দশম অঙ্কন :
ঋতি রায়, কলকাতা
২/১২/৮৭
এইচ ই সি অফিসার্স কলোনী
হাটিয়া, রাঁচী
প্রিয় ঋতি,
তোর পাঠানো প্যাকেটটি পেয়েছি । তেজেশ-এর চেনা এক ভদ্রলোক আগামী শনিবারের বেতলা যাবেন উইক-এন্ডে, তাঁর হাতে অরণ্যদেবের কাছে পাঠিয়ে দেবো বলে মনস্থ করেছি ।
তুই সত্যি পারিস! কথায় কথায় চিঠি লেখার অভ্যেস তোর এখনও অটুট আছে আর আমার তো এক লাইন লিখতেই গায়ে জ্বর আসে। তবে তোকে যখন লিখি, কিছু রেখে-ঢেকে ফর্ম্যালিটি করে লিখতে হয় না বলে মনেই হয় না যে চিঠি লিখছি ।
অশেষ থাকতে থাকতে যেতে পারলে সত্যিই মন্দ হতো না । ও আরও কতো বিদ্বান হতে চায় তা জানতে ইচ্ছে করে ! এবারে থিতু হতে বল তুই যে চিরকাল স্টেডি নাও থাকতে পারিস তা ওর এতোদিনে জানা উচিত । তোকে আমি অশেষের চেয়ে অনেকই বেশিদিন ধরে এবং অনেকই বেশি কাছ থেকে চিনি । তোর মতো চপলমতি-বালিকা বড় একটা দেখিনি । যদিও এই কথাটা তুই নিজে স্বীকার করিসনি কোনোদিনও ।
যাক্, যে খবরটা তোকে সবচেয়ে আগে দেওয়া উচিত ছিল সেটা ইচ্ছে করেই দেরিতে দিচ্ছি। আমাদের অরণ্যদেব কিন্তু একা। ফর ইওর ইনফরমেশন । তবে বনকুমারের কৌমার্য অটুট নেই। তা বলে ভাবিস না অরণ্যে কোনো নারী তার উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে । ঘটনা এই যে বছর দুয়েক আগে তার সঙ্গে নারীজাতির একটি নমুনার বিয়ে হয়েছিল । তিনমাস ঘরকন্না করার পর বনকুমারকে ছেড়ে সেই নগরদুহিতা চলে যান । পিতৃগৃহেই কি না তা সঠিক জানি না । তবে কলকাতায়ই । ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় । শুনেছি, ডিভোর্সও হয়ে গেছে ওদের একটি মেয়েও আছে। যার বয়স এখন পৌনে দু’বছর । অতএব বৎসা ঋতি, ভালো করে দেখেশুনে পা ফেলো। জঙ্গলে বেড়াতে যাবার একটি পার্মানেন্ট, নিখরচার আস্তানা জোটাবি ভেবেছিলি বেশ দাদা-ফাদা পাতিয়ে এবং তাঁর আনসাস্পেক্টিং স্ত্রী—মহিলাকেও (যদি তিনি থাকতেন) বৌদি পাতিয়ে কায়দা করবি।
যে অ্যাপারেন্টলি ইনোসেন্ট কিন্তু পোটেনসিয়ালি ডেঞ্জারাস পদক্ষেপ তুই নিচ্ছিলি তা একেবারেই বানচাল হয়ে গেল । দেখলি তো ! একেই একা পুরুষ যথেষ্ট বিপজ্জনক। তায় আবার অভিজ্ঞ হলে তো একেবারেই সোনায় সোহাগা। তোকে একন টাইট-রোপ ওয়াকিং করতে হবে। তোর হাতে আছে অশেষ । আর ঝোপে রাজর্ষি। সুকন্যা, মনে রেখো, ‘আ বার্ড ইন হ্যান্ড ইজ বেটার দ্যান টু ইন দ্যা বুশ’। হাতের পাখির দিকে নজর রেখো, তাকে নিয়মিত দানাপানি খাইও; নইলে বিপদ হতে পারে। হয়ে কায়দা করবি। আমি জানি, তুই অবশ্যই জানতে চাইবি এ চিঠির উত্তরেই যে এতো সব তথ্য আমি জানলাম কী করে রাঁচীতে বসেই ?
তোর কেতকীকে মনে আছে ঋতি ? গায়েপায়ে বড় বড় লোম ছিল । খুবই রোগা ছিল বলে মোটা দেখাবার জন্যে ক্যাটক্যাটে রঙা সব বিচ্ছিরী অথচ দামী শাড়ির নিচে চারটে করে পেটিকোট পরে আসতো কলেজে। ফলস্-কাপ্ লাগানো ব্রেসিয়ার পরতো ? মনে পড়েছে ? সেই কেতকীর স্বামী এখন রাঁচীতে। শুনেছি তিনি কোনো প্রাইভেট সেক্টর ফার্ম-এর হোমরা-চোমরা । কেতকীর একদা অস্থিসার কোমরে এবং মাংসহীন বক্ষদেশে রুখু পাহাড়ী নদীর বুকে হঠাৎ-নামা ঢল-এরই মতো যে কী প্রকার মাংসর ঢল নেমেছে তা না দেখলে তুই বিশ্বাসই করবি না। কাঁচা মাংস আর স্বামীর পারচেজ ডিপার্টমেন্টের কাঁচা টাকায় কেতকীকে এখন নদনদে শুয়োরীর মতো দেখায় । আমরা কলেজে যার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতাম না, স্বামীর পদমর্যাদার জোরে সে মেয়েরই এতোই দেমাক হয়েছে যে কী বলব তোকে ! অথচ নিজস্ব বলতে না আছে তেমন রূপ না আছে বলবার মতো কোনো গুণ । স্বামীর জন্যে শরীর এলিয়ে শোয়াকে যদি গুণ বলে না ধরিস। অবশ্য কেতকীর বাবার পয়সার জোর ছিল । এক একদিন এক একটা গাড়ি করে আসতো ।
জানিস, আমি এইসব নারীর উদাহরণ দেখি আর ভাবি যে একদিকে আমরা “উইমেনস্ লিব্” বলে চেঁচাবো আর অন্যদিকে স্বামীর পরিচয়ে স্ফীত হবো, হয়ে তার গ্রেট-ডেন কুকুর বা মার্সিডিস গাড়িরই মতো স্বামী-নিলয়ের শোভা বর্ধন করবো অথবা আক্ষরিকার্থেই তার ধারক ও সন্তানের বাহক হয়েই থাকবো এটা কেমন কথা ? “লিবারেশন” ব্যাপারটা অনেকই বড় ব্যাপার । নিজেদের কাছে নিজেরাই যতদিন না সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার যোগ্য করে তুলতে পারছি নিজেদের, বিবেকের কাছে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি ; ততদিন পুরুষ মানুষের মতো ধান্দাবাজ, ইতর, অত্যাচারী কোনো প্রাণী আমাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেবে এটা আশা করাই পরম মূর্খামি।
যাকগে কেতকীর কথা । উপযাচিত হয়েই দূত অথবা দূতী চিরদিনই অবধ্য । অর্থাৎ প্রণিধানযোগ্য নয় । এখন দূতী আমাদের অরণ্যদেবের কী সংবাদ আনলো তাই শোন্ । জানলাম, অরণ্যদেবের আগের স্ত্রীর নাম ছিল বনী । বন থেকে বনী । দারুণ নাম না ? বনে এসে টিয়াপাখির মতো রাজর্ষির বাংলো সে কাকলিমুখরও করে তুলেছিল । কিন্তু তারপরই তিনমাসের মাথাতেই ছাড়াছাড়ি। ছাড়াছাড়িটাও বেশ রহস্যজনক । তোর বিয়ে হলে তারপরই তুই জানতে পারবি যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যে কোথায় চাপ, কোথায় চিড়, কোথায় খিচ তা বাইরে থেকে বোঝা আদৌ সহজ নয় । এক বাড়িতে থেকেও বোঝা সম্ভব নয় অনেক সময় । তাই কারো দাম্পত্য সম্পর্ক সম্বন্ধেই অন্য লোকের মুখের কথা আমি বিশ্বাস করি না । দেখতে পাই যে ভেঙে যাওয়া বিয়ের বেলায় স্বামীর আত্মীয়রা চলে যাওয়া স্ত্রীর ওপরেই দোষ দেন আর স্ত্রীর আত্মীয়রা দেন স্বামীর ওপরে। স্বামীর আত্মীয়রা দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো সহজেই বলে বেড়ান যে স্ত্রী দুঃশ্চরিত্রা তাই…. যেহেতু চরিত্রই হচ্ছে মোস্ট ইনট্যানজিবল অফ অল ইনট্যানজিবল অ্যাসেটস তাই অখণ্ড কর্মহীন অবসরের বঙ্গভূমে চরিত্র হননের মতো অতো সোজা কাজ বোধহয় ছারপোকা নিধনও নয়। স্ত্রী-পুরুষ-যুবা-বৃদ্ধ সকলেই এই কাজে দারুণই দড়।
স্ত্রীর আত্মীয়রাও অম্লানবদনে বলে বেড়ান যে স্বামী “ইম্পো” বা “নিমরদ” । যদি সেই বদনামী পুরুষ কোনোদিন ঘুরে দাঁড়িয়ে এমন কোনো নারী রটনাকারীকে তার পৌরুষের সবল প্রমাণ দিতে প্রয়াসী হন তবে রটনাকারীর অবস্থা যে কী হতে পারে এটা কেউই একবারটি ভেবেও দেখেন না।
কেতকীর কথার দাম আমার কাছে বিশেষ নেই। তবে রাজর্ষি বসুর যে ডিভোর্স হয়ে গেছে এবং দু’বছর আগে তার স্ত্রী বনীর সঙ্গে তিনি যে মাত্র তিনটি মাস একসঙ্গে ছিলেন এই খবর রাঁচী এবং ডালটনগঞ্জের ওয়াকিবহাল মহিলা মহলের প্রায় সকলেই জানেন । কেতকীর খবরে ভেজাল নেই ।
তাই বলছি, আর যাই করিস প্রেমে পড়িস না রে পোড়ারমুখী ! তোর প্রেমে পড়ার ক্ষমতা এমনই অসীম যে টেবল-চেয়ার গাধা-গরু এমনকি যে কোনো পুরুষমানুষেরও প্রেমে তুই পড়তে পারিস অবহেলায় । সেই জন্যেই তোকে ভয় ।
আমরা তো আউট হয়ে গেছি । লম্বা ইনিংস খ্যাল । উইকেটের চারদিকে স্পারকলিং সব বাউন্ডারি মেরে খেল। অনেকক্ষণ উইকেটে থাক। এইই প্রার্থনা।
ভালো থাকিস। মাসীমা মেসোমশায়কে প্রণাম দিস।
—ইতি তোর শ্রুতি