‘সংস্কৃতি’ বাংলা শব্দ, সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ, কৃষ্টি, Culture. ইংরেজি Culture শব্দের অর্থই সংস্কৃতি। Culture শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Culture থেকে গৃহীত। এর অর্থ হলো কৃষিকার্য বা চাষাবাদ। তার মানে জমিতে উপযুক্তভাবে বীজ বপন ও পানি সিঞ্চন করা। বীজের রক্ষণাবেক্ষণ, লালন-পালন ও বিকাশের ব্যবস্থা করা। সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি মার্জিত রুচি বা অভ্যাসজাত উৎকর্ষ, উত্তম স্বভাব-চরিত্র। Culture এর বিপরীত শব্দ হলো অসভ্য-বর্বরতা। আর Culture হলো রুচিশীল, শালিন, মার্জিত, সুরুচিসম্পন্ন ভদ্র আচরণবিধি সম্পন্ন মানুষকে Cultured man বলে। আবার Culture বা সংস্কৃতি বলতে একদিকে মানুষের জাগতিক, বৈষয়িক ও তমুদ্দুন এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষকেও সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা হয় ।
একটা লোক যদি বিবস্ত্র অবস্থায় রাস্তা দিয়ে যেতে থাকে তাকে কি আমরা কালচারাল বলবো? না Uncultured man বলবো?
সংস্কৃতি শব্দটি সংস্কার থেকে এসেছে, যেমন : সংশোধন, পরিশুদ্ধকরণ, যে কোনো দোষ-ত্রুটি, ময়লা-আবর্জনা দূর করে ঠিক করা ।
ইংরেজি Culture শব্দের বাংলা অর্থ করা হয়েছে সংস্কৃতি যা সংস্কৃত ভাষার শব্দ—যার অর্থ উন্নতমানের চরিত্র।
অধ্যাপক Murray তাঁর ইংরেজি ডিকশনারিতে লিখেছেন : Culture হচ্ছে সভ্যতা, এরই মানসিক ও রুচিগত ব্যাপার। তাতে থাকা-খাওয়া, নিয়ম- নীতি, সামাজিক-সামষ্টিক, আচার-অনুষ্ঠান, স্বভাব-চরিত্র এবং আনন্দ-স্ফূর্তি লাভের উপকরণ। আনন্দ উৎসব, ললিতকলা, শিল্পচর্চা, সামষ্টিক আদত-অভ্যাস, পারস্পরিক আলাপ-ব্যবহার ও আচরণ বিধি শামিল রয়েছে এতে।
প্রখ্যাত দার্শনিক কবি T. S. Eliot তার লেখায় Culture বা সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেন : সংস্কৃতির দুটি বড় চিহ্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ-একটি ভাবগত ঐক্য আর দ্বিতীয়টি তার প্রকাশ ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের কোনো রূপ বা দিক। তার মতে, সংস্কৃতি ও ধর্ম সমার্থবোধক না হলেও ধর্মই সংস্কৃতির উৎস। সংস্কৃতি রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং দর্শনমূলক আন্দোলন অভিযানেও প্রভাবিত হতে পারে। Oswald Spengler-এর মতে, একটি সমাজের সংস্কৃতি প্রথমে উৎকর্ষ লাভ করে। তারই ব্যাপক ও উৎকর্ষের ফলেই গড়ে ওঠে সভ্যতা।
আরবিতে সাক্কাফাহ হলো সংস্কৃতি, ইংরেজিতে যা Culture। তাহযিব শব্দটিও একই অর্থে ব্যবহার হয়। সাক্কাফাহর শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ হলো : চতুর, তীব্র, সচেতন, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও সচেতন-সক্রিয় মেধাশীল হওয়া। আরবি সাক্কাফাহ অর্থ সোজা করা, সুসভ্য করা ও শিক্ষা দেয়া, পরিশুদ্ধ করা বা সংশোধন করা ।
Philip Baghy মতে, মানসিক লালন ও পরিশুদ্ধকরণেরই নাম হচ্ছে কালচার। অনতিবিলম্বে উন্নত সমাজের চাল-চলন, রীতি-নীতি, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান শিক্ষা ইত্যাদি এর আওতায় গণ্য হতে লাগলো।
ম্যাথু আর্নল্ড তার Culture and Anarehy গ্রন্থে ১৮০৫ সনের পরে ইংরেজি প্রথম ব্যবহার করেছেন। A.L. Krochs and Kluck Halm এর সূত্র উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, এর একশ’ একষট্টিটি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এবং তার মতে এমন সংজ্ঞা হওয়া উচিত যা মানবজীবনের সর্বদিকে পরিব্যাপ্ত হবে ধর্ম, রাজনীতি, রাষ্ট্রক্ষমতা, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রকৌশল বিদ্যা, ভাষা, প্ৰথা-প্রচলন ইত্যাদিতে এর মধ্যে শামিল মনে করতে হবে এবং মানবীয় বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা মতাদর্শ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্মীয় বিজ্ঞানক্ষমতা এবং এ ধরনের অন্যান্য জিনিসকে এর মধ্যে শামিল মনে করেছেন। টি.এস. ইলিয়ট কালচার শব্দটির তাৎপর্য বর্ণনায় বলেছেন : চাল-চলন ও আদব-কায়দার পরিশুদ্ধতাকেই কালচার বা সংস্কৃতি বলে।
ম্যাথু আর্নল্ড তার Culture and Anarchy গ্রন্থে শব্দটির অর্থ লিখেছেন : কালচার হলো মানুষকে পূর্ণ বানাবার নির্মল প্রচেষ্টা। অন্য কথায় কালচার হলো পূর্ণতা অর্জন ।
Mantesquev এবং B. Wilson এর দেয়া সংজ্ঞাকে অতীব উত্তম বলে মনে করেন। আর তাহলো- এক বুদ্ধিমান ও সচেতন মানুষকে অধিকতর বুদ্ধিমান ও সচেতন বানানো এবং সুস্থ বিবেকবুদ্ধির উৎকর্ষ ও আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্যে অব্যাহত চেষ্টা করা এবং তার মতে, কালচার ধর্ম হতেও ব্যাপক অর্থবোধক। তার গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক মুহসিন মেহেদী কালচার সম্পর্কে বলেছেন, এভাবে কালচার জীবনধারা থেকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কালচার হলো মানুষের আত্মার সাধারণ জমিনকে পরিষ্কার করা এবং তার কর্ষণের যোগ্য করে তোলা ।
চিন্তাবিদ ফারাবি কালচার শব্দের দুটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। একটি সমাজকেন্দ্রিক, অপরটি মানবিক। কালচার হচ্ছে এমন পূর্ণরূপ যাতে জ্ঞান- বিজ্ঞান, শিল্পকলা, নৈতিক আইন-বিধান, রসম-রেওয়াজ। মানবীয় কালচার হচ্ছে মানবাত্মার পরিপূর্ণ মুক্তির দিকে ক্রমাগত ও নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন ।
তমুদ্দুন বলতেও দুটি বুঝাবে। একটি হলো সুসভ্য হওয়ার পদ্ধতি আর দ্বিতীয়টি মানব সমাজের পূর্ণাঙ্গ ও উৎকর্ষপ্রাপ্ত রূপ। সংস্কৃতি আভ্যন্তরীণ ভাবধারার নাম আর তামাদ্দুন বা সভ্যতা হলো বাহ্য প্রকাশ ।
জীবনচর্চারই অন্য নাম সংস্কৃতি বলেছেন বদরুদ্দিন ওমর। মানুষের জীবিকা, তার আহার-বিহার, চলাফেরা, তার শোক-তাপ, আনন্দ-বেদনা, অভিব্যক্তি, তার শিক্ষা-সাহিত্য, ভাষা, তার দিন-রাত্রির হাজারো কাজকর্ম সব কিছুর মাধ্যমেই তার সংস্কৃতির পরিচয় ।
আবুল মনসুর আহমদের মতে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় রিফাইনমেন্ট, আরবিতে বলা হয় তাহযিব, সংস্কৃতি শব্দটা সেই অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে তিনি বলেন, কোনো সমাজ বা জাতির মনে কোনো এক ব্যাপারে একটা স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার বিধি মোটামুটি সর্বজনীন চরিত্র, ক্যারেক্টর, আচার-আচরণ বা আখলাকের রূপ ধারণ করলেই ঐ ব্যাপারে ঐ মানবগোষ্ঠীর কালচার বলা হয়ে থাকে ।
মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ভাষায় : ‘সমাজ সাধারণভাবে মানুষকে সৃষ্টি করে। মানুষ আবার নিজেকে গড়ে তোলে শিক্ষা-দীক্ষা ও সৌন্দর্য সাধনার সহায়তায়। এই যে নিজেকে বিশেষভাবে গড়ে তোলা এরই নাম কালচার। তাই কালচার্ড মানুষ স্বতন্ত্র সত্তা, আলাদা মানুষ। নিজের চিন্তা, নিজের ভাবনা, নিজের কল্পনা বিকাশ না ঘটে কালচার্ড হওয়া যায় না।’
একটি রাষ্ট্রের সব রকম নাগরিক মিলেই রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, ধর্ম ও ভাষার দিক দিয়ে না হলেও এখানে একই রাষ্ট্রে বাস করেও এক কালচার নাও হতে পারে। যেমন— বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কালচার। ভাষাগত ঐক্য থাকলেও ধর্মগত কালচারের পার্থক্য আছে, আবার ভৌগোলিক কারণেও কালচারের পার্থক্য হয়। কালচারের ধারক-বাহক হলো গ্রামাঞ্চল। গ্রামের মানুষের খাওয়া-পরা, চলাফেরা, আমোদ-আহ্লাদ, শোক-মাতম, আচার-ব্যবহার, পোশাক- পরিচ্ছদ এমনকি ভূত-প্রেতের গল্প বলার কাহিনী কিংবদন্তি। এই সব আবার সমাবেশের সমষ্টিই আমাদের জাতীয় কালচার। এই কালচার মূলত পল্লীর সম্পদ। অন্যদিকে শহরে-গ্রাম থেকেই মানুষ শহরে আসে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং বিদেশ থেকেও লোকজন আসে, তাদের আলাপ-আলোচনা, কথা-বার্তা, খাওয়া-পরা এক নয়, ভিন্ন। একসাথে বসবাস করে মানুষ ভালোটাই গ্রহণ করে থাকে। এই ভাবেই তাদের কালচার পরিশীলিত হয়, সংস্কার হয়। যে মন ও মস্তিষ্ক মানুষকে অন্যান্য জীবজন্তু হতে পৃথক করে সে মনের বিকাশের নাম কালচার, মস্তিষ্কের বিকাশের নাম সভ্যতা। তিনি বলেন, ‘সভ্যতাকে ভালবাসো, সৌন্দর্যকে ভালবাসো, ভালবাসাকে ভালবাসো। বিনা লাভের আশায় ভালবাসো, নিজের ক্ষতি স্বীকার করে ভালবাসো এরই নাম সংস্কৃতি। অনেকে সংস্কার মুক্তিকেই সংস্কৃতি মনে করে। উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পায় না ৷ কিন্তু তা সত্য নয়, সংস্কার মুক্তি সংস্কৃতির একটা শর্ত মাত্ৰ।
আবুল ফজল বলেন : ‘কালচার শব্দের ধাতুগত অর্থ কর্ষণ অর্থাৎ সোজা কথায় চাষ করা। জমি রীতিমত কর্ষিত না হলে যত ভালো বীজই বপন করা হোক না কেন তাতে ভালো ফসল কিছুতেই আশা করা যায় না। মন জিনিসটাও প্রায় জমির মতোই। মনের ফসল পেতে হলে তারও রীতিমতো কর্ষণের প্রয়োজন।’
ড. আহমদ শরীফের মতে : Culture বা সংস্কৃতি একটি পরিশ্রুত জীবন চেতনা। ব্যক্তিচিত্তেই এর উদ্ভব ও বিকাশ। এ কখনো সামগ্রিক বা সমবায় সৃষ্টি হতে পারে না। এজন্য দেশে কালে জাতে এর প্রসার আছে, কিন্তু বিকাশ নেই । অর্থাৎ এ জাতীয় কিংবা দেশীয় সম্পদ হতে পারে কিন্তু ফসল হবে ব্যক্তিমনের, কেননা সংস্কৃতি ও কাব্য, চিত্র ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মতো স্রষ্টার সৃষ্টি। কালচার সাধারণের সম্পদ ও ঐতিহ্য এবং পরিচিত হয় দেশীয় বা সংস্কৃতির নামে । যেমন, হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জীবন এবং বাণীর যে সংস্কৃতি প্রকাশ ঘটেছে তাই ইসলামি বা মুসলিম সংস্কৃতি বলে পরিচিত।’
ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা মওদূদী তাঁর ‘ইসলামিসংস্কৃতির মর্মকথা’ বইতে লিখেছেন, ‘সংস্কৃতি কাকে বলে তাই সর্বপ্রথম বিচার্য। লোকেরা মনে করে জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান, নিয়ম-নীতি, শিল্পকলা, ভাস্কর্য ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনী সামাজিক রীতি-নীতি, সভ্যতার ধরন-বৈশিষ্ট্য ও রাষ্ট্রনীতিই হলো সংস্কৃতি । কিন্তু আসলে এসব সংস্কৃতি নয়। এসব হচ্ছে সংস্কৃতির ফল প্রকাশ। এসব সংস্কৃতির মূল নয় সংস্কৃতি-বৃক্ষের পত্র-পল্লব মাত্র। এসব বাহ্যিক রূপ ও প্রদর্শনীমূলক পোশাক দেখে কোন সংস্কৃতির মূল্যায়ন করা যেতে পারে বটে, কিন্তু আসল জিনিস হলো এসবের অন্তর্নিহিত মৌল ভাবধারা, তার ভিত্তি ও মৌল নীতির সন্ধান করাই আমাদের কর্তব্য।’
এ, এস ইলিয়, এম, জেড, সিদ্দিকী ও মাওলানা মওদূদীর পূর্বোদ্ধৃত ব্যাখ্যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতি হচ্ছে চিন্তা ও মতাদর্শের পরিশুদ্ধি, পরিপক্বতা ও পারস্পরিক সংযোজন, যার কারণে মানুষের বাস্তব জীবন সর্বোত্তম ভিত্তিতে গড়ে উঠতে এবং পরিচালিত হতে পারে। ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুর রহীমের মতে, ‘মানব জীবনের দুইটি দিক। একটি বস্তুগত আর দ্বিতীয়টি আত্মিক বা প্রাণ। এই দুটি দিকেরই নিজস্ব কিছু দাবি-দাওয়া রয়েছে। মানুষ এই উভয় দাবি-দাওয়া পূরণে সব সময়ই ব্যস্ত থাকে। আত্মার দাবি আধ্যাত্মিকতার আকুল আবেদন। সে দাবি পরিতৃপ্তির জন্যে তার মন ও মগজে সর্বদাই চিন্তা ও ব্যতিব্যস্ত করতে থাকে। মানুষের বস্তুগত ও জৈবিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ব্যবস্থাপনার কাজ করে তার ধর্ম, শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন তার মনের ক্ষুধা মিটায়। বস্তুত যেসব উপায়-উপকরণ সূক্ষ্ম অনুভূতি ও আবেগময় ভাবধারা এবং মন ও আত্মার দাবি পূরণ করে তাই হচ্ছে সংস্কৃতি। নৃত্য, গীত, সঙ্গীত, কাব্য, ছবি আঁকা, প্রতিকৃতি নির্মাণ, সাহিত্য চর্চা, ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাস এবং দার্শনিকের চিন্তা-গবেষণা একটি জাতির সংস্কৃতির বাহ্যিক প্রকাশ মাধ্যম । মানুষ তার অন্তরের ডাকে সাড়া দিতে গিয়েই এইসব কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এইগুলো থেকে তৃপ্তি-আনন্দ-স্ফূর্তি ও প্রফুল্লতা লাভ করে। দার্শনিকের চিন্তা-গবেষণা, কবির রচিত কাব্য ও গান, সুরকারের সঙ্গীত এসবই মানুষের অন্তর্নিহিত ভাবধারাই প্রকাশ করে। এসব থেকে মানুষের মন তৃপ্তি পায়, আত্মার সন্তোষ ঘটে আর এই মূল্যমান ও আবেগ-উচ্ছ্বাসই জাতীয় সংস্কৃতির রূপায়ণ করে।’
আবুল মনসুর আহমদ পাকবাংলার কালচার বইতে লিখেছেন— ‘মানুষের আনন্দের ক্ষুধা পেটের ক্ষুধা ও যৌন ক্ষুধার মতোই তীব্র, সুস্থ ও স্বাভাবিক পথ নির্মাণ করতে না পারলে আনন্দের জন্য মানুষ পাপের পথে গিয়ে আনন্দ উপভোগ করবে। তার ওপর আবার পূর্বাদিতে মানুষের আনন্দ ক্ষুধার জোয়ার আসে। সেই সময় সাংস্কৃতিক আনন্দ অনুষ্ঠানের পিপাসা না মিটলে তৃপ্ত না হলে কু-পথে গিয়ে পিপাসা মেটাবেই ।
‘সংস্কৃতি মানব প্রকৃতির অন্তর্গত চাহিদা পরিতৃপ্তি ও চরিতার্থতারই ফসল। তা মানুষকে নিছক পশুর স্তর থেকে উন্নীত করে ভিন্নতর সত্তা দান করে। ফলে মানুষের নিতান্ত জৈবিক কামনা-বাসনা ও তার পরিতৃপ্তির ক্ষেত্র ও পরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।’
মানুষ নিম্ন শ্রেণীর পাশবিক গুণ-বৈশিষ্ট্য উৎকর্ষ ও উন্নয়ন লাভ করে উচ্চতর মানবীয় মূল্যমানে ভূষিত হয়। মহান স্রষ্টা তাকে বিবেক-বুদ্ধি এবং মন-মানস দিয়ে ধন্য করেছেন। যদিও মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও মননশক্তি, খোদার বিশেষ দান, না মানুষ নিজেরই চেষ্টা ও শ্রম-সাধনায় তা অর্জন করে নিয়েছেন। তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
বুদ্ধি-বিবেক, মন-মনন, চিন্তাশক্তি সবই ক্রমবিকাশের ফসল আর তা নিছক শ্রমলব্ধ ও অর্জিত গুণ বিশেষ।
পাশ্চাত্য দার্শনিক ডিউই বলেন: Culture means at least something cultivated something repened. It is opposed to the raw and crude অর্থাৎ সংস্কৃতি বলতে এমন কিছু বুঝায় যার অনুশীলন করা হয়েছে, যা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এ হচ্ছে অপরিণত ও অমার্জিতের পরিপন্থী ।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সংস্কৃতিকে দুইভাগ করে বলেন যে “দুনিয়াকে সর্বস্ব মনে করে মানুষ যে চিন্তা চেতনা লালন করে আসছে দুনিয়াকে ভোগ করার লক্ষ্যে, সে চিন্তা চেতনা প্রসূত সংস্কৃতিই অপসংস্কৃতি। অতএব সংস্কৃতিকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি প্রকৃত সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতি মানবতা, মানুষের বিকাশ বুঝায়। আর অন্যটি অপসংস্কৃতি যা মানুষের সমাজ পশুত্ব এবং বর্বরতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।
ড. ওসমান ফারুক বলেন, সংস্কৃতি বিভিন্ন সংজ্ঞা দেয়া হয়। এপার সংস্কৃতি ওপার সংস্কৃতি, পশ্চিমা সংস্কৃতি, পূর্বের সংস্কৃতি। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে সংস্কৃতির একটি সংজ্ঞাই থাকে তা হলো একটি এলাকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কিসে ঘটে সেটিই সে এলাকার সংস্কৃতি। আচার ব্যবহার ইত্যাদির প্রতিফলনই হলো সংস্কৃতি। আমরা যে গ্রামে বাস করি সে গ্রামের কৃষ্টি সকাল বেলার ফজরের আজান শুনে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে ক্ষেতে কাজ করতে বেরিয়ে যায়, এটিই আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ ।
একটি বিশেষ এলাকার মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং চিন্তাধারার যে প্রতিফলন সেটিই হচ্ছে সে দেশের সংস্কৃতি। নৈতিকতাবিহীন যে সংস্কৃতি মানুষের মনে মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারে না বরং মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটিয়ে দেয় সে সংস্কৃতি কখনো গ্রহণীয় সংস্কৃতি হতে পারে না। কাজেই মূল সত্তা বিবর্জিত সংস্কৃতি তা যেখান থেকেই আসুক না কেন সেটি কখনো আমাদের সংস্কৃতি হতে পারে না। তা কখনো কোনো সভ্য, সমাজের সংস্কৃতি হতে পারে না। যে সংস্কৃতি মানুষের সমাজে অশ্লীলতা এনে দেয়, মানুষের সমাজে সন্ত্রাস এনে দেয় সে সংস্কৃতি কোনো গ্রহণযোগ্য সংস্কৃতি নয়। ইসলামের মাঝে, যে মানবতাবোধ রয়েছে, ইসলামের মাঝে যে সহমর্মিতা রয়েছে, ইসলাম যে শিক্ষা দেয় সেগুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
ইসলামি সংস্কৃতি বা তমদ্দুন সম্পর্কে আলোচনা করে ড. হাসান জামান বলেন, “তমদ্দুন কথাটি আরবি মাদানুন” থেকে এসেছে মাদান্তন মানে শহর । শহরের বুকেই গড়ে উঠেছিল প্রথম সভ্যতা, গোড়া পত্তন হয়েছিল সংস্কৃতির এর ভেতরই হয়ত পাওয়া যাবে তমদ্দুন কথাটির সার্থকতা।
বাংলাভাষায় সাধারণত তমদ্দুন বলতে সংস্কৃতি কথাটা ব্যবহার করা হয় তমদ্দুন বা সংস্কৃতি দিকনির্দেশ করে।
সমাজবিজ্ঞানে কিন্তু আমরা মার্জিত রুচি আর মার্জিত রুচিহীনতার সংঙ্গে পরাস্তার পার্থক্য দেখিয়ে তমদ্দুনের সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করি না। কালচার আর আন-কালচার্ডের পার্থক্যই আমাদের সবার মাপকাঠি হয় না। ব্যাপক অর্থে- আমরা ব্যবহার করি তমদ্দুন কথাটা। তবে সবচাইতে বোয়া (Boas) ও টাইলর (Tulor) তার জেনারাল অ্যানথ্রোপলজি” (-General Anthreplogy-p-p-5)তে কালচার বা তমদ্দুনের সংজ্ঞাই ভেতরে উল্লেখ করেছেন ১. প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণ ২. অনুভূতিশীল মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও বিভিন্ন সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক ৩. মানসিক হাবভাব-ধর্ম নীতি সৌন্দৰ্য জ্ঞান, “তমদ্দুন” বলতে আমরা বুঝি সামাজিক প্রতিষ্ঠার যন্ত্রাদি প্রত্যয়। (ideas) ধর্ম পাশ্চাত্য অর্থে। নীতি আইন আচার ব্যবহার এসবেরই সমষ্টি। টাইলর তাঁর প্রিমিটিভ কালচার “এ তমদ্দুনের এই ধরনের সংজ্ঞা দিয়েছেন : Culture is that Complex which includes knowledge belief Art Moral law Custom and other capabilities and habits an acquaired by man as a member at society.
সংস্কৃতি সম্পর্কে হাসান আইউবী বলেন, আরবি ভাষায় ‘ছিকফুন’ অথবা ‘হুকফুন’ শব্দটি ‘লাযেম’ (অকর্মক্রিয়া) ও মুতাআন্দি (সকর্মক্রিয়া) উভয় এর পদেই ব্যবহৃত হয়। যখন ‘লাযেম’ অর্থে ব্যবহৃত হয় তখন অর্থ হয়- সে সভ্য বা সংস্কৃতিবান হয়েছে। আর যখন মুতায়ান্দি হয় তখন বলা হয়ে থাকে ‘ছাকক্কাফতোহু. অর্থ আমি তাকে সুসভ্য সংস্কৃতিবান বা সুসজ্জিত করেছি। আবার আরবি ‘ছাকাফত’ শব্দ নিম্নোক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয় যথা :
- দক্ষতা, নিপুণতা, কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা অর্থে, যেমন- ‘ছাকাফা ফুলানুন ছাকাফাতান’ অমুক ব্যক্তি খুব বুদ্ধিমান ও কুশলী হয়েছে।
- প্রভাবশালী, বিজয় অর্থে ‘ছাকাফাত’ ব্যবহৃত হয় ‘ছাকাফাতোহু ফি মাকানিন কাযা’ আমি অমুক স্থানে পেয়েছি। তার উপর বিজয় লাভ করেছি। “ইন ইয়াছ কাফুকুম ইয়াকুনো লাকুম’ যদি তারা তোমাদের উপর বিজয়ী হয় অথবা প্রাধান্য লাভ করে তবে অবশ্য তারা তোমাদের সাথে শত্রুতা করবে।
- ‘ছাকাফাত’ শব্দটি সোজা করে অথবা যোগ্যতা সৃষ্টি করা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয়ে থাকে- ‘ছাকিফতোর রূম্হা’ আমি বর্ণাকে সোহা করেছি, যাতে লক্ষ্য অর্জন করতে পারি। ‘ছাকাফাত’ শব্দটি যখন কোনো আচরণ বুঝাবার অর্থে ব্যবহৃত তখন তা আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে পরিভাষা ও পরোক্ষভাবে বিশেষ আচরণকে বুঝায়। আমরা বর্তমান পর্যায়ে ‘ছাকাফাত’ বলতে সুরুচি সম্পন্ন সংস্কৃতিবান, উৎকর্ষ সাধন এবং একটি সুষ্ঠু নৈতিক পদ্ধতি ও উন্নত মূল্যবোধের বুনিয়াদে সমাজ ও সভ্যতার পরিচালনাকে ‘ছাকাফাত’ বা সংস্কৃতি বলি। মানব চরিত্রে এক উন্নততর অবস্থা বা আচরণের নামই হচ্ছে— ‘ছাকাফাত’ বা সংস্কৃতি ।
প্রখ্যাত পন্ডিত আল্লামা ‘যমখশরী’ ‘আসাসআল বালাঘা’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘ছাকাফাত’ শব্দের পরিভাষাগত অর্থ হচ্ছে আদব-কায়দা শেখানো, সুসভ্য করে গড়ে তোলা। মানুষ বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হয়েও যদি উন্নত নৈতিক মূল্যবোধ হতে বঞ্চিত হয় তবে প্রকৃতপক্ষে তার আদৌ গুরুত্ব নেই ।
প্রকৃত সংস্কৃতি ও সভ্যতার তখনই উদ্ভব ঘটে যখন মানুষ দৃঢ় প্রত্যয় ও প্রস্তুতি সহকারে সভ্যতা গড়ে তোলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সামান্য শব্দগত পার্থক্য ছাড়া ‘ছাকাফাত’ শব্দের উপরোক্ত ব্যাখ্যা ও তাৎপর্যই “আলমুহিত” “আলক্বামুস” “মুখতারুস সিহাহ” ও “আসাস-আল বালাঘা” প্রভৃতি প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করা হয়েছে ।
যখন “ছাকাফাত” আভিধানিক ও পরিভাষাগত অর্থ সভ্যতা, সংস্কৃতি, নৈতিক উৎকর্ষ ও উন্নত প্রশিক্ষণ বুঝায় তখন এর প্রয়োগগত অর্থ এছাড়া আর কি হতে পারে? এ আর কিই বা তাৎপর্য হতে পারে? কোনো শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে মানুষের অনুভূতি ও চেতনাশক্তিই মূল উৎস হিসেবে কাজ করে । এর বিপরীত কখনও হয় না যে, শব্দই মানুষের অনুভূতি ও চেতনার উদ্ভব ঘটায়।
এ কারণেই একজন গ্রন্থকার, সাহিত্যিক ও প্রভাষকের সাফল্য এরই উপর যে তার রচনাশৈলী, চিন্তা, লেখা ও ভাষণে যখন সাধারণ গণমানুষের চিন্তা, কর্ম, আচরণ, অনুভূতি ও চেতনার পিরহান পরিধান করে সুশোভিত ও সুসজ্জিত হয়। তার প্রকাশিত ভাষা ও ছন্দে যখন সমাজের সাধারণ মানুষের পুঞ্জিভূত ও সঞ্চিত চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটে— তার কণ্ঠে যখন গণচেতনা ও অনুভূতির বিচ্ছুরণ ও সম্প্রসারণ পরিলক্ষিত হয়।