইদানিং বাড়ির কাজকর্ম সেরে প্রত্যেকদিন বিকেলে শহরে যেতে শুরু করেছে আহমদ খলিল। এ দোকান থেকে সে দোকান ঘুরে এবং বিচিত্র রকমের মানুষ দেখে সময় কাটে তার। তারপর রাতের আলো জ্বলারও অনেক পর মসজিদের মিনারগুলো থেকে এশার নামাজের আযান ধ্বনিত হতে শুরু করলে এফেন্দীর বাড়ির দিকে সে পা বাড়ায় ।
দিন কয়েক পরে সকাল বেলায় এফেন্দীর সাথে দেখা হতেই এক প্রস্থ গালির ঝড় বয়ে যায় আহমদ খলিলের উপর দিয়ে ঃ এই ফকিরের বাচ্চা, এ দিকে আয়। গোসল করিস না কতদিন? উহ্! গায়ের বিটকেলে গন্ধে কাছে দাঁড়ানো পর্যন্ত যায় না। এভাবে থাকিস কি করে তুই? লজ্জা করে না? কয়েকটা টাকা এগিয়ে দেয় এফেন্দী । যা, গাজায় গিয়ে ভালো করে গোসল করে আয় । তোর এই বিশ্রি চেহারা যেন আমাকে আর দেখতে না হয় বলে দিলাম। এফেন্দী ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় কথা শেষ করে।
মেজাজটা প্রথমে তিরিক্ষি হয়ে উঠলেও পরে লজ্জায় ঘাড় নুয়ে আসে আহমদ খলিলের। সত্যিই তো, কতদিন যে সে গোসল করেনি তারতো কোন হিসেবই নেই। তাছাড়া একটা কথা মনে হতেই মনটা ব্যথায় ভরে ওঠে। বাড়ি থেকে নিয়ে আসার পর শয়তান এফেন্দী আজ পর্যন্ত তাকে একটা কাপড়ও দেয়নি। গোসল করে পরার মতো দ্বিতীয় কোন কাপড় তো তার নেই। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, দুপুরে গাজায় গিয়ে আজ গোসল করে আসবে সে।
গাজায় রাস্তায় শুধু ট্রাক আর বাস। সৈন্য আর সাধারণ মানুষে ভর্তি। সবার কাছেই ব্যাগ-বোঁচকার ছড়াছড়ি। কোথায় যেন যাচ্ছে এরা। কৌতূহলী হয়ে ওঠে আহমদ খলিল। সরকারী গোসল খানার কাছে গিয়ে সে আরো অবাক হয়। অন্যান্য দিনে এ সময় গোসলখানা থাকে লোক ভর্তি। আজ তা একেবারে শূন্য। এটেন্ড্যান্ট লোকটি একা বসে গভীর মনোযোগের সাথে রেডিও শুনছে। রোজকার মতো কায়রো রেডিওতে একটা ভারি কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে। একটি ঘোষণা প্রচার করা হচ্ছে। আহমদ খলিল অবাক হয়ে শুনতে থাকে ঘোষকের কথা :
কোল ইসরাইয়েল (ভয়েস অব ইসরায়েল)। আমি এইমাত্র একটি দলিল হাতে পেয়েছি যাতে বৃটিশ ম্যান্ডেটরী শাসনের অবসান এবং ইসরাইলিদের জন্যে একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাসহ তার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণায় বলা হয়েছে :
ইসরাইল ইহুদীদের জন্মভূমি। এ ঐতিহাসিক কারণে ইহুদীরা শত শত বছর ধরে তাদের পূর্বপুরুষের ভূমিতে ফিরে আসার চেষ্টা করছে এবং নিজেদের দেশ ফেরত পাবার দাবি জানিয়ে আসছে। বিগত কয়েকটি দশকে বিপুল সংখ্যক ইহুদী এদেশে ফিরে আসে। তারা বসতি স্থাপন করে, ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করে, গড়ে তোলে খামার ও শিল্প। তারা নিজস্ব অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিসহ একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করে। তারা শান্তির প্রত্যাশী, নিজেদেরকে রক্ষায়ও সক্ষম । তাছাড়া সকল সম্প্রদায়ের জন্যেই তারা সমৃদ্ধি ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বার্তাবাহক।
১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর বেলফুর ঘোষণা দ্বারা আমাদের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। বৃটিশ ম্যান্ডেটে আমাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউরোপে নাজীদের দ্বারা লক্ষ লক্ষ ইহুদী হত্যার ঘটনার আমাদের জন্যে স্বতন্ত্র বাসভূমির প্রয়োজনীয়তা নতুন করে গুরুত্ব পায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ফিলিস্তিনের ইহুদীরা মিত্র পক্ষকে সার্বিক সমর্থন দান করে। ১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইহুদীদের দাবী অনস্বীকার্য। অন্য আরো দশটি জাতির মত ইহুদীদেরও নিজেদের দেশের নেতৃত্বদানের অধিকার আছে। ইসরাইল রাষ্ট্র পৃথিবীর সকল দেশের ইহুদীদের বসবাসের জন্যে উন্মুক্ত থাকবে। দেশের জনগণের কল্যাণে অর্থনীতি, শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়ন করা হবে। নবী ও মহত্ব্যক্তিদের নির্দেশিত স্বাধীনতা, ন্যায় ও শান্তি হবে রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তি। এ রাষ্ট্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার থাকবে। ধর্ম, চিন্তা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেয়া হবে এবং এ রাষ্ট্র একনিষ্ঠাবে জাতিসংঘ সনদের মর্যাদা দেবে। আমরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের সকল আরব অধিবাসীকে শান্তি বজায় রাখতে এবং রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে সমান অংশীদার হিসেবে সকল উন্নয়ন কাজে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা পার্শ্ববর্তী সকল রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি আমাদের প্রতিবেশী সুলভ বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করছি এবং আমাদের সহযোগিতার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এ প্রেক্ষিতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রেখে ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হলো। এ রাষ্ট্র ‘ইসরাইল’ নামে অভিহিত হবে, তেলআবিব হবে এর রাজধানী। ৫ই আইয়ার ৫৭০৮, ১৪ই মে ১৯৪৮ তারিখে এ ইসরাইয়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হলো।”
এ সময় এক গভীর নীরবতা রেডিও সেটটিকে গ্রাস করে। আর কিছু শোনার আগেই এটেনড্যান্ট বন্ধ করে দিল রেডিও সেটটা। আহমদ খলিল উপলব্ধি করে- বিরাট কোন ব্যাপার এখন ঘটে গেল। কিন্তু এর সাথে তার কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
গোসল সেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। সুগন্ধি সাবান এবং শীতল পানিতে গোসল করে এক অপূর্ব সুন্দর অনুভূতিতে মন ভরে ওঠে তার। আয়নায় তাকিয়ে সে দেখে কালো কালো গোঁফের রেখা, শক্ত, সমর্থ হয়ে তৈরি হতে থাকা তার শরীর। এখনই যথেষ্ট লম্বা ও স্বাস্থ্যবান সে। একজন পুরুষ বলেই তাকে মনে হয়। কিন্তু, মালেক ওহাবের চেহারাটা মনে পড়তেই চুপসে যায় সে। তার আব্বার তুলনায় শরীরের দিক দিয়ে সে এখনো একটি শিশুই রয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে থেকে সরে এসে পরনের তোয়ালে খুলে রেখে বহু পুরনো, ময়লা চিটচিটে নিজের কাপড়গুলো পরে নেয় । দ্রুত বেরিয়ে আসে রাস্তায় ।
গাজার রাস্তায় মানুষের ছুটোছুটি। শত শত মানুষ গাড়ি ট্রাকসহ যা পাওয়া যাচ্ছে তাতেই চড়ে বসছে। সবার সাথেই মালপত্রের বোঝা, চোখে মুখে আতঙ্কের চিহ্ন। কোথায়ও যাচ্ছে তারা। কিন্তু কোথায় এবং কেন তা সে ঠিক বুঝতে পারল না। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয় না তার। এফেন্দীর বাড়ি লক্ষ্য করে দৌঁড়তে শুরু করে সে।
এফেন্দীর বাড়িতে একটি প্রাণীও নেই। সমস্ত বাড়ি জুড়ে খা খা করছে শূন্যতা । সব দরজাতেই দু’টি করে তালা ঝুলছে, কিন্তু জানালা খোলা। আহমদ খলিল চিৎকার করে লোকজনকে ডাকে। কিন্তু কোন সাড়া পায় না। বিস্মিত হয় সে। লোকজন গেল কোথায়? সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে, কিন্তু কারোরই দেখা মেলে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে। গাজায় খবরের কাগজ না পড়ার জন্যে এখন খুব আফসোস হয় তার।
তবে যাই ঘটুক না কেন, আহমদ খলিল স্পষ্ট অনুভব করে, তার আর এখানে করার কিছুই নেই। নিজের গ্রাম, আব্বার কথা মনে হয়। সেদিকেই পা বাড়ায় সে।