
বুদ্ধদেব গুহ
বুদ্ধদেব গুহ (১৯৩৬–২০২১) বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব, যাঁর কলমে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের গল্প শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা এই লেখক ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে বড় হয়েছেন। তাঁর লেখায় তাই প্রকৃতি এক বহমান সত্তা, যেখানে অরণ্য আর বনজঙ্গলের শব্দেরা জীবন্ত হয়ে ওঠে।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর বুদ্ধদেব গুহ পেশাগত জীবনে একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করলেও সাহিত্যের প্রতি তাঁর টান ছিল অবিচল। ১৯৬০-এর দশকে লেখালেখি শুরু করে বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি নতুন ধারার সংযোজন ঘটান। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’, যা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান দেয়।
বুদ্ধদেব গুহর রচনা শৈলীর অনন্যতা ছিল তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ও অনুভূতির মিশেলে। তাঁর সৃষ্ট ঋজুদা চরিত্র যেমন পরিব্রাজক, তেমনই বুদ্ধদেব গুহ নিজেও ছিলেন একজন পরিব্রাজক মননের মানুষ। পূর্ব বাংলার অরণ্য থেকে ইউরোপের নগরজীবন—সবই তাঁর অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে ওঠে। তাঁর রচনার পটভূমি তাই কখনও শহরের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জটিল জীবনচিত্র, আবার কখনও গহীন অরণ্যের রহস্যময় সুর।
তাঁর রোমান্টিক উপন্যাসগুলো, বিশেষত ‘হলুদ বসন্ত’, বাংলা সাহিত্যে প্রেমের ব্যঞ্জনা আর আবেগের গভীরতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বুদ্ধদেব গুহর অন্যতম পাঠকপ্রিয় সৃষ্টি ‘মাধুকরী’। এই উপন্যাস শুধু বিতর্কিত নয়, বাংলা কথাসাহিত্যে এটি এক মাইলফলক। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন’, ও ‘আলোকঝারি’।
শুধু বড়দের জন্যই নয়, শিশু-কিশোরদের জন্যও তিনি রচনা করেছেন চিরস্মরণীয় গল্প। ঋজুদা সিরিজ তাঁর শিশুতোষ রচনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের কিশোর মনে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ এনে দিয়েছে।
লেখক ছাড়াও বুদ্ধদেব গুহ ছিলেন এক অনন্য সঙ্গীতপ্রেমী এবং একসময়ের নামকরা সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর গানের মতোই তাঁর রচনাগুলোও মানুষের হৃদয়ে অনুরণন তোলে। তাঁর বইগুলোর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে একাধিক টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র।
বাংলা সাহিত্যের এই মহীরুহ ১৯৭৭ সালে আনন্দ পুরস্কার-এ সম্মানিত হন। অরণ্য, প্রেম ও জীবনের সুরে সমৃদ্ধ তাঁর সাহিত্য চিরকাল পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে। বুদ্ধদেব গুহ তাঁর লেখার মাধ্যমে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের যে অদ্বিতীয় চিত্র এঁকেছেন, তা বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।