জন্মদিন, proggapath, progga, bangla literature, bangla kobita, bangla golpo, babgla story, romantic golpo

জন্মদিন

০ মন্তব্য দর্শক

মেজ্‌বানি শেষ হলো ? এসো তবে, এখন দুজনে
মুখোমুখি বসি এইখানে । রজনীগন্ধার গন্ধে
আমোদিত মলয়-কূজন— এমন নিবিড়ভাবে
বহুদিন বসিনি দুজন, বসিনি নিকটে । তুমি
নিত্য ব্যস্ত থাক রন্ধনশালায়, অথবা সেলাই
নিয়ে, অথবা গৃহের কাজে, টেবিল সজ্জায় । আমি
বৃদ্ধ, সংসারের ঝামেলা নিগ্রহ ভোগ করি পথে
পথে, পথিক জীবনে, ব্যবসার অলিতে-গলিতে ।
উদিত হয়েছে মনে মাঝে মাঝে— হয়তো প্রণয়
নয়, তোমাতে আমােেত এ সম্বন্ধ অভ্যাসের শুধু ।
তোমারে গ্রহণ করি রাত্রিদিন পোষাকের মত,
গৃহকোণে সুসজ্জিত— তোমারি হাতের সজ্জা-অই
পুরাতন দেরাজের মত । তোমারে হারাই যদি
তখনো হয়তো চিরাভ্যস্ত দেরাজের অভাবের
মত শূন্য শূন্য ঠেকবে জীবন ।

মাঝে মাঝে তবু
অযথা খোলস যেন খসে পড়ে হৃদয়ের থেকে ।
তোমাকে বলার ইচ্ছা সে মুহূর্তে প্রবল আকারে
জিভের ডগায় আসে। ব্যগ্রভরে ভাবি, এইবার
ভেঙেচুরে বলে উঠিঃ ‘ভুলে গেছ সেদিনের কথা,
তিরিশ বছর আগে যৌবনের মহুয়ার দিন ?”
‘বাজে কথা রাখ’ বলে যদি তুমি গৃহকাজ নিয়ে
বিবিধ প্রসঙ্গ তোল, যদি তুমি ‘এসব ছেলেমি’
বলে ভাব— তাই আর কখনো বলিনি । আজ এই
এতদিন পরে পঞ্চাশৎ জন্মদিনে বলার সাহস—
হয়তো ভাবছঃ পাগলামি কেন ? কি আর নতুন
কথা বলবার আছে ? সকালে, সন্ধ্যায় জান তুমি
যাকেঃ আকণ্ঠ আবদ্ধ করা শেরোয়ানী-পরা, চুলে

ধীরে গড়ে ওঠা সুচিক্কন টাক—— হায় টাক, এতো
মৃত্যুরই আলামত- এ বয়সে সুগম্ভীর এই
ব্যক্তি আজ— অতীতের স্মৃতি-পট নিয়ে কেন তার
মিথ্যা ছ্যাবলামি !

কেন যে তা আমিই জানিনে । শুধু
আজ সকলের হাসি, বন্ধুত্বের মার্জিত প্রকাশ,
রেমি সম্ভাষ শুনে, জয়নুল- যামিনী রায়ের
দ্যাভিঞ্চির ছবি দেখে উচ্ছ্বসিত বাহবা বহর
সভ্যতার পরাকাষ্ঠা দেখে— আমেরিকা বিলেতে কে
যায় যাবে তাই নিয়ে আলাপ প্রলাপ— মনে হল
মরুশুষ্ক পথে বসে আছি- চতুর্দিকে মুখোসেরা
নৃত্যরত বিচিত্র ভঙ্গীতে । এই ছায়ানৃত্য থেকে
মুক্তিকামী আজ । হয়তো এ বাগানের বৃষ্টিসিক্ত
হাওয়ায় রজনীগন্ধার গন্ধ নামিয়েছে যত
বকুনির ঝড়, হয়তোবা ভুলে যাব সংসারের
চাকার ঘর্ঘরে । তবু জানি এর চেয়ে বড় সত্য
এ মুহূর্তে আর কিছু নেই । অর্থের সাধনা তুচ্ছ,
বিচিত্র কঠিন তার গতি । সর্পিল কঠিন পথে
দান করে সম্মানের নিয্প্রেম নির্মোক । তাঁবেদারী
করে তার স্বপ্নসাধ মিথ্যা প্রমাণিত: আদর্শের
দূরদৃষ্টি মরীচিমায়ায় পরিণত । তার দান
অক্ষয় অমর হবে ? আজ শুধু মনে হয় — মিথ্যা
প্রহসন জীবনের প্রশান্তির কাছে, প্রেম আর
বিশ্বাসের উচ্ছ্বসিত প্রাণদাত্রী নির্ঝরের কাছে ।
তাই লুব্ধ, অন্ধকারে খুঁজি আজ তোমার অন্তরে
নির্ঝরের প্রকাশ-বিবর । চৈত্রমাসী শুষ্কতায়
খুঁজে ফিরি বৃষ্টির প্রপাত । সেদিনও চৈত্ররাত্রি ।
তিরিশ বছর পূর্বে সেও এক জন্মদিন ছিল ।
গলকম্বলের থর তখনও জমেনি । তারুণ্যের
লাবনী-মণ্ডিত দেহ, তুমি ছিলে মায়াবী জুলেখা ।
রাত্রি হল ।
মনে পড়ে ?
তোমারে পৌঁছিতে গেছি রমণার
রমণীয় পথে। দক্ষিণে বিস্তৃত মাঠ আলো-ছোঁয়া,
যাদুকরী, নিস্পন্দ, নীরব। বামে ছিল কৃষ্ণচূড়া
জ্যোৎস্নায় বিকচ কুসুম । নিম্নে ঝরা ঊর্ণনাভি-আলো ।
গুলঞ্চের মদগন্ধ ভেসে এল বাসন্তী হাওয়ায় ।
সুরভিত অন্ধকারে স্বল্পবাক্ তুমি হলে মূক ।
পশ্চাতে প্রাচীন দ্বার ভগ্নশোভা খিলানে খিলানে—
অতীত গৌরব-গাথা অনিবার্য বিনাশের স্মৃতিঃ
আনন্দ করুণ সুর ছুঁয়ে গেল দুজনের মন ।

শ্লথগতি । কখন দাঁড়িয়ে গেছি হাতে হাত বাঁধা ।
ভুলে গেছি সীমারুদ্ধ ক্ষণিক জীবন, রুক্ষ শুষ্ক,
বিজ্ঞপ্তি-ঢোলকে বন্ধ, নাগরিক ঊষরজীবন ।
ঊষর, ধূসর সেই নাগরিক জীবনের পথে
ঠেলে দিলে তুমিই আবার কাব্যের উৎসব থেকে
বিসর্জিত প্রতিমার মত । অর্থের পিচ্ছিল পথে
ক্রমগতি অন্ধকার গভীর গুহায়; ক্ষণলব্ধ
বাগিচার মধুক্ষর নির্ঝর-আলোক বৈদ্যুতিক
আভা শুধু ভুলে যাই বিংশ শতাব্দীর
চাকার ঘর্ঘরে, ঘর্মক্লান্ত মোটর-গহ্বরে, অতিব্যস্ত
ব্যাঙ্কঘরে বকিম তলায় ।

তবু জানি, সেইদিন
বন্ধুত্বের অবসানে প্রণয়ের সন্ধিলগ্ন জন্ম

নিয়েছিল । বিবাহের সম্মোহান্তে দারিদ্র্যের জ্বালা—
তার চেয়ে বেশী কি ছিল না অর্থসহচরী যত
সম্মানের, গৌরবের, ক্ষমতার লোভ ? শাড়ী বাড়ী
গাড়ী আজ ছড়াছড়ি কত! তবুও অতৃপ্ত চিত্ত
তৃপ্তি খুঁজি বিলিয়ার্ডে, কার্ডে ও ছবিতে, ক্লাবঘরে
সাজানো জৌলুষে ।
তবুও কয়েস নই । আমি শুধু
সাময়িক ঘড়ি, ঘুরে চলি বাঁধা পথে, ছন্দোবদ্ধ
প্রাণহীন কবিতার মত । ত্যাগের লালসা জাগে—
হাল্লাজের, রুমীর খোয়াব । স্বপ্ন, স্বপ্ন, মিথ্যা স্বপ্ন
শুধু আকাশ-কুসুম ।
প্রণয়ের হীরক-বলয়
কখন হারিয়ে গেছে অন্ধকারে অতীত-গুহায় !
তার দীপ্তি অন্ধ চোখে হয়তো বা পথের ইশারা
এনে দিতো কোনো সন্ধিক্ষণে। কেনানী ইউসুফ
আর ফিরবে কি ইয়াকুবের বুকে ? দেবে কি তোমার
ছোঁয়া ? সেই ছোঁয়া এখন কোথায় !
থাক্ কথা থাক্,
ঘুমের ব্যাঘাত হল ? শুতে যাও । আমি পরে যাব ।
চিন্তার কারণ নেই । মজ্নুত হইনি— এখনো অনেক দেরীঃ
হয়তো বা হওয়ার সাহস নেই, কখনো হব না ।
অলস বিষ্টির ছোয়া অংগে মেখে যদি তৃপ্তি পাই
তাই-ই একটু বাইরে বসেছি— হাওয়াটা সত্যিই মিষ্টি, না ?

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

জন্মদিন

দর্শক

মেজ্‌বানি শেষ হলো ? এসো তবে, এখন দুজনে
মুখোমুখি বসি এইখানে । রজনীগন্ধার গন্ধে
আমোদিত মলয়-কূজন— এমন নিবিড়ভাবে
বহুদিন বসিনি দুজন, বসিনি নিকটে । তুমি
নিত্য ব্যস্ত থাক রন্ধনশালায়, অথবা সেলাই
নিয়ে, অথবা গৃহের কাজে, টেবিল সজ্জায় । আমি
বৃদ্ধ, সংসারের ঝামেলা নিগ্রহ ভোগ করি পথে
পথে, পথিক জীবনে, ব্যবসার অলিতে-গলিতে ।
উদিত হয়েছে মনে মাঝে মাঝে— হয়তো প্রণয়
নয়, তোমাতে আমােেত এ সম্বন্ধ অভ্যাসের শুধু ।
তোমারে গ্রহণ করি রাত্রিদিন পোষাকের মত,
গৃহকোণে সুসজ্জিত— তোমারি হাতের সজ্জা-অই
পুরাতন দেরাজের মত । তোমারে হারাই যদি
তখনো হয়তো চিরাভ্যস্ত দেরাজের অভাবের
মত শূন্য শূন্য ঠেকবে জীবন ।

মাঝে মাঝে তবু
অযথা খোলস যেন খসে পড়ে হৃদয়ের থেকে ।
তোমাকে বলার ইচ্ছা সে মুহূর্তে প্রবল আকারে
জিভের ডগায় আসে। ব্যগ্রভরে ভাবি, এইবার
ভেঙেচুরে বলে উঠিঃ ‘ভুলে গেছ সেদিনের কথা,
তিরিশ বছর আগে যৌবনের মহুয়ার দিন ?”
‘বাজে কথা রাখ’ বলে যদি তুমি গৃহকাজ নিয়ে
বিবিধ প্রসঙ্গ তোল, যদি তুমি ‘এসব ছেলেমি’
বলে ভাব— তাই আর কখনো বলিনি । আজ এই
এতদিন পরে পঞ্চাশৎ জন্মদিনে বলার সাহস—
হয়তো ভাবছঃ পাগলামি কেন ? কি আর নতুন
কথা বলবার আছে ? সকালে, সন্ধ্যায় জান তুমি
যাকেঃ আকণ্ঠ আবদ্ধ করা শেরোয়ানী-পরা, চুলে

ধীরে গড়ে ওঠা সুচিক্কন টাক—— হায় টাক, এতো
মৃত্যুরই আলামত- এ বয়সে সুগম্ভীর এই
ব্যক্তি আজ— অতীতের স্মৃতি-পট নিয়ে কেন তার
মিথ্যা ছ্যাবলামি !

কেন যে তা আমিই জানিনে । শুধু
আজ সকলের হাসি, বন্ধুত্বের মার্জিত প্রকাশ,
রেমি সম্ভাষ শুনে, জয়নুল- যামিনী রায়ের
দ্যাভিঞ্চির ছবি দেখে উচ্ছ্বসিত বাহবা বহর
সভ্যতার পরাকাষ্ঠা দেখে— আমেরিকা বিলেতে কে
যায় যাবে তাই নিয়ে আলাপ প্রলাপ— মনে হল
মরুশুষ্ক পথে বসে আছি- চতুর্দিকে মুখোসেরা
নৃত্যরত বিচিত্র ভঙ্গীতে । এই ছায়ানৃত্য থেকে
মুক্তিকামী আজ । হয়তো এ বাগানের বৃষ্টিসিক্ত
হাওয়ায় রজনীগন্ধার গন্ধ নামিয়েছে যত
বকুনির ঝড়, হয়তোবা ভুলে যাব সংসারের
চাকার ঘর্ঘরে । তবু জানি এর চেয়ে বড় সত্য
এ মুহূর্তে আর কিছু নেই । অর্থের সাধনা তুচ্ছ,
বিচিত্র কঠিন তার গতি । সর্পিল কঠিন পথে
দান করে সম্মানের নিয্প্রেম নির্মোক । তাঁবেদারী
করে তার স্বপ্নসাধ মিথ্যা প্রমাণিত: আদর্শের
দূরদৃষ্টি মরীচিমায়ায় পরিণত । তার দান
অক্ষয় অমর হবে ? আজ শুধু মনে হয় — মিথ্যা
প্রহসন জীবনের প্রশান্তির কাছে, প্রেম আর
বিশ্বাসের উচ্ছ্বসিত প্রাণদাত্রী নির্ঝরের কাছে ।
তাই লুব্ধ, অন্ধকারে খুঁজি আজ তোমার অন্তরে
নির্ঝরের প্রকাশ-বিবর । চৈত্রমাসী শুষ্কতায়
খুঁজে ফিরি বৃষ্টির প্রপাত । সেদিনও চৈত্ররাত্রি ।
তিরিশ বছর পূর্বে সেও এক জন্মদিন ছিল ।
গলকম্বলের থর তখনও জমেনি । তারুণ্যের
লাবনী-মণ্ডিত দেহ, তুমি ছিলে মায়াবী জুলেখা ।
রাত্রি হল ।
মনে পড়ে ?
তোমারে পৌঁছিতে গেছি রমণার
রমণীয় পথে। দক্ষিণে বিস্তৃত মাঠ আলো-ছোঁয়া,
যাদুকরী, নিস্পন্দ, নীরব। বামে ছিল কৃষ্ণচূড়া
জ্যোৎস্নায় বিকচ কুসুম । নিম্নে ঝরা ঊর্ণনাভি-আলো ।
গুলঞ্চের মদগন্ধ ভেসে এল বাসন্তী হাওয়ায় ।
সুরভিত অন্ধকারে স্বল্পবাক্ তুমি হলে মূক ।
পশ্চাতে প্রাচীন দ্বার ভগ্নশোভা খিলানে খিলানে—
অতীত গৌরব-গাথা অনিবার্য বিনাশের স্মৃতিঃ
আনন্দ করুণ সুর ছুঁয়ে গেল দুজনের মন ।

শ্লথগতি । কখন দাঁড়িয়ে গেছি হাতে হাত বাঁধা ।
ভুলে গেছি সীমারুদ্ধ ক্ষণিক জীবন, রুক্ষ শুষ্ক,
বিজ্ঞপ্তি-ঢোলকে বন্ধ, নাগরিক ঊষরজীবন ।
ঊষর, ধূসর সেই নাগরিক জীবনের পথে
ঠেলে দিলে তুমিই আবার কাব্যের উৎসব থেকে
বিসর্জিত প্রতিমার মত । অর্থের পিচ্ছিল পথে
ক্রমগতি অন্ধকার গভীর গুহায়; ক্ষণলব্ধ
বাগিচার মধুক্ষর নির্ঝর-আলোক বৈদ্যুতিক
আভা শুধু ভুলে যাই বিংশ শতাব্দীর
চাকার ঘর্ঘরে, ঘর্মক্লান্ত মোটর-গহ্বরে, অতিব্যস্ত
ব্যাঙ্কঘরে বকিম তলায় ।

তবু জানি, সেইদিন
বন্ধুত্বের অবসানে প্রণয়ের সন্ধিলগ্ন জন্ম

নিয়েছিল । বিবাহের সম্মোহান্তে দারিদ্র্যের জ্বালা—
তার চেয়ে বেশী কি ছিল না অর্থসহচরী যত
সম্মানের, গৌরবের, ক্ষমতার লোভ ? শাড়ী বাড়ী
গাড়ী আজ ছড়াছড়ি কত! তবুও অতৃপ্ত চিত্ত
তৃপ্তি খুঁজি বিলিয়ার্ডে, কার্ডে ও ছবিতে, ক্লাবঘরে
সাজানো জৌলুষে ।
তবুও কয়েস নই । আমি শুধু
সাময়িক ঘড়ি, ঘুরে চলি বাঁধা পথে, ছন্দোবদ্ধ
প্রাণহীন কবিতার মত । ত্যাগের লালসা জাগে—
হাল্লাজের, রুমীর খোয়াব । স্বপ্ন, স্বপ্ন, মিথ্যা স্বপ্ন
শুধু আকাশ-কুসুম ।
প্রণয়ের হীরক-বলয়
কখন হারিয়ে গেছে অন্ধকারে অতীত-গুহায় !
তার দীপ্তি অন্ধ চোখে হয়তো বা পথের ইশারা
এনে দিতো কোনো সন্ধিক্ষণে। কেনানী ইউসুফ
আর ফিরবে কি ইয়াকুবের বুকে ? দেবে কি তোমার
ছোঁয়া ? সেই ছোঁয়া এখন কোথায় !
থাক্ কথা থাক্,
ঘুমের ব্যাঘাত হল ? শুতে যাও । আমি পরে যাব ।
চিন্তার কারণ নেই । মজ্নুত হইনি— এখনো অনেক দেরীঃ
হয়তো বা হওয়ার সাহস নেই, কখনো হব না ।
অলস বিষ্টির ছোয়া অংগে মেখে যদি তৃপ্তি পাই
তাই-ই একটু বাইরে বসেছি— হাওয়াটা সত্যিই মিষ্টি, না ?

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত