proggapath, progga, bangla literature, bangla kobita, bangla golpo, babgla story, romantic golpo, প্রজ্ঞাপাঠ, বাংলা সাহিত্য, কবিতা, বাংলা কবিতা, প্রজ্ঞা, গল্প, বাংলা গল্প, রহস্য গল্প, রম্য রচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, শিল্প-সাহিত্য, নাটক, চিঠি, patropanyas, poem, Story, golpo, bangla poem, bangla Story, Rahasya golpo, Rommo Rocona, Articles, Prabandha, Novel, Upanyas, Drama, Natok, Letter, Cithi, Art and literature, silpo-sahityo, মওলানা ভাসানী, Maolana Vasani, Voter age vat cai, ভোটের আগে ভাত চাই

 ভোটের আগে ভাত চাই

০ মন্তব্য দর্শক

‘ভোট’ মনে হয় আজ সকলের ঠোঁট ফাটাইয়া দিয়াছে, ‘ভোট ভোট’ করিয়া দেশে আজ হায় মাতম শুরু হইয়া গিয়াছে। মনে হয়, ভোট যেন আজ অনেকের এতো গরম হইয়া উঠিয়াছে।

সমস্যা-সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে পতিত হইয়া বাঁচিবার জন্য অনেকে আজ পথ হাতড়াইতেছেন। যাঁহারা বাঁচিবার আর কোনো আশ্রয় পাইতেছেন না, তাঁহারা আজ ভোটের ভেলা আশ্রয় করিয়া, আঁকড়াইয়া ধরিয়া কোনো রকমে বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছেন।

যতবারই দেশ কোনো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সঙ্কটে পতিত হইয়াছে, ততবারই এই ভোটের আশ্রয় লওয়া হইয়াছে, সঙ্কট ত্রাণের একমাত্র পরিত্রাণ হিসাবে ভোট গ্রহণ করা হইয়াছে, সঙ্কটের সুদীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্য ভোটের উপর সওয়ার করা হইয়াছে, সমস্যা-সঙ্কট হইতে বাঁচিবার জন্য ভোটের আশ্রয় লওয়া হইয়াছে।

এই ভোটেরও একটি ইতিহাস আছে, একটা ঐতিহ্য আছে। এখন আমাদের পর্যালোচনা করিয়া দেখা দরকার, এই ভোটের আদি ইতিহাস। অতীতে এই ভোট বা নির্বাচন দেশের জনগণকে দুরবস্থার হাত হইতে প্রকৃত মুক্তি দিতে পারিয়াছে কি না?

এখানে দেশ বলিতে, দেশের জনগণ বলিতে আমরা বুঝি যাহারা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করিয়া, মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া, জোঁকের কামড় সহ্য করিয়া সারাদিন খাটুনি খাটিয়া খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করে, দেশকে বাঁচায়, দেশের সমগ্র জনগণকে বাঁচায়। আর সমস্যা, সঙ্কটে, দুরবস্থা বলিতে এই দেশের বেশির ভাগ কৃষক, মজুর মেহনতি মানুষের সমস্যার কথাই সর্বপ্রথম মনে করিতেছি।

ভোট বা নির্বাচনকে নিজেদের ভাগ্যোন্নতির পথ হিসাবে যাঁহারা ব্যবহার করেন, তাঁহারা এ দেশের কৃষক, মজুর, মেহনতি মানুষ নয়, তাঁহারা সুযোগ-সন্ধানি ও আত্মস্বার্থের কাঙাল। তাঁহাদের সংখ্যা আমাদের দেশে কম নাই। তাই নির্বাচনের কথা শুনিলেই অতি উৎসাহে ঢাকঢোল পিটাইয়া ‘নির্বাচন জিন্দাবাদ’, ‘নির্বাচন পায়েন্দাবাদ’ বলিয়া চিৎকার করিবার লোকের ও দলের অভাব এ দেশে কখনো হইবে না। যে নির্বাচন, যে ভোটাভুটি দেশের জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের কল্যাণ সাধন করিয়াছে, যাহার ফলাফল দেশের প্রকৃত জনগণ ভোগ করিতে পারিয়াছে, ভবিষ্যতেও ভোগ করিতে পারিবে উহাই প্রকৃত নির্বাচন। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে জনগণ বারবার দেখিয়াছে, নির্বাচনের নামে দেশময় তোলপাড় করিয়া তুফান তুলিয়া যাহারা উপরের তলায় আরোহণ করে, তাহাদের নির্বাচন, চাতুরী ও অপকৌশল জনজীবনকে দুর্বিষহ করিয়া তোলে। প্রকারান্তরে দুর্যোগ কাটাইতে গিয়া, সরাইতে চাহিয়া পরিবেশকে আরও দুর্যোগপূর্ণ করিয়া তোলা ছাড়া এ সকল নির্বাচনের আর কোনোই অবদান নাই। যে ভোট বা নির্বাচন কৃষক-মজুরদের কোনো কল্যাণসাধন না করিয়া তাহাদের জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিয়াছে, জনগণের অগ্রগতি, উন্নতির পথে কাঁটা হইয়া দেখা দিয়াছে, যে ভোট বা নির্বাচন মানুষকে বিপাকের, আরো দুর্যোগের মধ্যে টানিয়া নেয়, নিতে পারে, তাহার আলোচনা, তাহার পর্যালোচনা করা, সেই প্রহসনমূলক, সেই প্রতারণামূলক নির্বাচন বা ভোট সম্পর্কে সাবধানতা সতর্কতা অবলম্বন করাই হইল সচেতন বুদ্ধিমানের কাজ, এ সম্পর্কে দেশের জনগণকে সজাগ-সচেতন করিয়া দেওয়াই হইল দেশ প্রেমিকদের কাজ, তাহাকেই এক কথায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক কাজ বলা চলে।

উজান ঠেলিয়া, গুণ টানিয়া উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে লড়াই করিয়া যে তরী পার করিতে পারে বা তরী পার করিবার চেষ্টা করে, তাহাকেই তো আমরা খাঁটি জাতের মাঝি বলিব। সেই জাতের কাণ্ডারির অভাব আমাদের দেশে রহিয়াছে। নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করিবার প্রাক্কালে নির্বাচনের অতীত ইতিহাস কিছুটা আলোচনা করা দরকার। বর্তমানে যেরূপ সার্বজনীন ভোটাধিকারের কথা শোনা যাইতেছে, তাহা আমাদের এই দেশে ছিল না। আমাদের দেশে প্রচলিত এই ভোট বা নির্বাচন ব্যবস্থা অতীতে বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আন্দোলনের ফলে অতীতে নির্ধারিত ট্যাক্স প্রদানকারীরাই কেবলমাত্র ভোটদান বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিবার অধিকার লাভ করিতে পারিত

এই সীমাবদ্ধ ভোট নির্বাচনী ব্যবস্থার দরুন যখন দেখা গেল যে, শাসকগোষ্ঠী টাকা-পয়সার জোরে, প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে ভীতি প্রদর্শন করিয়া ভোট গ্রহণের বাহানা করিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া শাসনক্ষমতা দখল করিয়া, শাসনক্ষমতার অধিকার লাভ করিয়া দেশের উপর কৃষক, মজুর বেশির ভাগ জনগণের উপর অবাধ শোষণ-নির্যাতন চালাইতে লাগিল, যখন দেখা গেল, নির্বাচনী গণতন্ত্রের উপর অবাধ শোষকসম্প্রদায় গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করিবার আইন-কানুন প্রবর্তন করিতে লাগিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণের মধ্যে নির্বাচিত শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ও সংগ্রামী মনোভাব লাগিয়া উঠিতে থাকে।

এই পরিস্থিতির, এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করিবার জন্য ক্ষমতাহীন, ক্ষমতাচ্যুত শাসক, ক্ষমতাহীন কায়েমী স্বার্থবাদীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করিবার বিরুদ্ধে বা নির্বাচনের বিরুদ্ধে জনগণের সমর্থন পাইবার জন্য জোর প্রচার করিতে থাকে যে, নির্বাচন সঠিক হয় নাই, নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় নাই, এই নির্বাচন মানুষের কোনো কল্যাণ সাধন করে নাই, ক্ষমতাসীন শাসকরা জনগণের কোনো উপকার করে নাই। তখন ক্ষমতাহীন শোষকগোষ্ঠীর প্রয়োজনের তাগিদেই দেশের ভিতরকার অসন্তোষকে তীব্রতর করিবার প্রচষ্টো পাইতে থাকিল আন্দোলন উঠাইল এবং দাবি উঠাইতে থাকিল যে, ‘সার্বজনীন ভোটাধিকার চাই।’

অধিকারহারা জনগণ স্বাভাবিকভাবেই তাহাদের এই আন্দোলনে শরিক হইল। তখন জনগণ ভাবিতে থাকিল যে, সার্বজনীন ভোট হইলে সম্ভবত তাহাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হইবে। তাহাদের এতদিনেকার দুঃখ-দুর্দশার লাঘব হইবে। তাহাদের জীবনে সুখ-শান্তি ফিরিয়া আসিবে। তাই সর্বসাধারণ ভোটের পাকে পড়িয়া সার্বজনীন ভোটাধিকার আন্দেলনে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল ।

জনগণের তীব্র আন্দোলনের ফলে শাসকগোষ্ঠী সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি স্বীকার করিতে বাধ্য হইল বটে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যাহাতে সার্বজনীন ভোটাধিকার ব্যর্থ করা যায়, বানচাল করা যায়, এই সার্বজনীন ভোটের দ্বারা সর্বসাধারণ বিশেষ করিয়া কৃষক, মজুর, মেহনতি মানুষ কোনো অধিকার লাভ করিতে না পারে, তার জন্য পক্ষ ও বিপক্ষের সরকারি ও বিরোধী সকল কায়েমী স্বার্থবাদীরা সব রকম কূটকৌশল প্রয়োগ করিতে ছলচাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করিতে লাগিয়া যায়। এ জন্য জাল ভোট, ভোটের সঙ্গে বাক্স গায়েব করা, ভোটের বাক্সের তলা ফাঁক করিয়া দেওয়া, একজন ভোটার দ্বারা অনেক ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা, বোরখার মধ্যে বহৃরূপী ভোটার বানানো, ভোট খরিদ করিবার কন্ট্রাক্ট দেওয়া, পরিবেশ সৃষ্টি করা, পোলিং অফিসারকে জীবনের ভয় দেখানো এই ধরনের সব নিয়মকানুন বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী যে প্রার্থী জনগণের খেদমত করিয়াছেন দেশের সেবা করিয়াছেন যিনি কৃষক মজুর মেহনতি জনগণের পাশে থাকিয়া তাহাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হইয়া সকল প্রকার শোষন অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছেন, যে প্রার্থী নিঃস্বার্থ সৎ ঈমানদার কর্মঠ হইবেন, তাহাকেই জনগণ স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনভাবে স্বেচ্ছায় ভোটদান করিবে কিন্তু সেখানে ঐ রকম পরিস্থিতি পরিবেশ সৃষ্টি কবিার কারণ কি? কেনইবা প্রার্থীগণ জাল জুয়াচুরির পথ অনুসরণ করিয়া পবিত্র গণতান্ত্রিক নির্বচানকে অপবিত্র করিয়া তোলেন?

যেহেতু প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন ক্ষমতাধর, ক্ষমতাহারা রাজনৈতিক প্রার্থীগণ ভোট বা নির্বাচনকে একটা ব্যবসা-বাণিজ্য কায়কারবার হিসাবে গ্রহণ করিয়া থাকেন। তাঁহারা লাভ লোকসানের হিসাবের মাপকাঠিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়া থাকেন। ভোট বা নির্বাচনকে তাঁহারা লগ্নি কারবার বলিয়া মনে করিয়া থাকেন। নির্বাচনের মৌসুমে জনগণের খাদেম সাজিয়া টাকার থলিয়া নিয়া ভোটের বাজারে হাজির হইয়া থাকেন ।

এই ধরনের ‘ভোট’ বা ‘নির্বাচন’ কৃষক, মজুর, মেহনতি, শোষিত জনগণকে শোষণমুক্ত অভাব-অনটন মুক্ত করিতে পারে নাই। প্রমাণ ১৯৪৭ হইতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের শাসনক্ষমতায় মুসলিম লীগ একচ্ছত্রভাবে সরকারে অধিষ্ঠিত ছিল। তাহাদের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, জুলুমে জনগণ অতিষ্ঠ হইয়া অস্থির হইয়া সংগ্রামে অবতীর্ণ হইতেছিল, তখন তৎকালীন বিরোধী দলের পক্ষ হইতে জনগণকে বলা হইয়াছিল যে, ভোট বা নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করিতে পারিলেই জনগণ সকল প্রকার শোষণমুক্ত হইতে পারিবে, জনগণের জীবনে সুখ-সুবিধা ফিরিয়া আসিবে, জনগণ অত্যাচার-জুলুম হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারিবে। বিনাক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হইলে জমিদারি শোষণের অবসান হইবে। খাজনা ট্যাক্সের বোঝা লাঘব হইবে। কৃষক মজুর মেহনতি জনগণ স্বাধীনতার ফল ভোগ করিতে পারিবে। এই আশা-ভরসা নিয়াই আমরা নির্বাচিত যুদ্ধের দ্বারা স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করিবার জন্য দেশের সব নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ১৯৫৪ সালে ‘ঐক্য ফ্রন্ট’ গঠন করিয়াছিলাম।

শেরে বাংলা হক সাহেব, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আমার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করিয়া বিশ্বের বুকে এই প্রথম একটি অদ্বিতীয়, অভূতপূর্ব, নির্বাচনী সংগ্রামের একটি সেরা ইতিহাস রচনা করা হইয়াছিল। দীর্ঘদিন শাসনের পর যে মুসলিম লীগ পাকিস্তানি কায়েমের আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করিয়াছিল, তার এইভাবে ভরাডুবি হইতে পারে, ইহা সকলের কাছেই কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল।

মুসলিম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা, যে বিক্ষোভ মানুষের মনে আগ্নেয়গিরির এতো দানা বাঁধিয়াছিল যার বিস্ফোরণ ঘটিলে এই দেশে আর একটি ফরাসি বিপ্লব ঘটিয়া যাইত। এই অবস্থায় এই দেশের সকল কায়েমি স্বার্থবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের উত্তরাধিকারী ধনী শোষকদের গড়া ইমারত, বালাখানা, তখত-তাউস ধূলিসাৎ হইয়া যাইত, বিলীন হইয়া যাইত, তাহাদের অবশিষ্ট চিহ্নটুকু ধরাপৃষ্ঠ হইতে চিরদিনের জন্য মুছিয়া যাইত।

সম্ভবত এই পরিণতির কথা আন্দাজ করিতে পারিয়া, তৎকালীন উঠতি বুর্জোয়ারা, শাসনক্ষমতার রাশ টানিয়া ধরিবার জন্য, শেরে বাংলা ফজলুল হক ও আমার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করত কৃষক-মজুর, মেহনতি জনগণের সুতীব্র সংগ্রামকে, ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামমুখী’ আন্দোলনকে সুকৌশলে নির্বাচনমুখী করিয়া দিবার জন্য, বিশেষ তৎপরতার সাথে তাহাদের গোপন হস্ত চালনা করিয়াছিল।

নির্বাচনের পরবর্তী কার্যক্রমই আমাদের এই বক্তব্যের, এই আলোচনার যথার্থতা প্রমাণ করিবে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আমাদের যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের জনগণ, ভোটারদের কৃষক, মজুর, মেহনতি মানুষের কাছে প্রদত্ত ওয়াদা ছিল জনগণের মুক্তিসনদ বলিয়া ঘোষিত ঐতিহাসিক ২১ দফা ওয়াদা ।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এতো অভিজ্ঞ, পরিপক্ক, জবরদস্ত নেতাদের নেতৃত্বে যে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হইয়াছিল, যাঁহার নেতৃত্বে, পরিচালনায় ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভ হইয়াছিল, যে যুক্তফ্রন্টে নেতাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে আমিও জড়িত ছিলাম কিন্তু আমাদের প্রশ্ন- নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব হইয়াছিল সত্য, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব হইয়াছিল? রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগ করিবার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার জনপ্রতিনিধিরা লাভ করিয়াছিলেন কি?

ভোটার অর্থাৎ কৃষক, মজুর, মেহনতি জনগণের কাছে প্রদত্ত ঐতিহাসিক মুক্তিসনদ ২১-দফা নির্বাচন প্রতিনিধিরা কি লাভ করিয়াছিলেন?

যুক্তফ্রন্ট ছিল যৌথবদ্ধ রাজনৈতিক ঐক্যজোট। বিভিন্ন অঙ্গদলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টের সংগ্রামশীল ভূমিকার যে পশ্চাৎপদতা, বাংলার জনবরেণ্য নেতা শেরে বাংলা হক সাহেব আজ পরলোকে। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের হাত হইতে, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের, সামন্তবাদী চক্রান্তকারী শাসকদের হাত হইতে ক্ষমতা ছিনাইয়া লইয়া জনগণের হাতে সেই ক্ষমতা তুলিয়া দিব এই সদিচ্ছায় হক সাহেব ও আমরা একমত হইয়াছিলাম। আমাদের এই সদিচ্ছা বাস্তবায়িত করার প্রয়াস আমরা পাইয়াছিলাম কিন্তু যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরে মুখোশধারী জনদরদীদের আড্ডা আমাদিগকে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে।

যে-সকল রাজনৈতিক নেতা জনগণের ভোটের বদৌলতে ধানমণ্ডি, গুলশান, ঢাকার বড় বড় আবাসিক এলাকায় সুরক্ষিত দারোয়ান ও কুকুরের পাহারায় বড় বড় দালানকোঠায়, সুরম্য অট্টালিকায় বসবাস করিবার, প্রশ্ন করিবার কৈফিয়ত তলব করিবার সৌভাগ্য জনসাধারণের না হইতে পারে, কিন্তু যে-সকল নেতা ও কর্মীসাধারণ বেশির ভাগ সময় দেশের গ্রামে বাড়িতে থাকেন, তাঁহাদের নিরন্ন, দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, লান্নত, সর্বহারা ভোটার কৃষক-মজুর জনসাধারণের তীব্র কটাক্ষপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হইয়াছে এবং হইতেছে।

ভোটার কৃষক, মজুর, মেহনতি, ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, কবিরাজ, প্রেসশ্রমিক, কুলি, মজুর, কামলারা প্রশ্ন করিয়া থাকে যে, ‘আপনাদের কথায় মিঞা ভোট দিয়াছিলাম- পাকিস্তান বানাইয়াছেন। পাকিস্তান বানাইয়া আমাদের কি উপকার করিয়াছেন? আগে আমাদের একটা ঘর ছিল, তাহাও আজ আর নাই; দুইটা গরু ছিল, তাহাও আজ নাই, আগে দিনে একবেলা অন্তত ডালভাত খাইতে পারিতাম, আজ তাহাও খাইতে পারিতেছি না।’

গ্রামের সেইসব ভোটার কৃষক-কামলারা প্রশ্ন করিতেছে যে, কৈ মিঞারা, জমিদারি উচ্ছেদ করিয়া নাকি আপনারা আমাদের জমির ব্যবস্থা করিবেন। সহযোগিতা করিত, সুদে ধারকর্য দান করিত, তাহাও আজ আর পাওয়া যাইতেছে না।

ভোটারগণ প্রশ্ন করিতেছে যে, আপনাদের কথায় যুক্তফ্রন্টের নৌকা মার্কা বাক্সে ভোট দিলাম- আমাদের উপর হইতে খাজনা-ট্যাক্স কমিয়া যাইবে, মওকুফ হইবে। কিন্তু জঠরজ্বালায় আমার এক ভাই গলায় দড়ি লাগাইয়াছে। আমার একটা মেয়েকে বলাইয়া (ধর্ষণ) দিয়াছি। বৌ-ত আগেই শেষ হইয়াছে, এখন বাকি আছি আমি। কাজের যে অভাব, বাজারের যে অবস্থা, তাহাতে আমাকেও শেষ পর্যন্ত গলায় দড়ি লাগাইতে হইবে।

ভোটার, কৃষক, মজুর, মেহনতি, দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত নিরন্ন মানুষের, নির্যাতিত মজলুম জনগণের এই সকল বেদনাদায়ক, কারণ মর্মান্তিক প্রশ্নের জবাব কি, বলিতে পারেন? কে আজ এই সকল প্রশ্নের সঠিক উপযুক্ত জবাব দান করিবে?

তাই আজ আমার অনুরোধ, কোনো রকম ভাঁওতা না দিয়া, মিথ্যা কথা না বলিয়া, মিথ্যা ওয়াদা না করিয়া, ছলনার আশ্রয় না নিয়া, জালিয়াতি না করিয়া, শঠতা না করিয়া, ভোটার জনগণের এই সকল হৃদয়বিদারক প্রশ্নের সঠিক জবাব পথ, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের সামনে আসল ঘটনা তুলিয়া ধরিয়া একটা কেন, হাজারটা নির্বাচন করুন, ভোটের ব্যবস্থা করুন আপত্তি নাই। ভোটারগণ অবশ্যই ভোটদান করিবে। ভোট দেওয়ার এতো সম্মানজনক নাগরিক অধিকার কে না প্রয়োগ করিতে চায়?

যে-কোনো দেশের গণতন্ত্রের মূল কথাই হইল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে জনমত গ্রহণ করা- জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা দান করে না, জনগণের মতামতকে গ্রাহ্য করে না, মূল্য দেয়া হয় না তাহারা কেবল কায়েমি স্বার্থবাদী, স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীই হইতে পারে। কোনো গণতন্ত্রকামী, দেশদরদি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কখনও যাইতে পারে না।

কিন্তু যদি গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারী আইয়ুবের গণতন্ত্রের এতো জনসাধারণের সংগ্রামী গতিকে বিপথগামী করিবার জন্য নির্বাচনের প্রহসন করা হয়, কেবলমাত্র ‘প্রভুবদল’ করিবার জন্য দক্ষিণ ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়ার এতো, ফাস্কো, সালাজারের এতো, রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গদের এতো নির্বাচনী ভাঁওতা দেওয়া হয়, তাহা হইলে সেই নির্বাচন, ভোটাভুটির ফলাফল পূর্বে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের এতো কলঙ্কজনক ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পরিণত হইতে বাধ্য।

ভোটার জনসাধারণের প্রশ্নসমূহের সঠিক জবাবের মধ্যেই সঠিক এবং বাস্তব সমাধান নিহিত রহিয়াছে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।

আমি মনে করি, পূর্বেকার নির্বাচনের ব্যর্থতার কারণগুলির সঠিক পর্যালোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে জনসাধারণের, দেশবাসীর সত্যিকারের মুক্তির পথ ।

আমরা নিঃসন্দেহে হাজার বার নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারি, সুস্পষ্ট করিয়া উচ্চকণ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়া বলিতে পারি যে, যিনি ভালো নির্বাচন করুন না কেন, যত বেশি ভোট লাভ করুন না কেন, জনগণের, কৃষক-মজুর মেহনতি মানুষের কোনো কল্যাণ সাধন তাঁহারা করিতে পারিবেন না, দুর্যোগ-দুরবস্থার হাত হইতে দেশকে উদ্ধার করিতে পারিবেন না, ফুটা থলির ভিতর যত টাকা-পয়সা, হিরা- মাণিক্যই রাখুন না কেন—খুঁত কেবল খালিই দেখিতে পাইবেন মাত্র। সেক্ষেত্রে তাঁহারা গণতন্ত্রের নামে কার্যত নির্বাচনের অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে, গর্ত বা কুয়ার মধ্যে জনগণকে ঠেলিয়া দিয়া কিছুদিনের জন্য ব্যক্তিগত আরাম সুযোগ-সুবিধা করিয়া নিতে পারিবেন, কায়েমি নিতে পারিবেন মাত্র। সেক্ষেত্রে তাঁহাদের এই কাজকে জনধিকৃত স্বৈরাচারী আইয়ুবের এতো বিশ্বাসঘাতক, মীর জাফরের সাথে তুলনা না করিয়া উপায় থাকিবে না। তখন তাঁহার পক্ষে আইয়ুবের এতো ভাগ্যবরণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকিবে না।

আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচনে জয়লাভ করা এবং সেই জয়লাভকে সুরক্ষিত রাখা, রক্ষণাবেক্ষণ করিবার একমাত্র নির্ভরযোগ্য গ্যারিন্টি হইল সচেতন, সংঘবন্ধ সংগ্রামী কৃষক-মজুর মেহনতি জনগণ। একমাত্র নির্ভরযোগ্য শক্তি হইল-সর্বহারা মানুষের বজ্রকঠিন আত্মত্যাগী ও দৃঢ় মনোবল ।

চাটুকারিতা দিয়া, ভাঁওতাবাজি দিয়া, কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়া হুমকি-ধমকি দিয়া, টাকা-পয়সা দিয়া, মিথ্যা প্রচার-প্রপাগাণ্ডা দ্বারা বাহাদুর সাজিয়া জনতার সেই সংগ্রামী, আত্মত্যাগী বজ্রকঠিন, দুর্বার মনোবল আশা করা আহম্মককে বেহেশতে বাস করিবার শামিল হইবে বলিয়া মনে করি।

সমাজকর্মীদের সর্বদা মনে রাখিতে হইবে-সংগ্রামের সবলতাই হইল জনতার জয়, শোষক শত্রুদের পরাজয়। আর জনতার সংগ্রামের দুর্বলতা- শিথিলতার অর্থ হইল

শত্রুদের জয়।

পরিশেষে, ভোট বা নির্বাচন সম্পর্কে অতীতের বাস্তব অভিজ্ঞতার একটি সাধারণ ইতিহাস হইল এই যে দুনিয়ার কোনো নির্বাচন বা ভোট দ্বারা দেশকে কৃষক, মজুর, মেহনতি জনগণের কোনো সমস্যার সমাধান হয় নাই, সাধারণ মানুষ কোনোদিন ক্ষমতা দখল করিতে পারে নাই।

কোনো আন্দোলন, দাবি-দাওয়া পেশ করা ছাড়া, সংগ্রাম দুর্বার সংগ্রাম ব্যতীত দুনিয়ার কোনো দেশে, কোনো সরকার স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া জনগণের কোনো দাবি আদায় করিয়াছে, জনগণের স্বার্থে কোনো আইন কার্যকরী করিয়াছে, ইতিহাসের এমন কোনো নজির পৃথিবীতে নাই ।

প্রসঙ্গক্রমে সাম্প্রতিক কালের একটি উদাহরণ এখানে নিশ্চয়ই বাহুল্য মনে হইবে না। বিগত ৬ই ডিসেম্বরের আন্দোলন, ঘেরাও আন্দোলন, ছাত্র-জনতার ১১ দফার আন্দোলন দেশবাসীকে কতখানি অধিকার সচেতন করিয়া তুলিয়াছে, দেশকে কতখানি আগাইয়া দিয়াছে, ছাত্র-জনতার কি পরিমাণ দাবি আদায় করিতে সক্ষম হইয়াছে? এমন কী, গণআন্দোলনের ঠেলার চোটে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার হইয়াছে। অপরপক্ষে স্বৈরাচারী আইয়ুবের পিণ্ডির গোলটেবিল বৈঠক, আপোস-আলোচনা দেশবাসীকে কী পরিণাম দান করিয়াছেন? জনগণ নিশ্চয়ই তাহা উপলব্ধি করিতে পারিতেছে।

তাই জনগণের কোনো কিছু আদায় করিতে হইলে তাহার একমাত্র পথ হইল- ‘সংগ্রামের পথ’, সেই পথ হইল ‘রাজপথ।’

নির্বাচন বানচাল করিবার জন্য, অথবা নির্বাচনের বিরোধিতার জন্য নয় জনগণকে, মজুর, সর্বহারা, মেহনতি মানুষকে ভাঁওতাবাজ শোষকদের বিরুদ্ধে সজাগ, সচেতন, সতর্ক, সাবধান রাখিবার জন্যই সর্বহারা জনগণকে তার বাঁচার অধিকারের আন্দোলনকে, ন্যায্য দাবি-দাওয়ার আন্দোলনকে সংগ্রামমুখী রাখিবার জন্যই জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা লইয়া আজ জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়াইয়া আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাইতেছি: ঘরে ঘরে, পল্লি প্রান্তরে, হাটে-বাজারে, শহরে-বন্দরে, রাজপথ-জনপদে নিরন্ন ভুখা-নাঙা মানুষের প্রাণফাটা বেদনা-আর্তনাদের সহিত কণ্ঠ মিলাইয়া জোরে আওয়াজ তুলুন—

‘ঘরে আজ ভাত নাই, ভোটের আগে ভাত চাই।’ 

 

[ভোটের আগে ভাত চাই, প্রকাশক, আজাদ সুলতান, গণতান্ত্রিক কর্মী শিবির, প্রকাশকাল ১৯৭০]

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

 ভোটের আগে ভাত চাই

দর্শক

‘ভোট’ মনে হয় আজ সকলের ঠোঁট ফাটাইয়া দিয়াছে, ‘ভোট ভোট’ করিয়া দেশে আজ হায় মাতম শুরু হইয়া গিয়াছে। মনে হয়, ভোট যেন আজ অনেকের এতো গরম হইয়া উঠিয়াছে।

সমস্যা-সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে পতিত হইয়া বাঁচিবার জন্য অনেকে আজ পথ হাতড়াইতেছেন। যাঁহারা বাঁচিবার আর কোনো আশ্রয় পাইতেছেন না, তাঁহারা আজ ভোটের ভেলা আশ্রয় করিয়া, আঁকড়াইয়া ধরিয়া কোনো রকমে বাঁচিবার চেষ্টা করিতেছেন।

যতবারই দেশ কোনো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সঙ্কটে পতিত হইয়াছে, ততবারই এই ভোটের আশ্রয় লওয়া হইয়াছে, সঙ্কট ত্রাণের একমাত্র পরিত্রাণ হিসাবে ভোট গ্রহণ করা হইয়াছে, সঙ্কটের সুদীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্য ভোটের উপর সওয়ার করা হইয়াছে, সমস্যা-সঙ্কট হইতে বাঁচিবার জন্য ভোটের আশ্রয় লওয়া হইয়াছে।

এই ভোটেরও একটি ইতিহাস আছে, একটা ঐতিহ্য আছে। এখন আমাদের পর্যালোচনা করিয়া দেখা দরকার, এই ভোটের আদি ইতিহাস। অতীতে এই ভোট বা নির্বাচন দেশের জনগণকে দুরবস্থার হাত হইতে প্রকৃত মুক্তি দিতে পারিয়াছে কি না?

এখানে দেশ বলিতে, দেশের জনগণ বলিতে আমরা বুঝি যাহারা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করিয়া, মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া, জোঁকের কামড় সহ্য করিয়া সারাদিন খাটুনি খাটিয়া খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করে, দেশকে বাঁচায়, দেশের সমগ্র জনগণকে বাঁচায়। আর সমস্যা, সঙ্কটে, দুরবস্থা বলিতে এই দেশের বেশির ভাগ কৃষক, মজুর মেহনতি মানুষের সমস্যার কথাই সর্বপ্রথম মনে করিতেছি।

ভোট বা নির্বাচনকে নিজেদের ভাগ্যোন্নতির পথ হিসাবে যাঁহারা ব্যবহার করেন, তাঁহারা এ দেশের কৃষক, মজুর, মেহনতি মানুষ নয়, তাঁহারা সুযোগ-সন্ধানি ও আত্মস্বার্থের কাঙাল। তাঁহাদের সংখ্যা আমাদের দেশে কম নাই। তাই নির্বাচনের কথা শুনিলেই অতি উৎসাহে ঢাকঢোল পিটাইয়া ‘নির্বাচন জিন্দাবাদ’, ‘নির্বাচন পায়েন্দাবাদ’ বলিয়া চিৎকার করিবার লোকের ও দলের অভাব এ দেশে কখনো হইবে না। যে নির্বাচন, যে ভোটাভুটি দেশের জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের কল্যাণ সাধন করিয়াছে, যাহার ফলাফল দেশের প্রকৃত জনগণ ভোগ করিতে পারিয়াছে, ভবিষ্যতেও ভোগ করিতে পারিবে উহাই প্রকৃত নির্বাচন। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে জনগণ বারবার দেখিয়াছে, নির্বাচনের নামে দেশময় তোলপাড় করিয়া তুফান তুলিয়া যাহারা উপরের তলায় আরোহণ করে, তাহাদের নির্বাচন, চাতুরী ও অপকৌশল জনজীবনকে দুর্বিষহ করিয়া তোলে। প্রকারান্তরে দুর্যোগ কাটাইতে গিয়া, সরাইতে চাহিয়া পরিবেশকে আরও দুর্যোগপূর্ণ করিয়া তোলা ছাড়া এ সকল নির্বাচনের আর কোনোই অবদান নাই। যে ভোট বা নির্বাচন কৃষক-মজুরদের কোনো কল্যাণসাধন না করিয়া তাহাদের জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিয়াছে, জনগণের অগ্রগতি, উন্নতির পথে কাঁটা হইয়া দেখা দিয়াছে, যে ভোট বা নির্বাচন মানুষকে বিপাকের, আরো দুর্যোগের মধ্যে টানিয়া নেয়, নিতে পারে, তাহার আলোচনা, তাহার পর্যালোচনা করা, সেই প্রহসনমূলক, সেই প্রতারণামূলক নির্বাচন বা ভোট সম্পর্কে সাবধানতা সতর্কতা অবলম্বন করাই হইল সচেতন বুদ্ধিমানের কাজ, এ সম্পর্কে দেশের জনগণকে সজাগ-সচেতন করিয়া দেওয়াই হইল দেশ প্রেমিকদের কাজ, তাহাকেই এক কথায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক কাজ বলা চলে।

উজান ঠেলিয়া, গুণ টানিয়া উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে লড়াই করিয়া যে তরী পার করিতে পারে বা তরী পার করিবার চেষ্টা করে, তাহাকেই তো আমরা খাঁটি জাতের মাঝি বলিব। সেই জাতের কাণ্ডারির অভাব আমাদের দেশে রহিয়াছে। নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করিবার প্রাক্কালে নির্বাচনের অতীত ইতিহাস কিছুটা আলোচনা করা দরকার। বর্তমানে যেরূপ সার্বজনীন ভোটাধিকারের কথা শোনা যাইতেছে, তাহা আমাদের এই দেশে ছিল না। আমাদের দেশে প্রচলিত এই ভোট বা নির্বাচন ব্যবস্থা অতীতে বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আন্দোলনের ফলে অতীতে নির্ধারিত ট্যাক্স প্রদানকারীরাই কেবলমাত্র ভোটদান বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিবার অধিকার লাভ করিতে পারিত

এই সীমাবদ্ধ ভোট নির্বাচনী ব্যবস্থার দরুন যখন দেখা গেল যে, শাসকগোষ্ঠী টাকা-পয়সার জোরে, প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে ভীতি প্রদর্শন করিয়া ভোট গ্রহণের বাহানা করিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া শাসনক্ষমতা দখল করিয়া, শাসনক্ষমতার অধিকার লাভ করিয়া দেশের উপর কৃষক, মজুর বেশির ভাগ জনগণের উপর অবাধ শোষণ-নির্যাতন চালাইতে লাগিল, যখন দেখা গেল, নির্বাচনী গণতন্ত্রের উপর অবাধ শোষকসম্প্রদায় গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করিবার আইন-কানুন প্রবর্তন করিতে লাগিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণের মধ্যে নির্বাচিত শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ও সংগ্রামী মনোভাব লাগিয়া উঠিতে থাকে।

এই পরিস্থিতির, এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করিবার জন্য ক্ষমতাহীন, ক্ষমতাচ্যুত শাসক, ক্ষমতাহীন কায়েমী স্বার্থবাদীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করিবার বিরুদ্ধে বা নির্বাচনের বিরুদ্ধে জনগণের সমর্থন পাইবার জন্য জোর প্রচার করিতে থাকে যে, নির্বাচন সঠিক হয় নাই, নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় নাই, এই নির্বাচন মানুষের কোনো কল্যাণ সাধন করে নাই, ক্ষমতাসীন শাসকরা জনগণের কোনো উপকার করে নাই। তখন ক্ষমতাহীন শোষকগোষ্ঠীর প্রয়োজনের তাগিদেই দেশের ভিতরকার অসন্তোষকে তীব্রতর করিবার প্রচষ্টো পাইতে থাকিল আন্দোলন উঠাইল এবং দাবি উঠাইতে থাকিল যে, ‘সার্বজনীন ভোটাধিকার চাই।’

অধিকারহারা জনগণ স্বাভাবিকভাবেই তাহাদের এই আন্দোলনে শরিক হইল। তখন জনগণ ভাবিতে থাকিল যে, সার্বজনীন ভোট হইলে সম্ভবত তাহাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হইবে। তাহাদের এতদিনেকার দুঃখ-দুর্দশার লাঘব হইবে। তাহাদের জীবনে সুখ-শান্তি ফিরিয়া আসিবে। তাই সর্বসাধারণ ভোটের পাকে পড়িয়া সার্বজনীন ভোটাধিকার আন্দেলনে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল ।

জনগণের তীব্র আন্দোলনের ফলে শাসকগোষ্ঠী সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি স্বীকার করিতে বাধ্য হইল বটে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যাহাতে সার্বজনীন ভোটাধিকার ব্যর্থ করা যায়, বানচাল করা যায়, এই সার্বজনীন ভোটের দ্বারা সর্বসাধারণ বিশেষ করিয়া কৃষক, মজুর, মেহনতি মানুষ কোনো অধিকার লাভ করিতে না পারে, তার জন্য পক্ষ ও বিপক্ষের সরকারি ও বিরোধী সকল কায়েমী স্বার্থবাদীরা সব রকম কূটকৌশল প্রয়োগ করিতে ছলচাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করিতে লাগিয়া যায়। এ জন্য জাল ভোট, ভোটের সঙ্গে বাক্স গায়েব করা, ভোটের বাক্সের তলা ফাঁক করিয়া দেওয়া, একজন ভোটার দ্বারা অনেক ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা, বোরখার মধ্যে বহৃরূপী ভোটার বানানো, ভোট খরিদ করিবার কন্ট্রাক্ট দেওয়া, পরিবেশ সৃষ্টি করা, পোলিং অফিসারকে জীবনের ভয় দেখানো এই ধরনের সব নিয়মকানুন বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী যে প্রার্থী জনগণের খেদমত করিয়াছেন দেশের সেবা করিয়াছেন যিনি কৃষক মজুর মেহনতি জনগণের পাশে থাকিয়া তাহাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হইয়া সকল প্রকার শোষন অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছেন, যে প্রার্থী নিঃস্বার্থ সৎ ঈমানদার কর্মঠ হইবেন, তাহাকেই জনগণ স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনভাবে স্বেচ্ছায় ভোটদান করিবে কিন্তু সেখানে ঐ রকম পরিস্থিতি পরিবেশ সৃষ্টি কবিার কারণ কি? কেনইবা প্রার্থীগণ জাল জুয়াচুরির পথ অনুসরণ করিয়া পবিত্র গণতান্ত্রিক নির্বচানকে অপবিত্র করিয়া তোলেন?

যেহেতু প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন ক্ষমতাধর, ক্ষমতাহারা রাজনৈতিক প্রার্থীগণ ভোট বা নির্বাচনকে একটা ব্যবসা-বাণিজ্য কায়কারবার হিসাবে গ্রহণ করিয়া থাকেন। তাঁহারা লাভ লোকসানের হিসাবের মাপকাঠিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়া থাকেন। ভোট বা নির্বাচনকে তাঁহারা লগ্নি কারবার বলিয়া মনে করিয়া থাকেন। নির্বাচনের মৌসুমে জনগণের খাদেম সাজিয়া টাকার থলিয়া নিয়া ভোটের বাজারে হাজির হইয়া থাকেন ।

এই ধরনের ‘ভোট’ বা ‘নির্বাচন’ কৃষক, মজুর, মেহনতি, শোষিত জনগণকে শোষণমুক্ত অভাব-অনটন মুক্ত করিতে পারে নাই। প্রমাণ ১৯৪৭ হইতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের শাসনক্ষমতায় মুসলিম লীগ একচ্ছত্রভাবে সরকারে অধিষ্ঠিত ছিল। তাহাদের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, জুলুমে জনগণ অতিষ্ঠ হইয়া অস্থির হইয়া সংগ্রামে অবতীর্ণ হইতেছিল, তখন তৎকালীন বিরোধী দলের পক্ষ হইতে জনগণকে বলা হইয়াছিল যে, ভোট বা নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করিতে পারিলেই জনগণ সকল প্রকার শোষণমুক্ত হইতে পারিবে, জনগণের জীবনে সুখ-সুবিধা ফিরিয়া আসিবে, জনগণ অত্যাচার-জুলুম হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারিবে। বিনাক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হইলে জমিদারি শোষণের অবসান হইবে। খাজনা ট্যাক্সের বোঝা লাঘব হইবে। কৃষক মজুর মেহনতি জনগণ স্বাধীনতার ফল ভোগ করিতে পারিবে। এই আশা-ভরসা নিয়াই আমরা নির্বাচিত যুদ্ধের দ্বারা স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করিবার জন্য দেশের সব নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ১৯৫৪ সালে ‘ঐক্য ফ্রন্ট’ গঠন করিয়াছিলাম।

শেরে বাংলা হক সাহেব, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আমার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করিয়া বিশ্বের বুকে এই প্রথম একটি অদ্বিতীয়, অভূতপূর্ব, নির্বাচনী সংগ্রামের একটি সেরা ইতিহাস রচনা করা হইয়াছিল। দীর্ঘদিন শাসনের পর যে মুসলিম লীগ পাকিস্তানি কায়েমের আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করিয়াছিল, তার এইভাবে ভরাডুবি হইতে পারে, ইহা সকলের কাছেই কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল।

মুসলিম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা, যে বিক্ষোভ মানুষের মনে আগ্নেয়গিরির এতো দানা বাঁধিয়াছিল যার বিস্ফোরণ ঘটিলে এই দেশে আর একটি ফরাসি বিপ্লব ঘটিয়া যাইত। এই অবস্থায় এই দেশের সকল কায়েমি স্বার্থবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের উত্তরাধিকারী ধনী শোষকদের গড়া ইমারত, বালাখানা, তখত-তাউস ধূলিসাৎ হইয়া যাইত, বিলীন হইয়া যাইত, তাহাদের অবশিষ্ট চিহ্নটুকু ধরাপৃষ্ঠ হইতে চিরদিনের জন্য মুছিয়া যাইত।

সম্ভবত এই পরিণতির কথা আন্দাজ করিতে পারিয়া, তৎকালীন উঠতি বুর্জোয়ারা, শাসনক্ষমতার রাশ টানিয়া ধরিবার জন্য, শেরে বাংলা ফজলুল হক ও আমার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করত কৃষক-মজুর, মেহনতি জনগণের সুতীব্র সংগ্রামকে, ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামমুখী’ আন্দোলনকে সুকৌশলে নির্বাচনমুখী করিয়া দিবার জন্য, বিশেষ তৎপরতার সাথে তাহাদের গোপন হস্ত চালনা করিয়াছিল।

নির্বাচনের পরবর্তী কার্যক্রমই আমাদের এই বক্তব্যের, এই আলোচনার যথার্থতা প্রমাণ করিবে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আমাদের যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের জনগণ, ভোটারদের কৃষক, মজুর, মেহনতি মানুষের কাছে প্রদত্ত ওয়াদা ছিল জনগণের মুক্তিসনদ বলিয়া ঘোষিত ঐতিহাসিক ২১ দফা ওয়াদা ।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এতো অভিজ্ঞ, পরিপক্ক, জবরদস্ত নেতাদের নেতৃত্বে যে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হইয়াছিল, যাঁহার নেতৃত্বে, পরিচালনায় ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভ হইয়াছিল, যে যুক্তফ্রন্টে নেতাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে আমিও জড়িত ছিলাম কিন্তু আমাদের প্রশ্ন- নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব হইয়াছিল সত্য, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব হইয়াছিল? রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগ করিবার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার জনপ্রতিনিধিরা লাভ করিয়াছিলেন কি?

ভোটার অর্থাৎ কৃষক, মজুর, মেহনতি জনগণের কাছে প্রদত্ত ঐতিহাসিক মুক্তিসনদ ২১-দফা নির্বাচন প্রতিনিধিরা কি লাভ করিয়াছিলেন?

যুক্তফ্রন্ট ছিল যৌথবদ্ধ রাজনৈতিক ঐক্যজোট। বিভিন্ন অঙ্গদলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টের সংগ্রামশীল ভূমিকার যে পশ্চাৎপদতা, বাংলার জনবরেণ্য নেতা শেরে বাংলা হক সাহেব আজ পরলোকে। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের হাত হইতে, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের, সামন্তবাদী চক্রান্তকারী শাসকদের হাত হইতে ক্ষমতা ছিনাইয়া লইয়া জনগণের হাতে সেই ক্ষমতা তুলিয়া দিব এই সদিচ্ছায় হক সাহেব ও আমরা একমত হইয়াছিলাম। আমাদের এই সদিচ্ছা বাস্তবায়িত করার প্রয়াস আমরা পাইয়াছিলাম কিন্তু যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরে মুখোশধারী জনদরদীদের আড্ডা আমাদিগকে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে।

যে-সকল রাজনৈতিক নেতা জনগণের ভোটের বদৌলতে ধানমণ্ডি, গুলশান, ঢাকার বড় বড় আবাসিক এলাকায় সুরক্ষিত দারোয়ান ও কুকুরের পাহারায় বড় বড় দালানকোঠায়, সুরম্য অট্টালিকায় বসবাস করিবার, প্রশ্ন করিবার কৈফিয়ত তলব করিবার সৌভাগ্য জনসাধারণের না হইতে পারে, কিন্তু যে-সকল নেতা ও কর্মীসাধারণ বেশির ভাগ সময় দেশের গ্রামে বাড়িতে থাকেন, তাঁহাদের নিরন্ন, দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, লান্নত, সর্বহারা ভোটার কৃষক-মজুর জনসাধারণের তীব্র কটাক্ষপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হইয়াছে এবং হইতেছে।

ভোটার কৃষক, মজুর, মেহনতি, ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, কবিরাজ, প্রেসশ্রমিক, কুলি, মজুর, কামলারা প্রশ্ন করিয়া থাকে যে, ‘আপনাদের কথায় মিঞা ভোট দিয়াছিলাম- পাকিস্তান বানাইয়াছেন। পাকিস্তান বানাইয়া আমাদের কি উপকার করিয়াছেন? আগে আমাদের একটা ঘর ছিল, তাহাও আজ আর নাই; দুইটা গরু ছিল, তাহাও আজ নাই, আগে দিনে একবেলা অন্তত ডালভাত খাইতে পারিতাম, আজ তাহাও খাইতে পারিতেছি না।’

গ্রামের সেইসব ভোটার কৃষক-কামলারা প্রশ্ন করিতেছে যে, কৈ মিঞারা, জমিদারি উচ্ছেদ করিয়া নাকি আপনারা আমাদের জমির ব্যবস্থা করিবেন। সহযোগিতা করিত, সুদে ধারকর্য দান করিত, তাহাও আজ আর পাওয়া যাইতেছে না।

ভোটারগণ প্রশ্ন করিতেছে যে, আপনাদের কথায় যুক্তফ্রন্টের নৌকা মার্কা বাক্সে ভোট দিলাম- আমাদের উপর হইতে খাজনা-ট্যাক্স কমিয়া যাইবে, মওকুফ হইবে। কিন্তু জঠরজ্বালায় আমার এক ভাই গলায় দড়ি লাগাইয়াছে। আমার একটা মেয়েকে বলাইয়া (ধর্ষণ) দিয়াছি। বৌ-ত আগেই শেষ হইয়াছে, এখন বাকি আছি আমি। কাজের যে অভাব, বাজারের যে অবস্থা, তাহাতে আমাকেও শেষ পর্যন্ত গলায় দড়ি লাগাইতে হইবে।

ভোটার, কৃষক, মজুর, মেহনতি, দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত নিরন্ন মানুষের, নির্যাতিত মজলুম জনগণের এই সকল বেদনাদায়ক, কারণ মর্মান্তিক প্রশ্নের জবাব কি, বলিতে পারেন? কে আজ এই সকল প্রশ্নের সঠিক উপযুক্ত জবাব দান করিবে?

তাই আজ আমার অনুরোধ, কোনো রকম ভাঁওতা না দিয়া, মিথ্যা কথা না বলিয়া, মিথ্যা ওয়াদা না করিয়া, ছলনার আশ্রয় না নিয়া, জালিয়াতি না করিয়া, শঠতা না করিয়া, ভোটার জনগণের এই সকল হৃদয়বিদারক প্রশ্নের সঠিক জবাব পথ, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের সামনে আসল ঘটনা তুলিয়া ধরিয়া একটা কেন, হাজারটা নির্বাচন করুন, ভোটের ব্যবস্থা করুন আপত্তি নাই। ভোটারগণ অবশ্যই ভোটদান করিবে। ভোট দেওয়ার এতো সম্মানজনক নাগরিক অধিকার কে না প্রয়োগ করিতে চায়?

যে-কোনো দেশের গণতন্ত্রের মূল কথাই হইল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে জনমত গ্রহণ করা- জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা দান করে না, জনগণের মতামতকে গ্রাহ্য করে না, মূল্য দেয়া হয় না তাহারা কেবল কায়েমি স্বার্থবাদী, স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীই হইতে পারে। কোনো গণতন্ত্রকামী, দেশদরদি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কখনও যাইতে পারে না।

কিন্তু যদি গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারী আইয়ুবের গণতন্ত্রের এতো জনসাধারণের সংগ্রামী গতিকে বিপথগামী করিবার জন্য নির্বাচনের প্রহসন করা হয়, কেবলমাত্র ‘প্রভুবদল’ করিবার জন্য দক্ষিণ ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়ার এতো, ফাস্কো, সালাজারের এতো, রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গদের এতো নির্বাচনী ভাঁওতা দেওয়া হয়, তাহা হইলে সেই নির্বাচন, ভোটাভুটির ফলাফল পূর্বে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের এতো কলঙ্কজনক ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পরিণত হইতে বাধ্য।

ভোটার জনসাধারণের প্রশ্নসমূহের সঠিক জবাবের মধ্যেই সঠিক এবং বাস্তব সমাধান নিহিত রহিয়াছে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।

আমি মনে করি, পূর্বেকার নির্বাচনের ব্যর্থতার কারণগুলির সঠিক পর্যালোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে জনসাধারণের, দেশবাসীর সত্যিকারের মুক্তির পথ ।

আমরা নিঃসন্দেহে হাজার বার নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারি, সুস্পষ্ট করিয়া উচ্চকণ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়া বলিতে পারি যে, যিনি ভালো নির্বাচন করুন না কেন, যত বেশি ভোট লাভ করুন না কেন, জনগণের, কৃষক-মজুর মেহনতি মানুষের কোনো কল্যাণ সাধন তাঁহারা করিতে পারিবেন না, দুর্যোগ-দুরবস্থার হাত হইতে দেশকে উদ্ধার করিতে পারিবেন না, ফুটা থলির ভিতর যত টাকা-পয়সা, হিরা- মাণিক্যই রাখুন না কেন—খুঁত কেবল খালিই দেখিতে পাইবেন মাত্র। সেক্ষেত্রে তাঁহারা গণতন্ত্রের নামে কার্যত নির্বাচনের অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে, গর্ত বা কুয়ার মধ্যে জনগণকে ঠেলিয়া দিয়া কিছুদিনের জন্য ব্যক্তিগত আরাম সুযোগ-সুবিধা করিয়া নিতে পারিবেন, কায়েমি নিতে পারিবেন মাত্র। সেক্ষেত্রে তাঁহাদের এই কাজকে জনধিকৃত স্বৈরাচারী আইয়ুবের এতো বিশ্বাসঘাতক, মীর জাফরের সাথে তুলনা না করিয়া উপায় থাকিবে না। তখন তাঁহার পক্ষে আইয়ুবের এতো ভাগ্যবরণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকিবে না।

আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচনে জয়লাভ করা এবং সেই জয়লাভকে সুরক্ষিত রাখা, রক্ষণাবেক্ষণ করিবার একমাত্র নির্ভরযোগ্য গ্যারিন্টি হইল সচেতন, সংঘবন্ধ সংগ্রামী কৃষক-মজুর মেহনতি জনগণ। একমাত্র নির্ভরযোগ্য শক্তি হইল-সর্বহারা মানুষের বজ্রকঠিন আত্মত্যাগী ও দৃঢ় মনোবল ।

চাটুকারিতা দিয়া, ভাঁওতাবাজি দিয়া, কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়া হুমকি-ধমকি দিয়া, টাকা-পয়সা দিয়া, মিথ্যা প্রচার-প্রপাগাণ্ডা দ্বারা বাহাদুর সাজিয়া জনতার সেই সংগ্রামী, আত্মত্যাগী বজ্রকঠিন, দুর্বার মনোবল আশা করা আহম্মককে বেহেশতে বাস করিবার শামিল হইবে বলিয়া মনে করি।

সমাজকর্মীদের সর্বদা মনে রাখিতে হইবে-সংগ্রামের সবলতাই হইল জনতার জয়, শোষক শত্রুদের পরাজয়। আর জনতার সংগ্রামের দুর্বলতা- শিথিলতার অর্থ হইল

শত্রুদের জয়।

পরিশেষে, ভোট বা নির্বাচন সম্পর্কে অতীতের বাস্তব অভিজ্ঞতার একটি সাধারণ ইতিহাস হইল এই যে দুনিয়ার কোনো নির্বাচন বা ভোট দ্বারা দেশকে কৃষক, মজুর, মেহনতি জনগণের কোনো সমস্যার সমাধান হয় নাই, সাধারণ মানুষ কোনোদিন ক্ষমতা দখল করিতে পারে নাই।

কোনো আন্দোলন, দাবি-দাওয়া পেশ করা ছাড়া, সংগ্রাম দুর্বার সংগ্রাম ব্যতীত দুনিয়ার কোনো দেশে, কোনো সরকার স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া জনগণের কোনো দাবি আদায় করিয়াছে, জনগণের স্বার্থে কোনো আইন কার্যকরী করিয়াছে, ইতিহাসের এমন কোনো নজির পৃথিবীতে নাই ।

প্রসঙ্গক্রমে সাম্প্রতিক কালের একটি উদাহরণ এখানে নিশ্চয়ই বাহুল্য মনে হইবে না। বিগত ৬ই ডিসেম্বরের আন্দোলন, ঘেরাও আন্দোলন, ছাত্র-জনতার ১১ দফার আন্দোলন দেশবাসীকে কতখানি অধিকার সচেতন করিয়া তুলিয়াছে, দেশকে কতখানি আগাইয়া দিয়াছে, ছাত্র-জনতার কি পরিমাণ দাবি আদায় করিতে সক্ষম হইয়াছে? এমন কী, গণআন্দোলনের ঠেলার চোটে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার হইয়াছে। অপরপক্ষে স্বৈরাচারী আইয়ুবের পিণ্ডির গোলটেবিল বৈঠক, আপোস-আলোচনা দেশবাসীকে কী পরিণাম দান করিয়াছেন? জনগণ নিশ্চয়ই তাহা উপলব্ধি করিতে পারিতেছে।

তাই জনগণের কোনো কিছু আদায় করিতে হইলে তাহার একমাত্র পথ হইল- ‘সংগ্রামের পথ’, সেই পথ হইল ‘রাজপথ।’

নির্বাচন বানচাল করিবার জন্য, অথবা নির্বাচনের বিরোধিতার জন্য নয় জনগণকে, মজুর, সর্বহারা, মেহনতি মানুষকে ভাঁওতাবাজ শোষকদের বিরুদ্ধে সজাগ, সচেতন, সতর্ক, সাবধান রাখিবার জন্যই সর্বহারা জনগণকে তার বাঁচার অধিকারের আন্দোলনকে, ন্যায্য দাবি-দাওয়ার আন্দোলনকে সংগ্রামমুখী রাখিবার জন্যই জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা লইয়া আজ জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়াইয়া আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাইতেছি: ঘরে ঘরে, পল্লি প্রান্তরে, হাটে-বাজারে, শহরে-বন্দরে, রাজপথ-জনপদে নিরন্ন ভুখা-নাঙা মানুষের প্রাণফাটা বেদনা-আর্তনাদের সহিত কণ্ঠ মিলাইয়া জোরে আওয়াজ তুলুন—

‘ঘরে আজ ভাত নাই, ভোটের আগে ভাত চাই।’ 

 

[ভোটের আগে ভাত চাই, প্রকাশক, আজাদ সুলতান, গণতান্ত্রিক কর্মী শিবির, প্রকাশকাল ১৯৭০]

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত