শিল্প নিয়ে গবেষকদের গবেষণার অন্ত নেই। তাত্ত্বিকগণ বিভিন্নভাবে শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সহজভাবে বলা যায় শিল্প হলো- আনন্দ, অথবা দুঃখ-বেদনার কোনো কিছু দেখা বা অনুধাবন করে মনে যে আবেগ অনুভূতির সৃষ্টি হয় তার নান্দনিক প্রকাশ। মহান আল্লাহ মানুষের উপকারের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আঠারো হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন বিনোদনের জন্যে সুন্দর নিসর্গ, পাহাড়, সাগর, ঝরনা, ফুল, ফল, নদী, অসংখ্য বৃক্ষরাজি। এই সৃষ্টি-সৌন্দর্য দেখে অথবা দুঃখজনক, বেদনার কিছু অনুধাবন করে হৃদয়-মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তার প্রকাশই হলো ‘শিল্প’। এ জন্য শিল্পীদের দেখা আর সাধারণ মানুষের দেখা এক নয়। সাধারণ মানুষ কোনো জিনিসের প্রতি যখন তাকান, সেটাকে বলা যেতে পারে শুধুমাত্র তাকানো । আর শিল্পীরা যখন তাকান তখন তা শুধুমাত্র তাকানোর নয়, তা অনুধাবন করে হৃদয়ঙ্গম করেন, হৃদয়ের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এবং শিল্পীদের থাকে আবেগপ্রবণ মন। যার মনে আবেগ যত বেশি, তার অনুধাবনক্ষমতা তত বেশি । আবেগহীন ব্যক্তি কোনো দিন শিল্পী হতে পারে না। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ পূর্ণিমার রাতে হঠাৎ ড্যাফোডিল ফুলের সৌন্দর্য দেখে, অনুধাবন করে আবেগপ্রবণ হয়ে তা শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করলেন, যা বিখ্যাত কবিতা ‘ড্যাফোডিল’।
শিল্পীদের হৃদয়ঙ্গম ক্ষমতা, ধারণ-অনুধাবনক্ষমতা অনেক তীব্র। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, যোগসাধন করতে হলে শুনেছি করতে হয় চোখ বন্ধ করে, কিন্তু শিল্প সাধনা অন্যরকম চোখকে সর্বদা খোলা রাখতে হয়, মনকে পিঞ্জর-খোলা পাখির ন্যায় মুক্তি দিতে হয়। তারা আকাশের ভাসমান মেঘমালার ভাষা বোঝেন, উত্তাল সাগরের তরঙ্গমালা অথবা শান্ত নদীর ঢেউ, পুবালি, দক্ষিণা হাওয়া, ঝিরিঝিরি বাতাসে গাছে সবুজ পত্র-পল্লবের কম্পন এ সবের ভাষা বুঝেন, তাদের মনের যে অপ্রকাশিত আকাঙ্ক্ষা অথবা হৃদয়ের গভীরের ক্রন্দন প্রকাশ করাই ‘শিল্প’।
প্রকাশের মাধ্যমের ভিন্নতার জন্যে শিল্পের ভিন্নতা হয়। যেমন রং রেখা, ফর্মের মাধ্যমে প্রকাশই চিত্রশিল্প। শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ কাব্য বা কবিতা, সুরের মাধ্যমে প্রকাশ গান, বা সুরশিল্প, অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ নৃত্যশিল্প, (বডিলেঙ্গুয়েজ) – ইমিটেশনের মাধ্যমে প্রকাশ নাট্যশিল্প এবং তার উদ্দেশ্য অভিন্ন। তবে শুধুমাত্র প্রকাশের ভিন্নতার জন্যে বিভিন্ন নামে পরিচিত।
শিল্প কী? এর উত্তর বিভিন্ন মনীষী ও আর্ট-ক্রিটিকগণ নানাভাবে দিয়েছেন। শিল্প সমালোচক দার্শনিকরা বিভিন্ন মতও প্রকাশ করেছেন। কারো কারো মতে শিল্প হচ্ছে অপ্রকাশিত রহস্যময় জীবনের প্রকাশ। বিখ্যাত মনীষী টলস্টয় বলেন, শিল্পীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রসূত অনুভূতি, রং, রেখা, বা শব্দের সাহায্যে অন্যের মনে সঞ্চারিত করাই শিল্পের উদ্দেশ্য। তার মতে শিল্পের উদ্দেশ্য শুধু অনুভূতির সঞ্চার।
শিল্পের উদ্ভব হয়েছে মানুষের সহজাত সৃজনশীল স্বভাব থেকেই। এর অন্যতম আমাদের জীবনে পূর্ণতা ও বিস্তৃতি যোগ করা। শিল্পকে বলা যেতে পারে আনন্দময় কোনো আকার বা রূপ সৃষ্টির চেষ্টা। কিন্তু শিল্পের উদ্দেশ্য সব সময় শুধুমাত্র আনন্দ দেয়া নয়। পৃথিবীর সব কিছুই শিল্পের উপকরণ হতে পারে, ধ্বনি, রং, মানুষ, গাছপালা, জীবজন্তু সব। মানুষ এই উপকরণ নিয়ে নিজের চাহিদা বা ইচ্ছামতো এমন একটি রূপ তৈরি করে যা তার বোধকে তৃপ্ত করে। এ জন্য সরলভাবে শিল্পকে বলতে পারি শিল্পীর কোনো অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার এক বিশেষ প্রকাশভঙ্গী যা আমাদের মনেও গভীরভাবে সংক্রমিত হয় বা আমরাও কোনোভাবে সেই অভিজ্ঞতার সংস্পর্শে আসি। অথবা বলা যায় শিল্প মানুষের কল্পনা, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার রূপ দান করার এক বিশেষ চেষ্টা । মানুষের সুকুমার বৃত্তির প্রতিফলন ।
শিল্প নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে যথার্থ শিল্পের স্বরূপ উদঘাটনের লক্ষ্যে। ভালো শিল্প, মন্দ শিল্প, সার্থক শিল্প, অসার্থক শিল্পের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে শিল্পী এবং দর্শকসমাজকে তারা প্রতিনিয়তই সচেতন করে চলেছেন। শিল্পের ফর্ম (Form), সৌন্দর্য (Beauty), অনুকরণ (Imitation), পরিপ্রেক্ষিত (Perspective), অনুপাত (Proportion), ঐকতান (Harmony), ভারসাম্য (Balance), ঐক্য (Unity) প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার মাধ্যমে প্রকৃত এবং সার্থক শিল্পের ব্যাখ্যাদানে এগিয়ে এসেছেন- প্লেটো, এরিস্টোটল, ক্রোচে, হেগেল, রমা রলা, অস্কার ওয়াইল্ড, অবনীন্দ্রনাথসহ বিশ্বখ্যাত অগণিত দার্শনিক এবং শিল্পতাত্ত্বিকগণ ।
দার্শনিক প্লেটোর মতে, আর্ট হচ্ছে অনুভূতির প্রকাশ, অনুকরণ নয়। যে অনুকরণে শিল্পীমনের স্পর্শ নেই তা যান্ত্রিক ব্যাপার মাত্র। অনুসৃত শিল্পকে মানুষ যখন নিজের মনের মতো করে মূর্ত করে তখনি সেটা আর্ট বা চিত্রকলা হয়ে ওঠে। সক্রেটিস বলেছেন- ‘আর্ট সত্য এবং বাস্তব থেকে আলাদা।’ সেন্ট অগাস্টিন বলেছেন— ‘আর্ট হচ্ছে আবিষ্কার বা অনুকরণ নয়।’ কান্ট বলেছেন- ‘শিল্পীর শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো সর্ববাধাহীন এবং যে কোনো বিশেষ জাগতিক উদ্দেশ্য বিরহিত।’ সুতরাং শিল্পতাত্ত্বিক অস্কারওয়াইল্ড এবং অন্য তাত্ত্বিকদের অভিমত অনুযায়ী সুস্পষ্ট যে, প্রকৃত শিল্পী কখনোই বাস্তবে দেখা বিষয়বস্তুর স্বরূপ বা হুবহু আঙ্গিকে ক্যানভাসে তুলে ধরেন না। যারা এ বিষয়ে ততটা সচেতন নন কিংবা আদৌ সচেতন নন তারা ততটা সার্থক কিংবা একেবারেই সার্থক শিল্পী নন। যারা এ বিষয়টি সম্পর্কে যত বেশি সচেতন, যারা এই নিয়মনীতি মেনে যত বেশি সার্থকরূপে শিল্প নির্মাণ করেন তারা তত বড় শিল্পী, তত বেশি সার্থক শিল্পী এবং তাদের সৃষ্ট শিল্প তত বেশি সার্থক এবং যথার্থ শিল্প । প্রকৃত শিল্প ।
অতএব আমরা বলতে পারি যে দৃশ্য-অদৃশ্যকে শিল্পীর চিত্তরসে রসায়িত করে বা স্থিতিশীল রূপ ও মহিমা দান করে তখনি সেটা শিল্পকর্ম হয় এবং যিনি এই সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন তাকেই শিল্পী বলে।
শিল্প সম্পর্কে শিল্পতাত্ত্বিক সৈয়দ আলী আহসান বলেন, ‘শিল্প হচ্ছে সময়, স্থান এবং অন্তরবোধের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের দৃষ্টিগ্রাহ্যতার একটি প্রতীক। শিল্পী যে দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখছেন, অবিকল সে দৃষ্টি আমার না থাকতে পারে কিন্তু আমি যদি অনুভব না করতে পারি শিল্পী কি দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখছেন, তাহলে শিল্পীর সৃষ্টিকে আমি প্রশংসা করতে পারবো না। এটা সম্ভবপর নয় । মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার দৃষ্টির বৈভব। আমাদের চোখ আছে, আমরা চেয়ে দেখি, কিন্তু জন্মসূত্রেই আমরা দৃষ্টিকে পাই না। যেমন জন্মসূত্রেই আমরা ভাষাকে পাই না। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সে ভাষার অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তেমনি সে দৃষ্টির অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে অর্থাৎ তার ভাষা প্রকাশের ক্ষমতা থাকে এবং দেখবার ক্ষমতা থাকে। কথা বলার ক্ষমতা নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করে এবং ক্রমান্বয়ে সে যখন বড় হয়, বিভিন্ন লোকের সংস্পর্শে আসে, মানুষের উচ্চারণ শোনে, সেগুলো অনুকরণ করে । ক্রমান্বয়ে বুদ্ধিবৃত্তি যখন তার সজীব হয় তখন সে যথার্থ যুক্তিসঙ্গতভাবে কথা বলতে শেখে। তেমনি দৃষ্টির ক্ষেত্রেও একথা সত্য। প্রথমে শিশু যা দেখে সে দেখার অর্থ হচ্ছে-বস্তুকে চিহ্নিতকরণ। এটা ক্রমশ প্রবল আকার ধারণ করে। শিশু প্রথমে তার মাকে চিনতে শেখে, যে একান্তভাবে তার ঘনিষ্ঠ, সে পিতাকে চিনতে শেখে এবং অবশেষে ক্রমান্বয়ে মাতার সঙ্গে অন্য মহিলার পার্থক্যও সে নির্ণয় করতে শেখে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সে যে মাকে চিনে ফেলেছে তা নয় কিন্তু ক্রমান্বয়ে ঐ দৃষ্টির অধিকারটা সে লাভ করতে থাকে। এভাবে দৃষ্টির অধিকার লাভ করে সে মানুষ দেখতে শেখে। অর্থাৎ পরবর্তী পর্যায়ে একজন যখন শিল্পী হবে, তখন শিল্পীকে মনে রাখতে হবে যে, শুধু দৃষ্টির অধিকার নিয়েই নয়, দেখার ক্ষমতা নিয়েই নয়, দেখার বস্তুকে নির্ণয় করা এবং অবশেষে যথার্থ দৃষ্টি দিয়ে দেখা, এটাই হলো শিল্পীর প্রধান কর্ম।’
শিল্প হচ্ছে দৃষ্টিগোচরতায় পৃথিবীকে অনুভব করার একটি আবেগময় কৌশল। এছাড়া আরও নানাবিধভাবে পৃথিবীকে অনুভব করা যায়। যেমন ভূতত্ত্বের সংজ্ঞায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাহায্যে, গাণিতিক বিবেচনায়, আপেক্ষিকতায়, কল্প-কাহিনী তৈরি করে অথবা দার্শনিক বিভাবনে বা চিন্তায় । কিন্তু শিল্প হচ্ছে ভিন্নতর একটি চৈতন্যভিত্তিক সিদ্ধি, দৃষ্টির সহায়তায় যাকে আমরা ব্যাখ্যা করি এবং দৃষ্টিগত তাৎপর্য যাকে আমরা মূর্তিমান করি। শিল্পী বিশেষ কৌশলে তাঁর দৃষ্টিনির্ভর অনুভূত সত্যকে রং ও রেখার সাহায্যে চিত্ররূপ দান করেন অথবা ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে মূর্তিময়তায় পর্যবসিত করেন। মানুষ যে কত চিত্ররূপে পৃথিবীতে দেখেছে তার প্রমাণ পাই শিল্পসত্তার বিকাশের ইতিহাসে। দৃষ্টিগত অনুভূতির যে কত বিচিত্র স্বরগ্রাম আছে, আছে বিচিত্র প্রয়াস, পৃথিবীর শিল্পসামগ্রী লক্ষ্য করলে তা প্রমাণিত হয়। বস্তুসত্তায় উপকরণ বা বাস্তবতা শিল্পীর লক্ষ্য নয়, শিল্পীর লক্ষ্য হচ্ছে বিশেষ অনুভূতি, যা প্রতিস্পন্দিত হয় তার শিল্পকর্মে।
হারবার্ট রিড শিল্পবোধের ক্ষেত্রে দুটো শব্দ ব্যবহার করেছেন। সে দুটো শব্দ হচ্ছে ‘পার্সেপশন (Perception) এবং ‘এক্সপ্রেশন’ (Expression)। দৃষ্টির ক্ষেত্রে এ দুটি শব্দের একান্ত প্রয়োজন। আমরা ‘পারসিভ’ করি একটি বস্তুকে, অর্থাৎ একটি বস্তুকে অনুভব করি। দেখার সঙ্গে সঙ্গে যদি তাকে অনুভব করতে না শিখি তাহলে আমি কিছুই দেখলাম না। সুতরাং আমি বস্তুকে দেখবো, বস্তুকে নির্ণয় করবো, বহু পাখি উড়ে যাচ্ছে দেখেন, বহু নদী দেখেন ও বাঁক দেখেন, নদীর স্রোতের উদ্যমতা দেখেন। কিন্তু সব কিছুকে তিনি প্রকাশ করেন না। হঠাৎ এর মধ্য থেকে তাকে নির্বাচন করতে হয়। এই যে চৈতন্য এই চৈতন্যকে ‘হারবার্ট রিড’ বলেছেন- ‘পার্সেপশন’। পার্সেপশন যে পর্যন্ত না আসছে একজন শিল্পীর মধ্যে সে পর্যন্ত কিন্তু ‘এক্সপ্রেশন’ যাকে বলা হচ্ছে, সে প্রকাশ করার ক্ষমতা তিনি পাচ্ছেন না। শুধুমাত্র নিয়মতান্ত্রিক রূপে ছবি আঁকা শিখলেই একজন যথার্থ শিল্পী হয়ে ওঠে না। যাকে আমি দৃষ্টির বৈভব বলছি, সেই দৃষ্টি বৈভব তাকে অর্জন করতে হয়। যথার্থ দৃষ্টির বৈভব অর্জন করলে পরে একজন শিল্পী যথার্থ রূপে শিল্পী হতে পারবেন। মানুষ যখন দেখে, তখন কিভাবে দেখে। এই দেখা নিয়ে বহু শিল্পী বহু সমালোচক বহু কথা বলেছেন । একটা দৃষ্টি আছে, তাকে বলা হয় ‘অপটিক্যাল’ দৃষ্টি। অর্থাৎ চোখের যে ক্ষমতাটুকু, সে ক্ষমতা নিয়ে যে বোধ, সেই অপটিক্যাল দৃষ্টি আমাদের সকলেরই আছে। আমি দেখছি, আপনি দেখছেন, দূরের একজন মানুষ দেখছে, সকলেই দেখছে। সেই অপটিক্যাল দৃষ্টি কিন্তু শিল্পীর দৃষ্টি নয়। শিল্পীর দৃষ্টি ভিন্নতর।
লিওনার্দো তার সূক্ষ্ম অনুভূতি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সব দিকেই এক অসীম সম্ভাবনাময় জগত; তাঁর দৃষ্টিতে বিরাজমান ছিল সর্বত্রই এক অপূর্ব সুন্দর, সূক্ষ্ম ও বিচিত্র ভুবন। নজরুলের এই কথাগুলোর সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে : ‘এই বৃহৎকে বুঝবার সাধনাই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা।’ মাঝে মাঝে চিন্তার জগতে মগ্ন থাকার তাৎপর্য সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ তাই আপনমনে বসে আছে কুসুম বনেতে।’ লিওনার্দোর চিন্তায় কিভাবে বিজ্ঞান ও অযৌক্তিকতা সহাবস্থান করে এবং পরস্পরকে অনুপ্রানিত ও শক্তিশালী করে। তাই এখানে অযৌক্তিকতার উল্লেখ কিঞ্চিৎ আশ্চর্যজনক, হয়ত এই ধরনের অযৌক্তিকতার কিছু যুক্তি রয়েছে। লিওনার্দোর অবস্থানের মৌলিকত্ব, যেটাতে চিত্রাঙ্কন একটি সমগ্র অথবা সর্বগুণান্বিত শিল্পকলার স্বরূপ কল্পনা করা যায় সেটার পরিণাম হয় এক ধরনের বস্তুনিষ্ঠতা, যা সাধিত হয় চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে। এটা একটি শিল্পকর্মকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় যেখানে সেটা নির্বোধ ধাঁধাঁ বা বোঝাসমূহ থেকে মুক্ত। এই অভিরাম অভ্যন্তরীণ বিতর্কের মাধ্যমে… শিল্পী ক্রমশ তাঁর সংবেদনশীলতা ও অনুভব শক্তিকে উঁচুস্তরে নিয়ে যেতে পারে; কোনো আবেগ প্রবলভাবে প্রকাশ করার জন্য নয়, যা সাধারণত স্থূলরুচি সম্পন্ন হয়, বরঞ্চ মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ সত্য প্রাণবন্তভাবে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে।’
লিওনার্দো প্রবল আবেগ প্রকাশ করতে পছন্দ করতেন না; অন্য শিল্পীদের মতো, যাদের কর্মে রয়েছে সংযম, পুসাঁ থেকে মাতিস পর্যন্ত। এই ধরনের প্রবল আবেগকে একটি ‘ভাবঘনিষ্ঠ সাধারণত্ব’র পরিণাম বলে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন যে এই ‘অভ্যন্তরীণ বিতর্ক’কে অভূতপূর্ব সুযোগ দেয়া উচিত। অর্থাৎ বিতর্ক ও চিন্তা অত পরিমাণ হওয়া উচিত না যে ছবি আঁকা সেটা থেকে বাধাগ্রস্ত হয়। এখানে উল্লেখ যে, লিওনার্দো বেশ কয়েকটি ছবি অসমাপ্ত রেখে যান।
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে মহান ও প্রভাবশালী স্বাধীন শিল্পী হলেন পিকাসো, যিনি (জর্জ ব্রাকের সাথে) ‘কিউবিজম্’ সৃষ্টি করেন। তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধ (SPANISH CIVIL WAR) দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন এবং ১৯৩৭ সালে তার বিখ্যাত ছবি গুয়ের্নিকা (GUERNICA) আঁকেন যেটাকে মহান ও পীড়াদায়ক রচনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে অবশেষে ফ্যাসিবাদিরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তৎকালীন একটি প্রদর্শনীতে, যেটাতে পিকাসো উপস্থিত ছিলেন, গুয়ের্নিকা ছবিটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় । ছবিতে স্পেনের গৃহযুদ্ধের নিষ্ঠুরতা প্রতিফলিত হয়েছে। পিকাসো ছবিটির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন যখন একজন সামরিক কর্মকর্তা দেখে পিকাসোকে জিজ্ঞেস করলেন: ‘ছবিটি আপনি করেছেন?’ জবাবে পিকাসো যা বলেছিলেন সেটা চিরস্মরণীয় হয়ে গেছে; ‘না, আপনি করেছেন।’ ছবিটি New York এর MUSEUM OF MODERN ART এ সংরক্ষিত রয়েছে। এই ঘটনাটি থেকে শিল্পীদের যে অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, সেটা প্রতীয়মান হয় ।
শিল্প নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সেই যে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০০ সাল থেকে ম্যাগডেলিয়ন মানুষদের অঙ্কিত গুহা গাত্রের চিত্র থেকে বিতর্কের শুরু হয়েছে আজও তার শেষ হয়নি। বিতর্কের মধ্য দিয়ে শিল্পের যত মত, পথ ও ধারার আবির্ভাব ঘটেছে বিতর্ক যেন ততই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। আর এমনিভাবেই বিভিন্ন দার্শনিক ও শিল্পতত্ত্ববিদদের বিভিন্ন মতবাদে পূর্ণ হয়ে গ্রন্থের পর গ্রন্থ আত্মপ্রকাশ করছে। ভারতীয় প্রাচীন শিল্পরীতিতে শিল্প শাস্ত্রকার পণ্ডিত যশোধর আবিষ্কৃত ‘ষড়ঙ্গ’-এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তখনকার দিনে এই ষড়ঙ্গকে ভারতীয় শিল্পের প্রাণ হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি বেঙ্গল স্কুলের প্রধান পুরুষ, তিনি এই ষড়ঙ্গকে অগ্রাহী করলেন। রূপভেদ, প্রমাণ, ভাব, লাবণ্যযোজন, সাদৃশ্য এবং বর্ণিকাভঙ্গ, ষড়ঙ্গ-এর এই ছয়টি বিষয়কে অবলম্বন করে শিল্পচর্চার যে প্রচলন ছিল তিনি তার বিরোধিতা করেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্পের জন্যে যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন, সেই স্বাধীনতার কথা পৃথিবীর সকল শিল্পবোদ্ধা পণ্ডিত এবং তাত্ত্বিকেরাও বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। প্রায় সকলেই শিল্পীর স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বলেছেন, শিল্পী কোনো বাধাধরা শাস্ত্রবিধি মানবেন না, কোনো কিছু দেখে অনুকরণ করবেন না, শিল্পী তার নির্ধারিত বিষয়কে অবলম্বন করে তাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে নান্দনিক রসসিক্ত শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষকে চমৎকৃত করবেন। নব নব সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীর শিল্পভাণ্ডারকে করবেন পরিপূর্ণ । এই সৃষ্টিধর্মী শিল্প সম্পর্কে তাই Plato বলেছেন- ‘The real artist does not imitate, he creates something now.’ Socretes বলেছেন- ‘Art is removed from the actuality something new.’ Sent. Augustine বলেছেন- ‘Art is invention not imitation.’ সুতরাং উল্লেখিত তথ্যসমূহে সুস্পষ্ট যে, প্রকৃত শিল্প হবে শিল্পীর সম্পূর্ণ নিজস্ব দৃষ্টি । দৃশ্যমান জগতের চেনা-জানা কোনো বিষয়ের হুবহু অনুকরণ নয়।
অধরার ও অদেখার পিছনে ছুটে চলেছেন শিল্পী। তাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, শিল্প হচ্ছে অতৃপ্ততা, একটা তৃষ্ণা অর্থাৎ খুঁজে বেড়ানো। শিল্পীর অন্তর্লোক উদ্ভাসিত হয় উৎসারিত হয় কল্পনায়। তবু সুন্দর ধরা দেয় না । আকাঙ্ক্ষিত পরম সুন্দরকে কখনই শিল্পী পূর্ণরূপে প্রত্যক্ষ করতে পারেন না। তাই শিল্পীর শিল্পও কখনো পূর্ণতা পায় না ।
তিনি বলেছেন, বর্তমান প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সমস্যা সত্ত্বেও কোনো শিল্পীরই নিজ দেশের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত নয়। উদাহরণ হিসেবে বলেছেন, যেমনটি হননি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ। তার মতে কামরুল হাসানের তিন কন্যা ছবিতে কিউবিজমের ভাঙচুর থাকলেও রঙ এবং মেয়েদের শরীরী আদল একেবারেই বাঙালি ।
বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী অরি-মাতিসের একটি শিল্পকর্ম আছে তার নাম রাজহাঁস। ছবিটিতে রাজহাঁস বলতে দুটো দুই এর মতো লাইন। বাস্তবে কোনো দর্শক যদি রাজহাঁস খোঁজেন তবে কিন্তু পাবেন না। তবে কি আমরা বলবো শিল্পী মাতিস রাজহাঁস আঁকতে জানেন না বলে শুধু দুটো রেখা এঁকেছেন? না এখানে রাজহাঁসের রাজকীয় ভাবটাই শুধু দুটো রেখায় একেঁছেন। এবং তা আঁকতে শিল্পী মাতিসের একাধারে তিন দিন সময় লেগেছে। প্রথমে রাজহাঁস সামনে রেখে তিনি ড্রইং করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্কেচ করেছেন, অনুশীলন করেছেন। অনুশীলন করে করে শেষ এসে দাঁড়ালো দুটো লাইন, যে লাইন দুটোতে রাজহাঁসের রাজকীয় ভাবটাই ফুটে উঠেছে। আর সেটি বিশ্ব বিখ্যাত শিল্প কর্ম হিসেবে স্বীকৃত। আর আমরা আগেই বলেছি, ছবি নকল নয়, বাস্তবে অনুকরণ নয়, ছবি হলো বাস্তব দেখে মনের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ।
ড. আব্দুস-এর ভাষায় শিল্প হলো অ-প্রকাশিত রহস্যময়তার প্রকাশ। আর এটাই হলো আবিষ্কার বা সৃষ্টি আর যেকোন সৃষ্টি মানেই আনন্দ।
শিল্পী দা-ভিঞ্চি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণ করেছেন যে, কবিতা এবং সঙ্গীতের চেয়ে চিত্রকলা অনেক বেশি উচ্চমান সম্পন্ন। তিনি বলেন, সঙ্গীতের চেয়ে চিত্রকলা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। তার মতে, একজন কবির চেয়ে একজন চিত্রশিল্পী প্রকৃতির যাবতীয় বিষয়বস্তুর ফর্মকে যথাযথভাবে চিত্রে তুলে ধরতে সক্ষম এবং এ কারণেই একজন চিত্রশিল্পীর সম্মান সবার চেয়ে উচ্চে। দা-ভিঞ্চি যে শুধু চিত্রকলা বিষয়েই দক্ষ ছিলেন তা নয়, তিনি অন্যান্য বিষয়েও ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী।
চিত্রকলা বিভিন্ন বিষয়কে যথাযথভাবে সূত্রবদ্ধ কিংবা প্রকাশ করতে সক্ষম, বিভিন্ন বিষয়ের গতি-প্রকৃতি, জীবজন্তুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন প্রক্রিয়া ও তার দ্রুত গতি প্রকাশ করে, চিত্রকলা গাণিতিক। কারণ চিত্রকলার আলোছায়া, অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ প্রভৃতির সঠিক মাপজোক এবং অনুপাত সঠিকভাবে নির্ধারণ করে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির রেখে যাওয়া পাণ্ডুলিপিই এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে। তিনি প্রায় ৫০০০ পৃষ্ঠার পুঁথিতে তাঁর মতবাদ ব্যক্ত করে গেছেন। যার এক স্থানে লিখেছেন যে, সূর্য স্থির। তার গতি নেই। অর্থাৎ কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওর বহু পূর্বেই তিনি এটা অনুমান করেছিলেন।
চিত্রকলা হচ্ছে গবেষণামূলক বিজ্ঞান, যা পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্নধর্মী পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর নির্ভরশীল। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এ সকল বিষয়ে শুধু অভিমতই ব্যক্ত করেননি, তিনি নিজে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন। মানুষের দেহের গঠন, অনুপাত ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক মাপজোকের প্রয়োজনে প্রায় ত্রিশটি মৃতদেহ নিজ হাতে কেটে-চিরে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেছেন।
শিল্প সম্পর্কে মতামতের অন্ত নেই। শিল্পী, সমালোচক, ঐতিহাসিক এবং দার্শনিকদের মতে শিল্প হচ্ছে : অপ্রকাশিত রহস্যময় জীবনের প্রকাশ। জীবন সম্পর্কে ব্যাখ্যা বা সমালোচনা, বস্তুর বাহ্যিক আনন্দ, একমাত্র বৈধ সর্বজনীন বা বিশ্বজনীন ধর্ম, নিছক খেলা, আদর্শবাদের বাহ্যিক রূপ বাধ্যবাধকতামুক্ত, অবাস্তবের আবিষ্কার (বাস্তব সুন্দর নয় এই অর্থে), নিজ অভিব্যক্তি, মানবতার প্রকাশ ইত্যাদি । শিল্পে মানবতা এবং শিল্পীমনের একান্ত অনুভূতির প্রকাশ শিল্পে-সাহিত্যে আমরা নানাভাবে মূর্ত হতে দেখেছি। এক্সপ্রেশনিজম বা প্রকাশবাদ হচ্ছে সকল শিল্পের মধ্যে হৃদয়ানুভূতি প্রকাশের একটি মৌলিক বিষয়। লুকে, গগিন, ভ্যানগগ এরা ইমপ্রেশনিজমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ তাদের হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটিয়েছেন। প্রকৃতিকে ইচ্ছে মতো গড়েছেন। এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের হৃদয়াবেগকে প্রকাশ করা এবং শিল্পকর্মে তা অন্তঃপ্রবিষ্ট করা। শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে মানবিক ধ্যান-ধারণা ও তার রীতি-পদ্ধতির সংমিশ্রণ ঘটেছে বহু পূর্ব থেকেই। মানবতাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত শিল্পী সচেতনভাবে তার হৃদয়ের মানবিক চেতনার বিভিন্ন দিকগুলো কাজে প্রক্ষিপ্ত করে থাকেন।
গ্রিক দার্শনিক এবং গণিতবেত্তা পিথাগোরাসের মতবাদ অনুযায়ী সঙ্গীত মানুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করে এবং মানসিক প্রশান্তি আনয়ন করে। চরিত্র সংশোধনেও মানবহৃদয়ে সুন্দর প্রভাব ফেলতে সাহায্য করে। পিথাগোরাসের পর দার্শনিক প্লেটো এই তত্ত্বের যথেষ্ট উন্নয়ন সাধন করেন, যা পরবর্তী পর্যায়ে ঈষৎ পরিবর্তনের মাধ্যমে দার্শনিক অ্যারিস্টটল গ্রহণ করেন। এরও পরে দার্শনিক স্টইক এ তত্ত্বের অনুসারী হন। তিনি অবশ্য কবিতার প্রতিও আগ্রহী ছিলেন এবং সৌন্দর্য বিষয়ক তত্ত্বের প্রতিও ছিলেন সমভাবে শ্রদ্ধাশীল। সর্বোচ্চ সত্যের বাহন হিসেবে, অপ্রস্তুত প্রশংসার দ্বারা মানবজীবনকে অলংকৃত করার বাসনায় তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কবিতা শিক্ষাদানের প্রতি জোর দিয়েছিলেন অথচ দার্শনিক এপিকিউরাস সঙ্গীতকে প্রশ্রয় দেননি, তিনি ছিলেন সঙ্গীতবিরোধী। তাঁর মতে, সঙ্গীত থেকে কিছু গ্রহণ করার নেই। সঙ্গীত যে সুখানুভূতি এবং প্রশাস্তিদানে সক্ষম তিনি তা বিশ্বাস করতেন না ।
ডোনাটেলো, মাইকেল এঞ্জলো এবং ভ্যানগগ- এরা সকলেই মানবতাবাদী শিল্পী। ভ্যানগগ বলতেন- ‘আমি আঁকতে চাই মানবতা, মানবতা আবার মানবতা।’ ১৯৪২-৪৩-এ সমগ্র বাংলাজুড়ে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তা ছিল মানুষেরই সৃষ্ট। এই দুর্ভিক্ষের কারণে মানবতার যে চরম অবমাননা জয়নুল লক্ষ্য করেছিলেন তার প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁর বলিষ্ঠ তুলি ও কালির মাধ্যমে। আমাদের সমাজের দুঃখ এবং ক্ষত চিহ্ন অবলোকন করে জয়নুল সে সমস্ত দুঃখ- বেদনা এবং প্রবঞ্চনার দহন থেকে মানবসত্তাকে মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধকে বাঁচাতে সদা তৎপর ছিলেন। তাঁর আজীবন প্রচেষ্টাই ছিল দেশ, সমাজ ও মানুষের কল্যাণের জন্য। তিনি এ দেশের মানুষকে, দেশকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তাঁর সংস্পর্শে এসে দেশের ছোট-বড় সকলে দেশকে, দেশের মানুষকে আপন করে নেয়ার গোপন মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
শিল্পশাস্ত্রে অনুকরণ বা ইমিটেশন বলে একটি কথা আছে। ইংরেজি ইমিটেশনের আভিধানিক অর্থ হলো অনুকৃতি, অনুক্রিয়া, অনুবর্তন, অনুকরণ, নকল, মেকি, কৃত্রিম প্রভৃতি। অর্থাৎ কোনো মূল বিষয়বস্তু নয়। মূল বিষয়বস্তুর অনুরূপ কিংবা হুবহু রূপ। যেমন অলঙ্কার পাওয়া যায় যার বাহ্যরূপ হুবহু স্বর্ণের মতো অথচ স্বর্ণের নয়। হুবহু রূপোর মতো অথচ রূপোর নয়। শিল্পকলার ক্ষেত্রেও একই কথা। কোনো কোনো চিত্র দেখতে হুবহু পিকাসোর চিত্রের অনুরূপ কিন্তু পিকাসোর নয়। হুবহু কামরুল হাসানের চিত্রের মতো অথচ কামরুল হাসানের নয়। অর্থাৎ এগুলো সবই নকল। নকল বা ইমিটেশন অলঙ্কারের যেমন কোনো মূল্য নেই, মূল্য নেই তেমনি নকল শিল্পকলার। এ সকল শিল্প বিষয়ের মূল্য যে একেবারে নেই, তা অবশ্য নয়। মূল্য আছে । তবে তা সোনার কিংবা রূপোর মূল্যের সমান নয়। কিংবা মূল চিত্রের সমান নয়। এ মূল্য নগণ্য। এ মূল্যের পার্থক্য মূল চিত্র এবং চিত্রের ছাপানো পোস্টারের মধ্যে সেই পার্থক্য। সুতরাং ইমিটেশনের মূল্য যে অতি নগণ্য সেটা স্পষ্ট।
জনৈক লেখক কিংবা সমালোচক, সব বিষয়ে একজন শিল্পীর সমানধৰ্মী হতে হয়। অর্থাৎ শিল্পনৈপুণ্য ও শিল্পকুশলতা এবং শিল্পবিষয় ও পদ্ধতি সম্পর্কে একজন শিল্পীকে তত্ত্বীয় বিষয়ে যেমন অভিজ্ঞ হতে হয়, তেমনি অভিজ্ঞ হতে হয় একজন লেখক কিংবা সমালোচককেও। অন্যথায় বিভ্রান্তি অনিবার্য। একজন লেখক সহজেই পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারেন তার ভুল তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে । বিভ্রান্ত যে শুধু পাঠকদেরই করেন তাই নয়, সাথে সাথে লেখক নিজের অজ্ঞতাকেও প্রকাশ করেন। একই সাথে সার্থক শিল্পী, শিল্প এবং শিল্পরসিক দর্শকদের মাঝে বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি করেন, যা শিল্পীর জন্যে, শিল্পের জন্যে এবং দেশের জন্যে ক্ষতিকর। লেখক ভুলে যান যে, বাস্তব ঘটনাপ্রবাহকে চিত্রে স্থান দেয়া শিল্পীর কাজ নয়। শিল্পীর কাজ তথা দায়িত্ব প্রকৃত বিষয়ের সারবস্তুর গূঢ়সত্তা আবিষ্কার করা এবং তার বিশেষ গুণগুলো ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে নিজস্ব অর্থপূর্ণ ফর্ম বা সিগনিফিকেন্ট ফর্ম সৃষ্টি করা। বাস্তবে ঘটে যাওয়া বিষয়ের অনুকরণে রচিত শিল্পকর্ম আর সেই ঘটনার ফটোগ্রাফিতে তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না। এই সহজ কথাটি শিল্পী যেমন ভুলে যান, তেমনি ভুলে যান লেখকও। ফলে শিল্প এবং সমালোচনা উভয়ই নিম্নমানসম্পন্ন হয়।
বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের প্রবক্তা শিল্পী জয়নুল আবেদিন বলেছেন, আমি ছবি আঁকি মহৎ শিল্পী হওয়ার জন্যে নয়, জীবনকে সুন্দর করার জন্য, জীবনকে সুন্দর করতে যে শক্তি বিরোধিতা করে তাকে চিহ্নিত করার জন্য । যে শিল্প জীবনকে সুন্দর করতে দিক-নির্দেশনা দেয় সেটাই মহৎ শিল্প। যে শিল্পী তা সৃষ্টি করেন তিনিই মহৎ শিল্পী
বস্তুত শিল্পের জন্য এ ধারণার পরিবর্তে শিল্প-জীবনের জন্য এ তথ্য এখন সাধারণভাবেই গৃহীত। শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও মনে করি শিল্প সত্যের জন্য, শিল্প সুন্দরের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য।
শিল্পীরা রূপবিলাসী রূপকার এবং রূপটাই আর্ট। মানুষ স্বভাবগতভাবেই সৃজনশীল।