প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, ইসলামে সঙ্গীত যে বিলকুল্ হারাম-এতকাল এই কথাই শুনে আসছি। অনেক স্থলে হাতে-কলমেও এর পরিচয় পেয়েছি। আপনাদের এখানে গান গাইলে আমি সমাদার লাভ করি বটে, কিন্তু তাই বলে মনে করবেন না যে, সর্বত্রই একরকম। অনেক স্থলে গান গেয়ে আমাকে বেশ অপ্রস্তুতও হতে হয়েছে। তাই ঠেকে শিখে আত্মরক্ষার জন্য একটু প্রস্তুত হয়েছি। কোন্ অস্ত্র দিয়ে নিজেকে রক্ষা করবো, তাই আজ আপনাদেরকে খুলে বলছি ।
শাস্ত্রের দোহাই দিয়েই যখন সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ বলা হয়, তখন সেই শাস্ত্ৰ সম্বন্ধেই প্রথমে আলোচনা করা যাক্ ।
কোরআন ও হাদিস (অবশ্য সহী হাদিস) আমাদের মাথার মনি। তাদের বিধি-নিষেধকে উল্লংঘন করবার ঔদ্ধত্য আমার নাই। কোরআন ও হাদিসে বাস্তবিকই যদি থাকে যে, সঙ্গীত একেবারেই হারাম, তবে তা হারামই। এ সম্বন্ধে আর কোনো দ্বিরুক্তি নাই। কিন্তু আমরা পরিষ্কার করে জানতে চাই— কোরআন-হাদিসে সেরূপ নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা। যাঁরা সঙ্গীতকে হারাম বলে ফাতোয়া দেন, এ প্রমাণ-ভার তাঁদের উপর। পরিষ্কার করে জানতে হারাম বলে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। তাহলেই সব গণ্ডগোল ঢুকে গেল। হযরত মুহম্মদের আবির্ভাবকালে লাম্পট্য, মদ্যপান প্রভৃতি দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গীতও তো জড়িয়ে ছিল। সুতরাং সঙ্গীত সর্ব অবস্থায় নিষিদ্ধ হলে, সে সম্বন্ধে কোরআন শরীফে কোনও আয়াত থাকা খুবই স্বাভাবিক- যেমন নাকি অন্যান্য দুর্নীতি সম্বন্ধে আছে। আমরা চাই সেই আয়াত ও সেই হাদিস।
কোরআন-হাদিস সম্বন্ধে আমার যে সামান্য জ্ঞান আছে, তাতে তো মনে হয়— কোরআন-হাদিসে ওরূপ কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই। কোরআন শরীফে তো নাই-ই, তবে কোনো আয়াত বিশেষকে আনুমানিক ও দূরাগত একটি অর্থ দিয়ে বিপক্ষ পক্ষ তাঁদের উদ্দেশ্য হাসিল করে থাকেন। হাদিস থেকেও তাঁরা ২/১ টি হাদিস উদ্ধৃত করেন বটে, কিন্তু তাও ততো সুস্পষ্ট নয়। সঙ্গীতের বিপক্ষে তাঁরা যেরূপ ২/১টি হাদিস দেখিয়ে থাকেন, আমরাও স্বপক্ষে সেরূপ দু’একটি হাদিস দেখাতে পারি। দৃষ্টান্তস্বরূপ দু’টি হাদিসের উল্লেখ এখানে করছিঃ
এক হাবশী বালিকা একদিন বিবি আয়েশার গৃহে গান গাচ্ছিল হযরত রসুলে করিম বিবি আয়েশার সঙ্গে সেই গান শুনছিলেন। এমন সময় হযরত ওমর এসে গৃহ-প্রবেশের এজাজত চেয়ে দ্বারে দাঁড়িয়ে রইলেন। হযরত ওমর ছিলেন ‘বাগরেশে’ পুরুষ। তাঁর নামে সকলের প্রাণে আতঙ্ক উপস্থিত হতো। হাবশী বালিকা ওমরের কথা শুনেই পালিয়ে গেল। ইত্যবসরে হযরত ওমর গৃহ-মধ্যে প্রবেশ করলেন। তিনি দেখলেন হযরত রসুল ও বিবি আয়েশা হযরত ওমরকে লক্ষ্য করে মৃদু মৃদু হাসছেন। তা দেখে হযরত ওমর তার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন হযরত রসুল বললেন— একটা হাবশী বালিকা গান করছিল, আমরা শুনছিলাম। কিন্তু তোমার আসার কথা শুনেই সে পালিয়েছে। তা শুনে হযরত ওমর বললেন— “রাসূলুল্লাহ্, আপনি যা শুনতে পারছেন, আমি তা পারবো না? কই? মেয়েটি কোথায়? ডাকুন তাকে, সে গান করুক।” তখন মেয়েটিকে আবার ডাকা হলো এবং তিনজনে বসে তার গান শুনলেন।
আর একবার একটি আনসার জাতীয়া মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল। হযরত রসুল সেখানে উপস্থিত হয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন— “বিবাহে তোমরা কোনো আমোদ করছো না? বাজাও, দফ্ বাজাও; আনসারগণ দফ বাজানো খুব ভালোবাসে ।
এ রকম আরও দু-একটা হাদিসের কথা উল্লেখ করা যায় ।
এর থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায় সঙ্গীতে অন্ততঃ বিশুদ্ধ সঙ্গীতে হযরত মুহম্মদের কোনোই আপত্তি ছিল না ।
সঙ্গীত যে হযরত মুহম্মদের পূর্ববর্তী পয়গম্বরদিগের সময়েও প্রচলিত ছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া যায় । হযরত দাউদ তাঁর সুমধুর কণ্ঠ-সঙ্গীতের জন্য (লেহানে দাউদী) চির- প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। হযরত মূসা যখন বনি-ইসরাইলদেরকে সঙ্গে নিয়ে নীল-নদ পার হয়ে যান, তখন বনি-ইসরাইল রমণীরা ওপারের তীরে উঠে আনন্দে অধীর হয়ে দফ্ বাজিয়ে গান করতে থাকে। হযরতের সময়েও আরবে সঙ্গীতের যথেষ্ট প্রচলন ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরও সঙ্গীতের উৎস কখনো নিরুদ্ধ হয়ে যায়নি । খলিফা হযরত ওমর নিজে সঙ্গীত রচনা করতেন । তিনিই সুপ্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ ইবনে সুরঈদের’ উৎসাহদাতা ছিলেন । খলিফা হযরত আলি ও হযরত মুয়াবিয়া উভয়েই সঙ্গীতের আলোচনা করতেন। খলিফা অলিদ একজন প্রসিদ্ধ বীণা-বাদক ছিলেন। খলিফা আবু আব্বাস এবং মনসুর সঙ্গীত ও অন্যান্য ললিত-কলার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য চির প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। খলিফা হারুন-আর্-র -রশিদের নাম না বললেও চলতে পারে। বস্তুতঃ খলিফাদের সময়ে বাগদাদ, পারশ্য, কর্ডোভা ও গ্রাণাডাতে সঙ্গীতের যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। ইতিহাস তার সাক্ষী ।
অন্যদের কথা দূরে থাক, যাঁরা খলিফাতুল মু’মেনি, তাঁদের সম্বন্ধেই এই কথা !
তারপর ভারতবর্ষ। সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনে ভারতীয় সঙ্গীত মুসলমানদিগের হাতে নবজীবন লাভ করেছে। যদি বলি যে ভারতীয় সঙ্গীতের অর্থ মুসলিম-সঙ্গীত, তাতেও অত্যুক্তি হয় না। ভারতীয় সঙ্গীতের ৪টি বড় বিভাগ আছে :- (১) ধ্রুপদ, (২) খেয়াল, (৩) ঠুংরি, (৪) টপ্পা । আপনারা শুনে হয়তো স্তম্ভিত হবেন যে, একমাত্র ধ্রুপদ ছাড়া অন্য ৩টি বিভাগই মুসলামনদের সৃষ্টি। মুসলমানেরাই ভারতীয় সঙ্গীতের মুক্তিসাধন করেছে। আর্য-ঋষিরা সঙ্গীতকে ধ্রুপদের কারাকক্ষে বন্ধ করে তাকে দম আটকে মেরে ফেলবার কায়দা করেছিলেন, এমন সময় মুসলমান এসে সেই কারার দুয়ার ভেঙে সঙ্গীতকে বাইরে নিয়ে এসে আকিমিয়ার যাদুস্পর্শ তার অসাড় অঙ্গে বুলিয়ে দিলো! অমনি খেয়াল-রূপিণী এক বিচিত্র মূর্তির আবির্ভাব হলো। সম্ভবতঃ এটা ত্রয়োদশ শতাব্দীর কথা। সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির সভাকবি ও সভাগায়ক আমির খসরুই খেয়াল গানের স্রষ্টা। খেয়াল গানের উৎকর্ষ যখন চরমে পৌঁছায়, তখন পাঞ্জাবের শোরি মিয়া টপ্পা গানের সৃষ্টি করেন ।
মুসলমান আমলে আমির খসরু, তানসেন, ধোধি খাঁ, সূরষ খাঁ, চাঁদ খাঁ, শোভন খাঁ, শোটি, হমদম, মৌলাদাদ, ইলিয়াস, গোলাম নবী, সনদ, কদর, খুশাল খাঁ, নবাব ওয়াজেদ আলি প্রভৃতি অসংখ্য ক্ষণজন্মা সঙ্গীত-স্রষ্টা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় মুসলমানের এই অধঃপতনের যুগেও আর কিছুতে না হোক-অন্ততঃ সঙ্গীতে মুসলমান সকলের শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে । আল্লাবন্দে খাঁ, নাসিরুদ্দীন খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, হাফিজ আলি খাঁ, আলাউদ্দীন খাঁ (বাঙালী) প্রভৃতি অসংখ্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুর-শিল্পী এখনো সগৌরবে ভারতে বিদ্যমান ।
শুধু গায়ক হিসাবে নয়-রাগ-রাগিণী হিসাবেও সঙ্গীতে মুসলমানের দান অপরিসীম। বহু রাগ-রাগিণী মুসলমান সুর-শিল্পীরা সৃষ্টি করে গেছেন। আড়ানো, মিয়াঁ সারঙ্গ, মিয়াঁ মল্লার, মিয়াকি জয়জয়ন্তী, হোসেনী কানাড়া, দরবারী কানাড়া, দরবারী তোড়ী, বাহাদুরী তোড়ী, জৌনপুরী তোড়ী, বাহার ইত্যাদি বহু নূতন রাগ-রাগিণী মুসলমানদের হাতে জন্ম লাভ করেছে।
সুতরাং স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছেন সঙ্গীতকে এক শ্রেণীর মৌলবী সাহেবরা নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া দিলেও ইসলাম কিন্তু সঙ্গীতের সঙ্গে চিরবিজড়িত। মুসলমানের কোরআন-হাদিস এবং সুদীর্ঘ ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিহাসই তার প্রমাণ। আশ্চর্যের বিষয়-খোদা যেখানে নীরব, রসুল যেখানে নীরব, খলিফাতুল মুমেনিনরা যেখানে প্রশ্রয়দাতা, সেখানে আজ তেরো শ’ বছর পরে এতদ্দেশীয় এক শ্রেণীর মৌলবীরা পঞ্চমুখ হয়ে ফতোয়া দিচ্ছেন যে— গান বিলকুল হারাম। যেন সঙ্গীতের এই সমস্যা স্বয়ং আল্লা, রসুল বা খলীফাদের জানা ছিল না । যেন মুসলমান আমলের শরিয়ত-পন্থী বড় বড় বাদশা, কাজী, মুফতী প্রভৃতি কারও মনেই এ সমস্যার উদয় হয়নি, অথবা তাঁরা যেন কেউ-ই এ সমস্যা সমাধান করবার যোগ্যতা রাখতেন না ।
উক্ত মৌলবী সাহেবরা সঙ্গীত সম্বন্ধে যে আপত্তি উত্থাপন করেন, তা এক হাস্যকর ব্যাপার। কেউ আমাকে বলেছিলেন— আপনার যে গলা কাঁপিয়ে রাগ-রাগিণী বার করেন, তার জন্যই সঙ্গীত হারাম হয়ে যায়। নতুবা কোরআন শরীফের মতো সুর করে কোনো কিছু পড়লে কিছুই দোষ হয় না। এ কথার কোনোই মূল্য নাই। রাগ-রাগিণী, আর যাকে বলে ‘খোশ এল্হান’-এরা উভয়ই একই মার পেটের সন্তান, -গলা জড়াজড়ি করে আছে। ওদের মধ্যে কোনো সীমারেখা নাই। তাছাড়া রাগ-রাগিণীই বলুন আর ‘এল্হানই’ বলুন— কোনো ধ্বনিই সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি এই সুর সপ্তকের বাইরে নয়। শুধু Permutation ও Combination -এর যা তফাৎ! রাগ-রাগিণীও যেমন হারমোনিয়ামে বাজিয়ে দেওয়া যায়, কোরআন পাঠও তেমনি হারমোনিয়ামে বাজানো যায় । মানব কণ্ঠের যে-সুর বাঁধা আছে, তার বাইরে কোনো কথা নাই। আর এক মৌলবী সাহেব আমাকে বলেছিলেন— “আপনারা যে তাল দিয়ে গান করেন, সেই তালই হচ্ছে হারাম।” ঐ কথাও মূল্যহীন । তাল তো অন্য কিছু নয়, শুধু সময়ের সমতা রক্ষা করা মাত্র ।
গান যদি যায়েজ হয়, তবে তাল হারাম হবে কেন? তাল তো মানুষের বহু কার্যের মধ্যেই বিদ্যমান । প্রতিদিন যে দরুদ শরীফ পাঠ করা হয়, তার মধ্যেও তো তাল রাখে।
বিশ্ব-প্রকৃতিই তো ছন্দ-তালে পরিপূর্ণ । ঋতুচক্রের আবর্তনের নৃত্যে কোনো দিন তো তাল কাটে না। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত-সবাই তো তালে তালে নেচে যায়। গাছে গাছে ফুল ফোটে, ফল ধরে-সবই তালে তালে। আগে-পিছে হয়ে তারা কেউ আসে না । চন্দ্র- সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র তালে তালেই আসে, তালে তালেই চলে যায়। আমাদের এই দেহের মধ্যেও তো তালের লীলা-খেলা চলেছে। ধমণীতে যে রক্ত-স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, তার মধ্যে চমৎকার তাল রয়েছে। কি সুন্দর তালে তালেই না নাড়ি আমাদের স্পন্দিত হচ্ছে। কি সুন্দর ছন্দ-তালেই না ফুসফুস নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছে। বস্তুতঃ এই তাল রক্ষা করে চলাই হচ্ছে স্বভাবধর্ম। তাল যখন কেটে যায়, তখনই বিপদ ঘটে। নাড়ীর গতি অসম হয়। তখনই বুঝতে হবে-একটা কিছু বিমার হয়েছে। বস্তুতঃ তাল কেটে গেলে সৃষ্টির সব কিছু বেসুরো ঠেকতো, সৃষ্টি অচল হতো ।
এইবার সাধারণভাবে একটু আলোচনা করা যাক্ । সঙ্গীত মানুষের এত প্রিয় কেন? হাজার হাজার মৌলবীর লক্ষ লক্ষ ফতোয়াও মানুষকে সঙ্গীত থেকে বিরত রাখতে পারে না কেন? তার কারণ-সঙ্গীতের সঙ্গে মানব-মনের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আছে। এই নিখিল সৃষ্টির মূলে আমি শুধু দুটি উপাদানই লক্ষ্য করি— সে হচ্ছে সুর আর রূপ । সুর আর রূপের ভিতরেই সৃষ্টি ডুবে আছে । আকাশে তাকাও, পাতালে তাকাও-সর্বত্র রূপের লীলাখেলা । পথে-প্রান্তরে অন্তরে-বাহিরে যে দিকে যখনই কান দাও, সর্বত্র সুরের লীলা-তরঙ্গ। বিশ্ব- বীণার তারে তারে নিশি-দিন সুর ধ্বনিত হচ্ছে। সেই Music of spheres যাদের কান আছে, তারাই শুনতে পায় ৷
এই যে সুর আর রূপের কথা বলছি, তার উপাদান সৃষ্টির মধ্যে যেমন লুকিয়ে আছে, মানুষের মনের মধ্যেও তেমনি লুকিয়ে আছে। খোদাতালা মানুষকে সুর আর রূপ দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। সুর আর রূপে তাই মানব-হৃদয় এমন করে সাড়া দেয়। কাজেই ফতোয়া যদি দিতে হয়, তবে সে ফতোয়া মানুষের উপর নয়-খোদাতালার উপর দিতে হবে। খোদাতালাকে বলতে হবে-হে খোদা, তুমি মানুষকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করো, সে ভালো, কিন্তু দোহাই তোমার,-সেই মাটির ভিতর তোমার সুরের সুধা আর রূপের রং মিশিয়ে দিও না! এ না হলে এই দুনিয়ায় ফতোয়া দিয়ে মানুষকে আমরা কাবু করতে পারি না!
মানব-মনে সুর আর রূপের উপাদান যে আছে, তা একটা প্রবাদ বাক্যেও পরিষ্কার বুঝা যায়। আদমের দেহাভ্যন্তরে (কবের মধ্যে) যখন খোদাতালা রুহ (আত্মা) প্রবিষ্ট করান, তখন রুহ্ সেখানে থাকতে চাইলো না, ছট্ফট্ করে বেরিয়ে এলো। তখন খোদাতালা ফেরেশতাদিগকে বললেন— সেই কলবের কুঠরিতে আলো দিতে। অপূর্ব রূপচ্ছটায় কল্ব আলোকিত হয়ে গেল। তখন রুহকে পুনঃপ্রবিষ্ট করানো হলো । এবারও রুহ্ থাকতে চাইলো না। তখন খোদাতালার হুকুম হলো-কলবের চারিদিকে সুমধুর বাদ্যধ্বনি করো। এইবার রুহ্ শান্ত হয়ে আদমের দেহে রয়ে গেল ।
এই উপাখ্যানের মূলে গভীর সত্য নিহিত আছে। বাস্তবিকই সুর আর নূর ছাড়া সৃষ্টি অচল হতো। এই যে বিশ্ব-প্রকৃতি নিতি-নবভাবে এমন রূপ-সুষমায় প্রকাশ পাচ্ছে, এই যে ফুল ফুটছে, চাঁদ হাসছে-দিকে দিকে, লোকে-লোকে এই যে সুমধুর সঙ্গীত-ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে, এ একবারে নিরর্থক নয়। বিরাট বিশ্বের সমবেত আত্মাকে (রুহ্) মশুল করে রাখবার জন্যই খোদাতালার এই বিপুল আয়োজন; বিশ্বের বিরহী আত্মা (রুহ্) এই পরের ঘরে থাকতে চায় না, বিচ্ছেদ-বেদনায় বেরিয়ে যেতে চায়, তাই খোদাতালা তাঁর রূপ ও তাঁর সুর দিয়ে তাকে শান্ত করলেন। সুর আর রূপের মধ্যে আমাদের আত্মা তার পরমাত্মীয়ের পুলক-পরশ অনুভব করে বলেই যা কিছু সান্ত্বনা। বিরহী আত্মা তার প্রিয়তমের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কতো দূরে এসে পড়েছে; এ যে অ-জানা অ-চেনা দেশ; এখানে সে নিতান্ত নিঃসঙ্গ, তাই সে তার প্রিয়তমের খোঁজে ব্যাকুল । প্রিয়তমের দেখা সে পায় না, শুধু পায় একটু আভাস-একটু চরণধ্বনি শুধু দেখে তার রূপের ছটা, শুধু শোনে তার নুপুর-গুঞ্জন! এই রূপের ছটা আর গুঞ্জন-গীতিই তাকে যেন পথের সন্ধান বলে দেয়, যেন বলে—“এই পথ দিয়ে উঠে এসো, আমার সন্ধান পাবে।” যে মানুষের অন্তর এই দু’টি পথের ইঙ্গিতকেই অস্বীকার করে, তার আবার কিসের বিরহ, কিসের কান্না, কিসের ব্যাকুলতা, প্রিয়তমের সন্ধান পাবার তার কোনো ভরসা নাই। Shakespeare এই রকম লোক সম্বন্ধেই বলেছেন-তারা ‘fit for treason and murder.’খোদাতালার এই সঙ্গীত-জলসা আর এই রূপের মেলা তাদের কাছেই শুধু ব্যর্থ।
মানুষের জীবনে ললিত-কলার প্রয়োজন আছে। যে জাতীয় উন্নতির দোহাই দিয়ে সঙ্গীত ও অন্যান্য কলা-বিদ্যাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, সেই জাতীয় উন্নতির জন্যও এর অপরিহার্য দরকার । সৌন্দর্য-পিপাসা মানুষের মনকে সুন্দর করে, অসুন্দরকে ঘৃণা করতে শিখায়। যার মনে সৌন্দৰ্য্যবোধ জন্মেছে, সে ভিতরে বাহিরে কোনো দিক দিয়েই অসুন্দরের সঙ্গে মিতালি করতে পারে না; তাজমহলের সৌন্দর্য্য যদি আমায় পাগল করে তোলে, তবে কুঁড়ে ঘরে নোংরা জীবন যাপন করতে আমর সাধ যায় না। একটা অভাবের তীব্র অনুভূতি সারা চিত্তকে চঞ্চল করে তোলে। আজ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রতি কার্যে আমরা অসুন্দরকে নিয়ে ঘর করছি। আমাদের যা আছে তাতেই আমরা সন্তুষ্ট হতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। সৌন্দর্যবোধের অভাবই এর মূল কারণ। অসুন্দরকে জয় করি আমরা সুন্দর হবো-এই আগ্রহ আজ আমাদের নেই। আমাদের জীবনে সৌন্দর্য ও সুর নেই-উচ্ছৃঙ্খল, এলোমেলো জীবন আমরা যাপন করছি। তার মধ্যে কোনো নিয়ম- শৃঙ্খলা বা তাল নেই । কাজেই সুর আর রূপের আমাদের এত দরকার । আজ যদি আমরা ললিত-কলার অনুরাগী হই, তবে আমরা ধর্মে-কর্মে, ভিতরে-বাহিরে সব দিক দিয়েই সুন্দর হতে পারবো ।
অবশ্য একটা কথা আছে। মৌলবী সাহেবরা সঙ্গীতকে যে দু’চোখ পেতে দেখতে পারেন না, তার যে একবারেই কোনো কারণ নেই, তাও মনে করবেন না। সঙ্গীত বলেই যে সঙ্গীত হারাম তাও যেমন নয়, আবার সঙ্গীত বলেই যে সঙ্গীত হালাল, তাও তেমনি নয়। প্রত্যেক জিনিসেরই ভালো-মন্দ আছে। দেশ, কাল ও পাত্র ভেদে সব জিনিসেরই বিচার করতে হয়। সঙ্গীত একটা তলোয়ার বিশেষ। যার হাতে যখন থাকে তার ইঙ্গিতেই চলে। ভালো লোকের হাতে থাকলো ভালো ফল হয়, মন্দ লোকের হাতে থাকলে মন্দ ফল হয়। সঙ্গীত এক দিকে যেমন মানবাত্মাকে শাস্ত্রের সকল সীমারেখা অতিক্রম করে অনন্ত ভাবরাজ্যে নিয়ে যেতে পারে, তেমনি আবার তাকে ধ্বংসের মুখেও ফেলে দিতে পারে। অবশ্য এ সঙ্গীতের দোষ নয়, এ সেই ব্যবহারকারীর দোষ। এমন যে হালাল জিনিস ভাত, তাও বিকৃত করে খেলে হারাম হয়ে যায়। কাজেই সর্বত্র আমাদের বিচার- বুদ্ধির দরকার। যে সঙ্গীত আমাদেরকে সুন্দর করতে পারে, আত্মাকে উন্নীত করতে পারে, সেই সঙ্গীতই আমরা চাই। পবিত্র অন্তর দিয়ে সঙ্গীতের সাধনা করতে হবে, তা হলেই সঙ্গীত ইসলামের বাহন হবে। ইসলাম অশরীরী ভাবেই ধর্ম, জড়ত্বকে সে স্বীকার করে না । মানবাত্মার সূক্ষ্ম অনুভূতিকে সে সারা প্রাণ দিয়া উপলব্ধি করে। কাজেই এই অশরীরী ভাবকে মনের মধ্যে মূর্ত করে তুলতে সঙ্গীতই হবে বড় একটা সহায়, কেননা অনন্তকে সান্তের মধ্যে রূপ দেওয়াই হচ্ছে সঙ্গীতের চরম সার্থকতা। অবশ্য এ উদ্দেশ্য সফল করে তুলতে হলে, আমাদের আদর্শ অনুযায়ী নূতন নূতন সঙ্গীত রচনা করতে হবে-যা সহজ ভাবেই আমরা প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করতে পারি। “এমন দিন কি হবে মা তারা”-এ রকম গান গাইলে আপনারা মৌলবীদের সঙ্গে ঝগড়া করে এঁটে উঠবেন না ।
আমার মনে হয়, সঙ্গীতে যে মুসলমান চিরদিনই শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করে আসছে, তার প্রধান কারণই হচ্ছে, সে মুসলমান। ইসলামই সঙ্গীতের উপযুক্ত ক্ষেত্র। সঙ্গীতের যে সাধনা, ইসলাম তার থেকে দূরে নয় । মুসলমানের মনে কোনো স্থূলত্ব বা জড়ত্ববোধ নাই, নিরাকারের ধেয়ানী সে, অনন্তের রাজ্যে সে যাওয়া আসা করে, তাই একান্ত ও তন্ময় হয়ে সে গান করতে পারে, তাই তার সুরের মুকুরে অসীমের ছায়া পড়ে, তাই তার কণ্ঠ- সঙ্গীত এত প্রাণবন্ত, এত জীবন্ত হয়ে ওঠে। কোনো পীর সাহেবের মুখে যদি কখনো গান শুনতে পেতাম, তবে তার চেয়ে সুন্দর জিনিস বোধ হয় আর কিছু হতো না ।
পরিশেষে বলতে চাই- সঙ্গীত সম্বন্ধে মৌলবী সাহেবদের সঙ্গে আমাদের একটা আপোষ হওয়া নিতান্ত দরকার। সঙ্গীতের খারাপ দিক (Sark side) সম্বন্ধে আমাদিগকে যেমন হুঁশিয়ার হতে হবে, মৌলবী সাহেবদেরকে তেমনি সঙ্গীতকে জীবনের মধ্যে গ্রহণ করতে হবে । খোদাতালার এই যে সুন্দর আকাশ, পৃথিবী, এই যে রূপের আলো, এই যে বিচিত্র সুরের খেলা,—তাঁর অস্তিত্বের এই যে পুলক-পরশ এ যেন তাঁদের জীবনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে না যায় ।