হাতের কাছেই যাহা থাকে, যাহাকে লইয়া অহরহ কারবার করিতে হয়, তাহার যথার্থ মূল্য ও মর্যাদা সম্বন্ধে খুব একটা স্পষ্ট অনুভূতি আমাদের মধ্যে অনেক সময়েই দেখা যায় না । এই দেহটাকে মাটির উপর খাড়া ভাবে দাঁড় করাইয়া রাখা যে কতটা অচিন্তিত নৈপুণ্যের পরিচায়ক ও প্রতিমুহূর্তে তাহার পতনের সম্ভাবনাকে অক্লেশে এড়াইয়া চলায় গণিতের কত জটিল তর্ক যে পদে পদেই অতর্কিতে মীমাংসিত হইয়া যায়, তাহার বিস্তৃত হিসাব লইতে গেলে এ ব্যাপারের গুরুত্ববোধে হয়তো আমাদের চলাফেরার স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট হইবার সম্ভাবনা ঘটিত।
তেমনি, কতকগুলি কৃত্রিম অযৌক্তিক ধ্বনির সংযোগে কেমন করিয়া যে আমার মনের নাড়ীনক্ষত্র সমস্ত দশজনের কাছে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, তাহার সূত্রান্বেষণ করিতে গেলে মনে হইতে পারে যে এতবড় আজগুবি কাণ্ড বুঝি আর কিছু নাই । ‘গাধা’ শব্দটা উচ্চারণ করিবামাত্র দশজন লোকে কোনো চতুষ্পদবিশিষ্ট সহিষ্ণু জীবের কথা ভাবিতে লাগিল । নিমন্ত্রিতের পেটে যে ক্ষুধানল জ্বলিতেছে তাহা কেহ দেখে নাই ; কিন্তু সে ‘লুচি’ ‘লুচি’ বলিয়া বাতাসে একটা তরঙ্গ তুলিবামাত্র চক্রাকার ঘৃতপক্ষ দ্রব্য বিশেষ দেখিতে দেখিতে তাহার পাতে হাজির ! অথচ এ সকলের কোনো ন্যায়সঙ্গত সাক্ষাৎ কারণ দেখা যায় না ; কারণ নামের সঙ্গে নামীর সাদৃশ্য বা সম্পর্ক যে কোথায়, তাহা আজ পর্যন্ত কেহ নির্দেশ করিতে পারে নাই । সুতরাং বলিতে হয়, ভাষা জিনিসটা গোড়া হইতেই একটা কৃত্রিমতার কারবার । কিন্তু তাই বলিয়া ভাষার ব্যবহারে কেবা নিরস্ত থাকে।
সুবিধার খোঁজ করিতে গেলেই তাহার আনুষঙ্গিক দু-চারটা অসুবিধা স্বীকার করিতেই হয় । সুবিধার খাতিরে আজ একটা জিনিসকে স্বীকার করিয়া লইলে দুদিন বাদে সে কিছু না কিছু অন্যায় দাবি করিবেই । কার্যের সুব্যবস্থার জন্যই লোকে নানারূপ কার্যপ্রণালী ও নানারূপ নিয়মতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে । কিন্তু কার্যত অনেক সময়ে তাহার ফল দাঁড়ায় ঠিক উল্টা । যেটা উপলক্ষ থাকা দরকার সেইটাই একটা প্রধান লক্ষ্য হইয়া নূতন কতগুলি অসুবিধার কেন্দ্র হইয়া দাঁড়ায়। সমাজের এক-একটা বিধিব্যবস্থা মূলত সুযুক্তি-প্রতিষ্ঠিত হইলেও, কালক্রমে অন্যায় রকম ব্যাপকতা ও ঔদ্ধত্য লাভ করিয়া তাহারা কিরূপে পুরুষপরম্পরায় মানুষের সহজবুদ্ধির ঘাড়ে চাপিয়া বসে, আমাদের দেশে তাহার ব্যাখ্যা বা দৃষ্টান্তের আড়ম্বর নিষ্প্রয়োজন । যে কারণে মানুষ শাস্ত্রব্যবস্থার উদ্দেশ্যকে ছাড়িয়া তাহার অনুশাসন লইয়াই সন্তুষ্ট থাকে, ঠিক সেই কারণেই মানুষের চিন্তা আপনার উদ্দিষ্ট সার্থকতাকে ছাড়িয়া কতগুলি বাক্যের আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত থাকিতে চায়। এ অবস্থায় বাক্য যে মাথায় চড়িয়া বসিবে তাহাতে বিচিত্র কি ?
সব জিনিসেরই একটা সোজা পথ বা শর্টকাট খুঁজিবার চেষ্টা মানুষের একটা অস্থিমজ্জাগত দুর্বলতা । কোনো একটা চিন্তাধারার আদ্যোপান্ত অনুসরণরূপ দুরূহ কার্যকে সংক্ষেপে সারিবার জন্য আমরা মোটামুটি কতগুলি শ্রুতি বা আপ্তবাক্যের আশ্রয় লইয়া মনে করি ঐসকল তত্ত্বের সহিত যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা স্থাপিত হইল । ডারউইনের ইভোলিউশন থিওরি বা অভিব্যক্তিবাদ জিনিসটা যে কি, সেটা অনুসন্ধান করা আবশ্যক বোধ করি না। কিন্তু ইভোলিউশন বা অভিব্যক্তি কথাটাকে আমরা খুব বিজ্ঞের মত গ্রহণ করিয়া বসি, এবং আবশ্যক হইলে ও-বিষয়ে সাবধানে দু-চারটা মতামত যে ব্যক্ত করিতে না পারি এমন নয়।
কথায় বলে, “ঘোড়া দেখলে খোঁড়া হয় ।” ভাষারূপ বাহনটার খাতিরে চিন্তা যে কেমন করিয়া ‘পঙ্গুত্বলাভ করে তার দৃষ্টান্তের ছড়াছড়ি চারিদিকেই। যে-কোনো জটিল জিনিসকে কতগুলি পরিচিত নামের কোঠায় ফেলিয়া লোকে মনে করে বিষয়টার একটা নিষ্পত্তি করা গেল। ইংরিজি গীতাঞ্জলি পাঠ করিয়া একজন ইংরেজ আকাশ-পাতাল ভাবিয়া অস্থির যে এই লেখাগুলিকে তিনি কোন পর্যায়ভুক্ত করিয়া কি ভাবে দেখিবেন! পরে যখন তাঁহার খেয়াল হইল যে এগুলিকে মিস্টিক্ আইডিয়ালিজিম্ বা ঐরূপ একটা কিছু বলা যাইতে পারে তখন তাঁহার সমস্ত উৎকণ্ঠা দূর হইল এবং তিনি এমন একটা নিশ্চিন্ততার ভাব প্রকাশ করিলেন যেন তাঁহার আর কিছু বুঝিতে বাকি নাই ।
এক-একটা কথা আসে অতি নিরীহভাবে চিন্তার বাহনরূপে। কিন্তু চিন্তার আদর তো চিরকাল সমান থাকে না ; সুতরাং তাহার আসনচ্যুতি ঘটিতে কতক্ষণ ? বাহনটা কিন্তু অত সহজে হটিবার নয় ; সে তখন একাই চিন্তার ক্ষেত্রে দাপাদাপি করিয়া আসন জমাইয়া রাখে । ইহাকেই বলি ভাষার অত্যাচার । ভাষা ভাববাহন কার্যেই নিযুক্ত থাকুক ; সে আবার চিন্তার আসরে নামিয়া আপনার জের টানিতে থাকিবে কেন ? শঙ্করাচার্যের অদ্বৈততত্ত্বে ‘মায়া’ শব্দটার অর্থ কি, আমরা হয়তো কোনকালে ভুলিয়া বসিয়াছি কিন্তু ঐ ‘মায়া’ শব্দটা আমাদের ছাড়ে নাই । সংসারকে এইভাবে ‘কিছু নয়’ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত কি না, সে বিষয়ে আলোচনা করিবার সময় বাস্তবিক কি ভাবে কি করিতে বলা হইয়াছে সেকথা ভাবিবার অবসর হয় না। কতগুলি শব্দ শুনি যাহার অর্থ বা ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের চিন্তার যোগ অতি সামান্য অথচ আমাদের ধারণা এই যে কথাগুলির মধ্যে খুব এক-একটা গভীর চিন্তা নিহিত আছে। তাহার উপর এক-একটি শব্দ আবহমানকাল হইতে নিরঙ্কুশভাবে চলিত থাকিলে কালক্রমে তাহার মধ্যে স্বভাবতই এমন একটা চূড়ান্ত মীমাংসার ভড়ং প্রকাশ পায় যে শব্দের মোহে পড়িয়া আমরা কথাগুলিকেই নাড়াচাড়া করি আর মনে করি খুব একটা উচ্চচিন্তার আলোড়ন চলিতেছে । একটি প্রবীণ গোছের ভদ্রলোক কৃষ্ণলীলার সমর্থনের উদ্দেশ্যে তর্ক করিতেছিলেন । তাঁহার যুক্তি প্রণালীটা এইরূপ : সত্ত্ব রজ তম এই তিন-গুণাশ্রিত পুরুষ তিন রকম ভাবাপন্ন সুতরাং তিনের সাধনমার্গ ও অধিকারভেদ তিনপ্রকার। সুতরাং নিম্নস্তরের অবিদ্যাশ্রিত আদর্শের দ্বারা সাত্ত্বিকী-প্রকৃতির আশ্রয়ীভূত নিত্যমুক্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিচার করিলে চলিবে কেন !—ইত্যাদি । প্রতিপক্ষ বেচারা বাক্যজালে আবদ্ধ ও প্রত্যুত্তর দানে সম্পূর্ণ অক্ষম হইয়া ছটফট করিতে লাগিলেন । সগুণ-নির্গুণ পুরুষ প্রকৃতি প্রাণ কারণ শব্দব্রহ্ম হিরণ্যগর্ভ প্রভৃতি শব্দঘটার সাহায্যে নিজ-নিজ বক্তব্যের মধ্যে গাম্ভীর্য সঞ্চায়ের জন্য অনেকেই সচেষ্ট, কিন্তু শব্দের মধ্যে যে ভাবটুকু ছিল, সে কোনকালে খোলস ছাড়িয়া পলাইয়াছে কে তাহার খবর রাখে ? ঐ এক-একটা কথায় আমরা যে পরিমাণে অভ্যস্ত হইয়া পড়ি, তাহাকে যতবার এবং যতসহজে মুখস্থ বুলির মতো আওড়াইতে থাকি, চিন্তাও ততই প্রমাদ গণিয়া একপা-দুইপা করিয়া হটিতে থাকে। কে অত পরিশ্রম করিয়া লুপ্তচিন্তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ! শব্দের গায়ে চিন্তার ছাঁটছুট যাহা লাগিয়া থাকে তাহাই যথেষ্ট, বাকিটুকু তোমার রুচি ও কল্পনা অনুসারে পুরাইয়া লও। ছাতার নিচে চটি চলিতেছে দেখিয়া লোকে বুঝিত বিদ্যাসাগর চলিয়াছেন। আমরা দেখি ভাষার ছাতা আর চটি, জীবন্ত বিদ্যাসাগরকে আর দেখা হয় না ।
এক-একটা কথার ধুয়া আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তিকে আড়ষ্ট করিয়া দেয় । মানুষের যে কোনো আচার-অনুষ্ঠান চালচলন বা চিন্তা-ভঙ্গীর প্রতি কটাক্ষ করিয়া লোকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কি সনাতন ধর্মবিধিকে উড়াইয়া দিতে চাও ?” এবং সনাতন ধর্মের নজীরকে অর্থাৎ ঐ “সনাতন” শব্দটার নজীরকে এমন অকাট্যভাবে মনের সম্মুখে দাঁড় করায়, যেন ইহার উপর আর কথা বলা চলে না । তখন যাহা কিছু যথেষ্ট জীর্ণ ও পুরাতন তাহাই আমাদের কাছে সনাতনত্বের দাবী করে এবং আমাদের কল্পনায় সনাতনধর্ম জিনিসটা যে কোনো বিধি নিয়ম আচার অনুষ্ঠানাদির সমারোহ সজারুবৎ কন্টকাকীর্ণ হইয়া ওঠে । কারণ, এই সকল শোনা কথায় আমরা এতই অভ্যস্ত যে ইহাদের এক-একটা মনগড়া অর্থ আমাদের কাছে আপনা হইতেই দাঁড়াইয়া গিয়াছে। সেটাকে আবার ঘাঁটাইয়া দেখা আবশ্যক বোধ করি না। শাস্ত্রে ‘ত্যাগ’ বলিতে কি-কি ছাড়িতে উপদেশ দেয় তাহা বুঝি আর নাই বুঝি আমরা ঐ ত্যাগ শব্দটার সঙ্গে ছাড়ার সংস্কারটুকুকে ধরিয়া রাখি । অমুক সংসার ছাড়িয়া পলাইয়াছেন, তিনি ত্যাগী ; অমুক এত টাকা দান করিয়াছেন, তিনি ত্যাগী ; অমুক এই অনুষ্ঠানে শক্তি ও সময় নষ্ট করিয়াছেন, তিনিও ত্যাগী। কর্মফলাসক্তি কিছুমাত্র কমিল না, দেহাত্মবুদ্ধির জড় সংস্কার ঘুচিল না, প্রভুত্বের অভিমান ও অহঙ্কার গেল না ; অথচ শাস্ত্রবাক্যেরই দোহাই দিয়া ‘ত্যাগের মাহাত্ম্য’ প্রমাণিত হইল । এইজন্য এক-একটা কথা-সংশ্লিষ্ট চিন্তাকে মাঝে মাঝে আঘাত দিয়া জাগাইয়া দিতে হয় । কারণ, চিন্তা সে নিজগুণে যতই বড় হউক না কেন, আর দশজনের মনে নিত্য নূতন খোরাক না পাইলে তাহার ক্ষয় অনিবার্য । ‘জাতীয়ভাব’ ‘ভারতীয় বিশেষত্ব’ ‘হিন্দুত্বের ছাঁচ’ প্রভৃতি নাম দিয়া আজকাল যে জিনিসটাকে আমরা শিল্পে সাহিত্যে অশনে বসনে প্রয়োগ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছি, তাহার স্বরূপলক্ষণাদির বিষয়ে আমাদের ধারণা যতই অস্পষ্ট হউক না কেন, তাহাতে ঐ-ঐ শব্দনির্দিষ্ট বিষয়গুলির প্রতি আমাদের আস্থা ও সম্ভ্রমের কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হয় না। সেটা হয়তো ভালোই, কিন্তু দশদিক হইতে যথেষ্ট মাত্রায়, অথবা যথার্থভাবে আঘাত না খাওয়ায় জিনিসটা যে ভাবে গড়িয়া উঠিতেছে, তাহাতে বোধহয় যে ঐ শব্দগুলিকে একবার বিশেষ রকমে ঘাঁটাইয়া দেখা আবশ্যক ।
আমার চিন্তাকে কতগুলি শব্দের ঘাড়ে চাপাইয়া দিলাম বলিয়াই নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি না । সে চিন্তাতরঙ্গের ভবিষ্যৎ ইতিহাস তাহাতেই আমার অজ্ঞাতসারে কতকগুলি শব্দের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত হইয়া পড়ে । শব্দের অর্থ তো চিরকাল একভাবে থাকে না, পরে একসময়ে হয়তো এক-একটা শব্দের অর্থ লইয়াই মারামারি বাধিয়া যাইবে, আমার চিন্তার সদগতি হওয়া তো দূরের কথা । ঋগবেদের একটি ঋকের অর্থ রমেশবাবু প্রভৃতি এইরূপ করেন—
“বৃষ্টিজল শব্দ করিয়া পড়িল এবং (মেঘ বায়ু ও কিরণ) এই তিনের যোগে গাভীরূপী পৃথিবী বিশ্বরূপী (অর্থাৎ শস্যাচ্ছাদিত) হইল”—ইত্যাদি ।
পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী মহাশয়ের মতে ইহারই অর্থ–
“পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতেছে, সূর্যশক্তি এই ঘুরানকার্যে নিযুক্ত আছেন । এই শক্তিসকলের মধ্যস্থলে গর্ভদেবতা অটলভাবে স্থির রহিয়াছেন” – ইত্যাদি । [ আমাদের জ্যোতিষী ও জ্যোতিষ”] এখানে এক-একটি শব্দের অর্থবাহুল্যই এইরূপ ব্যাখ্যা বিপর্যয় ঘটাইয়াছে । আবার, পুরাণাদি বর্ণিত রূপগুলিকে নিংড়াইয়া বৈজ্ঞানিকতত্ত্ব নিষ্কাশনের চেষ্টায় যে ইহা অপেক্ষাও গুরুতর অর্থবিভ্রাট ঘটিয়া থাকে, তাহা সকলেই জানেন । একই কথার অর্থ তোমার-আমার কাছে একরকম আর অন্য দশজনের কাছে অন্যরকম, এরূপ ঘটিলে ভাষার উদ্দেশ্যই পণ্ড হইয়া যায়। তত্ত্ব জিনিসটা যখন কবিত্বের খাতিরে রূপকের মধ্যে একেবারে হাত পা গুটাইয়া বসে, অথবা সে যখন ‘হিং টিং ছটের’ আকার ধারণ করে, তখন ভবিষ্যদ্বংশের কল্পনায় সে অতি সহজেই কাব্য বা ইতিহাস বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যাহা ইচ্ছা তাহাই হইয়া দাঁড়ায় ।
একে তো ভাষার অর্থভেদ সর্বদাই ঘটিতেছে তাহার উপর নিজের পছন্দমতো অর্থ বাহির করিবার দিকে মানুষের স্বভাবতই একটু আধটু নজর থাকে । ইহার মধ্যে আবার যদি ইচ্ছাপূর্বক বা স্পষ্টই খানিকটা ভুল বুঝিবার সম্ভাবনা রাখিয়া দেওয়া হয়, তবে মানুষের বুদ্ধি এ অনর্থ ঘটাইবার সুযোগ ছাড়িবে কেন ? সেকালে রোমীয় ধর্মশাসনের বিধি অনুসারে অবিশ্বাসী ধর্মদ্রোহীর জন্য এই মর্মে একটা ব্যবস্থা দেওয়া হইত, “ইহাকে আঘাত করিও না, কিন্তু বিনা রক্তপাতে ইহার দুর্মতির প্রতিবিধান কর ।” এ কথাটার অর্থ করা হইত “এ ব্যক্তিকে পোড়াইয়া মার !” এইরূপে অশ্বত্থামার নিধনসংবাদে ‘ইতিগজ’ সংযোগের ন্যায়, ব্যক্তভাষায় অব্যক্ত অভিপ্রায়ের স্বগত উক্তিটা ভাষার অর্থকে যে কখন কোনমুখে ফিরাইয়া দেয় তাহা অনেক সময়ে নির্ণয় করা কঠিন।
ভাষা যে কেবল চিন্তাকে বিপথে ঘোরাইয়া বা তাহার আসন দখল করিয়াই ক্ষান্ত হয়, তাহা নহে ; সে এক-এক সময়ে উদ্যোগী হইয়া আমাদের অজ্ঞতার উপর পাণ্ডিত্যের রঙ ফলাইতে থাকে । নিতান্ত সামান্য বিষয়েরও প্রকাণ্ড সংজ্ঞানির্দেশ করিয়া, অথবা যাহার সম্বন্ধে কিছুই জানি না তাহারও একটা নামকরণ করিয়া, আমাদের বিজ্ঞতার ঠাট বজায় রাখে এবং আমাদের পাণ্ডিত্যের অভিমানকে নানারূপ ছেলেভুলানো কথার সাহায্যে আশ্চর্য রকমে জাগাইয়া রাখে। একটা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো একটা জিনিস হয়তো আপাতদৃষ্টিতে সাক্ষীগোপালের কাজ করে মাত্র, অথচ তাহার উপস্থিতিটা কেন যে সেই ক্রিয়া নিষ্পত্তির সহায়তা করে, বৈজ্ঞানিক তাহার কারণ খুঁজিয়া পান না । কিন্তু বৈজ্ঞানিক ছাত্র যখন এই ব্যাপারটাকে ‘ক্যাটালিটিক একশন্’ নাম দিয়া ব্যাখ্যা করে তখন সে হয়তো মনেই করে না যে এখানে ঐ শব্দটার আড়ালেই একটা প্রকাণ্ড, অজ্ঞতার ফাঁক রহিয়াছে । আফিং খাইলে ঘুম আসে কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে মানুষ এক সময়ে সোমনিফেরাস্ প্রিন্সিপলস্ বা নিদ্রোৎপাদিকা শক্তির কল্পনা করিয়াই নিশ্চিন্ত থাকিত কিন্তু নিদ্রোৎপাদিকা শক্তির গুণে নিদ্রা আসে এ ব্যাখ্যা আর এখনকার যুগে ব্যাখ্যা বলিয়া গ্রাহ্য হয় না; কারণ কেবল ভাষার উলট-পালটে যে যুক্তির প্রতিষ্ঠা: হয় না, এ তত্ত্বটা এ ক্ষেত্রে নিতান্তই স্পষ্ট দেখিতে পাই । কিন্তু সৃষ্টিরহস্যের মূলে ‘মায়া’ বা ‘অবিদ্যার’ কল্পনা ঠিক এই শ্রেণীভুক্ত না হইলেও উহা যে আদৌ একটা ব্যাখ্যা বা মীমাংসা নয়, মূল প্রশ্নেরই স্পষ্টতর পুনরুক্তি মাত্র এবং এই নামকরণে যে কেবল আমাদের চিন্তার পরাজয়কেই স্বীকার করা হয়, একথা অনেকেই ভাবিয়া দেখেন না। বিজ্ঞানের এক-একটি সিদ্ধান্ত বা ‘ল’ আওড়াইয়া আমরা মনে করি খুব একটা কার্যকারণ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হইল । অমুক কাজটা অমুক ‘ল’ অনুসারে সম্পন্ন হইল; ‘এ্যকর্ডিং টু নিউটন’স্ থার্ড ল অফ মোশন’, নিউটনের গতিবিষয়ক তৃতীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সমান হইল । বলা বাহুল্য আইনটার খাতিরে কাজটা নিষ্পন্ন হয় না । কার্যতঃ, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার তুল্যতা দেখা যায় বা এরূপ হওয়াই স্বাভাবিক । ‘অমুক সিদ্ধান্ত অনুসারে হয়’ বলায় নূতন কিছুই বলা হইল না, কেবল সিদ্ধান্তকে তত্ত্বের সঙ্গে মিলাইয়া দেখা গেল । তেমনি, আলোকতত্ত্বের বর্ণনায় ‘ট্রান্সভারস্ ভাইব্রেসনস্ অফ দি লিউমিনিফেরাস্ ইথার’ বলায় চিত্তের চমক লাগিতে পারে ; কিন্তু তাহাতে যে আমার আলোকচৈতন্যের কোনোরূপ মীমাংসা হয় না, এ কথাটা শিক্ষিত লোকেও অনেক সময়ে ভুলিয়া যায়।
ভাষার একটা বিশেষ সুবিধা ও অসুবিধা এই যে, চিন্তার আদ্যোপান্ত ইতিহাস বহন করিতে সে বাধ্য নয়। বড়-বড় তত্ত্বগুলিকে সে এক-একটা সংক্ষিপ্ত নাম বা সূত্রের আকারে ধরিয়া রাখিতে পারে । জ্যামিতিতে বিন্দু কল্পনার আবশ্যক হইলে, প্রত্যেকবার বলিতে হয় না যে- “ এমন একটি অতিক্ষুদ্র দেশাংশ গ্রহণ কর যাহার আয়তন কল্পনা সম্ভব নয় কিন্তু অবস্থান নির্দিষ্ট হইতে পারে।” বিন্দু শব্দটার উল্লেখ করিলেই এই সকল চিন্তার ছায়া মনের মধ্যে আপনা হইতেই জাগিয়া উঠে । সেইরূপ অনেক জটিল তত্ত্ব আছে যাহাকে গোটাতত্ত্বের আকারে প্রত্যেকবার আওড়ানো চলে না । অথচ তাহাকে সংক্ষেপে দু-চারিটা কথায় সারিতে গেলেও বিপদের সম্ভাবনা। বিশেষতঃ, আত্মতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে এক-একটা কথার সঙ্গে মানুষের সঙ্গত অসঙ্গত নানাপ্রকার সংস্কার এমনভাবে জড়িত থাকে যে এক-একটা শব্দ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে-সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের অলক্ষিতে এক-একটা ব্যক্তিগত সংস্কারের প্রতিষ্ঠা করা হয় । ধর্ম বলিতে, আত্মা বলিতে, হাজার লোকে হাজার রকম অর্থ করে, অথচ এই কথাগুলি লইয়া লোকে এমনভাবে মারামারি করে যেন অর্থ সম্বন্ধে আর কোনো মতান্তর নাই।
এক ইংরেজ ভদ্রলোক বাইবেলের একটু উক্তি তুলিয়া বলিতেছিলেন, “ তোমরা তো বিশ্বাস কর যে এই সংসারটা কেবল ‘ফ্লেক্স’ নয়, জড়ের ব্যাপার নয়, ইহার মধ্যে স্পিরিট আছে।” আমি অতর্কিতে কথাটাকে স্বীকার করায় তিনি ভারি খুশি হইয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, তোমরা ওরিয়েন্টাল (প্রাচ্য) লোক কিনা, তোমাদের অন্তর্দৃষ্টি আছে। তোমাদের পক্ষে প্রেততত্ত্বে বিশ্বাস করা খুব স্বাভাবিক ।” তখন বুঝিলাম তিনি স্পিরিট বলিতে ভূতপ্রেত ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না।
জগতের কাছে দাঁড়াইতে গেলে চিন্তামাত্রকেই কতগুলি শব্দকে বিশেষভাবে আশ্রয় করিয়া দাঁড়াইতে হয় । কোনো-কোনো স্থলে এই যোগটা এত ঘনিষ্ঠ হইয়া দাঁড়ায় যে শব্দটাকে বাদ দিয়া চিন্তাটাকে ব্যক্ত করা দুঃসাধ্য হইয়া পড়ে। বৈষ্ণবতত্ত্বের আলোচনা করিতে গেলেই লীলা রস ভক্তি ভক্ত ভগবান প্রভৃতি কতগুলি শব্দকে একেবারেই বাদ দেওয়া চলে না । পাশ্চাত্য ক্রমবিকাশতত্ত্বের আলোচনা করিতে গেলেই হেরিডিটি, ভেরিয়েশন, স্ট্রাগল ফর এক্সিটেস্, ন্যাচারাল সিলেকশন, (উত্তরাধিকার, পরিবর্ত, জীবন-সংগ্রাম, যৌননির্বাচন) প্রভৃতি কথাগুলি অপরিহার্যরূপে আসিয়া পড়ে । কথাগুলিকে না বুঝিয়া গ্রহণ করায় তো বিপদ আছেই, বুঝিয়া গ্রহণ করিলেই যে বিপদ একেবারে কাটিয়া যায় তাহাও নহে। মনের এক-একটি চিন্তাকে কতগুলি শব্দের আটঘাটের মধ্যে বাঁধিয়া দিলে সে চিন্তার পথ ভবিষ্যৎ যাত্রীর পক্ষে অনেকটা সুগম হইতে পারে; কিন্তু চিন্তাটাও ক্রমে প্রণালীবদ্ধ হইয়া পড়ে এবং অনেক সময়ে দেখা যায় যে পরবর্তী যুগে যাঁহারা সেইসকল তত্ত্বের পূর্ণ মীমাংসা করিতে আসেন, তাঁহারা গোড়াতেই দু-একটা কথার বাঁধ ভাঙিয়া লইতে বাধ্য হন । যে বিষয়কে বা মতকে সাধারণ কথায় তত্ত্বের মতো করিয়া বুঝাইতে গেলে মনে তেমন কোনো সম্ভ্রমের উদয় হয় না, সে-ই যখন দু-একটা বহুজনস্বীকৃত শব্দের ধ্বজা উড়াইয়া আসে তখন তাহার মর্যাদা ও গুরু যেন অসম্ভব রকম বাড়িয়া যায় । শব্দের আধিপত্য তখন আমাদের কাছে নানারূপ অসঙ্গত দাবী করিতে থাকে । ক্রমে হয়তো সেই ব্যাপারটাই যদি কেহ অন্যরূপ ভাষায় বা অন্য কোনো দিক হইতে ব্যক্ত করিতে আসে, সেই পরিচিত শব্দগুলির অভাবে তাহা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য হইয়া ওঠে। অথবা কাহারও চিন্তা ঠিক সেই সেই শব্দ-নির্দিষ্ট পথে না চলিলেই মনে হয় যেন তাহা না জানি কোন অদ্ভুত পথে চলিয়াছে । হয়তো আর দশজন লোকের চিন্তার মধ্যে সেই পরিচিত প্রচলিত শব্দগুলির ঠিক যথাযথ স্থান নির্ণয় করাটা তখন ভারি একটা আবশ্যকীয় ব্যাপার বলিয়া মনে হয় । মনের এইপ্রকার সংস্কারই মানুষের কাছে সর্বদা ‘হাঁ-কি-না’ ‘এটা না-ওটা’ ‘মানো-কি মানো না’ গোছের একটা প্রশ্ন দাঁড় করায় । নিরীহ ধর্মার্থীর কাছে সে ধমক দিয়া জিজ্ঞাসা করে, “তুমি দ্বৈতবাদী না অদ্বৈতবাদী ?” অথচ সে বেচারা হয়তো কোনো একটা বিশেষ বাদের পক্ষ হইয়া লড়াই করিবার কোনো প্রয়োজনই অনুভব করে না, হয়তো তাহার মনের কথাটাকে ঐরূপ একটা তত্ত্বের মারামারির আকারে প্রকাশ করা তাহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব । আমাদের রাজনৈতিক মত নির্ণয়ের জন্য এক সময় জিজ্ঞাসা করা হইত, “তুমি মডারেট না একট্রিমিস্ট্” এই প্রশ্নই যেন রাজনীতির প্রকাণ্ডতম সমস্যা আর ইহার মধ্যেই যেন রাজনৈতিক শ্রেণী-বিভাগের নিগুঢ়তম সঙ্কেত নিহিত রহিয়াছে। মডারেট একট্রিমিস্ট্ (মধ্যপন্থী ও চরমপন্থী) লিবারেল কন্সারভেটিভ (উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল) ক্যাথলিক প্রোটেস্টান (প্রাচীনপন্থী ও প্রতিবাদপন্থী) প্রভৃতি কথার দ্বন্দ্ব সাময়িক মতবৈষম্য অযৌক্তিক দ্বৈততত্ত্বের একেবারে নিরর্থক না হইলেও, ইহার ফলে কতগুলি ধারণ করিয়া এক-একটি বিরোধকে চিরস্থায়ী করিবার পথ প্রশস্ত করিয়া দেয়। আপাতবিরুদ্ধ কথার মূলে যে সমন্বয়তত্ত্ব নিহিত থাকে ভাষার বিরুদ্ধতা সে তত্ত্বটাকে গোপন করিয়া রাখে। এদেশে জ্ঞান ও ভক্তির বিরোধ, কর্ম ও বৈরাগ্যের বিরোধ, প্রেম ও অনাসক্তির বিরোধ, কতক পরিমাণে শব্দবৈষম্যমূলক কৃত্রিম দ্বন্দ্বেরই পরিচায়ক । যাঁহারা দুর্ভাগ্যক্রমে এইসকল কথার ঘোর-ফেরের মধ্যে আটকাইয়া যান তাঁহাদের, ইচ্ছায় হউক অনিচ্ছায় হউক, একটা না-হয় অপরটার পর্যায়ে পড়িতেই হয়।
মানুষে প্রশ্ন করে, “তুমি জাতীয়তা জিনিসটা বিশ্বাস কর কিনা” “তুমি হিন্দুত্বকে মানো কিনা” আর সঙ্গে-সঙ্গে একটা হাঁ-না গোছের জবাব প্রত্যাশা করে । বাস্তবিক কিন্তু অনেক স্থলেই পাল্টা প্রশ্ন ছাড়া আর কোনো জবাব সম্ভব হয় না, নতুবা কোন-কোন অর্থে কি কি কথা কতদূর স্বীকার করি বা না করি তাহার একটা বিস্তৃত ফর্দ দিতে হয় । আগে শুনি তুমি যাহাকে জাতীয়তা বল সেটার লক্ষণ কি? হিন্দু বা হিন্দুত্ব বলিতে তুমি কি-কি জিনিস বুঝিয়া থাক ? তবে তো বলিতে পারি তোমার জাতীয়তাকে, তোমার হিন্দুত্বকে আমি স্বীকার করিতে প্রস্তুত কিনা । আমি অমুক জিনিসটাকে মানি আর অমুকটাকে মানি না, এক নিঃশ্বাসে একথা বলিয়া ফেলা কার্যত যেমন সহজ তেমনি মারাত্মক । জগতের অর্ধেক মারামারি কেবল কথারই মারামারি। আমার অমুক ধর্ম বাস্তবিক কি বলেন তাহাও আমি জানি না, আর তোমার যথার্থ বক্তব্য ও আদর্শ কি তাহারও ধার ধারি না, অথচ তোমার কাছে উত্তর দাবী করি তুমি অমুক ধর্মটা মানো কিনা অর্থাৎ ঐ শব্দসংসৃষ্ট আমার সংস্কারগুলিকে মানো কিনা ! পুরাণে লেখে গন্ধর্বেরা বাক্যভোজী, তাহারা নাকি শব্দ আহার করিয়া থাকে। এক হিসাবে, গন্ধর্বশ্রেণীর জীব আমাদের মধ্যে বড় কম নয়। কিন্তু অর্থই যে বাক্যের সার এবং অর্থটাকে সম্যকরূপে পরিপাক না করিলে শব্দটা যে মনের পুষ্টি সাধনের অন্তরায় হইয়া উঠিতে পারে এই সহজ কথাটা আমাদের মনে থাকে না বলিয়াই চিন্তার কুপুষ্টিজনিত নানারকম রোগের সৃষ্টি হয়। বিচারবুদ্ধির পাদুকাস্পর্শে বাক্যমাত্রসার প্লীহাজীর্ণ সংস্কারগুলির অপঘাত-মৃত্যুর আশঙ্কা করিয়া আমরা এক-একটা শিখানো বুলিকে অতিরিক্ত যত্নের সঙ্গে যুক্তিতর্ক সন্দেহের কবল হইতে বাঁচাইয়া রাখি। “বিশ্বাসে পাইবে বস্তু তর্কে বহুদূর” বলিয়া প্রাণপণে তর্ক করি এবং বিশ্বাস করিতে চেষ্টা করি যে ‘বস্তু’কে পাইতে আর অধিক বিলম্ব নাই।
ভাষা যে নিজের অর্থ গৌরবেই সত্য, একথা ভুলিয়া সে যখন কেবলমাত্র শব্দগৌরবে বড় হইতে চায়, তাহার অত্যাচার অনিবার্য । চিন্তা কোনোদিনই শব্দের দ্বারা নিঃসন্দেহরূপে ও সম্যকরূপে ব্যক্ত হইতে পারে না। সেইজন্যই এক-একটা সত্যকে পঞ্চাশবার পঞ্চাশরকম ভাষায় পঞ্চাশদিক হইতে দেখা আবশ্যক হয় । কিন্তু তবু দেখা যায় যে সত্যের মূলে প্রবেশ করিতে হইলে আর ভাষা পাওয়া যায় না, অথবা এমন ভাষা পাওয়া যায় না যাহা সত্যানভিজ্ঞের কাছে তত্ত্বকে ব্যক্ত করিতে পারে। অদ্বৈততত্ত্বের কথা নির্বিকল্প সমাধির কথা বলিয়াও এবং “যথা নদ্যঃ সান্দমানা সমুদ্রে অস্তং গচ্ছস্তি নামরূপং বিহায়” ইত্যাদি রূপকের ব্যবহার করিয়াও ঋষিরা বলিতেছেন, “এ সকল তত্ত্বকে প্রকাশ করা যায় না, ইহা ভাষায় জানাজানি হইবার বিষয়ই নহে।” বুদ্ধদেব নির্বাণ তত্ত্বের কথা আজীবন বলিয়া গেলেন কিন্তু “নির্বাণ কি” এ প্রশ্নের সোজাসুজি কোনো উত্তরই দিলেন না । আমরা কিন্তু এ-সকল কথাকে ভাষার মজলিশে টানিয়া অহরহই মারামারি করিয়া থাকি ।
ভাষার আশ্রয় লইয়া যে কোনো অপকর্ম অনুষ্ঠিত হয় তাহাকেই যদি ভাষার অত্যাচার বলা যায়, তবে ভাষা-ঘটিত আরো অনেকপ্রকার অত্যাচারের উল্লেখ করা যাইতে পারে । আমার কার্যটা তোমার মনঃপূত না হইলে তুমি যে সকল বাক্য ব্যবহার কর, সেও এক হিসাবে ভাষার অত্যাচার । অনিচ্ছুক ছাত্রকে পণ্ডিতমহাশয় যখন শাসন অনুশাসনের দ্বারা সংস্কৃত পড়িতে বাধ্য করেন ছাত্র নিশ্চয়ই তাহাকে ভাষার অত্যাচার বলিবে। তোমার ক্ষুধার সময়ে বা ব্যস্ততার মুহূর্তে তোমার কাছে দর্শনের তত্ত্ব বা কবিত্বের কথা আওড়াইতে গেলে তুমিও বলিরে ভাষার অত্যাচার। ভাষা যখন বন্ধন ছিঁড়িয়া বি-ইউ-টি বাট পি-ইউ-টি পুট ইত্যাদিবৎ বৈষম্যের সৃষ্টি করে অথবা সে যখন রুশিয়ার মানচিত্রে বসিয়া তোমার উচ্চারণ শক্তির পরীক্ষা করিতে থাকে, সেও একরূপ ভাষার অত্যাচার বৈ কি ! আর সর্বশেষে, এই প্রবন্ধটিকে আরো বিস্তৃত করিয়া ফেনাইতে গেলে তাহাও অত্যাচার বলিয়া গণ্য হইতে পারে।
০