হুযাইফা মুহাম্মাদ, Hujaifa Muhammad, proggapath, progga, bangla literature, প্রজ্ঞাপাঠ, বাংলা সাহিত্য, Rokte Ranga Phul, রক্তে রাঙা ফুল, গল্প, বাংলা গল্প, রহস্য গল্প, রম্য রচনা

রক্তে রাঙা ফুল

০ মন্তব্য দর্শক

এক

“অপেক্ষা জিনিসটা আসলে কষ্টের, সব কষ্টের ফলই মধুর হয়। অপেক্ষার ফলও কি মধুর হয়? নাকি কখনো কখনো মানুষ ‘অপেক্ষা’ নামক কষ্টটি করে থাকে কেবল আঁজলা ভর্তি বিষাদ আর বিষাদের বেদনা অনুভব করতে!”

জাহরা দাঁড়িয়ে আছে জলপাই বাগানের শেষ মাথার একটা বৃদ্ধ জলপাই গাছের আড়ালে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে না মেয়েটা কারো অপেক্ষায় অপেক্ষারত। অপেক্ষমান মানুষদের মতো তার অবয়বে চঞ্চলতা নেই। মুহূর্তে মুহূর্তে আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি নেই। বরং ফুটন্ত পুষ্পের মতো তার মাঝে স্থিরতা বিরাজ করছে। কোন এক সুপ্ত আত্মবিশ্বাসে যেন সে অনড়। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ নেই।স্বাভাবিক ভাবে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে অস্পষ্ট কিন্ত শান্ত স্বরে বললো, “নির্বোধ একটা, এতক্ষণ লাগে নাকি!”

আরো দু’পা এগিয়ে সামনের জলপাই গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো জাহরা নামের ফুলের মতো ফুটন্ত কিশোরী। এতটা সামনে আগানো হয়তো ঠিক হয়নি। আম্মির নির্ধারণ করা জলপাই বাগানের যে সীমানা ছিলো, দশ হাত পিছনেই তা রেখে এসেছে। জাহরা এখন যে জায়গায়টায় দাঁড়িয়ে আছে, আম্মির কাছে জাহরার জন্য এটা নিষিদ্ধ জায়গা।

জাহরা মনে মনে ভাবে, জায়গাটা তো ঘর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তবুও কেন আম্মি এত ভয় পায়! আচ্ছা এমন কি হতে পারে মারা যাওয়ার আগে আব্বু আম্মির মনে অনেকগুলো ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো? সেই থেকেই কি আম্মি সবকিছুতে ভয় পায়!। আমাকে বাহিরে দিতে ভয় পায়। মাথার উপর দিয়ে যখন শা শা শব্দ করে কোন বিমান উড়ে যায়, আম্মি তখন ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠেন। জাহরার তখন খুব ইচ্ছে করে আম্মিকে জিগ্যেস করতে, ‘আম্মি! ভয় পেয়েছো?’

কিন্তু কোন এক অস্পষ্ট জড়তায় আর জিগ্যাসা করা হয়ে উঠে না। আব্বুর শূন্যতা তখন সে খুব তীব্রভাবে অনুভব করে। আব্বু থাকাকালীন কি সুন্দর দিন কাটতো তাদের। গাযা শহরের এককোনে পাখির মতো ছোট্ট একটা বাসা ছিলো জাহরাদের। বাসার দেয়ালের এক পাশে ফাটল ধরা। ভরা পূর্ণিমায় ফাটলের ফাঁক গলে চাঁদের আলো চুইয়ে চুইয়ে মেঝেতে প্রতিফলিত হয়। জাহরার বাবার যেন চাঁদের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা চলছিলো। একদিন জাহরার বাবা ঘোষণা করলেন, চাঁদের আলো যেন ঘরে আসতে না পারে, সে জন্য দেয়ালটাকে মেরামত করা হবে। উক্ত ঘোষণায় সবাই বোধহয় খুশী । কেবল জাহরারই যেন একটু রাগ আর অজানা দু’মুঠো কষ্ট একাকার হয়ে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। জাহরার মন খারাপের কারণ কি? দেয়াল মেরামত করলে ঘরে চাঁদের আলো আসবেনা তাই?

কারণ যাইহোক। সেই দেয়াল আর মেরামত করা হয়নি। এক রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরে, গাযার পরিস্কার আকাশে হটাৎ কুন্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উড়তে শুরু করলো। ‘লেজার গাইডেড এয়ার টু গ্রাউন্ড’ মিসাইলের শব্দে হাজার হাজার মানুষের চিৎকার-আহাজারি চাপা পরে যায়। একটার পর একটা র‍্যাম্পেজ মিসাইল গাযার জমিনে আঘাত হানছিলো আর গাযার স্থাপনাগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছিলো। উচ্চ ইমারতগুলির একেকটি ইট একেক দিকে ছিটকে ছিটকে পরছিলো।

জাহরা তার আব্বুর গলা খুব শক্ত করে ধরে আছে। তার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা ভয়ে কাঁদছে না। যদি তার কান্নার আওয়াজ কেউ শুনে ফেলে। যদি কান্নার আওয়াজ লক্ষ্য করে বোমা ফেলে! এই ভয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বাবার বুকে মাথা লুকিয়ে রইলো জাহরা।

গাযায় তখন প্রলয় চলছে। ভয়ঙ্কর প্রলয়। এই ভয়ঙ্কর প্রলয়ের মাঝে আরেকটা ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটে গেছে। তা হচ্ছে, জাহরার আম্মিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও জাহরার বাবার পাশেই ছিলো। নিরাপদ আশ্রয়ে এসে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো তিনি নেই। তারমানে নিরাপদ স্থান অবধি আসতে পারেনি। জাহরার আব্বু একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক কে ডাকলেন। ভদ্রলোকের নাম সোলাইমান। জাহরার আব্বুর অতি কাছের বন্ধু। সোলাইমান সাহেবও পরিবার নিয়ে ভাগ্যের নির্মমতার সম্মুখীন।

ভাইজান জাহরাকে রাখেন, “আমি ওর মা’কে খুঁজতে যাচ্ছি।” এতটুকু বলেই সোলাইমান সাহেবের দিকে জাহরাকে বাড়িয়ে দিলেন।এতক্ষণ নিশ্চুপ জাহরা চিৎকার করে উঠলো। দুই হাতে যতটুকু পারলো বাবার নীল শার্টের কলারটা আঁকড়ে ধরলো। বাবাকে যে কিছুতেই যেতে দেওয়া যায় না। কিছুতেই না। বাবাই যেন জাহরার বেঁচে থাকার ভরসা। বাবা কে ছাড়া যে সে একমুহূর্তও কল্পনা করতে পারেনা।

: ছাড়ো মামণি, ছাড়ো। আমি তোমার আম্মিকে নিয়ে আসছি। ছেড়ে দাও। আব্বু আবার আসবে তো…কথা গুলো বলতে বলতে জাহরার বাবা ডুকরে কেঁদে উঠলো। জাহরাও হয়তো বুঝতে পেরেছিলো, আজকে বাবাকে ছেড়ে দিলে হয়তো দ্বিতীয়বার বাবাকে জড়িয়ে ধরার ফুরসত আর কখনোই মিলবে না। জাহরা বাবাকে যেতে দেয় না। কিন্তু নিয়তি যার প্রস্থান অবধারিত করে রেখেছে, তাকে ধরে রাখার সাধ্য হয় কার?

আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধা নামার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। সূর্যাস্তের আলো-আঁধারি একাকার হয়ে বিধ্বস্ত গাযার রূপ যেন আরো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। সমস্ত গাযা রক্তে রক্তে রঙিন। মানুষজন ধ্বংসস্তুপের মাঝ থেকে স্বজনদের লাশ বের করতে ব্যস্ত। ‘তারেক বিন যিয়াদ’ রোডের দিকটায় কোন আস্ত লাশ নেই। শুধুই ছিন্নবিচ্ছিন্ন মাংসের টুকরো। একজন মানুষের যতটুকু ওজন, ততটুকু মাংস মেপে পলিথিন করে দাফন করা হচ্ছে। দাফনের জন্য জমাকৃত মাংসের একটি স্তুপে হাত-পা-মাথা ছাড়া কেবল একটা দেহ দেখা গেলো। শরীরে জড়ানো নীল শার্ট। কলারটার কিছুটা অংশ নেই। তবুও সহজেই অনুমান করা যায় লাশটা একজন বাবার। যেই বাবা স্বীয় কন্যাকে ফিরে আসার ওয়াদা দিয়ে গিয়েছিলো। তার ফুলের মতো মেয়েটি তো তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। কিন্তু কে জানতো! এই অপেক্ষার প্রহর যে আর কখনো শেষ হবে না।

দুই

সোলাইমান সাহেবের এক ছেলে এক মেয়ে। আছিয়া এবং ইয়াছির। ইয়াছির আছিয়া থেকে দু’বছরের বড়। ভাই-বোনের মাঝে প্রচন্ড ভাব।ইয়াছির সর্বদা বোনকে আগলে আগলে রাখে। আছিয়ার শিশুসুলভ চাওয়া গুলো পূর্ণ করতে চেষ্টা করে। ইয়াছিরের একমাত্র খেলার সাথীও এই আছিয়া। তবে এবার সাথে আরেক জন যুক্ত হয়েছে।

সোলাইমান সাহেবের ঘর বাড়ি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হলে তিনি গাযা শহর ছেড়ে তার মামার বাড়ি ‘আল জাওয়াসি’ নামক গ্রামে চলে যান।জায়গাটি উপকূলের খুব অদূরে জলপাই বাগান ঘেরা একটি গ্রাম। জনবসতি একবারেই কম। গাজার মর্মান্তিক বিমান হামলার তিন দিন পর যখন জাহরার বাবা-মা কাউকেই পাওয়া গেলো না। বন্ধুর আমানত (জাহরাকে) বুঝিয়ে দেওয়ার মতো মানুষ যখন পৃথিবীতে আর নেই। তখন নিজেই জাহরার অভিভাবক হয়ে গেলেন সোলাইমান। জাহরা তখন সোলাইমান পরিবারেরই একজন সদস্য।

জাওয়াসি আসার পথে জাহরা সোলাইমান সাহেবের স্ত্রী-কে বললো: চাচী আমার খুব শীত করছে। ইয়াছিরের আম্মি জাহরার গা ছুঁয়ে আঁতকে উঠেন। শরীর যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তখনো গাড়ি গাযার এরিয়া ত্যাগ করেনি। গাড়ি ঘুরানো হলো। জাহরা কে নিয়ে যাওয়া হলো তীরবর্তী ‘শিফা হসপিটালে’। চিকিৎসকের রুম থেকে বের হয়ে এক্সিটের জন্য বিশাল একটা হল রুম পারি দিতে হয়। জাহরা কে নিয়ে হলরুম ধরে বের হতে যাবে ঠিক সেই সময়, একজন মহিলা ‘জাহরা,আমার জাহরা’ বলে বলে চিৎকার করতে লাগলো। মহিলার কোমরের নিচ থেকে বাকি অংশটুকু নেই। ধারণা করা যায় তিন দিন পূর্বের বোমা হামলায় মানুষটি পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। মেঝেতে চাদর বিছিয়ে রোগিদের জন্য যেইসব বেড তৈরি করা হয়েছে, তেমনই একটা বেডে বসে ছিলো মহিলাটি।

চোখাচোখি হতেই আম্মি বলে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরলো জাহরা। মা-মেয়ে দুনোজনই সমান তালে সে কি কান্না। আছিয়ার আম্মি মা-মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। জাহরার আব্বুর শহীদ হওয়ার সংবাদ জানানো হলো। সোলাইমান সাহেব বললেন: ভাবী! গাযায় আমাদের ঘর বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। মাথা রাখার ঠাঁই হিসেবে আল-জাওয়াসিতে মামার কিছু জমিজমা আছে। সন্তানদের জন্য গাযা নিরাপদ নয়। আপনার অবর্তমানে জাহরা সহ আমরা সবাই জাওয়াসিতেই যাচ্ছিলাম। আপনিও যদি ভাবী আমাদের সঙ্গে যেতেন, তাহলে আমরা খুবই খুশি হই।

জাহরার আম্মি প্রথমে না-ই করলেন। যে জমিনে প্রিয় স্বামী শহীদ হয়েছেন, সে জমিনে তিনিও মৃত্যুর স্বাদ নিতে চান। কিন্তু খোদার মর্জির উপরে তো বান্দার ইচ্ছা কখনোই প্রাধান্য পেতে পারে না। শেষমেশ জাহরার আম্মির জাওয়াসি যাওয়ার মর্জি হলো। যেমনটা খোদার ইচ্ছা।

ইয়াছিরদের ঘরের পিছনের ঘরটাই দেওয়া হলো জাহরাদের। জাহরার আম্মির পা নেই। পঙ্গুত্ব নিয়ে কোন কাজই করতে পারেন না তিনি।তার সর্বত্র সহোযোগিতায় ইয়াছিরের আম্মি সর্বদা পাশে থাকেন। জাহরা তার স্মৃতির পাতার ভয়ঙ্কর চিত্র গুলো ভুলে থাকার জন্য দু’জন সাথী পেলো। সন্ধার পর জাহরা, ইয়াছির-আছিয়ার আম্মির কাছে তিনজন মিলে পড়তে বসে। ইয়াছির আর আছিয়ার সাথে জাহরার ভাব জমতে সময় লাগলো না। অল্প দিনে ওদের বন্ধুত্ব বেশ জমে গেলো। যেন তিন দেহের এক আত্মা। দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলায় তিন জনের একজনকে ছাড়া যেন জমেই না।

আনেমোন জাহরার অতি প্রিয় একটি ফুল। ভূমধ্যসাগরীয় এই লাল রঙা ফুলের সংস্পর্শ জাহরার প্রতিদিনই চাই। আর জাহরার প্রতিদিনের এই ছোট্ট চাওয়াগুলো যে মানুষটি খুবই আগ্রহের সাথে পূরণ করে সে হচ্ছে ইয়াছির ভাইয়া। জাহরার ছোটো ছোটো এইসব আবদার গুলো পূরণ করতে পারলে ইয়াসিরের বুকের ভিতরটা যেন প্রশান্তিতে পূর্ণ হয়ে যায়। বিশাল জলপাই বাগান পেরিয়ে রক্ত রঙা আনেমোন নিয়ে এসে যখন ফুলগুলো জাহরার হাতে দেয়, জাহরা তখন আনন্দে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। জাহরার এই মিষ্টি হাসিটা দেখতে ইয়াছিরের কি…যে..ভালো লাগে।
ইয়াছির জিগ্যেস করে, “জাহরা এভাবে হাসছো কেন?”
“ফুল পেয়ে। তুমি জানো, লাল আনেমোন ফিলিস্তিনের প্রতীকী জাতীয় ফুল হিসেবে বিবেচিত। যা শহীদদের রক্ত, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তুলে ধরে “
“ও তাই নাকি? তুমি কিভাবে জানলে?”
“আমার আব্বু যখন আমাদের সাথে ছিলো, তখন তিনি আমায় বলে ছিলেন।”

জাহরার বাবার কথা উঠার পর কেউ আর কোন কথা বলে না। অনেকটা সময় চুপচাপ কেটে যায়। নিরবতা ভেঙে জাহরা হাতের ফুলগুলো ইয়াছিরের সামনে ধরে প্রশ্ন করলো, “সুন্দর না?”
ইয়াছির হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। কিছুক্ষণ পর বললো, “জাহরা তুমি কি জানো, “তুমি যে আনেমোন থেকেও সুন্দর?”

ইয়াছির ভাইয়ার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে আবারও খিলখিলিয়ে হেসে উঠে জাহরা। লজ্জা পেয়ে জলপাই বাগানের দিকে দৌঁড় দেয়। “জাহরা শোন, দাঁড়াও, বলে ইয়াছিরও জাহরার পিছু নেয়। ছোট্ট আছিয়া তাদের দৌঁড়াদৌঁড়ি দেখে ভাবে পুনরায় হয়তো দৌড় খেলা শুরু হয়েছে। সেও দু’জনের পিছনে ছুটতে থাকে।

সোলাইমান সাহেব প্রায়সময়ই তাদের উৎসবমুখর আনন্দ দেখে থমকে দাঁড়ায়। দূর থেকে স্থিরনেত্রে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, সুখহারা বাচ্চাগুলা কি তাহলে সুখ খোঁজে পেলো? বাচ্চাদের আনন্দ দেখে তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পরেন। তার মন কল্পনায় গাযার অলিতে-গলিতে ঘুরপাক খায়। এই বাচ্চাদের মতোই তো কত ফুল গাযার পথে পথে ছোটাছুটি করতো। আজ তারা কোথায়? জান্নাতে?সোলাইমান সাহেব আর ভাবতে পারেন না। তিনি কাজের উদ্দেশ্যে বাড়ির আঙ্গিনা ত্যাগ করেন।

জাহরা দৌঁড়ে এসে আম্মির কোলে ঝাঁপিয়ে পরে। হাতে থাকা আনেমোনের গুচ্ছটা দেখিয়ে বলে “আম্মি! ইয়াছির ভাইয়া দিয়েছে।”

জাহরার আম্মি জাহরাকে কাছে টেনে মাথায় বিলি কাঁটতে থাকে। আদর পেয়ে জাহরাও মায়ের কোলে শরীর ছেড়ে দেয়। বলতে থাকে, “আম্মি! ইয়াছির ভাইয়া আমাকে কি বলেছে জানো? বলেছে, আমি নাকি আনেমোন থেকেও সুন্দর।” কথাটা বলেই খিলখিলিয়ে আবার হেসে উঠে।
জাহরার খোলা চুলগুলো বেণি করতে করতে আম্মি বললো, “বলো তো জাহরা নামের অর্থ কি?
জাহরা মায়ের দিকে তাকায়। আম্মি বলে যেতে থাকে, “জাহরা নামের অর্থ হচ্ছে ফুল। তুমি তো আমাদের প্রথম সন্তান। তুমিই আমাকে প্রথম মাতৃত্বের সৌরভ দিয়েছো।সৌরভ তো ছড়ায় ফুল।তাই আমি তোমার নামও ফুল(জাহরা) রাখি। যদিও তোমার আব্বু ভেবে রেখেছিলো তোমার নাম রাখবে ‘মুনতাকিমা’।
আম্মির মুখ থেকে কথা কেড়ে জাহরা উল্টো প্রশ্ন করলো, “মুনতাকিমা অর্থ কি আম্মি?”

জাহরার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, “মুনতাকিমা অর্থ হচ্ছে প্রতিশোধ গ্রহণকারী।

জাহরা বললো, তাহলে আমি “মুনতাকিমাই হবো। গাযায় যারা আমাদের উপর হামলা করেছে, আমি তাদের উপর প্রতিশোধ নিবো “

জাহরার কথা শুনে আম্মি কান্না আর সংবরণ করতে পারেন না। মুখে আঁচল ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমরা এখানে থাকবো না জাহরা, আমরা গাযায় ফিরে যাবো। তোমার আব্বুর রক্তে যে জমিন রঞ্জিত হয়েছে, সে জমিনেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবো। আমরা গাযায় চলে যাবো।”

চলে যাবো চলে যাবো করে দশ বছর এই জাওয়াসির মাটির উপর কেটে গেলো। আমাদের আর গাযায় ফেরা হলো না। দশ বছরে পৃথিবীর অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে, কেবল পরিবর্তন হয়নি ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডের রক্তাক্ত ভাগ্যাকাশ, যেখানে এখনও শিশুদের কান্না আর বিধবার আহাজারি মাঝেমধ্যেই ইসরাইলের বোমায় স্তব্ধ হয়ে যায়।

তিন।

অপেক্ষার সময় দীর্ঘ হলেও জাহরার ধৈর্যের বাধ ভাঙেনি।

অবশেষে দূরে ছায়ার মতো ইয়াছিরের অবয়ব দেখা গেলো।জাহরা মনে মনে ভেবে রেখেছিলো,দেড়ি করার অপরাধে ইয়াছিরকে কিছু ঝাল কথা শোনাবে। কিন্তু ইয়াছিরকে দেখার সাথে সাথেই তার অভিপ্রায় পরিবর্তন হলো।ইয়াছিরের চেহারায় কিছু একটা আছে বৈকি।তার চেহারার দিকে তাকিয়ে তার সাথে কোন রূঢ় আচরন করা জাহরার পক্ষে সম্ভব না।জাহরা আজকে একটা জিনিস বুঝতে পারলো,এতদিন তাহলে ইয়াছির কত কষ্ট করেই না তারজন্য আনেমোন তুলে আনে।গত দশ বছরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মতো প্রতিদিন নিয়ম করে ইয়াছির যে কাজটি করে গেছে তা হলো জাহরার জন্য আনেমোন তুলে আনা।আজকে জাহরা বললো আমাকেও নিয়ে যাওনা সাথে করে।জলপাই বাগান অবধি এসে, খোলা প্রান্তরে আর জাহরাকে সাথে নিলো না। ইয়াছির নরম স্বরে বললো:এখানেই অপেক্ষা করো জাহরা।আর সামনে যাওয়া তোমার উচিত হবে না।

আনেমোন হাতে ইয়াছির কাছাকাছি আসতেই জাহরার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা খেলে গেলেও সে নিজেকে সংযত রাখল।

:”মাফ করো জাহরা, একটু দেরি হয়ে গেল।”

জাহরা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “এতক্ষণ কী করছিলে, ইয়াছির?” স্বরে খানিকটা কঠোরতা, তবে সুরের নিচে লুকানো এক ধরনের স্নেহমিশ্রিত অধিকারবোধ।

ইয়াছির কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর শব্দে প্রচন্ড ভাড়ী কিছু একটা জমিনে পতিত হলো।বিকট শব্দের কারণে ইয়াছির – জাহরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো। এতক্ষণে বুঝতে পারলো ইসরাইলীরা বিমান থেকে বোমা হামলা করছে।শেষমেশ আল – জাওয়াসিতেও হামলা?এতো ছোটো একটা গ্রামও কি ধ্বংসের হাত থেকে বাদ যাবে না? তাহলে কি ফিলিস্তিনের একটা এলাকাও ইসরাইলীলের হামলা থেকে নিরাপদ নয়?

ইসরাইলী বিমানগুলোর টার্গেট হয়তো ছিলো জনবসতি। আল জাওয়াসির ক্ষুদ্র জনবসতি ধ্বংস করতে ইসরাইলি F-15I “Ra’am” বিমানের সময় লাগলো কেবল এক মিনিট একুশ সেকেন্ড। এই এক মিনিট একুশ সেকেন্ডে প্রাণবন্ত একটা ছবির মতো গ্রাম ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।

ইয়াছির – জাহরা গ্রাম থেকে দূরে থাকায় কোনরকম ক্ষয় – ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি। তারা যখন দীর্ঘ জলপাই বাগান পেরিয়ে গ্রামে পৌঁছালো, জাহরাদের ঘরে তখনও দাউদাউ করা আগুন জ্বলছে।জ্বলন্ত ঘরের দিকে দৌড়ে যেতে যেতে জাহরা চিৎকার করে বলছে:’আমার আম্মি কোথায়? আমার আম্মি? আম্মি! আম্মি!! আম্মি…………!!!

জাহরার জ্ঞান ফিরলো পরদিন সকালে। চোখ মেলে ধাতস্থ হয়ে অস্ফুট স্বরে বললো: ‘আমার তো আর হারানোর কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না,কিচ্ছু না।’ আগুনে পুড়ে ঘরের ভিতরে থাকা লাশগুলো কয়লায় পরিণত হয়ে গেছে। সেইসব কয়লা দেখে শনাক্ত করা সম্ভব না কোনটা কার লাশ। আগুনে পোড়া ছাড়া যে একটি মাত্র লাশ ছিলো।সেটি হচ্ছে ইয়াছিরের বোন আছিয়ার। আছিয়ার লাশটি ব্যাতিত ছাই হয়ে যাওয়া দেহাবশেষ গুলো গণকবর দেওয়া হয়।জাহরা যখন জ্ঞান ফিরে পায় তখন আছিয়ার দাফন – কাফন সম্পূর্ণ শেষ।জাহরার আপন তো কোন ভাই বোন নেই।আছিয়াকে সবসময় আপন বোনই মনে করতো। প্রিয় বোনটি শহীদ হয়েছে।অথচ শেষ বারের মতো দেখতেও পারলোনা জাহরা।জিয়ারত শেষে আছিয়ার কবরের পাশে একগুচ্ছ আনেমোন ফুল রাখলো জাহরা। বিরবির করে বলতে লাগলো: “আছিয়া বোন আমার! তুমি তো বলেছিলে শহীদের মৃত্যু নেই… তবু কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার বুকের একটা অংশ আজ মাটির নিচে শুয়ে আছে। অপেক্ষা করো বোন আমার, আমার মন বলছে খুব শীঘ্রই আমরা মিলিত হবো।সেদিন পুনরায় তোমার হাত ধরে হাঁটবো, যেমন ভাবে হাঁটতাম জাওয়াসির জলপাই বাগানে,তেমন ভাবেই হাঁটবো জান্নাতের সবুজ বাগিচায়।
শুধু সময়ের অপেক্ষা……

চার

আল জাওয়াসির অল্প সংখ্যক লোক যারা কাজের জন্য গ্রাম থেকে দূরে থাকার কারনে বেঁচে ছিলো, তার মধ্যে সোলাইমান সাহেবও একজন। স্ত্রী ও মেয়ে হারিয়ে শোকে তিনি পাথর হয়ে গেলেন।প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা বলেন না। যখন তিনি কোন কথা বলেন, বুঝে নিতে হবে কথাটা খুবই প্রয়োজনীয় এবং একই সাথে গুরত্বপূর্ণ। এই মূহুর্তে তেমনই কিছু প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ইয়াছির এবং জাহরাকে ডাকলেন। কোন রকম ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি বললেন: ‘আল জাওয়াসিতে আমাদের থাকার সময় শেষ হয়ে এসেছে। আল জাওয়াসিও এখন আর আমাদের জন্য নিরাপদ নয়।
ইয়াছির বললো: ‘আব্বু ফিলিস্তিনের কোন জায়গায়ই এখন আর আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। গাযা থেকে রাফাহ অবধি প্রত্যেকটি কণা – প্রত্যেকটি বালু ওদের জুলুমের শিকার। এখন বলেন আব্বু কোথায় আমরা নিরাপদ?
:জেনিন। ইয়াছিরের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই উত্তর দিলো সোলাইমান সাহেব।

:জেনিন শিবিরে?

: হ্যা বাবা। আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি।জেনিন ছাড়া আপাতত নিরাপদ কোন আশ্রয় নেই আমাদের। আমরা কালকেই রওনা হচ্ছি।তৈরি থেকো ইয়াছির।তৈরি থেকো জাহরা।

পাঁচ

“কখনো কখনো স্মৃতি হাসির মতো, অনন্ত আনন্দ বয়ে আনে, কখনো কখনো স্মৃতি অশ্রুর মতো, নীরবে গড়িয়ে পড়ে।”
আল জাওয়াসি ছিলো আমার পুরো শৈশব। শৈশবের স্মৃতি যা হয়তো মনে করে করে সারাজীবন অশ্রু ফেলতে হবে। দশ বছর আগে এমনই কোন মাঝ দুপুরে জাওয়াসির মাটিতে পা রেখেছিলাম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এই পা এখন জাওয়াসি ত্যাগ করতে চলেছে। আচ্ছা জাওয়াসিতে কি আর কখনো ফেরা হবে? আমার জনমদুখিনী মা তো এখানে শায়িত। আমার কলিজা ছেঁড়া বোন তো এই মাটিতেই শুয়ে আছে।আমি কি আসবোনা তাদের জন্য?

গ্রাম থেকে বেড়িয়ে যাবার সময় এসব ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকায় জাহরা। অশ্রুসিক্ত নয়ন, বেদনায় উদ্বেল হয়ে ভেজা কন্ঠে মৃদু স্বরে বলে উঠে জাহরা, “এত দুঃখই যদি কপালে ছিলো,
তবে পাথর বানিয়েই কেন দুনিয়ায় পাঠান নাই মাবূদ?

ছয়

জেনিন শরণার্থী শিবিরটি ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে অবস্থিত। এই শিবিরটি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে, কারণ ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, সেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ফলে, ইসরাইলি বাহিনী প্রায়ই শিবিরে অভিযান চালায়, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে।

জেনিন শিবিরে আসার পর জাহরারা বুঝতে পারল, তাদের ধারণা পুরোপুরি সঠিক ছিল না। জেনিন ইসরাইলি আগ্রাসন থেকে নিরাপদ—এ কথা সত্য নয়। ইসরাইলি সেনারা প্রায়ই এখানে হামলা চালায়, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, মানুষ হত্যা করে। কিছুদিন আগেই শিবিরে ভয়াবহ অভিযান চালিয়ে তারা বহু প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এই শিবিরের আশেপাশে সেনা ঘাঁটিগুলো যেন সর্বদা ওঁত পেতে আছে, যে কোনো মুহূর্তে ধ্বংস নেমে আসতে পারে। তবু এখানকার মানুষ লড়াই করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।

জাহরা তেমনই এক বেঁচে থাকার স্বপ্নে স্বাপ্নিক। সে চায় শিবিরের সমস্ত মানুষ যেন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পরাজয় বরণ না করে।মানুষকে বাঁচতে থাকার স্বপ্নে সাহায্য করতে জাহরা ‘রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি হাসপাতালে’ নার্স হিসেবে যুক্ত হয়।যা ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দ্বারা পরিচালিত এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে।

জেনিন শিবিরে দুপুর নামার ধরনটা আলাদা। সূর্যের আলো থাকে, কিন্তু কোনো উষ্ণতা থাকে না। জানালার ফাঁক গলে কাঠামো ভাঙা দেয়ালে এসে পড়ে সেই আলো।

এমন এক দুপুরেই জাহরা গজের পর্দা সরিয়ে হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে ব্যান্ডেজের গন্ধ, জীবাণুনাশকের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ। কিন্তু তার চোখে অন্য কিছু। হয়তো দূরের কোনো মুখ, অথবা কাছে থাকা কোনো স্মৃতি।

জাহরা রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের একজন নার্স। বয়স বেশি না, কিন্তু চোখে এমন একধরনের আত্মবিশ্বাস, যেন কোনো যুদ্ধ তাকে কাঁপাতে পারবে না। অথচ সে যুদ্ধ এড়িয়ে চলে না। প্রতিদিনই সে যুদ্ধের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যায়—একজন আহত শিশুর চোখে, একজন মায়ের কান্নায়, কিংবা একজন শহীদের নিঃশ্বাসে।

এই হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক ডাক্তার মারিয়াম মুকাদ্দাস। বয়সে একটু বড়, স্বভাবে দৃঢ়, কিন্তু মনের ভেতরটা তুলতুলে তুলার মতো। তিনি বাংলাদেশে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়েছেন। পড়াশোনা শেষে ফিরে গেছেন নিজের ভাঙা দেশে, যেখানে হাসপাতালের ছাদ নেই, তবু মানুষ বাঁচতে চায়।

জাহরা তাকে মারিয়াম আপা নামেই ডাকে । তিনি এই ছোটখাটো, তেজি মেয়েটিকে অসম্ভব ভালোবাসেন। নার্সিংয়ের সবকিছু নিজের হাতে শেখান। ইনজেকশন ধরতে শেখান, রোগীর শ্বাস গুনতে শেখান, আর শেখান—কিভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একজন মানুষকে বলতে হয়, “ভয় পেয়ো না, তুমি বেঁচে থাকবে।”

জাহরার দিনগুলো এখন এইভাবেই কাটে—প্রতিদিন নতুন কিছু শেখে, নতুন কিছু দেখে, আর প্রতিদিন একটু একটু করে বদলায়।

জেনিনে আসার পর ইয়াছির ভাইয়ার সাথে দূরত্বটা যেন একটু গভীর হয়ে গেছে। ইয়াছির এখন আর আগের মতো প্রানবন্ত নেই।কিছুটা চুপচাপ। কেমন যেন অন্যমনস্ক,উদাসিন হয়ে থাকে।হয়তো এখনো মা-বোন হারানো শোক থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। তবুও প্রায়ই ভগ্নহৃদয়টা নিয়ে রেড ক্রিসেন্ট হসপিটালে জাহরাকে দেখতে আসে।মুখে তেমন কোন কথা থাকে না। কিন্তু জাহরা চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে,মানুষটা অনেক কথা বলতে চায়।অনেক কিছু বুঝাতে চায়। কিন্তু অচেনা অজানা একটা জড়তায় তার মুখ ফুটে না।

জাহরা জিগ্যেস করে,’ ভাইয়া, কেমন আছো?

ইয়াছির মাথা তুলে তাকায়,কোন জবাব দেয় না।জাহরা আবারও প্রশ্ন করে, তোমার শরীর কি খারাপ ভাইয়া?

ইয়াছির জাহরার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলতে থাকে,’আমি চলে যাবো জাহরা।জেনিন শিবিরটা হচ্ছে অসহায় মহিলাদের জন্য, এতিম শিশুদের জন্য। কোন সুস্থ সবল তাগড়া যুবকের জন্য নয়।

জাহরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিগ্যেস করে কোথায় যাবে ভাইয়া?

ইয়াছির জানালা দিয়ে বাহিরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, ‘ কোথায় যাবো তা এখনও জানিনা জাহরা,তবে এতটুকু বলতে পারি,যেখানে গেলে ফিলিস্তিনের ভাগ্যাকাশ বদলাবে,আমাদের গন্তব্য সেখানে।

কথা আর আগায় না।জাহরার ভিতরটা ভেঙে চুরে যাচ্ছে। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা।কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে কেমন যেন।গলার মাঝখানটায় কি যেন একটা দলা পাকিয়ে রয়েছে।খুব কষ্টে নিজের কান্না সংবরণ করলো। ইয়াছির চলে যাচ্ছে, জাহরা কান্না ভেজানো কন্ঠে ডাকলো,’ ভাইয়া!’
আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো,হয়তো এখানে নয়তো জান্নাতে।

সাত।

বাকি সারাটাদিন কাজে তেমন মনোযোগ দিতে পারলো না জাহরা। ডাক্তার মারিয়াম মুকাদ্দাস জিগ্যেস করলেন, কি হয়েছে জাহরা,এমন উদাসীন লাগছে কেন তোমাকে। জাহরা ছোট্ট করে উত্তর দিলো, কিছুনা আপা।

ডাক্তার মারিয়াম মুকাদ্দাস জাহরার সামনাসামনি দাঁড়ায়,চোখে চোখ রাখে।তারপর জাহরার শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,’জাহরা! দুঃখ জিনিসটার ওজন অনেক বেশি,এত ভারী জিনিস একলা বইতে হয় না,আপন মানুষদের সাথে ভাগ করে নিতে হয়।

জাহরার চক্ষু টলমল। দৃষ্টিটা মারিয়াম আপা থেকে সরিয়ে কান্না গলায় বললো ‘আপন মানুষ? আমার তো আপন বলতে কেউ-ই রইলো না আপা। সেই ছেলেবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছি।হারিয়েছে আমার দুঃখিনী আম্মিকে।রক্তের সম্পর্ক ছাড়া আমার যে একটা বোন ছিলো,নিয়তির নির্মম পরিহাসে তাকেও হারাতে হলো।হারিয়েছি আমার জন্মভূমি গাযা।শৈশব কাটানো ছবির মতো গ্রামটাও হারাতে হলো।সবকিছু হারিয়েও বিপন্ন জীবন নিয়ে ইয়াছির ভাইয়ার হাত ধরে জেনিনে এসেছিলাম। অভিপ্রায় ছিলো আমার,এই বিপন্ন জীবনটা একদিন সুখে সুখে সম্পূর্ণ হবে।তা আর হচ্ছে কোথায়? স্বপ্নের মানুষটাও একা ফেলে চলে যাচ্ছে অনিশ্চিতের পথে।

ডাক্তার মারিয়াম জাহরার দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটা কাঁদছে। ডাক্তার মারিয়াম বুঝতে পারছে জাহরা নিজেকে কান্না থেকে সংবরণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু পারছেনা। কান্না যেন জাহরার ভেতর থেকে উথলে উঠছে। ডাক্তার মারিয়াম জাহরার কাছে গেলো। জাহরাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, এই মুহূর্তে চোখের অশ্রু থেকে শরীরের তাজা রক্তই গাযার ভাগ্যাকাশ পরিবর্তনের জন্য বেশি দরকার জাহরা।তুমি তো বুদ্ধিমতী। সবকিছু বুঝতে পারো। আজকে তোমার ছুটি রইলো।বাসায় যাও। ইয়াছিরকে বিদায় দিবে,সাথে দিবে বুক ভরা সাহস।

আট

বৃহস্পতিবার রাত।
ঘড়ির কাটা এগারোটার ঘর ছুঁইছুঁই করছে।
জাহরা হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে শিবিরের পথ ধরলো।মারিয়াম আপা তাকে অনেক আগেই যেতে বলেছিলো। কিন্তু জাহরার প্রবল দায়িত্ববোধ তাকে কর্তব্য শেষ না করে বের হতে দিলো না। জেনিনে রাত যেন একটু তাড়াতাড়িই নেমে পরে।এগারোটা তো এখানে অনেক রাত। এত রাতে সেদিনের ছোট্ট জাহরা বড় বড় পা ফেলে সম্মুখে চলে যাচ্ছে।একটু ভয়ও তার পিছু নিচ্ছে না।এত দৃঢ় মনোবল তার কোত্থেকে হলো? বয়স তো বেশি না। তাহলে? আঘাতে আঘাতে? হয়তো। মানুষ তো বড় হয় বয়সে বয়সে,আর আঘাতে আঘাতে হয় শক্ত।

শিবিরের ভিতর পা ফেলে জাহরা হতবাক। একদিক থেকে চিৎকার ভেসে আসছে নারী শিশুদের। কয়েকবার গুলি ছোঁড়ার শব্দ হলো।হটাৎ এমন পরিস্থিতিতে জাহরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরলো। কি করবে কি করবেনা বুঝতে না পেরে উল্টোদিকে ভোঁদৌড় দিতে দিতে পরে গেলো প্রায়। উঠতে যাবে এমন সময় বুটজুতো পরা একজোড়া পা তার সামনে এসে দাঁড়ায়। জাহরা বুটজুতো পরা মানুষটার পুরো শরীর অবলোকন করার আগেই একটা শক্ত লাথি তার কপালকে রক্তাক্ত করে দিলো।জাহরা চিৎকার দিলো ঠিকই,কিন্তু মনে হচ্ছে তার মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়নি।শরীরটা ভিষণ ভারী ভারী লাগছে।আধো অচেতন শরীরটা ইসরাইলী এক সেনা কাঁধে করে জীপে নিয়ে তুললো।

ইসরাইলী সেনারা কিভাবে যেন জানতে পারে শিবিরের ভিতর যুবকদের একটা দল প্রতিশোধের জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ট্রেনিংয়ের জন্য আজ রাতেই জেনিন শিবির ত্যাগ করবে। তাদের প্রথম টার্গেটই ছিলো ওই সমস্ত যুবক। কিন্তু অপারেশন শুরু হলে নারী শিশু আবাল বৃদ্ধা কেউ তাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি স্বপ্নের পুরুষকে বিদায় জানাতে আসা জাহরাও।সেনারা তাকে ঘাটিতে নিয়ে যাওয়ার পর নির্যাতনের কোন দিকই বাদ রাখেনি। পর দিন ভোরের প্রথম আলোয় শিবিরের অদূরে জাহরাকে বস্ত্রহীন মৃতপ্রায় অবস্থায় পরে থাকতে দেখে শিবিরের শরনার্থীরা।গত ছয় মাস ধরে জাহরা যে হসপিটালটায় সেবা দিয়ে আসছিলো, সেই রেড ক্রিসেন্টে হসপিটালেই তাকে ভর্তি করা হয়। বেডের ওপর জাহরা ছিন্নভিন্ন দেহ।সমস্ত শরীর রক্তে রাঙা। ঠোঁট দুটি থেঁতলে গিয়েছে।পুরো শরীরে একশত বিশটি কামড়ের দাগ।বুটজুতোর আঘাতে একটি চোখ ফুলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

সকাল বেলা কি একটা সংবাদ দিতে হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে জাহরার কাছে আসেন সোলাইমান সাহেব। এসে মেয়ের এহেন পরিস্থিতি দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ডাক্টার মারিয়াম জাহরার শিয়রে বসা।ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা।কিছু একটা হয়তো বলতে চায়,কিন্তু বলতে পারছেনা।ডাক্তার মারিয়াম জাহরার ঠোঁটের কাছে কান পাতেন,খুবই অস্পষ্ট স্বরে জাহরা বলতে লাগলো, মারিয়াম আপা আমার নামের অর্থ কি জানেন? মা আমাকে ফুলের মতো ভাবতো বলে আমার নামও রাখেন ফুল (জাহরা)। অথচ আমি সবসময়ই চেয়েছিলাম আমার বাবার দেওয়া নাম (মুনতাক্বিমা) প্রতিশোধ গ্রহণকারী যেন আমি হয়ে উঠি।কিন্তু এই জীবনে আমি তা পারলাম না।’ এতটুকু বলার পর আরো নিচু স্বরে ডাক্তার মারিয়ামকে ডাকলো। ডাক্তার মারিয়াম জাহরাকে বললো,তুমি বলো জাহরা,আমি শুনছি।

জাহরা তার ডান হাতটা উঠানোর চেষ্টা করলো।ডাক্তার মারিয়াম বিষয়টা বুঝতে পেরে জাহরার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতে গিয়ে দেখলো জাহরার মুঠের ভিতর একটা চিরকুট। চিরকুটটা নেওয়ার সময় জাহরা বলতে লাগলো ‘ এটা আমার পক্ষ থেকে ইয়াছির ভাইয়াকে পৌঁছে দিবেন আপা।

খুবই শক্ত মনমানসিকতার ডাক্তার মারিয়াম মুকাদ্দাসও তখন ডুকরে কেঁদে উঠলো।ওড়নায় মুখ ঢেকে কামরার বাহিরে এসে দাঁড়ালো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো কতক্ষণ। তারপর আস্তে করে চিরকুটটা খুললো।সেখানে মুক্তোর মত গুটিগুটি করে লেখা….

“এই অপেক্ষার প্রহর শীঘ্রই শেষ হবে
আমাদের আবারও দেখা হবে;
হয়তো স্বাধীন গাজায়……
নয়তো সবুজ সুন্দর জান্নাতে।”

ইতি
জাহরা

চিরকুটটা পড়তে পড়তে ডাক্তার মারিয়ামের চোখ বেয়ে পানি পরছে।ধীরপায়ে সে জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। সেখান থেকে বেডের উপর থাকা জাহরার দেহটা দেখা যাচ্ছে। ক্ষতবিক্ষত পুরো শরীর। রক্তে রক্তে লাল হয়ে আছে। এতটা বিধ্বস্ত হওয়ার পরও চেহারায় এক ধরনের মায়া,একরকম স্নিগ্ধতা ছেয়ে আছে যেন।ডাক্তার মারিয়ামের হঠাৎ মনে হলো,জাহরা মেয়েটা সত্যিই ফুলের মতো।
স্নিগ্ধ,
সুরভিত,
সুন্দর।
এসব ভাবতে ভাবতে জাহরার দেওয়া চিরকুটটার দিকে আবারো চোখ বুলায়। তারপর আনমনে বলতে থাকে, আমাকে ক্ষমা করো জাহরা।তোমার দেওয়া চিরকুটটি তোমার প্রিয় মানুষটার কাছে পৌঁছানো পৃথিবীর কারো পক্ষে আর সম্ভব না।তোমার চাচার দেওয়া খবর তোমাকে কি করে বলি,যে তোমার ইয়াছির গতকাল রাতেই ইসরাইলী সেনা কর্তৃক শহীদ হয়েছেন।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত

রক্তে রাঙা ফুল

দর্শক

এক

“অপেক্ষা জিনিসটা আসলে কষ্টের, সব কষ্টের ফলই মধুর হয়। অপেক্ষার ফলও কি মধুর হয়? নাকি কখনো কখনো মানুষ ‘অপেক্ষা’ নামক কষ্টটি করে থাকে কেবল আঁজলা ভর্তি বিষাদ আর বিষাদের বেদনা অনুভব করতে!”

জাহরা দাঁড়িয়ে আছে জলপাই বাগানের শেষ মাথার একটা বৃদ্ধ জলপাই গাছের আড়ালে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে না মেয়েটা কারো অপেক্ষায় অপেক্ষারত। অপেক্ষমান মানুষদের মতো তার অবয়বে চঞ্চলতা নেই। মুহূর্তে মুহূর্তে আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি নেই। বরং ফুটন্ত পুষ্পের মতো তার মাঝে স্থিরতা বিরাজ করছে। কোন এক সুপ্ত আত্মবিশ্বাসে যেন সে অনড়। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ নেই।স্বাভাবিক ভাবে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে অস্পষ্ট কিন্ত শান্ত স্বরে বললো, “নির্বোধ একটা, এতক্ষণ লাগে নাকি!”

আরো দু’পা এগিয়ে সামনের জলপাই গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো জাহরা নামের ফুলের মতো ফুটন্ত কিশোরী। এতটা সামনে আগানো হয়তো ঠিক হয়নি। আম্মির নির্ধারণ করা জলপাই বাগানের যে সীমানা ছিলো, দশ হাত পিছনেই তা রেখে এসেছে। জাহরা এখন যে জায়গায়টায় দাঁড়িয়ে আছে, আম্মির কাছে জাহরার জন্য এটা নিষিদ্ধ জায়গা।

জাহরা মনে মনে ভাবে, জায়গাটা তো ঘর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তবুও কেন আম্মি এত ভয় পায়! আচ্ছা এমন কি হতে পারে মারা যাওয়ার আগে আব্বু আম্মির মনে অনেকগুলো ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো? সেই থেকেই কি আম্মি সবকিছুতে ভয় পায়!। আমাকে বাহিরে দিতে ভয় পায়। মাথার উপর দিয়ে যখন শা শা শব্দ করে কোন বিমান উড়ে যায়, আম্মি তখন ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠেন। জাহরার তখন খুব ইচ্ছে করে আম্মিকে জিগ্যেস করতে, ‘আম্মি! ভয় পেয়েছো?’

কিন্তু কোন এক অস্পষ্ট জড়তায় আর জিগ্যাসা করা হয়ে উঠে না। আব্বুর শূন্যতা তখন সে খুব তীব্রভাবে অনুভব করে। আব্বু থাকাকালীন কি সুন্দর দিন কাটতো তাদের। গাযা শহরের এককোনে পাখির মতো ছোট্ট একটা বাসা ছিলো জাহরাদের। বাসার দেয়ালের এক পাশে ফাটল ধরা। ভরা পূর্ণিমায় ফাটলের ফাঁক গলে চাঁদের আলো চুইয়ে চুইয়ে মেঝেতে প্রতিফলিত হয়। জাহরার বাবার যেন চাঁদের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা চলছিলো। একদিন জাহরার বাবা ঘোষণা করলেন, চাঁদের আলো যেন ঘরে আসতে না পারে, সে জন্য দেয়ালটাকে মেরামত করা হবে। উক্ত ঘোষণায় সবাই বোধহয় খুশী । কেবল জাহরারই যেন একটু রাগ আর অজানা দু’মুঠো কষ্ট একাকার হয়ে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। জাহরার মন খারাপের কারণ কি? দেয়াল মেরামত করলে ঘরে চাঁদের আলো আসবেনা তাই?

কারণ যাইহোক। সেই দেয়াল আর মেরামত করা হয়নি। এক রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরে, গাযার পরিস্কার আকাশে হটাৎ কুন্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উড়তে শুরু করলো। ‘লেজার গাইডেড এয়ার টু গ্রাউন্ড’ মিসাইলের শব্দে হাজার হাজার মানুষের চিৎকার-আহাজারি চাপা পরে যায়। একটার পর একটা র‍্যাম্পেজ মিসাইল গাযার জমিনে আঘাত হানছিলো আর গাযার স্থাপনাগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছিলো। উচ্চ ইমারতগুলির একেকটি ইট একেক দিকে ছিটকে ছিটকে পরছিলো।

জাহরা তার আব্বুর গলা খুব শক্ত করে ধরে আছে। তার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা ভয়ে কাঁদছে না। যদি তার কান্নার আওয়াজ কেউ শুনে ফেলে। যদি কান্নার আওয়াজ লক্ষ্য করে বোমা ফেলে! এই ভয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বাবার বুকে মাথা লুকিয়ে রইলো জাহরা।

গাযায় তখন প্রলয় চলছে। ভয়ঙ্কর প্রলয়। এই ভয়ঙ্কর প্রলয়ের মাঝে আরেকটা ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটে গেছে। তা হচ্ছে, জাহরার আম্মিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও জাহরার বাবার পাশেই ছিলো। নিরাপদ আশ্রয়ে এসে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো তিনি নেই। তারমানে নিরাপদ স্থান অবধি আসতে পারেনি। জাহরার আব্বু একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক কে ডাকলেন। ভদ্রলোকের নাম সোলাইমান। জাহরার আব্বুর অতি কাছের বন্ধু। সোলাইমান সাহেবও পরিবার নিয়ে ভাগ্যের নির্মমতার সম্মুখীন।

ভাইজান জাহরাকে রাখেন, “আমি ওর মা’কে খুঁজতে যাচ্ছি।” এতটুকু বলেই সোলাইমান সাহেবের দিকে জাহরাকে বাড়িয়ে দিলেন।এতক্ষণ নিশ্চুপ জাহরা চিৎকার করে উঠলো। দুই হাতে যতটুকু পারলো বাবার নীল শার্টের কলারটা আঁকড়ে ধরলো। বাবাকে যে কিছুতেই যেতে দেওয়া যায় না। কিছুতেই না। বাবাই যেন জাহরার বেঁচে থাকার ভরসা। বাবা কে ছাড়া যে সে একমুহূর্তও কল্পনা করতে পারেনা।

: ছাড়ো মামণি, ছাড়ো। আমি তোমার আম্মিকে নিয়ে আসছি। ছেড়ে দাও। আব্বু আবার আসবে তো…কথা গুলো বলতে বলতে জাহরার বাবা ডুকরে কেঁদে উঠলো। জাহরাও হয়তো বুঝতে পেরেছিলো, আজকে বাবাকে ছেড়ে দিলে হয়তো দ্বিতীয়বার বাবাকে জড়িয়ে ধরার ফুরসত আর কখনোই মিলবে না। জাহরা বাবাকে যেতে দেয় না। কিন্তু নিয়তি যার প্রস্থান অবধারিত করে রেখেছে, তাকে ধরে রাখার সাধ্য হয় কার?

আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধা নামার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। সূর্যাস্তের আলো-আঁধারি একাকার হয়ে বিধ্বস্ত গাযার রূপ যেন আরো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। সমস্ত গাযা রক্তে রক্তে রঙিন। মানুষজন ধ্বংসস্তুপের মাঝ থেকে স্বজনদের লাশ বের করতে ব্যস্ত। ‘তারেক বিন যিয়াদ’ রোডের দিকটায় কোন আস্ত লাশ নেই। শুধুই ছিন্নবিচ্ছিন্ন মাংসের টুকরো। একজন মানুষের যতটুকু ওজন, ততটুকু মাংস মেপে পলিথিন করে দাফন করা হচ্ছে। দাফনের জন্য জমাকৃত মাংসের একটি স্তুপে হাত-পা-মাথা ছাড়া কেবল একটা দেহ দেখা গেলো। শরীরে জড়ানো নীল শার্ট। কলারটার কিছুটা অংশ নেই। তবুও সহজেই অনুমান করা যায় লাশটা একজন বাবার। যেই বাবা স্বীয় কন্যাকে ফিরে আসার ওয়াদা দিয়ে গিয়েছিলো। তার ফুলের মতো মেয়েটি তো তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। কিন্তু কে জানতো! এই অপেক্ষার প্রহর যে আর কখনো শেষ হবে না।

দুই

সোলাইমান সাহেবের এক ছেলে এক মেয়ে। আছিয়া এবং ইয়াছির। ইয়াছির আছিয়া থেকে দু’বছরের বড়। ভাই-বোনের মাঝে প্রচন্ড ভাব।ইয়াছির সর্বদা বোনকে আগলে আগলে রাখে। আছিয়ার শিশুসুলভ চাওয়া গুলো পূর্ণ করতে চেষ্টা করে। ইয়াছিরের একমাত্র খেলার সাথীও এই আছিয়া। তবে এবার সাথে আরেক জন যুক্ত হয়েছে।

সোলাইমান সাহেবের ঘর বাড়ি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হলে তিনি গাযা শহর ছেড়ে তার মামার বাড়ি ‘আল জাওয়াসি’ নামক গ্রামে চলে যান।জায়গাটি উপকূলের খুব অদূরে জলপাই বাগান ঘেরা একটি গ্রাম। জনবসতি একবারেই কম। গাজার মর্মান্তিক বিমান হামলার তিন দিন পর যখন জাহরার বাবা-মা কাউকেই পাওয়া গেলো না। বন্ধুর আমানত (জাহরাকে) বুঝিয়ে দেওয়ার মতো মানুষ যখন পৃথিবীতে আর নেই। তখন নিজেই জাহরার অভিভাবক হয়ে গেলেন সোলাইমান। জাহরা তখন সোলাইমান পরিবারেরই একজন সদস্য।

জাওয়াসি আসার পথে জাহরা সোলাইমান সাহেবের স্ত্রী-কে বললো: চাচী আমার খুব শীত করছে। ইয়াছিরের আম্মি জাহরার গা ছুঁয়ে আঁতকে উঠেন। শরীর যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তখনো গাড়ি গাযার এরিয়া ত্যাগ করেনি। গাড়ি ঘুরানো হলো। জাহরা কে নিয়ে যাওয়া হলো তীরবর্তী ‘শিফা হসপিটালে’। চিকিৎসকের রুম থেকে বের হয়ে এক্সিটের জন্য বিশাল একটা হল রুম পারি দিতে হয়। জাহরা কে নিয়ে হলরুম ধরে বের হতে যাবে ঠিক সেই সময়, একজন মহিলা ‘জাহরা,আমার জাহরা’ বলে বলে চিৎকার করতে লাগলো। মহিলার কোমরের নিচ থেকে বাকি অংশটুকু নেই। ধারণা করা যায় তিন দিন পূর্বের বোমা হামলায় মানুষটি পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। মেঝেতে চাদর বিছিয়ে রোগিদের জন্য যেইসব বেড তৈরি করা হয়েছে, তেমনই একটা বেডে বসে ছিলো মহিলাটি।

চোখাচোখি হতেই আম্মি বলে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরলো জাহরা। মা-মেয়ে দুনোজনই সমান তালে সে কি কান্না। আছিয়ার আম্মি মা-মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। জাহরার আব্বুর শহীদ হওয়ার সংবাদ জানানো হলো। সোলাইমান সাহেব বললেন: ভাবী! গাযায় আমাদের ঘর বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। মাথা রাখার ঠাঁই হিসেবে আল-জাওয়াসিতে মামার কিছু জমিজমা আছে। সন্তানদের জন্য গাযা নিরাপদ নয়। আপনার অবর্তমানে জাহরা সহ আমরা সবাই জাওয়াসিতেই যাচ্ছিলাম। আপনিও যদি ভাবী আমাদের সঙ্গে যেতেন, তাহলে আমরা খুবই খুশি হই।

জাহরার আম্মি প্রথমে না-ই করলেন। যে জমিনে প্রিয় স্বামী শহীদ হয়েছেন, সে জমিনে তিনিও মৃত্যুর স্বাদ নিতে চান। কিন্তু খোদার মর্জির উপরে তো বান্দার ইচ্ছা কখনোই প্রাধান্য পেতে পারে না। শেষমেশ জাহরার আম্মির জাওয়াসি যাওয়ার মর্জি হলো। যেমনটা খোদার ইচ্ছা।

ইয়াছিরদের ঘরের পিছনের ঘরটাই দেওয়া হলো জাহরাদের। জাহরার আম্মির পা নেই। পঙ্গুত্ব নিয়ে কোন কাজই করতে পারেন না তিনি।তার সর্বত্র সহোযোগিতায় ইয়াছিরের আম্মি সর্বদা পাশে থাকেন। জাহরা তার স্মৃতির পাতার ভয়ঙ্কর চিত্র গুলো ভুলে থাকার জন্য দু’জন সাথী পেলো। সন্ধার পর জাহরা, ইয়াছির-আছিয়ার আম্মির কাছে তিনজন মিলে পড়তে বসে। ইয়াছির আর আছিয়ার সাথে জাহরার ভাব জমতে সময় লাগলো না। অল্প দিনে ওদের বন্ধুত্ব বেশ জমে গেলো। যেন তিন দেহের এক আত্মা। দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলায় তিন জনের একজনকে ছাড়া যেন জমেই না।

আনেমোন জাহরার অতি প্রিয় একটি ফুল। ভূমধ্যসাগরীয় এই লাল রঙা ফুলের সংস্পর্শ জাহরার প্রতিদিনই চাই। আর জাহরার প্রতিদিনের এই ছোট্ট চাওয়াগুলো যে মানুষটি খুবই আগ্রহের সাথে পূরণ করে সে হচ্ছে ইয়াছির ভাইয়া। জাহরার ছোটো ছোটো এইসব আবদার গুলো পূরণ করতে পারলে ইয়াসিরের বুকের ভিতরটা যেন প্রশান্তিতে পূর্ণ হয়ে যায়। বিশাল জলপাই বাগান পেরিয়ে রক্ত রঙা আনেমোন নিয়ে এসে যখন ফুলগুলো জাহরার হাতে দেয়, জাহরা তখন আনন্দে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। জাহরার এই মিষ্টি হাসিটা দেখতে ইয়াছিরের কি…যে..ভালো লাগে।
ইয়াছির জিগ্যেস করে, “জাহরা এভাবে হাসছো কেন?”
“ফুল পেয়ে। তুমি জানো, লাল আনেমোন ফিলিস্তিনের প্রতীকী জাতীয় ফুল হিসেবে বিবেচিত। যা শহীদদের রক্ত, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তুলে ধরে “
“ও তাই নাকি? তুমি কিভাবে জানলে?”
“আমার আব্বু যখন আমাদের সাথে ছিলো, তখন তিনি আমায় বলে ছিলেন।”

জাহরার বাবার কথা উঠার পর কেউ আর কোন কথা বলে না। অনেকটা সময় চুপচাপ কেটে যায়। নিরবতা ভেঙে জাহরা হাতের ফুলগুলো ইয়াছিরের সামনে ধরে প্রশ্ন করলো, “সুন্দর না?”
ইয়াছির হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। কিছুক্ষণ পর বললো, “জাহরা তুমি কি জানো, “তুমি যে আনেমোন থেকেও সুন্দর?”

ইয়াছির ভাইয়ার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে আবারও খিলখিলিয়ে হেসে উঠে জাহরা। লজ্জা পেয়ে জলপাই বাগানের দিকে দৌঁড় দেয়। “জাহরা শোন, দাঁড়াও, বলে ইয়াছিরও জাহরার পিছু নেয়। ছোট্ট আছিয়া তাদের দৌঁড়াদৌঁড়ি দেখে ভাবে পুনরায় হয়তো দৌড় খেলা শুরু হয়েছে। সেও দু’জনের পিছনে ছুটতে থাকে।

সোলাইমান সাহেব প্রায়সময়ই তাদের উৎসবমুখর আনন্দ দেখে থমকে দাঁড়ায়। দূর থেকে স্থিরনেত্রে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, সুখহারা বাচ্চাগুলা কি তাহলে সুখ খোঁজে পেলো? বাচ্চাদের আনন্দ দেখে তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পরেন। তার মন কল্পনায় গাযার অলিতে-গলিতে ঘুরপাক খায়। এই বাচ্চাদের মতোই তো কত ফুল গাযার পথে পথে ছোটাছুটি করতো। আজ তারা কোথায়? জান্নাতে?সোলাইমান সাহেব আর ভাবতে পারেন না। তিনি কাজের উদ্দেশ্যে বাড়ির আঙ্গিনা ত্যাগ করেন।

জাহরা দৌঁড়ে এসে আম্মির কোলে ঝাঁপিয়ে পরে। হাতে থাকা আনেমোনের গুচ্ছটা দেখিয়ে বলে “আম্মি! ইয়াছির ভাইয়া দিয়েছে।”

জাহরার আম্মি জাহরাকে কাছে টেনে মাথায় বিলি কাঁটতে থাকে। আদর পেয়ে জাহরাও মায়ের কোলে শরীর ছেড়ে দেয়। বলতে থাকে, “আম্মি! ইয়াছির ভাইয়া আমাকে কি বলেছে জানো? বলেছে, আমি নাকি আনেমোন থেকেও সুন্দর।” কথাটা বলেই খিলখিলিয়ে আবার হেসে উঠে।
জাহরার খোলা চুলগুলো বেণি করতে করতে আম্মি বললো, “বলো তো জাহরা নামের অর্থ কি?
জাহরা মায়ের দিকে তাকায়। আম্মি বলে যেতে থাকে, “জাহরা নামের অর্থ হচ্ছে ফুল। তুমি তো আমাদের প্রথম সন্তান। তুমিই আমাকে প্রথম মাতৃত্বের সৌরভ দিয়েছো।সৌরভ তো ছড়ায় ফুল।তাই আমি তোমার নামও ফুল(জাহরা) রাখি। যদিও তোমার আব্বু ভেবে রেখেছিলো তোমার নাম রাখবে ‘মুনতাকিমা’।
আম্মির মুখ থেকে কথা কেড়ে জাহরা উল্টো প্রশ্ন করলো, “মুনতাকিমা অর্থ কি আম্মি?”

জাহরার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, “মুনতাকিমা অর্থ হচ্ছে প্রতিশোধ গ্রহণকারী।

জাহরা বললো, তাহলে আমি “মুনতাকিমাই হবো। গাযায় যারা আমাদের উপর হামলা করেছে, আমি তাদের উপর প্রতিশোধ নিবো “

জাহরার কথা শুনে আম্মি কান্না আর সংবরণ করতে পারেন না। মুখে আঁচল ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমরা এখানে থাকবো না জাহরা, আমরা গাযায় ফিরে যাবো। তোমার আব্বুর রক্তে যে জমিন রঞ্জিত হয়েছে, সে জমিনেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবো। আমরা গাযায় চলে যাবো।”

চলে যাবো চলে যাবো করে দশ বছর এই জাওয়াসির মাটির উপর কেটে গেলো। আমাদের আর গাযায় ফেরা হলো না। দশ বছরে পৃথিবীর অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে, কেবল পরিবর্তন হয়নি ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডের রক্তাক্ত ভাগ্যাকাশ, যেখানে এখনও শিশুদের কান্না আর বিধবার আহাজারি মাঝেমধ্যেই ইসরাইলের বোমায় স্তব্ধ হয়ে যায়।

তিন।

অপেক্ষার সময় দীর্ঘ হলেও জাহরার ধৈর্যের বাধ ভাঙেনি।

অবশেষে দূরে ছায়ার মতো ইয়াছিরের অবয়ব দেখা গেলো।জাহরা মনে মনে ভেবে রেখেছিলো,দেড়ি করার অপরাধে ইয়াছিরকে কিছু ঝাল কথা শোনাবে। কিন্তু ইয়াছিরকে দেখার সাথে সাথেই তার অভিপ্রায় পরিবর্তন হলো।ইয়াছিরের চেহারায় কিছু একটা আছে বৈকি।তার চেহারার দিকে তাকিয়ে তার সাথে কোন রূঢ় আচরন করা জাহরার পক্ষে সম্ভব না।জাহরা আজকে একটা জিনিস বুঝতে পারলো,এতদিন তাহলে ইয়াছির কত কষ্ট করেই না তারজন্য আনেমোন তুলে আনে।গত দশ বছরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মতো প্রতিদিন নিয়ম করে ইয়াছির যে কাজটি করে গেছে তা হলো জাহরার জন্য আনেমোন তুলে আনা।আজকে জাহরা বললো আমাকেও নিয়ে যাওনা সাথে করে।জলপাই বাগান অবধি এসে, খোলা প্রান্তরে আর জাহরাকে সাথে নিলো না। ইয়াছির নরম স্বরে বললো:এখানেই অপেক্ষা করো জাহরা।আর সামনে যাওয়া তোমার উচিত হবে না।

আনেমোন হাতে ইয়াছির কাছাকাছি আসতেই জাহরার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা খেলে গেলেও সে নিজেকে সংযত রাখল।

:”মাফ করো জাহরা, একটু দেরি হয়ে গেল।”

জাহরা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “এতক্ষণ কী করছিলে, ইয়াছির?” স্বরে খানিকটা কঠোরতা, তবে সুরের নিচে লুকানো এক ধরনের স্নেহমিশ্রিত অধিকারবোধ।

ইয়াছির কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর শব্দে প্রচন্ড ভাড়ী কিছু একটা জমিনে পতিত হলো।বিকট শব্দের কারণে ইয়াছির – জাহরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো। এতক্ষণে বুঝতে পারলো ইসরাইলীরা বিমান থেকে বোমা হামলা করছে।শেষমেশ আল – জাওয়াসিতেও হামলা?এতো ছোটো একটা গ্রামও কি ধ্বংসের হাত থেকে বাদ যাবে না? তাহলে কি ফিলিস্তিনের একটা এলাকাও ইসরাইলীলের হামলা থেকে নিরাপদ নয়?

ইসরাইলী বিমানগুলোর টার্গেট হয়তো ছিলো জনবসতি। আল জাওয়াসির ক্ষুদ্র জনবসতি ধ্বংস করতে ইসরাইলি F-15I “Ra’am” বিমানের সময় লাগলো কেবল এক মিনিট একুশ সেকেন্ড। এই এক মিনিট একুশ সেকেন্ডে প্রাণবন্ত একটা ছবির মতো গ্রাম ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।

ইয়াছির – জাহরা গ্রাম থেকে দূরে থাকায় কোনরকম ক্ষয় – ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি। তারা যখন দীর্ঘ জলপাই বাগান পেরিয়ে গ্রামে পৌঁছালো, জাহরাদের ঘরে তখনও দাউদাউ করা আগুন জ্বলছে।জ্বলন্ত ঘরের দিকে দৌড়ে যেতে যেতে জাহরা চিৎকার করে বলছে:’আমার আম্মি কোথায়? আমার আম্মি? আম্মি! আম্মি!! আম্মি…………!!!

জাহরার জ্ঞান ফিরলো পরদিন সকালে। চোখ মেলে ধাতস্থ হয়ে অস্ফুট স্বরে বললো: ‘আমার তো আর হারানোর কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না,কিচ্ছু না।’ আগুনে পুড়ে ঘরের ভিতরে থাকা লাশগুলো কয়লায় পরিণত হয়ে গেছে। সেইসব কয়লা দেখে শনাক্ত করা সম্ভব না কোনটা কার লাশ। আগুনে পোড়া ছাড়া যে একটি মাত্র লাশ ছিলো।সেটি হচ্ছে ইয়াছিরের বোন আছিয়ার। আছিয়ার লাশটি ব্যাতিত ছাই হয়ে যাওয়া দেহাবশেষ গুলো গণকবর দেওয়া হয়।জাহরা যখন জ্ঞান ফিরে পায় তখন আছিয়ার দাফন – কাফন সম্পূর্ণ শেষ।জাহরার আপন তো কোন ভাই বোন নেই।আছিয়াকে সবসময় আপন বোনই মনে করতো। প্রিয় বোনটি শহীদ হয়েছে।অথচ শেষ বারের মতো দেখতেও পারলোনা জাহরা।জিয়ারত শেষে আছিয়ার কবরের পাশে একগুচ্ছ আনেমোন ফুল রাখলো জাহরা। বিরবির করে বলতে লাগলো: “আছিয়া বোন আমার! তুমি তো বলেছিলে শহীদের মৃত্যু নেই… তবু কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার বুকের একটা অংশ আজ মাটির নিচে শুয়ে আছে। অপেক্ষা করো বোন আমার, আমার মন বলছে খুব শীঘ্রই আমরা মিলিত হবো।সেদিন পুনরায় তোমার হাত ধরে হাঁটবো, যেমন ভাবে হাঁটতাম জাওয়াসির জলপাই বাগানে,তেমন ভাবেই হাঁটবো জান্নাতের সবুজ বাগিচায়।
শুধু সময়ের অপেক্ষা……

চার

আল জাওয়াসির অল্প সংখ্যক লোক যারা কাজের জন্য গ্রাম থেকে দূরে থাকার কারনে বেঁচে ছিলো, তার মধ্যে সোলাইমান সাহেবও একজন। স্ত্রী ও মেয়ে হারিয়ে শোকে তিনি পাথর হয়ে গেলেন।প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা বলেন না। যখন তিনি কোন কথা বলেন, বুঝে নিতে হবে কথাটা খুবই প্রয়োজনীয় এবং একই সাথে গুরত্বপূর্ণ। এই মূহুর্তে তেমনই কিছু প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ইয়াছির এবং জাহরাকে ডাকলেন। কোন রকম ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি বললেন: ‘আল জাওয়াসিতে আমাদের থাকার সময় শেষ হয়ে এসেছে। আল জাওয়াসিও এখন আর আমাদের জন্য নিরাপদ নয়।
ইয়াছির বললো: ‘আব্বু ফিলিস্তিনের কোন জায়গায়ই এখন আর আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। গাযা থেকে রাফাহ অবধি প্রত্যেকটি কণা – প্রত্যেকটি বালু ওদের জুলুমের শিকার। এখন বলেন আব্বু কোথায় আমরা নিরাপদ?
:জেনিন। ইয়াছিরের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই উত্তর দিলো সোলাইমান সাহেব।

:জেনিন শিবিরে?

: হ্যা বাবা। আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি।জেনিন ছাড়া আপাতত নিরাপদ কোন আশ্রয় নেই আমাদের। আমরা কালকেই রওনা হচ্ছি।তৈরি থেকো ইয়াছির।তৈরি থেকো জাহরা।

পাঁচ

“কখনো কখনো স্মৃতি হাসির মতো, অনন্ত আনন্দ বয়ে আনে, কখনো কখনো স্মৃতি অশ্রুর মতো, নীরবে গড়িয়ে পড়ে।”
আল জাওয়াসি ছিলো আমার পুরো শৈশব। শৈশবের স্মৃতি যা হয়তো মনে করে করে সারাজীবন অশ্রু ফেলতে হবে। দশ বছর আগে এমনই কোন মাঝ দুপুরে জাওয়াসির মাটিতে পা রেখেছিলাম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এই পা এখন জাওয়াসি ত্যাগ করতে চলেছে। আচ্ছা জাওয়াসিতে কি আর কখনো ফেরা হবে? আমার জনমদুখিনী মা তো এখানে শায়িত। আমার কলিজা ছেঁড়া বোন তো এই মাটিতেই শুয়ে আছে।আমি কি আসবোনা তাদের জন্য?

গ্রাম থেকে বেড়িয়ে যাবার সময় এসব ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকায় জাহরা। অশ্রুসিক্ত নয়ন, বেদনায় উদ্বেল হয়ে ভেজা কন্ঠে মৃদু স্বরে বলে উঠে জাহরা, “এত দুঃখই যদি কপালে ছিলো,
তবে পাথর বানিয়েই কেন দুনিয়ায় পাঠান নাই মাবূদ?

ছয়

জেনিন শরণার্থী শিবিরটি ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে অবস্থিত। এই শিবিরটি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে, কারণ ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, সেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ফলে, ইসরাইলি বাহিনী প্রায়ই শিবিরে অভিযান চালায়, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে।

জেনিন শিবিরে আসার পর জাহরারা বুঝতে পারল, তাদের ধারণা পুরোপুরি সঠিক ছিল না। জেনিন ইসরাইলি আগ্রাসন থেকে নিরাপদ—এ কথা সত্য নয়। ইসরাইলি সেনারা প্রায়ই এখানে হামলা চালায়, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, মানুষ হত্যা করে। কিছুদিন আগেই শিবিরে ভয়াবহ অভিযান চালিয়ে তারা বহু প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এই শিবিরের আশেপাশে সেনা ঘাঁটিগুলো যেন সর্বদা ওঁত পেতে আছে, যে কোনো মুহূর্তে ধ্বংস নেমে আসতে পারে। তবু এখানকার মানুষ লড়াই করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।

জাহরা তেমনই এক বেঁচে থাকার স্বপ্নে স্বাপ্নিক। সে চায় শিবিরের সমস্ত মানুষ যেন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পরাজয় বরণ না করে।মানুষকে বাঁচতে থাকার স্বপ্নে সাহায্য করতে জাহরা ‘রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি হাসপাতালে’ নার্স হিসেবে যুক্ত হয়।যা ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দ্বারা পরিচালিত এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে।

জেনিন শিবিরে দুপুর নামার ধরনটা আলাদা। সূর্যের আলো থাকে, কিন্তু কোনো উষ্ণতা থাকে না। জানালার ফাঁক গলে কাঠামো ভাঙা দেয়ালে এসে পড়ে সেই আলো।

এমন এক দুপুরেই জাহরা গজের পর্দা সরিয়ে হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে ব্যান্ডেজের গন্ধ, জীবাণুনাশকের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ। কিন্তু তার চোখে অন্য কিছু। হয়তো দূরের কোনো মুখ, অথবা কাছে থাকা কোনো স্মৃতি।

জাহরা রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের একজন নার্স। বয়স বেশি না, কিন্তু চোখে এমন একধরনের আত্মবিশ্বাস, যেন কোনো যুদ্ধ তাকে কাঁপাতে পারবে না। অথচ সে যুদ্ধ এড়িয়ে চলে না। প্রতিদিনই সে যুদ্ধের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যায়—একজন আহত শিশুর চোখে, একজন মায়ের কান্নায়, কিংবা একজন শহীদের নিঃশ্বাসে।

এই হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক ডাক্তার মারিয়াম মুকাদ্দাস। বয়সে একটু বড়, স্বভাবে দৃঢ়, কিন্তু মনের ভেতরটা তুলতুলে তুলার মতো। তিনি বাংলাদেশে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়েছেন। পড়াশোনা শেষে ফিরে গেছেন নিজের ভাঙা দেশে, যেখানে হাসপাতালের ছাদ নেই, তবু মানুষ বাঁচতে চায়।

জাহরা তাকে মারিয়াম আপা নামেই ডাকে । তিনি এই ছোটখাটো, তেজি মেয়েটিকে অসম্ভব ভালোবাসেন। নার্সিংয়ের সবকিছু নিজের হাতে শেখান। ইনজেকশন ধরতে শেখান, রোগীর শ্বাস গুনতে শেখান, আর শেখান—কিভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একজন মানুষকে বলতে হয়, “ভয় পেয়ো না, তুমি বেঁচে থাকবে।”

জাহরার দিনগুলো এখন এইভাবেই কাটে—প্রতিদিন নতুন কিছু শেখে, নতুন কিছু দেখে, আর প্রতিদিন একটু একটু করে বদলায়।

জেনিনে আসার পর ইয়াছির ভাইয়ার সাথে দূরত্বটা যেন একটু গভীর হয়ে গেছে। ইয়াছির এখন আর আগের মতো প্রানবন্ত নেই।কিছুটা চুপচাপ। কেমন যেন অন্যমনস্ক,উদাসিন হয়ে থাকে।হয়তো এখনো মা-বোন হারানো শোক থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। তবুও প্রায়ই ভগ্নহৃদয়টা নিয়ে রেড ক্রিসেন্ট হসপিটালে জাহরাকে দেখতে আসে।মুখে তেমন কোন কথা থাকে না। কিন্তু জাহরা চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে,মানুষটা অনেক কথা বলতে চায়।অনেক কিছু বুঝাতে চায়। কিন্তু অচেনা অজানা একটা জড়তায় তার মুখ ফুটে না।

জাহরা জিগ্যেস করে,’ ভাইয়া, কেমন আছো?

ইয়াছির মাথা তুলে তাকায়,কোন জবাব দেয় না।জাহরা আবারও প্রশ্ন করে, তোমার শরীর কি খারাপ ভাইয়া?

ইয়াছির জাহরার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলতে থাকে,’আমি চলে যাবো জাহরা।জেনিন শিবিরটা হচ্ছে অসহায় মহিলাদের জন্য, এতিম শিশুদের জন্য। কোন সুস্থ সবল তাগড়া যুবকের জন্য নয়।

জাহরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিগ্যেস করে কোথায় যাবে ভাইয়া?

ইয়াছির জানালা দিয়ে বাহিরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, ‘ কোথায় যাবো তা এখনও জানিনা জাহরা,তবে এতটুকু বলতে পারি,যেখানে গেলে ফিলিস্তিনের ভাগ্যাকাশ বদলাবে,আমাদের গন্তব্য সেখানে।

কথা আর আগায় না।জাহরার ভিতরটা ভেঙে চুরে যাচ্ছে। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা।কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে কেমন যেন।গলার মাঝখানটায় কি যেন একটা দলা পাকিয়ে রয়েছে।খুব কষ্টে নিজের কান্না সংবরণ করলো। ইয়াছির চলে যাচ্ছে, জাহরা কান্না ভেজানো কন্ঠে ডাকলো,’ ভাইয়া!’
আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো,হয়তো এখানে নয়তো জান্নাতে।

সাত।

বাকি সারাটাদিন কাজে তেমন মনোযোগ দিতে পারলো না জাহরা। ডাক্তার মারিয়াম মুকাদ্দাস জিগ্যেস করলেন, কি হয়েছে জাহরা,এমন উদাসীন লাগছে কেন তোমাকে। জাহরা ছোট্ট করে উত্তর দিলো, কিছুনা আপা।

ডাক্তার মারিয়াম মুকাদ্দাস জাহরার সামনাসামনি দাঁড়ায়,চোখে চোখ রাখে।তারপর জাহরার শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,’জাহরা! দুঃখ জিনিসটার ওজন অনেক বেশি,এত ভারী জিনিস একলা বইতে হয় না,আপন মানুষদের সাথে ভাগ করে নিতে হয়।

জাহরার চক্ষু টলমল। দৃষ্টিটা মারিয়াম আপা থেকে সরিয়ে কান্না গলায় বললো ‘আপন মানুষ? আমার তো আপন বলতে কেউ-ই রইলো না আপা। সেই ছেলেবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছি।হারিয়েছে আমার দুঃখিনী আম্মিকে।রক্তের সম্পর্ক ছাড়া আমার যে একটা বোন ছিলো,নিয়তির নির্মম পরিহাসে তাকেও হারাতে হলো।হারিয়েছি আমার জন্মভূমি গাযা।শৈশব কাটানো ছবির মতো গ্রামটাও হারাতে হলো।সবকিছু হারিয়েও বিপন্ন জীবন নিয়ে ইয়াছির ভাইয়ার হাত ধরে জেনিনে এসেছিলাম। অভিপ্রায় ছিলো আমার,এই বিপন্ন জীবনটা একদিন সুখে সুখে সম্পূর্ণ হবে।তা আর হচ্ছে কোথায়? স্বপ্নের মানুষটাও একা ফেলে চলে যাচ্ছে অনিশ্চিতের পথে।

ডাক্তার মারিয়াম জাহরার দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটা কাঁদছে। ডাক্তার মারিয়াম বুঝতে পারছে জাহরা নিজেকে কান্না থেকে সংবরণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু পারছেনা। কান্না যেন জাহরার ভেতর থেকে উথলে উঠছে। ডাক্তার মারিয়াম জাহরার কাছে গেলো। জাহরাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, এই মুহূর্তে চোখের অশ্রু থেকে শরীরের তাজা রক্তই গাযার ভাগ্যাকাশ পরিবর্তনের জন্য বেশি দরকার জাহরা।তুমি তো বুদ্ধিমতী। সবকিছু বুঝতে পারো। আজকে তোমার ছুটি রইলো।বাসায় যাও। ইয়াছিরকে বিদায় দিবে,সাথে দিবে বুক ভরা সাহস।

আট

বৃহস্পতিবার রাত।
ঘড়ির কাটা এগারোটার ঘর ছুঁইছুঁই করছে।
জাহরা হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে শিবিরের পথ ধরলো।মারিয়াম আপা তাকে অনেক আগেই যেতে বলেছিলো। কিন্তু জাহরার প্রবল দায়িত্ববোধ তাকে কর্তব্য শেষ না করে বের হতে দিলো না। জেনিনে রাত যেন একটু তাড়াতাড়িই নেমে পরে।এগারোটা তো এখানে অনেক রাত। এত রাতে সেদিনের ছোট্ট জাহরা বড় বড় পা ফেলে সম্মুখে চলে যাচ্ছে।একটু ভয়ও তার পিছু নিচ্ছে না।এত দৃঢ় মনোবল তার কোত্থেকে হলো? বয়স তো বেশি না। তাহলে? আঘাতে আঘাতে? হয়তো। মানুষ তো বড় হয় বয়সে বয়সে,আর আঘাতে আঘাতে হয় শক্ত।

শিবিরের ভিতর পা ফেলে জাহরা হতবাক। একদিক থেকে চিৎকার ভেসে আসছে নারী শিশুদের। কয়েকবার গুলি ছোঁড়ার শব্দ হলো।হটাৎ এমন পরিস্থিতিতে জাহরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরলো। কি করবে কি করবেনা বুঝতে না পেরে উল্টোদিকে ভোঁদৌড় দিতে দিতে পরে গেলো প্রায়। উঠতে যাবে এমন সময় বুটজুতো পরা একজোড়া পা তার সামনে এসে দাঁড়ায়। জাহরা বুটজুতো পরা মানুষটার পুরো শরীর অবলোকন করার আগেই একটা শক্ত লাথি তার কপালকে রক্তাক্ত করে দিলো।জাহরা চিৎকার দিলো ঠিকই,কিন্তু মনে হচ্ছে তার মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়নি।শরীরটা ভিষণ ভারী ভারী লাগছে।আধো অচেতন শরীরটা ইসরাইলী এক সেনা কাঁধে করে জীপে নিয়ে তুললো।

ইসরাইলী সেনারা কিভাবে যেন জানতে পারে শিবিরের ভিতর যুবকদের একটা দল প্রতিশোধের জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ট্রেনিংয়ের জন্য আজ রাতেই জেনিন শিবির ত্যাগ করবে। তাদের প্রথম টার্গেটই ছিলো ওই সমস্ত যুবক। কিন্তু অপারেশন শুরু হলে নারী শিশু আবাল বৃদ্ধা কেউ তাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি স্বপ্নের পুরুষকে বিদায় জানাতে আসা জাহরাও।সেনারা তাকে ঘাটিতে নিয়ে যাওয়ার পর নির্যাতনের কোন দিকই বাদ রাখেনি। পর দিন ভোরের প্রথম আলোয় শিবিরের অদূরে জাহরাকে বস্ত্রহীন মৃতপ্রায় অবস্থায় পরে থাকতে দেখে শিবিরের শরনার্থীরা।গত ছয় মাস ধরে জাহরা যে হসপিটালটায় সেবা দিয়ে আসছিলো, সেই রেড ক্রিসেন্টে হসপিটালেই তাকে ভর্তি করা হয়। বেডের ওপর জাহরা ছিন্নভিন্ন দেহ।সমস্ত শরীর রক্তে রাঙা। ঠোঁট দুটি থেঁতলে গিয়েছে।পুরো শরীরে একশত বিশটি কামড়ের দাগ।বুটজুতোর আঘাতে একটি চোখ ফুলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

সকাল বেলা কি একটা সংবাদ দিতে হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে জাহরার কাছে আসেন সোলাইমান সাহেব। এসে মেয়ের এহেন পরিস্থিতি দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ডাক্টার মারিয়াম জাহরার শিয়রে বসা।ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা।কিছু একটা হয়তো বলতে চায়,কিন্তু বলতে পারছেনা।ডাক্তার মারিয়াম জাহরার ঠোঁটের কাছে কান পাতেন,খুবই অস্পষ্ট স্বরে জাহরা বলতে লাগলো, মারিয়াম আপা আমার নামের অর্থ কি জানেন? মা আমাকে ফুলের মতো ভাবতো বলে আমার নামও রাখেন ফুল (জাহরা)। অথচ আমি সবসময়ই চেয়েছিলাম আমার বাবার দেওয়া নাম (মুনতাক্বিমা) প্রতিশোধ গ্রহণকারী যেন আমি হয়ে উঠি।কিন্তু এই জীবনে আমি তা পারলাম না।’ এতটুকু বলার পর আরো নিচু স্বরে ডাক্তার মারিয়ামকে ডাকলো। ডাক্তার মারিয়াম জাহরাকে বললো,তুমি বলো জাহরা,আমি শুনছি।

জাহরা তার ডান হাতটা উঠানোর চেষ্টা করলো।ডাক্তার মারিয়াম বিষয়টা বুঝতে পেরে জাহরার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতে গিয়ে দেখলো জাহরার মুঠের ভিতর একটা চিরকুট। চিরকুটটা নেওয়ার সময় জাহরা বলতে লাগলো ‘ এটা আমার পক্ষ থেকে ইয়াছির ভাইয়াকে পৌঁছে দিবেন আপা।

খুবই শক্ত মনমানসিকতার ডাক্তার মারিয়াম মুকাদ্দাসও তখন ডুকরে কেঁদে উঠলো।ওড়নায় মুখ ঢেকে কামরার বাহিরে এসে দাঁড়ালো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো কতক্ষণ। তারপর আস্তে করে চিরকুটটা খুললো।সেখানে মুক্তোর মত গুটিগুটি করে লেখা….

“এই অপেক্ষার প্রহর শীঘ্রই শেষ হবে
আমাদের আবারও দেখা হবে;
হয়তো স্বাধীন গাজায়……
নয়তো সবুজ সুন্দর জান্নাতে।”

ইতি
জাহরা

চিরকুটটা পড়তে পড়তে ডাক্তার মারিয়ামের চোখ বেয়ে পানি পরছে।ধীরপায়ে সে জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। সেখান থেকে বেডের উপর থাকা জাহরার দেহটা দেখা যাচ্ছে। ক্ষতবিক্ষত পুরো শরীর। রক্তে রক্তে লাল হয়ে আছে। এতটা বিধ্বস্ত হওয়ার পরও চেহারায় এক ধরনের মায়া,একরকম স্নিগ্ধতা ছেয়ে আছে যেন।ডাক্তার মারিয়ামের হঠাৎ মনে হলো,জাহরা মেয়েটা সত্যিই ফুলের মতো।
স্নিগ্ধ,
সুরভিত,
সুন্দর।
এসব ভাবতে ভাবতে জাহরার দেওয়া চিরকুটটার দিকে আবারো চোখ বুলায়। তারপর আনমনে বলতে থাকে, আমাকে ক্ষমা করো জাহরা।তোমার দেওয়া চিরকুটটি তোমার প্রিয় মানুষটার কাছে পৌঁছানো পৃথিবীর কারো পক্ষে আর সম্ভব না।তোমার চাচার দেওয়া খবর তোমাকে কি করে বলি,যে তোমার ইয়াছির গতকাল রাতেই ইসরাইলী সেনা কর্তৃক শহীদ হয়েছেন।

সর্ব্বশেষ প্রকাশিত