দ্বাদশ অঙ্কন :
৩/১২/৮৭
বেতল
ঋতি, কল্যাণীয়াসু,
তোমাকে আরও দীর্ঘদিন “আপনির” চৌকাঠে দাঁড় করিয়ে রাখাটা সমীচীন মনে করলাম না।
একটি যুক্তিগ্রাহ্য সময়-সীমার মধ্যে ‘আপনিকে’ ‘তুমি’ না করতে পারলে পরে আর করা হয়ে ওঠে না।
আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক আছেন যাঁর স্ত্রী তাঁকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেন বিয়ের বারো বছর পরেও । এবং তাঁর স্ত্রীকে তিনি সম্বোধন করেন ‘তুই’ বলে । পাছে তুমি আমার হিতার্থী বন্ধু হিসেবে আজীবন আপনির বাধো বাধো ফ্রেমেই না আটকে থাকো তাই সময়মতোই তোমাকে তুমির ঘরে নামিয়ে আনলাম। যে-বাঘের বাচ্চাটির ছবি তোমাকে পাঠিয়েছি সেটি আমারই বাচ্চা । যদিও আমি তার জনক নই এবং তার মাও আমার স্ত্রী
নয় ৷
মানুষ হিসেবে, ঔরস এবং গর্ভ ছাড়াও অনেকই প্রাণের উন্মেষ ঘটাই আমরা ; ধারণ করি সযত্নে দীর্ঘদিন, প্রাণের প্রাণ । তার কিছু জাগতিক, কিছু মানসিক । সেই সুবাদেই বাচ্চাটি আমারই।
ওরা চিড়িয়াখানার প্রাণী নয় । মুক্ত, স্বাধীন । বাধাহীন ওদের জীবন। সবচেয়ে বড় কথা ঋতি, ওদের চারধারে কোনো অদৃশ্য মানসিক গরাদের ঘের পর্যন্ত নেই, যা আমার তোমার এবং সমস্ত মানুষেরই আছে। মানুষের মতো পরাধীন প্রাণী, সেদিক দিয়ে বিচার করলে, বোধহয় খুব কমই আছে ।
ঐ বাচ্চাটির বাঘিনী-মা অন্য বাঘের সঙ্গে মিলিত যেদিন হয়েছে বলে খবর পাই সেদিন থেকেই তার ওপর নজর রাখতাম । তারপর থেকেই তার রক্ষণাবেক্ষণ করতাম যতখানি সম্ভব। যৌথ পরিবারের বড় জা যেমন গর্ভিনী ছোট জায়ের জন্যে করে ।
বাচ্চারা আসার আগে যাতে তার অযথা কষ্ট না হয় সে জন্যে যে গুহাতে সে আস্তানা নিয়েছিলো তার কাছেকাছেই গরু-গাধাকে খাদ্য হিসেবে বেঁধে দিতাম । ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে যতদিন না বাচ্চারা বড় হয় ততদিনও ঐ ভাবেই খাবার দিতাম । দিনে রাতে চব্বিশ ঘণ্টা গুহার তিনদিকের উঁচুগাছে রাইফেল দিয়ে ফরেস্ট গার্ডদের বসিয়ে রেখেছিলাম যাতে বাঘিনীর সঙ্গী বাঘ এসে তার নিজেরই ঔরসজাত বাচ্চাদের খেয়ে না যায় । পুরুষ মানুষেরই মতো, সব প্রজাতির পুরুষরাই সাধারণত স্বার্থপর এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন হয় । বাঘের বেলাতেও তাই ভয় ছিলো ।
আমার এই বাচ্চাকে কোনোদিন কোলে নিতে পারিনি আমি । আদর করিনি । চুমুও খাইনি একটি বারও । যদিও ইচ্ছে ছিলো খুবই । তবু এদের জন্মমুহূর্ত থেকেই দূরবীন দিয়ে দেখেছি ওদের । আমার উৎসুক চোখের সামনে শশীকলার মতো বেড়ে উঠেছে এরা । বড় বড় কান নিয়ে ছোট-ছোট বাচ্চারা যখন কালো পাথরের গুহার সামনের খোলা চ্যাটালো পাথরে রোদের মধ্যে বসে থাকতো, এ ওর ঘাড়ে উল্টাতো পাল্টাতো তখন ভুলেই যেতাম যে ওরা আমারই জাতক নয় ।
তারপর ধীরে ধীরে ওরা আমারই চোখের সামনে আমার আংশিক রক্ষণাবেক্ষণেই বড় হয়ে উঠতে লাগলো ।
এখন ওরা মস্ত যুবক-যুবতী । এ বছরই গরমের সময় ওরা যার যার মনের মতো সঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হবে এ জঙ্গলেই। বা দূরের কোনো জঙ্গলে। কোনো দেওয়াল ওদের আটকাতে পারবে না । যেখানে খুশি সেখানে হেঁটে যায় ওরা প্রতি রাতে । প্রয়োজনে বিশ-তিরিশ মাইল ।
যে-বাচ্চাটির ছবি পাঠিয়েছি তোমাকে তাকে একবার একদল জংলী কুকুর তাড়া করে প্রায় ধরেই ফেলেছিলো। কীভাবে নিজের জীবন বিপন্ন করে আমি এবং আমার একজন ফরেস্ট গার্ড যে তাকে বাঁচিয়েছিলাম তা আমরাই জানি ।
জঙ্গলেই আমার বাস। জঙ্গলই আমার জীবন। তাই, ওরাই তো আমার সব ! ওকে আমার বাচ্চা বলে ভাবতে তোমার এতো আপত্তি কেন ? তাছাড়া এই সব বাচ্চারা মানুষের বাচ্চাদের চেয়ে অনেকই ভালো । ওদের মা-বাবাদের যেমন ওদের কাছ থেকে কোনো প্রত্যাশা নেই ; ওদের নেই বাবা-মায়ের কাছ থেকে কিছুমাত্রই। অবশ্য জন্মের পরের একটি সীমিত সময় পর্যন্ত নিজেরা শিকার ধরে খেতে না-শেখা পর্যন্ত ওরা মায়েরই মুখাপেক্ষী । বাবার নয় । তারপরেই ওরা স্বাধীন স্বরাট । বাবা-মা ভাই-বোন কারো সঙ্গেই ওদের সম্পর্ক থাকে না । আর থাকে না আত্মীয়তা-কুটুম্বিতাও। বোনের সঙ্গে ভাই সঙ্গম করে । বোনপোর সঙ্গে মাসী । একা আসে, একা যায়, পেটের খিদে জাগলেই শিকার করে খায়, মিলনের বাসনা হলেই সঙ্গী বা সঙ্গিনী খুঁজে দিন কয় সাধ মিটিয়ে মিলিত হয়ে আবার যে যার পথে হেঁটে যায় । নিজেদের একাকিত্ব বা স্বাধীনতা অন্য কাউকেই ওরা বাঁধা দেয় না চোঁখ বুজে । মনের কারবার করতে গিয়ে, রুচির, পছন্দ-অপছন্দের শিক্ষার অর্থনৈতিক অবস্থার তারতম্যে সর্বস্বহৃত হয়ে মানসিকতার চড়াই-উতরাইয়ে ওরা পথ হারায় না মানুষের মতো কোনোদিনও । “সংস্কৃতি” শব্দটার সঙ্গে ওদের পরিচয় পর্যন্ত নেই । “প্রেম” নামক কোনো রক্তক্ষয়ী বোধে ওরা ক্লিষ্ট হয় না কখনও। বিবাহ নামক চুক্তিবদ্ধ আনন্দ অথবা দুঃখের ঘরে তারা বাজি পুড়িয়ে, সানাই বাজিয়ে, লোক, খাইয়ে সাড়ম্বরে প্রবেশ করে না মাথা নিচু করে কোনোদিন মধ্যরাতে চোরের মতো সাড়া না তুলে বেরিয়েও যেতে হতে যে পারে তা জেনেও । ওদের জীবন রক্ত-মাংসর। কামড়াকামড়ির । অতি স্থূল । তাই বড় সহজ সুখের । সূক্ষ্মতা আর দুঃখ তো সমার্থক । মানুষদের বিশেষত শিক্ষিত মানুষদের নিজস্ব এই সব বিশেষ বালাই বাঘেদের আদৌ নেই। সমাজই নেই ওদের, তাই সমাজের পরোয়াও নেই। দারুণ এক একাকী স্বাধীন স্বয়ম্ভর জীবনের ভাগীদার ওরা প্রত্যেকে।
ওদের অতি কাছ থেকে দিনের পর দিন দেখে ওদের আমি সত্যিই ঈর্ষা করি ঋতি । মনে হয়, মানুষের মতো মানুষ না হতে পারলে বাঘ হওয়াও ভালো ছিলো । তাই মনে কোরো ও আমারই বাচ্চা । পুলওভার নাই বা বানালে ওর জন্যে। ছবিটি তোমার শোওয়ার ঘরের ড্রেসিং-টেবিলেই রেখে দিও। তোমার মিথ্যে অরণ্যদেবের স্মৃতি হিসেবে ।
বড় শীত পড়ে গেছে এখানে । এদিকে হাতির অত্যাচারও বেড়েছে গ্রামে গ্রামে । গরিব মানুষগুলোর বড়ই বিপদ । এখুনি বেরোতে হবে । সারা রাত এই ঠাণ্ডায় জীপে করে ঘুরতে হবে কেঁড় থেকে মারুমার। মুণ্ডু থেকে কুমাণ্ডি। কুমাণ্ডি থেকে লাত্ । কোনোদিন নেতারহাটের পথে বানারি পর্যন্ত । কোন্ দিন যে হাতি কোন্ গ্রামে হানা দেয় কে জানে ! শীতের রাতে চোরা শিকারিদের উপদ্রবও বাড়ে।
গতকালই বেলার কাছেই একটি চিতল হরিণকে মেরেছিলো শিকারিরা । দিনে দিনে ভারতবর্ষের সর্বত্র এই চোরা-শিকারিরা যেমন বেপরোয়া হয়ে উঠছে তাতে মনে হয় যে প্রত্যেক রাজ্যের বনবিভাগেরই অদূর ভবিষ্যতে নিজস্ব কম্যাণ্ডো বাহিনী রাখতে হবে । যে অগণ্য মন এবং অগম্য বন জয় করা যেতো শুধুই ভালোবাসা দিয়ে যদি তা নিঃস্বার্থ ও প্রকৃত ভালোবাসা হতো এবং যদি তা থাকতো দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম দিনটি থেকেই তাহলে হয়তো আজকে কথায় কথায় আমাদের কম্যাণ্ডো বাহিনী তলব করতে হতো না, সমস্ত ক্ষেত্রেই । সততাতে ভেজাল ঢুকে গেলে কোনো কম্যাণ্ডো বাহিনীরই সাধ্য নেই তা মেরামত করে।
মানুষের ওপরে, মানুষের সমাজের উপরে, মানুষের রাজনীতির উপরে ক্রমশই আস্থা হারিয়ে ফেলছি ঋতি । আমার দেশকে, দেশের মানুষকে ভালো না বাসলে অতি সহজে অন্যদের মতো সুখী হতে পারতাম। পারলাম না । পারি না । তাই তো বাঘের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা বলে পরিচয় দিতে গিয়ে শ্লাঘাতে বেঁকে যাই।
অশেষ কি হুস্টনে চলে গেছেন ? তোমার ফিয়াঁসেকে নিয়ে আমার কাছে চলে এলে না কেন দু-তিনদিনের জন্যেও ? পছন্দের মানুষের সঙ্গে অরণ্যে এলে সেই পছন্দর কাঁচা আমে পাক ধরে । প্রেম হয় । আর প্রেমিককে নিয়ে বনে এলে প্রেম পেকে টনটন করে । তার রঙ হয়ে ওঠে সিঁদুরে লাল । ফিরে গেলেই নির্ঘাৎ বিয়ে । আম খসে যায় টুক্ করে । এখনও আসতে পারো । শুধু পৌঁছে যাওয়াটাই দরকার। বাকিটা আমারই ওপর ছেড়ে দিও । পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবার আগে প্রকৃতি হয়তো অশেষকে ঐ সর্বনাশা পথ থেকে নিবৃত্তও করতে পারতো। পৃথিবী যদি বেঁচে যায় আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে তবে তাকে অরণ্য-প্রকৃতি আর মানুষের অন্তর প্রকৃতিই শুধুমাত্র বাঁচাতে পারে নইলে ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
ভালো থেকো।
ইতি—রাজর্ষি
ফিরে,
তোমার এম. এ. পাশের বছর থেকে ব্যাক ক্যালকুলেশান করে দেখলাম জ্ঞানে-বুদ্ধিতে বড় হলেও বা হতে পারো কিন্তু বয়সে তুমি আমার চেয়ে কমপক্ষে সাত-আট বছরের ছোটই হবে । পড়াশুনোতে বেশি মেধাবী হওয়ায় আরও কম বয়সে এম. এ. পাশ করে থাকলে আরও ছোটও হতে পারো । তাই “তুমি” । আশা করি এতে তোমার সম্রান্ততায় বা ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগবে না—র